লকডাউনে বেপরোয়া খেয়াঘাটের ইজারাদার

চার টাকার ভাড়া ৩০ টাকা

সরকার ঘোষিত লকডাউন বরিশালের খেয়াঘাটগুলোর ইজারাদারদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। নদী পারাপারে যাত্রীদের জিম্মি করে ইজারাদাররা আগেই নির্ধারিত রেটের অতিরিক্ত টাকা আদায় করত। যাত্রীরা বাধ্য হয়ে তা মেনেও নিয়েছেন আর খেয়া পারাপারের জন্য যেসব সংস্থা ইজারা দিচ্ছেন তারা জেনেশুনেই যাত্রীদের কাছ অতিরিক্ত টাকা আদায়ের জন্য প্রতিবছর নিলাম ডাকের আয়োজন করে অর্থ উপার্জন করত।

বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাবে লকডাউন শুরুর পর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন খেয়াঘাটের ইজারাদারা। প্রতিজনের নির্ধারিত ৪ টাকার ভাড়া এখন ৩০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে আর যদি মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহন পারাপার করতে হয় তাহলে কমপক্ষে ৫০ টাকা ভাড়া নেয়া হওয়া হয়। বরিশাল জেলা পরিষদের আওতাধীন ৯টি খেয়াঘাটের সবটিতেই একই অবস্থা বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদেরই নির্বাচিত সদস্যরা।

জানা গেছে, প্রত্যেকটি খেয়াঘাটের ইজারাদার ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারা কেউ কেউ নিজেরাই খেয়ার ব্যবস্থা করেন। নতুবা উপ-ইজারা দিয়ে আগেই লাভের টাকা হাতিয়ে নেন। যেহেতু সরকারি দলের নেতা উপনেতারা ইজারাদার তাই তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে পারছেন না ভুক্তভোগী যাত্রীরা। প্রতিবাদ করলে নাজেহাল হতে হয় তাদের। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং যাত্রী নাজেহালের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ইজারাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা নির্ধারিত হারে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে এমন কোন নজির আজ পর্যন্ত দেখাতে পারবে না বরিশাল জেলা পরিষদ। তাদের এই রহস্যজনক আচরণে ক্ষুব্ধ সব মহল।  

বাবুগঞ্জ উপজেলা সদরের অদূরে কেদারপুর খেয়াঘাট দিয়ে যাতায়াত করেন এই উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের জনগণ। সন্ধ্যা নদীর এই শাখা নদীটিতে এক তীরে দাঁড়িয়ে জোরে কথা বললে অপর তীর থেকে শোনা যায়। এরকম চওড়া নদীটি পার করতে জনপ্রতি ৩০ টাকা ভাড়া নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কেদারপুর ইউনিয়ন ছাত্র সমাজের সাবেক সভাপতি শওকত হোসেন সুমন জানান, লকডাউন শুরুর পর কেদারপুর খেয়াঘাটে যাত্রী পারাপারে ২০-৩০ টাকা করে ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এর আগে নেয়া হতো ১০ টাকা করে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় প্রায়শই যাত্রীদের লাঞ্ছিত করছেন খেয়াঘাটের ইজাদারের লোকজন। বিষয়টি তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপুকে লিখিতভাবে জানালেও কোন প্রতিকার পাননি।

কেদারপুর ইউপি সদস্য রোকন হোসেন বলেন, সন্ধ্যা নদীর কেদারপুর খেয়ায় ইজারাদারদের ট্রলারে ২০ টাকা এবং লকডাউনের অজুহাতে বিশেষ খেয়ার কথা বলে ৩০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন এ খেয়াঘাট দিয়ে ৪ থেকে ৫ হাজার যাত্রী নদী পারাপার করেন। জেলা পরিষদের নির্ধারিত ভাড়া হচ্ছে জনপ্রতি ৪ টাকা।

একই অবস্থা উপজেলার শেষ প্রান্ত বরিশাল-মুলাদী-হিজলা সড়কের মীরগঞ্জ ফেরিঘাটে। ইজারাদারের নির্ধারিত ট্রলারে পারাপারে জনপ্রতি ভাড়া নেয়া হয় ১০ টাকা। ইজারাদারের ট্রলার বন্ধ রেখে বিশেষ ট্রলারের (রিজার্ভ) অজুহাত দেখিয়ে ২০ থেকে ৩০ টাকা করে ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এ খেয়াঘাটেও জেলা পরিষদের নির্ধারিত ভাড়া হচ্ছে জনপ্রতি ৪ টাকা করে।

বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আমীনুল ইসলাম তার উপজেলার দুটি খেয়াঘাটে এই অনিয়মের কথা জানিয়ে বলেন, কেদারপুর ও মীরগঞ্জ দুটি খেয়াঘাটেই তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালত পাঠিয়েছিলেন কিন্তু যাত্রীরা প্রকাশ্যে ইজারাদারের ভয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার কথা স্বীকার করেন না। যে কারণে তারা কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেননি। তবে দুইদিন আগে মীরগঞ্জ ফেরিঘাটের ইজারাদারকে তিনি জরিমানা করেছেন। তবে তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, খেয়াঘাটের ইজারাদাতা জেলা পরিষদ। তারা সবকিছু জেনে শুনেও রহস্যজনক কারণে নীরব রয়েছেন।  

বাকেরগঞ্জ উপজেলার কাটাদিয়া গ্রামের এক স্কুলশিক্ষক জানান, তিনি কয়েকদিন আগে বরিশাল-বাউফল সড়কের বাকেরগঞ্জের গোমা সেতু পার হয়েছেন। এ সময় তার কাছ থেকে ২০ টাকা ভাড়া নেয়া হয়েছে। লকডাউনের আগে নেয়া হতো ১০ টাকা করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা পরিষদের এই খেয়াঘাটেরও নির্ধারিত যাত্রীভাড়া ৫ টাকা। গোমা পয়েন্টে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ফেরিতে পারাপার হলেও খেয়াঘাটের ইজারাদারদের ভাড়া দিতে হয়।

এসব প্রসঙ্গ জানতে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মইদুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অবশ্য নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির ফোন ব্যতীত কারও ফোন না ধরা তার স্বভাব। প্যানেল চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান আরজু বলেন, খেয়াঘাটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রীদের লাঞ্ছিত করার বিষয়টি একাধিকবার পরিষদের সভায় আলোচনা হলেও চেয়ারম্যান প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে সদস্যদের আশ^াস দিলেও কোন পদক্ষেপ নেননি। একই কথা বলেন জেলা পরিষদ সদস্য ও বরিশাল পূর্বাঞ্চলীয় উন্নয়ন পরিষদের আহ্বায়ক সরকারদলীয় নেতা মো. মুনাওয়ারুল ইসলাম অলি। তিনি বলেন, তার ভাইকে কয়েকদিন আগে গোমা খেয়াঘাটে মোটরসাইকেল পার করতে ৫০ টাকা দিতে হয়েছে। অলির মতে, খেয়াঘাটের নৈরাজ্যকর অবস্থা এমনটা দাঁড়িয়েছে যে, এখন ইজারা প্রথা বাতিল করে খেয়াঘাট উন্মুক্ত করে দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

বুধবার, ২৮ এপ্রিল ২০২১ , ১৫ বৈশাখ ১৪২৮ ১৫ রমজান ১৪৪২

লকডাউনে বেপরোয়া খেয়াঘাটের ইজারাদার

চার টাকার ভাড়া ৩০ টাকা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, বরিশাল

সরকার ঘোষিত লকডাউন বরিশালের খেয়াঘাটগুলোর ইজারাদারদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। নদী পারাপারে যাত্রীদের জিম্মি করে ইজারাদাররা আগেই নির্ধারিত রেটের অতিরিক্ত টাকা আদায় করত। যাত্রীরা বাধ্য হয়ে তা মেনেও নিয়েছেন আর খেয়া পারাপারের জন্য যেসব সংস্থা ইজারা দিচ্ছেন তারা জেনেশুনেই যাত্রীদের কাছ অতিরিক্ত টাকা আদায়ের জন্য প্রতিবছর নিলাম ডাকের আয়োজন করে অর্থ উপার্জন করত।

বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাবে লকডাউন শুরুর পর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন খেয়াঘাটের ইজারাদারা। প্রতিজনের নির্ধারিত ৪ টাকার ভাড়া এখন ৩০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে আর যদি মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহন পারাপার করতে হয় তাহলে কমপক্ষে ৫০ টাকা ভাড়া নেয়া হওয়া হয়। বরিশাল জেলা পরিষদের আওতাধীন ৯টি খেয়াঘাটের সবটিতেই একই অবস্থা বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদেরই নির্বাচিত সদস্যরা।

জানা গেছে, প্রত্যেকটি খেয়াঘাটের ইজারাদার ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারা কেউ কেউ নিজেরাই খেয়ার ব্যবস্থা করেন। নতুবা উপ-ইজারা দিয়ে আগেই লাভের টাকা হাতিয়ে নেন। যেহেতু সরকারি দলের নেতা উপনেতারা ইজারাদার তাই তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে পারছেন না ভুক্তভোগী যাত্রীরা। প্রতিবাদ করলে নাজেহাল হতে হয় তাদের। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং যাত্রী নাজেহালের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ইজারাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা নির্ধারিত হারে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে এমন কোন নজির আজ পর্যন্ত দেখাতে পারবে না বরিশাল জেলা পরিষদ। তাদের এই রহস্যজনক আচরণে ক্ষুব্ধ সব মহল।  

বাবুগঞ্জ উপজেলা সদরের অদূরে কেদারপুর খেয়াঘাট দিয়ে যাতায়াত করেন এই উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের জনগণ। সন্ধ্যা নদীর এই শাখা নদীটিতে এক তীরে দাঁড়িয়ে জোরে কথা বললে অপর তীর থেকে শোনা যায়। এরকম চওড়া নদীটি পার করতে জনপ্রতি ৩০ টাকা ভাড়া নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কেদারপুর ইউনিয়ন ছাত্র সমাজের সাবেক সভাপতি শওকত হোসেন সুমন জানান, লকডাউন শুরুর পর কেদারপুর খেয়াঘাটে যাত্রী পারাপারে ২০-৩০ টাকা করে ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এর আগে নেয়া হতো ১০ টাকা করে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করায় প্রায়শই যাত্রীদের লাঞ্ছিত করছেন খেয়াঘাটের ইজাদারের লোকজন। বিষয়টি তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপুকে লিখিতভাবে জানালেও কোন প্রতিকার পাননি।

কেদারপুর ইউপি সদস্য রোকন হোসেন বলেন, সন্ধ্যা নদীর কেদারপুর খেয়ায় ইজারাদারদের ট্রলারে ২০ টাকা এবং লকডাউনের অজুহাতে বিশেষ খেয়ার কথা বলে ৩০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। প্রতিদিন এ খেয়াঘাট দিয়ে ৪ থেকে ৫ হাজার যাত্রী নদী পারাপার করেন। জেলা পরিষদের নির্ধারিত ভাড়া হচ্ছে জনপ্রতি ৪ টাকা।

একই অবস্থা উপজেলার শেষ প্রান্ত বরিশাল-মুলাদী-হিজলা সড়কের মীরগঞ্জ ফেরিঘাটে। ইজারাদারের নির্ধারিত ট্রলারে পারাপারে জনপ্রতি ভাড়া নেয়া হয় ১০ টাকা। ইজারাদারের ট্রলার বন্ধ রেখে বিশেষ ট্রলারের (রিজার্ভ) অজুহাত দেখিয়ে ২০ থেকে ৩০ টাকা করে ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এ খেয়াঘাটেও জেলা পরিষদের নির্ধারিত ভাড়া হচ্ছে জনপ্রতি ৪ টাকা করে।

বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আমীনুল ইসলাম তার উপজেলার দুটি খেয়াঘাটে এই অনিয়মের কথা জানিয়ে বলেন, কেদারপুর ও মীরগঞ্জ দুটি খেয়াঘাটেই তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালত পাঠিয়েছিলেন কিন্তু যাত্রীরা প্রকাশ্যে ইজারাদারের ভয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার কথা স্বীকার করেন না। যে কারণে তারা কোন আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেননি। তবে দুইদিন আগে মীরগঞ্জ ফেরিঘাটের ইজারাদারকে তিনি জরিমানা করেছেন। তবে তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, খেয়াঘাটের ইজারাদাতা জেলা পরিষদ। তারা সবকিছু জেনে শুনেও রহস্যজনক কারণে নীরব রয়েছেন।  

বাকেরগঞ্জ উপজেলার কাটাদিয়া গ্রামের এক স্কুলশিক্ষক জানান, তিনি কয়েকদিন আগে বরিশাল-বাউফল সড়কের বাকেরগঞ্জের গোমা সেতু পার হয়েছেন। এ সময় তার কাছ থেকে ২০ টাকা ভাড়া নেয়া হয়েছে। লকডাউনের আগে নেয়া হতো ১০ টাকা করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা পরিষদের এই খেয়াঘাটেরও নির্ধারিত যাত্রীভাড়া ৫ টাকা। গোমা পয়েন্টে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ফেরিতে পারাপার হলেও খেয়াঘাটের ইজারাদারদের ভাড়া দিতে হয়।

এসব প্রসঙ্গ জানতে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মইদুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অবশ্য নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির ফোন ব্যতীত কারও ফোন না ধরা তার স্বভাব। প্যানেল চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান আরজু বলেন, খেয়াঘাটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রীদের লাঞ্ছিত করার বিষয়টি একাধিকবার পরিষদের সভায় আলোচনা হলেও চেয়ারম্যান প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে সদস্যদের আশ^াস দিলেও কোন পদক্ষেপ নেননি। একই কথা বলেন জেলা পরিষদ সদস্য ও বরিশাল পূর্বাঞ্চলীয় উন্নয়ন পরিষদের আহ্বায়ক সরকারদলীয় নেতা মো. মুনাওয়ারুল ইসলাম অলি। তিনি বলেন, তার ভাইকে কয়েকদিন আগে গোমা খেয়াঘাটে মোটরসাইকেল পার করতে ৫০ টাকা দিতে হয়েছে। অলির মতে, খেয়াঘাটের নৈরাজ্যকর অবস্থা এমনটা দাঁড়িয়েছে যে, এখন ইজারা প্রথা বাতিল করে খেয়াঘাট উন্মুক্ত করে দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।