ভারতের ‘প্রধান বিরোধী মুখ’ হয়ে উঠেছেন মমতা

‘নরেন্দ্র মোদি ম্যাজিকে’ যেন হাওয়ায় ভাসছিল বিজেপি, আগেরবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় যাদের আসন সংখ্যা ছিল ৩, তারা এবার ঘোষণা দিয়েছিল, জিতবে এবার ২০০টিতে।

কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল, আকাশে উঠার সেই স্বপ্ন থেকে তাদের মাটিতে নামিয়ে এনেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস।

বাম রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ভারতের বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্যটিতে এক দশক আগে ক্ষমতায় আসা মমতা ‘রাম শাসনের’ অপেক্ষা দীর্ঘ করে টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন।

ভোটে নিজে হারলেও জোড়াফুলের এই বিজয়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘বাংলার জয় ভারতকে বাঁচালো।’

‘এই ভোটে জিতে গোটা দেশের প্রধান বিরোধী মুখ হয়ে উঠলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়,’ বললেন তার নির্বাচন কৌঁসুলি প্রশান্ত কিশোর।

তাদের এই কথার প্রতিফলন ধরা পড়ে বিশাল ভারতের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অভিনন্দন বার্তায়। ধরা পড়ে আরও চারটি রাজ্যে ভোট হলেও পশ্চিমবঙ্গের ফল নিয়ে দেশটির গণমাধ্যমের ব্যাপক উৎসাহ।

কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে এক সময় বিজেপির হাত ধরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া মমতা হালে বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর মোদির চরম বিরোধী হিসেবেই পরিচিত করেছেন নিজেকে।

ভারতের পার্লামেন্টে বিজেপির একচ্ছত্র আধিপত্যে প্রধান বিরোধী দল বলে কিছু যখন নেই, তখন মমতাকে নিজেদের কণ্ঠস্বর ভাবছেন আঞ্চলিকসহ সর্বভারতীয় দলগুলোর নেতারাও।

আসাম ও ত্রিপুরা করায়ত্ত করে পশ্চিমবঙ্গকে পাখির চোখ করেছিলেন মোদি, ফলে এবারের বিধানসভা নির্বাচন ‘মোদি ভার্সাস মমতা’ লড়াইয়ে রূপ নিয়েছিল।

ভোটের প্রচারে ১২ বার পশ্চিমবঙ্গে এসে ১৮টি জনসভা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জনসভা করেছেন ৬২টি। কেন্দ্রীয় অন্য নেতারাও ছুটে বেরিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে।

গেরুয়া শিবিরের প্রচারে বলা হচ্ছিল, এবারই মমতার বিদায় হবে। ২ মের পর ক্ষমতা থেকে তাকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেও বলছিলেন অমিত শাহ।

আর তাদের এই আশায় সাহস জোগাচ্ছিল গত লোকসভা নির্বাচনের ফল। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পদ্মফুল ২৯৪টির মধ্যে মাত্র ৩টিতে জিতলও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখায় চমক।

জাতীয় নির্বাচনে সেবার মোদির দল ১৮টি আসনে জেতে, আর তার সঙ্গে তুলনা করলে এবার বিধানসভায় ১২১ আসনে জেতার কথা তাদের।

কিন্তু গত রোববার রাত নাগাদ ২৯২টি (দুটি আসনে ভোট স্থগিত) আসনের মধ্যে সর্বশেষ ঘোষিত ফল অনুযায়ী ২১৩টি আসনে তৃণমূল জয়ী। বিজেপি জিতছে ৭৭ আসনে। মমতা নিজে ভোটে হারলেও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দলকে বিজয়ী করাকে বড় করে দেখছেন ভারতের অন্য রাজনীতিকরা। তৃণমূলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও ব্রায়েন এই জয়কে দেখিয়েছেন এভাবে- ‘মোদী+শাহ+বিজেপি+সিবিআই+ইডি+ইসি+গদি মিডিয়া+বিশ্বাসঘাতক’ মিলেও মমতাকে হারাতে পারেনি।

মমতাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইট করেছেন- ‘বিজেপিকে সহজেই হারিয়ে দেয়ার জন্য মমতাজি ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে অভিনন্দন।’

মমতার জয়কে সহজ করতে বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় প্রার্থী দেয়নি উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা, লালু প্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের তেজস্বী যাদব মমতার সঙ্গে দেখা করে সমর্থন জানিয়েছিলেন। অখিলেশ যাদব প্রচারের জন্য পাঠিয়েছেন তার দলের রাজ্যসভা সদস্য জয়া বচ্চনকে।

ভোটগণনার সঙ্গে সঙ্গেই মমতাকে একের পর এক শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন এনসিসির শারদ পাওয়ার, কাশ্মীরের ওমর আবদুল্লাহ, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে জিতে মোদি ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকে সরাসরি মোদির বিরোধিতা করে যাচ্ছেন মমতা। বারবার বিরোধীদের একজোট হওয়ার ডাক দিচ্ছেন।

কেন্দ্রের শাসক দলের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক দলগুলোকে জোটবদ্ধ করতে সক্রিয় রয়েছেন মমতা। বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে মোদিবিরোধী প্রচারে নিজের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন। মহারাষ্ট্রে উদ্ধব সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের হয়েও সরব হয়েছেন। উত্তর প্রদেশে অখিলেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতি, ওমর আবদুল্লাদের আটক করার প্রতিবাদও জানাচ্ছেন।

এক্ষেত্রে লোকসভা কিংবা রাজ্যসভায় না থেকেও গোটা ভারতে মোদিবিরোধী শীর্ষনেতা হিসেবে মমতা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর অন্য নেতারাও দৃশ্যত এখন ভরসা রাখছেন তার ওপরই।

তাই মমতাকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি তীব্র কটাক্ষ করেছেন মোদিকেও। তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী দিনে বাকি বিরোধী দলগুলোও রুখে দাঁড়াবে।

টানা দ্বিতীয়বার কেন্দ্রে সরকার গঠনের পর মোদি-অমিত শাহ জুটি সর্বভারতীয় দলগুলোকে কোণঠাসা করে ফেলার পর আঞ্চলিক দলগুলোকেও অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিচ্ছে। তখন পশ্চিমবঙ্গে মমতার এই জয় বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্য সবাইকে প্রেরণা জোগাবে বলে মনে করছে আনন্দবাজার।

কারণ তাদের ভাষায়, ‘মোদি-শাহের অশ্বমেধের ঘোড়ার লাগাম টানলেন’ তো মমতাই।

মঙ্গলবার, ০৪ মে ২০২১ , ২২ বৈশাখ ১৪২৮ ২২ রমজান ১৪৪২

ভারতের ‘প্রধান বিরোধী মুখ’ হয়ে উঠেছেন মমতা

সংবাদ ডেস্ক

image

‘নরেন্দ্র মোদি ম্যাজিকে’ যেন হাওয়ায় ভাসছিল বিজেপি, আগেরবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় যাদের আসন সংখ্যা ছিল ৩, তারা এবার ঘোষণা দিয়েছিল, জিতবে এবার ২০০টিতে।

কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল, আকাশে উঠার সেই স্বপ্ন থেকে তাদের মাটিতে নামিয়ে এনেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস।

বাম রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ভারতের বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্যটিতে এক দশক আগে ক্ষমতায় আসা মমতা ‘রাম শাসনের’ অপেক্ষা দীর্ঘ করে টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন।

ভোটে নিজে হারলেও জোড়াফুলের এই বিজয়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘বাংলার জয় ভারতকে বাঁচালো।’

‘এই ভোটে জিতে গোটা দেশের প্রধান বিরোধী মুখ হয়ে উঠলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়,’ বললেন তার নির্বাচন কৌঁসুলি প্রশান্ত কিশোর।

তাদের এই কথার প্রতিফলন ধরা পড়ে বিশাল ভারতের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অভিনন্দন বার্তায়। ধরা পড়ে আরও চারটি রাজ্যে ভোট হলেও পশ্চিমবঙ্গের ফল নিয়ে দেশটির গণমাধ্যমের ব্যাপক উৎসাহ।

কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে এক সময় বিজেপির হাত ধরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া মমতা হালে বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর মোদির চরম বিরোধী হিসেবেই পরিচিত করেছেন নিজেকে।

ভারতের পার্লামেন্টে বিজেপির একচ্ছত্র আধিপত্যে প্রধান বিরোধী দল বলে কিছু যখন নেই, তখন মমতাকে নিজেদের কণ্ঠস্বর ভাবছেন আঞ্চলিকসহ সর্বভারতীয় দলগুলোর নেতারাও।

আসাম ও ত্রিপুরা করায়ত্ত করে পশ্চিমবঙ্গকে পাখির চোখ করেছিলেন মোদি, ফলে এবারের বিধানসভা নির্বাচন ‘মোদি ভার্সাস মমতা’ লড়াইয়ে রূপ নিয়েছিল।

ভোটের প্রচারে ১২ বার পশ্চিমবঙ্গে এসে ১৮টি জনসভা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জনসভা করেছেন ৬২টি। কেন্দ্রীয় অন্য নেতারাও ছুটে বেরিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে।

গেরুয়া শিবিরের প্রচারে বলা হচ্ছিল, এবারই মমতার বিদায় হবে। ২ মের পর ক্ষমতা থেকে তাকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেও বলছিলেন অমিত শাহ।

আর তাদের এই আশায় সাহস জোগাচ্ছিল গত লোকসভা নির্বাচনের ফল। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পদ্মফুল ২৯৪টির মধ্যে মাত্র ৩টিতে জিতলও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখায় চমক।

জাতীয় নির্বাচনে সেবার মোদির দল ১৮টি আসনে জেতে, আর তার সঙ্গে তুলনা করলে এবার বিধানসভায় ১২১ আসনে জেতার কথা তাদের।

কিন্তু গত রোববার রাত নাগাদ ২৯২টি (দুটি আসনে ভোট স্থগিত) আসনের মধ্যে সর্বশেষ ঘোষিত ফল অনুযায়ী ২১৩টি আসনে তৃণমূল জয়ী। বিজেপি জিতছে ৭৭ আসনে। মমতা নিজে ভোটে হারলেও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দলকে বিজয়ী করাকে বড় করে দেখছেন ভারতের অন্য রাজনীতিকরা। তৃণমূলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও ব্রায়েন এই জয়কে দেখিয়েছেন এভাবে- ‘মোদী+শাহ+বিজেপি+সিবিআই+ইডি+ইসি+গদি মিডিয়া+বিশ্বাসঘাতক’ মিলেও মমতাকে হারাতে পারেনি।

মমতাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইট করেছেন- ‘বিজেপিকে সহজেই হারিয়ে দেয়ার জন্য মমতাজি ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে অভিনন্দন।’

মমতার জয়কে সহজ করতে বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় প্রার্থী দেয়নি উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা, লালু প্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের তেজস্বী যাদব মমতার সঙ্গে দেখা করে সমর্থন জানিয়েছিলেন। অখিলেশ যাদব প্রচারের জন্য পাঠিয়েছেন তার দলের রাজ্যসভা সদস্য জয়া বচ্চনকে।

ভোটগণনার সঙ্গে সঙ্গেই মমতাকে একের পর এক শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন এনসিসির শারদ পাওয়ার, কাশ্মীরের ওমর আবদুল্লাহ, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে জিতে মোদি ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকে সরাসরি মোদির বিরোধিতা করে যাচ্ছেন মমতা। বারবার বিরোধীদের একজোট হওয়ার ডাক দিচ্ছেন।

কেন্দ্রের শাসক দলের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক দলগুলোকে জোটবদ্ধ করতে সক্রিয় রয়েছেন মমতা। বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে মোদিবিরোধী প্রচারে নিজের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন। মহারাষ্ট্রে উদ্ধব সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের হয়েও সরব হয়েছেন। উত্তর প্রদেশে অখিলেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতি, ওমর আবদুল্লাদের আটক করার প্রতিবাদও জানাচ্ছেন।

এক্ষেত্রে লোকসভা কিংবা রাজ্যসভায় না থেকেও গোটা ভারতে মোদিবিরোধী শীর্ষনেতা হিসেবে মমতা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর অন্য নেতারাও দৃশ্যত এখন ভরসা রাখছেন তার ওপরই।

তাই মমতাকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি তীব্র কটাক্ষ করেছেন মোদিকেও। তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী দিনে বাকি বিরোধী দলগুলোও রুখে দাঁড়াবে।

টানা দ্বিতীয়বার কেন্দ্রে সরকার গঠনের পর মোদি-অমিত শাহ জুটি সর্বভারতীয় দলগুলোকে কোণঠাসা করে ফেলার পর আঞ্চলিক দলগুলোকেও অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিচ্ছে। তখন পশ্চিমবঙ্গে মমতার এই জয় বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্য সবাইকে প্রেরণা জোগাবে বলে মনে করছে আনন্দবাজার।

কারণ তাদের ভাষায়, ‘মোদি-শাহের অশ্বমেধের ঘোড়ার লাগাম টানলেন’ তো মমতাই।