রণেশ মৈত্র
২০২১-এর মার্চে শুরু হয়েছে পশ্চিম বাংলার বিধানসভার নির্বাচন। শেষ হবে ২৭ এপ্রিল। প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণী ফলাফল প্রকাশিত হবে ২ মে।
আজ পর্যন্ত পশ্চিম বাংলায় যতগুলো নির্বাচনী সভা বা লোক সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলের তিনজন সর্বাধিক প্রভাবশালী নেতা যেমন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপির সভাপতি নাড্ডা-কেউ না কেউ প্রতি দিনই রাজ্যের কোন না কোন স্থানে আসছেন-কোন না কোন জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন-মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জৌলুসপূর্ণ সমাবেশ, রোড শোর আয়োজন করছেন। ভাষণে বলছেন, আর কোন দল নয়, বিজেপিই এবার নির্বাচনে অন্তত: ২০০ আসনে বিজয়ী হয়ে রাজ্য সরকার গঠন করবে। অর্থাৎ ফলাফল ভোট গণনার আগেই তাদের জানা।
সর্ব ভারতীয় দল কার্যত: তৃণমূল কংগ্রেস আজও হতে পারেনি। তাদের সব দাপট পশ্চিম বাংলাতেই। নেতাও একজনই। তিনি ‘দিদি’ বলে পশ্চিম বাংলায় পরিচিত। মমতা বন্দোপাধ্যায়। তিনি মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিম বাংলার সেই ২০১১ সাল থেকে। দিল্লি বা ভারতের অন্য কোথাও তৃণমূলের কোন নেতা নেই তাই বাইরে থেকে কারও আসার প্রশ্নও উঠে না। মমতা ব্যানার্জি নিজেই বলেছেন, তিনি একাই একশ শুধু নন-তারাও বেশি। সত্য মিথ্যা জানি না। টেলিভিশনের ছবিতে দেখা যায় তার এক পা আহত। তাই তিনি হুইল চেয়ারে সে সমগ্র রাজ্যে জনসভা করে বেড়াচ্ছেন। তার কথা বাংলার মানুষ বাংলার মেয়েকেই’ জেতাবে-বাইরের কাউকে নয়। অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদি, আমিত শাহ্, নাড্ডারা বাংলার বাইরে থেকে এসে তাদের কাউকে ভোটে জেতাতে পারবেন না। বিজেপি-তৃণমূল, অন্তত: ভারতের ধনিক শ্রেণীর মালিকানাধীন গণমাধ্যমসমূহের প্রচার অনুযায়ী, পরস্পর পরস্পরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। মাঝখানে থাকা জনগণ যারাই আসলে হারানো জেতানোর মালিক তাদের কথা, তাদের অনুভূতি ওই দেশের মিডিয়ায় পুরোপুরি অনুপস্থিত।
সমগ্র ভারতীয় গণমাধ্যম দেখলে বা ঘাটলে কোথাও তৃতীয় কোন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাক্ষাৎ মেলে না অথচ তারা অত্যন্ত পরিচিত। বাম-কংগ্রেস আইএসএফএই তিন শক্তি মিলে জোট বেঁধেছেন তারা। আন্তর্জাতিক বা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মতেই বামদের বহু সুপরিচিত নেতা রয়েছেন পশ্চিম বাংলার বাইরেও। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেরও কেন্দ্রীয় নেতা প্রায় সবাই বাংলার বাইরের। কিন্তু তারা আসছেন না জোটের প্রচারণায় অর্থাৎ আনা হচ্ছে না তাদের। তাদের পশ্চিম বাংলায় নেতারাই সারা রাজ্যে জোটের প্রার্থীদের সপক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে আসছেন।
সবারই জানা যে, ভারত-পশ্চিম বাংলার প্রধান প্রধান বিত্তশালীরা বিজেপি-তৃণমূলের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছেন। সেক্ষেত্রে সর্বাধিক ধনীক শ্রেণীর মালিকরা একযোগে বিজেপির সমথর্ধনে দাঁড়িয়ে গেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় চালু থাকায় লাভটা তো ওই বিজেপিরই যারা সমগ্র ভারতের ধনিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষক। অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র তবে পশ্চিম বাংলার বৃহৎ পুঁজির মালিকরা সমবেত হয়েছেন মমতা ব্যানার্জির পাশে। লড়াইটা এখানেই।
এই লড়াই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চললে উভয় স্তরের ধনিকের দল দুটির সুবিধা দীর্ঘমেয়াদি প্রচার প্রচারণা চালানোর ক্ষেত্রে। আসলেও তাই ঘটে চলেছে পশ্চিম বাংলায়।
আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমাদের দেশের সীমান্তের ব্যাপক অংশজুড়ে রয়েছে পশ্চিম বাংলা ও আসাম। আর পশ্চিম বাংলায় অজস্র আত্মীয় স্বজনের বাস বাংলাদেশের মানুষের। অভিন্ন নদীও রয়েছে যার পানি বণ্টন নির্ভর করে পশ্চিম বাংলার রাজ্য ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। সেই রাজ্যে ও কেন্দ্রে বাংলাদেশ বান্ধব সরকার বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করতে পারে। তাই এমন একটি সরকার কারা গঠন করতে পারে তা একটু ভেবে দেখা যাক।
প্রথম ঘটনা ১৯৪৬-৫০ এর দিকের। সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার যুগ ছিল তখন। সেই উন্মাদনার শিকার হন হিন্দুরা। তারা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে দলে দলে ছুটে যান কলকাতাসহ পশ্চিম বাংলার নানা শহরে। এই হাজার হাজার, লাখ লাখ সহায় সম্বল ফেলে যাওয়া মানুষের প্রাথমিক আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল শিয়ালদহ জংশনসহ পশ্চিম বাংলার বড় বড় রেলওয়ে জংশন, খালি মাঠ এবং অল্পসংখ্যকের স্থান হয়েছিল তাদের আত্মীয় বাড়ি। কিন্তু রেলওয়ে জংশনগুলোতে চাদর পেতে মেঝেতে শুয়ে থাকা অগণিত নারী পুরুষ স্থায়ী আশ্রয়, তাদের নিত্যদিনের আহার, বস্ত্র, খাবার জল প্রভৃতি দৈনন্দিন সমস্যা মেটানোর আন্দোলনে নেমে পড়েছিল তৎকালীন ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। সিপিআই নামে পরিচিত ওই পার্টির হাজার হাজার কর্মী ওই বাস্তুচ্যুত মানুষদের স্থায়ী আশ্রয়, আয় উপার্জনের ব্যবস্থাসহ সর্বাধিক পুনর্বাসনের দাবিতে যে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তারই সুবাদে ওই সময়ের শরণার্থীরা ওই দেশে জমি, বাড়ি, নাগরিকত্ব ও কাজের এবং শিক্ষার সুযোগ পেলেন। সে কথা কি পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা ভুলে যাবেন?
আজকের সিপিএন- সিপিআই তাদের উত্তরসূরি। তারাই বাঙালির বৃহত্তম অংশের ভোটের দাবিদার। মনে আছে কি আমাদের, জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বাম জোট ক্ষমতায় থাকাকালেই ঢাকা-কলকাতা সরাসরি বাস সংযোগ এবং তার কয়েক বছর পর ঢাকা-কলকাতা সরাসরি রেল সংযোগও স্থাপিত হয় ওই বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালেই।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত এবং যার দ্রুত সমাধান বাংলাদেশের সার্বিক স্বার্থে ও ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিরাজমান বন্ধুত্ব বজায় রাখা ও অধিকতর শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য তা হলো তিস্তা নদীর জলবণ্টন নিয়ে বিরাজমান দীর্ঘকালীন সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের প্রধানতম অন্তরায় পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় স্বয়ং। তিনি প্রকাশ্যেই বলেন, ‘আমার কাছে পশ্চিম বাংলার মানুষের স্বার্থই প্রধান’। যদি কখনও তিস্তায় বাড়তি জল আসে তখন পশ্চিম বাংলার প্রয়োজন সম্পূর্ণভাবে মিটিয়ে তবেই বাংলাদেশকে দেয়া হবে। ব্যাপারটা এমন “আন আগে সাগরের পানি, তবে তোর কিরা মানি”। অর্থাৎ “সাতাশ মণ তেলও জুটবে না রাধাও নাচবে না”।
তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে চলমান নির্বাচনে পশ্চিম বাংলায় বাম, কংগ্রেস, আইএসএফ জোটের বিজয় এবং ওই রাজ্যে সরকার গঠনের জন্য তাদের উপযুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্তি। এই জোটের বিজয় শুধু বাংলাদেশের স্বার্থে প্রয়োজন-তা নয়। জোটটি দিধাহীনভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাদের নীতি অতীতের মতোই পরিচালনা করতে দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। আর সাম্প্রদায়িকতাই হলো বাংলাদেশ-ভারতসহ এই উপমহাদেশের জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তার সবচাইতে বড় শত্রু। সুতরাং বাংলাদেশ, ভারতসহ সমগ্র উপমহাদেশের সার্বিক স্বার্থেই বাম, কংগ্রেস আইএস জোটের বিজয়ী হয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। কারণ বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস উভয় দলই সাম্প্রদায়িক। বিজেপি হিন্দুত্বের নামে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয়-তৃণমূলও মুসলিম তোষণের নামে তৈরি করে চলেছে ভিন্ন ধরনের আবহ। তৃণমূল সংখ্যালঘু সমস্যার মূলে যেতে নারাজ। তাদের সমস্যার প্রকৃত সমাধানও তৃণমূল চায় না। তিস্তা নদী যে আন্তর্জাতিক নদী বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তাই আন্তর্জাতিক জলবণ্টন আইন অনুযায়ী তিস্তার জল যে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের প্রাপ্য তাও স্বীকার করতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।
দল বা জোট মনোনয়নের ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলো পশ্চিম বাংলার মানুষ গভীরভাবে ভেবে দেখবেন আশা করি।
[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]
raneshhmaitra@gmail.com
রবিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২১ , ১২ বৈশাখ ১৪২৮ ১২ রমজান ১৪৪২
রণেশ মৈত্র
২০২১-এর মার্চে শুরু হয়েছে পশ্চিম বাংলার বিধানসভার নির্বাচন। শেষ হবে ২৭ এপ্রিল। প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণী ফলাফল প্রকাশিত হবে ২ মে।
আজ পর্যন্ত পশ্চিম বাংলায় যতগুলো নির্বাচনী সভা বা লোক সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলের তিনজন সর্বাধিক প্রভাবশালী নেতা যেমন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপির সভাপতি নাড্ডা-কেউ না কেউ প্রতি দিনই রাজ্যের কোন না কোন স্থানে আসছেন-কোন না কোন জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন-মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জৌলুসপূর্ণ সমাবেশ, রোড শোর আয়োজন করছেন। ভাষণে বলছেন, আর কোন দল নয়, বিজেপিই এবার নির্বাচনে অন্তত: ২০০ আসনে বিজয়ী হয়ে রাজ্য সরকার গঠন করবে। অর্থাৎ ফলাফল ভোট গণনার আগেই তাদের জানা।
সর্ব ভারতীয় দল কার্যত: তৃণমূল কংগ্রেস আজও হতে পারেনি। তাদের সব দাপট পশ্চিম বাংলাতেই। নেতাও একজনই। তিনি ‘দিদি’ বলে পশ্চিম বাংলায় পরিচিত। মমতা বন্দোপাধ্যায়। তিনি মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিম বাংলার সেই ২০১১ সাল থেকে। দিল্লি বা ভারতের অন্য কোথাও তৃণমূলের কোন নেতা নেই তাই বাইরে থেকে কারও আসার প্রশ্নও উঠে না। মমতা ব্যানার্জি নিজেই বলেছেন, তিনি একাই একশ শুধু নন-তারাও বেশি। সত্য মিথ্যা জানি না। টেলিভিশনের ছবিতে দেখা যায় তার এক পা আহত। তাই তিনি হুইল চেয়ারে সে সমগ্র রাজ্যে জনসভা করে বেড়াচ্ছেন। তার কথা বাংলার মানুষ বাংলার মেয়েকেই’ জেতাবে-বাইরের কাউকে নয়। অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদি, আমিত শাহ্, নাড্ডারা বাংলার বাইরে থেকে এসে তাদের কাউকে ভোটে জেতাতে পারবেন না। বিজেপি-তৃণমূল, অন্তত: ভারতের ধনিক শ্রেণীর মালিকানাধীন গণমাধ্যমসমূহের প্রচার অনুযায়ী, পরস্পর পরস্পরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। মাঝখানে থাকা জনগণ যারাই আসলে হারানো জেতানোর মালিক তাদের কথা, তাদের অনুভূতি ওই দেশের মিডিয়ায় পুরোপুরি অনুপস্থিত।
সমগ্র ভারতীয় গণমাধ্যম দেখলে বা ঘাটলে কোথাও তৃতীয় কোন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাক্ষাৎ মেলে না অথচ তারা অত্যন্ত পরিচিত। বাম-কংগ্রেস আইএসএফএই তিন শক্তি মিলে জোট বেঁধেছেন তারা। আন্তর্জাতিক বা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মতেই বামদের বহু সুপরিচিত নেতা রয়েছেন পশ্চিম বাংলার বাইরেও। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেরও কেন্দ্রীয় নেতা প্রায় সবাই বাংলার বাইরের। কিন্তু তারা আসছেন না জোটের প্রচারণায় অর্থাৎ আনা হচ্ছে না তাদের। তাদের পশ্চিম বাংলায় নেতারাই সারা রাজ্যে জোটের প্রার্থীদের সপক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে আসছেন।
সবারই জানা যে, ভারত-পশ্চিম বাংলার প্রধান প্রধান বিত্তশালীরা বিজেপি-তৃণমূলের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছেন। সেক্ষেত্রে সর্বাধিক ধনীক শ্রেণীর মালিকরা একযোগে বিজেপির সমথর্ধনে দাঁড়িয়ে গেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় চালু থাকায় লাভটা তো ওই বিজেপিরই যারা সমগ্র ভারতের ধনিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষক। অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র তবে পশ্চিম বাংলার বৃহৎ পুঁজির মালিকরা সমবেত হয়েছেন মমতা ব্যানার্জির পাশে। লড়াইটা এখানেই।
এই লড়াই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চললে উভয় স্তরের ধনিকের দল দুটির সুবিধা দীর্ঘমেয়াদি প্রচার প্রচারণা চালানোর ক্ষেত্রে। আসলেও তাই ঘটে চলেছে পশ্চিম বাংলায়।
আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমাদের দেশের সীমান্তের ব্যাপক অংশজুড়ে রয়েছে পশ্চিম বাংলা ও আসাম। আর পশ্চিম বাংলায় অজস্র আত্মীয় স্বজনের বাস বাংলাদেশের মানুষের। অভিন্ন নদীও রয়েছে যার পানি বণ্টন নির্ভর করে পশ্চিম বাংলার রাজ্য ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। সেই রাজ্যে ও কেন্দ্রে বাংলাদেশ বান্ধব সরকার বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করতে পারে। তাই এমন একটি সরকার কারা গঠন করতে পারে তা একটু ভেবে দেখা যাক।
প্রথম ঘটনা ১৯৪৬-৫০ এর দিকের। সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার যুগ ছিল তখন। সেই উন্মাদনার শিকার হন হিন্দুরা। তারা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে দলে দলে ছুটে যান কলকাতাসহ পশ্চিম বাংলার নানা শহরে। এই হাজার হাজার, লাখ লাখ সহায় সম্বল ফেলে যাওয়া মানুষের প্রাথমিক আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছিল শিয়ালদহ জংশনসহ পশ্চিম বাংলার বড় বড় রেলওয়ে জংশন, খালি মাঠ এবং অল্পসংখ্যকের স্থান হয়েছিল তাদের আত্মীয় বাড়ি। কিন্তু রেলওয়ে জংশনগুলোতে চাদর পেতে মেঝেতে শুয়ে থাকা অগণিত নারী পুরুষ স্থায়ী আশ্রয়, তাদের নিত্যদিনের আহার, বস্ত্র, খাবার জল প্রভৃতি দৈনন্দিন সমস্যা মেটানোর আন্দোলনে নেমে পড়েছিল তৎকালীন ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। সিপিআই নামে পরিচিত ওই পার্টির হাজার হাজার কর্মী ওই বাস্তুচ্যুত মানুষদের স্থায়ী আশ্রয়, আয় উপার্জনের ব্যবস্থাসহ সর্বাধিক পুনর্বাসনের দাবিতে যে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তারই সুবাদে ওই সময়ের শরণার্থীরা ওই দেশে জমি, বাড়ি, নাগরিকত্ব ও কাজের এবং শিক্ষার সুযোগ পেলেন। সে কথা কি পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা ভুলে যাবেন?
আজকের সিপিএন- সিপিআই তাদের উত্তরসূরি। তারাই বাঙালির বৃহত্তম অংশের ভোটের দাবিদার। মনে আছে কি আমাদের, জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বাম জোট ক্ষমতায় থাকাকালেই ঢাকা-কলকাতা সরাসরি বাস সংযোগ এবং তার কয়েক বছর পর ঢাকা-কলকাতা সরাসরি রেল সংযোগও স্থাপিত হয় ওই বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালেই।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত এবং যার দ্রুত সমাধান বাংলাদেশের সার্বিক স্বার্থে ও ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিরাজমান বন্ধুত্ব বজায় রাখা ও অধিকতর শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য তা হলো তিস্তা নদীর জলবণ্টন নিয়ে বিরাজমান দীর্ঘকালীন সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের প্রধানতম অন্তরায় পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় স্বয়ং। তিনি প্রকাশ্যেই বলেন, ‘আমার কাছে পশ্চিম বাংলার মানুষের স্বার্থই প্রধান’। যদি কখনও তিস্তায় বাড়তি জল আসে তখন পশ্চিম বাংলার প্রয়োজন সম্পূর্ণভাবে মিটিয়ে তবেই বাংলাদেশকে দেয়া হবে। ব্যাপারটা এমন “আন আগে সাগরের পানি, তবে তোর কিরা মানি”। অর্থাৎ “সাতাশ মণ তেলও জুটবে না রাধাও নাচবে না”।
তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে চলমান নির্বাচনে পশ্চিম বাংলায় বাম, কংগ্রেস, আইএসএফ জোটের বিজয় এবং ওই রাজ্যে সরকার গঠনের জন্য তাদের উপযুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্তি। এই জোটের বিজয় শুধু বাংলাদেশের স্বার্থে প্রয়োজন-তা নয়। জোটটি দিধাহীনভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাদের নীতি অতীতের মতোই পরিচালনা করতে দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। আর সাম্প্রদায়িকতাই হলো বাংলাদেশ-ভারতসহ এই উপমহাদেশের জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তার সবচাইতে বড় শত্রু। সুতরাং বাংলাদেশ, ভারতসহ সমগ্র উপমহাদেশের সার্বিক স্বার্থেই বাম, কংগ্রেস আইএস জোটের বিজয়ী হয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। কারণ বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস উভয় দলই সাম্প্রদায়িক। বিজেপি হিন্দুত্বের নামে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয়-তৃণমূলও মুসলিম তোষণের নামে তৈরি করে চলেছে ভিন্ন ধরনের আবহ। তৃণমূল সংখ্যালঘু সমস্যার মূলে যেতে নারাজ। তাদের সমস্যার প্রকৃত সমাধানও তৃণমূল চায় না। তিস্তা নদী যে আন্তর্জাতিক নদী বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তাই আন্তর্জাতিক জলবণ্টন আইন অনুযায়ী তিস্তার জল যে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের প্রাপ্য তাও স্বীকার করতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।
দল বা জোট মনোনয়নের ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলো পশ্চিম বাংলার মানুষ গভীরভাবে ভেবে দেখবেন আশা করি।
[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]
raneshhmaitra@gmail.com