করোনা মহামারীর থাবায় দেশের বৃহত্তম তাঁতশিল্প হুমকির মুখে

সামনে ঈদ, হতাশায় শ্রমিকরা

প্রতিবছর ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পাবনা ও সিরাজগঞ্জের তাঁত সমৃদ্ধ এলাকাগুলো মহামারী করোনার থাবায় দেশের বৃহত্তম তাঁত সমৃদ্ধ এলাকায় এখন শুধুই হতাশা। করোনা মহামারীতে গেল বছর ঈদুল ফিতরে কাক্সিক্ষত ব্যবসা করতে না পেরে পুঁজি হারিয়েছেন অনেকেই, এ বছর ঈদে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ঈদের ব্যবসা শুরু করার আগেই করোনার থাবায় হুমকির মধ্যে পড়েছে দেশের বৃহত্তম তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা। তাঁতশিল্পকে বাঁচাতে সংকট নিরসনে সরকারের সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী তাঁতিরা।

প্রতিবছর রোজার দুই সপ্তাহ আগে থেকেই সিরাজগঞ্জ ও পাবনার তাঁত কাপড়ের হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকার ব্যবসায়ীরা কাপড় কিনতে আসেন ঈদের বাজারকে সামনে রেখে। তবে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায়, লকডাউন শুরু হওয়ায় রোজার আগে থেকেই তাঁত সমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জ ও পাবনার পাইকারি হাটে ছিল সুনসান নীরবতা। ২৫ এপ্রিল থেকে দোকানপাট শপিংমল খুলে দেয়ার পর থেকে কিছু কিছু পাইকার হাটে এলেও এখনও ঈদের কাক্সিক্ষত ব্যবসা শুরু হয়নি বলে দাবি করেছেন তাঁতিরা।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহত্তম তাঁত কাপড়ের পাইকারি হাটের ব্যবসায়ী রহমত আলি জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি হাটবারে তার দোকান থেকে প্রায় ৫০০ থেকে ৮০০ পিস কাপড় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। তবে এ বছর করোনার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা সেভাবে না আসায় বিকিকিনি আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

রোজার প্রথম দুই সপ্তাহে প্রতি হাটবারে তার গদি ঘরে কোন বেচা-বিক্রি ছিল না। তবে দোকানপাট খোলার পর রোববার (হাটবার) প্রায় দুইশত পিস কাপড় বিক্রি করতে পেরেছেন যা ঈদের বাজারের তুলনায় একেবারেই নগণ্য বলে জানান তিনি। শাহজাদপুর তাঁত কাপড়ের বাজারের অন্য ব্যবসায়ীদেরও একই অবস্থা বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ¯েপশালাইজড টেক্সটাইল মিলস অ্যান্ড পাওয়ারলুম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিএসটিএমপিআইএ) এর পরিচালক আলহাজ মো. হায়দার আলি জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিবছর ঈদের সময় প্রতিহাটে ২শ’ কোটি টাকার বেশি তাঁত কাপড় বিক্রি হতো শাহজাদপুর তাঁত কাপড়ের হাট থেকে কিন্তু করোনার কারণে গতবছর অর্ধেক কাপড়ও বিক্রি করতে পারেননি তাঁতিরা। একই অবস্থা এ বছরেও। কয়েক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর হাট শুরু হলেও প্রতিহাটে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার বেশি কাপড় বিক্রি হচ্ছে না বলে জানান হায়দার। করোনার কারণে পরিবহন বন্ধ থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা না আসায় দেশের অন্যতম বৃহত্তম তাঁত কাপড়ের হাটের পাইকার ব্যবসায় ধস নেমেছে বলে জানান তিনি।

এদিকে বেচা-বিক্রি না থাকলেও আশায় বাঁচেন তাঁতিরা আর তাই ধার-কর্য করে হলেও তাঁতিরা আবারও উৎপাদন শুরু করেছেন। করোনার কারণে গতবছরের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারায় অধিকাংশ তাঁতির ঘরেই থরে থরে জমে আছে তাঁত কাপড়। তারপরও নতুন করে কাপড় তৈরিতে ব্যস্ত। সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার তাঁত সমৃদ্ধ এলাকার তাঁতিরা।

পাবনার সাঁথিয়া সদরের তাঁত মালিক মন্তাজ আলী বলেন, গত দুই কয়েক বছরের টানা লোকসানে অর্থ সংকটে পড়েছে তার কারখানাটি। প্রায় ৩০টি তাঁত নিয়ে তার কারখানা। অর্থ সংকটে গত কয়েক মাস বন্ধ ছিল তার কারখানা। অবশেষে ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা লোন নিয়ে এ বছর ঈদে ব্যবসা করার জন্য মিল চালু করার উদ্যোগ নেয়ার পর থেকেই শুরু হয় লকডাউন। ফলে উৎপাদন শুরু করা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন তিনি।

চলমান অবস্থায় কারখানা চালু করলেও ব্যাংক লোনের কিস্তির টাকাও তিনি তুলতে পারবেন না বলে জানান আলামিন।

আফতাব নগরের তাঁত ব্যবসায়ী আবদুল মজিদ জানান, তার ২০টি তাঁতের ৮টিই বন্ধ রয়েছে, গত বছরের প্রায় অর্ধেক কাপড় তার ঘরে এখনও পড়ে আছে, তবে ঈদের মার্কেট সামনে রেখে আবারও উৎপাদন শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৮০টি কাপড় তৈরি হচ্ছে কারখানায়। তবে বিক্রি না থাকায় বেশিরভাগ কাপড়ই জমে আছে ঘরে।

তাঁত মালিকরা জানান, সারা বছরের তাঁতের কাপড়ের ব্যবসার প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ব্যবসা হয় রোজার মাসে ঈদকে সামনে রেখে। গতবছর রোজার মধ্যে লকডাউনের কারণে অর্ধেক কাপড়ও বিক্রি করতে পারেননি তাঁতিরা। কাপড় বিক্রি করতে না পারায় নতুন করে ব্যাংক ও মহাজনি লোন নিয়ে যারা উৎপাদন শুরু করেছেন তারাও এখন আরও বেশি হতাশায় পড়েছেন।

সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে দরিদ্র তাঁত শ্রমিকরা। বছরের এই সময়ে তারা উৎসবের আমেজে কাজ করে, সারা বছরের উপার্জনের বেশিরভাগ আসে রমজান মাসে, করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে কঠোর লকডাউন শুরু হওয়ায় এসব তাঁত শ্রমিক চরম হতাশায় পড়েছেন।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার ভুক্তভোগী তাঁত শ্রমিক আবদুল হাই বলেন, প্রতিবছর আমরা রোজার এই সময়ে বছরের সবচেয়ে বেশি আয় করি। এ বছর কাজ শুরু হলেও তাঁত কাপড়ের বিক্রি কমে যাওয়ায় কারখানায় উৎপাদনও অনেক কমে গেছে। অন্যান্য বছর ঈদের এ সময় আমরা প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি শাড়ি তৈরি করি যা থেকে প্রায় ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত আয় হতো। এ বছর উৎপাদন কম হওয়ায় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার বেশি আয় হচ্ছে না বলে জানান জলিল।

বছরের এ সময়ে কাক্সিক্ষত উপার্জন করতে না পারায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের পৈতৃক পেশা ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে জানান তিনি। আমাদের মতো সাধারণ শ্রমিকদের কাছে এখন করোনাঝুঁকির চেয়ে খেয়েপরে পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবনধারণই মুখ্য ব্যাপার হয়ে পড়েছে।

তাঁত ব্যবসায়ী সমিতির দেয়া তথ্য মতে, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ৬ লক্ষাধিক তাঁত রয়েছে যার মধ্যে ৪ লাখ তাঁতই এখন বন্ধ, ক্রমাগত লোকসান আর করোনা মহামারীতে পুঁজি হারিয়েছেন বেশিরভাগ দরিদ্র তাঁতি। ধার-কর্য করে যারা উৎপাদন শুরু করছেন তারাও পণ্য বিক্রি করতে না পাড়ায় ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে চাইছেন বলে জানান বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি হায়দার আলি।

হায়দার জানান, দেশের উৎপাদিত মোট তাঁত কাপড়ের প্রায় ৪৮ ভাগ কাপড় উৎপাদন হয় পাবনা ও সিরাজগঞ্জের তাঁত সমৃদ্ধ এলাকায়। এ দুই জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। গত দুই বছরের করোনা মহামারীর প্রকোপে দেশের সর্ববৃহৎ তাঁত কাপড় উৎপাদনকারী অঞ্চলে তাঁত কাপড় উৎপাদনকারী, শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীদের সবাই এখন দিশেহারা।

মহামারীর এ সময়ে দেশের বৃহত্তম তাঁতশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতার দাবি জানান তিনি।

এদিকে করোনা মহামারীর জন্য যখন তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখাটাই হুমকির মধ্যে পড়েছে, তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো তাঁতশিল্পের কাঁচামাল সুতার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন এ অঞ্চলের তাঁতিরা। তাঁতমালিকরা জানান, গত দুই মাসে প্রতি পাউন্ড সুতার দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ থেকে ১২০ টাকা, এতে বিক্রি না হলেও তাঁত কাপড়ের উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে। তবে উৎপাদন খরচ বাড়লেও উৎসবকে সামনে রেখে এখনই কেউ উৎপাদন বন্ধ করতে চাইছেন না। তাঁতিরা জানান, সরকারি নজরদারির অভাবে বেড়েই চলেছে কাঁচামালের দাম।

image

তাঁত কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা

আরও খবর
যে কোন উপায়ে হোক টিকা সংগ্রহ করা হবে
সব ভার্চুয়াল কোর্ট খুলে দিলে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়বে
যে কোন উপায়ে হোক টিকা সংগ্রহ করা হবে
সব ভার্চুয়াল কোর্ট খুলে দিলে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়বে প্রধান বিচারপতি
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৫ দশমিক ৫ : সেতুমন্ত্রী
৪৩২টি সড়ক দুর্ঘটনা নিহত ৪৬৮
সড়কে ঝরলো একই পরিবারের ৪ জনসহ ৮
‘মাফিয়াচক্র’ নিয়ে দেশ চালাচ্ছে সরকার মির্জা ফখরুল
হত্যা মামলার আবেদন মুনিয়ার ভাইয়ের
কলেজছাত্রী মুনিয়া হত্যার বিচার দাবিতে মানববন্ধন
দুর্নীতির খবর প্রকাশ করায় সাংবাদিকদের হুমকি উপজেলা চেয়ারম্যানের
ছাত্রদল ও হেফাজত নেতাসহ গ্রেপ্তার ৩
কর্মহীন পরিবারের মুড়ি আর পানি দিয়ে ইফতার, আলু সেদ্ধ খেয়ে সেহরি

সোমবার, ০৩ মে ২০২১ , ২১ বৈশাখ ১৪২৮ ২১ রমজান ১৪৪২

করোনা মহামারীর থাবায় দেশের বৃহত্তম তাঁতশিল্প হুমকির মুখে

সামনে ঈদ, হতাশায় শ্রমিকরা

হাবিবুর রহমান স্বপন, পাবনা

image

তাঁত কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা

প্রতিবছর ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পাবনা ও সিরাজগঞ্জের তাঁত সমৃদ্ধ এলাকাগুলো মহামারী করোনার থাবায় দেশের বৃহত্তম তাঁত সমৃদ্ধ এলাকায় এখন শুধুই হতাশা। করোনা মহামারীতে গেল বছর ঈদুল ফিতরে কাক্সিক্ষত ব্যবসা করতে না পেরে পুঁজি হারিয়েছেন অনেকেই, এ বছর ঈদে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ঈদের ব্যবসা শুরু করার আগেই করোনার থাবায় হুমকির মধ্যে পড়েছে দেশের বৃহত্তম তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা। তাঁতশিল্পকে বাঁচাতে সংকট নিরসনে সরকারের সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী তাঁতিরা।

প্রতিবছর রোজার দুই সপ্তাহ আগে থেকেই সিরাজগঞ্জ ও পাবনার তাঁত কাপড়ের হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকার ব্যবসায়ীরা কাপড় কিনতে আসেন ঈদের বাজারকে সামনে রেখে। তবে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায়, লকডাউন শুরু হওয়ায় রোজার আগে থেকেই তাঁত সমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জ ও পাবনার পাইকারি হাটে ছিল সুনসান নীরবতা। ২৫ এপ্রিল থেকে দোকানপাট শপিংমল খুলে দেয়ার পর থেকে কিছু কিছু পাইকার হাটে এলেও এখনও ঈদের কাক্সিক্ষত ব্যবসা শুরু হয়নি বলে দাবি করেছেন তাঁতিরা।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহত্তম তাঁত কাপড়ের পাইকারি হাটের ব্যবসায়ী রহমত আলি জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি হাটবারে তার দোকান থেকে প্রায় ৫০০ থেকে ৮০০ পিস কাপড় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। তবে এ বছর করোনার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা সেভাবে না আসায় বিকিকিনি আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

রোজার প্রথম দুই সপ্তাহে প্রতি হাটবারে তার গদি ঘরে কোন বেচা-বিক্রি ছিল না। তবে দোকানপাট খোলার পর রোববার (হাটবার) প্রায় দুইশত পিস কাপড় বিক্রি করতে পেরেছেন যা ঈদের বাজারের তুলনায় একেবারেই নগণ্য বলে জানান তিনি। শাহজাদপুর তাঁত কাপড়ের বাজারের অন্য ব্যবসায়ীদেরও একই অবস্থা বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ¯েপশালাইজড টেক্সটাইল মিলস অ্যান্ড পাওয়ারলুম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিএসটিএমপিআইএ) এর পরিচালক আলহাজ মো. হায়দার আলি জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিবছর ঈদের সময় প্রতিহাটে ২শ’ কোটি টাকার বেশি তাঁত কাপড় বিক্রি হতো শাহজাদপুর তাঁত কাপড়ের হাট থেকে কিন্তু করোনার কারণে গতবছর অর্ধেক কাপড়ও বিক্রি করতে পারেননি তাঁতিরা। একই অবস্থা এ বছরেও। কয়েক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর হাট শুরু হলেও প্রতিহাটে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার বেশি কাপড় বিক্রি হচ্ছে না বলে জানান হায়দার। করোনার কারণে পরিবহন বন্ধ থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা না আসায় দেশের অন্যতম বৃহত্তম তাঁত কাপড়ের হাটের পাইকার ব্যবসায় ধস নেমেছে বলে জানান তিনি।

এদিকে বেচা-বিক্রি না থাকলেও আশায় বাঁচেন তাঁতিরা আর তাই ধার-কর্য করে হলেও তাঁতিরা আবারও উৎপাদন শুরু করেছেন। করোনার কারণে গতবছরের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারায় অধিকাংশ তাঁতির ঘরেই থরে থরে জমে আছে তাঁত কাপড়। তারপরও নতুন করে কাপড় তৈরিতে ব্যস্ত। সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার তাঁত সমৃদ্ধ এলাকার তাঁতিরা।

পাবনার সাঁথিয়া সদরের তাঁত মালিক মন্তাজ আলী বলেন, গত দুই কয়েক বছরের টানা লোকসানে অর্থ সংকটে পড়েছে তার কারখানাটি। প্রায় ৩০টি তাঁত নিয়ে তার কারখানা। অর্থ সংকটে গত কয়েক মাস বন্ধ ছিল তার কারখানা। অবশেষে ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা লোন নিয়ে এ বছর ঈদে ব্যবসা করার জন্য মিল চালু করার উদ্যোগ নেয়ার পর থেকেই শুরু হয় লকডাউন। ফলে উৎপাদন শুরু করা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন তিনি।

চলমান অবস্থায় কারখানা চালু করলেও ব্যাংক লোনের কিস্তির টাকাও তিনি তুলতে পারবেন না বলে জানান আলামিন।

আফতাব নগরের তাঁত ব্যবসায়ী আবদুল মজিদ জানান, তার ২০টি তাঁতের ৮টিই বন্ধ রয়েছে, গত বছরের প্রায় অর্ধেক কাপড় তার ঘরে এখনও পড়ে আছে, তবে ঈদের মার্কেট সামনে রেখে আবারও উৎপাদন শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৮০টি কাপড় তৈরি হচ্ছে কারখানায়। তবে বিক্রি না থাকায় বেশিরভাগ কাপড়ই জমে আছে ঘরে।

তাঁত মালিকরা জানান, সারা বছরের তাঁতের কাপড়ের ব্যবসার প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ব্যবসা হয় রোজার মাসে ঈদকে সামনে রেখে। গতবছর রোজার মধ্যে লকডাউনের কারণে অর্ধেক কাপড়ও বিক্রি করতে পারেননি তাঁতিরা। কাপড় বিক্রি করতে না পারায় নতুন করে ব্যাংক ও মহাজনি লোন নিয়ে যারা উৎপাদন শুরু করেছেন তারাও এখন আরও বেশি হতাশায় পড়েছেন।

সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে দরিদ্র তাঁত শ্রমিকরা। বছরের এই সময়ে তারা উৎসবের আমেজে কাজ করে, সারা বছরের উপার্জনের বেশিরভাগ আসে রমজান মাসে, করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে কঠোর লকডাউন শুরু হওয়ায় এসব তাঁত শ্রমিক চরম হতাশায় পড়েছেন।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার ভুক্তভোগী তাঁত শ্রমিক আবদুল হাই বলেন, প্রতিবছর আমরা রোজার এই সময়ে বছরের সবচেয়ে বেশি আয় করি। এ বছর কাজ শুরু হলেও তাঁত কাপড়ের বিক্রি কমে যাওয়ায় কারখানায় উৎপাদনও অনেক কমে গেছে। অন্যান্য বছর ঈদের এ সময় আমরা প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি শাড়ি তৈরি করি যা থেকে প্রায় ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত আয় হতো। এ বছর উৎপাদন কম হওয়ায় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার বেশি আয় হচ্ছে না বলে জানান জলিল।

বছরের এ সময়ে কাক্সিক্ষত উপার্জন করতে না পারায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের পৈতৃক পেশা ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে জানান তিনি। আমাদের মতো সাধারণ শ্রমিকদের কাছে এখন করোনাঝুঁকির চেয়ে খেয়েপরে পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবনধারণই মুখ্য ব্যাপার হয়ে পড়েছে।

তাঁত ব্যবসায়ী সমিতির দেয়া তথ্য মতে, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ৬ লক্ষাধিক তাঁত রয়েছে যার মধ্যে ৪ লাখ তাঁতই এখন বন্ধ, ক্রমাগত লোকসান আর করোনা মহামারীতে পুঁজি হারিয়েছেন বেশিরভাগ দরিদ্র তাঁতি। ধার-কর্য করে যারা উৎপাদন শুরু করছেন তারাও পণ্য বিক্রি করতে না পাড়ায় ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে চাইছেন বলে জানান বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি হায়দার আলি।

হায়দার জানান, দেশের উৎপাদিত মোট তাঁত কাপড়ের প্রায় ৪৮ ভাগ কাপড় উৎপাদন হয় পাবনা ও সিরাজগঞ্জের তাঁত সমৃদ্ধ এলাকায়। এ দুই জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। গত দুই বছরের করোনা মহামারীর প্রকোপে দেশের সর্ববৃহৎ তাঁত কাপড় উৎপাদনকারী অঞ্চলে তাঁত কাপড় উৎপাদনকারী, শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীদের সবাই এখন দিশেহারা।

মহামারীর এ সময়ে দেশের বৃহত্তম তাঁতশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতার দাবি জানান তিনি।

এদিকে করোনা মহামারীর জন্য যখন তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখাটাই হুমকির মধ্যে পড়েছে, তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো তাঁতশিল্পের কাঁচামাল সুতার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন এ অঞ্চলের তাঁতিরা। তাঁতমালিকরা জানান, গত দুই মাসে প্রতি পাউন্ড সুতার দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ থেকে ১২০ টাকা, এতে বিক্রি না হলেও তাঁত কাপড়ের উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে। তবে উৎপাদন খরচ বাড়লেও উৎসবকে সামনে রেখে এখনই কেউ উৎপাদন বন্ধ করতে চাইছেন না। তাঁতিরা জানান, সরকারি নজরদারির অভাবে বেড়েই চলেছে কাঁচামালের দাম।