অতিথি শূন্যতায় চট্টগ্রামের ৩৫ হাজার হোটেল কর্মচারীর মানবেতর জীবনযাপন

মহামারী করোনাভাইরাস ও লকডাউনে অতিথি শূন্যতায় চট্টগ্রাম মহানগরে দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসায় ক্ষতির মুখ দেখছেন আবাসিক হোটেলগুলো। করোনায় সৃষ্ট সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারও ব্যবসায় ধস নেমেছে। এ বছরের শুরুতে ব্যবসার ক্ষতি কিছুটা পুষে উঠতে পারার স্বপ্ন দেখলেও ব্যবসায়ীদের সেই আশা পূরণ ?হলো না।

হোটেল সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ব্যবসা প্রায় এক-তৃতীয়াংশে বা তারও কমে নেমে এসেছে। বিশেষ অফারেও গ্রাহক পাওয়া যাচ্ছে না। বিদেশি অতিথি ছাড়াও আগে মোটামুটি প্রায় সব হোটেলেই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসের আয়োজনও থাকতো, যা এখন পুরোপুরি বন্ধ।

চট্টগ্রাম আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির তথ্য মতে, চট্টগ্রাম শহরে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৫০টিরও বেশি আবাসিক হোটেল রয়েছে।

এসব হোটেলে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন ৩৫ হাজার কর্মচারী। ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসতেন এখানে। ফলে স্বাভাবিক সময়ে আবাসিক হোটেলগুলো লোকে পরিপূর্ণ থাকতো। সেখানে হোটেল ব্যবসা এখন ২০ শতাংশও নেই। অতিথি না থাকায় একেবারেই ফাঁকা হোটেলের লবি ও রুমগুলো। সামনে ঈদ। অথচ আর্থিক লোকসানের কারণে ঠিকমত কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না অনেকেই।

আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ফলে এখানে তারকা মানের হোটেলসহ আবাসিক হোটেলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু মহামারী করোনা কোনভাবেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। শিল্প প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট সব খোলা রয়েছে। তাদের ন্যূনতম ব্যবসা চলছে। কিন্তু পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ থাকা, বিদেশি অতিথিদের আনাগোনা কমে যাওয়া, সামাজিক ও ব্যবসায়িক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় আবাসিক হোটেল ব্যবসা লাটে ওঠার উপক্রম হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে একপ্রকার অনিশ্চয়তার মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এমনটাই জানালেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

এদিকে নগরের চার তারকা চিহ্নিত হোটেল পেনিনসুলায়ও বিরাজ করছে শুনশান নীরবতা। করোনার ভয়াল থাবায় এখানেও চলছে মন্দাভাব। হোটেল পেনিনসুলার অপারেশন ম্যানেজার রমেন দাশ গুপ্ত বলেন, আমাদের হোটেলটি বিদেশি অতিথি নির্ভর। করোনার কারণে পোশাক শিল্প, বায়িং হাউস, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিদেশি অতিথিরা এখন আসছেন না। ফলে আমাদের ব্যবসায় স্থবিরতা নেমে এসেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেস্ট ওয়েস্টার্ন এলায়েন্স হোটেলের এক কর্মচারী বলেন, ৮ হাজার টাকা বেতনে দিনে ৯ ঘণ্টা কাজ করি। কিন্তু করোনায় এখন ব্যবসা মন্দা। হোটেল কর্তৃপক্ষও বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। কারণ আমি তো একা না, আমার মতো অনেকেই এখানে কাজ করেন। সামনে ঈদ আসছে। কিভাবে খরচ জোগাড় করব বুঝতে পারছি না। ভাবছি এ চাকরি ছেড়ে ছোটখাটো ব্যবসা করব। কারণ এভাবে তো আর দিন চলে না।

চট্টগ্রামের পাঁচ তারকা হোটেল রেডিসন ব্লু’র কম্যুনিকেশন অফিসার রাহফাত সালমান আবির বলেন, করোনা তো আমাদের বছর জুড়েই কষ্ট দিচ্ছে, লোকসানে ফেলেছে।

লকডাউনের কারণে সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ, বিদেশি অতিথিরা আসছেন না তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায় মন্দাভাব তৈরি হয়েছে। আশা করছি সামনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সব মন্দাভাব কাটিয়ে ওঠতে পারব আমরা।

চট্টগ্রাম আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, লকডাউনে বিধি নিষেধের কারণে আবাসিক হোটেলগুলো বন্ধ রয়েছে। কিন্তু ওয়াসা, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল, ভ্যাট, সিটি করপোরেশনের ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স, কর্মচারীদের বেতন দেয়া বন্ধ নেই।

গতবছরও প্রায় তিন মাস বন্ধ থাকার পরও আমরা সব ধরনের সরকারি ফি পরিশোধ করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই খারাপ পরিস্থিতিতে আমরা কোন সরকারি সহায়তা পাইনি। তিনি আরও বলেন, এক বছরের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠতে না ওঠতেই আবারও করোনার থাবায় আমরা বিপর্যস্ত। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।

শনিবার, ০৮ মে ২০২১ , ২৬ বৈশাখ ১৪২৮ ২৬ রমজান ১৪৪২

করোনাকালে প্রান্তিকজন

অতিথি শূন্যতায় চট্টগ্রামের ৩৫ হাজার হোটেল কর্মচারীর মানবেতর জীবনযাপন

নিরুপম দাশগুপ্ত, চট্টগ্রাম ব্যুরো

মহামারী করোনাভাইরাস ও লকডাউনে অতিথি শূন্যতায় চট্টগ্রাম মহানগরে দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসায় ক্ষতির মুখ দেখছেন আবাসিক হোটেলগুলো। করোনায় সৃষ্ট সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারও ব্যবসায় ধস নেমেছে। এ বছরের শুরুতে ব্যবসার ক্ষতি কিছুটা পুষে উঠতে পারার স্বপ্ন দেখলেও ব্যবসায়ীদের সেই আশা পূরণ ?হলো না।

হোটেল সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ব্যবসা প্রায় এক-তৃতীয়াংশে বা তারও কমে নেমে এসেছে। বিশেষ অফারেও গ্রাহক পাওয়া যাচ্ছে না। বিদেশি অতিথি ছাড়াও আগে মোটামুটি প্রায় সব হোটেলেই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসের আয়োজনও থাকতো, যা এখন পুরোপুরি বন্ধ।

চট্টগ্রাম আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির তথ্য মতে, চট্টগ্রাম শহরে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৫০টিরও বেশি আবাসিক হোটেল রয়েছে।

এসব হোটেলে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন ৩৫ হাজার কর্মচারী। ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসতেন এখানে। ফলে স্বাভাবিক সময়ে আবাসিক হোটেলগুলো লোকে পরিপূর্ণ থাকতো। সেখানে হোটেল ব্যবসা এখন ২০ শতাংশও নেই। অতিথি না থাকায় একেবারেই ফাঁকা হোটেলের লবি ও রুমগুলো। সামনে ঈদ। অথচ আর্থিক লোকসানের কারণে ঠিকমত কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না অনেকেই।

আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ফলে এখানে তারকা মানের হোটেলসহ আবাসিক হোটেলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু মহামারী করোনা কোনভাবেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। শিল্প প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট সব খোলা রয়েছে। তাদের ন্যূনতম ব্যবসা চলছে। কিন্তু পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ থাকা, বিদেশি অতিথিদের আনাগোনা কমে যাওয়া, সামাজিক ও ব্যবসায়িক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় আবাসিক হোটেল ব্যবসা লাটে ওঠার উপক্রম হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে একপ্রকার অনিশ্চয়তার মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এমনটাই জানালেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

এদিকে নগরের চার তারকা চিহ্নিত হোটেল পেনিনসুলায়ও বিরাজ করছে শুনশান নীরবতা। করোনার ভয়াল থাবায় এখানেও চলছে মন্দাভাব। হোটেল পেনিনসুলার অপারেশন ম্যানেজার রমেন দাশ গুপ্ত বলেন, আমাদের হোটেলটি বিদেশি অতিথি নির্ভর। করোনার কারণে পোশাক শিল্প, বায়িং হাউস, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিদেশি অতিথিরা এখন আসছেন না। ফলে আমাদের ব্যবসায় স্থবিরতা নেমে এসেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেস্ট ওয়েস্টার্ন এলায়েন্স হোটেলের এক কর্মচারী বলেন, ৮ হাজার টাকা বেতনে দিনে ৯ ঘণ্টা কাজ করি। কিন্তু করোনায় এখন ব্যবসা মন্দা। হোটেল কর্তৃপক্ষও বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। কারণ আমি তো একা না, আমার মতো অনেকেই এখানে কাজ করেন। সামনে ঈদ আসছে। কিভাবে খরচ জোগাড় করব বুঝতে পারছি না। ভাবছি এ চাকরি ছেড়ে ছোটখাটো ব্যবসা করব। কারণ এভাবে তো আর দিন চলে না।

চট্টগ্রামের পাঁচ তারকা হোটেল রেডিসন ব্লু’র কম্যুনিকেশন অফিসার রাহফাত সালমান আবির বলেন, করোনা তো আমাদের বছর জুড়েই কষ্ট দিচ্ছে, লোকসানে ফেলেছে।

লকডাউনের কারণে সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ, বিদেশি অতিথিরা আসছেন না তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায় মন্দাভাব তৈরি হয়েছে। আশা করছি সামনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সব মন্দাভাব কাটিয়ে ওঠতে পারব আমরা।

চট্টগ্রাম আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, লকডাউনে বিধি নিষেধের কারণে আবাসিক হোটেলগুলো বন্ধ রয়েছে। কিন্তু ওয়াসা, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল, ভ্যাট, সিটি করপোরেশনের ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স, কর্মচারীদের বেতন দেয়া বন্ধ নেই।

গতবছরও প্রায় তিন মাস বন্ধ থাকার পরও আমরা সব ধরনের সরকারি ফি পরিশোধ করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই খারাপ পরিস্থিতিতে আমরা কোন সরকারি সহায়তা পাইনি। তিনি আরও বলেন, এক বছরের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠতে না ওঠতেই আবারও করোনার থাবায় আমরা বিপর্যস্ত। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।