শঙ্খ ঘোষ : আত্মবোধের নিরুক্তলোক

উদয় শংকর দুর্জয়

কবি শঙ্খ ঘোষ যাবতীয় নিষ্পেষণের হাত থেকে সমাজকে বাঁচাতে চেয়েছেন বারবার। যখনই কালো মেঘ আরও কালো হয়ে জড়ো হয়েছে চারপাশে তখনই কবিতাকে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন।

কবিতা কখনও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। যখন মন ও মননের ভেতর একলা বসবাস করে তখন কবি নিজেকে এতোটাই কবিতার ভেতর সেঁটে দেন যে, কবিতার কাছে চির ঋণী হয়ে ওঠেন। কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার বহু দিক হয়তো আছে, কিন্তু বিশেষ একটি দিক আছে, যা কবিকে চিনিয়ে দিয়েছে অন্যরূপে। মানুষ তো এই সংসার যাপনের মধ্য দিয়েই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়, কিন্তু জীবনের ভেতর, এই মায়ার সংসারের ভেতর যেখানে জীবনকে উপলব্ধি করা যায়, সেখানে এতো নিবিড়ভাবে ক’জন আত্মাকে চেনার চেষ্টা করে। শঙ্খ ঘোষ সেই ক্ষুদে দলের একজন যিনি আত্মজীবনবোধের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করেছেন। তিনি তো সেই আত্মাকে চেনার চেষ্টা করেছেন যাকে চিনতে পারলে জগত সংসারের সবকিছু অনিত্য মনে হয়।

কবি শঙ্খ ঘোষ ঝলমলে রঙিন জীবনকে পেছনে ফেলে অতলান্ত আত্ম-সন্ধানে নেমেছেন। আত্মার মধ্যে বিলীন হয়েছেন বিরামহীন ভাবে। আর সেই উপলব্ধিকৃত জীবনের সব খুঁটিনাটি নিয়ে কবিতায় গল্প এঁকেছেন নিরুক্তভাবে। কবি শঙ্খ ঘোষ প্রায় ছয় দশক ধরে কবিতাকে শাসন করেছেন, দাপিয়ে বেড়িয়েছেন কবিতা অঙ্গন। কখনও প্রতিবাদি কবিতা, কখনও আত্মজীবনবোধের কবিতা আবার কখনও সমাজ সংস্করণের কবিতা দিয়ে পাঠককে বিমোহিত করে রেখেছেন। ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘সম্বল’, ‘ছেলে ধরা বুড়ো’, ‘সবুজ ছড়া’, ‘সে অনেক শতাব্দীর কাজ’সহ বহু কবিতা যা পাঠককে উজ্জীবিত করে চলেছে। কবি শঙ্খ ঘোষের আত্মবোধের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষীণ ছায়া এসে শীতল স্পর্শ দিয়ে গ্যাছে। তাঁর নৈসর্গিক কবিতায় কখনও মনে হয় জীবনানন্দ দাশ এসে পাতা উল্টিয়ে দিয়ে গ্যাছেন; এমন গুঞ্জন পাওয়া যায়। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে পড়েছেন কিন্তু নিজেকে তৈরি করেছেন এক অনন্য রূপে। সহজ কথাকে এতো নান্দনিক করে তুলেছেন- যেন, এ-তো পাঠকের চারপাশেরই কথা; চারপাশের শব্দসমুদ্র থেকে তিনি যে কবিতার আবহ তৈরি করেছেন তা এক সতন্ত্রধারার উজ্জ্বল নক্ষত্র।

সে এক স্বপ্নঘোরে কবি যখন জ্ঞান ও জিঘাংসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের সীমা পরিসীমাকে জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন; তখন কেউ যেন তাঁকে জানিয়ে যান এখনও অসীম জ্ঞান এই ধরাধামে প্রোথিত আছে, এখনও বিস্তীর্ণ অভিজ্ঞান ছড়িয়ে আছে শিশির কণার মধ্যে। অসময়ে যখন বিষাদ কিংবা অতর্কিত বিনাশের মিছিল এসে ঘিরে ধরে চারপাশ তখন সহসাই একটাই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়- কেন এই বিরুদ্ধ স্লোগান, কেন এই

অনিষ্টতা? কবির ভেতরকার সংশয় মুছে গেলে জানার অসীম দুয়ার খুলে যায়, কবি লেখেন-

“শিখর থেকে একে একে খসে পড়ছে তারা।/ গহ্বরের দিকে গড়িয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করছে, ‘বলো, কেন/ কেন অসময়ে আমাদের এই বিনাশ?’/ জানতে চাইছে শিলায় শিলায় ঝলসে-ওঠা স্বর :/ ‘আমরা কি তবে সত্য ছিলাম না আমাদের শব্দে?/ আমরা কি স্থির ছিলাম না আমাদের স্পন্দে?/ আমরা কি অনুগত ছিলাম না আমাদের স্বপ্নে?/ তবে কেন, কেন, আমাদের এই-’ (সে অনেক শতাব্দীর কাজ)। এই কবিতার শেষাংশে তিনি বলেছেন- একত্রিত হওয়ার কথা, নীরবতার কথা। স্তব্ধতায়, নীরবতায় মানুষ হয়ে ওঠে ভিন্ন মানুষ। মানুষ সবচেয়ে নিজেকে চিনতে পারে একাকীত্বে আর নিশ্চুপতায়। শুধু প্রবাহমান শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মানুষ যখন চিন্তার গভীরে ডুবে যেতে পারে তখন প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির নতুন অংক উঠে আসতে পারে। কবি সেই গোলোক ধাঁধা, মায়াময় সংসারের যাদুস্পর্শ- এসবের বাইরে অস্তিত্বকে জানার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা একজন জ্ঞান অন্বেষাকারীর জানা খুব প্রয়োজন। কবি শঙ্খ ঘোষের বিভিন্ন কবিতার মধ্যে আধ্যাত্মিকতা এবং আত্ম তত্ত্বের যে অভিজ্ঞান লক্ষ করা যায় তা অধুনা কবিতায় অসামান্য।

প্রতিটি মানুষের ভেতর বিদ্রোহ হানা দেয় যখন সে অনিষ্টের মুখোমুখি দাঁড়ায়, যখন সে অনিয়মকে নিয়ম নামে চলতে দ্যাখে। কবি শঙ্খ ঘোষ অনিয়মকে কোনো দিন আসকারা দেননি, বরং কবিতায় সেসব অনিষ্টকারীদের রীতিমতো শাসন করেছেন। প্রতিবাদ করেছেন প্রকাশ্যে, সাহিত্য আকাডেমির পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, সাধারণ মানুষের কাতারে এসে পায়ে পা মিলিয়েছন। মানুষ যখন ধীরে ধীরে অমানুষ হয়ে ওঠে তখন সে তার অস্তিত্বকে ভুলতে শুরু করে, এই ছোট্ট নশ্বর জীবনের কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় যে, তার একটি মাত্র অমানবিক আচরণে অন্যের কতটা বিয়োগ-ব্যথা ঘটতে পারে।

কবি শঙ্খ ঘোষ প্রতিবাদী কবিতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাবধানে যে কাজটি করেছেন, সেটি হলো: শব্দ এবং আবহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সেগুলো যেন স্লোগানে রূপ না নেয়। কবিতায় যে ছন্দ, চিত্রকল্প, অনুপ্রাস, অলংকার, অন্বয়ের ব্যবহার তিনি করেছেন সেখানে যেন উচ্চৈঃস্বর বা উগ্রতার উপস্থিতি না থাকে। কবিতা যখন স্লোগান হয়ে ওঠে তখন তার নান্দনিকতা লোপ পায়। তবুও বলতে হবে কবিতা নব জাগরণের, কবিতা কখনও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, কখনও শাসকবিরোধী। মানুষকে উজ্জীবিত করতে, দেশ ও জাতিকে নতুন করে জাগাতে কবিতা হয়ে ওঠে শাণিত অস্ত্র। নান্দনিকতার বিচারে কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতা এক অনবদ্য মিছিলের সামনের সারিতে হেঁটে গেছে বিরামহীন। ‘সবুজ ছড়া’ কবিতায় তারই এক অনন্য রূপ দেখি-

‘উত্থান- তার শেষ নেই কোনো, শেষ নেই দস্যুতার

ভোরের বেলায় শূন্যে উঠেছে পরশুরামের কুঠার।

ত্রিসীমানায় কোনো সঞ্চার কেউ রাখবে না কোনোভাবে

যেখানেই যার সবুজ রক্ত সবটুকু শুষে খাবে’

‘পরশুরামের কুঠার’ রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন কবি। কবিতার মধ্যে অলংকার আর অনুপ্রাসের সঙ্গম, অপ্রাপ্তি আর প্রতিবাদের সংলাপ, বিরহ এবং অনিষ্টের অগমন বার্তা, প্রকৃতির বিরুদ্ধে মনুষ্য-জানোয়ারের বাড়বাড়ন্ত... এসব-ই একই কবিতার ভেতর নিপুণতার সাথে গেঁথে দিয়েছেন। এই নিপুণতা, এই কৌশল, এই নান্দনিকতা শুধু পণ্ডিত কবিদের বেলায়ই ঘটতে পারে।

‘নষ্ট হয়ে যায় প্রভু, নষ্ট হয়ে যায়।

ছিলো, নেই- মাত্র এই, ইটের পাঁজায়

আগুন জ্বালায় রাত্রে দারুণ জ্বালায়

আর সব ধ্যান ধান নষ্ট হয়ে যায়।’

(ঝরে পড়ার শব্দ জানে তুমি আমার নষ্ট প্রভু)

কবিতার অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় প্রার্থনা এবং সেই প্রার্থনা কখনও প্রভুর কাছে পৌঁছে দিতে কবি হয়ে ওঠেন তৎপর। এই জগত সংসারে, মোহ আর মায়ার সংসারে মানুষ প্রতি নিয়ত ভুল করে চলেছে কিন্তু ক’জন আছে বুকের মধ্যে ভীরুতা নিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আগে শুধু একটিবারের জন্য চোখ বুলিয়ে নেয়ার। ভুলগুলো চোখের সামনে এসে পড়লে যিনি আত্ম প্রবঞ্চনায় ভোগেন তিনি প্রার্থনায় কামনায়-বাসনায় প্রভুর দ্বারস্থ হন। আজ একুবিংশ শতাব্দীতে অনুশোচনাকারীর সংখ্যা একেবারে শূন্যের কোটায় এসে ঠেকেছে বলা যায়। শঙ্খ ঘোষকে আত্মপ্রবাহমান ধারার কবি বলে আখ্যায়িত করতে কোনো বাঁধা নেই। তার কবিতার মধ্যে একান্ত নিজস্বতাকে উপলব্ধি করার যে তুমুল আলোড়ন থাকে তার নির্জাস থেকে পাঠক জেনে নিতে পারেন আসলে ছোট্ট অনুভূতিগুলো কতটা নাড়িয়ে দিতে পারে। ফিরে যেতে হয় ‘সম্বল’ কবিতার কাছে। কবিতার মধ্যে এতোটা নন্দন কারুকাজ, এতোটা আলো ছায়ার মায়জাল আর কোথায় পাওয়া যায়!-

‘একটি কথারই শুধু সম্বল রয়েছে পড়ে হাতে।

হাওয়ায় উড়িয়ে দি, মুখ দেখি, ব্রহ্মপুত্রজলে

বৈঠাহীন নৌকা তার অলস ভাসানে ভেসে চলে

ঘূর্ণিটান রাত্রি শেষ একটি কথাই শুধু বলে।’

এই কবিতার অবকাঠামোতে রয়েছে অসাধারণ কিছু চিত্রকল্পের ব্যবহার। বৈঠাহীন নৌকা তিনি ভাসিয়ে দিচ্ছেন ব্রহ্মপুত্রের জলে, কবি অজানাকে এভাবে জানতে চান কারণ তাঁর মধ্যে আকাক্সক্ষার পাল তোলা জাহাজ ভেসে বেড়ায়। হয়তো কখনও ভুলের মুখোমুখি হন, হয়তো চিরহরিতের খিদে এসে সামনে দাঁড়ায়- তবু কবি তো অন্বেষণে ভাসাবেন তার পাঁচতলা জাহাজ। তিনি দু’টি অনবদ্য লাইন লিখেছেন এই কবিতায়- ভাঙাপাড় থেকে জলে শিকড় নামিয়ে আনে ঠোঁট/ তার দিকে চেয়ে বুঝি, ভুল, সবই ভুল হয়ে গেছে’- জীবনে বিভ্রান্তির মায়াজালে জড়ানো শেকড় আর ঠোঁট কখন যেন অন্য কোনো মানে হয়ে ওঠে। হয়তো কবি কোনো অচেনা ঠোঁটের অবয়ব দেখেছিলেন সেখানে যা ছিল জল আর শেকড়ের কাছাকাছি। কবি অনুভব করেছেন কেউ তাঁর দিকে অধীর বিমূঢ়তা নিয়ে চেয়ে আছে, কেউ আজলে ভরে স্থবিরতা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। কবিতাটি বারবার পড়লে ভিন্ন ভিন্ন মানে বের করা যায়। মনে হয় কখনও তিনি নিজের সাথে কথা বলছেন; কখনও ভাঙা পাড়, জলমহল, নির্জনতা আবার কখনও নিরুদ্দেশের ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়া কোনো বোহেমিয়ান পাখির সাথে। আত্মপ্রবাহের ফল্গুধারায় কবি নিজেকে সাজিয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি। কবি ঘর আর প্রান্তের পথ এক করে দিতে দ্বিধাবোধ করেনিনি কখনও। এই মাটি-জল-হাওয়া থেকে যিনি সবকিছু শিখে নিয়েছেন সেখানে আর দ্বিমত কেন! তিনি লিখেছেন ‘ঘর’ কবিতায়- ‘ঘরের মধ্যে পথ পেয়েছি, পথের মধ্যে ঘর/সবাই এখন আপন আমার, কেউ নয় পর।/ তোমার কথার গুণে/ এমন আশ্বিনে-ফাল্গুনে/ মন হয়ে যায় মনের মতো ব্যাপ্ত চরাচর-/ আমার পথের মধ্যে ঘর।’

জীবনকে এতো সহজ করে চেনা যায়, এতো উদ্বেলভাবে সবকিছুকে আপন করা যায়- তাতো শঙ্খ ঘোষকে না পড়লে পাঠক কখনই উপলব্ধি করতে পারতেন না। কবিতা শুধু কবিতা কেন হবে, কবিতা কেন জীবনের কথা, আত্মবেহালার কথা বলবে না! শঙ্খ ঘোষ কবিতাকে সহজ এবং হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন বোধ আর উপলব্ধির গভীরতা দিয়ে। আত্মজ্ঞানের পরিধি পেরিয়ে তিনি এক জগতকে আবিষ্কার করেছেন কবিতার মধ্যে সে জগত ইহজগৎ বা পরোজগত নয়, যাকে বলা হয় মনোজগত। এই মনোজগতের এক অবিনাশী বাসিন্দা কবি যেন দরজা জানলাহীন কোনো নৈঃশব্দ্যের আলোয় মনের সব লেনদেন মিটিয়ে একা হেঁটে বেড়ান ঘরময়। কবি শঙ্খ ঘোষ আবিস্কার করেন মনোজগতের এক কাব্যময় নিঃসঙ্গ পথ যেখানে মন্ত্রে নিমজ্জিত হওয়ার পথ অনিঃশেষ। তাঁর সৃজন ভাবনাগুলো মনোজগতের মোহনা স্পর্শ করে যায়, তাঁকে উজ্জীবিত করে যায় নিরবধি। কবি তখন সূর্যের ওপাশে দেখতে পান আলোর অনশ্বর পথ।

‘আমার ধর্ম নেই আমার অধর্ম নেই কোনো

আমার মৃত্যুর কথা যদি কেউ দূর থেকে শোনো

জেনো- এ আমার মাটি এ কাল আমার দেশকাল

জালিয়ানওয়ালাবাগ এবার হয়েছে আরওয়াল!’

এমন স্পষ্ট করে কবিই বলতে পারেন, একজন শঙ্খ ঘোষই বলতে পারেন। ধর্মের বিভেদ আর হানানহানিতে নিয়ত সম্পর্ক ছিন্ন হচ্ছে, নিয়ত বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে একে অপরের ওপর। শত বছরের প্রতিবেশি সম্পর্ক শুধু একটা ধর্মীয় ঠুনকো আঘাতে ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সেখানে কবি দাঁড়িয়েছেন মানুষ হিসেবে, কোনো ধর্মতন্ত্রের ছায়াতলে নিজেকে পরিচিত করেননি। নিজের সত্যতাকে স্বীকার করা দুঃসাহসের পরিচয় যা সবাই অর্জন করতে পারে না। এই মহাপৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ মুখোশের আড়ালে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, নিজের বাহ্যিক অবয়বে রঙ চড়িয়ে আরও ভালো মানুষ হতে চায়। কবি শঙ্খ ঘোষ লোক দেখানো ভালো মানুষ হতে চাননি, তিনি এই মাটির সাথে আবার মাটি হয়ে মিশে যেতে চেয়েছেন। কবি শুধু আবগে আর প্রেম দিয়ে লিখে যাননি, তিনি লিখেছেন সমাজ সংস্করণের কথা, রূপান্তরের কথা, সহমর্মিতার কথা, অহিংসার কথা। নির্লোভ আর নির্মোহর কথা লিখে গেছেন কবি শঙ্খ ঘোষ। এ পৃথিবীর সবাই প্রাপ্তির জন্য ছুটছে, অতৃপ্ত জীবন পেছনে ফেলে ওরা শুধু সামনে দৌড়াচ্ছে, কে আগে কুড়িয়ে নিতে পারে ভোগ, কে আগে উপভোগ করতে পারে সুখের পরম সুখ। কিন্তু কবি দেখিয়েছেন সব শান্তি উপভোগে নয়, বরং তিনি যা পেয়েছেন তাতেই তৃপ্তি থেকেছেন; এমনকি আত্মত্যাগও করতে পেরেছেন অনায়াসে। কবি সে অমরত্বকে সরিয়ে রেখে নিজে বিলীন হতে চেয়েছেন। এমন আত্মমগ্ন প্রার্থনায় কবি যখন লেখেন-

‘আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার

জীর্ণ ক’রে ওকে কোথায় নেবে?

ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’

কবি শঙ্খ ঘোষ আত্মপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বরাবর হেঁটে গেছেন গভীর গহন পথে। তিনি গণমানুষের কথা ভেবেছেন। নতুন পথ দেখাতে চেয়েছেন যে পথ এসে মিশে যায় ঘরের চৌকাঠে। কবি ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখতে পাবেন আলো ভরা সে পথে শুধু মানুষ ধুলো উড়িয়ে চলেছে। সে ধুলোয় কোনো বিভেদ নেই, সে অক্সিজেনে কোনো মেরুকরণ নেই, সে দখিন বাতাসে কোনো ধর্মের কলকাঠি নেই। এই পথ ঘরের ভেতর-বার সব জায়গা জুড়ে একই রঙ উড়িয়ে সবার দেহমন আলোকিত করে চলেছে। এমন ভাবনার শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে কবি জানিয়ে দিতে চেয়েছেন এই ধরিত্রীর আলো-হাওয়া-নিঃশ্বাস সবই চলেছে এক সূত্র মেনে। কারো জন্য কোনো আলদা সমীকরণ নেই। পরিশেষে একটি কথা বলতে হয় কবিতায় যখন দর্শন থাকে, সাম্যের আহ্বান থাকে, আলোর আল্পনা থাকে তখন সে কবিতা বেঁচে থাকে চিরন্তন নক্ষত্রের মতো। কবি শঙ্খ ঘোষও বেঁচেয় থাকবেন চির-অক্ষয় হয়ে।

বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১ , ১৬ বৈশাখ ১৪২৮ ১৬ রমজান ১৪৪২

শঙ্খ ঘোষ : আত্মবোধের নিরুক্তলোক

উদয় শংকর দুর্জয়

image

সে-সময়ের ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ‘জ্ঞানপীঠ’ গ্রহণ করছেন কবি শঙ্খ ঘোষ

কবি শঙ্খ ঘোষ যাবতীয় নিষ্পেষণের হাত থেকে সমাজকে বাঁচাতে চেয়েছেন বারবার। যখনই কালো মেঘ আরও কালো হয়ে জড়ো হয়েছে চারপাশে তখনই কবিতাকে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন।

কবিতা কখনও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। যখন মন ও মননের ভেতর একলা বসবাস করে তখন কবি নিজেকে এতোটাই কবিতার ভেতর সেঁটে দেন যে, কবিতার কাছে চির ঋণী হয়ে ওঠেন। কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার বহু দিক হয়তো আছে, কিন্তু বিশেষ একটি দিক আছে, যা কবিকে চিনিয়ে দিয়েছে অন্যরূপে। মানুষ তো এই সংসার যাপনের মধ্য দিয়েই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়, কিন্তু জীবনের ভেতর, এই মায়ার সংসারের ভেতর যেখানে জীবনকে উপলব্ধি করা যায়, সেখানে এতো নিবিড়ভাবে ক’জন আত্মাকে চেনার চেষ্টা করে। শঙ্খ ঘোষ সেই ক্ষুদে দলের একজন যিনি আত্মজীবনবোধের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করেছেন। তিনি তো সেই আত্মাকে চেনার চেষ্টা করেছেন যাকে চিনতে পারলে জগত সংসারের সবকিছু অনিত্য মনে হয়।

কবি শঙ্খ ঘোষ ঝলমলে রঙিন জীবনকে পেছনে ফেলে অতলান্ত আত্ম-সন্ধানে নেমেছেন। আত্মার মধ্যে বিলীন হয়েছেন বিরামহীন ভাবে। আর সেই উপলব্ধিকৃত জীবনের সব খুঁটিনাটি নিয়ে কবিতায় গল্প এঁকেছেন নিরুক্তভাবে। কবি শঙ্খ ঘোষ প্রায় ছয় দশক ধরে কবিতাকে শাসন করেছেন, দাপিয়ে বেড়িয়েছেন কবিতা অঙ্গন। কখনও প্রতিবাদি কবিতা, কখনও আত্মজীবনবোধের কবিতা আবার কখনও সমাজ সংস্করণের কবিতা দিয়ে পাঠককে বিমোহিত করে রেখেছেন। ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘সম্বল’, ‘ছেলে ধরা বুড়ো’, ‘সবুজ ছড়া’, ‘সে অনেক শতাব্দীর কাজ’সহ বহু কবিতা যা পাঠককে উজ্জীবিত করে চলেছে। কবি শঙ্খ ঘোষের আত্মবোধের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষীণ ছায়া এসে শীতল স্পর্শ দিয়ে গ্যাছে। তাঁর নৈসর্গিক কবিতায় কখনও মনে হয় জীবনানন্দ দাশ এসে পাতা উল্টিয়ে দিয়ে গ্যাছেন; এমন গুঞ্জন পাওয়া যায়। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে পড়েছেন কিন্তু নিজেকে তৈরি করেছেন এক অনন্য রূপে। সহজ কথাকে এতো নান্দনিক করে তুলেছেন- যেন, এ-তো পাঠকের চারপাশেরই কথা; চারপাশের শব্দসমুদ্র থেকে তিনি যে কবিতার আবহ তৈরি করেছেন তা এক সতন্ত্রধারার উজ্জ্বল নক্ষত্র।

সে এক স্বপ্নঘোরে কবি যখন জ্ঞান ও জিঘাংসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের সীমা পরিসীমাকে জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন; তখন কেউ যেন তাঁকে জানিয়ে যান এখনও অসীম জ্ঞান এই ধরাধামে প্রোথিত আছে, এখনও বিস্তীর্ণ অভিজ্ঞান ছড়িয়ে আছে শিশির কণার মধ্যে। অসময়ে যখন বিষাদ কিংবা অতর্কিত বিনাশের মিছিল এসে ঘিরে ধরে চারপাশ তখন সহসাই একটাই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়- কেন এই বিরুদ্ধ স্লোগান, কেন এই

অনিষ্টতা? কবির ভেতরকার সংশয় মুছে গেলে জানার অসীম দুয়ার খুলে যায়, কবি লেখেন-

“শিখর থেকে একে একে খসে পড়ছে তারা।/ গহ্বরের দিকে গড়িয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করছে, ‘বলো, কেন/ কেন অসময়ে আমাদের এই বিনাশ?’/ জানতে চাইছে শিলায় শিলায় ঝলসে-ওঠা স্বর :/ ‘আমরা কি তবে সত্য ছিলাম না আমাদের শব্দে?/ আমরা কি স্থির ছিলাম না আমাদের স্পন্দে?/ আমরা কি অনুগত ছিলাম না আমাদের স্বপ্নে?/ তবে কেন, কেন, আমাদের এই-’ (সে অনেক শতাব্দীর কাজ)। এই কবিতার শেষাংশে তিনি বলেছেন- একত্রিত হওয়ার কথা, নীরবতার কথা। স্তব্ধতায়, নীরবতায় মানুষ হয়ে ওঠে ভিন্ন মানুষ। মানুষ সবচেয়ে নিজেকে চিনতে পারে একাকীত্বে আর নিশ্চুপতায়। শুধু প্রবাহমান শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মানুষ যখন চিন্তার গভীরে ডুবে যেতে পারে তখন প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির নতুন অংক উঠে আসতে পারে। কবি সেই গোলোক ধাঁধা, মায়াময় সংসারের যাদুস্পর্শ- এসবের বাইরে অস্তিত্বকে জানার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা একজন জ্ঞান অন্বেষাকারীর জানা খুব প্রয়োজন। কবি শঙ্খ ঘোষের বিভিন্ন কবিতার মধ্যে আধ্যাত্মিকতা এবং আত্ম তত্ত্বের যে অভিজ্ঞান লক্ষ করা যায় তা অধুনা কবিতায় অসামান্য।

প্রতিটি মানুষের ভেতর বিদ্রোহ হানা দেয় যখন সে অনিষ্টের মুখোমুখি দাঁড়ায়, যখন সে অনিয়মকে নিয়ম নামে চলতে দ্যাখে। কবি শঙ্খ ঘোষ অনিয়মকে কোনো দিন আসকারা দেননি, বরং কবিতায় সেসব অনিষ্টকারীদের রীতিমতো শাসন করেছেন। প্রতিবাদ করেছেন প্রকাশ্যে, সাহিত্য আকাডেমির পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, সাধারণ মানুষের কাতারে এসে পায়ে পা মিলিয়েছন। মানুষ যখন ধীরে ধীরে অমানুষ হয়ে ওঠে তখন সে তার অস্তিত্বকে ভুলতে শুরু করে, এই ছোট্ট নশ্বর জীবনের কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় যে, তার একটি মাত্র অমানবিক আচরণে অন্যের কতটা বিয়োগ-ব্যথা ঘটতে পারে।

কবি শঙ্খ ঘোষ প্রতিবাদী কবিতার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাবধানে যে কাজটি করেছেন, সেটি হলো: শব্দ এবং আবহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সেগুলো যেন স্লোগানে রূপ না নেয়। কবিতায় যে ছন্দ, চিত্রকল্প, অনুপ্রাস, অলংকার, অন্বয়ের ব্যবহার তিনি করেছেন সেখানে যেন উচ্চৈঃস্বর বা উগ্রতার উপস্থিতি না থাকে। কবিতা যখন স্লোগান হয়ে ওঠে তখন তার নান্দনিকতা লোপ পায়। তবুও বলতে হবে কবিতা নব জাগরণের, কবিতা কখনও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, কখনও শাসকবিরোধী। মানুষকে উজ্জীবিত করতে, দেশ ও জাতিকে নতুন করে জাগাতে কবিতা হয়ে ওঠে শাণিত অস্ত্র। নান্দনিকতার বিচারে কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতা এক অনবদ্য মিছিলের সামনের সারিতে হেঁটে গেছে বিরামহীন। ‘সবুজ ছড়া’ কবিতায় তারই এক অনন্য রূপ দেখি-

‘উত্থান- তার শেষ নেই কোনো, শেষ নেই দস্যুতার

ভোরের বেলায় শূন্যে উঠেছে পরশুরামের কুঠার।

ত্রিসীমানায় কোনো সঞ্চার কেউ রাখবে না কোনোভাবে

যেখানেই যার সবুজ রক্ত সবটুকু শুষে খাবে’

‘পরশুরামের কুঠার’ রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন কবি। কবিতার মধ্যে অলংকার আর অনুপ্রাসের সঙ্গম, অপ্রাপ্তি আর প্রতিবাদের সংলাপ, বিরহ এবং অনিষ্টের অগমন বার্তা, প্রকৃতির বিরুদ্ধে মনুষ্য-জানোয়ারের বাড়বাড়ন্ত... এসব-ই একই কবিতার ভেতর নিপুণতার সাথে গেঁথে দিয়েছেন। এই নিপুণতা, এই কৌশল, এই নান্দনিকতা শুধু পণ্ডিত কবিদের বেলায়ই ঘটতে পারে।

‘নষ্ট হয়ে যায় প্রভু, নষ্ট হয়ে যায়।

ছিলো, নেই- মাত্র এই, ইটের পাঁজায়

আগুন জ্বালায় রাত্রে দারুণ জ্বালায়

আর সব ধ্যান ধান নষ্ট হয়ে যায়।’

(ঝরে পড়ার শব্দ জানে তুমি আমার নষ্ট প্রভু)

কবিতার অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় প্রার্থনা এবং সেই প্রার্থনা কখনও প্রভুর কাছে পৌঁছে দিতে কবি হয়ে ওঠেন তৎপর। এই জগত সংসারে, মোহ আর মায়ার সংসারে মানুষ প্রতি নিয়ত ভুল করে চলেছে কিন্তু ক’জন আছে বুকের মধ্যে ভীরুতা নিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আগে শুধু একটিবারের জন্য চোখ বুলিয়ে নেয়ার। ভুলগুলো চোখের সামনে এসে পড়লে যিনি আত্ম প্রবঞ্চনায় ভোগেন তিনি প্রার্থনায় কামনায়-বাসনায় প্রভুর দ্বারস্থ হন। আজ একুবিংশ শতাব্দীতে অনুশোচনাকারীর সংখ্যা একেবারে শূন্যের কোটায় এসে ঠেকেছে বলা যায়। শঙ্খ ঘোষকে আত্মপ্রবাহমান ধারার কবি বলে আখ্যায়িত করতে কোনো বাঁধা নেই। তার কবিতার মধ্যে একান্ত নিজস্বতাকে উপলব্ধি করার যে তুমুল আলোড়ন থাকে তার নির্জাস থেকে পাঠক জেনে নিতে পারেন আসলে ছোট্ট অনুভূতিগুলো কতটা নাড়িয়ে দিতে পারে। ফিরে যেতে হয় ‘সম্বল’ কবিতার কাছে। কবিতার মধ্যে এতোটা নন্দন কারুকাজ, এতোটা আলো ছায়ার মায়জাল আর কোথায় পাওয়া যায়!-

‘একটি কথারই শুধু সম্বল রয়েছে পড়ে হাতে।

হাওয়ায় উড়িয়ে দি, মুখ দেখি, ব্রহ্মপুত্রজলে

বৈঠাহীন নৌকা তার অলস ভাসানে ভেসে চলে

ঘূর্ণিটান রাত্রি শেষ একটি কথাই শুধু বলে।’

এই কবিতার অবকাঠামোতে রয়েছে অসাধারণ কিছু চিত্রকল্পের ব্যবহার। বৈঠাহীন নৌকা তিনি ভাসিয়ে দিচ্ছেন ব্রহ্মপুত্রের জলে, কবি অজানাকে এভাবে জানতে চান কারণ তাঁর মধ্যে আকাক্সক্ষার পাল তোলা জাহাজ ভেসে বেড়ায়। হয়তো কখনও ভুলের মুখোমুখি হন, হয়তো চিরহরিতের খিদে এসে সামনে দাঁড়ায়- তবু কবি তো অন্বেষণে ভাসাবেন তার পাঁচতলা জাহাজ। তিনি দু’টি অনবদ্য লাইন লিখেছেন এই কবিতায়- ভাঙাপাড় থেকে জলে শিকড় নামিয়ে আনে ঠোঁট/ তার দিকে চেয়ে বুঝি, ভুল, সবই ভুল হয়ে গেছে’- জীবনে বিভ্রান্তির মায়াজালে জড়ানো শেকড় আর ঠোঁট কখন যেন অন্য কোনো মানে হয়ে ওঠে। হয়তো কবি কোনো অচেনা ঠোঁটের অবয়ব দেখেছিলেন সেখানে যা ছিল জল আর শেকড়ের কাছাকাছি। কবি অনুভব করেছেন কেউ তাঁর দিকে অধীর বিমূঢ়তা নিয়ে চেয়ে আছে, কেউ আজলে ভরে স্থবিরতা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। কবিতাটি বারবার পড়লে ভিন্ন ভিন্ন মানে বের করা যায়। মনে হয় কখনও তিনি নিজের সাথে কথা বলছেন; কখনও ভাঙা পাড়, জলমহল, নির্জনতা আবার কখনও নিরুদ্দেশের ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়া কোনো বোহেমিয়ান পাখির সাথে। আত্মপ্রবাহের ফল্গুধারায় কবি নিজেকে সাজিয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি। কবি ঘর আর প্রান্তের পথ এক করে দিতে দ্বিধাবোধ করেনিনি কখনও। এই মাটি-জল-হাওয়া থেকে যিনি সবকিছু শিখে নিয়েছেন সেখানে আর দ্বিমত কেন! তিনি লিখেছেন ‘ঘর’ কবিতায়- ‘ঘরের মধ্যে পথ পেয়েছি, পথের মধ্যে ঘর/সবাই এখন আপন আমার, কেউ নয় পর।/ তোমার কথার গুণে/ এমন আশ্বিনে-ফাল্গুনে/ মন হয়ে যায় মনের মতো ব্যাপ্ত চরাচর-/ আমার পথের মধ্যে ঘর।’

জীবনকে এতো সহজ করে চেনা যায়, এতো উদ্বেলভাবে সবকিছুকে আপন করা যায়- তাতো শঙ্খ ঘোষকে না পড়লে পাঠক কখনই উপলব্ধি করতে পারতেন না। কবিতা শুধু কবিতা কেন হবে, কবিতা কেন জীবনের কথা, আত্মবেহালার কথা বলবে না! শঙ্খ ঘোষ কবিতাকে সহজ এবং হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন বোধ আর উপলব্ধির গভীরতা দিয়ে। আত্মজ্ঞানের পরিধি পেরিয়ে তিনি এক জগতকে আবিষ্কার করেছেন কবিতার মধ্যে সে জগত ইহজগৎ বা পরোজগত নয়, যাকে বলা হয় মনোজগত। এই মনোজগতের এক অবিনাশী বাসিন্দা কবি যেন দরজা জানলাহীন কোনো নৈঃশব্দ্যের আলোয় মনের সব লেনদেন মিটিয়ে একা হেঁটে বেড়ান ঘরময়। কবি শঙ্খ ঘোষ আবিস্কার করেন মনোজগতের এক কাব্যময় নিঃসঙ্গ পথ যেখানে মন্ত্রে নিমজ্জিত হওয়ার পথ অনিঃশেষ। তাঁর সৃজন ভাবনাগুলো মনোজগতের মোহনা স্পর্শ করে যায়, তাঁকে উজ্জীবিত করে যায় নিরবধি। কবি তখন সূর্যের ওপাশে দেখতে পান আলোর অনশ্বর পথ।

‘আমার ধর্ম নেই আমার অধর্ম নেই কোনো

আমার মৃত্যুর কথা যদি কেউ দূর থেকে শোনো

জেনো- এ আমার মাটি এ কাল আমার দেশকাল

জালিয়ানওয়ালাবাগ এবার হয়েছে আরওয়াল!’

এমন স্পষ্ট করে কবিই বলতে পারেন, একজন শঙ্খ ঘোষই বলতে পারেন। ধর্মের বিভেদ আর হানানহানিতে নিয়ত সম্পর্ক ছিন্ন হচ্ছে, নিয়ত বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে একে অপরের ওপর। শত বছরের প্রতিবেশি সম্পর্ক শুধু একটা ধর্মীয় ঠুনকো আঘাতে ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সেখানে কবি দাঁড়িয়েছেন মানুষ হিসেবে, কোনো ধর্মতন্ত্রের ছায়াতলে নিজেকে পরিচিত করেননি। নিজের সত্যতাকে স্বীকার করা দুঃসাহসের পরিচয় যা সবাই অর্জন করতে পারে না। এই মহাপৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ মুখোশের আড়ালে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, নিজের বাহ্যিক অবয়বে রঙ চড়িয়ে আরও ভালো মানুষ হতে চায়। কবি শঙ্খ ঘোষ লোক দেখানো ভালো মানুষ হতে চাননি, তিনি এই মাটির সাথে আবার মাটি হয়ে মিশে যেতে চেয়েছেন। কবি শুধু আবগে আর প্রেম দিয়ে লিখে যাননি, তিনি লিখেছেন সমাজ সংস্করণের কথা, রূপান্তরের কথা, সহমর্মিতার কথা, অহিংসার কথা। নির্লোভ আর নির্মোহর কথা লিখে গেছেন কবি শঙ্খ ঘোষ। এ পৃথিবীর সবাই প্রাপ্তির জন্য ছুটছে, অতৃপ্ত জীবন পেছনে ফেলে ওরা শুধু সামনে দৌড়াচ্ছে, কে আগে কুড়িয়ে নিতে পারে ভোগ, কে আগে উপভোগ করতে পারে সুখের পরম সুখ। কিন্তু কবি দেখিয়েছেন সব শান্তি উপভোগে নয়, বরং তিনি যা পেয়েছেন তাতেই তৃপ্তি থেকেছেন; এমনকি আত্মত্যাগও করতে পেরেছেন অনায়াসে। কবি সে অমরত্বকে সরিয়ে রেখে নিজে বিলীন হতে চেয়েছেন। এমন আত্মমগ্ন প্রার্থনায় কবি যখন লেখেন-

‘আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার

জীর্ণ ক’রে ওকে কোথায় নেবে?

ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর

আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’

কবি শঙ্খ ঘোষ আত্মপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বরাবর হেঁটে গেছেন গভীর গহন পথে। তিনি গণমানুষের কথা ভেবেছেন। নতুন পথ দেখাতে চেয়েছেন যে পথ এসে মিশে যায় ঘরের চৌকাঠে। কবি ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখতে পাবেন আলো ভরা সে পথে শুধু মানুষ ধুলো উড়িয়ে চলেছে। সে ধুলোয় কোনো বিভেদ নেই, সে অক্সিজেনে কোনো মেরুকরণ নেই, সে দখিন বাতাসে কোনো ধর্মের কলকাঠি নেই। এই পথ ঘরের ভেতর-বার সব জায়গা জুড়ে একই রঙ উড়িয়ে সবার দেহমন আলোকিত করে চলেছে। এমন ভাবনার শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে কবি জানিয়ে দিতে চেয়েছেন এই ধরিত্রীর আলো-হাওয়া-নিঃশ্বাস সবই চলেছে এক সূত্র মেনে। কারো জন্য কোনো আলদা সমীকরণ নেই। পরিশেষে একটি কথা বলতে হয় কবিতায় যখন দর্শন থাকে, সাম্যের আহ্বান থাকে, আলোর আল্পনা থাকে তখন সে কবিতা বেঁচে থাকে চিরন্তন নক্ষত্রের মতো। কবি শঙ্খ ঘোষও বেঁচেয় থাকবেন চির-অক্ষয় হয়ে।