বোর ধান কাটা শুরু

আবাহমান কাল হতে বাঙালীর ঘরে ঘরে প্রচলিত পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ বরণের নানা উৎসবের মধ্যে যোগ হতো মাঠে মাঠে কৃষাণের সোনালী বোর ধান কাটা আর নবান্নের মহা উৎসব। নববর্ষের নবান্নে ভরে উঠতো কৃষাণ কৃষাণির লক্ষীর ভা-ার আর রহমতের গোলা। দেশে বিরাজমান মহামারী করোনার কারণে সকল উৎসব যেন ঘা ঢাকা দিয়েছে। তবু বেঁচে থাকার অবলম্বন কৃষকের খেতের ধান যা না কাটলে উপায় নেই। চলমান লকডাউনে যান বাহন বন্ধ থাকায় শ্রমিক না পেয়ে ধান কাটা নিয়ে মহা সংকটে রয়েছেন কৃষকরা। পাকা ধান সময়মত কাটতে না পারলে শিলা ঝড়ে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় কৃষকরা ভীতির মধ্যে রয়েছেন। অগত্যা নিজেরাই স্থানীয় অল্প সংখক শ্রমিক নিয়ে অনেকে বোর ধান কেটে বাড়িতে আনছেন। ভালুকার মাঠে মাঠে পাকা সোনালী রংয়ের বোর ধান মাড়াইয়ে ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছেন পাড়া গ্রামের কৃষান কৃষানিরা। নতুন ধান ঘরে তুলতে উৎসবমুখর প্রতিটি হিন্দু-মুসলিম বাড়ির উঠান মুখরিত হয় মুড়ি হতে ধান ছড়ানো, গরুর মলন, খড় ছাড়ানো, আর কুলা দিয়ে শুকনা পাতা উড়িয়ে ঝকঝকে ধান খাদায় ভরে গোলার ডোলায় তোলা। এ সময় নতুন ধানের গন্ধ পেয়ে গাঁয়ের পথে বেড়ে যায় ফেরিওয়ালা, মিষ্টি ওয়ালা আর ফিতা চুরি ওয়ালাদের ভিড়। শশুর শাশুড়ি বাবা মা’র চোখ ফাকি দিয়ে কৃষাণ ঝি-বউরা যুক্তি করে একখাদি ধান নিয়ে সটকে পরেন। আর সেই ধানে পছন্দ মতো চুলের ফিতা, আলতা সনো, রঙ্গিন কাঁচের চুরি, আর রসনা মিটাতে লাল জিলিপি কিনে ননদ ভাবি চুপি চুপি ঘরের কোনে। বোর ধান ঘরে তোলা মানেই কৃষকের ঘর হাসি খুশি সুখ শান্তির পরশ নেমে আসা। সবার আগে নতুন ধানের চালে ক্ষীর পায়েশ মসজিদের মুসল্লিদের খাওয়ানো আর মন্দিরে ঠাকুর দেবতার উদ্দেশ্যে ভোগ পরিবেশনের মাধ্যমে অন্ন গ্রহণ ছিল বাঙলী হিন্দু-মুসলিম কৃষাণ পরিবার গুলির বহমান চিরায়ত প্রথা। যা এখন বিলুপ্ত প্রায়।

২০ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকেলে ভালুকার হবিরবাড়ী আমতলী গ্রামে বোরো ধান কাটছিলেন একদল শ্রমিক কৃষক আব্দুর রাজ্জাক মিয়ার ক্ষেতে। রাজ্জাক মিয়া জানান এ বছর ৩ বিঘা জমিতে ব্রি-ধান ৮১ ও আড়াই বিঘা জমিতে বাঁশমতি জাতের ধান চাষ করেছেন। তিনি প্রতি বিঘা জমি ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করা বাবদ ১২০০ টাকা, ধান লাগানো ১৫০০ টাকা,সার,কীটনাশক, ও ঘাস বাছা বাবদ ১৫০০ টাকা, পানি সেচ ১৫০০ টাকা খরচ করেছেন। বর্তমানে পাকাধান কাটা ও মাড়াই বাবদ শ্রমিকদের প্রতি বিঘা ৩৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে। প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ২২ মণ ধান পাবেন বলে তিনি আশাবাদী। ধান রোপন হতে শুরু করে পাকা পর্যন্ত কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে ক্ষেত পরিচর্যা করায় তিনি ভাল ফলন পেয়েছেন। বর্তমানে ১০০০ টাকা মণ দরে বাজারে ধান বিক্রি করতে পারায় তিনি বেজায় খুশি। হবিরবাড়ী ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে হবিরবাড়ী ব্লকে ৪২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। তিনি জানান ব্রিধান ৮১ উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ বাঁশমতি চালের আকৃতি দেশীয় বাজারে জিরা ধানের বিকল্প হিসেবে গণ্য বিদেশে রপ্তানি যোগ্য। এ ধানের জীবনকাল ১৪০ দিন। উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে চলতি মৌসুমে ভালুকায় ১৭ হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমিতে বোর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও অর্জিত হয়েছে ১৮ হাজার ৭১০ হেক্টর। এর মধ্যে হাইব্রিড লক্ষমাত্রা ৫১০ হেক্টর অর্জিত ১২০০ হেক্টর, উফসি লক্ষ্যমাত্রা ১৭৩৭৫ হেক্টর অর্জিত ১৭৫০০ হেক্টর, স্থানীয় জাত ১০ হেক্টর। তবে ধানের পরাগায়ন সময়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি হওয়ায় কিছু কিছু এলাকায় চিটা হয়ে ধানের ক্ষতি হয়েছে যার পরিমান ১৫০ হেক্টরের মতো। তার পরও বোর আবাদে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে অনেক বেশি আবাদ হয়েছে।

রবিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২১ , ১২ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমজান ১৪৪২

বোর ধান কাটা শুরু

প্রতিনিধি, ভালুকা (ময়মনসিংহ)

আবাহমান কাল হতে বাঙালীর ঘরে ঘরে প্রচলিত পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ বরণের নানা উৎসবের মধ্যে যোগ হতো মাঠে মাঠে কৃষাণের সোনালী বোর ধান কাটা আর নবান্নের মহা উৎসব। নববর্ষের নবান্নে ভরে উঠতো কৃষাণ কৃষাণির লক্ষীর ভা-ার আর রহমতের গোলা। দেশে বিরাজমান মহামারী করোনার কারণে সকল উৎসব যেন ঘা ঢাকা দিয়েছে। তবু বেঁচে থাকার অবলম্বন কৃষকের খেতের ধান যা না কাটলে উপায় নেই। চলমান লকডাউনে যান বাহন বন্ধ থাকায় শ্রমিক না পেয়ে ধান কাটা নিয়ে মহা সংকটে রয়েছেন কৃষকরা। পাকা ধান সময়মত কাটতে না পারলে শিলা ঝড়ে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় কৃষকরা ভীতির মধ্যে রয়েছেন। অগত্যা নিজেরাই স্থানীয় অল্প সংখক শ্রমিক নিয়ে অনেকে বোর ধান কেটে বাড়িতে আনছেন। ভালুকার মাঠে মাঠে পাকা সোনালী রংয়ের বোর ধান মাড়াইয়ে ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছেন পাড়া গ্রামের কৃষান কৃষানিরা। নতুন ধান ঘরে তুলতে উৎসবমুখর প্রতিটি হিন্দু-মুসলিম বাড়ির উঠান মুখরিত হয় মুড়ি হতে ধান ছড়ানো, গরুর মলন, খড় ছাড়ানো, আর কুলা দিয়ে শুকনা পাতা উড়িয়ে ঝকঝকে ধান খাদায় ভরে গোলার ডোলায় তোলা। এ সময় নতুন ধানের গন্ধ পেয়ে গাঁয়ের পথে বেড়ে যায় ফেরিওয়ালা, মিষ্টি ওয়ালা আর ফিতা চুরি ওয়ালাদের ভিড়। শশুর শাশুড়ি বাবা মা’র চোখ ফাকি দিয়ে কৃষাণ ঝি-বউরা যুক্তি করে একখাদি ধান নিয়ে সটকে পরেন। আর সেই ধানে পছন্দ মতো চুলের ফিতা, আলতা সনো, রঙ্গিন কাঁচের চুরি, আর রসনা মিটাতে লাল জিলিপি কিনে ননদ ভাবি চুপি চুপি ঘরের কোনে। বোর ধান ঘরে তোলা মানেই কৃষকের ঘর হাসি খুশি সুখ শান্তির পরশ নেমে আসা। সবার আগে নতুন ধানের চালে ক্ষীর পায়েশ মসজিদের মুসল্লিদের খাওয়ানো আর মন্দিরে ঠাকুর দেবতার উদ্দেশ্যে ভোগ পরিবেশনের মাধ্যমে অন্ন গ্রহণ ছিল বাঙলী হিন্দু-মুসলিম কৃষাণ পরিবার গুলির বহমান চিরায়ত প্রথা। যা এখন বিলুপ্ত প্রায়।

২০ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকেলে ভালুকার হবিরবাড়ী আমতলী গ্রামে বোরো ধান কাটছিলেন একদল শ্রমিক কৃষক আব্দুর রাজ্জাক মিয়ার ক্ষেতে। রাজ্জাক মিয়া জানান এ বছর ৩ বিঘা জমিতে ব্রি-ধান ৮১ ও আড়াই বিঘা জমিতে বাঁশমতি জাতের ধান চাষ করেছেন। তিনি প্রতি বিঘা জমি ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করা বাবদ ১২০০ টাকা, ধান লাগানো ১৫০০ টাকা,সার,কীটনাশক, ও ঘাস বাছা বাবদ ১৫০০ টাকা, পানি সেচ ১৫০০ টাকা খরচ করেছেন। বর্তমানে পাকাধান কাটা ও মাড়াই বাবদ শ্রমিকদের প্রতি বিঘা ৩৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে। প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ২২ মণ ধান পাবেন বলে তিনি আশাবাদী। ধান রোপন হতে শুরু করে পাকা পর্যন্ত কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে ক্ষেত পরিচর্যা করায় তিনি ভাল ফলন পেয়েছেন। বর্তমানে ১০০০ টাকা মণ দরে বাজারে ধান বিক্রি করতে পারায় তিনি বেজায় খুশি। হবিরবাড়ী ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে হবিরবাড়ী ব্লকে ৪২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। তিনি জানান ব্রিধান ৮১ উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ বাঁশমতি চালের আকৃতি দেশীয় বাজারে জিরা ধানের বিকল্প হিসেবে গণ্য বিদেশে রপ্তানি যোগ্য। এ ধানের জীবনকাল ১৪০ দিন। উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে চলতি মৌসুমে ভালুকায় ১৭ হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমিতে বোর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও অর্জিত হয়েছে ১৮ হাজার ৭১০ হেক্টর। এর মধ্যে হাইব্রিড লক্ষমাত্রা ৫১০ হেক্টর অর্জিত ১২০০ হেক্টর, উফসি লক্ষ্যমাত্রা ১৭৩৭৫ হেক্টর অর্জিত ১৭৫০০ হেক্টর, স্থানীয় জাত ১০ হেক্টর। তবে ধানের পরাগায়ন সময়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি হওয়ায় কিছু কিছু এলাকায় চিটা হয়ে ধানের ক্ষতি হয়েছে যার পরিমান ১৫০ হেক্টরের মতো। তার পরও বোর আবাদে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে অনেক বেশি আবাদ হয়েছে।