রাশিয়ার ‘স্পুটনিক’ চীনের ‘সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম’ টিকা ব্যবহারের উদ্যোগ বাংলাদেশের

অনুমোদনে কোন বাধা নেই : রোগ বিশেষজ্ঞ

এখন পর্যন্ত ‘ডব্লিউএইচও’ এবং ইউরোপীয় ৮ দেশের জোটের অনুমোদন পায়নিÑ এমন কোন টিকা ব্যবহার করেনি বাংলাদেশ। ডব্লিউএইচও’র অনুমোদনের অপেক্ষায় না থেকে এবার করোনাভাইরাসের টিকা রাশিয়ার ‘স্পুটনিক ভি’ এবং চীনের ‘সিনোভ্যাক’ ও ‘সিনোফার্ম’ টিকা ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে আইনী জটিলতার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। তবে সরকারি উদ্যোগে টিকা আমদানি করা হলে ‘আইনি জটিলতা’র সুযোগ নেই। সরকার ইচ্ছে করলে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন ছাড়াই টিকা আমদানি করতে পারে এবং টিকাদান কর্মসূচি চালাতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা।

কর্মকর্তা আরও জানান, এতদিন বাংলাদেশের একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল; যেটিকে রেওয়াজ বলা হয়। সেটি হলো- যেসব টিকা ডব্লিউএইচও’র অনুমোদন পেয়েছে সে টিকাই ব্যবহার করা হবে। কোন কারণে ডব্লিউএইচ’র অনুমোদনের অপেক্ষা থাকা সম্ভব না হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৮ দেশের জোটের অনুমোদিত টিকাও ব্যবহার করা যাবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক প্রফেসর ডা. বেনজির আহমেদ সংবাদকে বলেছেন, ‘সরকার ইচ্ছে করলে, বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন থাক বা না থাক যে কোন টিকাই ব্যবহার করতে পারবে। এটা লাগে কখন, যখন কোন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা টিকা চায় অথবা আমেরিকা যদি টাকা (টিকাদানের জন্য) দিতে চাই, তখন তারা শর্তারোপ করে থাকে যে, ওই টিকা ডব্লিউএইচও’র অনুমোদিত হতে হবে কিন্তু সরকার কিনতে চাইলে অনুমোদনের কোন বাধা নেই।’

বর্তমানে দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র উদ্ভাবিত করোনার টিকা দেয়া হচ্ছে, যা উৎপাদন হচ্ছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে। সেরাম থেকে তিন কোটি ডোজ টিকা কিনতে গত বছরের নভেম্বরে চুক্তি করে বাংলাদেশ। বেক্সিমকো ফার্মা ওই টিকা সংরক্ষণ ও সরবরাহের কাজ পেয়েছে।

কিন্তু ভারত সরকার টিকা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় সেরাম ইনস্টিটিউট এখন টিকা দিতে পারছে না। এতে বাংলাদেশের টিকা কর্মসূচি মাঝপথে থেমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই অনিশ্চয়তা কাটাতে বাংলাদেশ বিকল্প হিসেবে রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা করছে। রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা পেতে ইতোমধ্যে সরকার প্রাথমিকভাবে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। দেশটি নিজেদের ‘স্পুটনিক ভি’র প্রযুক্তি সরবরাহের আশ^াস দিয়েছে। দেশে উৎপাদন করা হলে স্পুটনিক ভি এবং সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম’র টিকা দামেও সাশ্রয়ী হবে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র টিকার চেয়েও খরচ কম হতে পারে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

খ্যাতিমান জনস্বাস্থ্যবিদ ড. মুশতাক হোসেন সংবাদকে জানিয়েছেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং স্পুটনিক ভি-প্রায় একই রকম টিকা। দুটির প্রযুক্তিও প্রায় একই রকম, সহজ। অন্য একটি ভাইরাসের মধ্যে করোনাভাইরাসের পাইক প্রোটিন ঢুকিয়ে দিয়ে সেটা শরীরে ঢোকানো হয়। এরপর অ্যান্টিজেন তৈরি হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের জানান, এর আগে রাশিয়া ও চীন থেকে টিকা আনার চেষ্টা করা হলেও সেগুলোর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন না থাকায় পিছিয়ে এসেছিল সরকার। এখন সে অবস্থান পাল্টেছে।

এ প্রসঙ্গে ড. মোমেন বলেন, ‘চীন বলছে, আমাদের ভ্যাকসিন ডব্লিউএইচও কখন অনুমোদন দেবে আমরা জানি না। তবে এটা ১০০ মিলিয়নের বেশি লোক ব্যবহার করেছে; ৮০টা দেশে আমরা রপ্তানি করেছি। ৬৩ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এটা গ্রহণ করেছেন। কারও কোন অসুবিধা হয় নাই, এটাই একটা প্রমাণ। আবার যেসব দেশ টিকা নিয়ে গেছে, ডব্লিউএইচও তাতে কিছু মনে করেনি।’

চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত করোনার টিকা ‘সিনোভ্যাক’ এবং ‘সিনোফার্ম’ সংগ্রহের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। দুটি টিকাই করোনা প্রতিরোধে কার্যকর বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। এই দুটি টিকা এখন পর্যন্ত চীনের ১২ কোটির বেশি নাগরিককে দেয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে সরকারের রোগ তত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম-দুটি টিকাই ভালো; বাংলাদেশ দুটিই পাওয়ার চেষ্টা করছে। চীন ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাসহ অনেক দেশেই এই টিকা দেয়া হচ্ছে। খারাপ হলে এত দেশে টিকা চলত না। আমরাও এগুলোর কোন খারাপ খবর পায়নি।’

চীনের এই দুটি টিকার প্রযুক্তি একই জানিয়ে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক বলেন, ‘টিকা তৈরির ট্র্যাডিশনাল যে পদ্ধতি, তারা যেভাবেই করোনার টিকা তৈরি করেছেন। তাদের ফর্মুলা, প্রযুক্তি ও কাঁচামাল পেলে খুব সহজে দেশেই এই টিকা উৎপাদন করা যাবে। টিকা তৈরির কাঁচামাল চীনসহ অন্য দেশ থেকেও আমদানি করা যায়।’

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজমুল হাসান পাপন গতকাল ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনা ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার পর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ওয়ার্ল্ড মার্কেটে চারটি ভ্যাকসিন আছে যেগুলো অ্যাপ্রুভড। ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন, মর্ডানা ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা আর কোনটা অ্যাপ্রুভালের আগে আনা সম্ভব না।’

সহ-উৎপাদন ব্যবস্থার আওতায় দেশের স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় রাশিয়া তাদের ‘স্পুটনিক ভি’ উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশকে। এ তথ্য জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী বিপুল চাহিদার প্রেক্ষিতে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ভ্যাকসিনটি রপ্তানি করার মতো পর্যাপ্ত উৎপাদন সক্ষমতা না থাকায় মস্কো বাংলাদেশে ভ্যাকসিনটি উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে।

প্রস্তাব অনুযায়ী রাশিয়া প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, ‘আর দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ‘স্পুটনিক ভি’ উৎপাদন করবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে- এটা তুলনামূলক সাশ্রয়ী হবে এবং আশা করা যায় যে, এটা অপেক্ষাকৃত ভালো হবে।

দেশের টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা কতটুকু

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, দেশের তিন-চারটি ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানের টিকা উৎপাদনের অবকাঠামো ও সক্ষমতা রয়েছে কিন্তু টিকা উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি করতে হবে; এটি এখন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

এ ব্যাপারে ‘আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ড. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর যে সক্ষমতা তা দিয়ে কোটি কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন সম্ভব নয়। এজন্যই হয়তো সরকার এখন একাধিক দেশ থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা করছে। আবার টিকার কাঁচামালও আমদানি করতে হয়। এগুলোও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে একাধিক উৎস থেকে টিকা পাওয়া গেলে আমাদের চাহিদা পূরণ সম্ভব।’

‘স্পুটনিক ভি’ টিকার বিষয়ে ড. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘স্পুটনিক ভি ভালো টিকা। এটা অক্সফোর্ডের টিকার মতোই। চীনের সিনোফার্মার ‘সিনোভ্যাক’ টিকাও ভালো। এগুলোর সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও কার্যকারিতাও ভালো প্রমাণিত।’

স্পুটনিক ভি’র কার্যকারিতা

রাশিয়ার উদ্ভাবিত টিকা ‘স্পুটনিক ভি’ কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্রায় ৯২ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে বলে জানিয়েছে ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ ‘দ্য ল্যানসেট’র গবেষণা জার্নাল। এই জার্নালটির চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যু থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয়।

যুক্তরাজ্যের প্রস্তুত করা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং বেলজিয়ামে উদ্ভাবন করা জ্যানসেনের টিকা যেভাবে কাজ করে সেই একইভাবে কাজ করে রাশিয়ার স্পুটনিক ভ্যাকসিন। কোল্ড-টাইপ ভাইরাস ব্যবহার করে এটি করোনাভাইরাসের শরীরে ছোট একটি টুকরা ঢুকিয়ে দেয়। টিকা নেয়ার পর শরীর করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি উৎপাদন শুরু করে দেয়।

স্পুটনিক ভ্যাকসিনটি ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মজুদ করা যায়। এর ফলে এটি সহজে পরিবহন এবং মজুদ করা যায়। সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার থাকলেও সেগুলো হাতে ব্যথা, ক্লান্তি এবং সামান্য তাপমাত্রা বাড়ার মতো সাধারণ বিষয়। ভ্যাকসিন গ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে মৃত্যু এবং মারাত্মক অসুস্থতার কোন বিষয় নেই।

রাশিয়া ছাড়াও বিশে^র ২০টির বেশি দেশ স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনটির গণপ্রয়োগ শুরু করেছে। আর্জেন্টিনা, ফিলিস্তিনি অঞ্চল, ভেনেজুয়েলা, বেলারুশ, হাঙ্গেরি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান প্রমুখ দেশে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ চলছে। এছাড়াও ভারত, ইউরোপের একাধিক দেশ, লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে ‘স্পুটনিক ভি’ ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে দেশগুলোর সরকার।

দ্য ল্যানসেটের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘স্পুটনিক ভি’ ভ্যাকসিন প্রস্তুতে বৈজ্ঞানিক মূলনীতি প্রতিফলিত হয়েছে। ভ্যাকসিনটি সব বয়সী মানুষের ওপরই ভালো প্রভাব দেখিয়েছে এবং মারাত্মক অসুস্থতার ঝুঁকি কমিয়েছে।

চীনের ‘সিনোভ্যাক’ ও ‘সিনোফার্ম’

চীনের ‘জাতীয় চিকিৎসা পণ্য প্রশাসন’ সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য তাদের করোনাভাইরাস টিকা অনুমোদন করেছে বলে জানিয়েছে ‘সিনোভ্যাক বায়োটেক’। তাদের বেইজিংভিত্তিক ইউনিট সিনোভ্যাক লাইফ সায়েন্স প্রতি বছর একশ’ কোটিরও বেশি টিকা উৎপাদন করতে পারবে বলে আশা করছে। এই টিকাটির কার্যকারিতা ৫৩ শতাংশ বলে সম্প্রতি ব্রাজিলের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে প্রমাণ হয়েছে।

সিনোভ্যাক জানিয়েছে, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া, উরুগুয়ে ও লাওস সিনোভ্যাক লাইফ সায়েন্সের উৎপাদিত টিকা ব্যবহার করছে।

এদিকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ওষুধ কোম্পানি চায়না ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপের (সিনোফার্ম) অধীনস্ত বেইজিং বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্ট ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত টিকাটি ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ কার্যকর বলে দাবি করা হয়েছে।

চীন সরকার এখন পর্যন্ত তিনটি টিকা নিজেদের নাগরিকদের ব্যবহার অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেয়া হচ্ছে ‘সিনোভ্যাক’ ও ‘সিনোফার্ম’র টিকা।

রবিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২১ , ১২ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমজান ১৪৪২

রাশিয়ার ‘স্পুটনিক’ চীনের ‘সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম’ টিকা ব্যবহারের উদ্যোগ বাংলাদেশের

অনুমোদনে কোন বাধা নেই : রোগ বিশেষজ্ঞ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

এখন পর্যন্ত ‘ডব্লিউএইচও’ এবং ইউরোপীয় ৮ দেশের জোটের অনুমোদন পায়নিÑ এমন কোন টিকা ব্যবহার করেনি বাংলাদেশ। ডব্লিউএইচও’র অনুমোদনের অপেক্ষায় না থেকে এবার করোনাভাইরাসের টিকা রাশিয়ার ‘স্পুটনিক ভি’ এবং চীনের ‘সিনোভ্যাক’ ও ‘সিনোফার্ম’ টিকা ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে আইনী জটিলতার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। তবে সরকারি উদ্যোগে টিকা আমদানি করা হলে ‘আইনি জটিলতা’র সুযোগ নেই। সরকার ইচ্ছে করলে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন ছাড়াই টিকা আমদানি করতে পারে এবং টিকাদান কর্মসূচি চালাতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা।

কর্মকর্তা আরও জানান, এতদিন বাংলাদেশের একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল; যেটিকে রেওয়াজ বলা হয়। সেটি হলো- যেসব টিকা ডব্লিউএইচও’র অনুমোদন পেয়েছে সে টিকাই ব্যবহার করা হবে। কোন কারণে ডব্লিউএইচ’র অনুমোদনের অপেক্ষা থাকা সম্ভব না হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৮ দেশের জোটের অনুমোদিত টিকাও ব্যবহার করা যাবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক প্রফেসর ডা. বেনজির আহমেদ সংবাদকে বলেছেন, ‘সরকার ইচ্ছে করলে, বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন থাক বা না থাক যে কোন টিকাই ব্যবহার করতে পারবে। এটা লাগে কখন, যখন কোন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা টিকা চায় অথবা আমেরিকা যদি টাকা (টিকাদানের জন্য) দিতে চাই, তখন তারা শর্তারোপ করে থাকে যে, ওই টিকা ডব্লিউএইচও’র অনুমোদিত হতে হবে কিন্তু সরকার কিনতে চাইলে অনুমোদনের কোন বাধা নেই।’

বর্তমানে দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র উদ্ভাবিত করোনার টিকা দেয়া হচ্ছে, যা উৎপাদন হচ্ছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে। সেরাম থেকে তিন কোটি ডোজ টিকা কিনতে গত বছরের নভেম্বরে চুক্তি করে বাংলাদেশ। বেক্সিমকো ফার্মা ওই টিকা সংরক্ষণ ও সরবরাহের কাজ পেয়েছে।

কিন্তু ভারত সরকার টিকা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় সেরাম ইনস্টিটিউট এখন টিকা দিতে পারছে না। এতে বাংলাদেশের টিকা কর্মসূচি মাঝপথে থেমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই অনিশ্চয়তা কাটাতে বাংলাদেশ বিকল্প হিসেবে রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা করছে। রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা পেতে ইতোমধ্যে সরকার প্রাথমিকভাবে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। দেশটি নিজেদের ‘স্পুটনিক ভি’র প্রযুক্তি সরবরাহের আশ^াস দিয়েছে। দেশে উৎপাদন করা হলে স্পুটনিক ভি এবং সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম’র টিকা দামেও সাশ্রয়ী হবে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র টিকার চেয়েও খরচ কম হতে পারে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

খ্যাতিমান জনস্বাস্থ্যবিদ ড. মুশতাক হোসেন সংবাদকে জানিয়েছেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং স্পুটনিক ভি-প্রায় একই রকম টিকা। দুটির প্রযুক্তিও প্রায় একই রকম, সহজ। অন্য একটি ভাইরাসের মধ্যে করোনাভাইরাসের পাইক প্রোটিন ঢুকিয়ে দিয়ে সেটা শরীরে ঢোকানো হয়। এরপর অ্যান্টিজেন তৈরি হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের জানান, এর আগে রাশিয়া ও চীন থেকে টিকা আনার চেষ্টা করা হলেও সেগুলোর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন না থাকায় পিছিয়ে এসেছিল সরকার। এখন সে অবস্থান পাল্টেছে।

এ প্রসঙ্গে ড. মোমেন বলেন, ‘চীন বলছে, আমাদের ভ্যাকসিন ডব্লিউএইচও কখন অনুমোদন দেবে আমরা জানি না। তবে এটা ১০০ মিলিয়নের বেশি লোক ব্যবহার করেছে; ৮০টা দেশে আমরা রপ্তানি করেছি। ৬৩ দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এটা গ্রহণ করেছেন। কারও কোন অসুবিধা হয় নাই, এটাই একটা প্রমাণ। আবার যেসব দেশ টিকা নিয়ে গেছে, ডব্লিউএইচও তাতে কিছু মনে করেনি।’

চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত করোনার টিকা ‘সিনোভ্যাক’ এবং ‘সিনোফার্ম’ সংগ্রহের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। দুটি টিকাই করোনা প্রতিরোধে কার্যকর বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। এই দুটি টিকা এখন পর্যন্ত চীনের ১২ কোটির বেশি নাগরিককে দেয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে সরকারের রোগ তত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম-দুটি টিকাই ভালো; বাংলাদেশ দুটিই পাওয়ার চেষ্টা করছে। চীন ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাসহ অনেক দেশেই এই টিকা দেয়া হচ্ছে। খারাপ হলে এত দেশে টিকা চলত না। আমরাও এগুলোর কোন খারাপ খবর পায়নি।’

চীনের এই দুটি টিকার প্রযুক্তি একই জানিয়ে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক বলেন, ‘টিকা তৈরির ট্র্যাডিশনাল যে পদ্ধতি, তারা যেভাবেই করোনার টিকা তৈরি করেছেন। তাদের ফর্মুলা, প্রযুক্তি ও কাঁচামাল পেলে খুব সহজে দেশেই এই টিকা উৎপাদন করা যাবে। টিকা তৈরির কাঁচামাল চীনসহ অন্য দেশ থেকেও আমদানি করা যায়।’

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজমুল হাসান পাপন গতকাল ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনা ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার পর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ওয়ার্ল্ড মার্কেটে চারটি ভ্যাকসিন আছে যেগুলো অ্যাপ্রুভড। ফাইজার, জনসন অ্যান্ড জনসন, মর্ডানা ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা আর কোনটা অ্যাপ্রুভালের আগে আনা সম্ভব না।’

সহ-উৎপাদন ব্যবস্থার আওতায় দেশের স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় রাশিয়া তাদের ‘স্পুটনিক ভি’ উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশকে। এ তথ্য জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী বিপুল চাহিদার প্রেক্ষিতে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ভ্যাকসিনটি রপ্তানি করার মতো পর্যাপ্ত উৎপাদন সক্ষমতা না থাকায় মস্কো বাংলাদেশে ভ্যাকসিনটি উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে।

প্রস্তাব অনুযায়ী রাশিয়া প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, ‘আর দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ‘স্পুটনিক ভি’ উৎপাদন করবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে- এটা তুলনামূলক সাশ্রয়ী হবে এবং আশা করা যায় যে, এটা অপেক্ষাকৃত ভালো হবে।

দেশের টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা কতটুকু

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে জানিয়েছেন, দেশের তিন-চারটি ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানের টিকা উৎপাদনের অবকাঠামো ও সক্ষমতা রয়েছে কিন্তু টিকা উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানি করতে হবে; এটি এখন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

এ ব্যাপারে ‘আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ড. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর যে সক্ষমতা তা দিয়ে কোটি কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন সম্ভব নয়। এজন্যই হয়তো সরকার এখন একাধিক দেশ থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা করছে। আবার টিকার কাঁচামালও আমদানি করতে হয়। এগুলোও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে একাধিক উৎস থেকে টিকা পাওয়া গেলে আমাদের চাহিদা পূরণ সম্ভব।’

‘স্পুটনিক ভি’ টিকার বিষয়ে ড. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘স্পুটনিক ভি ভালো টিকা। এটা অক্সফোর্ডের টিকার মতোই। চীনের সিনোফার্মার ‘সিনোভ্যাক’ টিকাও ভালো। এগুলোর সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও কার্যকারিতাও ভালো প্রমাণিত।’

স্পুটনিক ভি’র কার্যকারিতা

রাশিয়ার উদ্ভাবিত টিকা ‘স্পুটনিক ভি’ কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্রায় ৯২ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে বলে জানিয়েছে ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ ‘দ্য ল্যানসেট’র গবেষণা জার্নাল। এই জার্নালটির চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যু থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয়।

যুক্তরাজ্যের প্রস্তুত করা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং বেলজিয়ামে উদ্ভাবন করা জ্যানসেনের টিকা যেভাবে কাজ করে সেই একইভাবে কাজ করে রাশিয়ার স্পুটনিক ভ্যাকসিন। কোল্ড-টাইপ ভাইরাস ব্যবহার করে এটি করোনাভাইরাসের শরীরে ছোট একটি টুকরা ঢুকিয়ে দেয়। টিকা নেয়ার পর শরীর করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি উৎপাদন শুরু করে দেয়।

স্পুটনিক ভ্যাকসিনটি ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মজুদ করা যায়। এর ফলে এটি সহজে পরিবহন এবং মজুদ করা যায়। সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার থাকলেও সেগুলো হাতে ব্যথা, ক্লান্তি এবং সামান্য তাপমাত্রা বাড়ার মতো সাধারণ বিষয়। ভ্যাকসিন গ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে মৃত্যু এবং মারাত্মক অসুস্থতার কোন বিষয় নেই।

রাশিয়া ছাড়াও বিশে^র ২০টির বেশি দেশ স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনটির গণপ্রয়োগ শুরু করেছে। আর্জেন্টিনা, ফিলিস্তিনি অঞ্চল, ভেনেজুয়েলা, বেলারুশ, হাঙ্গেরি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান প্রমুখ দেশে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ চলছে। এছাড়াও ভারত, ইউরোপের একাধিক দেশ, লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে ‘স্পুটনিক ভি’ ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে দেশগুলোর সরকার।

দ্য ল্যানসেটের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘স্পুটনিক ভি’ ভ্যাকসিন প্রস্তুতে বৈজ্ঞানিক মূলনীতি প্রতিফলিত হয়েছে। ভ্যাকসিনটি সব বয়সী মানুষের ওপরই ভালো প্রভাব দেখিয়েছে এবং মারাত্মক অসুস্থতার ঝুঁকি কমিয়েছে।

চীনের ‘সিনোভ্যাক’ ও ‘সিনোফার্ম’

চীনের ‘জাতীয় চিকিৎসা পণ্য প্রশাসন’ সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য তাদের করোনাভাইরাস টিকা অনুমোদন করেছে বলে জানিয়েছে ‘সিনোভ্যাক বায়োটেক’। তাদের বেইজিংভিত্তিক ইউনিট সিনোভ্যাক লাইফ সায়েন্স প্রতি বছর একশ’ কোটিরও বেশি টিকা উৎপাদন করতে পারবে বলে আশা করছে। এই টিকাটির কার্যকারিতা ৫৩ শতাংশ বলে সম্প্রতি ব্রাজিলের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে প্রমাণ হয়েছে।

সিনোভ্যাক জানিয়েছে, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া, উরুগুয়ে ও লাওস সিনোভ্যাক লাইফ সায়েন্সের উৎপাদিত টিকা ব্যবহার করছে।

এদিকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ওষুধ কোম্পানি চায়না ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপের (সিনোফার্ম) অধীনস্ত বেইজিং বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্ট ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত টিকাটি ৭৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ কার্যকর বলে দাবি করা হয়েছে।

চীন সরকার এখন পর্যন্ত তিনটি টিকা নিজেদের নাগরিকদের ব্যবহার অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেয়া হচ্ছে ‘সিনোভ্যাক’ ও ‘সিনোফার্ম’র টিকা।