একজন মাজু বিবি ও শিল্পী পান্নার মুক্তিগাঁথা ফুডব্যাংক

মাজু বিবি জানেন না তার বয়স কত? বলতে পারেন না একমাত্র ছেলের এমনকি নিজের নামটিও। হাঁটতে-চলতে পারেন না বহুদিন হলো। চোখেও তেমন দেখেন না। দরজা-জানালাবিহীন টিনের চালায় একাই থাকেন আশিতিপর এ বৃদ্ধা। কিন্তু একটি বিষয় শুধু বুঝতে পারেন। সেটি হলো পেটের ক্ষুধা। ঘরের মেঝেতে একটি পাটের চট বিছিয়ে বসে থাকেন মাজু বিবি।

কখন আসবে পান্না। কখন দেবে খাবার। কৈ গো মা জননী শব্দে ডাকতে ডাকতে পান্নার কন্ঠ শুনলেই তার চোখ চকচক করে ওঠে। প্রতিবন্ধী ছেলে শুকুর আলীর হতদরিদ্র সংসারে দুবেলা খেতে পাওয়া যখন অনিশ্চিত।

এ অবস্থায় দুবেলা খাবার অনিশ্চয়তা কিছুটা হলেও দূর করছে শিল্পী শামসুজ্জামান পান্নার উদ্যোগে গড়ে উঠা ফুডব্যাংক। গ্রামের কয়েকজন মানুষের কাছে খবর পেয়ে মাজু বিবির বাড়িতে প্রথম যেদিন খাবার নিয়ে হাজির হন চিত্রশিল্পী পান্না। কয়েক টুকরো মুরগির মাংসের সঙ্গে একটু তরকারি আর ভাতে যেন অমৃতের সন্ধান পান ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত বৃদ্ধা মাজু বিবি।

একইভাবে এ গ্রামের অসংখ্য দরিদ্র শিশু, প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধ মানুষ পান প্রতিদিন এক বেলা উন্নত খাবারের ব্যবস্থা। পান্নাকে স্থানীয় শিশুরা চেনে বন্ধু নামে। বৃদ্ধরা অনেকে তা বলেই ডাকেন। বন্ধুকে আসতে দেখলেই ওদের যত আনন্দ।

মাগুরা সদর উপজেলার চাউলিয়া ইউনিয়নের কড়চাডাঙ্গা পাড়ায় গত বছর থেকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র অসহায় পরিবারের শিশুদের জন্য একবেলা যথাসম্ভব উন্নত খাবার সরবরাহের জন্য মুক্তিগাঁথা ফুডব্যাংক কর্মসূচির মতো মানবিক কর্মসূচিতে হাত দেন শিল্পী পান্না। প্রথমে নিজের জমানো টাকা দিয়ে শুরু। এরপর তার মানবিক উদ্যোগে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় কিছু পরিচিত বন্ধু, মাগুরা শহরে প্রতিষ্ঠিত মাগুরা ক্লাব ও গ্রামের অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল মানুষরা।

শামসুজ্জামান পান্না জানান- গত বছরের শুরুতে করোনার সময়ে শহর বা শহরের আশপাশের অসহায় মানুষ কিছুটা সরকারি সহায়তা পেলেও গ্রামের মানুষরা অনেকটাই অবহেলিত ছিল বলে আমার চোখে পড়েছে। বাবা মা কর্মহীন হয়ে পড়ায় গ্রামের শিশুদের পুষ্টি চাহিদা অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এ অবস্থায় নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী শিশুদের পড়াশুনা, সুকুমার বৃত্তির পরিচর্যাসহ যতটুকু সম্ভব দরিদ্র শিশু ও বৃদ্ধদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।

গত বছর দুমাস একটানা ও পরবর্তীতে মাঝে মাঝে বন্ধুদের সহায়তায় এ খাবার সরবরাহ করি। সেখান থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতায় আমি মনে করি প্রতিটি এলাকায় শিশুদের জন্য একটি ফুডব্যাংক থাকা জরুরি। সেখানে গ্রামের সমর্থবান মানুষরা খাদ্য জমা রেখে অংশ নেবেন। আবার যাদের সামর্থ্য নেই তারা কায়িক শ্রম দিয়ে সঙ্গে থাকবেন।

এ বছর লকডাউনের শুরুর দিন থেকে আমরা এ ফুডব্যাংক কার্যক্রম নতুন করে শুরু করি। আমরা এটির নাম দিয়েছি ‘মুক্তিগাঁথা ফুডব্যাংক’। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে মুস্টির চাউল সংগ্রহ করে ও সামর্থ্যবানদের সহায়তায় ছোট পরিসরে এ ফুডব্যাংকটি এখন এলাকার মানুষের অতি আপন হয়ে ওঠেছে। এমনকি অনেক সময় পাশের গ্রাম থেকে নদী সাঁতরে এখানে শিশুরা চলে আসে খাবারের সন্ধানে। ওদের মুখে কিছু খাবার তুলে দিতে পারলে ভালো লাগে। যদি না দিতে পারি মনে কষ্ট পাই। আর ভাবি প্রতিটি গ্রামে অপেক্ষাকৃত সামর্থ্যবানরা যদি একটু এগিয়ে আসতো। প্রয়োজনে আমি সেসব এলাকায় গিয়ে ফুডব্যাংক কার্যক্রম চালু করার প্রক্রিয়া দেখিয়ে দিতে পারতাম। আমি মনে করি এভাবেই পারস্পরিক যোগসূত্রেই আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে করোনা জয় করতে পারি। প্রতিদিন গড়ে এখানে প্রায় ১শ শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে। পরবর্তীতে যা আরও বৃহৎ পরিসরে করার ইচ্ছা আছে।

এ প্রসঙ্গে ‘মুক্তিগাঁথা ফুডব্যাংক’ থেকে খাদ্য সহায়তা প্রাপ্ত শিশু শান্ত, রাকিব, মিম, সামিয়া, লাবিবসহ একাধিক শিশু জানায়- বন্ধু আমাদের ছবি আঁকা শেখায়, বইপড়া-গান-কবিতা শেখায় আবার খেতেও দেয়। এতে আমরা খুব খুশি। বাড়িতে আমরা ভালো খাওয়া পাই না। কিন্তু এখানে ভালো খাবার পাই। এতে আমাদের খুব ভালো লাগে। এখানে আমাদের বাবা-ময়েরা রান্না করেন। আমরা সেগুলি প্যাকেট করে বাড়ি পৌঁছে দেই।

ফুডব্যাংক কর্মসূচিতে সহায়তাকারীদের অন্যতম সামাজিক সংগঠন মাগুরা ক্লাবের সদস্য অধ্যাপক কনক কান্তি সাহা জানান- মূলত মাগুরার যে কোন প্রান্তে অসহায় অস্বচ্ছল মানুষের পাশে দাঁড়াতেই আমাদের মাগুরা ক্লাবের জন্ম। এ ক্লাবের পক্ষ থেকে আমরা শিল্পী পান্নার মাধ্যমে অসহায় মানুষের পাশে থাকতে চেষ্টা করেছি। ভবিষ্যতেও তাদের পাশে থাকতে চাই।

কড়চাডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা সংগীত শিল্পী শুকুর আল মামুন জানান- করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। এ সময় গ্রামের শিশুরা অনেকটাই লাগামছাড়া চলাফেরা করতো। তাদের একটি কাঠামোর মধ্যে এনে নিয়মিত খেলাধুলা ও লেখাপড়ার পাশাপাশি খাবার প্রদান করছেন শিল্পী পান্না ও তার টিমের সদস্যরা। আমরা এ কর্মসূচিকে স্বাগত জানাই।

শনিবার, ০৮ মে ২০২১ , ২৬ বৈশাখ ১৪২৮ ২৬ রমজান ১৪৪২

একজন মাজু বিবি ও শিল্পী পান্নার মুক্তিগাঁথা ফুডব্যাংক

রূপক আইচ, মাগুরা

image

মাজু বিবি জানেন না তার বয়স কত? বলতে পারেন না একমাত্র ছেলের এমনকি নিজের নামটিও। হাঁটতে-চলতে পারেন না বহুদিন হলো। চোখেও তেমন দেখেন না। দরজা-জানালাবিহীন টিনের চালায় একাই থাকেন আশিতিপর এ বৃদ্ধা। কিন্তু একটি বিষয় শুধু বুঝতে পারেন। সেটি হলো পেটের ক্ষুধা। ঘরের মেঝেতে একটি পাটের চট বিছিয়ে বসে থাকেন মাজু বিবি।

কখন আসবে পান্না। কখন দেবে খাবার। কৈ গো মা জননী শব্দে ডাকতে ডাকতে পান্নার কন্ঠ শুনলেই তার চোখ চকচক করে ওঠে। প্রতিবন্ধী ছেলে শুকুর আলীর হতদরিদ্র সংসারে দুবেলা খেতে পাওয়া যখন অনিশ্চিত।

এ অবস্থায় দুবেলা খাবার অনিশ্চয়তা কিছুটা হলেও দূর করছে শিল্পী শামসুজ্জামান পান্নার উদ্যোগে গড়ে উঠা ফুডব্যাংক। গ্রামের কয়েকজন মানুষের কাছে খবর পেয়ে মাজু বিবির বাড়িতে প্রথম যেদিন খাবার নিয়ে হাজির হন চিত্রশিল্পী পান্না। কয়েক টুকরো মুরগির মাংসের সঙ্গে একটু তরকারি আর ভাতে যেন অমৃতের সন্ধান পান ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত বৃদ্ধা মাজু বিবি।

একইভাবে এ গ্রামের অসংখ্য দরিদ্র শিশু, প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধ মানুষ পান প্রতিদিন এক বেলা উন্নত খাবারের ব্যবস্থা। পান্নাকে স্থানীয় শিশুরা চেনে বন্ধু নামে। বৃদ্ধরা অনেকে তা বলেই ডাকেন। বন্ধুকে আসতে দেখলেই ওদের যত আনন্দ।

মাগুরা সদর উপজেলার চাউলিয়া ইউনিয়নের কড়চাডাঙ্গা পাড়ায় গত বছর থেকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র অসহায় পরিবারের শিশুদের জন্য একবেলা যথাসম্ভব উন্নত খাবার সরবরাহের জন্য মুক্তিগাঁথা ফুডব্যাংক কর্মসূচির মতো মানবিক কর্মসূচিতে হাত দেন শিল্পী পান্না। প্রথমে নিজের জমানো টাকা দিয়ে শুরু। এরপর তার মানবিক উদ্যোগে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় কিছু পরিচিত বন্ধু, মাগুরা শহরে প্রতিষ্ঠিত মাগুরা ক্লাব ও গ্রামের অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল মানুষরা।

শামসুজ্জামান পান্না জানান- গত বছরের শুরুতে করোনার সময়ে শহর বা শহরের আশপাশের অসহায় মানুষ কিছুটা সরকারি সহায়তা পেলেও গ্রামের মানুষরা অনেকটাই অবহেলিত ছিল বলে আমার চোখে পড়েছে। বাবা মা কর্মহীন হয়ে পড়ায় গ্রামের শিশুদের পুষ্টি চাহিদা অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এ অবস্থায় নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী শিশুদের পড়াশুনা, সুকুমার বৃত্তির পরিচর্যাসহ যতটুকু সম্ভব দরিদ্র শিশু ও বৃদ্ধদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।

গত বছর দুমাস একটানা ও পরবর্তীতে মাঝে মাঝে বন্ধুদের সহায়তায় এ খাবার সরবরাহ করি। সেখান থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতায় আমি মনে করি প্রতিটি এলাকায় শিশুদের জন্য একটি ফুডব্যাংক থাকা জরুরি। সেখানে গ্রামের সমর্থবান মানুষরা খাদ্য জমা রেখে অংশ নেবেন। আবার যাদের সামর্থ্য নেই তারা কায়িক শ্রম দিয়ে সঙ্গে থাকবেন।

এ বছর লকডাউনের শুরুর দিন থেকে আমরা এ ফুডব্যাংক কার্যক্রম নতুন করে শুরু করি। আমরা এটির নাম দিয়েছি ‘মুক্তিগাঁথা ফুডব্যাংক’। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে মুস্টির চাউল সংগ্রহ করে ও সামর্থ্যবানদের সহায়তায় ছোট পরিসরে এ ফুডব্যাংকটি এখন এলাকার মানুষের অতি আপন হয়ে ওঠেছে। এমনকি অনেক সময় পাশের গ্রাম থেকে নদী সাঁতরে এখানে শিশুরা চলে আসে খাবারের সন্ধানে। ওদের মুখে কিছু খাবার তুলে দিতে পারলে ভালো লাগে। যদি না দিতে পারি মনে কষ্ট পাই। আর ভাবি প্রতিটি গ্রামে অপেক্ষাকৃত সামর্থ্যবানরা যদি একটু এগিয়ে আসতো। প্রয়োজনে আমি সেসব এলাকায় গিয়ে ফুডব্যাংক কার্যক্রম চালু করার প্রক্রিয়া দেখিয়ে দিতে পারতাম। আমি মনে করি এভাবেই পারস্পরিক যোগসূত্রেই আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে করোনা জয় করতে পারি। প্রতিদিন গড়ে এখানে প্রায় ১শ শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে। পরবর্তীতে যা আরও বৃহৎ পরিসরে করার ইচ্ছা আছে।

এ প্রসঙ্গে ‘মুক্তিগাঁথা ফুডব্যাংক’ থেকে খাদ্য সহায়তা প্রাপ্ত শিশু শান্ত, রাকিব, মিম, সামিয়া, লাবিবসহ একাধিক শিশু জানায়- বন্ধু আমাদের ছবি আঁকা শেখায়, বইপড়া-গান-কবিতা শেখায় আবার খেতেও দেয়। এতে আমরা খুব খুশি। বাড়িতে আমরা ভালো খাওয়া পাই না। কিন্তু এখানে ভালো খাবার পাই। এতে আমাদের খুব ভালো লাগে। এখানে আমাদের বাবা-ময়েরা রান্না করেন। আমরা সেগুলি প্যাকেট করে বাড়ি পৌঁছে দেই।

ফুডব্যাংক কর্মসূচিতে সহায়তাকারীদের অন্যতম সামাজিক সংগঠন মাগুরা ক্লাবের সদস্য অধ্যাপক কনক কান্তি সাহা জানান- মূলত মাগুরার যে কোন প্রান্তে অসহায় অস্বচ্ছল মানুষের পাশে দাঁড়াতেই আমাদের মাগুরা ক্লাবের জন্ম। এ ক্লাবের পক্ষ থেকে আমরা শিল্পী পান্নার মাধ্যমে অসহায় মানুষের পাশে থাকতে চেষ্টা করেছি। ভবিষ্যতেও তাদের পাশে থাকতে চাই।

কড়চাডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা সংগীত শিল্পী শুকুর আল মামুন জানান- করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। এ সময় গ্রামের শিশুরা অনেকটাই লাগামছাড়া চলাফেরা করতো। তাদের একটি কাঠামোর মধ্যে এনে নিয়মিত খেলাধুলা ও লেখাপড়ার পাশাপাশি খাবার প্রদান করছেন শিল্পী পান্না ও তার টিমের সদস্যরা। আমরা এ কর্মসূচিকে স্বাগত জানাই।