মুনিয়াকে হত্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ

কলেজছাত্রী মোসরাত জাহান মুনিয়াকে হত্যা করা হয়েছে নাকি আত্মহত্যা ছিল সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে পুলিশ ময়নাতদন্ত রিপোর্টের অপেক্ষায় আছে। পারিপার্শ্বিক আলামতে মুনিয়াকে হত্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ। তবে মুনিয়া আত্মহত্যার ঘটনায় বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে প্ররোচনকারী হিসেবে উল্লেখ করে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেই অভিযোগের প্রমাণ জোগাড় করতে কাজ করছে পুলিশ। আর আনভীরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে সেই অভিযোগের প্রমাণ জোগাড় করে আনভীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায় পুলিশ।

এখন পর্যন্ত মুনিয়ার পরিবারের জোর দাবি যে অবস্থায় মুনিয়াকে পাওয়া গেছে তাতে মুনিয়া আত্মহত্যা করেছে বলে মনে হয় না। তাকে নির্মম নির্যাতনে হত্যা করে লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা আইন অনুযায়ী তদন্ত চলবে। ‘যেই অপরাধী হোক, তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এটা তদন্তাধীন। তদন্তের পরে আমরা বলতে পারবো।

এদিকে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর হত্যা মামলার আগাম জামিন চেয়েছেন তার আইনজীবীর মাধ্যমে। মামলার অগ্রগতি বিষয়ে গতকাল পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, আমাদের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সিসিটিভি ফুটেজ ওই ভবনের এবং এর আশপাশের বিভিন্ন সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে নিয়েছি। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে মুনিয়ার ফ্ল্যাটে সায়েম সোবহান আনভীরের যাতায়াতের তথ্য পেয়েছি। আদালতের অনুমতি নিয়ে আমরা এসব ফুটেজ সাক্ষ্য হিসেবে নেব। মুনিয়ার বাসার আশপাশে সন্দেহজনক কারো মুভমেন্ট পাওয়া গেছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বাড়ির অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্টে লোকজনের বসবাস আছে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা ফুটেজে অনেকের গতিবিধি পেয়েছি। কিন্তু কোন সন্দেহজনক মুভমেন্ট আমরা এখনও পাইনি। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ঘটনায় ফ্ল্যাটের মালিক, তার মেয়ের জামাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এছাড়া যিনি ম্যানেজার ছিলেন তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তবে এগুলো প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ। অফিসিয়ালি জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের বক্তব্য নেয়ার বিষয়গুলো প্রক্রিয়াধীন আছে। ওই বাড়ির ম্যানেজার, সিকিউরিটি গার্ড ও গৃহকর্মীদের আদালতের মাধ্যমে অথবা ১৬১ ধারায় জবানবন্দি নেয়া হবে।

মুনিয়ার উদ্ধার হওয়া ফোনে পুলিশ কী কী তথ্য পেয়েছে- এই প্রশ্নের উত্তরে গুলশানের ডিসি বলেন, আমরা ভিকটিমের দুটি ফোন সিজ করেছি। এই ফোনগুলো নিয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছে। তারা এগুলো বিশ্লেষণ করছেন । ডিসি জানান, মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেই অভিযোগের প্রমাণ জোগার করতে আমরা কাজ করছি। ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট, বা বস্তুগত সাক্ষ্য, দালিলিক প্রমাণ জোগার করার বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। আত্মহত্যায় প্রচারনাকারী হিসেবে আনভীরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তাতে একটি হচ্ছে অভিপ্রায় আরেকটি হচ্ছে প্ররোচনাকারী। তাই এক্ষেত্রে ভিকটিম (মুনিয়া) এবং আসামির (আনভীর) মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কে বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, ফরেনসিক প্রতিবেদনের অপেক্ষা করছেন তারা। এরপরই বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণ করবেন পুলিশ। আনভীরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো এসেছে সেগুলো প্রমাণ সাপেক্ষে দ-বিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী আনভীরের বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিবে পুলিশ।

গুলশান থানা পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, এই মামলায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ করেছেন ভিকটিমের বোন মামলার বাদী। আত্মহত্যার প্ররোচনা এবং প্ররোচনার অভিপ্রায় এই দুটি বিষয়কে প্রমাণ করতে পুলিশ তদন্ত করে যাচ্ছে। দুটি বিষয়কে প্রমাণ করার জন্য পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ, ভিকটিমের ডায়েরি, ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করে যাচাইসহ পর্যাপ্ত সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ করছে। মরদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দ্রুত দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ। এছাড়া মরদেহের ডিএনএ প্রোফাইলিং এবং ফরেনসিক রিপোর্ট করার জন্যও পুলিশের পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের অনুরোধ করা হয়েছে। আর এসব বিষয়ের ওপরেই মামলার পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নির্ভর করছে।

গুলশান থানা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাড়ির (বি/৩) যে ফ্ল্যাটটিতে মোসরাত জাহান মুনিয়া ভাড়া থাকতেন, সেখানে যাতায়াত ছিল বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের। মুনিয়া যে ফ্ল্যাটটিতে থাকতেন সেই ভবনের বেশকিছু সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ওই ফ্ল্যাটে সায়েম সোবহান আনভীরের যাতায়াতের প্রমাণ পেয়েছে তারা। তবে ঘটনার দিন বা এর আগের দিন মুনিয়ার ফ্ল্যাটে আনভীরের যাতায়াতের কোন ফুটেজ পাননি তারা। মুনিয়া আত্মহত্যা করেছে সেই রহস্য উদঘাটনে গতকাল পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। যে ফ্ল্যাটে মুনিয়ার লাশ মিলেছে সেই ফ্ল্যাটের মালিক, মালিকের মেয়ের জামাইসহ বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের মামলার তদন্তের কাজে আসতে পারে এমন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে তারা। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছে। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, মুনিয়ার সঙ্গে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের যে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল সে বিষয়ে তারা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন। সম্পর্কের কারণেই ২ বছর আগে মুনিয়াকে বনানীতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে দেন সায়েম সোবহান আনভীর। সেই ফ্ল্যাটের ভাড়াও আনভীর বহন করতেন। সেই ফ্ল্যাটে মুনিয়া একাই থাকতো। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আনভীরের। আনভীরের সঙ্গে মুনিয়ার ঘনিষ্ট কিছু ছবি পুলিশের কাছে এসেছে। কিছু ছবি সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়েছে। এর আগে মুনিয়া মিরপুরে একটি ফ্ল্যাটে ছিলেন। সেই ফ্ল্যাটেও আনভীরের যাতায়াত ছিল। আনভীর গাড়ি নিয়ে সেখানে যেতেন। সেখানে মুনিয়া আনভীরকে স্বামী বলেও পরিচয় দিতেন।

দেশেই আত্মগোপনে আনভীর

মুনিয়ার মৃত্যুর বসুন্ধরার এমডি আনভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে অভিযোগ তুলে মামলা দায়েরের পর থেকে খোঁজ মিলছে না আনভীরের। গুঞ্জন উঠেছে যে রাতে মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ ওই রাতেই আনভীর একটি কার্গো বিমানে করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আনভীরের পর তার স্ত্রী ও পরিবারের কয়েকজন দেশ ছেড়েছেন। এ বিষয়ে পুলিশের গুলশান বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, বৈধভাবে আনভীরের দেশত্যাগ করে পালানোর কোন সুযোগ নেই। এছাড়া ইমিগ্রেশনের সবগুলো চেকপোস্ট ঘেটে আনভীরের বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়ার কোন প্রমাণ মেলিনি। গুলশানের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, এটি তারা প্রচার করছে। আমরা নিশ্চিত হয়েছে আনভীর দেশেই আছে। সে পালিয়ে যেতে পারেনি।

কী ছিল সেই ডায়েরিতে

মুনিয়ার লাশ যে ফ্ল্যাটে মিলেছে সেই ফ্ল্যাট থেকে বিভিন্ন আলামতের সঙ্গে মুনিয়ার লেখা ডায়েরি উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওই ডায়েরিতে মুনিয়ার জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা, আনভীরের সঙ্গে মুনিয়ার কিভাবে পরিচয়, এরপর মেলামেশাসহ নানা বিষয় লেখা ছিল। পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, ছয়টি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে। এটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

মুনিয়া মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের

এদিকে মুনিয়া মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ কেন্দ্রীয় কমিটির। সংগঠনের সভাপতি মো. সাজ্জাদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জামান শাহীন গতকাল এক বিবৃতিতে এটা হত্যা না আত্মহত্যা, এ নিয়ে সঠিক তদন্ত প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি। তাই এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর সঠিক বিচারের স্বার্থে এবং মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার আইনের শাসনে বিশ^াস করে। এই দেশকে স্বাধীন করতে মুনিয়ার বাবার অসামান্য অবদানের কথা বিবেচনায় নিয়ে এবং আইনের শাসন সমুন্নত রাখার স্বার্থে আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার দাবি করছি।

আগাম জামিন চেয়েছে আনভীর

এদিকে কলেজ শিক্ষার্থী মোসারাত জাহান মুনিয়ার মুত্যুর ঘটনায় প্ররোচনাকারী হিসেবে মামলায় আসামি করার পর আগাম জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর। গতকাল মামলাটি হাইকোর্টের কার্যতালিকায় ১৪ নম্বর ক্রমিকে রাখা হয়েছে। এর ফলে আজ বৃহস্পতিবার জামিন আবেদনটির ওপর বিচারপতি মামুনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি হবে।

বৃহস্পতিবার, ২৯ এপ্রিল ২০২১ , ১৬ বৈশাখ ১৪২৮ ১৬ রমজান ১৪৪২

মুনিয়াকে হত্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

মুনিয়ার মৃত্যু ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে গতকাল রাজধানীতে নারীমুক্তি কেন্দ্রের মানববন্ধন -সংবাদ

কলেজছাত্রী মোসরাত জাহান মুনিয়াকে হত্যা করা হয়েছে নাকি আত্মহত্যা ছিল সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে পুলিশ ময়নাতদন্ত রিপোর্টের অপেক্ষায় আছে। পারিপার্শ্বিক আলামতে মুনিয়াকে হত্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ। তবে মুনিয়া আত্মহত্যার ঘটনায় বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে প্ররোচনকারী হিসেবে উল্লেখ করে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেই অভিযোগের প্রমাণ জোগাড় করতে কাজ করছে পুলিশ। আর আনভীরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে সেই অভিযোগের প্রমাণ জোগাড় করে আনভীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায় পুলিশ।

এখন পর্যন্ত মুনিয়ার পরিবারের জোর দাবি যে অবস্থায় মুনিয়াকে পাওয়া গেছে তাতে মুনিয়া আত্মহত্যা করেছে বলে মনে হয় না। তাকে নির্মম নির্যাতনে হত্যা করে লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা আইন অনুযায়ী তদন্ত চলবে। ‘যেই অপরাধী হোক, তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এটা তদন্তাধীন। তদন্তের পরে আমরা বলতে পারবো।

এদিকে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর হত্যা মামলার আগাম জামিন চেয়েছেন তার আইনজীবীর মাধ্যমে। মামলার অগ্রগতি বিষয়ে গতকাল পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, আমাদের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সিসিটিভি ফুটেজ ওই ভবনের এবং এর আশপাশের বিভিন্ন সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে নিয়েছি। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে মুনিয়ার ফ্ল্যাটে সায়েম সোবহান আনভীরের যাতায়াতের তথ্য পেয়েছি। আদালতের অনুমতি নিয়ে আমরা এসব ফুটেজ সাক্ষ্য হিসেবে নেব। মুনিয়ার বাসার আশপাশে সন্দেহজনক কারো মুভমেন্ট পাওয়া গেছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বাড়ির অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্টে লোকজনের বসবাস আছে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা ফুটেজে অনেকের গতিবিধি পেয়েছি। কিন্তু কোন সন্দেহজনক মুভমেন্ট আমরা এখনও পাইনি। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ঘটনায় ফ্ল্যাটের মালিক, তার মেয়ের জামাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এছাড়া যিনি ম্যানেজার ছিলেন তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তবে এগুলো প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ। অফিসিয়ালি জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের বক্তব্য নেয়ার বিষয়গুলো প্রক্রিয়াধীন আছে। ওই বাড়ির ম্যানেজার, সিকিউরিটি গার্ড ও গৃহকর্মীদের আদালতের মাধ্যমে অথবা ১৬১ ধারায় জবানবন্দি নেয়া হবে।

মুনিয়ার উদ্ধার হওয়া ফোনে পুলিশ কী কী তথ্য পেয়েছে- এই প্রশ্নের উত্তরে গুলশানের ডিসি বলেন, আমরা ভিকটিমের দুটি ফোন সিজ করেছি। এই ফোনগুলো নিয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছে। তারা এগুলো বিশ্লেষণ করছেন । ডিসি জানান, মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেই অভিযোগের প্রমাণ জোগার করতে আমরা কাজ করছি। ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট, বা বস্তুগত সাক্ষ্য, দালিলিক প্রমাণ জোগার করার বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। আত্মহত্যায় প্রচারনাকারী হিসেবে আনভীরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তাতে একটি হচ্ছে অভিপ্রায় আরেকটি হচ্ছে প্ররোচনাকারী। তাই এক্ষেত্রে ভিকটিম (মুনিয়া) এবং আসামির (আনভীর) মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কে বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, ফরেনসিক প্রতিবেদনের অপেক্ষা করছেন তারা। এরপরই বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণ করবেন পুলিশ। আনভীরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো এসেছে সেগুলো প্রমাণ সাপেক্ষে দ-বিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী আনভীরের বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিবে পুলিশ।

গুলশান থানা পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, এই মামলায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ করেছেন ভিকটিমের বোন মামলার বাদী। আত্মহত্যার প্ররোচনা এবং প্ররোচনার অভিপ্রায় এই দুটি বিষয়কে প্রমাণ করতে পুলিশ তদন্ত করে যাচ্ছে। দুটি বিষয়কে প্রমাণ করার জন্য পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ, ভিকটিমের ডায়েরি, ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করে যাচাইসহ পর্যাপ্ত সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ করছে। মরদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দ্রুত দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ। এছাড়া মরদেহের ডিএনএ প্রোফাইলিং এবং ফরেনসিক রিপোর্ট করার জন্যও পুলিশের পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের অনুরোধ করা হয়েছে। আর এসব বিষয়ের ওপরেই মামলার পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নির্ভর করছে।

গুলশান থানা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাড়ির (বি/৩) যে ফ্ল্যাটটিতে মোসরাত জাহান মুনিয়া ভাড়া থাকতেন, সেখানে যাতায়াত ছিল বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের। মুনিয়া যে ফ্ল্যাটটিতে থাকতেন সেই ভবনের বেশকিছু সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ওই ফ্ল্যাটে সায়েম সোবহান আনভীরের যাতায়াতের প্রমাণ পেয়েছে তারা। তবে ঘটনার দিন বা এর আগের দিন মুনিয়ার ফ্ল্যাটে আনভীরের যাতায়াতের কোন ফুটেজ পাননি তারা। মুনিয়া আত্মহত্যা করেছে সেই রহস্য উদঘাটনে গতকাল পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। যে ফ্ল্যাটে মুনিয়ার লাশ মিলেছে সেই ফ্ল্যাটের মালিক, মালিকের মেয়ের জামাইসহ বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের মামলার তদন্তের কাজে আসতে পারে এমন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে তারা। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছে। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, মুনিয়ার সঙ্গে বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের যে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল সে বিষয়ে তারা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন। সম্পর্কের কারণেই ২ বছর আগে মুনিয়াকে বনানীতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে দেন সায়েম সোবহান আনভীর। সেই ফ্ল্যাটের ভাড়াও আনভীর বহন করতেন। সেই ফ্ল্যাটে মুনিয়া একাই থাকতো। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আনভীরের। আনভীরের সঙ্গে মুনিয়ার ঘনিষ্ট কিছু ছবি পুলিশের কাছে এসেছে। কিছু ছবি সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়েছে। এর আগে মুনিয়া মিরপুরে একটি ফ্ল্যাটে ছিলেন। সেই ফ্ল্যাটেও আনভীরের যাতায়াত ছিল। আনভীর গাড়ি নিয়ে সেখানে যেতেন। সেখানে মুনিয়া আনভীরকে স্বামী বলেও পরিচয় দিতেন।

দেশেই আত্মগোপনে আনভীর

মুনিয়ার মৃত্যুর বসুন্ধরার এমডি আনভীরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে অভিযোগ তুলে মামলা দায়েরের পর থেকে খোঁজ মিলছে না আনভীরের। গুঞ্জন উঠেছে যে রাতে মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ ওই রাতেই আনভীর একটি কার্গো বিমানে করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আনভীরের পর তার স্ত্রী ও পরিবারের কয়েকজন দেশ ছেড়েছেন। এ বিষয়ে পুলিশের গুলশান বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, বৈধভাবে আনভীরের দেশত্যাগ করে পালানোর কোন সুযোগ নেই। এছাড়া ইমিগ্রেশনের সবগুলো চেকপোস্ট ঘেটে আনভীরের বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়ার কোন প্রমাণ মেলিনি। গুলশানের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, এটি তারা প্রচার করছে। আমরা নিশ্চিত হয়েছে আনভীর দেশেই আছে। সে পালিয়ে যেতে পারেনি।

কী ছিল সেই ডায়েরিতে

মুনিয়ার লাশ যে ফ্ল্যাটে মিলেছে সেই ফ্ল্যাট থেকে বিভিন্ন আলামতের সঙ্গে মুনিয়ার লেখা ডায়েরি উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওই ডায়েরিতে মুনিয়ার জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা, আনভীরের সঙ্গে মুনিয়ার কিভাবে পরিচয়, এরপর মেলামেশাসহ নানা বিষয় লেখা ছিল। পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, ছয়টি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে। এটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

মুনিয়া মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের

এদিকে মুনিয়া মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ কেন্দ্রীয় কমিটির। সংগঠনের সভাপতি মো. সাজ্জাদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জামান শাহীন গতকাল এক বিবৃতিতে এটা হত্যা না আত্মহত্যা, এ নিয়ে সঠিক তদন্ত প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি। তাই এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর সঠিক বিচারের স্বার্থে এবং মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে। তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার আইনের শাসনে বিশ^াস করে। এই দেশকে স্বাধীন করতে মুনিয়ার বাবার অসামান্য অবদানের কথা বিবেচনায় নিয়ে এবং আইনের শাসন সমুন্নত রাখার স্বার্থে আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার দাবি করছি।

আগাম জামিন চেয়েছে আনভীর

এদিকে কলেজ শিক্ষার্থী মোসারাত জাহান মুনিয়ার মুত্যুর ঘটনায় প্ররোচনাকারী হিসেবে মামলায় আসামি করার পর আগাম জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর। গতকাল মামলাটি হাইকোর্টের কার্যতালিকায় ১৪ নম্বর ক্রমিকে রাখা হয়েছে। এর ফলে আজ বৃহস্পতিবার জামিন আবেদনটির ওপর বিচারপতি মামুনুন রহমান ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি হবে।