শঙ্খ ঘোষের পাকশী পাকশীর শঙ্খ ঘোষ

ইশতিয়াক আলম

দীর্ঘ ৩৭ বছর পরে এসে শৈশব-কৈশরে বেড়ে ওঠা রেলশহর ঘুরে পাকশী সম্বন্ধে লেখেন, “সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের কথা শুনতে শুনতে, আর আমরা অনবরতই প্রমাণ করবার চেষ্টা করছি, পাকশী হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জায়গা”।

শঙ্খ ঘোষ, যাঁর মূল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ, পরিবারের সঙ্গে পাকশীতে আসেন সাত বছর বয়সে। তার পিতা শ্রী মনিন্দ্রকুমার ঘোষ চাঁদপুর হাই ইংলিশ স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব ছেড়ে জুলাই ১৯৩৯ সালে পাকশীতে আসেন চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ পাকশী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে। তাদের বংশানুক্রমিক পৈতৃক বাড়ী বরিশাল জেলার বানারীপাড়া। দেশভাগের আগে সেখান থেকে ভারতে চলে যাওয়া নিয়ে শঙ্খ ঘোষের একটি কিশোর উপন্যাস আছে “সুপুরিবনের সারি” [১ম কিশোর উপন্যাস “সকালবেলার আলোর” দ্বিতীয় পর্ব।

শঙ্খ ঘোষের জন্ম চাঁদপুরে মাতুলালয়ে। পাকশীতে এসে তাঁরা প্রথমে ওঠেন পাকশীর অফিসার্স কলোনিতে কাকার বাসায়। পরে স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতরে লাল ইটের বাসায়। পাকশীতে এসেই স্কুলে ভর্তি হননি শঙ্খ ঘোষ। বাড়িতে পড়ে সরাসরি ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন ১৯৪২ সালে। এখন থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন ১৯৪৭ সালে, পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল নাটোর। মোট ৪৭ জন ছাত্রের মধ্যে ৪ জন মুসলিম ছাত্র সেবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়- যাঁদের নাম এখনো তার স্পষ্ট মনে আছে, তারা হলেন মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম, নুরল, এ এস এম তরিকুল আলম খাঁন এবং সাইদুর। কারো কারো সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ দিন যোগাযোগ ছিল।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের বা এই উপমহাদেশের স্বাধীনতার সময়ে পাকশীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা দেখা দিলে তাঁরা স্কুল কম্পাউন্ডের বাসা ছেড়ে কিছু সময় আবার অফিসার্স কলোনিতে থাকেন। এটি ঘটেছিল স্কুলের দক্ষিণদিকে ইউসুফ বাবুর আঙ্গিনার মসজিদ শুরু করা নিয়ে। জমিটি নিয়ে স্কুলের সঙ্গে বিরোধ ছিল। ধর্মীয় দাঙ্গাই জয়ী হয়। স্কুল জমিটি হারায়। সেখানে প্রস্তাবিত বিজ্ঞানাগার হয়নি। হয় মসজিদ।

ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে শঙ্খ ঘোষরা ভারতে চলে যান। তবে তাঁর পিতা চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক একা থেকে যান আরো কিছু দিন। কিন্তু বেশি দিন নয়, পারিবারিক চাপে ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে তিনিও চলে যান কলকাতার নাড়কেলডাঙ্গা হাইস্কুলে। শ্রী মনীন্দ্রকুমার ঘোষ ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল সর্বজনবিদিত। তাঁর পাকশী ছেড়ে যাওয়ার দিন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয় পাকশী রেল স্টেশনে, চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের সব ছেলেরা এবং পাকশী গার্লস স্কুলের সব ময়েরা তাঁকে অশ্রুসজল নয়নে কলকাতাগামী দুপুরের ট্রেনে উঠিয়ে দেন।

স্কুলে পড়ার সময় শঙ্খ ঘোষ ‘টিপু সুলতান’ এবং ‘রামের সুমতি’ নাটকে অভিনয় করেন। এই সময়ে তার গলা বসে গেলে সহপাঠি সনৎ মিত্রের পরামর্শে তেজপাতার বিড়ি টেনে গলা ঠিক হয়েছিল বলে জানান সহাস্যে। পাকশী এবং চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের স্মৃতি নিয়ে ছোটদের জন্য শঙ্খ ঘোষের রয়েছে বেশ কটি মজার বই- যার নাম জানানোর লোভ সম্বরণ করতে পারছিনা :

১। সকালবেলার আলো (কিশোর উপন্যাস); প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ১৯৭২।

২। রাগ করো না রাগুনি (ছড়া); প্রথম প্রকাশ : ১৯৮৩।

৩। সুপুরিবনের সারি [সকালবেলার আলোর দ্বিতীয় পর্যায়]; (কিশোর উপন্যাস); প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ১৯৯০।

৪। আমন ধানের ছড়া (ছড়া); এপ্রিল ১৯৯১।

৫। ছোট্ট একটা স্কুল (ছেলেবেলার স্মৃতি নিয়ে লেখা মজার গল্প), জানুয়ারি ১৯৯৮।

৬। বড়ো হওয়া খুব ভুল (ছড়া); ২০০২।

৭। অল্প বয়স কল্পবয়স (ছেলেবেলার স্মৃতি নিয়ে লেখা গল্প); সেপ্টেম্বর ২০০৭।

শঙ্খ ঘোষ ১৯৪৭-এ পাকশী ছাড়ার ৩৭ বছর পরে আবার পাকশী আসেন ১৯৮৪ সালের মাঝামাঝি। আসার কথা ছিল ২০ ও ২১ শে এপ্রিল ১৯৮৪ সালে পাকশীতে অনুষ্ঠিতব্য চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের হীরক জয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগদানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যথাসময়ে আসতে পারেননি। ফিরে যেয়ে পাকশী সম্বন্ধে লেখেন সেই ঐতিহাসিক চিঠি, “... আমরা অনবরতই প্রমাণ করবার চেষ্টা করছি, পাকশী হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জায়গা।”

একই স্কুলের ছাত্র হওয়ার অধিকার নিয়ে বিগত ০২.০২.২০১০ সালে উল্টোভাঙ্গা ভিআইপি মোড়ে আবাসিক এলাকা ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসের, ছয় নম্বর ভবনের তিনতলায় তাঁর ফ্ল্যাটে শঙ্খ ঘোষের মুখোমুখি হয়েছিলাম তাঁর শৈশব-কৈশরের কথা জানতে। তিনি খুশি মনেই তাঁর প্রিয় চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ পাকশী হাইস্কুলের আরেক ছাত্রকে সময় দিয়ে ইচ্ছাপূরণ করেন এবং সম্মানিত করেন তাঁর পাকশীর পটভূমিকায় লেখা “সকালবেলার আলো” কিশোর উপন্যাসটি “পাকশী স্থলের স্মৃতিতে ইশতিয়াককে” লিখে ও স্বাক্ষর দিয়ে।

ওঠার আগে বাংলা ভাষার এই সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি শঙ্খ ঘোষকে যখন জিজ্ঞেস করি আপনার কবি হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি কী কাজ করেছে? তিনি সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে বলেন, পাকশীতে বেড়ে ওঠা ও এর পরিবেশ।

বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১ , ১৬ বৈশাখ ১৪২৮ ১৬ রমজান ১৪৪২

শঙ্খ ঘোষের পাকশী পাকশীর শঙ্খ ঘোষ

ইশতিয়াক আলম

image

পাকশীর এই চন্দ্রপ্রভা জ্ঞানপিঠে শৈশবে স্কুলজীবন কেটেছে কবি শঙ্খ ঘোষের

দীর্ঘ ৩৭ বছর পরে এসে শৈশব-কৈশরে বেড়ে ওঠা রেলশহর ঘুরে পাকশী সম্বন্ধে লেখেন, “সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের কথা শুনতে শুনতে, আর আমরা অনবরতই প্রমাণ করবার চেষ্টা করছি, পাকশী হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জায়গা”।

শঙ্খ ঘোষ, যাঁর মূল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ, পরিবারের সঙ্গে পাকশীতে আসেন সাত বছর বয়সে। তার পিতা শ্রী মনিন্দ্রকুমার ঘোষ চাঁদপুর হাই ইংলিশ স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব ছেড়ে জুলাই ১৯৩৯ সালে পাকশীতে আসেন চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ পাকশী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে। তাদের বংশানুক্রমিক পৈতৃক বাড়ী বরিশাল জেলার বানারীপাড়া। দেশভাগের আগে সেখান থেকে ভারতে চলে যাওয়া নিয়ে শঙ্খ ঘোষের একটি কিশোর উপন্যাস আছে “সুপুরিবনের সারি” [১ম কিশোর উপন্যাস “সকালবেলার আলোর” দ্বিতীয় পর্ব।

শঙ্খ ঘোষের জন্ম চাঁদপুরে মাতুলালয়ে। পাকশীতে এসে তাঁরা প্রথমে ওঠেন পাকশীর অফিসার্স কলোনিতে কাকার বাসায়। পরে স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতরে লাল ইটের বাসায়। পাকশীতে এসেই স্কুলে ভর্তি হননি শঙ্খ ঘোষ। বাড়িতে পড়ে সরাসরি ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন ১৯৪২ সালে। এখন থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন ১৯৪৭ সালে, পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল নাটোর। মোট ৪৭ জন ছাত্রের মধ্যে ৪ জন মুসলিম ছাত্র সেবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়- যাঁদের নাম এখনো তার স্পষ্ট মনে আছে, তারা হলেন মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম, নুরল, এ এস এম তরিকুল আলম খাঁন এবং সাইদুর। কারো কারো সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ দিন যোগাযোগ ছিল।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের বা এই উপমহাদেশের স্বাধীনতার সময়ে পাকশীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা দেখা দিলে তাঁরা স্কুল কম্পাউন্ডের বাসা ছেড়ে কিছু সময় আবার অফিসার্স কলোনিতে থাকেন। এটি ঘটেছিল স্কুলের দক্ষিণদিকে ইউসুফ বাবুর আঙ্গিনার মসজিদ শুরু করা নিয়ে। জমিটি নিয়ে স্কুলের সঙ্গে বিরোধ ছিল। ধর্মীয় দাঙ্গাই জয়ী হয়। স্কুল জমিটি হারায়। সেখানে প্রস্তাবিত বিজ্ঞানাগার হয়নি। হয় মসজিদ।

ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে শঙ্খ ঘোষরা ভারতে চলে যান। তবে তাঁর পিতা চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক একা থেকে যান আরো কিছু দিন। কিন্তু বেশি দিন নয়, পারিবারিক চাপে ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে তিনিও চলে যান কলকাতার নাড়কেলডাঙ্গা হাইস্কুলে। শ্রী মনীন্দ্রকুমার ঘোষ ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল সর্বজনবিদিত। তাঁর পাকশী ছেড়ে যাওয়ার দিন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয় পাকশী রেল স্টেশনে, চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের সব ছেলেরা এবং পাকশী গার্লস স্কুলের সব ময়েরা তাঁকে অশ্রুসজল নয়নে কলকাতাগামী দুপুরের ট্রেনে উঠিয়ে দেন।

স্কুলে পড়ার সময় শঙ্খ ঘোষ ‘টিপু সুলতান’ এবং ‘রামের সুমতি’ নাটকে অভিনয় করেন। এই সময়ে তার গলা বসে গেলে সহপাঠি সনৎ মিত্রের পরামর্শে তেজপাতার বিড়ি টেনে গলা ঠিক হয়েছিল বলে জানান সহাস্যে। পাকশী এবং চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের স্মৃতি নিয়ে ছোটদের জন্য শঙ্খ ঘোষের রয়েছে বেশ কটি মজার বই- যার নাম জানানোর লোভ সম্বরণ করতে পারছিনা :

১। সকালবেলার আলো (কিশোর উপন্যাস); প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ১৯৭২।

২। রাগ করো না রাগুনি (ছড়া); প্রথম প্রকাশ : ১৯৮৩।

৩। সুপুরিবনের সারি [সকালবেলার আলোর দ্বিতীয় পর্যায়]; (কিশোর উপন্যাস); প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ১৯৯০।

৪। আমন ধানের ছড়া (ছড়া); এপ্রিল ১৯৯১।

৫। ছোট্ট একটা স্কুল (ছেলেবেলার স্মৃতি নিয়ে লেখা মজার গল্প), জানুয়ারি ১৯৯৮।

৬। বড়ো হওয়া খুব ভুল (ছড়া); ২০০২।

৭। অল্প বয়স কল্পবয়স (ছেলেবেলার স্মৃতি নিয়ে লেখা গল্প); সেপ্টেম্বর ২০০৭।

শঙ্খ ঘোষ ১৯৪৭-এ পাকশী ছাড়ার ৩৭ বছর পরে আবার পাকশী আসেন ১৯৮৪ সালের মাঝামাঝি। আসার কথা ছিল ২০ ও ২১ শে এপ্রিল ১৯৮৪ সালে পাকশীতে অনুষ্ঠিতব্য চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের হীরক জয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগদানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যথাসময়ে আসতে পারেননি। ফিরে যেয়ে পাকশী সম্বন্ধে লেখেন সেই ঐতিহাসিক চিঠি, “... আমরা অনবরতই প্রমাণ করবার চেষ্টা করছি, পাকশী হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জায়গা।”

একই স্কুলের ছাত্র হওয়ার অধিকার নিয়ে বিগত ০২.০২.২০১০ সালে উল্টোভাঙ্গা ভিআইপি মোড়ে আবাসিক এলাকা ঈশ্বরচন্দ্র নিবাসের, ছয় নম্বর ভবনের তিনতলায় তাঁর ফ্ল্যাটে শঙ্খ ঘোষের মুখোমুখি হয়েছিলাম তাঁর শৈশব-কৈশরের কথা জানতে। তিনি খুশি মনেই তাঁর প্রিয় চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ পাকশী হাইস্কুলের আরেক ছাত্রকে সময় দিয়ে ইচ্ছাপূরণ করেন এবং সম্মানিত করেন তাঁর পাকশীর পটভূমিকায় লেখা “সকালবেলার আলো” কিশোর উপন্যাসটি “পাকশী স্থলের স্মৃতিতে ইশতিয়াককে” লিখে ও স্বাক্ষর দিয়ে।

ওঠার আগে বাংলা ভাষার এই সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি শঙ্খ ঘোষকে যখন জিজ্ঞেস করি আপনার কবি হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি কী কাজ করেছে? তিনি সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে বলেন, পাকশীতে বেড়ে ওঠা ও এর পরিবেশ।