সরকার উভয় সংকটে

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অনেক বেশি ছোঁয়াছে, অনেক বেশি প্রাণঘাতী। প্রথম ঢেউয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়ায় বেশিরভাগ লোক আগের মতো সাধারণ জীবনযাপন শুরু করে দিয়েছিল; বহুদিন ঘরে আবদ্ধ থেকে সবাই হাঁপিয়ে উঠেছিল, একটু খোলা আবহাওয়ায় লাফালাফি করার আগ্রহে সবাই দ্বিগুণ উৎসাহে বিয়ে-শাদি, গান-বাজনা, ওয়াজ-মাহফিল, নাটক-সিনেমায় মজে গিয়েছিল। পর্যটনকেন্দ্রগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। মানুষ আগের মতো হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি শুরু করে দিয়েছিল। প্রবাসীরা দলে দলে দেশে আসা আরম্ভ করল। কমিউনিটি সেন্টার, ক্লাব সব উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠল। ছেলেমেয়ের বিয়ের ধুম পড়ে গেল। চারিদিকে নির্বাচনের মিছিল, মসজিদ, মন্দির সরগরম হয়ে উঠল। বিশাল বিশাল গণ-জমায়েত আর মিছিলে ঢাকার রাস্তা সয়লাভ হয়ে গেল। করোনাভাইরাস সুযোগ পেয়ে আরও বেশি শক্তি নিয়ে ফেরত এলো।

বাংলাদেশে এবার ব্রিটেন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভয়ানক করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গের শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্ট পৌঁছলে আক্রমণের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। অধিক ছোঁয়াছে এই ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা পুনরায় পরিস্ফূট হয়ে উঠেছে। হাসপাতালে সিট নেই, অক্সিজেন নেই, আইসিইউ নেই। রোগী নিয়ে স্বজনেরা শুধু একটা কভিড বেডের জন্য উ™£ান্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন, একটি আইসিইউ’র জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। হাসপাতালের বারান্দা, করিডোর, লনে অক্সিজেনের সিলিন্ডার সমেত রোগীর অসহায়ত্ব দেখে বেঁচে থাকা মানুষগুলোও মৃত্যু ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের করোনাভাইরাসের ডাবল বা ট্রিপল মিউটেশন ভ্যারিয়েন্ট রুখতে সীমান্ত ও বিমান যোগাযোগ বন্ধ রাখা হলেও বাস্তবে এত বড় সীমান্ত পাহারা দিয়ে মানুষের অবৈধ চলাচল বন্ধ রাখা যাবে বলে মনে হয় না।

ভারতে স্বাস্থ্য পরিষেবা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো বলেই এদেশের লোকেরা ভারতে চিকিৎসার জন্য যায়। কিন্তু ভারতের অবস্থা এখন বাংলাদেশের চেয়েও শোচনীয়। কঠোর লকডাউন দিয়েও করোনার বিস্তার ঠেকাতে পারছে না। দিল্লিতে সান্ধ্য আইন বলবৎ রয়েছে। প্রতিদিন সেখানে তিন লাখেরও বেশি লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। ওখানেও হাসপাতালে সিট নেই, অক্সিজেন নেই, টিকা নেই। প্রতি ঘণ্টায় মৃত্যু হচ্ছে ১২ জনের, ২৪ ঘণ্টা জ্বলছে গণচিতা। ভারতে ভ্যাকসিনের তীব্র সংকট, টিকা প্রদান কেন্দ্রগুলো থেকে টিকা না নিয়েই মানুষ ফেরত যাচ্ছে, অনেকেরই সেকেন্ড ডোজ নেয়ার সময়সীমা পার হয়ে গেছে। যে দেশের অক্সিজেন দিয়ে বাংলাদেশের চাহিদা মেটানো হয় সেই দেশে অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছে। অক্সিজেন ও টিকার তীব্র সংকটে পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গুগল, মাইক্রোসফট প্রভৃতি দেশ ও প্রতিষ্ঠান ভারতের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। ভারতের জন্য ৮০ মেট্রিক টন লিকুইড অক্সিজেন পাঠিয়েছে সৌদি আরব। ভারত এই অবস্থায় তাদের মৃত্যুর মিছিল শ্লথ করে জনরোষ রুখতে টিকা রপ্তানি বন্ধ রেখেছে।

রাশিয়া, চীন এবং ভারতে উৎপাদিত টিকা ছাড়াও যে সব টিকা বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না ও ফাইজারের টিকা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ভারতের সেরামের টিকা নেয়ার পেছনে অনেকগুলো ইতিবাচক কারণ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত এই টিকা ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়। এই টিকার দামও কম; ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট প্রতি ডোজের জন্য নিচ্ছে চার ডলার, আর টিকার পরিবহন, শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি খরচের জন্য বেক্সিমকো নিচ্ছে এক ডলার। অন্যদিকে মডার্না ও ফাইজারের এক ডোজ টিকার দাম পড়ে যথাক্রমে ৩৭ ডলার ও ২০ ডলার। ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার শুধু দাম বেশি নয়, এই টিকা সংরক্ষণ করতে হয় মাইনাস ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে যা আমাদের দেশে প্রায় অসম্ভব। চীন, রাশিয়া, ফাইজার এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার উদ্ভাবনের ঘোষণা এসেছে বহু পরে; এদের নাম প্রাথমিক অবস্থায় আলোচনায়ও আসেনি।

এছাড়া রাশিয়া এবং চীনের টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃতও নয়। গবেষণাকালীন সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়েছিল, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদন হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে। পরবর্তীতে বাজারে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার, মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা কেনার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশ আগাম ফরমাশ দিয়ে রেখেছে। কিন্তু চাহিদা মতো কেউই টিকা পাচ্ছে না; টিকা নিয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছে। টিকা দেয়ার সংবাদ পেয়ে একটি কেন্দ্রের সম্মুখে কানাডার লোকেরা গভীর রাত থেকে লাইন দেয়া শুরু করে এবং সকালে সেই লাইনের আকার হয় কয়েক মাইল। এমন সংকটের মধ্যেও পৃথিবীর অনেক ধনী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে টিকা প্রদানের হার অনেক বেশি।

ভারতে টিকার তীব্র সংকট সৃষ্টি হওয়ায় ইউরোপ এবং ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ভারত থেকে টিকা পাচ্ছে না। চুক্তির ৭০ লাখ এবং উপহার হিসেবে ৩২ লাখ ডোজ দেয়ার পর ভারত শুধু বাংলাদেশে নয় অন্যান্য দেশেও টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এই অবস্থায় টিকা সংগ্রহের বিকল্প উৎসের সন্ধানে বাংলাদেশ চীন ও রাশিয়ার কাছে ধরনা দিচ্ছে। রাশিয়া তাদের টিকা ‘স্পুটনিক ভি’ বাংলাদেশে উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার টিকা জরুরি ভিত্তিতে আমদানি এবং নিজ দেশে উৎপাদন দুটিই বিবেচনা করছে। এছাড়া চীন থেকেও টিকা সংগ্রহের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

দেশের কমপক্ষে ৬০% লোককে টিকা দেয়া সম্ভব হলে করোনার বিস্তার ঠেকানো সম্ভব; কিন্তু ইসরাইল ব্যতীত পৃথিবীর আর কোন দেশ এখনও এই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। এই অবস্থায় করোনার বিস্তার শ্লথ করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এডিবি। বাংলাদেশের মতো এমন একটি গরিব দেশে জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা কঠিন। যতই উন্নয়ন হোক, এখনও বাংলাদেশে ২০% লোক দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে এবং তার মধ্যে ১১ শতাংশ লোক অতি দরিদ্র- এদের থাকার ঘর নেই, খাবারের নিশ্চয়তা নেই। এদের অনেকে ভিক্ষা করে, রিকশা বা ঠেলাগাড়ি চালিয়ে খাবার জোগাড় করেন। হাজার হাজার লোক ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করে কোনভাবে বেঁচে আছেন। বস্তিতেও এদের অনেকের ঠাঁই হয় না। ফুটপাতে জন্ম নিয়ে ফুটপাতে বেড়ে উঠা শিশু কিশোরগুলো ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে আছে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে প্রকৃতির বুকে মানুষ হওয়া লোকগুলোর লকডাউনের দেয়াল নেই, এদের বাসস্থান হচ্ছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, আন্তঃজেলা বাসস্ট্যান্ড, ফুটওভার ব্রিজ, অফিস-আদালতের বারান্দা। এদের কাছে সব মৃত্যুই স্বাভাবিক- কে কখন মরল, কীভাবে মরল, কে জানাজা পড়ল, কে কবর দিল, মৃত্যুর পর কী হবে তার হিসাব-নিকাশ তারা করে না।

সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম কারো কাছে এদের কোন গুরুত্ব নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে এরা চোর, বদমাশ; মসজিদ, মন্দির, মাদরাসায় এরা দান করার ক্ষমতা রাখে না। ওরাও সব কিছুর ক্ষেত্রে উদাসীন, ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে চলে। এই লোকগুলো অদৃশ্য করোনার ভয়ে ভীত নয়, তাদের ভয় লকডাউনকে যা তাদের ক্ষুধা নিবারণের খাবার কেড়ে নেয়। সব খোলা না থাকলে ভিক্ষুক ভিক্ষা পায় না, রিকশাওয়ালা যাত্রী পায় না, ঠেলাওয়ালা পণ্য পায় না, দোকানদার গ্রাহক পায় না, বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়া পায় না, উৎপাদক ব্যবসায়ী পায় না, কর্মজীবী মজুরি পায় না, মজুরি না পেলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা থাকে না, ক্রয় ক্ষমতা না থাকলে উৎপাদকের পণ্য বিক্রি হয় না, বিক্রি না হলে উৎপাদক উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এই বিরাট কর্মযজ্ঞের লোকগুলোকে দীর্ঘদিন প্রণোদনা আর রিলিফ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়; কর্মহীন লোকগুলোকে দীর্ঘদিন রিলিফ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে এক সময় লোকও মরবে, দেশও ডুববে।

সরকারকে দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে হবে; করোনা এবং দুর্ভিক্ষ একত্রিত হলে সরকারে পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। লোকসংখ্যা কম থাকার কারণে পৃথিবীর বহু দেশে স্বাভাবিক অবস্থায়ও চলাচলে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে। বাংলাদেশের একটি ছোট্ট ভূখণ্ডে ১৭ কোটি লোকের বাস, সর্বত্র লোকে লোকারণ্য, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। রাস্তায় চলতে গেলে একজনের কাঁধে অন্য জনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ছোঁয়া লাগে। ৬০% লোককে টিকা দিয়ে জাতিকে সুরক্ষা দেয়া সময় সাপেক্ষ। করোনা তাই শীঘ্রই যাবে বলে মনে হচ্ছে না, ভ্যাকসিন দিয়ে সবাইকে সুরক্ষিত করতে দীর্ঘদিন লেগে যাবে। এই অবস্থায় ওয়াজ-মাহফিল, মিছিল-মিটিং, সামাজিক গণজমায়েত বন্ধ করা অপরিহার্য। মাস্ক আর স্যানেটাইজার ব্যবহার নিশ্চিত করে দেশের উন্নয়নের ধারা অক্ষুণœ রাখতে আর সব উন্মুক্ত করে দেয়াই শ্রেয় হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com

শনিবার, ০১ মে ২০২১ , ১৯ বৈশাখ ১৪২৮ ১৯ রমজান ১৪৪২

সরকার উভয় সংকটে

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অনেক বেশি ছোঁয়াছে, অনেক বেশি প্রাণঘাতী। প্রথম ঢেউয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়ায় বেশিরভাগ লোক আগের মতো সাধারণ জীবনযাপন শুরু করে দিয়েছিল; বহুদিন ঘরে আবদ্ধ থেকে সবাই হাঁপিয়ে উঠেছিল, একটু খোলা আবহাওয়ায় লাফালাফি করার আগ্রহে সবাই দ্বিগুণ উৎসাহে বিয়ে-শাদি, গান-বাজনা, ওয়াজ-মাহফিল, নাটক-সিনেমায় মজে গিয়েছিল। পর্যটনকেন্দ্রগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। মানুষ আগের মতো হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি শুরু করে দিয়েছিল। প্রবাসীরা দলে দলে দেশে আসা আরম্ভ করল। কমিউনিটি সেন্টার, ক্লাব সব উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠল। ছেলেমেয়ের বিয়ের ধুম পড়ে গেল। চারিদিকে নির্বাচনের মিছিল, মসজিদ, মন্দির সরগরম হয়ে উঠল। বিশাল বিশাল গণ-জমায়েত আর মিছিলে ঢাকার রাস্তা সয়লাভ হয়ে গেল। করোনাভাইরাস সুযোগ পেয়ে আরও বেশি শক্তি নিয়ে ফেরত এলো।

বাংলাদেশে এবার ব্রিটেন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভয়ানক করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গের শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্ট পৌঁছলে আক্রমণের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। অধিক ছোঁয়াছে এই ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা পুনরায় পরিস্ফূট হয়ে উঠেছে। হাসপাতালে সিট নেই, অক্সিজেন নেই, আইসিইউ নেই। রোগী নিয়ে স্বজনেরা শুধু একটা কভিড বেডের জন্য উ™£ান্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন, একটি আইসিইউ’র জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। হাসপাতালের বারান্দা, করিডোর, লনে অক্সিজেনের সিলিন্ডার সমেত রোগীর অসহায়ত্ব দেখে বেঁচে থাকা মানুষগুলোও মৃত্যু ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের করোনাভাইরাসের ডাবল বা ট্রিপল মিউটেশন ভ্যারিয়েন্ট রুখতে সীমান্ত ও বিমান যোগাযোগ বন্ধ রাখা হলেও বাস্তবে এত বড় সীমান্ত পাহারা দিয়ে মানুষের অবৈধ চলাচল বন্ধ রাখা যাবে বলে মনে হয় না।

ভারতে স্বাস্থ্য পরিষেবা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো বলেই এদেশের লোকেরা ভারতে চিকিৎসার জন্য যায়। কিন্তু ভারতের অবস্থা এখন বাংলাদেশের চেয়েও শোচনীয়। কঠোর লকডাউন দিয়েও করোনার বিস্তার ঠেকাতে পারছে না। দিল্লিতে সান্ধ্য আইন বলবৎ রয়েছে। প্রতিদিন সেখানে তিন লাখেরও বেশি লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। ওখানেও হাসপাতালে সিট নেই, অক্সিজেন নেই, টিকা নেই। প্রতি ঘণ্টায় মৃত্যু হচ্ছে ১২ জনের, ২৪ ঘণ্টা জ্বলছে গণচিতা। ভারতে ভ্যাকসিনের তীব্র সংকট, টিকা প্রদান কেন্দ্রগুলো থেকে টিকা না নিয়েই মানুষ ফেরত যাচ্ছে, অনেকেরই সেকেন্ড ডোজ নেয়ার সময়সীমা পার হয়ে গেছে। যে দেশের অক্সিজেন দিয়ে বাংলাদেশের চাহিদা মেটানো হয় সেই দেশে অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছে। অক্সিজেন ও টিকার তীব্র সংকটে পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গুগল, মাইক্রোসফট প্রভৃতি দেশ ও প্রতিষ্ঠান ভারতের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। ভারতের জন্য ৮০ মেট্রিক টন লিকুইড অক্সিজেন পাঠিয়েছে সৌদি আরব। ভারত এই অবস্থায় তাদের মৃত্যুর মিছিল শ্লথ করে জনরোষ রুখতে টিকা রপ্তানি বন্ধ রেখেছে।

রাশিয়া, চীন এবং ভারতে উৎপাদিত টিকা ছাড়াও যে সব টিকা বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না ও ফাইজারের টিকা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ভারতের সেরামের টিকা নেয়ার পেছনে অনেকগুলো ইতিবাচক কারণ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত এই টিকা ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়। এই টিকার দামও কম; ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট প্রতি ডোজের জন্য নিচ্ছে চার ডলার, আর টিকার পরিবহন, শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি খরচের জন্য বেক্সিমকো নিচ্ছে এক ডলার। অন্যদিকে মডার্না ও ফাইজারের এক ডোজ টিকার দাম পড়ে যথাক্রমে ৩৭ ডলার ও ২০ ডলার। ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার শুধু দাম বেশি নয়, এই টিকা সংরক্ষণ করতে হয় মাইনাস ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে যা আমাদের দেশে প্রায় অসম্ভব। চীন, রাশিয়া, ফাইজার এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার উদ্ভাবনের ঘোষণা এসেছে বহু পরে; এদের নাম প্রাথমিক অবস্থায় আলোচনায়ও আসেনি।

এছাড়া রাশিয়া এবং চীনের টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃতও নয়। গবেষণাকালীন সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়েছিল, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদন হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে। পরবর্তীতে বাজারে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার, মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা কেনার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশ আগাম ফরমাশ দিয়ে রেখেছে। কিন্তু চাহিদা মতো কেউই টিকা পাচ্ছে না; টিকা নিয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছে। টিকা দেয়ার সংবাদ পেয়ে একটি কেন্দ্রের সম্মুখে কানাডার লোকেরা গভীর রাত থেকে লাইন দেয়া শুরু করে এবং সকালে সেই লাইনের আকার হয় কয়েক মাইল। এমন সংকটের মধ্যেও পৃথিবীর অনেক ধনী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে টিকা প্রদানের হার অনেক বেশি।

ভারতে টিকার তীব্র সংকট সৃষ্টি হওয়ায় ইউরোপ এবং ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ভারত থেকে টিকা পাচ্ছে না। চুক্তির ৭০ লাখ এবং উপহার হিসেবে ৩২ লাখ ডোজ দেয়ার পর ভারত শুধু বাংলাদেশে নয় অন্যান্য দেশেও টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এই অবস্থায় টিকা সংগ্রহের বিকল্প উৎসের সন্ধানে বাংলাদেশ চীন ও রাশিয়ার কাছে ধরনা দিচ্ছে। রাশিয়া তাদের টিকা ‘স্পুটনিক ভি’ বাংলাদেশে উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার টিকা জরুরি ভিত্তিতে আমদানি এবং নিজ দেশে উৎপাদন দুটিই বিবেচনা করছে। এছাড়া চীন থেকেও টিকা সংগ্রহের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

দেশের কমপক্ষে ৬০% লোককে টিকা দেয়া সম্ভব হলে করোনার বিস্তার ঠেকানো সম্ভব; কিন্তু ইসরাইল ব্যতীত পৃথিবীর আর কোন দেশ এখনও এই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। এই অবস্থায় করোনার বিস্তার শ্লথ করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এডিবি। বাংলাদেশের মতো এমন একটি গরিব দেশে জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা কঠিন। যতই উন্নয়ন হোক, এখনও বাংলাদেশে ২০% লোক দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে এবং তার মধ্যে ১১ শতাংশ লোক অতি দরিদ্র- এদের থাকার ঘর নেই, খাবারের নিশ্চয়তা নেই। এদের অনেকে ভিক্ষা করে, রিকশা বা ঠেলাগাড়ি চালিয়ে খাবার জোগাড় করেন। হাজার হাজার লোক ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করে কোনভাবে বেঁচে আছেন। বস্তিতেও এদের অনেকের ঠাঁই হয় না। ফুটপাতে জন্ম নিয়ে ফুটপাতে বেড়ে উঠা শিশু কিশোরগুলো ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে আছে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে প্রকৃতির বুকে মানুষ হওয়া লোকগুলোর লকডাউনের দেয়াল নেই, এদের বাসস্থান হচ্ছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, আন্তঃজেলা বাসস্ট্যান্ড, ফুটওভার ব্রিজ, অফিস-আদালতের বারান্দা। এদের কাছে সব মৃত্যুই স্বাভাবিক- কে কখন মরল, কীভাবে মরল, কে জানাজা পড়ল, কে কবর দিল, মৃত্যুর পর কী হবে তার হিসাব-নিকাশ তারা করে না।

সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম কারো কাছে এদের কোন গুরুত্ব নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে এরা চোর, বদমাশ; মসজিদ, মন্দির, মাদরাসায় এরা দান করার ক্ষমতা রাখে না। ওরাও সব কিছুর ক্ষেত্রে উদাসীন, ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে চলে। এই লোকগুলো অদৃশ্য করোনার ভয়ে ভীত নয়, তাদের ভয় লকডাউনকে যা তাদের ক্ষুধা নিবারণের খাবার কেড়ে নেয়। সব খোলা না থাকলে ভিক্ষুক ভিক্ষা পায় না, রিকশাওয়ালা যাত্রী পায় না, ঠেলাওয়ালা পণ্য পায় না, দোকানদার গ্রাহক পায় না, বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়া পায় না, উৎপাদক ব্যবসায়ী পায় না, কর্মজীবী মজুরি পায় না, মজুরি না পেলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা থাকে না, ক্রয় ক্ষমতা না থাকলে উৎপাদকের পণ্য বিক্রি হয় না, বিক্রি না হলে উৎপাদক উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এই বিরাট কর্মযজ্ঞের লোকগুলোকে দীর্ঘদিন প্রণোদনা আর রিলিফ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়; কর্মহীন লোকগুলোকে দীর্ঘদিন রিলিফ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে এক সময় লোকও মরবে, দেশও ডুববে।

সরকারকে দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে হবে; করোনা এবং দুর্ভিক্ষ একত্রিত হলে সরকারে পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। লোকসংখ্যা কম থাকার কারণে পৃথিবীর বহু দেশে স্বাভাবিক অবস্থায়ও চলাচলে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে। বাংলাদেশের একটি ছোট্ট ভূখণ্ডে ১৭ কোটি লোকের বাস, সর্বত্র লোকে লোকারণ্য, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। রাস্তায় চলতে গেলে একজনের কাঁধে অন্য জনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ছোঁয়া লাগে। ৬০% লোককে টিকা দিয়ে জাতিকে সুরক্ষা দেয়া সময় সাপেক্ষ। করোনা তাই শীঘ্রই যাবে বলে মনে হচ্ছে না, ভ্যাকসিন দিয়ে সবাইকে সুরক্ষিত করতে দীর্ঘদিন লেগে যাবে। এই অবস্থায় ওয়াজ-মাহফিল, মিছিল-মিটিং, সামাজিক গণজমায়েত বন্ধ করা অপরিহার্য। মাস্ক আর স্যানেটাইজার ব্যবহার নিশ্চিত করে দেশের উন্নয়নের ধারা অক্ষুণœ রাখতে আর সব উন্মুক্ত করে দেয়াই শ্রেয় হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

ahmedzeauddin0@gmail.com