অভয়াশ্রমে শত শত অবৈধ ড্রেজার : অধরা ইলিশ

চাঁদপুর হাইমচরের চরভৈরবী থেকে মতলব উত্তরের ষাটনলের ৭০ কিলোমিটার এলাকার নৌপথে শত শত অবৈধ বালুর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলনে ধ্বংসের মুখে পড়েছে জাতীয় সম্পদ ইলিশ। যেজন্য নদীতে নেমেও কাঙ্খিত বড় ইলিশ পাচ্ছে না জেলেরা। সরকার নদীতে জাটকা রক্ষায় অসাধু জেলেদের বিরুদ্ধে কঠোর ছিল। কিন্তু তা পুরোপুরি ভেস্তে দিচ্ছে অবৈধ ড্রেজিংয়ের বালু উত্তোলন। এমনটি জানিয়েছেন চাঁদপুর জেলে, মৎস্য নেতা, মৎস্য কর্মকর্তা, ইলিশ গবেষকসহ সংশ্লিষ্টরা।

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে চাঁদপুরের বড়স্টেশন মাছঘাট, বহরিয়াবাজার, হরিনাঘাট, পুরানবাজার ঘুরে দেখা যায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরেও ইলিশ ছাড়াই ফিরতে হচ্ছে জেলেদের।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, মার্চ-এপ্রিল দু’মাসের অভয়াশ্রমের সময় প্রায় পাঁচ শতাধিক জেলেকে জেল জরিমানা করা হয়েছে। প্রায় ৪০ টন জাটকা ও আড়াই কোটি মিটার অবৈধ কারেন্ট জালসহ অন্যান্য জাল জব্দ করা হয়েছে। জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, চাঁদপুর সদর, হাইমচর, মতলব দক্ষিণ ও মতলব উত্তর উপজেলাসহ জেলায় মোট ৫১ হাজার ১শ’ ৯০ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। তালিকাভুক্ত এসব জেলেকে এ সময় চার ধাপে ৪০ কেজি করে নদীতে না নামার শর্তে ভিজিএফের চাল প্রদান করা হয়েছে।

হাইমচর চরভৈরবী মৎস্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সালাউদ্দিন হাওলদার বলেন, সরকার প্রশাসন দিয়ে জেলেদের আটকিয়ে ইলিশ শিকার বন্ধ করে ঠিকই। কিন্তু ইলিশ উৎপাদনের মূল বাঁধা জেলে নয় বরং অবৈধ ড্রেজিং। তাই সরকারকে অবৈধ বালু উত্তোলনকারী এসব ড্রেজার নদী থেকে উৎখাতের মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে। তাহলেই নদীতে ইলিশের অন্যান্য মাছের ডিম টিকবে এবং ভরপুর বড় বড় মাছ পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ আওয়ামী মৎসজীবী লীগ চাঁদপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. মানিক দেওয়ান বলেন, জাটকা ইলিশ বালু উত্তোলনকারী ড্রেজিংয়ে ধ্বংস হচ্ছে। যেজন্য দুমাস জেলেরা অবসর থেকেও এখন নদীতে কাক্সিক্ষত ইলিশ পাচ্ছে না। বাংলাদেশ আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মালেক দেওয়ান বলেন, জাটকা মরার মরছেই। অক্টোবর-নভেম্বরে যখন মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়ে। ওই সময়েই কোটি কোটি ইলিশের ডিম এই অবৈধ বালু উত্তোলনকারী ড্রেজিংয়ে ধ্বংস হয়েছে। চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আসাদুল বাকী বলেন, ইলিশের গবেষকদের মতে অভয়াশ্রম ও প্রজনন মৌসুমে বালু উত্তোলনকারী ড্রেজারে নদীর পানি মারাত্মক ডিস্টার্ব হচ্ছে। এতে ইলিশের খাদ্য সঙ্কটসহ নানাভাবে এদের উৎপাদন বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা ওপর মহলে এর ভয়াবহতা তুলে ধরে পরবর্তীতে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেব।

চাঁদপুর নদী কেন্দ্রে চীফ সাইন্টিফিক অফিসার ড. মো. আনিছুর রহমান বলেন, পরিভ্রমনশীল স্বভাবের ইলিশ মাছ সাগর মোহনা হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে পদ্মায় যে চলাচল করছে। এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে যেখানে ইলিশ ডিম ছাড়ে, বাচ্চা লালিত-পালিত হয়। সেখানে বালু উত্তোলনের প্রেক্ষিতে তাদের যে ইকো সিস্টেম, সেটা বাঁধাগ্রস্ত হয়। পানির গুণাগুণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বোপরি এই যে মাইগ্রোরেটি রুটে অভিপ্রায়ন ইলিশ চলাচল করে। তাদের চলাচলের গভীরতাও বাঁধাগ্রস্ত হয়ে ইলিশ উৎপাদন হুমকির মুখে রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, চাঁদপুর হচ্ছে ইলিশের নানী বাড়ি। এখানে ডিম ছাড়ার জায়গা। অক্টোবরের পূর্ণিমা হচ্ছে ইলিশ ডিম ছাড়ার মুখ্যম সময়। প্রধানত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হলেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ও মার্চেও সুপ্ত আকারে ইলিশ ডিম ছাড়ে। কিন্তু চাঁদপুরের সফরমালী, ফরাজীকান্দি, কানুদী ও রাজরাজেশ্বরের অঞ্চলটা বালু উত্তোলনের জন্য বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। ইলিশের চলাচলের রুটটাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ব্যপারে জেলা প্রশাসক অন্জনা খান মজলিশ বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে চাঁদপুরের ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাঁধাগ্রস্তকারী যেকোন কিছুর ব্যাপারেই প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সেখানে এই বালু উত্তোলনের ড্রেজিং ব্যবহারের ব্যাপারেও আমরা কঠোর সিদ্ধান্তে যাচ্ছি। এইটুকু বলে রাখি ‘অবৈধ ড্রেজারের বিরুদ্ধে প্রশাসন জিরো টলারেন্স’। ইলিশ সম্পদ রক্ষায় সকলের সচেতনতা ও সহযোগিতা কামনা করছি।

বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১ , ২৪ বৈশাখ ১৪২৮ ২৪ রমজান ১৪৪২

অভয়াশ্রমে শত শত অবৈধ ড্রেজার : অধরা ইলিশ

অমরেশ দত্ত জয়, চাঁদপুর

image

চাঁদপুর হাইমচরের চরভৈরবী থেকে মতলব উত্তরের ষাটনলের ৭০ কিলোমিটার এলাকার নৌপথে শত শত অবৈধ বালুর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলনে ধ্বংসের মুখে পড়েছে জাতীয় সম্পদ ইলিশ। যেজন্য নদীতে নেমেও কাঙ্খিত বড় ইলিশ পাচ্ছে না জেলেরা। সরকার নদীতে জাটকা রক্ষায় অসাধু জেলেদের বিরুদ্ধে কঠোর ছিল। কিন্তু তা পুরোপুরি ভেস্তে দিচ্ছে অবৈধ ড্রেজিংয়ের বালু উত্তোলন। এমনটি জানিয়েছেন চাঁদপুর জেলে, মৎস্য নেতা, মৎস্য কর্মকর্তা, ইলিশ গবেষকসহ সংশ্লিষ্টরা।

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে চাঁদপুরের বড়স্টেশন মাছঘাট, বহরিয়াবাজার, হরিনাঘাট, পুরানবাজার ঘুরে দেখা যায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরেও ইলিশ ছাড়াই ফিরতে হচ্ছে জেলেদের।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, মার্চ-এপ্রিল দু’মাসের অভয়াশ্রমের সময় প্রায় পাঁচ শতাধিক জেলেকে জেল জরিমানা করা হয়েছে। প্রায় ৪০ টন জাটকা ও আড়াই কোটি মিটার অবৈধ কারেন্ট জালসহ অন্যান্য জাল জব্দ করা হয়েছে। জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, চাঁদপুর সদর, হাইমচর, মতলব দক্ষিণ ও মতলব উত্তর উপজেলাসহ জেলায় মোট ৫১ হাজার ১শ’ ৯০ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। তালিকাভুক্ত এসব জেলেকে এ সময় চার ধাপে ৪০ কেজি করে নদীতে না নামার শর্তে ভিজিএফের চাল প্রদান করা হয়েছে।

হাইমচর চরভৈরবী মৎস্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সালাউদ্দিন হাওলদার বলেন, সরকার প্রশাসন দিয়ে জেলেদের আটকিয়ে ইলিশ শিকার বন্ধ করে ঠিকই। কিন্তু ইলিশ উৎপাদনের মূল বাঁধা জেলে নয় বরং অবৈধ ড্রেজিং। তাই সরকারকে অবৈধ বালু উত্তোলনকারী এসব ড্রেজার নদী থেকে উৎখাতের মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে। তাহলেই নদীতে ইলিশের অন্যান্য মাছের ডিম টিকবে এবং ভরপুর বড় বড় মাছ পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ আওয়ামী মৎসজীবী লীগ চাঁদপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. মানিক দেওয়ান বলেন, জাটকা ইলিশ বালু উত্তোলনকারী ড্রেজিংয়ে ধ্বংস হচ্ছে। যেজন্য দুমাস জেলেরা অবসর থেকেও এখন নদীতে কাক্সিক্ষত ইলিশ পাচ্ছে না। বাংলাদেশ আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মালেক দেওয়ান বলেন, জাটকা মরার মরছেই। অক্টোবর-নভেম্বরে যখন মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়ে। ওই সময়েই কোটি কোটি ইলিশের ডিম এই অবৈধ বালু উত্তোলনকারী ড্রেজিংয়ে ধ্বংস হয়েছে। চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আসাদুল বাকী বলেন, ইলিশের গবেষকদের মতে অভয়াশ্রম ও প্রজনন মৌসুমে বালু উত্তোলনকারী ড্রেজারে নদীর পানি মারাত্মক ডিস্টার্ব হচ্ছে। এতে ইলিশের খাদ্য সঙ্কটসহ নানাভাবে এদের উৎপাদন বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা ওপর মহলে এর ভয়াবহতা তুলে ধরে পরবর্তীতে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেব।

চাঁদপুর নদী কেন্দ্রে চীফ সাইন্টিফিক অফিসার ড. মো. আনিছুর রহমান বলেন, পরিভ্রমনশীল স্বভাবের ইলিশ মাছ সাগর মোহনা হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে পদ্মায় যে চলাচল করছে। এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে যেখানে ইলিশ ডিম ছাড়ে, বাচ্চা লালিত-পালিত হয়। সেখানে বালু উত্তোলনের প্রেক্ষিতে তাদের যে ইকো সিস্টেম, সেটা বাঁধাগ্রস্ত হয়। পানির গুণাগুণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বোপরি এই যে মাইগ্রোরেটি রুটে অভিপ্রায়ন ইলিশ চলাচল করে। তাদের চলাচলের গভীরতাও বাঁধাগ্রস্ত হয়ে ইলিশ উৎপাদন হুমকির মুখে রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, চাঁদপুর হচ্ছে ইলিশের নানী বাড়ি। এখানে ডিম ছাড়ার জায়গা। অক্টোবরের পূর্ণিমা হচ্ছে ইলিশ ডিম ছাড়ার মুখ্যম সময়। প্রধানত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হলেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ও মার্চেও সুপ্ত আকারে ইলিশ ডিম ছাড়ে। কিন্তু চাঁদপুরের সফরমালী, ফরাজীকান্দি, কানুদী ও রাজরাজেশ্বরের অঞ্চলটা বালু উত্তোলনের জন্য বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। ইলিশের চলাচলের রুটটাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ব্যপারে জেলা প্রশাসক অন্জনা খান মজলিশ বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে চাঁদপুরের ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাঁধাগ্রস্তকারী যেকোন কিছুর ব্যাপারেই প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সেখানে এই বালু উত্তোলনের ড্রেজিং ব্যবহারের ব্যাপারেও আমরা কঠোর সিদ্ধান্তে যাচ্ছি। এইটুকু বলে রাখি ‘অবৈধ ড্রেজারের বিরুদ্ধে প্রশাসন জিরো টলারেন্স’। ইলিশ সম্পদ রক্ষায় সকলের সচেতনতা ও সহযোগিতা কামনা করছি।