পাঁচ পুলিশসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র

সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় পাঁচ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

বুধবার সকালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার কাছে অভিযোগপত্রটি দাখিল করে। প্রশিকিউশন শাখা অভিযোগপত্রটি ভার্চ্যুয়াল আদালতে উপস্থাপন করবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ খালেদ উজ জামান। এতে ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়াকে প্রধান হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযুক্ত অন্যরা হলেন- ফাঁড়ির টুআইসি এসআই হাসান আলী, এএসআই আশেকে এলাহী, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস ও আবদুল্লাহ আল নোমান। তাদের মধ্যে সবাই কারাগারে থাকলেও কোম্পানীগঞ্জের আবদুল আল নোমান পলাতক রয়েছেন। অভিযোগপত্রে যেসব আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে তা প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

অভিযোগপত্র জমা দেয়ার পর বুধবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান বলেন, অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২, ৫০১ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর ১৫(২), ১৫(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

এই দুই আইনের একটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও অপরটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের কথা উল্লেখ আছে। ফলে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।

১৯৬২ পৃষ্ঠার এই অভিযোগপত্রে ৬৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে জানিয়ে এসপি বলেন, এরমধ্যে ১০ জন ১৬৪ ধারায় আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। যাদের মধ্যে ৭ জন পুলিশ রয়েছেন।

তবে রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন পূর্বপরিকল্পিত কিংবা পূর্ব বিরোধের জের ধরে নয় বলে দাবি এই কর্মকর্তার। তিনি বলেন, তদন্তে রায়হান আহমদকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানোর প্রমাণ মিলেছে। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ বহিষ্কৃত এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া, বহিষ্কৃত সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আশেকে এলাহি, পুলিশের কনস্টেবল হারুনুর রশিদ ও টিটু চন্দ্র দাস নির্যাতনে অংশ নেন বলে তদন্তে প্রমাণ মিলেছে।

আর নির্যাতনের আলামত নষ্ট ও অভিযুক্তদের পালাতে সহয়াতা করেন এএসআই হাসান উদ্দিন এবং কথিত সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল নোমান।

নগরের আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কাষ্টঘর সুইপার কলোনি থেকে তাকে ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যান এই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ও তার সহকারীরা।

ফাঁড়িতে রায়হানকে ধরে আনা প্রসঙ্গে এসপি খালেদ উজ জামান বলেন, সাইদুল শেখ নামের এক ব্যক্তির করা ছিনতাইয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে রায়হানকে কাষ্টঘর থেকে ধরে আনে পুলিশ।

এসপি বলেন, সাইদুল ইয়াবা সংগ্রহ করতে কাষ্টঘর এলাকায় গিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলাও রয়েছে। সাইদুলের দাবি, ইয়াবা সংগ্রহকালে সেখানে রায়হানের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই পুলিশ সুপার আরও বলেন, সাইদুলের অভিযোগ পেয়ে রায়হানকে কাষ্টঘর থেকে ধরে আনে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশ। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদকালে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে মারা যান।

রায়হানের মা সালমা বেগম প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছেন, অন্য কারও ইন্ধনে পূর্বপরিকল্পনার জেরে রায়হানকে তুলে এনে নির্যাতন করেছে পুলিশ।

তবে বুধবার এসপি খালেদ উজ জামান বলেন, দীর্ঘ তদন্ত, সবার সাক্ষ্যগ্রহণ এবং রায়হান, আকবরসহ সংশ্লিষ্টদের মোবাইল ফোন আলাপ সংগ্রহ করেও আমরা এরকম কোন প্রমাণ পাইনি। রায়হানকে নির্যাতনের সঙ্গে পূর্ব বিরোধের কিছু পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, রায়হানকে তুলে নেয়ার পর শেষ রাতে এক পুলিশ সদস্যের মোবাইল থেকে নিজের চাচাকে ফোন করেন রায়হান। এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্রুত ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসার জন্য চাচাকে অনুরোধ করে। ভোরের ফজরের নামাজের পূর্ব মুহূর্তে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে হাজির হন চাচা। তবে তখন তাকে রায়হানের সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এরপর ১১ অক্টোবর সকালে আবার চাচা ফাঁড়িতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়হানকে ওসমানী হাসপাতপালে পাঠানো হয়েছে। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে রায়হানের মরদেহ দেখতে পায় পরিবার।

১১ অক্টাবর রাতেই হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। রায়হান হত্যার বিচার দাবিতে সিলেটজুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। অবশেষে প্রায় সাত মাস পর চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করা হলো।

এ বিষয়ে মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এমএ ফজল চৌধুরী বলেন, পিবিআই দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে আপাতত কোন অসঙ্গতি চোখে পড়েনি। তবে অভিযোগপত্রসহ অন্যান্য কাগজপত্র তুলার পর বিস্তারিত জানা যাবে। অভিযোগপত্রের কপি আমাদের কাছে আসার পর তা দেখে আমারা সিদ্ধান্ত নেব অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে না রাজি দিব কি, দিব না।

শেষ রক্ষা হলো না কথিত সাংবাদিক নোমানের

সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান আহমদ হত্যার পর সিসিটিভির ফুটেজ নষ্ট ও এসআই আকবরকে পালাতে সহায়তা করার অভিযোগ ওঠে কথিত সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে। বর্তমানে তিনি পলাতক থাকলেও শেষরক্ষা হয়নি। মামলার অভিযোগপত্রে তাকে আসামি করা হয়েছে।

অভিযোগপত্র জমা দেয়ার পর গতকাল দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান বলেন, নোমানের বিরুদ্ধে নির্যাতনের আলামত ধ্বংস ও আকবরকে পালাতে সহায়তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, নোমান এখনও পলাতক রয়েছে। তবে তাকে ধরতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলছে।

পিবাআই সূত্রে জানা যায়, নোমান ও এসআই আকবর পরষ্পরের আত্মীয়। আত্মীয় নোমানের সহায়তায় সিলেট থেকে পালান আকবর। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সিসিটিভির হার্ডডিস্কও গায়েব করেন তিনি। তবে নানা চেষ্টায়ও তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে তিনি বেশ দক্ষ।

যা বললেন রায়হানের মা

সিলেটে আলোচিত রায়হান হত্যা মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন অভিযোগপত্র দাখিলের পর গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রায়হানের মা সালমা বেগম।

তিনি বলেন, ‘চার্জশিট দাখিল করতে এত সময় নিল পুলিশ। পুলিশ আমাদের বলল- ভালো ফলাফল পেতে গেলে একটু ধৈর্য ধরতে হবে, দেরি হবে। আমরা ধৈর্য ধরে ৮ মাস তো অপেক্ষা করলাম। কিন্তু শোনলাম চার্জশিটে ২-৩ জনের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। তাহলে এই অপেক্ষা করে লাভ কী হলো?’

সালমা বেগম বলেন, ‘আপনাদের কাছে হয়তো রায়হান না থাকার ৭-৮ মাস। কিন্তু আমার কাছে আমার কলিজার টুকরা সন্তান হারানোর পর একেকটি দিন ছিল যেন একেকটি বছর। তারপরও যদি অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি পাইয়ে দেয়ার মতো চার্জশিট তৈরি করা হয় তবে অন্তত এই ৮ মাস ধৈর্য ধরা কিছুটা স্বার্থক হবে।’

রায়হানের মা সালমা বেগম আরও বলেন, ‘জড়িত সব আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তাহলে আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে। আমি মরে যাওয়ার আগে আসামিদের শাস্তি দেখে যেতে চাই। আমার ছেলেকে ধরে নির্যাতন করার অধিকার কারও নাই। সে অন্যায় করে থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশ মারধর করবে কেন? আমার ছেলেকে রাত ১টার দিাকে তুলে নেয়। সকাল ৭টার দিকে সে মারা যায়। এই ৬ ঘণ্টা ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে তাকে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ইয়াবা-ছিনতাইসহ এখন নানা বিষয়কে রায়হানের সঙ্গে জড়ানো হচ্ছে। রায়হান যেহেতু নেই তাই এমন বিষয়ের সত্য মিথ্যা যাচাই করা সম্ভব নয়। এখন তো সে আর এসবের প্রতিবাদ করতে পারবে না। আমাদের দাবি একটাই, রায়হান হত্যার বিচার চাই।’

বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১ , ২৪ বৈশাখ ১৪২৮ ২৪ রমজান ১৪৪২

সিলেটে ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান হত্যা

পাঁচ পুলিশসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র

বিশেষ প্রতিনিধি

সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় পাঁচ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

বুধবার সকালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার কাছে অভিযোগপত্রটি দাখিল করে। প্রশিকিউশন শাখা অভিযোগপত্রটি ভার্চ্যুয়াল আদালতে উপস্থাপন করবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ খালেদ উজ জামান। এতে ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়াকে প্রধান হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযুক্ত অন্যরা হলেন- ফাঁড়ির টুআইসি এসআই হাসান আলী, এএসআই আশেকে এলাহী, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস ও আবদুল্লাহ আল নোমান। তাদের মধ্যে সবাই কারাগারে থাকলেও কোম্পানীগঞ্জের আবদুল আল নোমান পলাতক রয়েছেন। অভিযোগপত্রে যেসব আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে তা প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

অভিযোগপত্র জমা দেয়ার পর বুধবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান বলেন, অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২, ৫০১ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর ১৫(২), ১৫(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

এই দুই আইনের একটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও অপরটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের কথা উল্লেখ আছে। ফলে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।

১৯৬২ পৃষ্ঠার এই অভিযোগপত্রে ৬৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে জানিয়ে এসপি বলেন, এরমধ্যে ১০ জন ১৬৪ ধারায় আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। যাদের মধ্যে ৭ জন পুলিশ রয়েছেন।

তবে রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন পূর্বপরিকল্পিত কিংবা পূর্ব বিরোধের জের ধরে নয় বলে দাবি এই কর্মকর্তার। তিনি বলেন, তদন্তে রায়হান আহমদকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানোর প্রমাণ মিলেছে। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ বহিষ্কৃত এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া, বহিষ্কৃত সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আশেকে এলাহি, পুলিশের কনস্টেবল হারুনুর রশিদ ও টিটু চন্দ্র দাস নির্যাতনে অংশ নেন বলে তদন্তে প্রমাণ মিলেছে।

আর নির্যাতনের আলামত নষ্ট ও অভিযুক্তদের পালাতে সহয়াতা করেন এএসআই হাসান উদ্দিন এবং কথিত সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল নোমান।

নগরের আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কাষ্টঘর সুইপার কলোনি থেকে তাকে ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যান এই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ও তার সহকারীরা।

ফাঁড়িতে রায়হানকে ধরে আনা প্রসঙ্গে এসপি খালেদ উজ জামান বলেন, সাইদুল শেখ নামের এক ব্যক্তির করা ছিনতাইয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে রায়হানকে কাষ্টঘর থেকে ধরে আনে পুলিশ।

এসপি বলেন, সাইদুল ইয়াবা সংগ্রহ করতে কাষ্টঘর এলাকায় গিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলাও রয়েছে। সাইদুলের দাবি, ইয়াবা সংগ্রহকালে সেখানে রায়হানের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই পুলিশ সুপার আরও বলেন, সাইদুলের অভিযোগ পেয়ে রায়হানকে কাষ্টঘর থেকে ধরে আনে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশ। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদকালে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে মারা যান।

রায়হানের মা সালমা বেগম প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছেন, অন্য কারও ইন্ধনে পূর্বপরিকল্পনার জেরে রায়হানকে তুলে এনে নির্যাতন করেছে পুলিশ।

তবে বুধবার এসপি খালেদ উজ জামান বলেন, দীর্ঘ তদন্ত, সবার সাক্ষ্যগ্রহণ এবং রায়হান, আকবরসহ সংশ্লিষ্টদের মোবাইল ফোন আলাপ সংগ্রহ করেও আমরা এরকম কোন প্রমাণ পাইনি। রায়হানকে নির্যাতনের সঙ্গে পূর্ব বিরোধের কিছু পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, রায়হানকে তুলে নেয়ার পর শেষ রাতে এক পুলিশ সদস্যের মোবাইল থেকে নিজের চাচাকে ফোন করেন রায়হান। এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্রুত ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসার জন্য চাচাকে অনুরোধ করে। ভোরের ফজরের নামাজের পূর্ব মুহূর্তে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে হাজির হন চাচা। তবে তখন তাকে রায়হানের সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এরপর ১১ অক্টোবর সকালে আবার চাচা ফাঁড়িতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়হানকে ওসমানী হাসপাতপালে পাঠানো হয়েছে। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে রায়হানের মরদেহ দেখতে পায় পরিবার।

১১ অক্টাবর রাতেই হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। রায়হান হত্যার বিচার দাবিতে সিলেটজুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। অবশেষে প্রায় সাত মাস পর চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র প্রদান করা হলো।

এ বিষয়ে মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এমএ ফজল চৌধুরী বলেন, পিবিআই দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে আপাতত কোন অসঙ্গতি চোখে পড়েনি। তবে অভিযোগপত্রসহ অন্যান্য কাগজপত্র তুলার পর বিস্তারিত জানা যাবে। অভিযোগপত্রের কপি আমাদের কাছে আসার পর তা দেখে আমারা সিদ্ধান্ত নেব অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে না রাজি দিব কি, দিব না।

শেষ রক্ষা হলো না কথিত সাংবাদিক নোমানের

সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান আহমদ হত্যার পর সিসিটিভির ফুটেজ নষ্ট ও এসআই আকবরকে পালাতে সহায়তা করার অভিযোগ ওঠে কথিত সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে। বর্তমানে তিনি পলাতক থাকলেও শেষরক্ষা হয়নি। মামলার অভিযোগপত্রে তাকে আসামি করা হয়েছে।

অভিযোগপত্র জমা দেয়ার পর গতকাল দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান বলেন, নোমানের বিরুদ্ধে নির্যাতনের আলামত ধ্বংস ও আকবরকে পালাতে সহায়তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, নোমান এখনও পলাতক রয়েছে। তবে তাকে ধরতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলছে।

পিবাআই সূত্রে জানা যায়, নোমান ও এসআই আকবর পরষ্পরের আত্মীয়। আত্মীয় নোমানের সহায়তায় সিলেট থেকে পালান আকবর। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সিসিটিভির হার্ডডিস্কও গায়েব করেন তিনি। তবে নানা চেষ্টায়ও তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে তিনি বেশ দক্ষ।

যা বললেন রায়হানের মা

সিলেটে আলোচিত রায়হান হত্যা মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন অভিযোগপত্র দাখিলের পর গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রায়হানের মা সালমা বেগম।

তিনি বলেন, ‘চার্জশিট দাখিল করতে এত সময় নিল পুলিশ। পুলিশ আমাদের বলল- ভালো ফলাফল পেতে গেলে একটু ধৈর্য ধরতে হবে, দেরি হবে। আমরা ধৈর্য ধরে ৮ মাস তো অপেক্ষা করলাম। কিন্তু শোনলাম চার্জশিটে ২-৩ জনের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। তাহলে এই অপেক্ষা করে লাভ কী হলো?’

সালমা বেগম বলেন, ‘আপনাদের কাছে হয়তো রায়হান না থাকার ৭-৮ মাস। কিন্তু আমার কাছে আমার কলিজার টুকরা সন্তান হারানোর পর একেকটি দিন ছিল যেন একেকটি বছর। তারপরও যদি অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি পাইয়ে দেয়ার মতো চার্জশিট তৈরি করা হয় তবে অন্তত এই ৮ মাস ধৈর্য ধরা কিছুটা স্বার্থক হবে।’

রায়হানের মা সালমা বেগম আরও বলেন, ‘জড়িত সব আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তাহলে আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে। আমি মরে যাওয়ার আগে আসামিদের শাস্তি দেখে যেতে চাই। আমার ছেলেকে ধরে নির্যাতন করার অধিকার কারও নাই। সে অন্যায় করে থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশ মারধর করবে কেন? আমার ছেলেকে রাত ১টার দিাকে তুলে নেয়। সকাল ৭টার দিকে সে মারা যায়। এই ৬ ঘণ্টা ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে তাকে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ইয়াবা-ছিনতাইসহ এখন নানা বিষয়কে রায়হানের সঙ্গে জড়ানো হচ্ছে। রায়হান যেহেতু নেই তাই এমন বিষয়ের সত্য মিথ্যা যাচাই করা সম্ভব নয়। এখন তো সে আর এসবের প্রতিবাদ করতে পারবে না। আমাদের দাবি একটাই, রায়হান হত্যার বিচার চাই।’