হত্যার পর পুলিশ প্রচার করে রায়হান গণপিটুনিতে নিহত হয়

সিলেটে রায়হান হত্যার বিষয়টি শুরুতে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত বলে প্রচার করেছিল পুলিশ। নগরীর কাস্টঘর এলাকায় গত বছরের ১০ অক্টোবর রাতে এমন একটি নাটক সাজিয়ে পরদিন ১১ অক্টোবর প্রচার করা হয়। আর তা ঘটনার মূল হোতা পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া গণমাধ্যমকর্মীদের নিজ থেকেই ফোন করে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে ওই এলাকায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় কোন গণপিটুনির চিত্র পাওয়া যায়নি। ফলে সন্দেহ শুরু হয় এবং এ ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে সিলেট।

শুরুতে কাস্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে আহত হয়ে কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার ফাঁড়িতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, তবে ওই এলাকায় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের স্থাপন করা ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় এমন কোন গণপিটুনির চিত্র পাওয়া যায়নি। রায়হানের পরিবারের দাবি ছিল ১০ অক্টোবর রাতে বাসায় না ফেরায় তাকে খোঁজাখুঁজি করেন পরিবারের সদস্যরা। পরদিন ভোরে রায়হানের পরিবারের সদস্যদের কাছে বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকে ফোনে জানানো হয়, রায়হান পুলিশ হেফাজতে আছেন। তাকে ছাড়িয়ে নিতে হলে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। তারা এ সময় পুলিশ ফাঁড়িতে যান। তবে গিয়ে জানতে পারেন রায়হান মারা গেছেন। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে তার লাশ শনাক্ত করেন পরিবারের সদস্যরা।

পরে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলায় তিনি কাউকে আসামি না করলেও এজাহারে যে মুঠোফোন থেকে পরিবারের কাছে কল এসেছিল, তার নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। ‘টাকা নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আসো, আমাকে বাঁচাও’, রায়হানের এই আকুতি তুলে ধরা হয়।

প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে ওই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) স্থানান্তরিত হয় এবং ঘটনার পরদিন থেকে এসআই আকবরকে পাওয়া যায়নি। তবে ২০ অক্টোবর কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। ২১ অক্টোবর ফাঁড়ির সিসি ক্যামেরার চিত্র নষ্ট করা ও আকবরকে পালাতে সহায়তা করার দায়ে ‘টুইআইসি’ পদে থাকা এসআই হাসান উদ্দিনকে বরখাস্ত করা হয়।

ঘটনার দিন (১০ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত ফাঁড়িতে সেন্ট্রি পোস্টে কর্তব্যরত তিনজন কনস্টেবল শামীম মিয়া, সাইদুর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে নির্যাতনের প্রমাণ মেলে। সাইদুর ও দেলোয়ারকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলেছিলেন আকবর। সত্য কথা বললে ‘বুকে গুলি করব, পিঠ দিয়ে বের হবে’ বলে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।

পুলিশ সূত্র জানায়, ১৪ অক্টোবর আকবর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবশে করেন। সেখান থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আশ্রয় নেন আসামের শিলচরে। আকবর তখন বেশভূষা বদল করে নিজের নাম ‘কুমার দেব’ বলে পরিচয় দেন। এভাবে ১৮ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত বসবাস করেন।

এদিকে এসআই আকবর ভারতে পালিয়ে গেলে নগরীর আখালিয়া এলাকা থেকে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পর্যন্ত প্রতিদিনই প্রতিবাদী কর্মসূচি সরব হয়ে ওঠে। তবে তাকে ধরতে সিলেটের পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একটি দল ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় হয়। এরপর শিলচরে আকবরের আশ্রয়দাতাকে ১০ লাখ রুপি (১২ লাখ টাকা) দিয়ে আকবরকে ধরার বন্দোবস্ত পাকা করা হয়। পরদিন আশ্রয়দাতার লোকজনই ডোনা সীমান্তের ওপার থেকে কানাইঘাটে পাঠান। সেখান থেকে জেলা পুলিশের একটি দল আকবরকে গ্রেপ্তার করে।

যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে টাকার বিনিময়ের কোন তথ্য দেয়া হয়নি। তাদের দাবি সবাই বলেছেন আকবর পালিয়ে ভারতে ছিলেন, কিন্তু তারা সীমান্ত এলাকা থেকে আটক করেন। ধরা পড়ার পর একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে তিনি খাসিয়াদের বেশে। ‘আমাকে বাঁচান...’ বলে আকুতিও প্রকাশ করেন।

বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১ , ২৪ বৈশাখ ১৪২৮ ২৪ রমজান ১৪৪২

হত্যার পর পুলিশ প্রচার করে রায়হান গণপিটুনিতে নিহত হয়

প্রতিনিধি, সিলেট

সিলেটে রায়হান হত্যার বিষয়টি শুরুতে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত বলে প্রচার করেছিল পুলিশ। নগরীর কাস্টঘর এলাকায় গত বছরের ১০ অক্টোবর রাতে এমন একটি নাটক সাজিয়ে পরদিন ১১ অক্টোবর প্রচার করা হয়। আর তা ঘটনার মূল হোতা পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া গণমাধ্যমকর্মীদের নিজ থেকেই ফোন করে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে ওই এলাকায় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় কোন গণপিটুনির চিত্র পাওয়া যায়নি। ফলে সন্দেহ শুরু হয় এবং এ ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে সিলেট।

শুরুতে কাস্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে আহত হয়ে কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার ফাঁড়িতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, তবে ওই এলাকায় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের স্থাপন করা ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় এমন কোন গণপিটুনির চিত্র পাওয়া যায়নি। রায়হানের পরিবারের দাবি ছিল ১০ অক্টোবর রাতে বাসায় না ফেরায় তাকে খোঁজাখুঁজি করেন পরিবারের সদস্যরা। পরদিন ভোরে রায়হানের পরিবারের সদস্যদের কাছে বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকে ফোনে জানানো হয়, রায়হান পুলিশ হেফাজতে আছেন। তাকে ছাড়িয়ে নিতে হলে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। তারা এ সময় পুলিশ ফাঁড়িতে যান। তবে গিয়ে জানতে পারেন রায়হান মারা গেছেন। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে তার লাশ শনাক্ত করেন পরিবারের সদস্যরা।

পরে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলায় তিনি কাউকে আসামি না করলেও এজাহারে যে মুঠোফোন থেকে পরিবারের কাছে কল এসেছিল, তার নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। ‘টাকা নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আসো, আমাকে বাঁচাও’, রায়হানের এই আকুতি তুলে ধরা হয়।

প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে ওই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) স্থানান্তরিত হয় এবং ঘটনার পরদিন থেকে এসআই আকবরকে পাওয়া যায়নি। তবে ২০ অক্টোবর কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। ২১ অক্টোবর ফাঁড়ির সিসি ক্যামেরার চিত্র নষ্ট করা ও আকবরকে পালাতে সহায়তা করার দায়ে ‘টুইআইসি’ পদে থাকা এসআই হাসান উদ্দিনকে বরখাস্ত করা হয়।

ঘটনার দিন (১০ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত ফাঁড়িতে সেন্ট্রি পোস্টে কর্তব্যরত তিনজন কনস্টেবল শামীম মিয়া, সাইদুর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে নির্যাতনের প্রমাণ মেলে। সাইদুর ও দেলোয়ারকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলেছিলেন আকবর। সত্য কথা বললে ‘বুকে গুলি করব, পিঠ দিয়ে বের হবে’ বলে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।

পুলিশ সূত্র জানায়, ১৪ অক্টোবর আকবর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবশে করেন। সেখান থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আশ্রয় নেন আসামের শিলচরে। আকবর তখন বেশভূষা বদল করে নিজের নাম ‘কুমার দেব’ বলে পরিচয় দেন। এভাবে ১৮ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত বসবাস করেন।

এদিকে এসআই আকবর ভারতে পালিয়ে গেলে নগরীর আখালিয়া এলাকা থেকে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পর্যন্ত প্রতিদিনই প্রতিবাদী কর্মসূচি সরব হয়ে ওঠে। তবে তাকে ধরতে সিলেটের পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একটি দল ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় হয়। এরপর শিলচরে আকবরের আশ্রয়দাতাকে ১০ লাখ রুপি (১২ লাখ টাকা) দিয়ে আকবরকে ধরার বন্দোবস্ত পাকা করা হয়। পরদিন আশ্রয়দাতার লোকজনই ডোনা সীমান্তের ওপার থেকে কানাইঘাটে পাঠান। সেখান থেকে জেলা পুলিশের একটি দল আকবরকে গ্রেপ্তার করে।

যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে টাকার বিনিময়ের কোন তথ্য দেয়া হয়নি। তাদের দাবি সবাই বলেছেন আকবর পালিয়ে ভারতে ছিলেন, কিন্তু তারা সীমান্ত এলাকা থেকে আটক করেন। ধরা পড়ার পর একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে তিনি খাসিয়াদের বেশে। ‘আমাকে বাঁচান...’ বলে আকুতিও প্রকাশ করেন।