বাঙালি প্রতিভার অন্যতম সেরা আইকন

কামরুল ইসলাম

যে ক’জন বাঙালি মনীষী বাঙালির ভাষা, শিল্প, ঐতিহ্য এবং তার পূর্ণ অবয়বের চিত্র বিশ্বদরবারে তুলে ধরে বাঙালিকে গৌরাবান্বিত করেছেন, তাঁদের মধ্যে সত্যজিৎ রায় অন্যতম। মাত্র ২ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হয়ে পড়েন। তাঁর পিতা উপমহাদেশের বিশিষ্ট ছড়াকার ও কিশোর সাহিত্যের পুরোধা সুকুমার রায় মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মারা যান। এর পর সংসারের নানান টানাপড়েনে তাঁরা মামার বাড়িতে চলে যান। তারপর তাঁর মা সুপ্রভা রায় একটি স্কুলে চাকরি নেন এবং সূচিশিল্পও করতেন সংসারের অনটন মেটাতে। রবীন্দ্রনাথের পরেই এই বাঙালি প্রতিভা আমাদের চিরকালের সুখ-দুঃখকে স্পর্শ করেছেন চলচ্চিত্রের শিল্পিত বাতাবরনে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল তাঁর অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। রবীন্দ্রনাথ একসময় পশ্চিমেও খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলেন, কিন্তু তারপর আর নয়। কেন? লিন্ডসে অ্যান্ডার্সনের এরকম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন- ‘প্রথমত আমি মনে করি রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদ করা অসম্ভব। ভারতবর্ষের অনেক পরিচালকই রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বন করে ছবি করেছেন। আর তাঁর লেখা নভেলের চেয়ে ছোটগল্পকে ছবি করা সহজ। আমি নিজেও তাই করি।’

অর্থনীতির ছাত্র। শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন ফাইন আর্টস শিখতে। সেখানে তিনি আড়াই বছর ছিলেন। তিনি যখন শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়েছিলেন ১৯৪০ সালে তখন রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে ১৯৪৩ সালে ২২ বছর বয়সে আর্টিস্ট হিসেবে একটি বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে চাকরি নেন। তিনি এমন এক পরিবারে জন্মেছিলেন, যে পরিবারে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে সহজেই জড়িয়ে পড়া যায়। বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জের জমিদার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর নাতি এবং সুকুমার রায়-এর পুত্র তিনি। উল্লেখ্য, সুকুমার রায়ের সাথে রবীন্দ্রনাথের ভালো সখ্য ছিল। সঙ্গীত মৃত্যু-যন্ত্রণাও ভোলাতে পারে কিংবা ভয়াবহ মৃত্যুর হাতছানিও হয়ে যেতে পারে শান্তি পারাবার, আর যে কারণে মৃত্যু পথযাত্রী সুকুমার রায় রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেন ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ গানটি তাঁর নিজ কণ্ঠে তাঁকে শোনানোর জন্য- রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাড়িতে গিয়ে শয্যার পাশে বসে গানটি শুনিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর পিতা সুকুমার রায় থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক সংলাপ বানিয়েছিলেন।

উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী নিজেও লেখক ছিলেন, ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞও, আর সুকুমার রায়-এর কথা আর আলাদা করে বলার দরকার নেই। এই চলচ্চিত্রের কবির জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এই সামান্য লেখার আয়োজন। ১৯৯২ সালে বিশেষ ক্যাাটাগরিতে অস্কার লাভ করে তিনি ভারতবর্ষকে সম্মানিত করেছেন এবং নিজেও পৃথিবীর সেরা চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে নাম লিখিয়েছেন। অবশ্য এর আগেই তিনি পৃথিবীজুড়ে চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষদের কাছে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন এবং নানা সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হন। কোলকাতার ফিল্ম সোটাইটি প্রতিষ্ঠায় তাঁর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। সত্যি বলতে কি তাঁর মতো এত বড় মাপের পরিচালক ভারতবর্ষে আর একটা আছে বলে আমার মনে হয় না।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন- ‘আমি বুদ্ধিজীবী পরিচালক নই। যা আমি ঠিক মনে করি, তাই করি। পরিচালনা, অভিনয়, সঙ্গীত- আমার ছবির প্রতিটি ক্ষেত্রে এটা মেনে চলি। আমি নিজেকে বাঙালি পরিচালক মনে করি।’ শ্যাম বেনেগালের মতে, ‘সত্যজিৎ রায়ই হচ্ছেন একমাত্র ভারতীয় চলচ্চিত্রকার যিনি ছবি করেছেন ভারতীয় পদ্ধতিতে।’ যেকারণে তাঁর ছবিগুলো বিভিন্ন ভাষায় ডাবিং করে দেখানো

হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ, বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, দারিদ্র্য এবং তাদের জীবনের গল্পকে শিল্পের আবরণে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন- বাংলায় আমার সবকিছু। ওরা আমাকে হিন্দি ছবি করতে বলেছে, কিন্তু আমার পক্ষে হিন্দি ছবি করা সম্ভব নয়; (যদিও তিনি পরে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ী’ নামে হিন্দি ছবি বানিয়েছিলেন এবং ১৯৭৭ সালে শ্রেষ্ঠ হিন্দি ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন)। আমেরিকান পরিচালক কেমন করে ইউরোপিয়ান ছবি করতে পারেন, তা আমি বুঝি না। বুঝতে পারি না। শুধু ভাষা নয় প্রকাশভঙ্গিও। একজন বাঙালি কথা বলার সময়ে যেভাবে হাত নাড়েন তার সঙ্গে ভারতের অন্য কোনো প্রদেশের লোকের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি যা জানি তাই নিয়ে ছবি করতে পারি। আমার কাছে সবচেয়ে দরকারি ব্যাপার হলো ভাষা।’

শিল্প-সঙ্গীতের সব ক্ষেত্রেই তার অবাধ বিচরণ ছিল। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- ‘তিনকন্যা’র পরে আমি নিজেই সঙ্গীত পরিচালনা করি। তিনি শিল্প নির্দেশকও ছিলেন। তার আগে রবিশঙ্কর, বিলায়েত খাঁ, এবং আলি আকবর খাঁকে দিয়ে কাজ করিয়েছিলেন। ছবিতে আসার আগে থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। তিনি লিখেছেন- ‘পাশ্চাত্য সংগীতের কাছে আমার অজ¯্র ঋণ। প্রথমবার যখন ইউরোপে যাই, আমি মোজার্ট ফেস্টিভ্যালে যোগদান করব স্থির করি।... আমি যখন স্কুলে পড়ি আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে পেয়ে গেলাম বিটোফেনের একটা রেকর্ড। এই মহান শিল্পীর সংগীত শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বিটোফেন সম্পর্কে যেখানে যত লেখা পেলাম সব পড়ে ফেললাম। কলেজে ঢোকার আগে থেকেই আমি পাশ্চাত্য মার্গ-সঙ্গীতের রেকর্ড সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। আমার ছবিতে সিম্ফনি বা সোনাটার যথেষ্ট প্রভাব আছে। চারুলতা’র জন্য অবিরাম ভেবেছি মোজার্টের কথা।’ ভারতীয় ছবির মন্থর গতির কথা রায় গর্ভভরেই স্বীকার করেছেন। ইউরোপীয় ছবির সাথে এইখানেই যে আমাদের পার্থক্য তা তিনি ভালোভাবেই বুঝতেন।

বিজ্ঞাপণ সংস্থায় কাজ করার সুবাদে তাঁর মধ্যে চলচ্চিত্র পরিচালনার এক সুপ্ত বাসনা আগে থেকেই ছিল এবং তিনি সে বিষযে যথেষ্ট পড়াশোনাও করেছিলেন। ১৯৫০ সালে ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়া কোলকাতায় এসেছিলেন ‘দি রিভার’ ছবির স্যুটিং করার জন্যে। ওই সময়ে তাঁর সুযোগ হয় এই বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারের সাথে সাক্ষাতের। জাঁ রেনোয়া কোলকাতায় এসে এক নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করেছিলেন। কলকাতার গঙ্গা, ছোট ছোট পালতোলা নৌকো, কয়লাখনি ইত্যাদি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- কলকাতা তাঁর কেমন লাগছে। তিনি বলেছিলেন আপাতত আমি শুধু কোলকাতা শহরটা বোঝার চেষ্টা করছি। তিনি বলেছিলেন আদিম যুগের সরলতা ও সৌন্দর্য এখনো ভারতে আছে। মাঝিদের দাঁড়টানা, চাষিদের হালচষা, এবং গাঁয়ের মেয়েদের জল আনতে যাওয়া ইত্যাদির মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন মুগ্ধতার রসদ। তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন এইসব মানুষ নিয়ে নিশ্চয় ছবি তৈরি হবে। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন- না, ওদের নিয়ে কোনোদিনই ছবি হবে না। আমাদের দেশের পরিচালকরা হলিউডের চকচকে কায়দার ছবি করা পছন্দ করেন। জাঁ রেনোয়া বলেছিলেন, কোনো দেশের সঙ্কটকালেই ভালোছবি তৈরি হয়। তিনি যুদ্ধের সময়ের একটি ইতালীয় ছবির উদাহরণ দিয়েছিলেন।

যুদ্ধে আহত হয়ে তিনি যখন হাসপাতাল ছেড়ে চলে আসার পথে সেসময়ে জাঁ রেনোয়া সিনেমা নিয়ে ভাবতে থাকেন। কিছুদিন সাংবাদিকতা করার পর তিনি এই ব্যাপারে সক্রিয় হন। প্যারি থেকে হলিউডে চলে আসেন এবং আমেরিকান নাগরিক হয়ে যান। বিশ্ববরেণ্য এই চলচ্চিত্র-প্রতিভার মুখোমুখি হয়ে এবং তার সহকারি হিসেবে কাজ করে মি. রায় চলচ্চিত্র নিয়ে নতুন ভাবনার একটি ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। সত্যজিত রায় ছিলেন গভীর মননশীল ও বহুমুখী জানালাখোলা বিদগ্ধ শিল্পী। তিনি জাঁ রেনোয়ার মতো ধীর স্থিরভাবে দেখেন আবার দেখেন এবং ঘটনার একেবারে ভেতরে ঢুকে অবলোকন করেন সবকিছু। জাঁ রেনোয়ার ‘দি সাউদার্নার’ তাঁকে প্রভাবিত করেছিল বেশি। চলচ্চিত্রের একটি নিজস্ব ভাষা আছে এবং আমার মনে হয় চলচ্চিত্র এমনই এক শিল্প যা একজন পরিচালকের অনেকগুলো চোখ একসঙ্গে উচ্চাঙ্গের না হলে তা বিস্তৃত পরিসরে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না। জাঁ রেনোয়া তাঁকে বলেছিলেন, হলিউডি ব্যপার-স্যাাপার ঝেড়ে ফেলতে পারলে এদেেেশও ভালো ছবি করা সম্ভব। সত্যজিৎ তাঁর এই উপদেশ মনে রেখেছিলেন। ১৯৫০ সালের পর পাঁচবছর তিনি নিজেকে নানাভাবে প্রস্তুত করেছেন এবং ১৯৫৫ সালে নির্মাণ করেন ‘পথের পাঁচালী’। উল্লেখ্য রবার্ট ফ্লেহার্টির ‘নানুক অব দ্য নর্থ’ও তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ভিট্টোরিও ডিসিকার ‘বাইসাইকেল থিফ’ দেখেও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি জীবনে হলিউড চিত্রনির্মাতাদের বহু ছবি দেখেছেন।

বিজ্ঞাপণের কাজে লন্ডন অফিসে গিয়েছিলেন এবং কাজ শেষে ফেরার পথে তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র চিত্রনাট্যের কাজ শুরু করেন। তিনি মনে করতেন বাংলাসাহিত্যের সেইসব গল্প নিয়ে তিনি কাজ করবেন যা শিল্পমানে উৎকৃষ্ট এবং যার মধ্যে বিশদ ভাবনার জায়গা রয়েছে। এক অসম্ভব শিল্পভাবনার চিত্রায়ন করতে চাইলেন তিনি। এই ছবি করতে গিয়ে তাঁকে অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়তে হয় দারুণভাবে। এসময় তিনি স্ত্রীর গহনা, মূল্যবান বই-পুস্তক, ফোনোগ্রাফ রেকর্ডসহ অনেক প্রিয় জিনিস বিক্রি করে দেন। তাতেও যথন হচ্ছিল না, তখন তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাহায্য নিয়েছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের জীর্ণ-দশা এবং আবোল-তাবোল থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলেন, তা ছিল একধরনের বিপ্লব এবং অনেক সমালোচকই তাঁকে চরচ্চিত্রের নতুন যুগস্রষ্টা হিসেবে মনে করেন। ‘অপু ট্রিলজি’ তাঁকে জগদ্বিখ্যাত করে। ‘পথের পাঁচালী’ তাঁকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার এনে দেয়। এই ছবিতে তিনি ১১টা পুরস্কার লাভ করেন। পরে ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’।

সত্যজিৎ রায় মনে করতেন- ছবিতে আবেগের মতো শিল্পসম্মত জিনিস আর নেই। কলাকৌশলও প্রয়োজনীয়, কারণ তা ছবির সুষমা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। মজার ব্যাপার হলো সত্যজিৎ রায় যখন ছবি করতে শুরু করেন ৮ জনের একটি টিম করে, তখন এই ৮ জনের একজনের শুধু পূবর্ অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি তাঁর কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করলেন। তিন বছরের বড় মামাতো বোনকে বিয়ে করেছিলেন, যখন হিন্দুদের মধ্যে ফার্স্ট কাজিনকে বিয়ে করা নিষিদ্ধ। যাই হোক, তাঁর এই টানাপড়েনের মধ্যে স্ত্রী বিজয়া রায়ের সহায়তা পেয়েছিলেন নানাভাবে। তিনি তার গহনা বিক্রি করে দিতেও কার্পণ্য করেননি। একটি ভাঙাচোরা ক্যামেরা নিয়ে কাজ শুরু করে বহু কষ্টের মধ্য দিয়ে ২ বছরে কাজটি শেষ করেন কোনোমতে। তিনি লিখেন- কীভাবে পয়সার অভাবে ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, এমন বিরক্তি এসে গিয়েছিল যে চিত্রনাট্যের দিকে তাকালেই রাগ হতো। পরে তিনি করলেন ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’। অনেকের মতে এই ট্রিলজির যে ব্যাপক শিল্পসুষমা ও কাব্যিক সৌন্দর্য তা কেবল ডনস্কয়-এর গোর্কি ট্রিলজির সাথেই তুলনীয়। একজন বিদেশি সমালোচক লিখেছেন- আমার মনে হয়, এই লংট্র্যাক শর্টগুলিই পাঁচালীর ঐন্দ্রজালিক সৌন্দর্য। মিঠাইঅলার পেছনে শিশুটির দৌড়, ট্রেন সিকোয়েন্স, খেলনার বাক্স নিয়ে ঝগড়া করার পর দুর্গার পিছনে মাঠের ওপর দিয়ে অপুর দৌড়ে যাওয়া- আরো কত ঐন্দ্রজালিক মুহূর্ত। সুব্রত মিত্রের ক্যামেরার কাজে যেমন ছিল সত্যজিতের অনুপ্রেরণা, তেমনি রবিশঙ্করও সুন্দর সুরারোপ করতে পারতেন। ছবির শেষের দিকে যখন আমরা দেখি, সুরের মিড়ে মিড়ে যে ক্রন্দন ধ্বনিত হলো দুর্গার মরে যাবার সময় আর ঠোঁট নেড়ে যে নিঃশব্দ কান্না- এক গভীর বেদনার নিবিড়তা যেন জেগে উঠছে জগতের এক নিঃসীম শূন্যতায়। এই যে অভাবনীয় বোধের কারুকাজ, এই যে নিমগ্ন চেতনায় জীবনকে দেখা এবং পৃথিবীর এক অশ্রাব্য সংগীতের অনুধাবন- এসবই সত্যাজিৎ রায়, এক বহুমখী প্রতিভা।

‘অপু ট্রিলজি’র মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবী জয় করলেও ভারতবর্ষে সেসময় তাঁর কোনো মূল্যায়ন হয় নি। অবশ্য একথা ঠিক যে এগিয়ে থাকা প্রতিভাদের সমকাল সেইভাবে নিতেও পারে না। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার ব্যাপারে যদি বলি, তাহলে আরো পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে যে, শেষে তিনি স্যুটকেসে ভরে তার শিল্পকর্ম বিদেশে নিয়ে গেলেন এবং প্রদর্শনী করলেন। তারা তাঁকে প্রশংসা করলেন, নিজ দেশের মানুষ তাঁকে সেসময় বুঝলোই না। আজ আমরা বুঝি যে, আধুনিক চিত্রকলায়ও রবীন্দ্রনাথ অগ্রপথিক ছিলেন। বিদেশে পুরস্কৃত হবার পর ‘পথের পাঁচালী’ দেখতে গিয়েছে লোকজন। তার আগে এ ছবি নিয়ে কারো তেমন আগ্রহ ছিল না। দেখতে পারার একটি আনন্দ আছে। যে যত বেশি দূরে দেখতে পারে, সে তত বেশি আনন্দ পায়, প্রকৃত সত্যকে খুঁজে পায়। আলব্যের কামু বলেছিলেন-Always go too far, because that’s where you’ll find the truth.কারণ জগতের প্রত্যেক প্রাণি ও বস্তুর মধ্যে রয়েছে অপার রহস্য, সেই রহস্যের অবগুণ্ঠন ভেদ করে ভেতরের সিঁড়ি-উপসিঁড়ির সন্ধান পেলে আরো ভেতরে যাওয়া যায়, দেখা যায় অমৃতের উৎসব কিংবা অনন্ত জাগ্রত সত্তার আলোক সম্ভার। তিনি দেখতে শিখেছিলেন কঠোর তপস্যায়, দারিদ্র্যে-দৈন্যে, সাধনার বিপুল অন্বেষায়। তাই তাঁর ছবির যে ঐন্দ্রজালিক রূপ, চরিত্রের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা আরেকটি মুখ, তার মায়াবী নিঃশব্দ বিস্তার- সবই যেন সেই হাতের, সেই মস্তিষ্কের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। অপু জেগে উঠছে। দুর্গা একটি বিয়ে বাড়ি দেখছে। দেওয়ালের দিকে দুজনের দৌড়াদৌড়ি, আর ওদের ঠাকুর মা, শান্তিতে মরে যাওয়ার জন্যে ঘন অরণ্যে প্রবেশ করছেন। অসামান্য এই শিল্পদৃষ্টিতে তিনি জয় করলেন জগৎ। ‘চারুলতা’ বার্লিন উৎসবে সর্বোচ্চ পুরস্কার না পেলেও (যদিও ইংল্যান্ডের সমালোচকরা আশা করেছিলেন) শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান পেয়েছিলেন সত্যজিৎ। ‘মহানগর’ ও ‘চারুলতা’ ছবি দু’টির জন্য পর পর দু’বার তিনি শ্রেষ্ট পরিচালক হিসেবে বিবেচিত হন। অপূর্ব দক্ষতার সাথে তিনি নির্মাণ করেছিলেন ‘জলসাঘর’। এখানে তিনি দেখিয়েছেন এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদারকে যিনি ভালোবাসেন ব্যবসার পরিবর্তে শিল্পকলা।

আমেরিকায় দেখানোর জন্য এডওয়ার্ড হ্যারিসন সত্যজিতের ছবি কেনার পর কোনো হল পেলেন না। আনাড়ি সমালোচকরা অভ্যস্ত-গেথিকে বেরোতে পারলো না। সমালোচকরা বলল, তার ছবি একঘেয়ে, ধীর গতির এবং অনেকটাই বিরক্তিকর। কেউ বলল, চারটি পুরস্কার পেয়েছে বটে, কিন্তু তাতে তো আর ব্যবসা হবে না। এভাবে নানা সমালোচনার পরে যখন নিউইয়র্ক শহরে ‘পথের পাঁচালী’ সাতদিন ধরে চলল তখন সমালোচকরা অনেকটা চুপ মেরে গেল। বিশিষ্ট পরিচালক রবার্ট স্টিল লিখেছেন- আমি প্রথমত এই ছবির (পথের পাঁচালী) প্রশংসা শুনি ১৯৫৫ সালে, কিন্তু দেখার আগ্রহ প্রকাশ করিনি। পরের বছর ছবিটি বোম্বেতে প্রদর্শিত হলে আমি ছবিটি দেখে খুবই মুগ্ধ হই। মহৎ ছবি বলতে যা বোঝায় এই ছবিটি ছিল তাই। ১৯৬২ সালে তিনি প্রথম বাংলা রঙিন ছবি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৬৮ সালে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ফিচার ছবির জন্য তিনি দেশে-বিদেশে অনেক খ্যাতি ও পুরস্কার অর্জন করেন। এই ছবির জন্য ১৯৬৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক এবং ১৯৭০ সালে মেলবোর্ন উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার অর্জন করেন। ‘পথের পাঁচালী’ এবং ‘অশনি সংকেত’ (১৯৭৩) নিয়ে এরকম সমালোচনা হয়েছিল যে তিনি বিদেশে দারিদ্র্য রপ্তানি করছেন এবং ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন। ১৯৭৪ সালে ‘অশনি সংকেত’ ছবির জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। তিনি অন্যান্য পরিচালকের জন্য চিত্রনাট্য তৈরি ও সুরারোপও করেছেন। তাঁর বিপুল প্রতিভার বিস্তৃত পরিসর নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে লেখা হলেও বড়রাও পড়ে আনন্দ পাবেন। অলংকরণ শিল্পী এবং চারুলিপিকার হিসেবেও তার পরিচিতি ছিল। তাঁর ছোটগল্প নিয়ে তিনি নিজে, তাঁর পুত্র সন্দীপ রায় এবং আরো অনেকেই ছবি বানিয়েছেন।

তিনি ‘পথের পাঁচালী’কে ফ্লেহার্টি ফিল্ম সেমিনারে দেখাবার জন্য তদ্বির করেছিলেন। পরে মার্কিন সরকারের ভ্রমণ-সংস্থার সহযোগিতায় সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে সেমিনারে যোগ দেন। উল্লেখ্য, এডওয়ার্ড হ্যারিসন সারা আমেরিকায় এ ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এজন্য তাঁকে অনেক বাধা-বিপত্তি কষ্ট পাড়ি দিতে হয়েছিল। রবার্ট স্টিল বলেছেন- ‘হ্যারিসন না থাকলে এ ছবি মার্কিন মুলুকের কেউ দেখতে পেত না এবং একজন মেধাবী পরিচালক অনেকটা অন্ধকারেই থেকে যেতেন’। মার্কিন সমালোচকরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে সেসময়ে, এক পক্ষের সমালোচনা এরকম ছিল যে, তার ছবি বুঝতে হলে ধড়ে আরেকটি মাথা থাকতে হবে। কেউ বলল, এ ছবির গাঁথুনি এত ঢিলে-ঢালা যে, হলিউডের রাপ-কাটও এর চেয়ে ভালো। অবশ্য সত্যজিৎকে সমর্থন করে যারা কলম ধরেছিলেন তারা এবং সত্যজিৎ রায়েরই বিজয় হয়েছিল শেষমেশ।

আমেরিকায় তখন অনেকে বলতে শুরু করেছেন, বিশেষ করে যারা নিরপেক্ষ চিত্র-সমালোচক, যে, সত্যজিৎ একজন সৎ শিল্পী এবং সমকালীন পরিচালকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। চলচ্চিত্রের একটি আলাদা ভাষা রয়েছে। যে ছবির মধ্যে মানবিকতার দিকগুলো ভেসে ওঠে মৃদুভাস শিল্পের আলোয়, তা দেশ-কাল ভেদে সবার হয়ে যায়, তার সর্বজনীনতা বিস্তৃত হয়ে ওঠে। আমেরিকায় যে সমালোচকের কারণে সত্যজিৎ রায় আরো সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠেন, তাঁর নাম ড্যানিয়েল ট্যালবট। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় চিত্র সমালোচক। তিনি ‘প্রগ্রেসিভ’ নামের একটি কাগজে একটি প্রবন্ধ লিখে সত্যজিৎ-বিরোধী সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন- ‘হলিউডের ছবি ক্রমশই স্থুল থেকে স্থুলতর হচ্ছে। ‘অপুর সংসার’কে মাস্টারপিস বললে কোনো অত্যুক্তি হয় না।... নতুন যুগের শেষ্ঠ পরিচালক সত্যজিৎ মানবতাবাদী, বাস্তবতাবাদী ও রোমান্টিক। সাধারণ মানুষের কথা সাধারণ ঘটনা দিয়ে যেভাবে বোঝাতে পারেন, তা অন্য কোনো পরিচালক পারেন কিনা আমার জানা নেই।’ এইভাবে সত্যজিৎ রায় মার্কিন মুলুকেও শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে স্বীকৃতি পান।

মার্কিন মুলুকে যেভাবে সত্যজিৎকে মূল্যায়ন করা হলো সেভাবে ভারতবর্ষে তিনি মূল্যায়িত হলেন না। এর নানা কারণও রয়েছে। হলিউডের চেয়ে পিছিয়ে পড়া ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে তিনি যেন অনেককাল অচেনাই রয়ে গেলেন। বিদেশি সমালোচকরা গোর্কি ট্রিলজির চেয়ে পথের পাঁচালী ট্রিলজিকে বেশি মূল্যায়িত করেছেন এবং এটি একটি আন্তর্জাতিক ছবি তো বটেই, পৃথিবীর অন্যতম মাস্টাপিস হিসেবে তা চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবে। খুব মিতব্যয়ী পরিচালক ছিলেন তিনি। খুব অল্প কথা এবং অল্প শর্টেই তিনি ধরে ফেলতে পারতেন কোনো ঘটনার বিশালতাকে। জাঁ রেনোয়া কিংবা ডি সিকো’র মতো সত্যজিৎ জীবনের গভীরে দৃষ্টি ফেলতে পারতেন, সে-জীবন যেমনই হোক না কেন।

সত্যজিতের দেবী, জলসাঘর, দুই কন্যা, মহানগর ও চারুলতাও নানাভাবে পৃথিবীর বোদ্ধা সমালোচকরা প্রশংসা করেছেন এবং সত্যজিৎকে একজন উঁচুমানের গল্পকার হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। ‘চারুলতা’কে একজন সমালোচক সূর্যের আলোর মতো পরিচ্ছন্ন ছবি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ছবি তৈরির ক্ষেত্রে সত্যজিতের ইনটেগ্রিটি এবং সত্য প্রকাশের অনির্বচনীয় সাহসকে অনেক বড় করে দেখার কারণ রয়েছে। তিনি যেন ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রকাশ, মানুষের, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের চিরকালের সুখ-দুঃখের কাহিনীকে অসাধারণ শিল্প-নৈপুণ্যে তুলে ধরেছেন। জাপানি চিত্রপরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া একবার বলেছিলেন, ‘যিনি সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র কখনও দেখেননি, তিনি যেন এই পৃথিবীতে বাস করেও সূর্য এবং চন্দ্র দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছেন নিজেকে।’ সত্যজিৎ রায়ের সামগ্রিক কাজ নিয়ে ব্যাপকভাবে কোনো গবেষণামূলক কাজ হয় নি আজও। এই না-হওয়ার পিছনে আমাদের গবেষণার জগতের একধরনের কাঙালিপনাই বলতে হবে।

সত্যজিতের কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু। ১৯৪৭ সালে তাঁর নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ফিল্প সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পর তিনি ফিল্ম তৈরি এবং বিশেষভাবে ইন্ডিয়ান ফিল্মের দুর্বলতাগুলো পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। এসময় তিনি দেশি-বিদেশি অনেক ছবি দেখতে থাকেন এবং নিজে ফিল্ম তৈরির জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তাঁর করা গ্রন্থপ্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন, পোস্টার আমাদের যেমন মুগ্ধ করে তেমনি চিত্রনাট্য তৈরি, পরিচালনা, অভিনেতা নির্বাচন, সেট ডিজাইন, পোশাক, ভারতীয় চলচ্চিত্রের পুরনো ধ্যান-ধারণা ঝেড়ে ফেলে নতুন দিগন্তের উন্মোচন, চলচ্চিত্র সংগীতে নতুনত্ব আনা ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে তাঁর প্রতিভার প্রাবল্য উদ্ভাসিত। পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নিজের নকশায় যে বাড়ি তৈরি করেছিলেন, সেই বাড়িতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতের শ্রেষ্ঠ ছাপাখানা, বাংলার শ্রেষ্ঠ শিশুকিশোর পত্রিকা ‘সন্দেশ’ এখান থেকে প্রকাশিত হতো। এই বাড়িতেই জন্ম হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের। রবীন্দ্রনাথের পরে যে বহুমুখী প্রতিভা সারা পৃথিবীকে মুগ্ধ করেছেন তাঁর সৃজনীশক্তির যাদুতে, তাঁকে শুধু গুটিকয়েক বিশ^বিদ্যালয়ে আটকে রাখলে চলবে না। দু-একটি সেমিনার-সিম্পেজিয়ামেও তাঁকে ধরা যাবে না। তাঁর চলচ্চিত্রের নানা কলাকৌশল নিয়ে বিস্তর গবেষণা ও আলোচনার দ্বার উন্মোচন করা প্রয়োজন। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ ছিলেন বহুমুখী এবং তার কাজের পরিমাণও বিপুল।

তিনি ৩৭টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) ১৯৫৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” পুরস্কার লাভ করায় চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল। পথের পাঁচালী (১৯৫৫), অপরাজিত (১৯৫৬) ও অপুর সংসার (১৯৫৯) এই ট্রিলজি সত্যজিৎ রায়ের শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে বিবেচিত। ইতালীয় নিওরিয়ালিজম তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ইতালীয় চলচ্চিত্র ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’ (বাইসাইকেল চোর) দেখে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহিত হয়েছিলেন, এটি ছিল নিওরিয়ালিস্টিক ছবি। ‘দেবী’ (১৯৬০) তাঁর চতুর্থ ছবি। হিন্দু ধর্মকে বিকৃত করে দেখানো হয়েছে সেন্সর বোর্ড এমনই অভিযোগ তুলেছিল। পরে জহরলাল নেহরুর হস্তক্ষেপে ছবিটি সবার দেখার সুযোগ হয়। ‘নায়ক’ (১৯৬৬) তাঁর একটি বাস্তববাদী ছবি। এই ছবিতে উত্তমকুমারের অভিনয় দেখে মনেই হয় না যে এটা অভিনয়। তাঁর অভিনয় ছিল খুবই বাস্তব ও স্বাভাবিক। এই নায়ক নিঃসঙ্গ এবং ভিড়ের মধ্যেও একা। খ্যাতির অন্তরালের একাকিত্বকে পরিচালক যে শিল্পনৈপুণ্যে তুলে ধরেছেন, তা অনবদ্য। ১৯৮০ সালে নির্মাণ করেন ‘হীরক রাজার দেশে’। এই ছবির জন্য তিনি ১৯৮১ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার পান। চিত্রসমালোচক হল হিনসন ‘আগন্তুক’ (১৯৯১) দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন-Agantuk shows all the virtues of a master artist in full maturity. বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের রুগ্ন শিরায় রক্ত সরবরাহ করে তিনি নতুন যুগের সূচনা করলেন। আমরা বিস্ময়ে দেখলাম সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা’। তিন বয়সের, তিন ভিন্ন চরিত্র মিলে ফেলুদা অ্যান্ড কোং এর মতো ত্রিরত্ন সত্যিই বিস্ময়ের। বিজ্ঞানী প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুও বাঙালি পাঠকের কাছে অত্যন্ত প্রিয় মুখ।

দেশে-বিদেশে তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তিনি ৩২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১টি গোল্ডেন লায়ন, ২টি রৌপ্য ভল্লুক লাভ করেন। ৬ বার তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে তিনি ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামে যে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন তা ছিল তাঁর প্রতিভার অনবদ্য স্বাক্ষর। এই তথ্যচিত্রের জন্য তিনি ১৯৬১ সালে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক এবং লোকার্নো উৎসবে শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র হিসেবে গোল্ডেন শেইল লাভ করেন। পৃথিবীর অনেক চলচ্চিত্র সমালোচকই বলেছেন ‘রবীন্দ্রনাথ’-এর মতো তথ্যচিত্র আর দু-একটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। একজন মহান শিল্প স্রষ্টা ও দ্রষ্টার পরিচয় পাওয়া যায় এই তথ্যচিত্রে। এটি তাঁর সপ্তম ছবি এবং প্রথম পূর্ণাঙ্গ তথ্যচিত্র। এই তথ্যচিত্রে আমরা প্রথমে দেখি রবীন্দ্র-প্রয়াণ, অতঃপর শ্মশানঘাটের দিকে মানুষের ঢল, সেইসাথে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং রবীন্দ্র-প্রতিভার নানান দিকবলয়। এক ঘণ্টার এই তথ্যচিত্রে রবীন্দ্র-জীবনের সাথে দর্শকরা সহজেই নিমগ্ন হয়ে পড়েন।

সত্যজিৎ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টোরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে তাঁকে দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্স থেকে সম্মানসূচক লেজিওঁ দনরে পুরস্কার পান। ১৯৯২ সালে ভারত সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ভারত রতœ সম্মাননা প্রদান করেন। সত্যজিৎ ভারত রতœ এবং পদ্মভূষণসহ সকল মর্যাদাপূর্ণ ভারতীয় পুরস্কার লাভ করেছেন। মৃত্যুর পরে জাপান সরকার তাঁকে আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কারে ভূষিত করেন। ২০০৪ সালে বিবিসির এক জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় তিনি ১৩তম স্থান লাভ করেছিলেন। প্রচণ্ড ধুমপান করতেন, কিন্তু মদ খেতেন না। তিনি কাজকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করতেন এবং রাত দুটোতে ঘুমুতে যেতেন। তাঁর শখ ছিল পুরনো জিনিসপত্র, পাণ্ডুলিপি, গ্রামোফোন রেকর্ডস, পেইন্টিংস, এবং দুর্লভ বই-পত্র সংগ্রহ করা। ১৯৯২ সালে জটিল হৃদরোগ নিয়ে তিনি হাপাতালে ভর্তি হন এবং আর ফিরে আসেন নি। চিত্র সমালোচক আর্থার নাইট ‘স্যাটারডে রিভ্যু’তে অপরাজিত সম্পর্কে লিখেছিলেন- ‘গোড়া থেকেই দেখা যায় চরিত্রের প্রতি রায়ের একটি ভাবনা থাকে। সাধারণ ঘটনাকে তিনি এমনভাবে শিল্পায়িত করেন যে তা মুহূর্তে ইমেজধর্মী কবিতায় পরিণত হয়, কিন্ত বাস্তববোধ এতটুকু মলিন হয় না।’ এই কথা যে কতটা সত্য তা তাঁর ছবিগুলো নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়।

মৃত্যুর মাত্র ২৪ দিন আগে ভিডিও-লিংকের মাধ্যম অড্রে হেপবার্ন তাঁকে অনারেরি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেছিলেন। তিনি তখন খুবই অসুস্থ, তবু তিনি অনেকটা মনের জোরেই এটি গ্রহণের পর সামান্য কিছু কথা বলেছিলেন। তিনি এই পুরস্কারকে অভিহিত করেছিলেন-Best achievement of his movie-making career:দুনিয়ার সমস্ত জরিপেই তাঁকে শ্রেষ্ঠ ফিল্প পরিচালকদের একজন হিসেবে তালিকায় রাখা হয়েছে। সত্যজিৎ রায় পঞ্চাশের দশকেই বিদেশি সমালোচক ও পরিচালকদের কাছে তাঁর যোগ্য সম্মান ও মূল্যায়ন পেলেও দেশে তাঁর যোগ্য মর্যাদা পেতে অনেক দেরি হয়েছে। তার অন্যতম কারণ বোধ হয় চলচ্চিত্র-দর্শন ও শিল্প নিয়ে যোগ্য সমালোচকের অভাব। বাঙালি চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে মৃণাল সেনও একজন বিদগ্ধ ও মননশীল ¯্রষ্টা। তিনি একজন বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ হলেও চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে নির্মাণের ক্ষেত্রে সৎ ছিলেন। সত্যজিৎ সেইভাবে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ ছিলেন না। সমাজ, মানুষ এবং মানুষের অমিত সম্ভাবনা ও মুক্তির সর্বজনীন দর্শনকেই তিনি শিল্পে রূপায়িত করেছেন অনন্য কুশলতায় ও নান্দনিকতায়। অনেককিছু করার ব্যাপক পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তিনি একসময় সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়েও ছবি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সব পরিকল্পনা শেষ হয়ে যায়। ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে সৌমিত্রের বিপরীতে তিনি বাংলাদেশ থেকে ববিতাকে নায়িকা হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন এবং তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

এই পরিসরে এই বিশাল প্রতিভাকে বিস্তৃতভাবে তুলে ধরার কোনো সুযোগ নেই। অস্কার পাওয়ার পর সত্যজিৎকে নিয়ে মৃণাল সেন লিখেছিলেন- ‘... হ্যাঁ, সত্যজিৎ রায় এদেশে এবং হয়ত বা দেশের বাইরেও একেবারে বিতর্কিত নন এমন কথা আমি বলবো না। পৃথিবীর কোথাও কোনো শিল্পেই যেমন বিতর্কের ঊর্ধ্বে কেউ থাকেননি, সত্যজিৎ রায়ও থাকতে পারেননি। বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, কখনো সখনো, পত্রপত্রিকা, সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আসর উত্তপ্ত হয়েছে মাঝে মধ্যেই। প্রয়োজনবোধে আত্মপক্ষ সমর্থনে আমাকেও কঠোর বিরোধীর ভূমিকায় দাঁড়াতে হয়েছে। তবু নান্দনিক বোধ ও জীবনদর্শনের ক্ষেত্রে ছোট বড় মতান্তর সত্ত্বেও একথা নির্দ্বিধায় বলব যে সত্যজিৎ রায় এদেশের এযুগের ক্রান্তিকারী মহৎ শিল্পী এবং বিশ্বচলচ্চিত্রের বিশিষ্ট একজন এবং এই বিশিষ্টতার জন্যই তাঁর এই বিশ্বস্বীকৃতি ও এই বিশেষ অস্কার- মার্কিন অকাডেমির যোগ্যতম সম্মান।’ প্রতীক্ষণ/জানুয়ারি ’৯২)। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল চলচ্চিত্রের এই মহান কবি মৃত্যুবরণ করেন।

বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১ , ১৬ বৈশাখ ১৪২৮ ১৬ রমজান ১৪৪২

বাঙালি প্রতিভার অন্যতম সেরা আইকন

কামরুল ইসলাম

image

সত্যজিৎ রায় / জন্ম : ২ মে ১৯২১; মৃত্যু : ২৩ এপ্রিল ১৯৯২

যে ক’জন বাঙালি মনীষী বাঙালির ভাষা, শিল্প, ঐতিহ্য এবং তার পূর্ণ অবয়বের চিত্র বিশ্বদরবারে তুলে ধরে বাঙালিকে গৌরাবান্বিত করেছেন, তাঁদের মধ্যে সত্যজিৎ রায় অন্যতম। মাত্র ২ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হয়ে পড়েন। তাঁর পিতা উপমহাদেশের বিশিষ্ট ছড়াকার ও কিশোর সাহিত্যের পুরোধা সুকুমার রায় মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মারা যান। এর পর সংসারের নানান টানাপড়েনে তাঁরা মামার বাড়িতে চলে যান। তারপর তাঁর মা সুপ্রভা রায় একটি স্কুলে চাকরি নেন এবং সূচিশিল্পও করতেন সংসারের অনটন মেটাতে। রবীন্দ্রনাথের পরেই এই বাঙালি প্রতিভা আমাদের চিরকালের সুখ-দুঃখকে স্পর্শ করেছেন চলচ্চিত্রের শিল্পিত বাতাবরনে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল তাঁর অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। রবীন্দ্রনাথ একসময় পশ্চিমেও খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলেন, কিন্তু তারপর আর নয়। কেন? লিন্ডসে অ্যান্ডার্সনের এরকম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন- ‘প্রথমত আমি মনে করি রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদ করা অসম্ভব। ভারতবর্ষের অনেক পরিচালকই রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বন করে ছবি করেছেন। আর তাঁর লেখা নভেলের চেয়ে ছোটগল্পকে ছবি করা সহজ। আমি নিজেও তাই করি।’

অর্থনীতির ছাত্র। শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন ফাইন আর্টস শিখতে। সেখানে তিনি আড়াই বছর ছিলেন। তিনি যখন শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়েছিলেন ১৯৪০ সালে তখন রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে ১৯৪৩ সালে ২২ বছর বয়সে আর্টিস্ট হিসেবে একটি বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে চাকরি নেন। তিনি এমন এক পরিবারে জন্মেছিলেন, যে পরিবারে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে সহজেই জড়িয়ে পড়া যায়। বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জের জমিদার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর নাতি এবং সুকুমার রায়-এর পুত্র তিনি। উল্লেখ্য, সুকুমার রায়ের সাথে রবীন্দ্রনাথের ভালো সখ্য ছিল। সঙ্গীত মৃত্যু-যন্ত্রণাও ভোলাতে পারে কিংবা ভয়াবহ মৃত্যুর হাতছানিও হয়ে যেতে পারে শান্তি পারাবার, আর যে কারণে মৃত্যু পথযাত্রী সুকুমার রায় রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেন ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ গানটি তাঁর নিজ কণ্ঠে তাঁকে শোনানোর জন্য- রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাড়িতে গিয়ে শয্যার পাশে বসে গানটি শুনিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর পিতা সুকুমার রায় থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক সংলাপ বানিয়েছিলেন।

উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী নিজেও লেখক ছিলেন, ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞও, আর সুকুমার রায়-এর কথা আর আলাদা করে বলার দরকার নেই। এই চলচ্চিত্রের কবির জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এই সামান্য লেখার আয়োজন। ১৯৯২ সালে বিশেষ ক্যাাটাগরিতে অস্কার লাভ করে তিনি ভারতবর্ষকে সম্মানিত করেছেন এবং নিজেও পৃথিবীর সেরা চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে নাম লিখিয়েছেন। অবশ্য এর আগেই তিনি পৃথিবীজুড়ে চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষদের কাছে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন এবং নানা সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হন। কোলকাতার ফিল্ম সোটাইটি প্রতিষ্ঠায় তাঁর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। সত্যি বলতে কি তাঁর মতো এত বড় মাপের পরিচালক ভারতবর্ষে আর একটা আছে বলে আমার মনে হয় না।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন- ‘আমি বুদ্ধিজীবী পরিচালক নই। যা আমি ঠিক মনে করি, তাই করি। পরিচালনা, অভিনয়, সঙ্গীত- আমার ছবির প্রতিটি ক্ষেত্রে এটা মেনে চলি। আমি নিজেকে বাঙালি পরিচালক মনে করি।’ শ্যাম বেনেগালের মতে, ‘সত্যজিৎ রায়ই হচ্ছেন একমাত্র ভারতীয় চলচ্চিত্রকার যিনি ছবি করেছেন ভারতীয় পদ্ধতিতে।’ যেকারণে তাঁর ছবিগুলো বিভিন্ন ভাষায় ডাবিং করে দেখানো

হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ, বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, দারিদ্র্য এবং তাদের জীবনের গল্পকে শিল্পের আবরণে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন- বাংলায় আমার সবকিছু। ওরা আমাকে হিন্দি ছবি করতে বলেছে, কিন্তু আমার পক্ষে হিন্দি ছবি করা সম্ভব নয়; (যদিও তিনি পরে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ী’ নামে হিন্দি ছবি বানিয়েছিলেন এবং ১৯৭৭ সালে শ্রেষ্ঠ হিন্দি ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন)। আমেরিকান পরিচালক কেমন করে ইউরোপিয়ান ছবি করতে পারেন, তা আমি বুঝি না। বুঝতে পারি না। শুধু ভাষা নয় প্রকাশভঙ্গিও। একজন বাঙালি কথা বলার সময়ে যেভাবে হাত নাড়েন তার সঙ্গে ভারতের অন্য কোনো প্রদেশের লোকের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি যা জানি তাই নিয়ে ছবি করতে পারি। আমার কাছে সবচেয়ে দরকারি ব্যাপার হলো ভাষা।’

শিল্প-সঙ্গীতের সব ক্ষেত্রেই তার অবাধ বিচরণ ছিল। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- ‘তিনকন্যা’র পরে আমি নিজেই সঙ্গীত পরিচালনা করি। তিনি শিল্প নির্দেশকও ছিলেন। তার আগে রবিশঙ্কর, বিলায়েত খাঁ, এবং আলি আকবর খাঁকে দিয়ে কাজ করিয়েছিলেন। ছবিতে আসার আগে থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। তিনি লিখেছেন- ‘পাশ্চাত্য সংগীতের কাছে আমার অজ¯্র ঋণ। প্রথমবার যখন ইউরোপে যাই, আমি মোজার্ট ফেস্টিভ্যালে যোগদান করব স্থির করি।... আমি যখন স্কুলে পড়ি আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে পেয়ে গেলাম বিটোফেনের একটা রেকর্ড। এই মহান শিল্পীর সংগীত শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বিটোফেন সম্পর্কে যেখানে যত লেখা পেলাম সব পড়ে ফেললাম। কলেজে ঢোকার আগে থেকেই আমি পাশ্চাত্য মার্গ-সঙ্গীতের রেকর্ড সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। আমার ছবিতে সিম্ফনি বা সোনাটার যথেষ্ট প্রভাব আছে। চারুলতা’র জন্য অবিরাম ভেবেছি মোজার্টের কথা।’ ভারতীয় ছবির মন্থর গতির কথা রায় গর্ভভরেই স্বীকার করেছেন। ইউরোপীয় ছবির সাথে এইখানেই যে আমাদের পার্থক্য তা তিনি ভালোভাবেই বুঝতেন।

বিজ্ঞাপণ সংস্থায় কাজ করার সুবাদে তাঁর মধ্যে চলচ্চিত্র পরিচালনার এক সুপ্ত বাসনা আগে থেকেই ছিল এবং তিনি সে বিষযে যথেষ্ট পড়াশোনাও করেছিলেন। ১৯৫০ সালে ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়া কোলকাতায় এসেছিলেন ‘দি রিভার’ ছবির স্যুটিং করার জন্যে। ওই সময়ে তাঁর সুযোগ হয় এই বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারের সাথে সাক্ষাতের। জাঁ রেনোয়া কোলকাতায় এসে এক নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করেছিলেন। কলকাতার গঙ্গা, ছোট ছোট পালতোলা নৌকো, কয়লাখনি ইত্যাদি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- কলকাতা তাঁর কেমন লাগছে। তিনি বলেছিলেন আপাতত আমি শুধু কোলকাতা শহরটা বোঝার চেষ্টা করছি। তিনি বলেছিলেন আদিম যুগের সরলতা ও সৌন্দর্য এখনো ভারতে আছে। মাঝিদের দাঁড়টানা, চাষিদের হালচষা, এবং গাঁয়ের মেয়েদের জল আনতে যাওয়া ইত্যাদির মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন মুগ্ধতার রসদ। তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন এইসব মানুষ নিয়ে নিশ্চয় ছবি তৈরি হবে। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন- না, ওদের নিয়ে কোনোদিনই ছবি হবে না। আমাদের দেশের পরিচালকরা হলিউডের চকচকে কায়দার ছবি করা পছন্দ করেন। জাঁ রেনোয়া বলেছিলেন, কোনো দেশের সঙ্কটকালেই ভালোছবি তৈরি হয়। তিনি যুদ্ধের সময়ের একটি ইতালীয় ছবির উদাহরণ দিয়েছিলেন।

যুদ্ধে আহত হয়ে তিনি যখন হাসপাতাল ছেড়ে চলে আসার পথে সেসময়ে জাঁ রেনোয়া সিনেমা নিয়ে ভাবতে থাকেন। কিছুদিন সাংবাদিকতা করার পর তিনি এই ব্যাপারে সক্রিয় হন। প্যারি থেকে হলিউডে চলে আসেন এবং আমেরিকান নাগরিক হয়ে যান। বিশ্ববরেণ্য এই চলচ্চিত্র-প্রতিভার মুখোমুখি হয়ে এবং তার সহকারি হিসেবে কাজ করে মি. রায় চলচ্চিত্র নিয়ে নতুন ভাবনার একটি ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। সত্যজিত রায় ছিলেন গভীর মননশীল ও বহুমুখী জানালাখোলা বিদগ্ধ শিল্পী। তিনি জাঁ রেনোয়ার মতো ধীর স্থিরভাবে দেখেন আবার দেখেন এবং ঘটনার একেবারে ভেতরে ঢুকে অবলোকন করেন সবকিছু। জাঁ রেনোয়ার ‘দি সাউদার্নার’ তাঁকে প্রভাবিত করেছিল বেশি। চলচ্চিত্রের একটি নিজস্ব ভাষা আছে এবং আমার মনে হয় চলচ্চিত্র এমনই এক শিল্প যা একজন পরিচালকের অনেকগুলো চোখ একসঙ্গে উচ্চাঙ্গের না হলে তা বিস্তৃত পরিসরে আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না। জাঁ রেনোয়া তাঁকে বলেছিলেন, হলিউডি ব্যপার-স্যাাপার ঝেড়ে ফেলতে পারলে এদেেেশও ভালো ছবি করা সম্ভব। সত্যজিৎ তাঁর এই উপদেশ মনে রেখেছিলেন। ১৯৫০ সালের পর পাঁচবছর তিনি নিজেকে নানাভাবে প্রস্তুত করেছেন এবং ১৯৫৫ সালে নির্মাণ করেন ‘পথের পাঁচালী’। উল্লেখ্য রবার্ট ফ্লেহার্টির ‘নানুক অব দ্য নর্থ’ও তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ভিট্টোরিও ডিসিকার ‘বাইসাইকেল থিফ’ দেখেও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি জীবনে হলিউড চিত্রনির্মাতাদের বহু ছবি দেখেছেন।

বিজ্ঞাপণের কাজে লন্ডন অফিসে গিয়েছিলেন এবং কাজ শেষে ফেরার পথে তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র চিত্রনাট্যের কাজ শুরু করেন। তিনি মনে করতেন বাংলাসাহিত্যের সেইসব গল্প নিয়ে তিনি কাজ করবেন যা শিল্পমানে উৎকৃষ্ট এবং যার মধ্যে বিশদ ভাবনার জায়গা রয়েছে। এক অসম্ভব শিল্পভাবনার চিত্রায়ন করতে চাইলেন তিনি। এই ছবি করতে গিয়ে তাঁকে অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়তে হয় দারুণভাবে। এসময় তিনি স্ত্রীর গহনা, মূল্যবান বই-পুস্তক, ফোনোগ্রাফ রেকর্ডসহ অনেক প্রিয় জিনিস বিক্রি করে দেন। তাতেও যথন হচ্ছিল না, তখন তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাহায্য নিয়েছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের জীর্ণ-দশা এবং আবোল-তাবোল থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলেন, তা ছিল একধরনের বিপ্লব এবং অনেক সমালোচকই তাঁকে চরচ্চিত্রের নতুন যুগস্রষ্টা হিসেবে মনে করেন। ‘অপু ট্রিলজি’ তাঁকে জগদ্বিখ্যাত করে। ‘পথের পাঁচালী’ তাঁকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার এনে দেয়। এই ছবিতে তিনি ১১টা পুরস্কার লাভ করেন। পরে ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’।

সত্যজিৎ রায় মনে করতেন- ছবিতে আবেগের মতো শিল্পসম্মত জিনিস আর নেই। কলাকৌশলও প্রয়োজনীয়, কারণ তা ছবির সুষমা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। মজার ব্যাপার হলো সত্যজিৎ রায় যখন ছবি করতে শুরু করেন ৮ জনের একটি টিম করে, তখন এই ৮ জনের একজনের শুধু পূবর্ অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি তাঁর কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করলেন। তিন বছরের বড় মামাতো বোনকে বিয়ে করেছিলেন, যখন হিন্দুদের মধ্যে ফার্স্ট কাজিনকে বিয়ে করা নিষিদ্ধ। যাই হোক, তাঁর এই টানাপড়েনের মধ্যে স্ত্রী বিজয়া রায়ের সহায়তা পেয়েছিলেন নানাভাবে। তিনি তার গহনা বিক্রি করে দিতেও কার্পণ্য করেননি। একটি ভাঙাচোরা ক্যামেরা নিয়ে কাজ শুরু করে বহু কষ্টের মধ্য দিয়ে ২ বছরে কাজটি শেষ করেন কোনোমতে। তিনি লিখেন- কীভাবে পয়সার অভাবে ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, এমন বিরক্তি এসে গিয়েছিল যে চিত্রনাট্যের দিকে তাকালেই রাগ হতো। পরে তিনি করলেন ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’। অনেকের মতে এই ট্রিলজির যে ব্যাপক শিল্পসুষমা ও কাব্যিক সৌন্দর্য তা কেবল ডনস্কয়-এর গোর্কি ট্রিলজির সাথেই তুলনীয়। একজন বিদেশি সমালোচক লিখেছেন- আমার মনে হয়, এই লংট্র্যাক শর্টগুলিই পাঁচালীর ঐন্দ্রজালিক সৌন্দর্য। মিঠাইঅলার পেছনে শিশুটির দৌড়, ট্রেন সিকোয়েন্স, খেলনার বাক্স নিয়ে ঝগড়া করার পর দুর্গার পিছনে মাঠের ওপর দিয়ে অপুর দৌড়ে যাওয়া- আরো কত ঐন্দ্রজালিক মুহূর্ত। সুব্রত মিত্রের ক্যামেরার কাজে যেমন ছিল সত্যজিতের অনুপ্রেরণা, তেমনি রবিশঙ্করও সুন্দর সুরারোপ করতে পারতেন। ছবির শেষের দিকে যখন আমরা দেখি, সুরের মিড়ে মিড়ে যে ক্রন্দন ধ্বনিত হলো দুর্গার মরে যাবার সময় আর ঠোঁট নেড়ে যে নিঃশব্দ কান্না- এক গভীর বেদনার নিবিড়তা যেন জেগে উঠছে জগতের এক নিঃসীম শূন্যতায়। এই যে অভাবনীয় বোধের কারুকাজ, এই যে নিমগ্ন চেতনায় জীবনকে দেখা এবং পৃথিবীর এক অশ্রাব্য সংগীতের অনুধাবন- এসবই সত্যাজিৎ রায়, এক বহুমখী প্রতিভা।

‘অপু ট্রিলজি’র মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবী জয় করলেও ভারতবর্ষে সেসময় তাঁর কোনো মূল্যায়ন হয় নি। অবশ্য একথা ঠিক যে এগিয়ে থাকা প্রতিভাদের সমকাল সেইভাবে নিতেও পারে না। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার ব্যাপারে যদি বলি, তাহলে আরো পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে যে, শেষে তিনি স্যুটকেসে ভরে তার শিল্পকর্ম বিদেশে নিয়ে গেলেন এবং প্রদর্শনী করলেন। তারা তাঁকে প্রশংসা করলেন, নিজ দেশের মানুষ তাঁকে সেসময় বুঝলোই না। আজ আমরা বুঝি যে, আধুনিক চিত্রকলায়ও রবীন্দ্রনাথ অগ্রপথিক ছিলেন। বিদেশে পুরস্কৃত হবার পর ‘পথের পাঁচালী’ দেখতে গিয়েছে লোকজন। তার আগে এ ছবি নিয়ে কারো তেমন আগ্রহ ছিল না। দেখতে পারার একটি আনন্দ আছে। যে যত বেশি দূরে দেখতে পারে, সে তত বেশি আনন্দ পায়, প্রকৃত সত্যকে খুঁজে পায়। আলব্যের কামু বলেছিলেন-Always go too far, because that’s where you’ll find the truth.কারণ জগতের প্রত্যেক প্রাণি ও বস্তুর মধ্যে রয়েছে অপার রহস্য, সেই রহস্যের অবগুণ্ঠন ভেদ করে ভেতরের সিঁড়ি-উপসিঁড়ির সন্ধান পেলে আরো ভেতরে যাওয়া যায়, দেখা যায় অমৃতের উৎসব কিংবা অনন্ত জাগ্রত সত্তার আলোক সম্ভার। তিনি দেখতে শিখেছিলেন কঠোর তপস্যায়, দারিদ্র্যে-দৈন্যে, সাধনার বিপুল অন্বেষায়। তাই তাঁর ছবির যে ঐন্দ্রজালিক রূপ, চরিত্রের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা আরেকটি মুখ, তার মায়াবী নিঃশব্দ বিস্তার- সবই যেন সেই হাতের, সেই মস্তিষ্কের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। অপু জেগে উঠছে। দুর্গা একটি বিয়ে বাড়ি দেখছে। দেওয়ালের দিকে দুজনের দৌড়াদৌড়ি, আর ওদের ঠাকুর মা, শান্তিতে মরে যাওয়ার জন্যে ঘন অরণ্যে প্রবেশ করছেন। অসামান্য এই শিল্পদৃষ্টিতে তিনি জয় করলেন জগৎ। ‘চারুলতা’ বার্লিন উৎসবে সর্বোচ্চ পুরস্কার না পেলেও (যদিও ইংল্যান্ডের সমালোচকরা আশা করেছিলেন) শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান পেয়েছিলেন সত্যজিৎ। ‘মহানগর’ ও ‘চারুলতা’ ছবি দু’টির জন্য পর পর দু’বার তিনি শ্রেষ্ট পরিচালক হিসেবে বিবেচিত হন। অপূর্ব দক্ষতার সাথে তিনি নির্মাণ করেছিলেন ‘জলসাঘর’। এখানে তিনি দেখিয়েছেন এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদারকে যিনি ভালোবাসেন ব্যবসার পরিবর্তে শিল্পকলা।

আমেরিকায় দেখানোর জন্য এডওয়ার্ড হ্যারিসন সত্যজিতের ছবি কেনার পর কোনো হল পেলেন না। আনাড়ি সমালোচকরা অভ্যস্ত-গেথিকে বেরোতে পারলো না। সমালোচকরা বলল, তার ছবি একঘেয়ে, ধীর গতির এবং অনেকটাই বিরক্তিকর। কেউ বলল, চারটি পুরস্কার পেয়েছে বটে, কিন্তু তাতে তো আর ব্যবসা হবে না। এভাবে নানা সমালোচনার পরে যখন নিউইয়র্ক শহরে ‘পথের পাঁচালী’ সাতদিন ধরে চলল তখন সমালোচকরা অনেকটা চুপ মেরে গেল। বিশিষ্ট পরিচালক রবার্ট স্টিল লিখেছেন- আমি প্রথমত এই ছবির (পথের পাঁচালী) প্রশংসা শুনি ১৯৫৫ সালে, কিন্তু দেখার আগ্রহ প্রকাশ করিনি। পরের বছর ছবিটি বোম্বেতে প্রদর্শিত হলে আমি ছবিটি দেখে খুবই মুগ্ধ হই। মহৎ ছবি বলতে যা বোঝায় এই ছবিটি ছিল তাই। ১৯৬২ সালে তিনি প্রথম বাংলা রঙিন ছবি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৬৮ সালে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ফিচার ছবির জন্য তিনি দেশে-বিদেশে অনেক খ্যাতি ও পুরস্কার অর্জন করেন। এই ছবির জন্য ১৯৬৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক এবং ১৯৭০ সালে মেলবোর্ন উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার অর্জন করেন। ‘পথের পাঁচালী’ এবং ‘অশনি সংকেত’ (১৯৭৩) নিয়ে এরকম সমালোচনা হয়েছিল যে তিনি বিদেশে দারিদ্র্য রপ্তানি করছেন এবং ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন। ১৯৭৪ সালে ‘অশনি সংকেত’ ছবির জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। তিনি অন্যান্য পরিচালকের জন্য চিত্রনাট্য তৈরি ও সুরারোপও করেছেন। তাঁর বিপুল প্রতিভার বিস্তৃত পরিসর নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে লেখা হলেও বড়রাও পড়ে আনন্দ পাবেন। অলংকরণ শিল্পী এবং চারুলিপিকার হিসেবেও তার পরিচিতি ছিল। তাঁর ছোটগল্প নিয়ে তিনি নিজে, তাঁর পুত্র সন্দীপ রায় এবং আরো অনেকেই ছবি বানিয়েছেন।

তিনি ‘পথের পাঁচালী’কে ফ্লেহার্টি ফিল্ম সেমিনারে দেখাবার জন্য তদ্বির করেছিলেন। পরে মার্কিন সরকারের ভ্রমণ-সংস্থার সহযোগিতায় সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে সেমিনারে যোগ দেন। উল্লেখ্য, এডওয়ার্ড হ্যারিসন সারা আমেরিকায় এ ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এজন্য তাঁকে অনেক বাধা-বিপত্তি কষ্ট পাড়ি দিতে হয়েছিল। রবার্ট স্টিল বলেছেন- ‘হ্যারিসন না থাকলে এ ছবি মার্কিন মুলুকের কেউ দেখতে পেত না এবং একজন মেধাবী পরিচালক অনেকটা অন্ধকারেই থেকে যেতেন’। মার্কিন সমালোচকরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে সেসময়ে, এক পক্ষের সমালোচনা এরকম ছিল যে, তার ছবি বুঝতে হলে ধড়ে আরেকটি মাথা থাকতে হবে। কেউ বলল, এ ছবির গাঁথুনি এত ঢিলে-ঢালা যে, হলিউডের রাপ-কাটও এর চেয়ে ভালো। অবশ্য সত্যজিৎকে সমর্থন করে যারা কলম ধরেছিলেন তারা এবং সত্যজিৎ রায়েরই বিজয় হয়েছিল শেষমেশ।

আমেরিকায় তখন অনেকে বলতে শুরু করেছেন, বিশেষ করে যারা নিরপেক্ষ চিত্র-সমালোচক, যে, সত্যজিৎ একজন সৎ শিল্পী এবং সমকালীন পরিচালকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। চলচ্চিত্রের একটি আলাদা ভাষা রয়েছে। যে ছবির মধ্যে মানবিকতার দিকগুলো ভেসে ওঠে মৃদুভাস শিল্পের আলোয়, তা দেশ-কাল ভেদে সবার হয়ে যায়, তার সর্বজনীনতা বিস্তৃত হয়ে ওঠে। আমেরিকায় যে সমালোচকের কারণে সত্যজিৎ রায় আরো সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠেন, তাঁর নাম ড্যানিয়েল ট্যালবট। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় চিত্র সমালোচক। তিনি ‘প্রগ্রেসিভ’ নামের একটি কাগজে একটি প্রবন্ধ লিখে সত্যজিৎ-বিরোধী সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন- ‘হলিউডের ছবি ক্রমশই স্থুল থেকে স্থুলতর হচ্ছে। ‘অপুর সংসার’কে মাস্টারপিস বললে কোনো অত্যুক্তি হয় না।... নতুন যুগের শেষ্ঠ পরিচালক সত্যজিৎ মানবতাবাদী, বাস্তবতাবাদী ও রোমান্টিক। সাধারণ মানুষের কথা সাধারণ ঘটনা দিয়ে যেভাবে বোঝাতে পারেন, তা অন্য কোনো পরিচালক পারেন কিনা আমার জানা নেই।’ এইভাবে সত্যজিৎ রায় মার্কিন মুলুকেও শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে স্বীকৃতি পান।

মার্কিন মুলুকে যেভাবে সত্যজিৎকে মূল্যায়ন করা হলো সেভাবে ভারতবর্ষে তিনি মূল্যায়িত হলেন না। এর নানা কারণও রয়েছে। হলিউডের চেয়ে পিছিয়ে পড়া ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে তিনি যেন অনেককাল অচেনাই রয়ে গেলেন। বিদেশি সমালোচকরা গোর্কি ট্রিলজির চেয়ে পথের পাঁচালী ট্রিলজিকে বেশি মূল্যায়িত করেছেন এবং এটি একটি আন্তর্জাতিক ছবি তো বটেই, পৃথিবীর অন্যতম মাস্টাপিস হিসেবে তা চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবে। খুব মিতব্যয়ী পরিচালক ছিলেন তিনি। খুব অল্প কথা এবং অল্প শর্টেই তিনি ধরে ফেলতে পারতেন কোনো ঘটনার বিশালতাকে। জাঁ রেনোয়া কিংবা ডি সিকো’র মতো সত্যজিৎ জীবনের গভীরে দৃষ্টি ফেলতে পারতেন, সে-জীবন যেমনই হোক না কেন।

সত্যজিতের দেবী, জলসাঘর, দুই কন্যা, মহানগর ও চারুলতাও নানাভাবে পৃথিবীর বোদ্ধা সমালোচকরা প্রশংসা করেছেন এবং সত্যজিৎকে একজন উঁচুমানের গল্পকার হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। ‘চারুলতা’কে একজন সমালোচক সূর্যের আলোর মতো পরিচ্ছন্ন ছবি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ছবি তৈরির ক্ষেত্রে সত্যজিতের ইনটেগ্রিটি এবং সত্য প্রকাশের অনির্বচনীয় সাহসকে অনেক বড় করে দেখার কারণ রয়েছে। তিনি যেন ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রকাশ, মানুষের, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের চিরকালের সুখ-দুঃখের কাহিনীকে অসাধারণ শিল্প-নৈপুণ্যে তুলে ধরেছেন। জাপানি চিত্রপরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া একবার বলেছিলেন, ‘যিনি সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র কখনও দেখেননি, তিনি যেন এই পৃথিবীতে বাস করেও সূর্য এবং চন্দ্র দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছেন নিজেকে।’ সত্যজিৎ রায়ের সামগ্রিক কাজ নিয়ে ব্যাপকভাবে কোনো গবেষণামূলক কাজ হয় নি আজও। এই না-হওয়ার পিছনে আমাদের গবেষণার জগতের একধরনের কাঙালিপনাই বলতে হবে।

সত্যজিতের কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু। ১৯৪৭ সালে তাঁর নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ফিল্প সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পর তিনি ফিল্ম তৈরি এবং বিশেষভাবে ইন্ডিয়ান ফিল্মের দুর্বলতাগুলো পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। এসময় তিনি দেশি-বিদেশি অনেক ছবি দেখতে থাকেন এবং নিজে ফিল্ম তৈরির জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তাঁর করা গ্রন্থপ্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন, পোস্টার আমাদের যেমন মুগ্ধ করে তেমনি চিত্রনাট্য তৈরি, পরিচালনা, অভিনেতা নির্বাচন, সেট ডিজাইন, পোশাক, ভারতীয় চলচ্চিত্রের পুরনো ধ্যান-ধারণা ঝেড়ে ফেলে নতুন দিগন্তের উন্মোচন, চলচ্চিত্র সংগীতে নতুনত্ব আনা ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে তাঁর প্রতিভার প্রাবল্য উদ্ভাসিত। পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নিজের নকশায় যে বাড়ি তৈরি করেছিলেন, সেই বাড়িতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতের শ্রেষ্ঠ ছাপাখানা, বাংলার শ্রেষ্ঠ শিশুকিশোর পত্রিকা ‘সন্দেশ’ এখান থেকে প্রকাশিত হতো। এই বাড়িতেই জন্ম হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের। রবীন্দ্রনাথের পরে যে বহুমুখী প্রতিভা সারা পৃথিবীকে মুগ্ধ করেছেন তাঁর সৃজনীশক্তির যাদুতে, তাঁকে শুধু গুটিকয়েক বিশ^বিদ্যালয়ে আটকে রাখলে চলবে না। দু-একটি সেমিনার-সিম্পেজিয়ামেও তাঁকে ধরা যাবে না। তাঁর চলচ্চিত্রের নানা কলাকৌশল নিয়ে বিস্তর গবেষণা ও আলোচনার দ্বার উন্মোচন করা প্রয়োজন। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ ছিলেন বহুমুখী এবং তার কাজের পরিমাণও বিপুল।

তিনি ৩৭টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) ১৯৫৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” পুরস্কার লাভ করায় চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল। পথের পাঁচালী (১৯৫৫), অপরাজিত (১৯৫৬) ও অপুর সংসার (১৯৫৯) এই ট্রিলজি সত্যজিৎ রায়ের শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে বিবেচিত। ইতালীয় নিওরিয়ালিজম তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ইতালীয় চলচ্চিত্র ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’ (বাইসাইকেল চোর) দেখে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহিত হয়েছিলেন, এটি ছিল নিওরিয়ালিস্টিক ছবি। ‘দেবী’ (১৯৬০) তাঁর চতুর্থ ছবি। হিন্দু ধর্মকে বিকৃত করে দেখানো হয়েছে সেন্সর বোর্ড এমনই অভিযোগ তুলেছিল। পরে জহরলাল নেহরুর হস্তক্ষেপে ছবিটি সবার দেখার সুযোগ হয়। ‘নায়ক’ (১৯৬৬) তাঁর একটি বাস্তববাদী ছবি। এই ছবিতে উত্তমকুমারের অভিনয় দেখে মনেই হয় না যে এটা অভিনয়। তাঁর অভিনয় ছিল খুবই বাস্তব ও স্বাভাবিক। এই নায়ক নিঃসঙ্গ এবং ভিড়ের মধ্যেও একা। খ্যাতির অন্তরালের একাকিত্বকে পরিচালক যে শিল্পনৈপুণ্যে তুলে ধরেছেন, তা অনবদ্য। ১৯৮০ সালে নির্মাণ করেন ‘হীরক রাজার দেশে’। এই ছবির জন্য তিনি ১৯৮১ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার পান। চিত্রসমালোচক হল হিনসন ‘আগন্তুক’ (১৯৯১) দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন-Agantuk shows all the virtues of a master artist in full maturity. বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের রুগ্ন শিরায় রক্ত সরবরাহ করে তিনি নতুন যুগের সূচনা করলেন। আমরা বিস্ময়ে দেখলাম সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা’। তিন বয়সের, তিন ভিন্ন চরিত্র মিলে ফেলুদা অ্যান্ড কোং এর মতো ত্রিরত্ন সত্যিই বিস্ময়ের। বিজ্ঞানী প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুও বাঙালি পাঠকের কাছে অত্যন্ত প্রিয় মুখ।

দেশে-বিদেশে তিনি অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তিনি ৩২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১টি গোল্ডেন লায়ন, ২টি রৌপ্য ভল্লুক লাভ করেন। ৬ বার তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে তিনি ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামে যে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন তা ছিল তাঁর প্রতিভার অনবদ্য স্বাক্ষর। এই তথ্যচিত্রের জন্য তিনি ১৯৬১ সালে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক এবং লোকার্নো উৎসবে শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র হিসেবে গোল্ডেন শেইল লাভ করেন। পৃথিবীর অনেক চলচ্চিত্র সমালোচকই বলেছেন ‘রবীন্দ্রনাথ’-এর মতো তথ্যচিত্র আর দু-একটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। একজন মহান শিল্প স্রষ্টা ও দ্রষ্টার পরিচয় পাওয়া যায় এই তথ্যচিত্রে। এটি তাঁর সপ্তম ছবি এবং প্রথম পূর্ণাঙ্গ তথ্যচিত্র। এই তথ্যচিত্রে আমরা প্রথমে দেখি রবীন্দ্র-প্রয়াণ, অতঃপর শ্মশানঘাটের দিকে মানুষের ঢল, সেইসাথে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং রবীন্দ্র-প্রতিভার নানান দিকবলয়। এক ঘণ্টার এই তথ্যচিত্রে রবীন্দ্র-জীবনের সাথে দর্শকরা সহজেই নিমগ্ন হয়ে পড়েন।

সত্যজিৎ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টোরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে তাঁকে দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্স থেকে সম্মানসূচক লেজিওঁ দনরে পুরস্কার পান। ১৯৯২ সালে ভারত সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ভারত রতœ সম্মাননা প্রদান করেন। সত্যজিৎ ভারত রতœ এবং পদ্মভূষণসহ সকল মর্যাদাপূর্ণ ভারতীয় পুরস্কার লাভ করেছেন। মৃত্যুর পরে জাপান সরকার তাঁকে আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কারে ভূষিত করেন। ২০০৪ সালে বিবিসির এক জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় তিনি ১৩তম স্থান লাভ করেছিলেন। প্রচণ্ড ধুমপান করতেন, কিন্তু মদ খেতেন না। তিনি কাজকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করতেন এবং রাত দুটোতে ঘুমুতে যেতেন। তাঁর শখ ছিল পুরনো জিনিসপত্র, পাণ্ডুলিপি, গ্রামোফোন রেকর্ডস, পেইন্টিংস, এবং দুর্লভ বই-পত্র সংগ্রহ করা। ১৯৯২ সালে জটিল হৃদরোগ নিয়ে তিনি হাপাতালে ভর্তি হন এবং আর ফিরে আসেন নি। চিত্র সমালোচক আর্থার নাইট ‘স্যাটারডে রিভ্যু’তে অপরাজিত সম্পর্কে লিখেছিলেন- ‘গোড়া থেকেই দেখা যায় চরিত্রের প্রতি রায়ের একটি ভাবনা থাকে। সাধারণ ঘটনাকে তিনি এমনভাবে শিল্পায়িত করেন যে তা মুহূর্তে ইমেজধর্মী কবিতায় পরিণত হয়, কিন্ত বাস্তববোধ এতটুকু মলিন হয় না।’ এই কথা যে কতটা সত্য তা তাঁর ছবিগুলো নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়।

মৃত্যুর মাত্র ২৪ দিন আগে ভিডিও-লিংকের মাধ্যম অড্রে হেপবার্ন তাঁকে অনারেরি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেছিলেন। তিনি তখন খুবই অসুস্থ, তবু তিনি অনেকটা মনের জোরেই এটি গ্রহণের পর সামান্য কিছু কথা বলেছিলেন। তিনি এই পুরস্কারকে অভিহিত করেছিলেন-Best achievement of his movie-making career:দুনিয়ার সমস্ত জরিপেই তাঁকে শ্রেষ্ঠ ফিল্প পরিচালকদের একজন হিসেবে তালিকায় রাখা হয়েছে। সত্যজিৎ রায় পঞ্চাশের দশকেই বিদেশি সমালোচক ও পরিচালকদের কাছে তাঁর যোগ্য সম্মান ও মূল্যায়ন পেলেও দেশে তাঁর যোগ্য মর্যাদা পেতে অনেক দেরি হয়েছে। তার অন্যতম কারণ বোধ হয় চলচ্চিত্র-দর্শন ও শিল্প নিয়ে যোগ্য সমালোচকের অভাব। বাঙালি চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে মৃণাল সেনও একজন বিদগ্ধ ও মননশীল ¯্রষ্টা। তিনি একজন বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ হলেও চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে নির্মাণের ক্ষেত্রে সৎ ছিলেন। সত্যজিৎ সেইভাবে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ ছিলেন না। সমাজ, মানুষ এবং মানুষের অমিত সম্ভাবনা ও মুক্তির সর্বজনীন দর্শনকেই তিনি শিল্পে রূপায়িত করেছেন অনন্য কুশলতায় ও নান্দনিকতায়। অনেককিছু করার ব্যাপক পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তিনি একসময় সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়েও ছবি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সব পরিকল্পনা শেষ হয়ে যায়। ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে সৌমিত্রের বিপরীতে তিনি বাংলাদেশ থেকে ববিতাকে নায়িকা হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন এবং তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

এই পরিসরে এই বিশাল প্রতিভাকে বিস্তৃতভাবে তুলে ধরার কোনো সুযোগ নেই। অস্কার পাওয়ার পর সত্যজিৎকে নিয়ে মৃণাল সেন লিখেছিলেন- ‘... হ্যাঁ, সত্যজিৎ রায় এদেশে এবং হয়ত বা দেশের বাইরেও একেবারে বিতর্কিত নন এমন কথা আমি বলবো না। পৃথিবীর কোথাও কোনো শিল্পেই যেমন বিতর্কের ঊর্ধ্বে কেউ থাকেননি, সত্যজিৎ রায়ও থাকতে পারেননি। বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, কখনো সখনো, পত্রপত্রিকা, সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আসর উত্তপ্ত হয়েছে মাঝে মধ্যেই। প্রয়োজনবোধে আত্মপক্ষ সমর্থনে আমাকেও কঠোর বিরোধীর ভূমিকায় দাঁড়াতে হয়েছে। তবু নান্দনিক বোধ ও জীবনদর্শনের ক্ষেত্রে ছোট বড় মতান্তর সত্ত্বেও একথা নির্দ্বিধায় বলব যে সত্যজিৎ রায় এদেশের এযুগের ক্রান্তিকারী মহৎ শিল্পী এবং বিশ্বচলচ্চিত্রের বিশিষ্ট একজন এবং এই বিশিষ্টতার জন্যই তাঁর এই বিশ্বস্বীকৃতি ও এই বিশেষ অস্কার- মার্কিন অকাডেমির যোগ্যতম সম্মান।’ প্রতীক্ষণ/জানুয়ারি ’৯২)। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল চলচ্চিত্রের এই মহান কবি মৃত্যুবরণ করেন।