মামুনুলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর

হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা। কেবল ধর্ষণই নয় টানা ২৪ দিন তাকে রাজধানীর একটি বাড়িতে আটকে রাখারও অভিযোগ করেছেন তিনি। বড় ছেলের সঙ্গে যোগাযোগের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে গত ২৭ এপ্রিল উদ্ধার হয়েছেন বলেও মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন বাদী জান্নাত আরা ঝর্ণা।

গতকাল সকাল সোয়া দশটার দিকে নিজে বাদী হয়ে সোনারগাঁ থানায় মামলাটি দায়ের করেন তিনি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন থানার ওসি হাফিজুর রহমান।

গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টে এই নারীসহ অবরুদ্ধ হয়েছিলেন মামুনুল হক। তখন তাকে দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করেছিলেন তিনি। যদিও মামলার কোথাও মামুনুল হককে বিয়ের কথা উল্লেখ করেননি মামলার বাদী। তাকে বিয়ে না করেই নানা প্রলোভনে ও প্রতারণার মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন বলে অভিযোগ ওই নারীর।

এদিকে এই মামলায় হেফাজতে ইসলামের সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হককে গ্রেপ্তার দেখানো হবে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম। তিনি বলেন, সকালে মামুনুল হকের কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানায় ধর্ষণের লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগটি আমলে নিয়ে মামলা হিসেবে রুজু করা হয়। অভিযোগকারীর ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়েছে। মামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সামগ্রিক তদন্ত ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি তদন্ত করা হচ্ছে। ভুক্তভোগী যেন সুবিচার পান সে চেষ্টা থাকবে। এক প্রশ্নের জবাবে এসপি আরও বলেন, মামলার কার্যক্রম অনুযায়ী এই মামলায় আসামিকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হবে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডেরও আবেদন করা হবে।

মামলার এজাহারে বাদী জান্নাত আরা ঝর্ণা বলেছেন, ‘বিয়ের প্রলোভন ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে মামুনুল হক আমার সঙ্গে সম্পর্ক করেছেন। কিন্তু বিয়ের কথা বললে মামুনুল করছি, করব বলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। ২০১৮ সাল থেকে ঘোরাঘুরির কথা বলে মামুনুল বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্টে আমাকে নিয়ে যান।’

এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ২০০৫ সালে সাবেক স্বামীর মাধ্যমে মাওলানা মামুনুল হকের সঙ্গে পরিচয় হয় ওই নারীর। স্বামীর বন্ধু হওয়ায় তাদের বাড়িতে মামুনুলের অবাধ যাতায়াত ছিল। মামুনুলের সঙ্গে পরিচয়ের আগে তাদের সংসার সুখে-শান্তিতে চলছিল বলে উল্লেখ করেন মামলার বাদী জান্নাত আরা ঝর্ণা। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মতানৈক্যের মধ্যে প্রবেশ করে মামুনুল হক আমার স্বামী ও আমার মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে থাকেন। মামুনুলের কারণে আমাদের দাম্পত্য জীবন চরমভাবে বিষিয়ে ওঠে। সাংসারিক এই টানাপড়েনের একপর্যায়ে মামনুলের কু-পরামর্শে ২০১৮ সালের ১০ আগস্ট আমাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।’

অভিযোগে মামুনুল হকের দাবি করা কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা বলেন, ‘বিচ্ছেদের পর তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিকভাবে অসহায় হয়ে পড়েন। এ সময় মামুনুল আমাকে খুলনা থেকে ঢাকায় আসার জন্য বলেন। আমি ঢাকায় চলে আসি। মামুনুল আমাকে তার অনুসারীদের বাসায় রাখেন। সেখানে নানাভাবে আমাকে প্রস্তাব দেন। একপর্যায়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে তার প্রলোভনে পা দেই। এরপর তিনি উত্তর ধানমন্ডির নর্থ সার্কুলার রোডের একটি বাসায় আমাকে সাবলেট রাখেন। একটি বিউটি পার্লারে কাজের ব্যবস্থা করে দেন। ঢাকায় থাকার খরচ মামুনুলই দিচ্ছিলেন। গত দুই বছর যাবত আমাকে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় পরিচিত বিভিন্ন হোটেল ও রিসোর্টে ঘোরাঘুরির নাম করে রাত্রিযাপন করতেন এবং বিয়ের আশ্বাস দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতেন।’

অভিযোগে ওই নারী বলেন, ‘৩ এপ্রিল সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টে ঘোরাঘুরির কথা বলে মামুনুল হক নিয়ে যান। সেখানে অবস্থানকালে কিছু মানুষ আমাদের আটক করে ফেলে। পরে মামুনুল হকের অনুসারীরা রিসোর্টে হামলা করে আমাদের নিয়ে যায়। কিন্তু মামুনুল আমাকে নিজের বাসায় ফিরতে না দিয়ে পরিচিত একজনের বাসায় আটকে রাখেন। কারও সঙ্গে যোগাযোগও করতে দেননি। পরে কৌশলে আমি আমার বড় ছেলেকে আমার দুরবস্থার সব কথা জানাই এবং আমাকে বন্দীদশা থেকে উদ্ধারের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে বলি। পরে গত ২৭ এপ্রিল ডিবি পুলিশ আমাকে উদ্ধার করলে জানতে পারি, আমার বাবা রাজধানীর কলাবাগান থানায় আমাকে উদ্ধারের জন্য একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। পুলিশ আমাকে উদ্ধারের পর বাবার জিম্মায় দেন। সেখানে আমি আমার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পরামর্শ করায় অভিযোগ দায়ের করতে বিলম্ব হয়।’

প্রসঙ্গত, গত ৩ এপ্রিল সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টে মামলার বাদী এই নারীসহ অবরুদ্ধ হন মামুনুল হক। পরে পুলিশের উপস্থিতিতে তাকে এবং এই নারীকে সেখান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যান হেফাজতের সমর্থকরা। রিসোর্ট, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগের অফিস, নেতাকর্মীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়িতে হামলা চালায় হেফাজত কর্মীরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আগুন দিয়েও অবরোধ করেন তারা। রিসোর্টে সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া এক সাংবাদিককেও নির্যাতন করা হয়। এসব ঘটনায় সোনারগাঁ থানায় সাতটি মামলা দায়ের করা হয়। কয়েকটি মামলাতে প্রধান আসামি করা হয়েছে মামুনুল হককে। গত ১৮ এপ্রিল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি।

শনিবার, ০১ মে ২০২১ , ১৯ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমজান ১৪৪২

মামুনুলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ

হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা। কেবল ধর্ষণই নয় টানা ২৪ দিন তাকে রাজধানীর একটি বাড়িতে আটকে রাখারও অভিযোগ করেছেন তিনি। বড় ছেলের সঙ্গে যোগাযোগের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে গত ২৭ এপ্রিল উদ্ধার হয়েছেন বলেও মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন বাদী জান্নাত আরা ঝর্ণা।

গতকাল সকাল সোয়া দশটার দিকে নিজে বাদী হয়ে সোনারগাঁ থানায় মামলাটি দায়ের করেন তিনি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন থানার ওসি হাফিজুর রহমান।

গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টে এই নারীসহ অবরুদ্ধ হয়েছিলেন মামুনুল হক। তখন তাকে দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করেছিলেন তিনি। যদিও মামলার কোথাও মামুনুল হককে বিয়ের কথা উল্লেখ করেননি মামলার বাদী। তাকে বিয়ে না করেই নানা প্রলোভনে ও প্রতারণার মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন বলে অভিযোগ ওই নারীর।

এদিকে এই মামলায় হেফাজতে ইসলামের সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হককে গ্রেপ্তার দেখানো হবে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম। তিনি বলেন, সকালে মামুনুল হকের কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানায় ধর্ষণের লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগটি আমলে নিয়ে মামলা হিসেবে রুজু করা হয়। অভিযোগকারীর ডাক্তারি পরীক্ষা করানো হয়েছে। মামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সামগ্রিক তদন্ত ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি তদন্ত করা হচ্ছে। ভুক্তভোগী যেন সুবিচার পান সে চেষ্টা থাকবে। এক প্রশ্নের জবাবে এসপি আরও বলেন, মামলার কার্যক্রম অনুযায়ী এই মামলায় আসামিকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হবে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডেরও আবেদন করা হবে।

মামলার এজাহারে বাদী জান্নাত আরা ঝর্ণা বলেছেন, ‘বিয়ের প্রলোভন ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে মামুনুল হক আমার সঙ্গে সম্পর্ক করেছেন। কিন্তু বিয়ের কথা বললে মামুনুল করছি, করব বলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। ২০১৮ সাল থেকে ঘোরাঘুরির কথা বলে মামুনুল বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্টে আমাকে নিয়ে যান।’

এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ২০০৫ সালে সাবেক স্বামীর মাধ্যমে মাওলানা মামুনুল হকের সঙ্গে পরিচয় হয় ওই নারীর। স্বামীর বন্ধু হওয়ায় তাদের বাড়িতে মামুনুলের অবাধ যাতায়াত ছিল। মামুনুলের সঙ্গে পরিচয়ের আগে তাদের সংসার সুখে-শান্তিতে চলছিল বলে উল্লেখ করেন মামলার বাদী জান্নাত আরা ঝর্ণা। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মতানৈক্যের মধ্যে প্রবেশ করে মামুনুল হক আমার স্বামী ও আমার মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে থাকেন। মামুনুলের কারণে আমাদের দাম্পত্য জীবন চরমভাবে বিষিয়ে ওঠে। সাংসারিক এই টানাপড়েনের একপর্যায়ে মামনুলের কু-পরামর্শে ২০১৮ সালের ১০ আগস্ট আমাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।’

অভিযোগে মামুনুল হকের দাবি করা কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা বলেন, ‘বিচ্ছেদের পর তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিকভাবে অসহায় হয়ে পড়েন। এ সময় মামুনুল আমাকে খুলনা থেকে ঢাকায় আসার জন্য বলেন। আমি ঢাকায় চলে আসি। মামুনুল আমাকে তার অনুসারীদের বাসায় রাখেন। সেখানে নানাভাবে আমাকে প্রস্তাব দেন। একপর্যায়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে তার প্রলোভনে পা দেই। এরপর তিনি উত্তর ধানমন্ডির নর্থ সার্কুলার রোডের একটি বাসায় আমাকে সাবলেট রাখেন। একটি বিউটি পার্লারে কাজের ব্যবস্থা করে দেন। ঢাকায় থাকার খরচ মামুনুলই দিচ্ছিলেন। গত দুই বছর যাবত আমাকে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় পরিচিত বিভিন্ন হোটেল ও রিসোর্টে ঘোরাঘুরির নাম করে রাত্রিযাপন করতেন এবং বিয়ের আশ্বাস দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতেন।’

অভিযোগে ওই নারী বলেন, ‘৩ এপ্রিল সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টে ঘোরাঘুরির কথা বলে মামুনুল হক নিয়ে যান। সেখানে অবস্থানকালে কিছু মানুষ আমাদের আটক করে ফেলে। পরে মামুনুল হকের অনুসারীরা রিসোর্টে হামলা করে আমাদের নিয়ে যায়। কিন্তু মামুনুল আমাকে নিজের বাসায় ফিরতে না দিয়ে পরিচিত একজনের বাসায় আটকে রাখেন। কারও সঙ্গে যোগাযোগও করতে দেননি। পরে কৌশলে আমি আমার বড় ছেলেকে আমার দুরবস্থার সব কথা জানাই এবং আমাকে বন্দীদশা থেকে উদ্ধারের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে বলি। পরে গত ২৭ এপ্রিল ডিবি পুলিশ আমাকে উদ্ধার করলে জানতে পারি, আমার বাবা রাজধানীর কলাবাগান থানায় আমাকে উদ্ধারের জন্য একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। পুলিশ আমাকে উদ্ধারের পর বাবার জিম্মায় দেন। সেখানে আমি আমার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পরামর্শ করায় অভিযোগ দায়ের করতে বিলম্ব হয়।’

প্রসঙ্গত, গত ৩ এপ্রিল সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টে মামলার বাদী এই নারীসহ অবরুদ্ধ হন মামুনুল হক। পরে পুলিশের উপস্থিতিতে তাকে এবং এই নারীকে সেখান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যান হেফাজতের সমর্থকরা। রিসোর্ট, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগের অফিস, নেতাকর্মীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়িতে হামলা চালায় হেফাজত কর্মীরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আগুন দিয়েও অবরোধ করেন তারা। রিসোর্টে সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া এক সাংবাদিককেও নির্যাতন করা হয়। এসব ঘটনায় সোনারগাঁ থানায় সাতটি মামলা দায়ের করা হয়। কয়েকটি মামলাতে প্রধান আসামি করা হয়েছে মামুনুল হককে। গত ১৮ এপ্রিল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি।