করোনাকালে প্রান্তিকজন

বন্ধ ছাপাখানা-বাঁধাইখানা, দিন চলে না ফরহাদ-রেজাউলের

পুরান ঢাকার বইপাড়ার বিভিন্ন গলি ছাপাখানা আর বই বাঁধাইখানার মেশিনের খটখট শব্দে মুখর থাকত। এখন সেই শব্দ-দৃশ্য আর নেই। করোনার ছোবলে ওলট-পালট হয়ে গেছে সব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বার বন্ধ। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে ছাপাখানা আর বাঁধাইখানার কর্মকা-। এর সঙ্গে বেকার হয়ে পড়েছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিপুলসংখ্যক মালিক-শ্রমিক। অনেক ছাপাখানার মালিকের দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। তেমনি দুইজন হলেন ফরহাদ হোসেন সাজু ও রেজাউল করিম রিপন। লক্ষ্মীবাজারের আল-কাদের অফসেট প্রিন্টার্সের পরিচালক ফরহাদ হোসেন সাজু আর বাংলাবাজার রূপচান দাস লেনে মায়ের দোয়া বুক বাইন্ডিং কারখানার মালিক রেজাউল করিম রিপন।

করোনায় কারখানার কাজকর্ম না থাকায় দু’জনই চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। স্কুল ও কলেজ বন্ধ মানেই প্রকাশক, প্রেস এবং বইবাঁধাই শিল্প বন্ধ। শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এই ব্যবসা। করোনার কারণে গত বছরের মার্চ মাস থেকে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় বইবাঁধাই ছাপাখানার ব্যবসাও বন্ধ। আর ব্যবসা না থাকায় চরম অর্থ সংকটে রয়েছে তারা, তাদের মতো অনেকেই।

দুই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীই সংবাদকে জানান, করোনার আগে অনেক কাজ আসত, করোনায় সবকিছু গ্রাস করে ফেলেছে, এখন লোকজন ছাপাখানামুখী হচ্ছেন না। ফলে চরম অর্থ সংকটে রয়েছেন তারা। করোনা মহামারীর কারণে এই ব্যবসা না থাকায় এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। নীরবে কান্না ছাড়া কোন উপায় দেখছেন না তারা।

লক্ষ্মীবাজারের আল-কাদের অফসেট প্রিন্টার্সের মালিক ফরহাদ হোসেন সাজু জানান, স্কুল-কলেজ বন্ধ মানেই আমাদের ব্যবসা বন্ধ। এক বছরের বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তক কিনছে না। নতুন বই বাজারে বের হচ্ছে না। প্রকাশকরাও নতুন বই ছাপার প্রয়োজন বোধ করছেন না। সেই সঙ্গে আমরাও চরম সংকটে পড়ে গেছি। ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে নিয়মিতই। এভাবে আর কতদিন টিকে থাকতে পারব তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছি।

ফরহাদ হোসেন সাজু বলেন, প্রতিবছর একটা আশায় থাকিÑ বইমেলা নিয়ে। কারণ মেলা উপলক্ষে প্রচুর বই ছাপার অর্ডার আসে আমাদের কাছে। এবার সেই ব্যবসা করতে পারিনি। একুশের মেলায় অল্পকিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকরাই এবার ব্যবসা করতে পারেনি তাহলে আমাদের টাকা দেবে কীভাবে। তিনি বলেন, আমরা চরম বিপদে আছি।

মায়ের দোয়া বুক বাইন্ডিংয়ের কর্ণধার মো. রেজাউল করিম রিপন জানান, ১৯৮৬ সাল দেশের এক নামকরা প্রেসে সাগরেদ হিসেবে কাজ শুরু করি। সেই সাগরেদ থেকে এখন আমি এই প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছি। এই ব্যবসা শুরু করতে আমার ব্যাংক থেকে লোন নিতে হয়েছে এবং স্ত্রীর গহনাও বিক্রি করতে হয়েছে। এত কষ্ট করে এই ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি। আর এখন এই এক বছরে এতটাই লোকসানে পড়েছি যে, মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় আত্মহত্যা করি। যেহেতু আমি মানুষ তাই বাধ্য হয়ে এই নিকৃষ্ট কাজটি করতে পারছি না।

সংবাদের এ প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, করোনার শুরু থেকেই আমি আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছি। সেই সঙ্গে আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরাও পড়েছেন চরম বিপাকে। গত কয়েক মাস ধরে বেতন দিতে পারছি না। ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল দিতে পারছি না। তাছাড়া ব্যাংক লোন পরিশোধ করার জন্যও চাপ দিচ্ছে। এক কথায় সব মিলিয়ে চরম হতাশা মধ্যে পড়ে আছি। এখনই শুধু নয়, ভবিষ্যৎও অন্ধকার দেখছি।

রেজাউল করিম রিপন বলেন, ৩৬ বছর ধরে আমি এই ব্যবসার করে আসছি। কত উত্থান-পতন দেখলাম কিন্তু করোনা মহামারী সময় যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে এমন খারাপ অবস্থা কখনোই দেখিনি। আমার পরিচিত অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে, অনেকে অন্য পেশায় চলে গেছে, এখনও যাচ্ছে। এটা আমার জন্য কত কষ্টের তা কাউকে বোঝাতে পারব না। তিনি বলেন, অন্য খাতের ব্যবসায়ীরা সরকারি প্রণোদনা পেলেও বঞ্চিত হচ্ছেন বই ব্যবসায়ীরা। আত্ম-সম্মানের খাতিরে অন্যের দারস্থও হতে পারেন না তারা। অন্য ব্যবসায়ীদের মতো পুস্তক ব্যবসায়ীদের জন্য যেন প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা থাকে সরকারের কাছে সেই দাবি করেন রিপন।

বুধবার, ২৮ এপ্রিল ২০২১ , ১৫ বৈশাখ ১৪২৮ ১৫ রমজান ১৪৪২

করোনাকালে প্রান্তিকজন

বন্ধ ছাপাখানা-বাঁধাইখানা, দিন চলে না ফরহাদ-রেজাউলের

গোলাম মোস্তফা

image

পুরান ঢাকার বইপাড়ার বিভিন্ন গলি ছাপাখানা আর বই বাঁধাইখানার মেশিনের খটখট শব্দে মুখর থাকত। এখন সেই শব্দ-দৃশ্য আর নেই। করোনার ছোবলে ওলট-পালট হয়ে গেছে সব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বার বন্ধ। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে ছাপাখানা আর বাঁধাইখানার কর্মকা-। এর সঙ্গে বেকার হয়ে পড়েছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিপুলসংখ্যক মালিক-শ্রমিক। অনেক ছাপাখানার মালিকের দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। তেমনি দুইজন হলেন ফরহাদ হোসেন সাজু ও রেজাউল করিম রিপন। লক্ষ্মীবাজারের আল-কাদের অফসেট প্রিন্টার্সের পরিচালক ফরহাদ হোসেন সাজু আর বাংলাবাজার রূপচান দাস লেনে মায়ের দোয়া বুক বাইন্ডিং কারখানার মালিক রেজাউল করিম রিপন।

করোনায় কারখানার কাজকর্ম না থাকায় দু’জনই চরম সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। স্কুল ও কলেজ বন্ধ মানেই প্রকাশক, প্রেস এবং বইবাঁধাই শিল্প বন্ধ। শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এই ব্যবসা। করোনার কারণে গত বছরের মার্চ মাস থেকে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় বইবাঁধাই ছাপাখানার ব্যবসাও বন্ধ। আর ব্যবসা না থাকায় চরম অর্থ সংকটে রয়েছে তারা, তাদের মতো অনেকেই।

দুই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীই সংবাদকে জানান, করোনার আগে অনেক কাজ আসত, করোনায় সবকিছু গ্রাস করে ফেলেছে, এখন লোকজন ছাপাখানামুখী হচ্ছেন না। ফলে চরম অর্থ সংকটে রয়েছেন তারা। করোনা মহামারীর কারণে এই ব্যবসা না থাকায় এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। নীরবে কান্না ছাড়া কোন উপায় দেখছেন না তারা।

লক্ষ্মীবাজারের আল-কাদের অফসেট প্রিন্টার্সের মালিক ফরহাদ হোসেন সাজু জানান, স্কুল-কলেজ বন্ধ মানেই আমাদের ব্যবসা বন্ধ। এক বছরের বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তক কিনছে না। নতুন বই বাজারে বের হচ্ছে না। প্রকাশকরাও নতুন বই ছাপার প্রয়োজন বোধ করছেন না। সেই সঙ্গে আমরাও চরম সংকটে পড়ে গেছি। ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে নিয়মিতই। এভাবে আর কতদিন টিকে থাকতে পারব তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছি।

ফরহাদ হোসেন সাজু বলেন, প্রতিবছর একটা আশায় থাকিÑ বইমেলা নিয়ে। কারণ মেলা উপলক্ষে প্রচুর বই ছাপার অর্ডার আসে আমাদের কাছে। এবার সেই ব্যবসা করতে পারিনি। একুশের মেলায় অল্পকিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকরাই এবার ব্যবসা করতে পারেনি তাহলে আমাদের টাকা দেবে কীভাবে। তিনি বলেন, আমরা চরম বিপদে আছি।

মায়ের দোয়া বুক বাইন্ডিংয়ের কর্ণধার মো. রেজাউল করিম রিপন জানান, ১৯৮৬ সাল দেশের এক নামকরা প্রেসে সাগরেদ হিসেবে কাজ শুরু করি। সেই সাগরেদ থেকে এখন আমি এই প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছি। এই ব্যবসা শুরু করতে আমার ব্যাংক থেকে লোন নিতে হয়েছে এবং স্ত্রীর গহনাও বিক্রি করতে হয়েছে। এত কষ্ট করে এই ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি। আর এখন এই এক বছরে এতটাই লোকসানে পড়েছি যে, মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় আত্মহত্যা করি। যেহেতু আমি মানুষ তাই বাধ্য হয়ে এই নিকৃষ্ট কাজটি করতে পারছি না।

সংবাদের এ প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, করোনার শুরু থেকেই আমি আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছি। সেই সঙ্গে আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরাও পড়েছেন চরম বিপাকে। গত কয়েক মাস ধরে বেতন দিতে পারছি না। ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল দিতে পারছি না। তাছাড়া ব্যাংক লোন পরিশোধ করার জন্যও চাপ দিচ্ছে। এক কথায় সব মিলিয়ে চরম হতাশা মধ্যে পড়ে আছি। এখনই শুধু নয়, ভবিষ্যৎও অন্ধকার দেখছি।

রেজাউল করিম রিপন বলেন, ৩৬ বছর ধরে আমি এই ব্যবসার করে আসছি। কত উত্থান-পতন দেখলাম কিন্তু করোনা মহামারী সময় যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে এমন খারাপ অবস্থা কখনোই দেখিনি। আমার পরিচিত অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে, অনেকে অন্য পেশায় চলে গেছে, এখনও যাচ্ছে। এটা আমার জন্য কত কষ্টের তা কাউকে বোঝাতে পারব না। তিনি বলেন, অন্য খাতের ব্যবসায়ীরা সরকারি প্রণোদনা পেলেও বঞ্চিত হচ্ছেন বই ব্যবসায়ীরা। আত্ম-সম্মানের খাতিরে অন্যের দারস্থও হতে পারেন না তারা। অন্য ব্যবসায়ীদের মতো পুস্তক ব্যবসায়ীদের জন্য যেন প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা থাকে সরকারের কাছে সেই দাবি করেন রিপন।