করোনাকালে প্রান্তিকজন

করোনায় জীবন চলে না নৌকার মাঝি হোসেন আর রজব আলীর

মো. হোসেন, বাড়ি বরিশালের মেহেদীগঞ্জে। আরেকজন মো. রজব আলী, বাড়ি মাদীপুরের কালকিনিতে। দুইজনেরই বয়স ৭৫ এর কাছাকাছি। দুজনই সদরঘাটের মাঝি। তাদের গোটা জীবনটাই কেটে গেল সদরঘাটে। জীবিকার তাগিদে ভোরের আলো জেগে উঠার আগেই তারা বুড়িগঙ্গার বুকে ভাসিয়ে দেন নৌকা। তাদের জীবনটাও যেন নদীর সঙ্গে বাঁধা পড়ে গেছে। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে তাদের জীবনে নেমে এসেছে জীবিকার অন্ধকার। মহামারী লকডাউনে তাদের উপার্জন কমছে। সারাদিন নৌকা চালিয়ে যা আয় করেন তা দিয়ে কোনমতে আর সংসার চলে না। গত রোববার সদরঘাটে সংবাদের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় জানালেন তার সুখ-দুঃখ এবং ফেলে আসা অতীতের নানা কথা।

মো. হোসেন জানান, ১৯৮৬ সালে থেকে এই ঘাটে নৌকা চালাচ্ছি। শুধু নৌকাই চালাইলাম, বিনিময়ে কিছুই পেলাম না। কোনমতে পেটে-ভাতে চলছে জীবন। দিনে যা আয় করি, তার বেশির ভাগই চাল-ডাল কিনতে ব্যয় হয়ে যায়। দিন শেষে আর কিছু থাকে না।

তিনি জানান, বয়সকালে সারাদিন নৌকা চালিয়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করতাম। এখন বয়সে কারণে আর পারি না। অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে এখন আর আগের মতো শক্তি পাই না। এক দিন চালাই তো পরের দিন বৈঠা হাতে নেয়ার শক্তি পাই না।

এখন কত টাকা আয় করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মো. হোসেন জানান, এখন লকডাউনের কারণে অবস্থা খুবই খারাপ। এই যেমন আজকে এই বেলা পর্যন্ত ১২০ টাকা আয় করেছি। তিনি জানান, কাজ না থাকলে মাঝে মাঝে না খেয়েও থাকি। এই লকডাউনে কাজ নেই, ইনকাম নেই। খুবই কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। গত বছর লকডাউনে সরকারি-বেসরকারিভাবে কিছুটা সহযোগিতা পেলেও এই লকডাউনে কিছুই পাচ্ছি না। কোনরকম ধার-উধার করে একবেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছি।’

আরেক নৌকার মাঝি রজব আলী বলেন, অনেক দিন ধইরা নৌকা চালাই। আগে রোজগার ভালা আছিল, সংসারে কোন অভাব আছিল না। বাবা, অহন বড় দুঃখে আছি, ৭৫ বছর বয়স, অহন নৌকা বাইয়া সংসার চালাইতে পারি না। সারাদিন নাও চালাই, কখনও খেয়ে আবার কখনও না খেয়ে দিন পার করছি।

রজব আলী জানান, এ ঘাটে ৪৫-৫০ বছর ধরে খেয়াপার করছি। এ পেশায় থেকেই সন্তানদের বিয়া দিছি। সংসার চালাইছি। কিন্তু এহন জীবন চলা দায়, রোজগার নেই। শরীরে নানা অসুখ বাসা বেঁধেছে, ওষুধ খাওয়ার টাহা নেই। সন্তানরা যে যার মতো চলছে। এভাবে জীবন থাইমা যাবে এমন চিন্তাও কখনও করি নাই ।

তিনি বলেন, একটা সময় ছিল এ ঘাট দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ চলাচল করত। তখন খুব ব্যস্ত সময় পাড় করছি। আয়ও হতো ভালো। ভবিষ্যতের কথা ভাবি নাই। এহন বুছতেছি জীবনে কত্ত ভুল করছি।

রজব আলী হতাশ কণ্ঠে বলেন, এই বয়সে শরীর আর কুলায় না। কিন্তু কাম না করলে খামু কী? গত বছর লকডাউনে সরকারি-বেসরকারিভাবে কিছুটা সহযোগিতা পেলেও এই লকডাউনে কিছুই পাইতেছি না। কোনরকম ধার-উধার করে একবেলা খেয়ে দিন কাটাইতাছি।

মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল ২০২১ , ১৪ বৈশাখ ১৪২৮ ১৪ রমজান ১৪৪২

করোনাকালে প্রান্তিকজন

করোনায় জীবন চলে না নৌকার মাঝি হোসেন আর রজব আলীর

গোলাম মোস্তফা

image

মো. হোসেন, বাড়ি বরিশালের মেহেদীগঞ্জে। আরেকজন মো. রজব আলী, বাড়ি মাদীপুরের কালকিনিতে। দুইজনেরই বয়স ৭৫ এর কাছাকাছি। দুজনই সদরঘাটের মাঝি। তাদের গোটা জীবনটাই কেটে গেল সদরঘাটে। জীবিকার তাগিদে ভোরের আলো জেগে উঠার আগেই তারা বুড়িগঙ্গার বুকে ভাসিয়ে দেন নৌকা। তাদের জীবনটাও যেন নদীর সঙ্গে বাঁধা পড়ে গেছে। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে তাদের জীবনে নেমে এসেছে জীবিকার অন্ধকার। মহামারী লকডাউনে তাদের উপার্জন কমছে। সারাদিন নৌকা চালিয়ে যা আয় করেন তা দিয়ে কোনমতে আর সংসার চলে না। গত রোববার সদরঘাটে সংবাদের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় জানালেন তার সুখ-দুঃখ এবং ফেলে আসা অতীতের নানা কথা।

মো. হোসেন জানান, ১৯৮৬ সালে থেকে এই ঘাটে নৌকা চালাচ্ছি। শুধু নৌকাই চালাইলাম, বিনিময়ে কিছুই পেলাম না। কোনমতে পেটে-ভাতে চলছে জীবন। দিনে যা আয় করি, তার বেশির ভাগই চাল-ডাল কিনতে ব্যয় হয়ে যায়। দিন শেষে আর কিছু থাকে না।

তিনি জানান, বয়সকালে সারাদিন নৌকা চালিয়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করতাম। এখন বয়সে কারণে আর পারি না। অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে এখন আর আগের মতো শক্তি পাই না। এক দিন চালাই তো পরের দিন বৈঠা হাতে নেয়ার শক্তি পাই না।

এখন কত টাকা আয় করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মো. হোসেন জানান, এখন লকডাউনের কারণে অবস্থা খুবই খারাপ। এই যেমন আজকে এই বেলা পর্যন্ত ১২০ টাকা আয় করেছি। তিনি জানান, কাজ না থাকলে মাঝে মাঝে না খেয়েও থাকি। এই লকডাউনে কাজ নেই, ইনকাম নেই। খুবই কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। গত বছর লকডাউনে সরকারি-বেসরকারিভাবে কিছুটা সহযোগিতা পেলেও এই লকডাউনে কিছুই পাচ্ছি না। কোনরকম ধার-উধার করে একবেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছি।’

আরেক নৌকার মাঝি রজব আলী বলেন, অনেক দিন ধইরা নৌকা চালাই। আগে রোজগার ভালা আছিল, সংসারে কোন অভাব আছিল না। বাবা, অহন বড় দুঃখে আছি, ৭৫ বছর বয়স, অহন নৌকা বাইয়া সংসার চালাইতে পারি না। সারাদিন নাও চালাই, কখনও খেয়ে আবার কখনও না খেয়ে দিন পার করছি।

রজব আলী জানান, এ ঘাটে ৪৫-৫০ বছর ধরে খেয়াপার করছি। এ পেশায় থেকেই সন্তানদের বিয়া দিছি। সংসার চালাইছি। কিন্তু এহন জীবন চলা দায়, রোজগার নেই। শরীরে নানা অসুখ বাসা বেঁধেছে, ওষুধ খাওয়ার টাহা নেই। সন্তানরা যে যার মতো চলছে। এভাবে জীবন থাইমা যাবে এমন চিন্তাও কখনও করি নাই ।

তিনি বলেন, একটা সময় ছিল এ ঘাট দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ চলাচল করত। তখন খুব ব্যস্ত সময় পাড় করছি। আয়ও হতো ভালো। ভবিষ্যতের কথা ভাবি নাই। এহন বুছতেছি জীবনে কত্ত ভুল করছি।

রজব আলী হতাশ কণ্ঠে বলেন, এই বয়সে শরীর আর কুলায় না। কিন্তু কাম না করলে খামু কী? গত বছর লকডাউনে সরকারি-বেসরকারিভাবে কিছুটা সহযোগিতা পেলেও এই লকডাউনে কিছুই পাইতেছি না। কোনরকম ধার-উধার করে একবেলা খেয়ে দিন কাটাইতাছি।