স্পিডবোট দুর্ঘটনার মর্মান্তিক ঘটনা

বাবা-মা, দু’বোনের লাশ নিয়ে গ্রামে ফিরল শিশু মিম

দাদিকে শেষবারের মতো দেখার জন্য আমরা সবাই আসছিলাম দাদাবাড়ি। কিন্তু এখন বাবা-মা ও বোনেরা কেউ নেই। আমি একা হয়ে গেলাম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল ৯ বছরের শিশু মিম খাতুন। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে অনেকটা বাকরুদ্ধ সে। সোমবার সকালে মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা নদীতে একটি বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষ হয়। এসময় স্পিডবোটটি ডুবে যায়। এতে খুলনার তেরখাদা উপজেলার সদর ইউনিয়ানের পারোখালী গ্রামের মনির হোসেন এবং তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। ওই পরিবারে এখন বেঁচে আছে শুধু মিম। দুর্ঘটনার পর জীবিত উদ্ধার হয় মিম। প্রথমে আহত অবস্থায় তাকে শিবচরের পাচ্চর রয়েল হাসপাতালে নেয়া হয়। একটু সুস্থ হলে দোতরা স্কুলের মাঠে আনা হয় মিমকে। মা, বাবা, দুই বোন নেই জেনে তার কান্না থামছিল না। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে যান শিবচর ইউএনও আসাদুজ্জামান।

তিনি লাশের সারি থেকে মিমের মাধ্যমে মনির, হেনা, সুমি ও রুমির লাশ শনাক্ত করেন। ইউএনও আসাদুজ্জামান বলেন, আমাদের খরচে সোমবারই শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে মিমসহ নিহত মনির, হেনা, সুমি ও রুমির মরদেহ তাদের নিজ বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে দুর্ঘটনায় বেঁচে ফেরা মিম বাবা, মা ও দুই বোনের লাশ নিয়ে পারোখালী গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। এ সময় ছুটে আসেন পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন। তারাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। মঙ্গলবার সকালে সরেজমিন তেরখাদার পারোখালীতে দেখা যায়, পরিবারে চলছে শোকের মাতম। বাবা-মা ও ছোট দুই বোন হারিয়ে বাকরুদ্ধ মিম, শুধু ফ্যালফ্যাল করে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে।

মিমকে দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। নদীতে সে একটি ব্যাগ ধরে ভাসতে থাকে বলে জানায়। অবুঝ মিমকে সান্ত¡না দেয়ার ভাষাও নেই স্বজন-প্রতিবেশীদের। মীম এখন কোথায় থাকবে, কীভাবে থাকবে বা তার ভবিষ্যৎ কী? এ নিয়ে চিন্তিত স্বজন-প্রতিবেশীরা। মীমের কান্নায় চোখ ভিজে উঠছে তাদেরও। সকাল ৯টায় পারোখালী ফাঁকামাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় মনির শিকদার, তার স্ত্রী হেনা বেগম ও তাদের দুই কন্যাশিশু সুমী ও রুমীর। পরে মনিরের মা লাইলি বেগমের কবরের পাশেই পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

এমন শোকাবহ পরিস্থিতিতে জানাজায় উপজেলার সীমানা ছাড়িয়ে সর্বস্তরের শোকাহত মানুষের ঢল ছিল। জানাজা শেষে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিপাত যেন জানান দিল-প্রকৃতিও শোকাহত! নিহত মনির হোসেনের ছোট ভাই মো. কামরুজ্জামান জানান, চার ভাইবোনের মধ্যে মনির ছিল তৃতীয়। ঢাকার মিরপুর-১১ মসজিদ মার্কেটে কাটা-কাপড়ের দোকান ছিল তার। ওই এলাকার বাসিন্দাও তিনি। মনির বাড়ি আসছিলেন মাকে শেষবারের মতো দেখতে। সঙ্গে ছিল স্ত্রী হেনা বেগম, বড় মেয়ে মিম, মেজো মেয়ে সুমি খাতুন (৭) ও ছোট মেয়ে রুমি খাতুন (৪)।

কিন্তু মাকে আর দেখা হলো না, নিজেই সপরিবারে চলে গেলেন মায়ের সঙ্গেই। কামরুজ্জামান বলেন, মার কবর দেয়া হয়েছে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায়। আর মঙ্গলবার কবর দিলাম ভাই-ভাবি, ভাইঝিদের। মনির শিকদারের বেয়াই কিসমত হাওলাদার জানান, ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে সুখের সংসার ছিল মনিরের। তার বাবা আলম শিকদার মারা গেছেন অনেক আগে। কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। এখন বাবা-মা হীন ছোট মিমের কী হবে? তেরখাদা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এফএম অহিদুজ্জামান বলেন, মায়ের লাশ দেখতে এসে লাশ হয়ে গেল পুরো পরিবারটি। সত্যি বড় হৃদয়বিদারক। ছোট মিমের জন্য বেশ কষ্ট লাগছে। তেরখাদা উপজেলা চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম বলেন, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে মিমের জন্য এক লাখ টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া মিমের বিয়ের আগ পর্যন্ত আমরা তার ভরণপোষণ দেব।

বুধবার, ০৫ মে ২০২১ , ২৩ বৈশাখ ১৪২৮ ২৩ রমজান ১৪৪২

স্পিডবোট দুর্ঘটনার মর্মান্তিক ঘটনা

বাবা-মা, দু’বোনের লাশ নিয়ে গ্রামে ফিরল শিশু মিম

শুভ্র শচীন, খুলনা

image

দাদিকে শেষবারের মতো দেখার জন্য আমরা সবাই আসছিলাম দাদাবাড়ি। কিন্তু এখন বাবা-মা ও বোনেরা কেউ নেই। আমি একা হয়ে গেলাম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল ৯ বছরের শিশু মিম খাতুন। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে অনেকটা বাকরুদ্ধ সে। সোমবার সকালে মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা নদীতে একটি বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষ হয়। এসময় স্পিডবোটটি ডুবে যায়। এতে খুলনার তেরখাদা উপজেলার সদর ইউনিয়ানের পারোখালী গ্রামের মনির হোসেন এবং তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। ওই পরিবারে এখন বেঁচে আছে শুধু মিম। দুর্ঘটনার পর জীবিত উদ্ধার হয় মিম। প্রথমে আহত অবস্থায় তাকে শিবচরের পাচ্চর রয়েল হাসপাতালে নেয়া হয়। একটু সুস্থ হলে দোতরা স্কুলের মাঠে আনা হয় মিমকে। মা, বাবা, দুই বোন নেই জেনে তার কান্না থামছিল না। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে যান শিবচর ইউএনও আসাদুজ্জামান।

তিনি লাশের সারি থেকে মিমের মাধ্যমে মনির, হেনা, সুমি ও রুমির লাশ শনাক্ত করেন। ইউএনও আসাদুজ্জামান বলেন, আমাদের খরচে সোমবারই শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে মিমসহ নিহত মনির, হেনা, সুমি ও রুমির মরদেহ তাদের নিজ বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে দুর্ঘটনায় বেঁচে ফেরা মিম বাবা, মা ও দুই বোনের লাশ নিয়ে পারোখালী গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। এ সময় ছুটে আসেন পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন। তারাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। মঙ্গলবার সকালে সরেজমিন তেরখাদার পারোখালীতে দেখা যায়, পরিবারে চলছে শোকের মাতম। বাবা-মা ও ছোট দুই বোন হারিয়ে বাকরুদ্ধ মিম, শুধু ফ্যালফ্যাল করে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে।

মিমকে দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। নদীতে সে একটি ব্যাগ ধরে ভাসতে থাকে বলে জানায়। অবুঝ মিমকে সান্ত¡না দেয়ার ভাষাও নেই স্বজন-প্রতিবেশীদের। মীম এখন কোথায় থাকবে, কীভাবে থাকবে বা তার ভবিষ্যৎ কী? এ নিয়ে চিন্তিত স্বজন-প্রতিবেশীরা। মীমের কান্নায় চোখ ভিজে উঠছে তাদেরও। সকাল ৯টায় পারোখালী ফাঁকামাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় মনির শিকদার, তার স্ত্রী হেনা বেগম ও তাদের দুই কন্যাশিশু সুমী ও রুমীর। পরে মনিরের মা লাইলি বেগমের কবরের পাশেই পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

এমন শোকাবহ পরিস্থিতিতে জানাজায় উপজেলার সীমানা ছাড়িয়ে সর্বস্তরের শোকাহত মানুষের ঢল ছিল। জানাজা শেষে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিপাত যেন জানান দিল-প্রকৃতিও শোকাহত! নিহত মনির হোসেনের ছোট ভাই মো. কামরুজ্জামান জানান, চার ভাইবোনের মধ্যে মনির ছিল তৃতীয়। ঢাকার মিরপুর-১১ মসজিদ মার্কেটে কাটা-কাপড়ের দোকান ছিল তার। ওই এলাকার বাসিন্দাও তিনি। মনির বাড়ি আসছিলেন মাকে শেষবারের মতো দেখতে। সঙ্গে ছিল স্ত্রী হেনা বেগম, বড় মেয়ে মিম, মেজো মেয়ে সুমি খাতুন (৭) ও ছোট মেয়ে রুমি খাতুন (৪)।

কিন্তু মাকে আর দেখা হলো না, নিজেই সপরিবারে চলে গেলেন মায়ের সঙ্গেই। কামরুজ্জামান বলেন, মার কবর দেয়া হয়েছে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায়। আর মঙ্গলবার কবর দিলাম ভাই-ভাবি, ভাইঝিদের। মনির শিকদারের বেয়াই কিসমত হাওলাদার জানান, ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে সুখের সংসার ছিল মনিরের। তার বাবা আলম শিকদার মারা গেছেন অনেক আগে। কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। এখন বাবা-মা হীন ছোট মিমের কী হবে? তেরখাদা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এফএম অহিদুজ্জামান বলেন, মায়ের লাশ দেখতে এসে লাশ হয়ে গেল পুরো পরিবারটি। সত্যি বড় হৃদয়বিদারক। ছোট মিমের জন্য বেশ কষ্ট লাগছে। তেরখাদা উপজেলা চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম বলেন, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে মিমের জন্য এক লাখ টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া মিমের বিয়ের আগ পর্যন্ত আমরা তার ভরণপোষণ দেব।