রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কি থমকে গেল?

মিহির কুমার রায়

গত ১ ফেব্রুয়ারি সোমবার মায়ানমারে অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) পার্টির নেতৃত্বাধীন দল গত নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে শতকরা ৮৩ ভাগ ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেও তিন মাস অতিবাহিত হতে না হতেই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারির পর বাংলাদেশের সামনে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছেÑ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এখন কী ধরনের প্রভাব পড়বে। উল্লেখ্য, গত ১৯ জানুয়ারি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ-মায়ানমার-চীন ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমান বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের শুরুতেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, সেই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে কিনা নাকি আবারও প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চিত সৃষ্টি হবেÑ সে প্রশ্নই সবার কাছে এখন প্রতিভাত হয়েছে।

অতি সম্প্রতি জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ, ইউপিআর ব্যবস্থায় মায়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনায় ১১২টি দেশের প্রতিনিধিদের অধিকাংশই এবার দুটি বিষয়ের প্রতি জোর দিয়েছেন; যার একটি হলো রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতির জন্য অত্যাবশ্যক জাতিগত বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন এবং অপরটি হলো কফি আনানের নেতৃত্বাধীন রাখাইন পরামর্শক কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর পরিচালিত নিরাপত্তা অভিযানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগ ওঠার পর জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায় এটিই প্রথম দেশটির সর্বজনীন মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনা।

বাংলাদেশও জাতিসংঘের কোনো ফোরামে এই প্রথমবারের মতো স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করার জন্য মায়ানমারের প্রতি আহ্বান জানাল। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তদন্তকারী এবং স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ারকেও অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়ার কথা বলেছে। আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় বাংলাদেশ শুরু থেকে সহযোগিতা দিয়ে এসেছে ঠিকই, তবে তা ততটা খোলাসা করে নয়। ওই মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার আহ্বানে বাংলাদেশ সাড়া দেয়নি। এবারই এ বিষয়ে অবস্থান এতটা খোলাসা হলো। তবে এ কথাও এখন অন্য সবাইকে বলা জরুরি যে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলকরণের নিন্দা ও বিচারকে সমর্থন না করা মানবতাবিরোধী অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়ারই শামিল। কানাডা ও নেদারল্যান্ডস আইসিজের মামলায় পক্ষ ভুক্ত হওয়ার আবেদন করার কথা জানিয়েছে। আর যুক্তরাজ্যও মামলায় সহায়তা দেয়ার কথা বলেছে। এসব কারণে যৌক্তিকভাবেই ধারণা করা চলে যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মায়ানমার থেকে নির্মূল করার অভিযানের জবাবদিহি আদায়ে আন্তর্জাতিক আদালতের প্রাথমিক সাফল্য অন্যান্য দেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দেওয়া এবং প্রত্যাবাসনেই বিশ্ব সম্প্রদায়ের লক্ষ্য সীমাবদ্ধ নয়। প্রত্যাবাসনের অগ্রাধিকার ক্ষুণœ হোক, সেটা কারও কাম্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ বিষয়ে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বরে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই করার পর তিন বছরে একজনেরও প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। শুরু থেকেই চীন, রাশিয়া ও ভারত রোহিঙ্গা সংকটকে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ এবং একটি মানবিক সমস্যা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে এসেছে। তারা এখনো দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেই শরণার্থী সমস্যার সমাধানের কথাই বলে চলেছেন। চীনের মধ্যস্থতার ভূমিকার কথাও নতুন নয়, তবে সেই ত্রিপক্ষীয় আলোচনা আয়োজনে সময় লেগেছে তিন বছর। নাগরিকত্বের স্বীকৃতির প্রশ্ন মীমাংসা ছাড়া প্রত্যাবাসন প্রশ্নে কোনো মধ্যস্থতা কাজে আসবে- এমন আশাবাদের যে কোনো ভিত্তি নেই, যা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। মায়ানমার চার দশক ধরে রোহিঙ্গাদের বাঙালি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার ধারাবাহিক চেষ্টা চালিয়ে আসছে।

বাংলাদেশ তাই রাখাইন কমিশনের সুপারিশমালা পুরোপুরি বাস্তবায়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি লাভের যে সুস্পষ্ট ব্যবস্থার কথা জেনেভায় বলেছে, তা অর্জনেও আন্তর্জাতিক আদালতের অর্ন্তর্বতী আদেশ প্রতিপালনের ওপর জোর দেয়া প্রয়োজন। রোহিঙ্গা সংকট প্রশ্নে চীন ও ভারতের অবস্থান যে একটুও বদলায়নি, তারও প্রমাণ মিলেছে জেনেভার এ আলোচনায়। দুই দেশের প্রতিনিধিই রোহিঙ্গা সংকটের কোনো উল্লেখ না করে দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে মায়ানমার সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। চীন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং ভারত ১ জানুয়ারি থেকে অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দুই বছরের মেয়াদ শুরু করেছে। সুতরাং নিরাপত্তা পরিষদে শিগগিরই যে কোনো ধরনের কার্যকর সহায়তা মিলবে, এমন সম্ভাবনা ক্ষিণ। মায়ানমার মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিবরণ তুলে ধরলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্ন কিংবা আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার বিষয়ে সরাসরি কোনো অঙ্গীকার বা উদ্যোগের কথা বলেনি। তবে দেশটি আদালতের অন্তর্বর্তী নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিষয়ে সময়মতো প্রতিবেদন পেশ করেছে। আদালতের নির্দেশ নামানার বিষয়ে কতটা সততা অথবা চাতুরির আশ্রয় নেয়া হচ্ছে তা অবশ্য জানার কোনো উপায় নেই। কেননা আদালত তা প্রকাশ করেননি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে এগুলো প্রকাশ করার দাবি উঠেছে, যাতে তার সত্যাসত্য যাচাই সম্ভব হয়। পাশাপাশি আলাদাভাবে আইসিসির তদন্তও অব্যাহত আছে। আইনগত এসব প্রক্রিয়া যতই ত্বরান্বিত হবে, মিয়ানমার যে ততই সমাধানের চাপ অনুভব করবে, সে রকমই আভাস মেলে।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থান দেয়া কোন স্থায়ী সমাধান নয, বরং এটি একটি সাময়িক আশ্রয়। তাই সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে যে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে আশ্রয় দেয়ার অর্থ তাদের সেখানে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করা নয়। একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে কোন নৃগোষ্ঠীর এরকম লাখ লাখ মানুষকে কোন শাসকগোষ্ঠী দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে দেশত্যাগে বাধ্য করা মোটামুটি একটি বিরল ঘটনা। আর মায়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে যদি বাধ্য না হয়, তা হবে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত। আগামীতেও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন নৃগোষ্ঠীর মানুষ সম্বন্ধে ক্ষোভ, ভীতি, ঘৃণা ছডিয়ে বিভিন্ন রকম অত্যাচার নিপীড়ন চালিয়ে তাদের ব্যাপক আকারে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারে, যা শুধু সেই দেশ বা অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যাহত করবে না, বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তাকেও ব্যাহত করতে পারে। সাম্প্রতিক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত ও উদ্ভূত পরিস্থিতির ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে মায়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থা সমুন্নত থাকার আশা প্রকাশ করে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছায়, নিরাপদ এবং টেকসই প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াগুলো চলমান থাকবে বলে বাংলাদেশ আশা করে।

[লেখক : অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটি]

সোমবার, ২৬ এপ্রিল ২০২১ , ১৩ বৈশাখ ১৪২৮ ১৩ রমজান ১৪৪২

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কি থমকে গেল?

মিহির কুমার রায়

গত ১ ফেব্রুয়ারি সোমবার মায়ানমারে অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) পার্টির নেতৃত্বাধীন দল গত নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে শতকরা ৮৩ ভাগ ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেও তিন মাস অতিবাহিত হতে না হতেই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারির পর বাংলাদেশের সামনে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছেÑ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এখন কী ধরনের প্রভাব পড়বে। উল্লেখ্য, গত ১৯ জানুয়ারি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ-মায়ানমার-চীন ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমান বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের শুরুতেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, সেই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে কিনা নাকি আবারও প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চিত সৃষ্টি হবেÑ সে প্রশ্নই সবার কাছে এখন প্রতিভাত হয়েছে।

অতি সম্প্রতি জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ, ইউপিআর ব্যবস্থায় মায়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনায় ১১২টি দেশের প্রতিনিধিদের অধিকাংশই এবার দুটি বিষয়ের প্রতি জোর দিয়েছেন; যার একটি হলো রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতির জন্য অত্যাবশ্যক জাতিগত বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন এবং অপরটি হলো কফি আনানের নেতৃত্বাধীন রাখাইন পরামর্শক কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর পরিচালিত নিরাপত্তা অভিযানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগ ওঠার পর জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায় এটিই প্রথম দেশটির সর্বজনীন মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনা।

বাংলাদেশও জাতিসংঘের কোনো ফোরামে এই প্রথমবারের মতো স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করার জন্য মায়ানমারের প্রতি আহ্বান জানাল। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তদন্তকারী এবং স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ারকেও অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়ার কথা বলেছে। আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় বাংলাদেশ শুরু থেকে সহযোগিতা দিয়ে এসেছে ঠিকই, তবে তা ততটা খোলাসা করে নয়। ওই মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ার আহ্বানে বাংলাদেশ সাড়া দেয়নি। এবারই এ বিষয়ে অবস্থান এতটা খোলাসা হলো। তবে এ কথাও এখন অন্য সবাইকে বলা জরুরি যে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলকরণের নিন্দা ও বিচারকে সমর্থন না করা মানবতাবিরোধী অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়ারই শামিল। কানাডা ও নেদারল্যান্ডস আইসিজের মামলায় পক্ষ ভুক্ত হওয়ার আবেদন করার কথা জানিয়েছে। আর যুক্তরাজ্যও মামলায় সহায়তা দেয়ার কথা বলেছে। এসব কারণে যৌক্তিকভাবেই ধারণা করা চলে যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মায়ানমার থেকে নির্মূল করার অভিযানের জবাবদিহি আদায়ে আন্তর্জাতিক আদালতের প্রাথমিক সাফল্য অন্যান্য দেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দেওয়া এবং প্রত্যাবাসনেই বিশ্ব সম্প্রদায়ের লক্ষ্য সীমাবদ্ধ নয়। প্রত্যাবাসনের অগ্রাধিকার ক্ষুণœ হোক, সেটা কারও কাম্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ বিষয়ে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বরে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই করার পর তিন বছরে একজনেরও প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। শুরু থেকেই চীন, রাশিয়া ও ভারত রোহিঙ্গা সংকটকে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ এবং একটি মানবিক সমস্যা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে এসেছে। তারা এখনো দ্বিপক্ষীয় আলোচনাতেই শরণার্থী সমস্যার সমাধানের কথাই বলে চলেছেন। চীনের মধ্যস্থতার ভূমিকার কথাও নতুন নয়, তবে সেই ত্রিপক্ষীয় আলোচনা আয়োজনে সময় লেগেছে তিন বছর। নাগরিকত্বের স্বীকৃতির প্রশ্ন মীমাংসা ছাড়া প্রত্যাবাসন প্রশ্নে কোনো মধ্যস্থতা কাজে আসবে- এমন আশাবাদের যে কোনো ভিত্তি নেই, যা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। মায়ানমার চার দশক ধরে রোহিঙ্গাদের বাঙালি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার ধারাবাহিক চেষ্টা চালিয়ে আসছে।

বাংলাদেশ তাই রাখাইন কমিশনের সুপারিশমালা পুরোপুরি বাস্তবায়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি লাভের যে সুস্পষ্ট ব্যবস্থার কথা জেনেভায় বলেছে, তা অর্জনেও আন্তর্জাতিক আদালতের অর্ন্তর্বতী আদেশ প্রতিপালনের ওপর জোর দেয়া প্রয়োজন। রোহিঙ্গা সংকট প্রশ্নে চীন ও ভারতের অবস্থান যে একটুও বদলায়নি, তারও প্রমাণ মিলেছে জেনেভার এ আলোচনায়। দুই দেশের প্রতিনিধিই রোহিঙ্গা সংকটের কোনো উল্লেখ না করে দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে মায়ানমার সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন। চীন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং ভারত ১ জানুয়ারি থেকে অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দুই বছরের মেয়াদ শুরু করেছে। সুতরাং নিরাপত্তা পরিষদে শিগগিরই যে কোনো ধরনের কার্যকর সহায়তা মিলবে, এমন সম্ভাবনা ক্ষিণ। মায়ানমার মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিবরণ তুলে ধরলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্ন কিংবা আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার বিষয়ে সরাসরি কোনো অঙ্গীকার বা উদ্যোগের কথা বলেনি। তবে দেশটি আদালতের অন্তর্বর্তী নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিষয়ে সময়মতো প্রতিবেদন পেশ করেছে। আদালতের নির্দেশ নামানার বিষয়ে কতটা সততা অথবা চাতুরির আশ্রয় নেয়া হচ্ছে তা অবশ্য জানার কোনো উপায় নেই। কেননা আদালত তা প্রকাশ করেননি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে এগুলো প্রকাশ করার দাবি উঠেছে, যাতে তার সত্যাসত্য যাচাই সম্ভব হয়। পাশাপাশি আলাদাভাবে আইসিসির তদন্তও অব্যাহত আছে। আইনগত এসব প্রক্রিয়া যতই ত্বরান্বিত হবে, মিয়ানমার যে ততই সমাধানের চাপ অনুভব করবে, সে রকমই আভাস মেলে।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থান দেয়া কোন স্থায়ী সমাধান নয, বরং এটি একটি সাময়িক আশ্রয়। তাই সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে যে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে আশ্রয় দেয়ার অর্থ তাদের সেখানে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করা নয়। একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে কোন নৃগোষ্ঠীর এরকম লাখ লাখ মানুষকে কোন শাসকগোষ্ঠী দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে দেশত্যাগে বাধ্য করা মোটামুটি একটি বিরল ঘটনা। আর মায়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিতে যদি বাধ্য না হয়, তা হবে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত। আগামীতেও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন নৃগোষ্ঠীর মানুষ সম্বন্ধে ক্ষোভ, ভীতি, ঘৃণা ছডিয়ে বিভিন্ন রকম অত্যাচার নিপীড়ন চালিয়ে তাদের ব্যাপক আকারে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারে, যা শুধু সেই দেশ বা অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যাহত করবে না, বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তাকেও ব্যাহত করতে পারে। সাম্প্রতিক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত ও উদ্ভূত পরিস্থিতির ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে মায়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থা সমুন্নত থাকার আশা প্রকাশ করে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছায়, নিরাপদ এবং টেকসই প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াগুলো চলমান থাকবে বলে বাংলাদেশ আশা করে।

[লেখক : অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটি]