অভিন্ন নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আমাদের পেতে হবে

আব্দুল মান্নান খান

মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং স্বাধীনতার স্থপতি মহান নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের কথা ছিল ২০২০ সালে। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। ১৯২০ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সালটিকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। কথা ছিল এ উপলক্ষে বিশ্বনেতারা ঢাকায় আসবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসবেন সঙ্গে ভারতের অন্যান্য শীর্ষ নেতারা আসবেন। অনুষ্ঠানাদি হবে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে। আমরা আশা করেছিলাম তিস্তাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি নিয়ে এবার ফলপ্রসূ একটা কিছু না হয়ে পারে না। ঠিক সেই মুহূর্তে কভিডÑ১৯ এসে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিল। স্থগিত হয়ে যায় সব আয়োজন।

এর এক বছর পরে এসে করোনা পরিস্থিতি অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসাতে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালার শুভসূচনা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হয় ২০২১ সালের ১৭ মার্চ। চলে মহান স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ পর্যন্ত। সবই ঠিকঠাক মতো হলো, শীর্ষ বৈঠকও অনুষ্ঠিত হলো। অনুষ্ঠান শেষে আমাদের পররাষ্ট্রমন্তী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানালেন, ‘তিস্তাসহ যৌথ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার ওপর বাংলাদেশের অধিকারের বিষয়টি বরাবরের মতোই জোরালোভাবেই উত্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চুক্তিটি দ্রুত স্বাক্ষরে ভারত আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং এ বিষয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি’ (দৈনিক সংবাদ, ২৮ মার্চ ২০২১)। পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে ‘তিস্তা সমস্যার দ্রুত সমাধানে ভারতের আশ্বাস’।

সেই একই কথা ‘আশ্বাস’। এদিকে বাংলাদেশের নদ-নদীর অবস্থা ওই আশ্বাসে আশ্বাসে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে তা সবাই দেখছেন। নয়ন ভরে দেখছেন। শুধু দেখছেন না মনে হয় তৃপ্তির সঙ্গে দেখছেন। কৃষি ফসলে ভরা নদ-নদী কি চমৎকার দেখাচ্ছে! আলু, পেঁয়াজ, ধান, পাটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সূর্যমুখি ফুল, চোখ আর ফেরে না! এর সঙ্গে কোথাও নদীর বুকে ছেলেরা ফুটবল খেলছে, কোথাও গরু-ছাগল চরছে আবার কোথাও গড়ে উঠছে বসতবাড়ি। দেখার মতো বিষয় তো বটেই।

এক সময় গঙ্গার পানি চুক্তির বিষয়টি জাতিসংঘে ওঠায় বাংলাদেশ। এনিয়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় ২০১৯ সালে বলেছিলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম উজান ও ভাটির দেশের ক্ষেত্রে অববাহিকা ব্যবস্থাপনায় সমান অধিকার থাকবে। কিন্তু তারা চাচ্ছিলেন এটার ওপর এককভাবে তাদের অধিকার থাকবে। তিনি বলেন, ভারতের অনেক প্রভাব আছে, অনেক বন্ধু আছে। গঙ্গার পানি চুক্তির বিষয়টি পরে জাতিসংঘে নিলে ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ভারত বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে কোন অধিবেশন করতে দেয়নি। পরবর্তী সময়ে আমরা বিষয়টি জাতিসংঘ থেকে প্রত্যাহার করি এবং দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করি। গঙ্গার বিষয়টি জাতিসংঘে নিয়ে আমাদের কোন লাভ হয়নি বরং ক্ষতি হয়েছে এবং এতে একটা বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল’ (ওই সময়ের পত্রপত্রিকা)।

এখন কথা হলো ভারতের এই মনোভাবের কোন পরিবর্তন ঘটেছে কি না। যদি না ঘটে থাকে তা হলে বলা যায় স্বাধীনতার ৫০ বছর কেন ৫০০ বছরেও কোন কাজ হবে না। সত্তর দশকে ভারত গঙ্গা নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করে যার নাম ফারাক্কা। পঁচাত্তর সালে ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষামূলকভাবে চালু করল ভারত। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধ নিহত হলেন নির্মমভাবে। তারপর সে পরীক্ষা আর শেষ হয় না। এর ফলে পদ্মা ও তার শাখা নদী উপনদীগুলো দ্রুত কীভাবে পরিবর্তন হয়ে গেল দেশের একটা অঞ্চলের ওপর তার প্রভাব কেমন ভয়ঙ্করভাবে পড়ল তা সবাই দেখল। এখনও দেখছে। পরে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি একটা হয়েছে কিন্তু পদ্মা-গড়াই-মধুমতির সেরূপ কতটা ফিরে এসেছে এবং অন্যান্য শাখা নদী উপনদীগুলোর নাব্যতা কতটুকু ফিরে এসেছে তাও সবাই দেখছে। সেদিন পত্রিকায় এসেছে, উজানে পানিপ্রবাহ কমে গেছে, দক্ষিণাঞ্চলে নদ-নদীর পানিতে লবণাক্ততা দ্বিগুণ বেড়েছে, পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা’ দৈনিক সংবাদ, ১১ এপ্রিল ২০২১। পত্রিকায় বলা হয়েছে, উজানে পানিপ্রবাহ হ্রাসের সঙ্গে বৃষ্টির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমেছে। সাগরের মাত্রাতিরিক্ত নোনা পানি উঠে এসে দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের মধ্যভাগের নদ-নদীর পানির লবণাক্ততা বেড়েছে। এতে মাত্রাতিরিক্ত নোনা পানি শুধু ফসলি জমিরই ক্ষতি করছে না, তা মৎস্য ও উপকূলীয় বনজ সম্পদের জন্যও হুমকি স্বরূপ। আশঙ্কা করা হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়ের’।

বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার বাংলাবান্দা সীমান্ত থেকে চোখে পড়ে মহানন্দা নদীর ওপর ভারতের নির্মিত সুউচ্চ বাঁধটি। তার সঙ্গে চোখে পড়ে এপাশে মহানন্দার ক্ষীণ ধারাটি। মনে হয় যেন ওর (মহানন্দার) চোখের জল বইছে এপারে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত পঞ্চাশের অথিক নদ-নদীর এপারের অবস্থা এখন ওই মহানন্দার এপারের ধারাটির মতোই হাপসি কাটছে। বলা হচ্ছে ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত পানির প্রবাহ আটকে দিয়েছে একতরফাভাবে। সে যা হোক, এসব নদ-নদীর নামের একটা তালিকা কখনো চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। আবার বাংলাদেশে নদ-নদীর সঠিক সংখ্যাটি কত তার হিসাবও নাকি পাওয়া যায় না বলে একদিন পত্রিকায় দেখেছি।

শুরুতেই একথাটা বলা দরকার ছিল যে, পানি বলেন, নদ-নদী বলেন কোন বিষয়েই আমার কোন বিশেষ লেখাপড়া নেই। নেই কোন বিশেষ জ্ঞান-গরিমা। লেখালেখিতেও তাই নেই কোন বিশেষ বিষয়, যা দেখি যা জানি যা সত্য বলে উপলব্ধি করি তার থেকেই কিছু লেখার চেষ্টা করি। জন্মেছি যশোরের এক অজপাড়াগাঁয়ে। দেখেছি নদী-খাল-বিল ভরা পানি। বিল-খালের স্বচ্ছ জল আঁচলা ভরে পান করেছি। ডোঙ্গায় চড়ে ‘কয়ে’ জাল আর ‘ঘুনি-বেনে’ পেতে মাছ ধরেছি। ডিঙ্গি নৌকায় বৈঠা বেয়ে হাটেবাজারে গিয়েছি। দেখেছি কত হাজার মনি নৌকার আসা-যাওয়া। দাঁড় বেয়ে গুণ টেনে উজানে চলেছে কত মাল বোঝাই নৌকা। পাল তোলা ছোট্ট টাবুরে নৌকায় কত সোয়ারি করেছে ওঠানামা। চিত্রা নদীর উজানে আমার বাড়ি। আমি চিত্রা পাড়ের মানুষ। ঠিক কেন জানি না আমার একটা গর্ব আছে ভেতরেÑ বলতেও ভালো লাগে, আমি চিত্রা পাড়ের মানুষ। হ্যাঁ, এটা না হয় হলো আমার আবেগপ্রসূত ভাবনা কিন্তু বাকিটা তো সজ্ঞানে স্বচক্ষে দেখা। সজ্ঞানে পায়ে হেঁটে চিত্রা পার হয়েছি এ কথায় তো কোন কল্পনা নেই। পরিবর্তন সৃষ্টির ধর্ম। হবেই। কিন্তু এ কেমন পরিবর্তন আমাদের নদ-নদী খালবিলের! এ কথা ঠিক বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাব রয়েছে। আবার এ কথাও ঠিক গাছাপালা ধ্বংস করে চাষ-বাস করে ভূমির ইরোশান ঘটিয়ে নদ-নদী ভরাট করে ফেলা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো উজানে ভারতের অংশে দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত অভিন্ন নদ-নদীর ওপর ভারত বাঁধ নির্মাণ করায় আমরা পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।

১৯৬৪ সালের কথা। সেই প্রথম যশোর থেকে ট্রেনে চড়ে গোয়ালন্দ ঘাটে এসে নেমেছিলাম। ট্রেন যেখানে থামল তার সন্নিকটেই দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে স্টিমার নামের বিশাল এক জিনিস। দাঁড়িয়ে আছে পদ্মা নদীতে। কি এক বিস্ময় নিয়ে জাহাজে গিয়ে উঠলাম। সন্ধ্যার আগে জাহাজ ছেড়ে দিল। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। এত বড় নদী! যশোরের মানুষ আমি। এত বড় নদী কল্পনাও করতে পারিনি আগে। ডেকে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে পদ্মাকে দেখেছিলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে। দেখেছিলাম রাতে ইলিশ ধরার মোহনীয় রূপ।

গোয়ালন্দের সেই ঘাট থেকে এখন কয়েক কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে দৌলতদিয়া ঘাটে আসা লাগে। যতবার আসি-যাই নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলি। দেখি রেললাইন বাড়িঘর আর দুই দিকে সবুজ গাছপালা ফসলের মাঠ।

১৯৯১ সালের কথা। কুচ্ছিা শহরের মিলগেট থেকে পায়ে হেঁটে গড়াই নদী পার হয়ে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। যে কুটিবাড়ি হৃদয়ে ধারণ করে সেদিন গিয়েছিলাম তা ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছিল। বার বার শুধু কবিগুরুর সেই পদ্মা-গড়াইয়ের কথা মনে হয়েছে। কবিগুরু যদি এ অবস্থা দেখতেন তা হলে কী অবস্থাটা না হতো! প্রমত্তা পদ্মায় ধূ ধূ করছে বালুচর। দেখে মাঝে মাঝে ভ্রম হতে পারে Ñও বুঝি পদ্মার ঘোলা জল। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ খালি খাঁচার মতো দাঁড়িয়ে আছে বালুচরে। এর শাখা নদী উপনদীর অবস্থার কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সালটা হবে ২০০৩-০৪। একদিন খুব ভোরে বাস থেকে নেমে রিকশা করে চিলমারির বন্দরে পৌঁছেছিলাম। গন্তব্য ছিল রৌমারি উপজেলা। দেখলাম ব্রহ্মপুত্র নদ। পার হয়ে যেতে হবে ওপারে। শুনলাম বেলা বাড়বে যাত্রীরা আসবে তারপর নৌকা ছাড়বে। পাড় থেকে অনেকখানি নিচে নেমে যেতে হলো পানির কাছে। তারপর চরের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হবে। ওপারে যেতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। আমার ইচ্ছা ছিল রৌমারি থেকে সেদিনই ফিরে আসার। অবস্থা দেখে সে আশা ত্যাগ করতে হলো। ছোট নৌকায় পার হলাম ব্রহ্মপুত্র । কখনো দুজন মাঝি কতক জায়গা টেনেও পার করে পথ সংক্ষেপ করে নিল। নদীর ভেতরে কোন কোন জায়গায় পুকুরের মতো পানি আবদ্ধ হয়ে আছে। মাঝে মাজেই এ রকম দৃশ্য। এটা শীত মৌসুমের শেষের দিকের কথা।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি শুকনা মৌসুমে ডিমলায় গিয়ে তিস্তা নদী দেখেছিলাম। এত বড় নদী কোথায় লঞ্চ-স্টিমার দেখব তা না দেখি নৌকাই চলে না। তখন শুধু ফারাক্কার কথাই ছিল মানুষের মুখে মুখে। এখন তিস্তাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বণ্টন নিয়ে যেভাবে আশ্বাসবাণী চলছে তাতে গঙ্গা-পদ্মার মতো করে চুক্তি হলেও তা সম্পন্ন হতে কত সময় যাবে তা কি কারও পক্ষে বলা সম্ভব। তবে এটুকু বলা যায় যে, তখন হয়তো নদ-নদী খুঁজে বের করতেই কমিশন গঠন করা লাগবে দুই বন্ধু দেশের মধ্যে।

তবে এ কথা সত্য যে, আমাদের এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করছে ভারতের ওপর। ভারত আমাদের বিপদের বন্ধু। একাত্তরের সারথী জন্মলগ্নের ধাত্রী। ভারতই প্রথম আমাদের করোনার প্রতিশেধক ৭০ লাখ ডোজ ঠিকা উপহার হিসেবে দিয়েছে। আরও দেবে। ভারত আমাদের প্রতি নির্দয় হতে পারে না। প্রয়োজন সমস্যাটি বারবার যথাযতভাবে তাদের কাছে উপস্থাপন করা। পানি বলে কথা, যার অপর নাম জীবন। বিষয়টি তাই কোনভাবেই আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না যুগের পরে যুগ। ভারতের সঙ্গে আমাদের সব দ্বারই খুলে গেছে, খোলেনি শুধু পানির খিলটি, যা এতদিনে মরিচা ধরে গেছে। গলদ আছে আমাদের ভেতর। আমরা পারছি না ভারতকে রাজি করাতে। অথচ পারতে আমাদের হবেই। কূটনীতির ঘোরপ্যাঁচে না পারলে হাত-পায়ে ধরে হলেও পারতে হবে। যে কোন মূল্যে আমাদের উজানের পানি পেতে হবে। নদ-নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট]

শনিবার, ০৮ মে ২০২১ , ২৬ বৈশাখ ১৪২৮ ২৬ রমজান ১৪৪২

অভিন্ন নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আমাদের পেতে হবে

আব্দুল মান্নান খান

image

মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং স্বাধীনতার স্থপতি মহান নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের কথা ছিল ২০২০ সালে। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। ১৯২০ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সালটিকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। কথা ছিল এ উপলক্ষে বিশ্বনেতারা ঢাকায় আসবেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসবেন সঙ্গে ভারতের অন্যান্য শীর্ষ নেতারা আসবেন। অনুষ্ঠানাদি হবে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে। আমরা আশা করেছিলাম তিস্তাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি নিয়ে এবার ফলপ্রসূ একটা কিছু না হয়ে পারে না। ঠিক সেই মুহূর্তে কভিডÑ১৯ এসে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিল। স্থগিত হয়ে যায় সব আয়োজন।

এর এক বছর পরে এসে করোনা পরিস্থিতি অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসাতে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালার শুভসূচনা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হয় ২০২১ সালের ১৭ মার্চ। চলে মহান স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ পর্যন্ত। সবই ঠিকঠাক মতো হলো, শীর্ষ বৈঠকও অনুষ্ঠিত হলো। অনুষ্ঠান শেষে আমাদের পররাষ্ট্রমন্তী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জানালেন, ‘তিস্তাসহ যৌথ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার ওপর বাংলাদেশের অধিকারের বিষয়টি বরাবরের মতোই জোরালোভাবেই উত্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চুক্তিটি দ্রুত স্বাক্ষরে ভারত আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং এ বিষয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি’ (দৈনিক সংবাদ, ২৮ মার্চ ২০২১)। পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে ‘তিস্তা সমস্যার দ্রুত সমাধানে ভারতের আশ্বাস’।

সেই একই কথা ‘আশ্বাস’। এদিকে বাংলাদেশের নদ-নদীর অবস্থা ওই আশ্বাসে আশ্বাসে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে তা সবাই দেখছেন। নয়ন ভরে দেখছেন। শুধু দেখছেন না মনে হয় তৃপ্তির সঙ্গে দেখছেন। কৃষি ফসলে ভরা নদ-নদী কি চমৎকার দেখাচ্ছে! আলু, পেঁয়াজ, ধান, পাটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সূর্যমুখি ফুল, চোখ আর ফেরে না! এর সঙ্গে কোথাও নদীর বুকে ছেলেরা ফুটবল খেলছে, কোথাও গরু-ছাগল চরছে আবার কোথাও গড়ে উঠছে বসতবাড়ি। দেখার মতো বিষয় তো বটেই।

এক সময় গঙ্গার পানি চুক্তির বিষয়টি জাতিসংঘে ওঠায় বাংলাদেশ। এনিয়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় ২০১৯ সালে বলেছিলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম উজান ও ভাটির দেশের ক্ষেত্রে অববাহিকা ব্যবস্থাপনায় সমান অধিকার থাকবে। কিন্তু তারা চাচ্ছিলেন এটার ওপর এককভাবে তাদের অধিকার থাকবে। তিনি বলেন, ভারতের অনেক প্রভাব আছে, অনেক বন্ধু আছে। গঙ্গার পানি চুক্তির বিষয়টি পরে জাতিসংঘে নিলে ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ভারত বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘে কোন অধিবেশন করতে দেয়নি। পরবর্তী সময়ে আমরা বিষয়টি জাতিসংঘ থেকে প্রত্যাহার করি এবং দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করি। গঙ্গার বিষয়টি জাতিসংঘে নিয়ে আমাদের কোন লাভ হয়নি বরং ক্ষতি হয়েছে এবং এতে একটা বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল’ (ওই সময়ের পত্রপত্রিকা)।

এখন কথা হলো ভারতের এই মনোভাবের কোন পরিবর্তন ঘটেছে কি না। যদি না ঘটে থাকে তা হলে বলা যায় স্বাধীনতার ৫০ বছর কেন ৫০০ বছরেও কোন কাজ হবে না। সত্তর দশকে ভারত গঙ্গা নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করে যার নাম ফারাক্কা। পঁচাত্তর সালে ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষামূলকভাবে চালু করল ভারত। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধ নিহত হলেন নির্মমভাবে। তারপর সে পরীক্ষা আর শেষ হয় না। এর ফলে পদ্মা ও তার শাখা নদী উপনদীগুলো দ্রুত কীভাবে পরিবর্তন হয়ে গেল দেশের একটা অঞ্চলের ওপর তার প্রভাব কেমন ভয়ঙ্করভাবে পড়ল তা সবাই দেখল। এখনও দেখছে। পরে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি একটা হয়েছে কিন্তু পদ্মা-গড়াই-মধুমতির সেরূপ কতটা ফিরে এসেছে এবং অন্যান্য শাখা নদী উপনদীগুলোর নাব্যতা কতটুকু ফিরে এসেছে তাও সবাই দেখছে। সেদিন পত্রিকায় এসেছে, উজানে পানিপ্রবাহ কমে গেছে, দক্ষিণাঞ্চলে নদ-নদীর পানিতে লবণাক্ততা দ্বিগুণ বেড়েছে, পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা’ দৈনিক সংবাদ, ১১ এপ্রিল ২০২১। পত্রিকায় বলা হয়েছে, উজানে পানিপ্রবাহ হ্রাসের সঙ্গে বৃষ্টির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমেছে। সাগরের মাত্রাতিরিক্ত নোনা পানি উঠে এসে দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের মধ্যভাগের নদ-নদীর পানির লবণাক্ততা বেড়েছে। এতে মাত্রাতিরিক্ত নোনা পানি শুধু ফসলি জমিরই ক্ষতি করছে না, তা মৎস্য ও উপকূলীয় বনজ সম্পদের জন্যও হুমকি স্বরূপ। আশঙ্কা করা হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়ের’।

বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার বাংলাবান্দা সীমান্ত থেকে চোখে পড়ে মহানন্দা নদীর ওপর ভারতের নির্মিত সুউচ্চ বাঁধটি। তার সঙ্গে চোখে পড়ে এপাশে মহানন্দার ক্ষীণ ধারাটি। মনে হয় যেন ওর (মহানন্দার) চোখের জল বইছে এপারে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত পঞ্চাশের অথিক নদ-নদীর এপারের অবস্থা এখন ওই মহানন্দার এপারের ধারাটির মতোই হাপসি কাটছে। বলা হচ্ছে ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত পানির প্রবাহ আটকে দিয়েছে একতরফাভাবে। সে যা হোক, এসব নদ-নদীর নামের একটা তালিকা কখনো চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। আবার বাংলাদেশে নদ-নদীর সঠিক সংখ্যাটি কত তার হিসাবও নাকি পাওয়া যায় না বলে একদিন পত্রিকায় দেখেছি।

শুরুতেই একথাটা বলা দরকার ছিল যে, পানি বলেন, নদ-নদী বলেন কোন বিষয়েই আমার কোন বিশেষ লেখাপড়া নেই। নেই কোন বিশেষ জ্ঞান-গরিমা। লেখালেখিতেও তাই নেই কোন বিশেষ বিষয়, যা দেখি যা জানি যা সত্য বলে উপলব্ধি করি তার থেকেই কিছু লেখার চেষ্টা করি। জন্মেছি যশোরের এক অজপাড়াগাঁয়ে। দেখেছি নদী-খাল-বিল ভরা পানি। বিল-খালের স্বচ্ছ জল আঁচলা ভরে পান করেছি। ডোঙ্গায় চড়ে ‘কয়ে’ জাল আর ‘ঘুনি-বেনে’ পেতে মাছ ধরেছি। ডিঙ্গি নৌকায় বৈঠা বেয়ে হাটেবাজারে গিয়েছি। দেখেছি কত হাজার মনি নৌকার আসা-যাওয়া। দাঁড় বেয়ে গুণ টেনে উজানে চলেছে কত মাল বোঝাই নৌকা। পাল তোলা ছোট্ট টাবুরে নৌকায় কত সোয়ারি করেছে ওঠানামা। চিত্রা নদীর উজানে আমার বাড়ি। আমি চিত্রা পাড়ের মানুষ। ঠিক কেন জানি না আমার একটা গর্ব আছে ভেতরেÑ বলতেও ভালো লাগে, আমি চিত্রা পাড়ের মানুষ। হ্যাঁ, এটা না হয় হলো আমার আবেগপ্রসূত ভাবনা কিন্তু বাকিটা তো সজ্ঞানে স্বচক্ষে দেখা। সজ্ঞানে পায়ে হেঁটে চিত্রা পার হয়েছি এ কথায় তো কোন কল্পনা নেই। পরিবর্তন সৃষ্টির ধর্ম। হবেই। কিন্তু এ কেমন পরিবর্তন আমাদের নদ-নদী খালবিলের! এ কথা ঠিক বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাব রয়েছে। আবার এ কথাও ঠিক গাছাপালা ধ্বংস করে চাষ-বাস করে ভূমির ইরোশান ঘটিয়ে নদ-নদী ভরাট করে ফেলা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো উজানে ভারতের অংশে দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত অভিন্ন নদ-নদীর ওপর ভারত বাঁধ নির্মাণ করায় আমরা পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।

১৯৬৪ সালের কথা। সেই প্রথম যশোর থেকে ট্রেনে চড়ে গোয়ালন্দ ঘাটে এসে নেমেছিলাম। ট্রেন যেখানে থামল তার সন্নিকটেই দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে স্টিমার নামের বিশাল এক জিনিস। দাঁড়িয়ে আছে পদ্মা নদীতে। কি এক বিস্ময় নিয়ে জাহাজে গিয়ে উঠলাম। সন্ধ্যার আগে জাহাজ ছেড়ে দিল। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। এত বড় নদী! যশোরের মানুষ আমি। এত বড় নদী কল্পনাও করতে পারিনি আগে। ডেকে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে পদ্মাকে দেখেছিলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে। দেখেছিলাম রাতে ইলিশ ধরার মোহনীয় রূপ।

গোয়ালন্দের সেই ঘাট থেকে এখন কয়েক কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে দৌলতদিয়া ঘাটে আসা লাগে। যতবার আসি-যাই নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলি। দেখি রেললাইন বাড়িঘর আর দুই দিকে সবুজ গাছপালা ফসলের মাঠ।

১৯৯১ সালের কথা। কুচ্ছিা শহরের মিলগেট থেকে পায়ে হেঁটে গড়াই নদী পার হয়ে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। যে কুটিবাড়ি হৃদয়ে ধারণ করে সেদিন গিয়েছিলাম তা ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছিল। বার বার শুধু কবিগুরুর সেই পদ্মা-গড়াইয়ের কথা মনে হয়েছে। কবিগুরু যদি এ অবস্থা দেখতেন তা হলে কী অবস্থাটা না হতো! প্রমত্তা পদ্মায় ধূ ধূ করছে বালুচর। দেখে মাঝে মাঝে ভ্রম হতে পারে Ñও বুঝি পদ্মার ঘোলা জল। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ খালি খাঁচার মতো দাঁড়িয়ে আছে বালুচরে। এর শাখা নদী উপনদীর অবস্থার কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সালটা হবে ২০০৩-০৪। একদিন খুব ভোরে বাস থেকে নেমে রিকশা করে চিলমারির বন্দরে পৌঁছেছিলাম। গন্তব্য ছিল রৌমারি উপজেলা। দেখলাম ব্রহ্মপুত্র নদ। পার হয়ে যেতে হবে ওপারে। শুনলাম বেলা বাড়বে যাত্রীরা আসবে তারপর নৌকা ছাড়বে। পাড় থেকে অনেকখানি নিচে নেমে যেতে হলো পানির কাছে। তারপর চরের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হবে। ওপারে যেতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। আমার ইচ্ছা ছিল রৌমারি থেকে সেদিনই ফিরে আসার। অবস্থা দেখে সে আশা ত্যাগ করতে হলো। ছোট নৌকায় পার হলাম ব্রহ্মপুত্র । কখনো দুজন মাঝি কতক জায়গা টেনেও পার করে পথ সংক্ষেপ করে নিল। নদীর ভেতরে কোন কোন জায়গায় পুকুরের মতো পানি আবদ্ধ হয়ে আছে। মাঝে মাজেই এ রকম দৃশ্য। এটা শীত মৌসুমের শেষের দিকের কথা।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি শুকনা মৌসুমে ডিমলায় গিয়ে তিস্তা নদী দেখেছিলাম। এত বড় নদী কোথায় লঞ্চ-স্টিমার দেখব তা না দেখি নৌকাই চলে না। তখন শুধু ফারাক্কার কথাই ছিল মানুষের মুখে মুখে। এখন তিস্তাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বণ্টন নিয়ে যেভাবে আশ্বাসবাণী চলছে তাতে গঙ্গা-পদ্মার মতো করে চুক্তি হলেও তা সম্পন্ন হতে কত সময় যাবে তা কি কারও পক্ষে বলা সম্ভব। তবে এটুকু বলা যায় যে, তখন হয়তো নদ-নদী খুঁজে বের করতেই কমিশন গঠন করা লাগবে দুই বন্ধু দেশের মধ্যে।

তবে এ কথা সত্য যে, আমাদের এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করছে ভারতের ওপর। ভারত আমাদের বিপদের বন্ধু। একাত্তরের সারথী জন্মলগ্নের ধাত্রী। ভারতই প্রথম আমাদের করোনার প্রতিশেধক ৭০ লাখ ডোজ ঠিকা উপহার হিসেবে দিয়েছে। আরও দেবে। ভারত আমাদের প্রতি নির্দয় হতে পারে না। প্রয়োজন সমস্যাটি বারবার যথাযতভাবে তাদের কাছে উপস্থাপন করা। পানি বলে কথা, যার অপর নাম জীবন। বিষয়টি তাই কোনভাবেই আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে চলতে পারে না যুগের পরে যুগ। ভারতের সঙ্গে আমাদের সব দ্বারই খুলে গেছে, খোলেনি শুধু পানির খিলটি, যা এতদিনে মরিচা ধরে গেছে। গলদ আছে আমাদের ভেতর। আমরা পারছি না ভারতকে রাজি করাতে। অথচ পারতে আমাদের হবেই। কূটনীতির ঘোরপ্যাঁচে না পারলে হাত-পায়ে ধরে হলেও পারতে হবে। যে কোন মূল্যে আমাদের উজানের পানি পেতে হবে। নদ-নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট]