জিয়াউদ্দীন আহমেদ
লকডাউনের মধ্যে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে একজন ডাক্তারকে পুলিশের পথ আটকানোর পর ওই ডাক্তারের সঙ্গে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের ঝগড়ার ঘটনা বেশ প্রচার পেয়েছে। কয়েকজন পুলিশ ও একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে একজন চিকিৎসকের বাকবিতণ্ডায় অপরিশীলিত ভাষায় নির্গত বাক্যবাণ দর্শক ও শ্রোতাদের হতাশ করেছে। এরা সবাই সরকারের ভিন্ন ভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা। করোনার বিস্তার ঠেকাতে লকডাউনে মানুষের সহজ চলাচল সীমিত করার অভিপ্রায়ে ঘোষিত নিয়মনীতির বাস্তবায়নে পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট রাস্তায় তদারকি করছে। ডাক্তারের গাড়িতে তার কর্মস্থল হাসপাতালের স্টিকার ছিল, তার গায়ে ডাক্তারের অ্যাপ্রন ছিল, কিন্তু আইডি কার্ড ছিল না। আইডি কার্ড চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকবিতণ্ডার উত্তেজনা শুরু হয়ে যায়। পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট বনাম ডাক্তারের পদমর্যাদার লড়াই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত জেনির ক্ষোভ হচ্ছে, পুলিশ তাকে যথাযথ মর্যাদা দেয়নি, তার সম পদমর্যাদার একজন যুগ্ম-সচিবের পরিচয় পাওয়ার পর পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট এভাবে জেরা করতেন না, আইডি কার্ড চাইতেন না। ডাক্তার জেনি অসত্য বলেননি। মৌখিক পরিচয় পাওয়ার পর ইউনিফর্মবিহীন কোন পুলিশ কর্মকর্তার গাড়িও ডা. জেনির গাড়ির মতো দাঁড়িয়ে থাকত না।
নিজের পেশা ও প্রতিষ্ঠানকে সবাই ভালোবাসে; এই ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া যায় ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন পেশার লোকদের সঙ্গে বাদানুবাদে। তখন ন্যায়-অন্যায় মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে স্বীয় প্রতিষ্ঠান ও পেশার ভাবমূর্তি। তাই তো হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতারা মাওলানা মামুনুল হকের কোন অপরাধ খুঁজে পান না। একজন ঘুষখোরের বিরুদ্ধেও তার অফিসে ভুক্তভোগী কোন নাগরিকের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়, কিছু বললে ঘুষখোরের পক্ষে তার সব সহকর্মী এক হয়ে যাবে। অনভিপ্রেত সম্প্রদায় প্রীতির জন্যই অপরাধ কমে না, দুর্নীতি হ্রাস পায় না। দুদকের চেয়ারম্যান দুর্নীতি নির্মূলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে পরামর্শ দিয়েছিলেন; সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান দুর্নীতি দমন কমিশনের দুর্নীতির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকলে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কিন্তু কেউ কানাডার নাগরিকের মতো দায়িত্ববান হতে চান না। পুলিশ মালয়েশীয়ার প্রধানমন্ত্রী মহাথির মোহাম্মদের গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র দেখছেন- সত্য না হলেও এই ছবিটি দেখে ফেসবুকের সবাই ট্রাফিক পুলিশের কর্তব্য পরায়নতায় মুগ্ধ, কিন্তু বাংলাদেশে একজন ডাক্তারের আইডি কার্ড চাওয়া হলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না; পুলিশকে গাড়ির স্টিকার দেখে, গায়ে ইউনিফর্ম দেখে চিনতে হবে, বুঝতে হবে। প্রায়ই ভুয়া ডাক্তার, পুলিশ, সাংবাদিক চিহ্নিত হচ্ছে; পোশাক দেখে, গাড়ির স্টিকার দেখে শনাক্ত করার কোন উপায় থাকে না। প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া আইডি কার্ডের গুরুত্ব অপরিসীম, বিপদে-আপদে কাজে লাগে। ১৯৭৭ বা ১৯৭৮ সনের কথা; বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সহকারী পরিচালক মোহাম্মদপুরের জহুরী মহল্লায় তার এক পরিচিত লোকের সঙ্গে সন্ধ্যায় নির্জন জায়গায় হাঁটার সময় হঠাৎ সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হন। আক্রমণের লক্ষ্মণ দেখেই সঙ্গের পরিচিতজন দেয়াল টপকে পালিয়ে যায়; সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালককে পিটিয়ে প্রায় মৃত অবস্থায় বস্তায় ভরার সময় তার পকেটে আইডি কার্ডটি দেখে বুঝতে পারে, তারা ভুল লোককে পিটিয়েছে। তিনি পরে আমার ‘স্যার’ ছিলেন, জিএম বা নির্বাহী পরিচালক হয়ে অবসরে যান। ইতোমধ্যে তিনি ইন্তেকালও করেছেন। অফিসে একদিন আমার পকেটে আইডি কার্ড না দেখে তিনি তার জীবনের মর্মান্তিক ঘটনাটি উল্লেখ করেছিলেন।
তাত্ত্বিকভাবে একজন ট্রাফিক কনস্টেবল দেশের প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির কাগজপত্র চাইতে পারেন; কিন্তু আমাদের মতো দেশে তা প্রায় অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী নয়, একজন বড় আমলার ড্রাইভারও ট্রাফিক পুলিশদের রাস্তায় পাত্তা দেয় না। কারণ ড্রাইভার সাহেব তার কর্তার ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল। পুলিশও নিশ্চুপ থাকেন, দেখেও না দেখার ভান করেন। অন্যদিকে যারা ক্যাডারভুক্ত নন, তাদের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে তার পদমর্যাদার জন্য ধরনা দিতে হয় তারই ছাত্র কোন আমলা বা মন্ত্রীর কাছে। সম বেতন স্কেলের একজন প্রকৌশলী বা একজন চিকিৎসক বা একজন শিক্ষক বা একজন ব্যাংকারের গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করার সময় যথাযথ সম্মানটুকু দেখানো হয় না। এই অবমূল্যায়ন দেখতে দেখতে ডা. জেনির অনেকদিনের জমানো ক্ষোভ থেকেই হয়তো এমন উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া। পাশ্চাত্যে করদাতা নাগরিকদের দাপট যে কোন আমলা বা পুলিশের চেয়ে বেশি। তবে ওখানকার করদাতা নাগরিকরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আমাদের মতো এত বেপরোয়া নয়।
পেশার মর্যাদার তারতম্য নিয়ে কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা প্রকৌশল ও চিকিৎসা শাস্ত্রে লেখাপড়া করলেও ইদানীং তারা তাদের অধীত বিদ্যার পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। মেধাবী এই ডাক্তার এবং প্রকৌশলীরা তাদের আপন পেশায় চাকরি করে কখনো তার দপ্তরের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি হতে পারেন না। তাই তারা প্রশাসক হতে পছন্দ করেন, কূটনীতিবিদ হতে চেষ্টা করেন, কাস্টমে চাকরি করে তৃপ্তি পান। এই পদগুলোর মধ্যেও অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে; ক্যাডার সার্ভিসগুলোর মধ্যে এই অন্তর্দ্বন্দ্ব অনেক পুরানো। জনগণের কাছে সব পেশার মর্যাদা রয়েছে; মুমূর্ষু রোগীর আত্মীয়-স্বজনের কাছে সৃষ্টিকর্তার পরই ডাক্তারের স্থান। এই জন্য সমাজে ডাক্তারদের আলাদা একটি মর্যাদা আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়ে যায়। কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের গুরুত্ব বেশি। শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের ভাষ্য অনুযায়ী মানুষ দোজখের আগুনের চেয়েও থানার দারোগাকে বেশি ভয় করে। বাংলাদেশের লোকেরা ক্ষমতা দেখাতে পছন্দ করে, রাস্তায় বের হলে কতজন তাকে স্যালুট দিল, সালাম দিলো তাই তার ক্ষমতার মানদণ্ড। সম্প্রতি এক ব্যক্তির লনে দাড়িয়ে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে সরে যেতে বললে তাকে কয়েক পা পেছনে সরে যেতে একটি ভিডিওতে দেখা গেছে।
সরকার বা পুলিশ লকডাউনের বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। জীবিকা যাদের নিশ্চিত তাদের কাছে এখন জীবন বড়, আবার কারও কারও কাছে জীবন বাঁচানোর জন্য জীবিকা বড়। ক্ষুধার্ত মানুষগুলো করোনার ভয়ানক পরিণতি নিয়ে চিন্তিত নন, তাদের প্রতিদিন অমানুষিক পরিশ্রম করে ডাল-ভাতের পয়সা জোগাড় করতে হয়। এই লোকগুলো বিধিনিষেধ মানতে সম্মত নয়, এরা মুভমেন্ট পাস কী তা বোঝে না। অন্যদিকে সরকার থেকে পুলিশকে সর্বাত্মক লকডাউন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। দুটোর সমন্বয় করা কঠিন। পুলিশকে তাই মাঝে মাঝে কঠোর হতে হয়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগও উঠেছে। হলিউডের একটি সিনেমায় দেখলাম, বোনের ধর্ষককে পুলিশ অফিসার গ্রেপ্তার করতে গিয়ে দুটি চড় দিয়েছিলেন বলে পুলিশ অফিসারকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল। কারণ পুলিশের হাতে অস্ত্র থাকে, শৃঙ্খলা রক্ষায় আইনের শক্তি থাকে। আইন অমান্যের চরম বিপর্যয়কর অবস্থায়ও পুলিশকে তাই অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে হয়।
ফেসবুকে ডাক্তার ও পুলিশদের বাগযুদ্ধ চলছে, অন্যান্য পেশার লোকও জড়িয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ দুই পেশার লোকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে উত্তেজনা ও বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন; করোনাভাইরাসের আক্রমণে জনগণের আস্থার দুটি পেশাকে বিতর্কিত করে আনন্দ পাচ্ছেন। কিন্তু এই দুটি পেশাই মানবজাতি ও মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য জরুরি। একজন জীবনঘাতি করোনার মধ্যে দায়িত্ব পালন করে রোগীর সেবা করেন, অন্যজন তপ্ত রোদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাজার রকম মানব চরিত্রের মুখোমুখি হয়ে করোনার বিস্তার ঠেকাচ্ছেন। ক্যাডারভুক্ত এই দুই পেশার লোকের মধ্যে কে কত বড় তা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স দিয়ে ঠিক করা সম্ভব, কিন্তু মানব সমাজের কাছে উভয় সেবক, উভয়ের মর্যাদা অনেক উঁচুতে। করোনাকালীন তাদের উভয়ের সেবা সাধারণ মানুষের জন্য অনেক জরুরি। পুলিশ ও চিকিৎসক একসঙ্গে মিলে যে সংকটজনক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তা যেন মুখ থুবড়ে না পড়ে।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com
রবিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২১ , ১২ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমজান ১৪৪২
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
লকডাউনের মধ্যে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে একজন ডাক্তারকে পুলিশের পথ আটকানোর পর ওই ডাক্তারের সঙ্গে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের ঝগড়ার ঘটনা বেশ প্রচার পেয়েছে। কয়েকজন পুলিশ ও একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে একজন চিকিৎসকের বাকবিতণ্ডায় অপরিশীলিত ভাষায় নির্গত বাক্যবাণ দর্শক ও শ্রোতাদের হতাশ করেছে। এরা সবাই সরকারের ভিন্ন ভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা। করোনার বিস্তার ঠেকাতে লকডাউনে মানুষের সহজ চলাচল সীমিত করার অভিপ্রায়ে ঘোষিত নিয়মনীতির বাস্তবায়নে পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট রাস্তায় তদারকি করছে। ডাক্তারের গাড়িতে তার কর্মস্থল হাসপাতালের স্টিকার ছিল, তার গায়ে ডাক্তারের অ্যাপ্রন ছিল, কিন্তু আইডি কার্ড ছিল না। আইডি কার্ড চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকবিতণ্ডার উত্তেজনা শুরু হয়ে যায়। পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট বনাম ডাক্তারের পদমর্যাদার লড়াই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত জেনির ক্ষোভ হচ্ছে, পুলিশ তাকে যথাযথ মর্যাদা দেয়নি, তার সম পদমর্যাদার একজন যুগ্ম-সচিবের পরিচয় পাওয়ার পর পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট এভাবে জেরা করতেন না, আইডি কার্ড চাইতেন না। ডাক্তার জেনি অসত্য বলেননি। মৌখিক পরিচয় পাওয়ার পর ইউনিফর্মবিহীন কোন পুলিশ কর্মকর্তার গাড়িও ডা. জেনির গাড়ির মতো দাঁড়িয়ে থাকত না।
নিজের পেশা ও প্রতিষ্ঠানকে সবাই ভালোবাসে; এই ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া যায় ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন পেশার লোকদের সঙ্গে বাদানুবাদে। তখন ন্যায়-অন্যায় মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে স্বীয় প্রতিষ্ঠান ও পেশার ভাবমূর্তি। তাই তো হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতারা মাওলানা মামুনুল হকের কোন অপরাধ খুঁজে পান না। একজন ঘুষখোরের বিরুদ্ধেও তার অফিসে ভুক্তভোগী কোন নাগরিকের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়, কিছু বললে ঘুষখোরের পক্ষে তার সব সহকর্মী এক হয়ে যাবে। অনভিপ্রেত সম্প্রদায় প্রীতির জন্যই অপরাধ কমে না, দুর্নীতি হ্রাস পায় না। দুদকের চেয়ারম্যান দুর্নীতি নির্মূলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে পরামর্শ দিয়েছিলেন; সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান দুর্নীতি দমন কমিশনের দুর্নীতির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকলে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কিন্তু কেউ কানাডার নাগরিকের মতো দায়িত্ববান হতে চান না। পুলিশ মালয়েশীয়ার প্রধানমন্ত্রী মহাথির মোহাম্মদের গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র দেখছেন- সত্য না হলেও এই ছবিটি দেখে ফেসবুকের সবাই ট্রাফিক পুলিশের কর্তব্য পরায়নতায় মুগ্ধ, কিন্তু বাংলাদেশে একজন ডাক্তারের আইডি কার্ড চাওয়া হলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না; পুলিশকে গাড়ির স্টিকার দেখে, গায়ে ইউনিফর্ম দেখে চিনতে হবে, বুঝতে হবে। প্রায়ই ভুয়া ডাক্তার, পুলিশ, সাংবাদিক চিহ্নিত হচ্ছে; পোশাক দেখে, গাড়ির স্টিকার দেখে শনাক্ত করার কোন উপায় থাকে না। প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া আইডি কার্ডের গুরুত্ব অপরিসীম, বিপদে-আপদে কাজে লাগে। ১৯৭৭ বা ১৯৭৮ সনের কথা; বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সহকারী পরিচালক মোহাম্মদপুরের জহুরী মহল্লায় তার এক পরিচিত লোকের সঙ্গে সন্ধ্যায় নির্জন জায়গায় হাঁটার সময় হঠাৎ সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হন। আক্রমণের লক্ষ্মণ দেখেই সঙ্গের পরিচিতজন দেয়াল টপকে পালিয়ে যায়; সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালককে পিটিয়ে প্রায় মৃত অবস্থায় বস্তায় ভরার সময় তার পকেটে আইডি কার্ডটি দেখে বুঝতে পারে, তারা ভুল লোককে পিটিয়েছে। তিনি পরে আমার ‘স্যার’ ছিলেন, জিএম বা নির্বাহী পরিচালক হয়ে অবসরে যান। ইতোমধ্যে তিনি ইন্তেকালও করেছেন। অফিসে একদিন আমার পকেটে আইডি কার্ড না দেখে তিনি তার জীবনের মর্মান্তিক ঘটনাটি উল্লেখ করেছিলেন।
তাত্ত্বিকভাবে একজন ট্রাফিক কনস্টেবল দেশের প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির কাগজপত্র চাইতে পারেন; কিন্তু আমাদের মতো দেশে তা প্রায় অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী নয়, একজন বড় আমলার ড্রাইভারও ট্রাফিক পুলিশদের রাস্তায় পাত্তা দেয় না। কারণ ড্রাইভার সাহেব তার কর্তার ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল। পুলিশও নিশ্চুপ থাকেন, দেখেও না দেখার ভান করেন। অন্যদিকে যারা ক্যাডারভুক্ত নন, তাদের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে তার পদমর্যাদার জন্য ধরনা দিতে হয় তারই ছাত্র কোন আমলা বা মন্ত্রীর কাছে। সম বেতন স্কেলের একজন প্রকৌশলী বা একজন চিকিৎসক বা একজন শিক্ষক বা একজন ব্যাংকারের গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করার সময় যথাযথ সম্মানটুকু দেখানো হয় না। এই অবমূল্যায়ন দেখতে দেখতে ডা. জেনির অনেকদিনের জমানো ক্ষোভ থেকেই হয়তো এমন উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া। পাশ্চাত্যে করদাতা নাগরিকদের দাপট যে কোন আমলা বা পুলিশের চেয়ে বেশি। তবে ওখানকার করদাতা নাগরিকরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আমাদের মতো এত বেপরোয়া নয়।
পেশার মর্যাদার তারতম্য নিয়ে কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা প্রকৌশল ও চিকিৎসা শাস্ত্রে লেখাপড়া করলেও ইদানীং তারা তাদের অধীত বিদ্যার পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। মেধাবী এই ডাক্তার এবং প্রকৌশলীরা তাদের আপন পেশায় চাকরি করে কখনো তার দপ্তরের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি হতে পারেন না। তাই তারা প্রশাসক হতে পছন্দ করেন, কূটনীতিবিদ হতে চেষ্টা করেন, কাস্টমে চাকরি করে তৃপ্তি পান। এই পদগুলোর মধ্যেও অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে; ক্যাডার সার্ভিসগুলোর মধ্যে এই অন্তর্দ্বন্দ্ব অনেক পুরানো। জনগণের কাছে সব পেশার মর্যাদা রয়েছে; মুমূর্ষু রোগীর আত্মীয়-স্বজনের কাছে সৃষ্টিকর্তার পরই ডাক্তারের স্থান। এই জন্য সমাজে ডাক্তারদের আলাদা একটি মর্যাদা আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়ে যায়। কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের গুরুত্ব বেশি। শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের ভাষ্য অনুযায়ী মানুষ দোজখের আগুনের চেয়েও থানার দারোগাকে বেশি ভয় করে। বাংলাদেশের লোকেরা ক্ষমতা দেখাতে পছন্দ করে, রাস্তায় বের হলে কতজন তাকে স্যালুট দিল, সালাম দিলো তাই তার ক্ষমতার মানদণ্ড। সম্প্রতি এক ব্যক্তির লনে দাড়িয়ে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে সরে যেতে বললে তাকে কয়েক পা পেছনে সরে যেতে একটি ভিডিওতে দেখা গেছে।
সরকার বা পুলিশ লকডাউনের বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। জীবিকা যাদের নিশ্চিত তাদের কাছে এখন জীবন বড়, আবার কারও কারও কাছে জীবন বাঁচানোর জন্য জীবিকা বড়। ক্ষুধার্ত মানুষগুলো করোনার ভয়ানক পরিণতি নিয়ে চিন্তিত নন, তাদের প্রতিদিন অমানুষিক পরিশ্রম করে ডাল-ভাতের পয়সা জোগাড় করতে হয়। এই লোকগুলো বিধিনিষেধ মানতে সম্মত নয়, এরা মুভমেন্ট পাস কী তা বোঝে না। অন্যদিকে সরকার থেকে পুলিশকে সর্বাত্মক লকডাউন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। দুটোর সমন্বয় করা কঠিন। পুলিশকে তাই মাঝে মাঝে কঠোর হতে হয়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগও উঠেছে। হলিউডের একটি সিনেমায় দেখলাম, বোনের ধর্ষককে পুলিশ অফিসার গ্রেপ্তার করতে গিয়ে দুটি চড় দিয়েছিলেন বলে পুলিশ অফিসারকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল। কারণ পুলিশের হাতে অস্ত্র থাকে, শৃঙ্খলা রক্ষায় আইনের শক্তি থাকে। আইন অমান্যের চরম বিপর্যয়কর অবস্থায়ও পুলিশকে তাই অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে হয়।
ফেসবুকে ডাক্তার ও পুলিশদের বাগযুদ্ধ চলছে, অন্যান্য পেশার লোকও জড়িয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ দুই পেশার লোকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে উত্তেজনা ও বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন; করোনাভাইরাসের আক্রমণে জনগণের আস্থার দুটি পেশাকে বিতর্কিত করে আনন্দ পাচ্ছেন। কিন্তু এই দুটি পেশাই মানবজাতি ও মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য জরুরি। একজন জীবনঘাতি করোনার মধ্যে দায়িত্ব পালন করে রোগীর সেবা করেন, অন্যজন তপ্ত রোদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাজার রকম মানব চরিত্রের মুখোমুখি হয়ে করোনার বিস্তার ঠেকাচ্ছেন। ক্যাডারভুক্ত এই দুই পেশার লোকের মধ্যে কে কত বড় তা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স দিয়ে ঠিক করা সম্ভব, কিন্তু মানব সমাজের কাছে উভয় সেবক, উভয়ের মর্যাদা অনেক উঁচুতে। করোনাকালীন তাদের উভয়ের সেবা সাধারণ মানুষের জন্য অনেক জরুরি। পুলিশ ও চিকিৎসক একসঙ্গে মিলে যে সংকটজনক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তা যেন মুখ থুবড়ে না পড়ে।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com