দ্রুত চালু হবে বিজেএমসির বন্ধ পাটকল : বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী

বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেছেন, বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) বন্ধ থাকা মিলগুলো দ্রুততম সময়ে ভাড়া ভিত্তিক ইজারা পদ্ধতিতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পুনরায় চালুর বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে মন্ত্রণালয়ের মাসিক সমন্বয় সভায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

মন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বিজ্ঞপ্তির আওতায় দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা লিজ গ্রহণের সুযোগ পাবেন। এক্ষেত্রে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগকে (এফডিআই) অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হবে। পৃথিবী জুড়ে পাটের কদর ও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাট চাষিরা বর্তমানে কাঁচা পাটের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন। চলতি পাট মৌসুমে কাঁচা পাটের গড়দর ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। ফলে পাট চাষিরা এ মৌসুমে অধিক পরিমাণে পাট চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তিনি বলেন, উৎপাদন বন্ধ থাকা ২৫টি মিলের মধ্যে চারটি মিলের (জাতীয়, খালিশপুর, দৌলতপুর ও কেএফডি) শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ২০২০ সালের আগস্ট মাসে পরিশোধ করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত ও অবসায়নকৃত ৩৪ হাজার ৭৫৭ জন স্থায়ী শ্রমিকদের পাওনাদি ২ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে পাওনার ক্ষেত্রে অর্ধেক নগদে ও অর্ধেক তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধের সিদ্ধান্ত আছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১টি মিলের সবগুলোতে নগদ অংশ পরিশোধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে এ পর্যন্ত ১৭৬৯.৪১ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত ৩১ হাজার ৭৫৭ জন শ্রমিকের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে ১৬৬২.১৭ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, যা বরাদ্দের তুলনায় প্রায় ৯৩.৯৪ শতাংশ। মামলাজনিত সমস্যা, অডিট আপত্তিজনিত সমস্যা, শ্রমিকদের নামের সঙ্গে এনআইডির গরমিল, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাব না থাকার কারণে কিছু সংখ্যক শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধ বিলম্বিত হচ্ছে।

সভায় জানানো হয়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৯৫৩.৫৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২.৯৪ শতাংশ বেশি। আর তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১০.৬৪ শতাংশ বেশি। সভায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুল মান্নান, অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল কালামসহ বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তর সংস্থার প্রধানরা যুক্ত ছিলেন।

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন, পরিত্যক্ত ও সাবেক ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের ৭৮টি পাটকল নিয়ে বিজেএমসি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালে মিলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮২। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সময় ৩৫টি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। আটটি পাটকলের পুঁজি প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৯০ সালের পর বিশ্বব্যাংকের পাট খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ১১টি পাটকল বন্ধ, বিক্রি ও একীভূত করা হয়। ২০০২ সালের জুনে বন্ধ হয় আদমজী জুট মিল। বর্তমানে বিজেএমসির আওতায় ২৬টি পাটকলের মধ্যে গত সপ্তাহ পর্যন্ত চালু ছিল ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন-জুট কারখানা।

এর পর নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার মেনে বর্তমান মহাজোট সরকার ২০০৯ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল লাভজনক করতে কর্মপরিকল্পনা করে। বকেয়া মজুরি ও দায়দেনা শোধের জন্য ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা দেয় সরকার। দুই বছরের মধ্যে বন্ধ থাকা দুটি পাটকল চালু করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে চালু হয় আরও তিনটি, যা বেসরকারি খাত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।

সরকারের পাটকলগুলো ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। সে সময় যেসব যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছিল, তা দিয়েই চালানো হচ্ছিল। ফলে উৎপাদনশীলতা অর্ধেকে নেমে আসে। ২০০৯ সালে পাটকল লাভজনক করার উদ্যোগ নেয়া হলেও যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নে নজর দেয়া হয়নি। এমনকি যে বিজেএমসিকে নিয়ে বর্তমানে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে, সেখানেও সংস্কারের কোন হাত পড়েনি। ফলে লোকসানের গল্পের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরেই কেবল একবার সরকারি পাটকলগুলো ১৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা মুনাফা করে। পরের বছরই ৬৬ কোটি টাকা লোকসান করে। তারপর ধারাবাহিকভাবে লোকসান বেড়েছে। এর মধ্যে সব মিলিয়ে গত ১০ বছরেই ৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল। দেরিতে হলেও পাটকলের আধুনিকায়নে একটা উদ্যোগ নিয়েছিল অবশ্য বিজেএমসি। সেখানেও ছিল গলদ। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইউএমসি, জেজেআই ও গালফা হাবিব এই তিন মিল বিএমআরই করার জন্য ১৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়। একনেকে পাসের পর গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আড়াই কোটি টাকা ছাড় করা হলেও পুরোটা ব্যয় করতে পারেনি করপোরেশন। ৩৭ লাখ টাকা ফেরত যায় সরকারের কোষাগারে। এরপর ২২টি পাটকল বিএমআরই করার জন্য চীনা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা এগোলেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। এরপর অবশেষে পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর সরকার ফের সেগুলো চালু করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।

বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১ , ১৬ বৈশাখ ১৪২৮ ১৬ রমজান ১৪৪২

দ্রুত চালু হবে বিজেএমসির বন্ধ পাটকল : বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

image

বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেছেন, বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) বন্ধ থাকা মিলগুলো দ্রুততম সময়ে ভাড়া ভিত্তিক ইজারা পদ্ধতিতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পুনরায় চালুর বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে মন্ত্রণালয়ের মাসিক সমন্বয় সভায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

মন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বিজ্ঞপ্তির আওতায় দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা লিজ গ্রহণের সুযোগ পাবেন। এক্ষেত্রে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগকে (এফডিআই) অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হবে। পৃথিবী জুড়ে পাটের কদর ও চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাট চাষিরা বর্তমানে কাঁচা পাটের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন। চলতি পাট মৌসুমে কাঁচা পাটের গড়দর ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। ফলে পাট চাষিরা এ মৌসুমে অধিক পরিমাণে পাট চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তিনি বলেন, উৎপাদন বন্ধ থাকা ২৫টি মিলের মধ্যে চারটি মিলের (জাতীয়, খালিশপুর, দৌলতপুর ও কেএফডি) শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ২০২০ সালের আগস্ট মাসে পরিশোধ করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত ও অবসায়নকৃত ৩৪ হাজার ৭৫৭ জন স্থায়ী শ্রমিকদের পাওনাদি ২ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে পাওনার ক্ষেত্রে অর্ধেক নগদে ও অর্ধেক তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধের সিদ্ধান্ত আছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১টি মিলের সবগুলোতে নগদ অংশ পরিশোধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে এ পর্যন্ত ১৭৬৯.৪১ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত ৩১ হাজার ৭৫৭ জন শ্রমিকের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে ১৬৬২.১৭ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, যা বরাদ্দের তুলনায় প্রায় ৯৩.৯৪ শতাংশ। মামলাজনিত সমস্যা, অডিট আপত্তিজনিত সমস্যা, শ্রমিকদের নামের সঙ্গে এনআইডির গরমিল, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের ব্যাংক হিসাব না থাকার কারণে কিছু সংখ্যক শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধ বিলম্বিত হচ্ছে।

সভায় জানানো হয়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৯৫৩.৫৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২.৯৪ শতাংশ বেশি। আর তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১০.৬৪ শতাংশ বেশি। সভায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুল মান্নান, অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল কালামসহ বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তর সংস্থার প্রধানরা যুক্ত ছিলেন।

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন, পরিত্যক্ত ও সাবেক ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের ৭৮টি পাটকল নিয়ে বিজেএমসি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালে মিলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮২। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সময় ৩৫টি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। আটটি পাটকলের পুঁজি প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৯০ সালের পর বিশ্বব্যাংকের পাট খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ১১টি পাটকল বন্ধ, বিক্রি ও একীভূত করা হয়। ২০০২ সালের জুনে বন্ধ হয় আদমজী জুট মিল। বর্তমানে বিজেএমসির আওতায় ২৬টি পাটকলের মধ্যে গত সপ্তাহ পর্যন্ত চালু ছিল ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন-জুট কারখানা।

এর পর নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার মেনে বর্তমান মহাজোট সরকার ২০০৯ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল লাভজনক করতে কর্মপরিকল্পনা করে। বকেয়া মজুরি ও দায়দেনা শোধের জন্য ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা দেয় সরকার। দুই বছরের মধ্যে বন্ধ থাকা দুটি পাটকল চালু করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে চালু হয় আরও তিনটি, যা বেসরকারি খাত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।

সরকারের পাটকলগুলো ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। সে সময় যেসব যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছিল, তা দিয়েই চালানো হচ্ছিল। ফলে উৎপাদনশীলতা অর্ধেকে নেমে আসে। ২০০৯ সালে পাটকল লাভজনক করার উদ্যোগ নেয়া হলেও যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নে নজর দেয়া হয়নি। এমনকি যে বিজেএমসিকে নিয়ে বর্তমানে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে, সেখানেও সংস্কারের কোন হাত পড়েনি। ফলে লোকসানের গল্পের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরেই কেবল একবার সরকারি পাটকলগুলো ১৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা মুনাফা করে। পরের বছরই ৬৬ কোটি টাকা লোকসান করে। তারপর ধারাবাহিকভাবে লোকসান বেড়েছে। এর মধ্যে সব মিলিয়ে গত ১০ বছরেই ৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল। দেরিতে হলেও পাটকলের আধুনিকায়নে একটা উদ্যোগ নিয়েছিল অবশ্য বিজেএমসি। সেখানেও ছিল গলদ। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইউএমসি, জেজেআই ও গালফা হাবিব এই তিন মিল বিএমআরই করার জন্য ১৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়। একনেকে পাসের পর গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আড়াই কোটি টাকা ছাড় করা হলেও পুরোটা ব্যয় করতে পারেনি করপোরেশন। ৩৭ লাখ টাকা ফেরত যায় সরকারের কোষাগারে। এরপর ২২টি পাটকল বিএমআরই করার জন্য চীনা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা এগোলেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। এরপর অবশেষে পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর সরকার ফের সেগুলো চালু করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।