ভালো নেই ফুল চাষিরা

রফিকুল ইসলাম। ঢাকার অদূরে বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামে ফুল চাষ করেন তিনি। চলতি মৌসুমে তিনি প্রায় ৩ বিঘা জমিতে ফুল চাষ করেছিলেন। খরচ হয়েছিল প্রায় ২ লাখ টাকা। আশা ছিল, ফুল বিক্রি করে সেই ঢাকা তুলে আনবেন। কিন্তু তা আর হলো না। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে তার সব স্বপ্ন ভেঙে দিল। দেশে সর্বাত্মক লকডাউনে দুই সপ্তাহ ধরে ফুল বিক্রি করতে পারছেন না তিনি। দীর্ঘদিন গাছে থাকার কারণে ফুলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুধু গোলাপ গ্রামের রফিকুল ইসলামই নয়, সারাদেশের অসংখ্য ফুল চাষি লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, ‘কৃষক তাদের ফুল বিক্রি করতে পারছেন না। স্বাধীনতা দিবস ও পহেলা বৈশাখে ফুল বিক্রি করতে না পারায় চাষি ও ব্যবসায়ীদের অন্তত ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্য মতে, চলতি বছর ঝিকরগাছা উপজেলায় ২৭২ হেক্টর জমিতে গ্লাডিওলাস, ১৬৫ হেক্টর জমিতে রজনীগন্ধা, ১০৫ হেক্টর জমিতে গোলাপ, ৫৫ হেক্টর জমিতে গাঁদা, ২২ হেক্টর জমিতে জারবেরা ও অন্যান্য ফুল চাষ করা হয়েছে প্রায় ৬ হেক্টর জমিতে। ২০২০ সালের মার্চে দেশের করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ার পরপর দেশে লকডাউন শুরু হয়। এতে ফুল বিক্রিতে ধস নামায় জেলার ফুল চাষিদের ব্যাপক লোকসান হয়েছিল। ফুল বিক্রি করতে না পারায় ফুলক্ষেত গরু ও ছাগল দিয়ে খাওয়াতে হয়েছিল।

করোনার প্রভাব কিছুটা কমে আসার পর আবার চাষিরা নতুন করে ফুলের চাষ শুরু করেন। সেই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার স্বপ্ন নিয়ে ফুল বিক্রি শুরুও করেছিলেন। কিন্তু এবার করোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ে সরকারের বিধিনিষেধের কারণে ফুল চাষিদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। সর্বাত্মক বিধিনিষেধে চাষিরা ফুল বিক্রি করতে পারছেন না। আবার ক্ষেতেও ফুল রাখতে পারছেন না। ফুল ক্ষেত থেকে তুলতে দিতে হচ্ছে শ্রমিকদের মজুরি।

ঝিকরগাছার হাঁড়িয়া গ্রামের চাষি শাহাজান আলী বলেন, ‘এ বছর ১৫ বিঘা জমিতে গোলাপ, জবা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস ও জারবেরা চাষ করে ব্যাপক লোকসানে পড়েছি। ফুল না তুললে নতুন করে আর কুঁড়ি আসে না। তাই গোলাপ ফুল কেটে ছাগল ও গরু দিয়ে খাওয়াতে হচ্ছে। ক্ষেতে সবেমাত্র ফুল ওঠা শুরু করেছিল।’

সপ্তাহে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার ফুল বিক্রিও করছিলেন তারা। এভাবেই আরও তিন মাস ফুল বিক্রি করা গেলে চলতি বছরের সব খরচ ওঠে ঘুরে দাঁড়াতে পারতেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই চাষি, পাইকার, মজুরের হাঁকডাকে মুখর হয়ে ওঠতো যশোর ও বেনাপোল মহাসড়কের পাশে ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিত গদখালী বাজার। দূর-দূরান্ত থেকে ফুল কিনতে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আসতেন। সকাল থেকেই বিভিন্ন রুটের বাসের ছাদে সাজানো হতো ফুল। পাঠানো হতো দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে ফুল ভর্তি করে ছুটে চলতো ট্রাক ও পিকআপভ্যান। সর্বাত্মক বিধি নিষেধের কারণে এখন সেটা হচ্ছে না। ফলে ফুল চাষিরা পড়েছেন বিপাকে। এদিকে ফুল তুলে ফেলে না দিলে গাছ মরে যাচ্ছে। একবার ক্ষেতের গাছ থেকে ফুল তুলে ফেলে দিতে খরচ হয় প্রায় চার হাজার টাকা। সপ্তাহে একবার ক্ষেত থেকে ফুল তুলে ফেলে দিতে হচ্ছে। কবে ফুলের বাজার শুরু হবে তাও অনিশ্চিত। পকেটের টাকা খরচ করে এভাবে ফুলগাছ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব না।’ তাই বাধ্য হয়ে এখন ফুল গাছ তুলে ফেলে দিতে হচ্ছে বলেও জানান গদখালীর ফুল চাষিরা।

ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ জানান, করোনাভাইরাসের কারণে ফুলচাষিরা বিপদে পড়েছেন। তারা ফুল বিক্রি করতে পারছেন না। আবার ক্ষেতে ফুল রাখতেও পারছেন না। বাধ্য হয়ে গরু ও ছাগল দিয়ে ফুল খাওয়াচ্ছেন। অনেকে ফুল তুলে দিচ্ছে। ফুলচাষ দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখলেও দ্রুতত পচনশীল হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছে এ অঞ্চলের কৃষকরা।

এদিকে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম আরও বলেন, ‘গদখালীর ছয় হাজার কৃষক তাদের ফুল বিক্রি করতে পারছেন না। সবজির মতো ফুলের পাইকারি বাজারগুলো খোলা রাখার অনুমতি দিলে ফুলচাষিরা কষ্ট করে হলেও বাঁচতে পারতাম।’

রবিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২১ , ১২ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমজান ১৪৪২

ভালো নেই ফুল চাষিরা

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

image

রফিকুল ইসলাম। ঢাকার অদূরে বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামে ফুল চাষ করেন তিনি। চলতি মৌসুমে তিনি প্রায় ৩ বিঘা জমিতে ফুল চাষ করেছিলেন। খরচ হয়েছিল প্রায় ২ লাখ টাকা। আশা ছিল, ফুল বিক্রি করে সেই ঢাকা তুলে আনবেন। কিন্তু তা আর হলো না। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে তার সব স্বপ্ন ভেঙে দিল। দেশে সর্বাত্মক লকডাউনে দুই সপ্তাহ ধরে ফুল বিক্রি করতে পারছেন না তিনি। দীর্ঘদিন গাছে থাকার কারণে ফুলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুধু গোলাপ গ্রামের রফিকুল ইসলামই নয়, সারাদেশের অসংখ্য ফুল চাষি লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, ‘কৃষক তাদের ফুল বিক্রি করতে পারছেন না। স্বাধীনতা দিবস ও পহেলা বৈশাখে ফুল বিক্রি করতে না পারায় চাষি ও ব্যবসায়ীদের অন্তত ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্য মতে, চলতি বছর ঝিকরগাছা উপজেলায় ২৭২ হেক্টর জমিতে গ্লাডিওলাস, ১৬৫ হেক্টর জমিতে রজনীগন্ধা, ১০৫ হেক্টর জমিতে গোলাপ, ৫৫ হেক্টর জমিতে গাঁদা, ২২ হেক্টর জমিতে জারবেরা ও অন্যান্য ফুল চাষ করা হয়েছে প্রায় ৬ হেক্টর জমিতে। ২০২০ সালের মার্চে দেশের করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ার পরপর দেশে লকডাউন শুরু হয়। এতে ফুল বিক্রিতে ধস নামায় জেলার ফুল চাষিদের ব্যাপক লোকসান হয়েছিল। ফুল বিক্রি করতে না পারায় ফুলক্ষেত গরু ও ছাগল দিয়ে খাওয়াতে হয়েছিল।

করোনার প্রভাব কিছুটা কমে আসার পর আবার চাষিরা নতুন করে ফুলের চাষ শুরু করেন। সেই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার স্বপ্ন নিয়ে ফুল বিক্রি শুরুও করেছিলেন। কিন্তু এবার করোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ে সরকারের বিধিনিষেধের কারণে ফুল চাষিদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। সর্বাত্মক বিধিনিষেধে চাষিরা ফুল বিক্রি করতে পারছেন না। আবার ক্ষেতেও ফুল রাখতে পারছেন না। ফুল ক্ষেত থেকে তুলতে দিতে হচ্ছে শ্রমিকদের মজুরি।

ঝিকরগাছার হাঁড়িয়া গ্রামের চাষি শাহাজান আলী বলেন, ‘এ বছর ১৫ বিঘা জমিতে গোলাপ, জবা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস ও জারবেরা চাষ করে ব্যাপক লোকসানে পড়েছি। ফুল না তুললে নতুন করে আর কুঁড়ি আসে না। তাই গোলাপ ফুল কেটে ছাগল ও গরু দিয়ে খাওয়াতে হচ্ছে। ক্ষেতে সবেমাত্র ফুল ওঠা শুরু করেছিল।’

সপ্তাহে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার ফুল বিক্রিও করছিলেন তারা। এভাবেই আরও তিন মাস ফুল বিক্রি করা গেলে চলতি বছরের সব খরচ ওঠে ঘুরে দাঁড়াতে পারতেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই চাষি, পাইকার, মজুরের হাঁকডাকে মুখর হয়ে ওঠতো যশোর ও বেনাপোল মহাসড়কের পাশে ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিত গদখালী বাজার। দূর-দূরান্ত থেকে ফুল কিনতে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আসতেন। সকাল থেকেই বিভিন্ন রুটের বাসের ছাদে সাজানো হতো ফুল। পাঠানো হতো দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে ফুল ভর্তি করে ছুটে চলতো ট্রাক ও পিকআপভ্যান। সর্বাত্মক বিধি নিষেধের কারণে এখন সেটা হচ্ছে না। ফলে ফুল চাষিরা পড়েছেন বিপাকে। এদিকে ফুল তুলে ফেলে না দিলে গাছ মরে যাচ্ছে। একবার ক্ষেতের গাছ থেকে ফুল তুলে ফেলে দিতে খরচ হয় প্রায় চার হাজার টাকা। সপ্তাহে একবার ক্ষেত থেকে ফুল তুলে ফেলে দিতে হচ্ছে। কবে ফুলের বাজার শুরু হবে তাও অনিশ্চিত। পকেটের টাকা খরচ করে এভাবে ফুলগাছ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব না।’ তাই বাধ্য হয়ে এখন ফুল গাছ তুলে ফেলে দিতে হচ্ছে বলেও জানান গদখালীর ফুল চাষিরা।

ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ জানান, করোনাভাইরাসের কারণে ফুলচাষিরা বিপদে পড়েছেন। তারা ফুল বিক্রি করতে পারছেন না। আবার ক্ষেতে ফুল রাখতেও পারছেন না। বাধ্য হয়ে গরু ও ছাগল দিয়ে ফুল খাওয়াচ্ছেন। অনেকে ফুল তুলে দিচ্ছে। ফুলচাষ দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখলেও দ্রুতত পচনশীল হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছে এ অঞ্চলের কৃষকরা।

এদিকে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম আরও বলেন, ‘গদখালীর ছয় হাজার কৃষক তাদের ফুল বিক্রি করতে পারছেন না। সবজির মতো ফুলের পাইকারি বাজারগুলো খোলা রাখার অনুমতি দিলে ফুলচাষিরা কষ্ট করে হলেও বাঁচতে পারতাম।’