মরণোত্তর মৃত্যুদিবস ও নৌকাকাণ্ড

মামুন হুসাইন

মানুষ মৃতদেহ থেকে কদাচিৎ দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন করে।

জুতো খুলে রকার-এ দোল খেতে-খেতে মনে হতেই পারে- উত্তেজিত হওয়ার উপাদান চারপাশে কী কম?- আর কেনো মৃতদেহের গল্পই আমাদের জানতে হবে সবাইকে?- আমাদের ভ্রমণ আছে, উত্তম সঙ্গ-আড্ডা আছে, সুপর্যাপ্ত শান্তি-স্বাধীনতা, চোখের জল, স্বচ্ছ ভূদৃশ্য, অলঙ্কারশাস্ত্র আছে, নুডুলস স্যুপ আছে, আর আছে কুকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়ার সবুজ-সূক্ষ্ম আনন্দ। আমাদের সময় ক্ষীণ হয়ে আসছে- অচ্ছ্যুত-কঙ্কাল-অক্ষরের কাগজ সবিস্তারে পাঠ করার অবকাশ এখন কম। কেউ টেক্সট করেছেন- এই লেখাটি আমি কখনো পড়তে চাই নি। ...কেউ জানিয়েছেন, হয়তো এই ছাইভস্ম লেখাটির জন্যই অপেক্ষা করেছি। অন্য এক ভাষ্যে : ...এই লেখাটি আগামী শীতে পাঠ করতে চাই। কারণ, লেখার পৃষ্ঠা, অনুভব হয়েছিল আয়না-সদৃশ- তুমি, আমি, এবং আমাদের মুখমণ্ডল ঐ আয়নার প্রতিফলিত হয়। ...এই লেখাটিই খুঁজছি, কারণ এ বিষয়েই এখন আমি কাজ করছি। অথবা স্থির হই- এই লেখাটি পাঠ করবো, করোনা-বিঘটন সমাপ্তির পর একখণ্ড নৌকাকাণ্ড ও মরণোত্তর জলকাহিনী হিসেবে। এমন কী হতে পারে, এর প্রথম বাক্য সামান্য উৎসাহ তৈরি করলেও, পরবর্তী বাক্যসমূহ এত হতাশ করে যে- বুক সেল্ফের গভীর কাটাছেঁড়া-ময়লার ভেতর ঘৃণা ও প্রত্যাশাসহ তক্ষনি জলন্ত আগুনের গন্ধ মনে রেখে ছুঁড়ে দিলাম? [...মানুষ মৃতদেহ থেকে কদাচিৎ দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন করে]। মানুষ ভবিষ্যৎ, অতীত ও নীরবতা বিষয়ে নিচু গলায় কথা বলে। মানুষ নথিপত্রের সংকেত-লিপি খোঁজে, প্রণোদিত হয় এবং আবারও নিরুপায় হয়ে ভবিষ্যৎ শব্দটি উচ্চারণ করে গভীর তৃষ্ণায় : ফলে ভবিষ্যত শব্দটি অতীত হয় এবং অচিরেই নীরবতা ধ্বংস হয়।

তোমাদের নীরব-অতীত পাড়াগাঁয়ে, পূর্বকথিত মৃতদেহ তৈরির আগে, ধরা যাক স্বল্প-পরিচিত লোকটির নাম নজিবর রহমান- নজিবর রহমানের নিকট আত্মীয় কেউ মিষ্টান্ন প্রস্তুত করতেন, কিন্তু মিষ্টান্ন-বাণিজ্য ক্ষীণ হওয়ায় তিনি গ্রামে ফিরে যান, অথবা জীবন-জীবিকার প্রহারে নৌকা হয়ে, কমিউটার ট্রেন হয়ে, আমৃত্যু শহর-গাঁ করেন- আর এই পরিবারের দূরবর্তী কেউ, যার নাম হয়- মোমেনা খাতুন, যিনি অনেক দিন পর ২০ জুন, ২০২০ কোভিড-১৯ নামক বিপুল এক বৈশ্বিক-অদৃশ্য-বিচূর্ণন প্রক্রিয়ায় বিচেতন হন এবং মৃত্যু নামক বিচ্ছিত্তি গ্রহণ করেন। জনাব নজিবর রহমান, এই পরিবারে প্রথম একটি গ্রন্থ রচনা করেন নৌকা বিষয়ে- তিনি মেয়েটিকে চিনতেন, কিছুদিন তার গৃহে আশ্র্রিতা ছিল; এর অর্থ এই নয় যে, এই মেয়েটিও লিখতে অনুপ্রাণিত হলো; মেয়েটি তাদের জন্য দুপুরের খাবার প্রস্তুত করতো এবং একবার সদ্য প্রস্তুতকৃত কফি নৌকাণ্ডবিষয়ক পাণ্ডুলিপির ২২ নং পৃষ্ঠায় ছিঁটকে ফেলে আচমকা- সেদিন ছিল ২২শে জুন ১৯১৭; ...মেয়েটির মৃত্যু হয় ২২শে জুন ২০২০! এটি কোনো নালিশ নয়- আর কে না জানে, কোনো সকাল-দুপুর আগের সকাল দুপুরের মতো হয় না, চোখের দৃষ্টিও একই রকম হয় না, ...কোনো কিছুই দ্বিতীয়বার হয় না; তোমরা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলেও, আসলে এক অপ্রয়োজনীয় ভয়ের সাথেই বসবাস করছিলে। মেয়েটি ১৯১৭-এর জুলাই-আগস্ট, নজিবর রহমানের গৃহত্যাগ করে, অথবা গার্হস্থ্য-সন্দিগ্ধতা তাকে গৃহচ্যুত করে; মেয়েটি ২২, আলমগঞ্জ লেন থেকে একটি গ্রন্থ ক্রয় করে এবং চাকুরির পরীক্ষায় প্রস্তুতির সূত্রে অবহিত হয়- গার্মেন্টসের সেকশান প্রধানত তিনটি- কাটিং, সুইং ও ফিনিসিং। মেয়েটি এখানে নাম অন্তর্ভুক্ত করে এবং ওভার লক মেশিনে প্রতি ইঞ্চি সেলাইয়ে কী পরিমাণ সুতা লাগে সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করে। মেয়েটি একদিন, ফেব্রুয়ারি শেষ-শেষ, ২০২০ সাল- ...সূর্য দেখার মতো জনৈক বায়ার-এর সুগন্ধ ত্বক এবং ত্বক ছিন্ন করে ভেসে ওঠা সুঘ্রাণ দেখতে দেখতে কতিপয় পাইলট-সার্টের ছবি বিস্মৃত হয়। এরকম মুহূর্তে কোয়ালিটি কন্ট্রোল দপ্তর থেকে সে বকুনি খায়, আর হঠাৎ-ই শোনে- সন্ধ্যা-সন্ধ্যায় সব গার্মেন্টস অদৃশ্য এক বৈশ্বিক মারীর সম্ভাবনায় বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। মেয়েটি গৃহ-অভিমুখি হয়, স্বেচ্ছা অন্তরীণ হয় কিছুকাল, তারপর চাকুরি রক্ষার্থে বাধ্যতামূলক ফিরে আসে, পুলিশী তাণ্ডবে গার্মেন্টসের দোরগোড়া থেকে আবার উন্মূল হয়, গৃহ-অভিমুখি হয় নবপর্যায়ে, আবার ফিরে আসে...; তারপর ঘরে-বাইরের অতল-মিথষ্ক্রিয়ায় সে জ্বর-জ্বর ঘোরের ভেতর, নিঃশ্বাস ক্ষীণ হতে-হতে প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলে চিরকালের মতো এবং দ্রুত নিক্ষিপ্ত হয় ২২শে জুন ২০২০-এর গরম-ভ্যাপসা বিষ্টি-বিষ্টি এক দমবন্ধ ঘূর্ণিপাকে।

তোমাদের গাঁ-ঘরের মানুষেরা এই প্রকার মৃতদেহ থেকে কদাচিৎ দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন করে; প্রকারন্তরে অসময়-মৃত্যুর আলিঙ্গনে মোড়ানো এই দেহ আমাদের ভেতর অতিশয় এক অলাতচক্রের অঙ্গার ছড়িয়ে প্রশস্ত দুঃখী-চোখ খুলে রাখে নিশ্চিন্তে। আমাদের অভ্যাসের শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ে ঘাড়ের উপর; অনুভব হয়- বিন্দুবিন্দু ঘাম, সহজপাঠ্য-শিলালিপি, দুর্বোধ্য জীবন ও নীরবতার সারাংশ। অ-শরণা মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে নজিবর রহমান ভাবলেন, এটা ছিল অলিখিত এক ক্ষণস্থায়ী মর্মন্তুদ বিয়োগ কাহিনীই বটে! আমরা কী তবে দিনশেষে, অচেনা বৃক্ষের অচেনা ছায়া হয়ে, ক্ষুধা-তৃষ্ণার প্রতীক্ষা পেরিয়ে নিপুণ-নির্ধারিত এক সমাপণ মাত্র? লোকটি পাখা ঝাপ্টায়, স্মৃতি ঝাকায় এবং পতপত কাঁপতে থাকে- মৃত বেড়ালকে শাস্তি দিয়ে কী লাভ? ...কোনো কিছুই তো নেই আগের মতো। কফির দাগপড়া পাণ্ডুলিপির ২২ নং পৃষ্ঠায় সে দৃষ্টি ঘষে- পদধ্বনি শোনার মতো। কোথাও কী লুকিয়ে ছিলাম আমরা? কেন এতসব অজ্ঞাতবাস? চারপাশে এত এত বৃত্তান্ত, অগ্নিস্রোত, মর্মবেদনা এবং বীভৎস ধারাবিবরণী- কিন্তু সংকীর্ণ আকাক্সক্ষায়-কৌতূহলে, স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় নৌকাণ্ডবিষয়ক একটি অনুদ্দিষ্ট-নিরর্থ গ্রন্থ-রচনায় কেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠি? পরাজিত মনের প্রদাহ এড়াতে আমি তবে অত্যধিক কিছু আশা করে ছিলাম? নিজের জন্য অদৃশ্য হওয়া- কৌশলটি খুব খারাপ নয়। নৌকা সম্পর্কিত লেখক নজিবর রহমান মৃতদেহ চাক্ষুষের মতো গ্রন্থের পৃষ্ঠা উল্টায়- ...এই বই নির্মাণে, রপ্তানিযোগ্য পোশাকের গায়ে প্রতিস্থাপিত মেইন লেবেল ও সাব-লেবেল পৃথককারী একদা গৃহপরিচারিকা-কন্যার অদৃশ্য নিঃশ্বাস ও আঙুল ছুঁয়ে আছে। অনেকদিন আগে যখন সে গৃহপরিচারিকা- খাদ্য প্রস্তুতিতে বিভ্রাট প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহিণীর লাগাতার বকুনিতে যখন আত্মহননের ইচ্ছে প্রকাশ করে, তখন নজিবর রহমান, এক আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে, তার মাথায় হাত রাখে মৃদু-প্রসন্ন-সংবেদনশীলতায়। সামান্য নরম হয়ে যাওয়া শাড়ি পরিহিত মেয়েটি পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ ছড়িয়ে দাঁড়ায় : তার আঙুল এবং আমাদের আঙুল মাতৃভাষা লোভী হয়ে উঠে; আঙুল শিরা-উপশিরার মতো নদীমাতৃক হয়, তারপর তারা বৃক্ষ শাখা হয়, ছায়ামূর্তি হয়, মানব-সন্তান হয় এবং ভাষা-অস্পষ্ট লেখক হয়; শরীরে-গলায়-পিঠে-চিবুকে আঙুল বুলিয়ে এবার তারা প্রলয়কালের আলপথ বেয়ে গোপন স্থগিতাদেশ লেখে- ফলশ্রুতিতে রচিত হয়, কতিপয় দুঃখের কথা, বাবার অপমৃত্যুর কথা, ইংরেজি মাস্টারের সঙ্গে কানাইবাবুর স্ত্রী-পলায়নের ইতিবৃত্ত ও হঠাৎ আঙুল কেটে রক্ত বেরুনোর কথা। নজিবর রহমান নৌকা-বই তৈরির সময়, আজ এই হঠাৎ অখণ্ড শোকদিবসের কিনারায় দাঁড়িয়ে ভাবছিল- মোমেনা খাতুন নামে সদ্যমৃত মেয়েটির কতিপয় দৃশ্যাবলি অগোচরে অতল-নিরাময় হিসেবে সেদিন সে এত অনুকূল উপযুক্তিতে গ্রহণ করেছিল কেন? নৌকা বিষয়ক পাণ্ডুলিপির ২২নং পৃষ্ঠায় মেয়েটি কালো-কফির দাগ ঘষে দিলেও, হতে পারে কিছুকিছু রেফারেন্স বই ওর ঈষৎ নরম-পাড়ের শাড়ি ঘষে ময়লা মুক্ত করেছিল। হতে পারে তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কয়েকটি দিন স্নানের জল গরম করে দিয়েছিল। অথবা উড়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির সোনালি ডালার চিল-প্রকল্প স্থগিত পূর্বক পৃষ্ঠাসমূহ সংরক্ষণ করেছিল বন্ধ-টেবিল ওয়াচ-এ তৈরি পেপার ওয়েটে; আর কখনো কখনো শুধুই দাঁড়িয়ে থাকত শুভাকাক্সক্ষার দূর কল্পলোকে- কুয়াশা, অশ্রুজল ও নিচু জাতের গন্ধ নিয়ে। নিচু জাতের মেয়েরা কী বৃক্ষ ও আকাশ জুড়ে গরম ভাতের মায়া ছড়িয়ে কথা বলতে সক্ষম? [...ক্যান সাব অল্টার্ন স্পিক?] নিচু জাতের মেয়েরা পানপরাগের খালি কৌটা ওয়েস্টবিনে ফেলার সময় বইয়ের অক্ষর বুঝতে পারে? নজিবর রহমান লিখতে লিখতে কখনো ঘুমায়। নৌকা বিষয়ক অক্ষরপুঞ্জি নিদ্রাচালিত পারিবারিক ধুলোবালিতে স্কুলব্যাগ গোছায়, হিংস্র হয় এবং মাতাল হয়। নৌকার অক্ষর সমূহ নৈর্ঋত পেরিয়ে রেস্তোঁরায় যায়, তুলসিপাতা চিবোয়, বাস ভর্তি বালক-বালিকা হয়, পৃথিবীহীন হয় এবং নেচেনেচে ফড়িং ধরে। নজিবর রহমান নৌকার প্রকারভেদ করে এবং একটি মেয়ে কীভাবে যুগপৎ সাধারণ ও অসাধারণ হয়- তার ঠিকুজি খুঁজতে হন্যে হয়। দেখা গেল : সাবানজলে নতুন কাপড় এবং পুরনো কাপড় গলাগলি হয়ে অনেকখানি রঙ আদান প্রদান করায়, গৃহপরিচারিকা আবার একদিন জ্ঞানশূন্য ক্রুদ্ধতার ভেতর আটক হয়েছে। মেয়েটি কি ক্ষমতার ভাষা বুঝতে পারে? নৌকার পাণ্ডুলিপি থেকে অব্যবহৃত ঝর্না কলম গড়িয়ে গড়িয়ে স্থির হয় অপর বইয়ের গায়ে- সাধারণ ও অসাধারণ মেয়ে বুঝবার কোনো স্থির-ছলনাহীন মাপকাঠি জানা আছে তোমাদের? তোমাকেই জিজ্ঞেস করি- একজন কি দুটি মানুষকে একসঙ্গে ভালবাসতে পারে? একত্রে দুজনকে ধাক্কা দিতে পারে? বা দুজনের সঙ্গেই একত্রে শত্রুতা উদ্যাপন করতে? প্রবল জ্বরে শয্যশায়ী হলে, কেউ যদি এ্র্যানালজেসিক খুলে দেয়, সে কি অসাধারণ মেয়ে হয়? অসাধারণ মেয়েরা [আমাদের স্বার্থে বলি] অপরের জন্য মৃত্যুবরণ করে, নিঃসঙ্গ হয় এবং খুন হয়? অসাধারণ মেয়েরা সারাদিন চুলার পাশে ছাই হয় এবং আগুন স্নানে লিপ্ত থাকে। অসাধারণ মেয়েরা খাদ্য ও স্নানের চিরায়ত শুদ্ধ সময় নিয়ে কর্তাদের সামনে তর্ক করে না। অসাধারণ মেয়েরা বাপের-মায়ের ওষুধ সংগ্রহের জন্য যেকোনো নিষিদ্ধ হোটেলে রাত্রিযাপন করে ভোর-ভোর ঘরে ফেরে। অসাধারণ মেয়েরা ঘরে ফেরে, শরীরে আঘাতের চিহ্ন আঁকে, বাসন মাজে, রুটি বানায়, মশারি গোছায় এবং রান্নাঘরের ঝুল কালি মোছে পুরনো পেটিকোটে। বলা যায়- ২০শে জুন ২০২০-এ উৎপাদিত- একদা গৃহচ্যুত পরিচারিকার অপ্রস্তুত মৃত্যু সংবাদ অবহিত হয়ে নৌকা বিষয়ক গ্রন্থ প্রণেতা নজিবর রহমান, অনেক বছর আগের কতিপয় গোধূলি-দিন-রাতে এইভাবে সমর্পিত হয়েছিল। গতজীবনে অকিঞ্চিৎ এই বই লেখার জন্য কত রাত বাড়ি ফিরি নি, পত্রিকায় সামান্য একটি মফস্বল সংবাদ প্রেরণের জন্য শিশুপুত্র হত্যাকারী সদ্যধৃত মায়ের আদল দেখতে থানার সামনে দাঁড়িয়েছি, দিঘির জল দেখেছি, খড়কুটো যোগাড় করেছি, শাপ-শাপান্ত করেছি, প্রতিপক্ষ হয়েছি, তিস্তা-গঙ্গা করেছি, প্রহসন করেছি, সাইকেল চড়েছি, আর একটি গরিব মেয়েকে নিবর্তন থেকে রক্ষা করার জন্য ভ্রষ্ট প্রমাণিত হয়েছি- ...এর অর্থ শরীরে-বুকে বিবিধ আঘাত ও ব্যথার জগত; ব্যথায়-আঘাতে গলায় কালশিটে দাগ পড়ে এবং চোখের নিচে সাতটি দীর্ঘ-মলিন-নির্বান্ধব সেলাই। নৌকা বিষয়ক বই আড়াল করে, কখনো কি গরিবের ঈশ্বর নিয়ে জার্নাল করার বুদ্ধি এসেছিল? চোখের নিচে সেলাইয়ের আত্মবিশ্বাসী দাগ নিয়ে, মনে হয়েছিল- স্বর্গরাজ্য একটি মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে- ছোট ছোট মিথ্যা, ছোট ছোট ঘর এবং ছাদ- ছাদের দুইপাশ দিয়ে দুই মিথ্যা- সাদা মিথ্যা এবং কালো মিথ্যা! [তুমি দার্শনিক হওয়ার লোভে পড়েছ- ...এনাফ ফিলোসোফাইজিং...; খেয়াল কর যেন ঠাণ্ডায় না পড়ো]।

এরকম, এক শীত-শীত ঠাণ্ডায় গরিব মেয়েটি, গরিবের ঈশ্বর খোঁজার জন্য, গার্মেন্টস প্রশিক্ষণে নাম অন্তর্ভুক্ত করে, পুরনো শাড়ি-ব্যাগে টুকিটাকি জড়ো করে এবং পরিত্যক্ত স্টেডিয়ামের গা-ঘেঁষে টেনিস কোর্ট পেরিয়ে নতুন ঘর-বাড়িতে পৌঁছায়। অপর মানুষের এই প্রকার গৃহত্যাগ পর্যবেক্ষণ শেষে, নজিবর রহমান, জানালা বন্ধের সময় দূরের জামরুল গাছে মৌচাক আন্দাজ করলো। কলতলা থেকে কথা আসে- এই কয়টা থালা বাসন নিজেরা মাজতে পারো না? নজিবর রহমান, মিছেমিছি টর্চ ঠিক করে, বিনুনি খুলতে দেখে মেয়ের, আর ছিপছিপে ঘাসের ভেতর ফড়িং ও বিধবা রেনু কাকীর সাদা শাড়ির মেঘ দেখে অন্য উপকথায় জড়িয়ে যায়; হয়তো বলে, জানেন তো, সময় হলো তিন রকম- বেলা-অবেলা-কালবেলা! জগৎ-প্রান্তর জুড়ে কত বৃহৎ আকাশ, মাটি, পাহাড়, নদী- ...আর কী তীব্র ক্ষুদ্র হয়ে বেঁচে থাকা। নৌকা বিষয়ক গ্রন্থ প্রণেতা নজিবর রহমান, লেখার কালে- নদীর ভেতর জ্যোৎস্না, দূর প্রতিবেশীর গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠানে সমবেত ছায়াচ্ছন্ন-মদ্দা সমষ্টি, উদ্ভট্টি আলোকসামান্য ছোট ষড়যন্ত্র, এবং ব্রাহ্ম-মুহূর্ত উদ্যাপন দেখে বেলা-অবেলা-কালবেলার স্রোতে- লোকেরা নদীর মাঝখানে মদের বোতল খুলছে, শাড়ি-ব্লাউজের সেফটিপিন খুলে কেউ ডুব দিচ্ছে, অন্য নৌকায় বিচুলি আর নৌকার পাড় জুড়ে সীমান্ত রক্ষীদের তীব্র আলো। কে জানে, এইরকম কতিপয় নদী এবং নৌকার ছবিসমূহ সংগ্রহ করেই নজিবর রহমান হয়তো নৌকা বিষয়ক গ্রন্থ সৃষ্টির দখলি স্বত্বে আগ্রহশীল হয়- বলা যায় এই প্রকার অন্যমনস্কতা ও ভাবুকতায়- এক ফাঁকে হয়তো ধানের ক্ষেত দেখে, স্রোতে ডুবে যাওয়া ভাতের হাঁড়ি দেখে, নিজেকে ক্ষুধার্ত করে এবং শেষমেশ তৈরি করে এক নির্জন লেখার টেবিল- যে টেবিলে কালো কফি স্থাপনের সময় নৌকা বিষয়ক ম্যানুস্ক্রিপ্টের ২২নং পৃষ্ঠায় বাদামি দাগ ছড়িয়ে দেয় অকালমৃত সেই গৃহপারিচারিকা। নজিবর রহমান সামান্য ময়লা হয়ে যাওয়া ম্যানুস্ক্রিপ্টের, অনন্ত-কালক্রম পর্যবেক্ষণের অনুমতি পাঠায় নিজের কাছে। [ঈশ্বর তার মনস্কামনা পূর্ণ করে] : ...অনেক দিন অবধি সকল জ্ঞান গোপন করে, একটি নির্মিয়মাণ গ্রন্থের সম্মানে আরোগ্যহীন-জনশূন্য কাগজ-কলমে আয়ুষ্কাল ক্ষয় করতে হয়েছে : ...একবারই বেপরোয়া হয়েছিলাম টানা চারদিন। তারপর নিজের দোষে, নিজের মুদ্রাদোষে অনন্যোপায় হয়ে নজিবর রহমান নৌকা-রচনা লিখে চলে। ...নৌকার সঙ্গে অনেক মানুষ যুক্ত থাকে- নৌকার চালক, নৌকার মালিক, ঠিকাদার, মাঝি ইত্যাদি; সব নৌকার নাম তুমি জান না। বরিশালের নৌকা, কুমিল্লার নৌকা এবং ময়মনসিংহের নৌকা এক নয়। ঢাকার নৌকাও আলাদা নামের- ঘাসি/ কোশা/ রপ্তানি/ : কোনো নৌকায় ফল, কোনো নৌকায় পাট, ধান, কৃষি সরঞ্জাম, ...আবার বালি বহনের নৌকা খানিকটা আলাদা বটে। নদী এবং নৌকা, ধরা যাক- এইভাবে অন্তত এক অপ্রবীণ-অনাদি ছবি নির্মাণ করে একদিন এবং জলের শরীরে তা প্রক্ষেপণ করে : পাল তুলে যাওয়া নৌকার নাম দিন, জালি। লবণপূর্ণ এই নৌকাটি দেখবেন কক্সবাজারে। এই নৌকাটির গলুই এবং হাল চামচের মতো। আপনাদের পাশের ঘাটে নৌকা থেকে কাঠ সরানো হচ্ছে। নৌকায় মাটির হাঁড়িও অনেক সময় বহন করা হয়। ডুবে-ডুবে বালি তোলা হয়, ...এরকম নৌকা চোখে পড়েছে কখনো? দেখবেন নৌকার ভেতর অন্য এক বিপুল বাজার-ব্যবস্থা লুকিয়ে থাকে। যদি এই নৌকাটি পাট বহন করে, তবে আপনি পাবেন- মাঝি, ফড়িয়া, বেপারী, আড়তদার এবং পাটকলের এজেন্ট; যদি নৌকাটি ইটভাটার কাজে ব্যবহৃত হয়- তবে নৌকায় কখনো মাটি, কখনো কয়লা, কখনো ফার্নেসওয়েল, কখনো জ্বালানি কাঠ বহন করা হয়। বলা যায়- নৌকা বর্ণনা এইভাবে আবশ্যক-অনাবশ্যক ভবিতব্যের দিকে ধাবিত হয়, ভেতর-বাইরে সমান্তরাল হয়, সংকুচিত হয়, পরিব্যাপ্ত হয়, কৃশ হয় এবং চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। নৌকা বর্ণনা শেষ হলে, নজিবর রহমান অতঃপর জলের স্তর ক্ষীণ হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে একটি পরিচ্ছেদ লেখে- পত্রিকা অফিস এবং বিআইডব্লুটিএ তার বক্তব্যের সাক্ষ্যদাতা হয় : ...নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহীর প্রায় চার লাখ একর জমিতে বর্তমানে বোরো ও গম চাষের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে, ...পদ্মার সকল শাখা এখন জলশূন্য। ড্রেজিং কি সমাধান? নজিবর রহমান লেখে, অন্তত ছয় ফিট গভীরতা চাই সর্বত্র- ঢাকা-বরিশাল-চাঁদপুর-আড়িয়ালখাঁ/ খুলনা-কালিগঞ্জ সীমান্ত/ নারায়ণগঞ্জ-লাখপুর/ চাঁদপুর-আরিচা/ আরিচা-বাহাদুরাবাদ/ চাঁদপুর-ভৈরব/ ভৈরব-ছাতক/ ভৈরব-ফেঞ্চুগঞ্জ /কুষ্টিয়া-খুলনা- ...এই বিস্তীর্ণ জলরাশি সচল রাখার দায় কার? অন্তত ৫৮টি নদীর উৎসমুখ ভারত-বাংলাদেশের জন্য অভিন্ন! আমাদের নৌকাসমূহ উজান-ভাটিতে চলাচলের সুবিধা বারোমাস সমানভাবে পায় না : যেমন- আশ্বিনে উজানযাত্রা কষ্টকর, ভাটাতে যাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ; অগ্রহায়ণে উজানে অসুবিধা, ভাটিতে সুবিধে; বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে উজানযাত্রা মধ্যম মানের, ভাটিতে কষ্ট তীব্রতর; পৌষ থেকে চৈত্র উজান-ভাটি, দুইটিই সুবিধাজনক। আবার আষাঢ়-শ্রাবণ, পুরো মাসই নৌকা ভাসান অনেক সহজ। নজিবর রহমান বিশেষজ্ঞদের বই থেকে সমাধান লেখার চেষ্টা করে : ছোট নোটস্ ছিল, খুঁজে পেতে অসুবিধে হচ্ছে; স্বরুপকাঠিতে ৫০০ মণী নৌকা তৈরিতে কাঠের পরিমাণ কত ছিল? অকালমৃত গৃহপরিচারিকা, অনেকদিন আগে ওয়েস্টবিন থেকে রকমারি নৌকার একটি-দুটি উড়ে যাওয়া ফটোগ্রাফ কুড়িয়ে নজিবুর রহমানকে চমৎকৃত করে- বাঘাবাড়ি, কাপাশিয়া এবং বেড়া থেকে সংগৃহীত নৌকার ছবি : একটি ছবির পেছনে পেন্সিলে আলতো লেখা- স্বরুপকাঠিতে তৈরি নৌকার বিবরণ।

নদী-বিষয়ক এই পাণ্ডুলিপি স্পর্শে নজিবর রহমান কখনো, এজন্যও বাড়তি সময় সঞ্চয় করে- ২০শে জুন, ২০২০-এ অকালমৃত গৃহপরিচারিকাকে ভেবে। এই বাবু শহরে লোকেরা- গেঞ্জি খুলে, বাথরুমে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ হয়ে সাবান মাখে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিবিধ আলকাতরার রঙ-তামাশা মাখে এবং বাড়িওয়ালাকে গালি দেয়, সঠিক সময় জল সরবরাহ না করার জন্য। মাঝরাতে ছটফট করে- কে-কার পাশে শোবে; অন্য মানুষের পেট নিয়ে ইয়ার্কি করে বিস্তর, আর অবিবাহিত শ্যালিকার হঠাৎ পেট নিয়ে সম্মিলিত ভয় পায়। বাবু শহরে লোকেরা মাতাল হয়, চাঁদ দেখে, স্নান করে এবং ড্রাংক হয়ে অচেনা মেয়ের কাঁধে হাত রাখে। লোকেদের পুরুষযন্ত্র সচল হয়, উত্তেজক গালাগালি করে জিপারের আড়াল থেকে, আর ফোক সং গাইবে যে কন্যাটি তার আগুনে-সরিসৃপ ভঙ্গি দেখে অপেক্ষমাণ অন্ধকারের জন্য ছোট ষড়যন্ত্র করে প্রায়শ- এসব লীলা-নৈপুণ্যে দেখা যাবে, হয়তো সারা সকাল সে ছিল বেজায় সৎ, কিন্তু সাঁঝবাতির পর থেকেই তার চোখ বদল হতে থাকে- এই মেয়েটি কার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যায় রে? তারপর আবার সেই ভুল-ভুল খুনসুটি- কতকাল তোমার স্নান করা চুলের গন্ধ পায় নি, ...এই দেখ চোখের ভেতর জল জমা হচ্ছে। নজিবর রহমানের ধূসর জলে চোখ কলরব করে; স্বর হয়- স্থির, স্বজ্ঞাময়, অপ্রসন্ন ও ভাসমান। সারাদিন-সারারাত ছায়া আসে এবং অবিরত স্বপ্নের প্রতিরূপ প্লাবিত হয়- নিভুনিভু চোখে সে মুখোশ পরে, স্কুলে যায়, হাসপাতালে যায়, ওজনহীন মেঘ হয়, ছায়া আঁকে, মৃতবৎ শান্ত-শীতল হয় জলের স্রোতে এবং প্লাবিত হয় অদ্ভুত স্বাতন্ত্র্যে।

এই প্রকার স্মৃতিলেখ তৈরির আগে, সহজেই অনুমেয়- নজিবর রহমানের পাণ্ডুলিপিতে কালো কফির সীলমোহর তৈরির আগে, তার দূর আত্মীয়া- একদা গৃহপরিচারিকা মোমেনা খাতুনের অন্য এক পরিবৃত্ত, অন্য এক পরিব্রাজন ও পরিলেখ সঞ্চয়ে ছিল। হাতে কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে পুনশ্চ ভাবুন... গরিব মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারী, যিনি শহর থেকে নিখোঁজ হন- তিনি নজিবর রহমান অথবা মোমেনা খাতুনের আত্মীয়, নাকি এই আত্মীয়তার প্রতিভা, রডেনড্রনগুচ্ছ হয়ে, প্যান অপটিকান তত্ত্ব হয়ে, উন্নয়নের সংজ্ঞা হয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে-ভিজে মুচি ডোম-চামার হয়ে অবশেষে নির্বংশ ও নির্বিষ হয়ে পড়ে। মোমেনা খাতুন যখন গৃহপরিচারিকা নয়, তখনও গার্মেন্টস প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত হয় নি, শহরমুখো হয় নি... সকল মানবাধিকার চূর্ণ করে অপর মানবকুলের মতো তার জীবনও প্রতিষ্ঠা পায়, কলহাস্যময় হয়, হয় পুষ্পবৎ; তারপর রুক্ষ ছায়ার ধারাবর্ষণে জীবন ছিন্নভিন্ন হয়, জীবন পরীক্ষিত হয় এবং পুনর্নির্মিত হয়। মোমেনা খাতুন, মোমেনা খাতুনের বাবা-মা, আত্মীয়কূল- সবাই অক্ষরজ্ঞান-রহিত হয়ে তীব্র অন্নচিন্তায়... সকালবেলা জাগে, ঠোঙা বানায়, টিভি দেখে, শ্যাম্পু কেনে, বাসন মাজে, রুটি কেনে, হাইওয়ে মাড়ায়, যৌনসঙ্গম করে, ঝগড়া করে, আর হয়ে ওঠে কচুপাতার ওপর জমে থাকা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলবিন্দু ও দণ্ডাধীন আত্মক্ষয়ী-ক্রন্দসী।

[আপনি যা বললেন, তা সব কর্জকরা ধারণা; প্রতিনিধিত্বশীল কথা বলুন...]! মোমেনা খাতুন এবং মোমেনা খাতুনের অপর আত্মীয়কুল এবং প্রতিবেশীদের জীবন- তাদের আলাদা ঘর বাড়ি বটে, কিন্তু প্রায়শ তারা প্রাচীন এক অভিসম্পাতে একক পরিসর হয়ে ওঠে; যেমন, এইসব ঘর-বাড়িতে শিশুর জন্মলাভ উৎসবের মতো এবং পরক্ষণেই ক্ষুধার্ত হওয়ার ভয়। কখনো ভয় আসে নিষিদ্ধ গর্ভবতীর অনুষঙ্গে- ঘটনাটি বলি : একবার কোনভাবেই প্রমাণ করা যাচ্ছে না, এই শিশুটি তোমার পলাতক ভাইয়ের! শিশুর বিকাশ রোধ করার জন্য, তোমাদের মুখরক্ষা করার জন্য, লাল মরিচের গুড়া এবং ছয়টি লেবুর রস একত্রে পান করি। সুখ্যাত গুণিনের পরামর্শে তাৎক্ষণিক গর্ভপাতের জন্য জীবন্ত তামাক পাতা খাই... তীব্র বমি, যেন শেকড় সমেত বৃক্ষ উৎপাটন হবে। তাবিজ নিই, ...আর জানাজানি বাড়তে থাকে। আমি লুকাই; একদিন তীব্র ব্যথা, সকাল থেকেই ব্যথা ছড়িয়ে যাচ্ছে তলপেট জুড়ে। দেয়াল চেপে দাঁড়াই। শিশুর পা বেরিয়েছে প্রথম। আমি চুল ছিড়ঁছি- ভয়ে-অসহায় হয়ে, আর গোঙানি। এর পরে অপর পা, মাথা এবং গর্ভফুল : ...একটি ধবধবে মৃতশিশু। কেউ রক্ত মুছিয়ে দেয়। আমি তোয়ালে জড়িয়ে ঐ মৃতমানব শিশুকে নদীতে ভাসিয়ে দেই। আমার কোনো উপায় সেদিন জানা ছিল না। ভয় আড়াল হলে খেয়াল করো- ইজারাদারের জলাশয়ের পাড়ে, মেয়েটির আত্মীয়কুল অনানুষ্ঠানিক পেশার সুবাদে, দলবদ্ধ চা খায় কখনো দিঘি-পুষ্করিণীতে চুন ছড়ানোর কালে অথবা মৎস্য শিকারের আগে পরে। জলে কুমির ডাঙায় বাঘ, গভীর জলের মাছ, তেলে জলে মিশ খায় না ইত্যাদি প্রবাদ মিলিয়ে তারা কখনো গল্পগাছা শোনায়। বিকেল-সন্ধ্যায় তাদের প্রপিতামহরা নদের চাঁদের মুখে মহুয়ার প্রত্যুত্তর সাজায়... কোথায় পাব কলসী কইন্যা কোথায় পাব দড়ি। তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুব্যা মরি। ...প্রতিবেশীদের গল্পে উঠোন জুড়ে চাঁদ ঝিকমিক করে। কেউ তখন হাতিডুবা দিঘির গল্প বলে : অনেককাল আগে এক রাজার হাতি এই পুকুরে ডুবে যায়। ধীরে-ধীরে গল্প ছড়ায়- এই ঘাটে আরো বহুকাল আগে সহমরণ হতো। একবার কোথায় দিঘি কাটা হলো উত্তর-দক্ষিণে, ...কোনভাবেই জল আসে না। মৌলানা আতাউল্লা আসেন সাতজন সেবক নিয়ে। পুকুর ঘুরিয়ে দিলেন পূর্ব-পশ্চিমে, ...আর থৈথৈ পানি। বুড়ো দেওয়ান সাহেবের পুষ্করিণীতে, যদি তোমাকে কুত্তা-বিড়াল কামড়ায়, তবে স্নান করবা। নাপিত বাড়ি নিশ্চয় চেনা আছে? তেনারা এখন কেউ নাপিত নয়- ডাক্তার, টিচার, পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার; এই বাড়ির গল্পটা শুনেছি মায়ের ছোট ফুপুর কাছ থেকে- বৈশাখ মাস। দুপুর, খাঁখাঁ রোদে নাপিত যাচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে এক গাছের নিচে বিশ্রাম নেয়। সেখানে এক বয়স্ক লোক বসে আছেন আগেভাগেই... আমারে একটু কামিয়ে দাও ভাই। নাপিত বলে, জল পাব কোথায়, আমার কাছে যে জল নেই, ...কাছে-পিঠে খাল-বিলও নেই! জলের চিন্তা নেই, তোমার পাত্রটা দাও- লোকটি বাটি নিয়ে হাত বাড়ায়, হাত বাড়তে-বাড়তে অনেক দূরের বিল অবধি পৌঁছে যায় এবং জলভর্তি হয়ে বাটি আবার নাপিতের হাতে পৌঁছায়। নাপিত যত্ন করে দাড়ি কামিয়ে, বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে চারুদর্শন লোকটিকে গড় হয়ে প্রণাম করে; তুই কী বর চাস? সে বললো আমাকে এমন বর দিন যেন কাউকে ক্ষুর-কাঁচি ধরতে না হয়, আর যেন ভাতের অভাব না হয়; সেই থেকে নাপিত বাড়ির উন্নতি- সবাই এখন ডাক্তার, টিচার, পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার...। (আগামী সংখ্যায় পড়ুন)

রবিবার, ০৯ মে ২০২১ , ২৬ বৈশাখ ১৪২৮ ২৬ রমজান ১৪৪২

মরণোত্তর মৃত্যুদিবস ও নৌকাকাণ্ড

মামুন হুসাইন

image

চিত্র : ইন্টারনেট

মানুষ মৃতদেহ থেকে কদাচিৎ দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন করে।

জুতো খুলে রকার-এ দোল খেতে-খেতে মনে হতেই পারে- উত্তেজিত হওয়ার উপাদান চারপাশে কী কম?- আর কেনো মৃতদেহের গল্পই আমাদের জানতে হবে সবাইকে?- আমাদের ভ্রমণ আছে, উত্তম সঙ্গ-আড্ডা আছে, সুপর্যাপ্ত শান্তি-স্বাধীনতা, চোখের জল, স্বচ্ছ ভূদৃশ্য, অলঙ্কারশাস্ত্র আছে, নুডুলস স্যুপ আছে, আর আছে কুকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়ার সবুজ-সূক্ষ্ম আনন্দ। আমাদের সময় ক্ষীণ হয়ে আসছে- অচ্ছ্যুত-কঙ্কাল-অক্ষরের কাগজ সবিস্তারে পাঠ করার অবকাশ এখন কম। কেউ টেক্সট করেছেন- এই লেখাটি আমি কখনো পড়তে চাই নি। ...কেউ জানিয়েছেন, হয়তো এই ছাইভস্ম লেখাটির জন্যই অপেক্ষা করেছি। অন্য এক ভাষ্যে : ...এই লেখাটি আগামী শীতে পাঠ করতে চাই। কারণ, লেখার পৃষ্ঠা, অনুভব হয়েছিল আয়না-সদৃশ- তুমি, আমি, এবং আমাদের মুখমণ্ডল ঐ আয়নার প্রতিফলিত হয়। ...এই লেখাটিই খুঁজছি, কারণ এ বিষয়েই এখন আমি কাজ করছি। অথবা স্থির হই- এই লেখাটি পাঠ করবো, করোনা-বিঘটন সমাপ্তির পর একখণ্ড নৌকাকাণ্ড ও মরণোত্তর জলকাহিনী হিসেবে। এমন কী হতে পারে, এর প্রথম বাক্য সামান্য উৎসাহ তৈরি করলেও, পরবর্তী বাক্যসমূহ এত হতাশ করে যে- বুক সেল্ফের গভীর কাটাছেঁড়া-ময়লার ভেতর ঘৃণা ও প্রত্যাশাসহ তক্ষনি জলন্ত আগুনের গন্ধ মনে রেখে ছুঁড়ে দিলাম? [...মানুষ মৃতদেহ থেকে কদাচিৎ দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন করে]। মানুষ ভবিষ্যৎ, অতীত ও নীরবতা বিষয়ে নিচু গলায় কথা বলে। মানুষ নথিপত্রের সংকেত-লিপি খোঁজে, প্রণোদিত হয় এবং আবারও নিরুপায় হয়ে ভবিষ্যৎ শব্দটি উচ্চারণ করে গভীর তৃষ্ণায় : ফলে ভবিষ্যত শব্দটি অতীত হয় এবং অচিরেই নীরবতা ধ্বংস হয়।

তোমাদের নীরব-অতীত পাড়াগাঁয়ে, পূর্বকথিত মৃতদেহ তৈরির আগে, ধরা যাক স্বল্প-পরিচিত লোকটির নাম নজিবর রহমান- নজিবর রহমানের নিকট আত্মীয় কেউ মিষ্টান্ন প্রস্তুত করতেন, কিন্তু মিষ্টান্ন-বাণিজ্য ক্ষীণ হওয়ায় তিনি গ্রামে ফিরে যান, অথবা জীবন-জীবিকার প্রহারে নৌকা হয়ে, কমিউটার ট্রেন হয়ে, আমৃত্যু শহর-গাঁ করেন- আর এই পরিবারের দূরবর্তী কেউ, যার নাম হয়- মোমেনা খাতুন, যিনি অনেক দিন পর ২০ জুন, ২০২০ কোভিড-১৯ নামক বিপুল এক বৈশ্বিক-অদৃশ্য-বিচূর্ণন প্রক্রিয়ায় বিচেতন হন এবং মৃত্যু নামক বিচ্ছিত্তি গ্রহণ করেন। জনাব নজিবর রহমান, এই পরিবারে প্রথম একটি গ্রন্থ রচনা করেন নৌকা বিষয়ে- তিনি মেয়েটিকে চিনতেন, কিছুদিন তার গৃহে আশ্র্রিতা ছিল; এর অর্থ এই নয় যে, এই মেয়েটিও লিখতে অনুপ্রাণিত হলো; মেয়েটি তাদের জন্য দুপুরের খাবার প্রস্তুত করতো এবং একবার সদ্য প্রস্তুতকৃত কফি নৌকাণ্ডবিষয়ক পাণ্ডুলিপির ২২ নং পৃষ্ঠায় ছিঁটকে ফেলে আচমকা- সেদিন ছিল ২২শে জুন ১৯১৭; ...মেয়েটির মৃত্যু হয় ২২শে জুন ২০২০! এটি কোনো নালিশ নয়- আর কে না জানে, কোনো সকাল-দুপুর আগের সকাল দুপুরের মতো হয় না, চোখের দৃষ্টিও একই রকম হয় না, ...কোনো কিছুই দ্বিতীয়বার হয় না; তোমরা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলেও, আসলে এক অপ্রয়োজনীয় ভয়ের সাথেই বসবাস করছিলে। মেয়েটি ১৯১৭-এর জুলাই-আগস্ট, নজিবর রহমানের গৃহত্যাগ করে, অথবা গার্হস্থ্য-সন্দিগ্ধতা তাকে গৃহচ্যুত করে; মেয়েটি ২২, আলমগঞ্জ লেন থেকে একটি গ্রন্থ ক্রয় করে এবং চাকুরির পরীক্ষায় প্রস্তুতির সূত্রে অবহিত হয়- গার্মেন্টসের সেকশান প্রধানত তিনটি- কাটিং, সুইং ও ফিনিসিং। মেয়েটি এখানে নাম অন্তর্ভুক্ত করে এবং ওভার লক মেশিনে প্রতি ইঞ্চি সেলাইয়ে কী পরিমাণ সুতা লাগে সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করে। মেয়েটি একদিন, ফেব্রুয়ারি শেষ-শেষ, ২০২০ সাল- ...সূর্য দেখার মতো জনৈক বায়ার-এর সুগন্ধ ত্বক এবং ত্বক ছিন্ন করে ভেসে ওঠা সুঘ্রাণ দেখতে দেখতে কতিপয় পাইলট-সার্টের ছবি বিস্মৃত হয়। এরকম মুহূর্তে কোয়ালিটি কন্ট্রোল দপ্তর থেকে সে বকুনি খায়, আর হঠাৎ-ই শোনে- সন্ধ্যা-সন্ধ্যায় সব গার্মেন্টস অদৃশ্য এক বৈশ্বিক মারীর সম্ভাবনায় বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। মেয়েটি গৃহ-অভিমুখি হয়, স্বেচ্ছা অন্তরীণ হয় কিছুকাল, তারপর চাকুরি রক্ষার্থে বাধ্যতামূলক ফিরে আসে, পুলিশী তাণ্ডবে গার্মেন্টসের দোরগোড়া থেকে আবার উন্মূল হয়, গৃহ-অভিমুখি হয় নবপর্যায়ে, আবার ফিরে আসে...; তারপর ঘরে-বাইরের অতল-মিথষ্ক্রিয়ায় সে জ্বর-জ্বর ঘোরের ভেতর, নিঃশ্বাস ক্ষীণ হতে-হতে প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলে চিরকালের মতো এবং দ্রুত নিক্ষিপ্ত হয় ২২শে জুন ২০২০-এর গরম-ভ্যাপসা বিষ্টি-বিষ্টি এক দমবন্ধ ঘূর্ণিপাকে।

তোমাদের গাঁ-ঘরের মানুষেরা এই প্রকার মৃতদেহ থেকে কদাচিৎ দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন করে; প্রকারন্তরে অসময়-মৃত্যুর আলিঙ্গনে মোড়ানো এই দেহ আমাদের ভেতর অতিশয় এক অলাতচক্রের অঙ্গার ছড়িয়ে প্রশস্ত দুঃখী-চোখ খুলে রাখে নিশ্চিন্তে। আমাদের অভ্যাসের শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ে ঘাড়ের উপর; অনুভব হয়- বিন্দুবিন্দু ঘাম, সহজপাঠ্য-শিলালিপি, দুর্বোধ্য জীবন ও নীরবতার সারাংশ। অ-শরণা মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে নজিবর রহমান ভাবলেন, এটা ছিল অলিখিত এক ক্ষণস্থায়ী মর্মন্তুদ বিয়োগ কাহিনীই বটে! আমরা কী তবে দিনশেষে, অচেনা বৃক্ষের অচেনা ছায়া হয়ে, ক্ষুধা-তৃষ্ণার প্রতীক্ষা পেরিয়ে নিপুণ-নির্ধারিত এক সমাপণ মাত্র? লোকটি পাখা ঝাপ্টায়, স্মৃতি ঝাকায় এবং পতপত কাঁপতে থাকে- মৃত বেড়ালকে শাস্তি দিয়ে কী লাভ? ...কোনো কিছুই তো নেই আগের মতো। কফির দাগপড়া পাণ্ডুলিপির ২২ নং পৃষ্ঠায় সে দৃষ্টি ঘষে- পদধ্বনি শোনার মতো। কোথাও কী লুকিয়ে ছিলাম আমরা? কেন এতসব অজ্ঞাতবাস? চারপাশে এত এত বৃত্তান্ত, অগ্নিস্রোত, মর্মবেদনা এবং বীভৎস ধারাবিবরণী- কিন্তু সংকীর্ণ আকাক্সক্ষায়-কৌতূহলে, স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় নৌকাণ্ডবিষয়ক একটি অনুদ্দিষ্ট-নিরর্থ গ্রন্থ-রচনায় কেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠি? পরাজিত মনের প্রদাহ এড়াতে আমি তবে অত্যধিক কিছু আশা করে ছিলাম? নিজের জন্য অদৃশ্য হওয়া- কৌশলটি খুব খারাপ নয়। নৌকা সম্পর্কিত লেখক নজিবর রহমান মৃতদেহ চাক্ষুষের মতো গ্রন্থের পৃষ্ঠা উল্টায়- ...এই বই নির্মাণে, রপ্তানিযোগ্য পোশাকের গায়ে প্রতিস্থাপিত মেইন লেবেল ও সাব-লেবেল পৃথককারী একদা গৃহপরিচারিকা-কন্যার অদৃশ্য নিঃশ্বাস ও আঙুল ছুঁয়ে আছে। অনেকদিন আগে যখন সে গৃহপরিচারিকা- খাদ্য প্রস্তুতিতে বিভ্রাট প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহিণীর লাগাতার বকুনিতে যখন আত্মহননের ইচ্ছে প্রকাশ করে, তখন নজিবর রহমান, এক আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে, তার মাথায় হাত রাখে মৃদু-প্রসন্ন-সংবেদনশীলতায়। সামান্য নরম হয়ে যাওয়া শাড়ি পরিহিত মেয়েটি পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ ছড়িয়ে দাঁড়ায় : তার আঙুল এবং আমাদের আঙুল মাতৃভাষা লোভী হয়ে উঠে; আঙুল শিরা-উপশিরার মতো নদীমাতৃক হয়, তারপর তারা বৃক্ষ শাখা হয়, ছায়ামূর্তি হয়, মানব-সন্তান হয় এবং ভাষা-অস্পষ্ট লেখক হয়; শরীরে-গলায়-পিঠে-চিবুকে আঙুল বুলিয়ে এবার তারা প্রলয়কালের আলপথ বেয়ে গোপন স্থগিতাদেশ লেখে- ফলশ্রুতিতে রচিত হয়, কতিপয় দুঃখের কথা, বাবার অপমৃত্যুর কথা, ইংরেজি মাস্টারের সঙ্গে কানাইবাবুর স্ত্রী-পলায়নের ইতিবৃত্ত ও হঠাৎ আঙুল কেটে রক্ত বেরুনোর কথা। নজিবর রহমান নৌকা-বই তৈরির সময়, আজ এই হঠাৎ অখণ্ড শোকদিবসের কিনারায় দাঁড়িয়ে ভাবছিল- মোমেনা খাতুন নামে সদ্যমৃত মেয়েটির কতিপয় দৃশ্যাবলি অগোচরে অতল-নিরাময় হিসেবে সেদিন সে এত অনুকূল উপযুক্তিতে গ্রহণ করেছিল কেন? নৌকা বিষয়ক পাণ্ডুলিপির ২২নং পৃষ্ঠায় মেয়েটি কালো-কফির দাগ ঘষে দিলেও, হতে পারে কিছুকিছু রেফারেন্স বই ওর ঈষৎ নরম-পাড়ের শাড়ি ঘষে ময়লা মুক্ত করেছিল। হতে পারে তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কয়েকটি দিন স্নানের জল গরম করে দিয়েছিল। অথবা উড়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির সোনালি ডালার চিল-প্রকল্প স্থগিত পূর্বক পৃষ্ঠাসমূহ সংরক্ষণ করেছিল বন্ধ-টেবিল ওয়াচ-এ তৈরি পেপার ওয়েটে; আর কখনো কখনো শুধুই দাঁড়িয়ে থাকত শুভাকাক্সক্ষার দূর কল্পলোকে- কুয়াশা, অশ্রুজল ও নিচু জাতের গন্ধ নিয়ে। নিচু জাতের মেয়েরা কী বৃক্ষ ও আকাশ জুড়ে গরম ভাতের মায়া ছড়িয়ে কথা বলতে সক্ষম? [...ক্যান সাব অল্টার্ন স্পিক?] নিচু জাতের মেয়েরা পানপরাগের খালি কৌটা ওয়েস্টবিনে ফেলার সময় বইয়ের অক্ষর বুঝতে পারে? নজিবর রহমান লিখতে লিখতে কখনো ঘুমায়। নৌকা বিষয়ক অক্ষরপুঞ্জি নিদ্রাচালিত পারিবারিক ধুলোবালিতে স্কুলব্যাগ গোছায়, হিংস্র হয় এবং মাতাল হয়। নৌকার অক্ষর সমূহ নৈর্ঋত পেরিয়ে রেস্তোঁরায় যায়, তুলসিপাতা চিবোয়, বাস ভর্তি বালক-বালিকা হয়, পৃথিবীহীন হয় এবং নেচেনেচে ফড়িং ধরে। নজিবর রহমান নৌকার প্রকারভেদ করে এবং একটি মেয়ে কীভাবে যুগপৎ সাধারণ ও অসাধারণ হয়- তার ঠিকুজি খুঁজতে হন্যে হয়। দেখা গেল : সাবানজলে নতুন কাপড় এবং পুরনো কাপড় গলাগলি হয়ে অনেকখানি রঙ আদান প্রদান করায়, গৃহপরিচারিকা আবার একদিন জ্ঞানশূন্য ক্রুদ্ধতার ভেতর আটক হয়েছে। মেয়েটি কি ক্ষমতার ভাষা বুঝতে পারে? নৌকার পাণ্ডুলিপি থেকে অব্যবহৃত ঝর্না কলম গড়িয়ে গড়িয়ে স্থির হয় অপর বইয়ের গায়ে- সাধারণ ও অসাধারণ মেয়ে বুঝবার কোনো স্থির-ছলনাহীন মাপকাঠি জানা আছে তোমাদের? তোমাকেই জিজ্ঞেস করি- একজন কি দুটি মানুষকে একসঙ্গে ভালবাসতে পারে? একত্রে দুজনকে ধাক্কা দিতে পারে? বা দুজনের সঙ্গেই একত্রে শত্রুতা উদ্যাপন করতে? প্রবল জ্বরে শয্যশায়ী হলে, কেউ যদি এ্র্যানালজেসিক খুলে দেয়, সে কি অসাধারণ মেয়ে হয়? অসাধারণ মেয়েরা [আমাদের স্বার্থে বলি] অপরের জন্য মৃত্যুবরণ করে, নিঃসঙ্গ হয় এবং খুন হয়? অসাধারণ মেয়েরা সারাদিন চুলার পাশে ছাই হয় এবং আগুন স্নানে লিপ্ত থাকে। অসাধারণ মেয়েরা খাদ্য ও স্নানের চিরায়ত শুদ্ধ সময় নিয়ে কর্তাদের সামনে তর্ক করে না। অসাধারণ মেয়েরা বাপের-মায়ের ওষুধ সংগ্রহের জন্য যেকোনো নিষিদ্ধ হোটেলে রাত্রিযাপন করে ভোর-ভোর ঘরে ফেরে। অসাধারণ মেয়েরা ঘরে ফেরে, শরীরে আঘাতের চিহ্ন আঁকে, বাসন মাজে, রুটি বানায়, মশারি গোছায় এবং রান্নাঘরের ঝুল কালি মোছে পুরনো পেটিকোটে। বলা যায়- ২০শে জুন ২০২০-এ উৎপাদিত- একদা গৃহচ্যুত পরিচারিকার অপ্রস্তুত মৃত্যু সংবাদ অবহিত হয়ে নৌকা বিষয়ক গ্রন্থ প্রণেতা নজিবর রহমান, অনেক বছর আগের কতিপয় গোধূলি-দিন-রাতে এইভাবে সমর্পিত হয়েছিল। গতজীবনে অকিঞ্চিৎ এই বই লেখার জন্য কত রাত বাড়ি ফিরি নি, পত্রিকায় সামান্য একটি মফস্বল সংবাদ প্রেরণের জন্য শিশুপুত্র হত্যাকারী সদ্যধৃত মায়ের আদল দেখতে থানার সামনে দাঁড়িয়েছি, দিঘির জল দেখেছি, খড়কুটো যোগাড় করেছি, শাপ-শাপান্ত করেছি, প্রতিপক্ষ হয়েছি, তিস্তা-গঙ্গা করেছি, প্রহসন করেছি, সাইকেল চড়েছি, আর একটি গরিব মেয়েকে নিবর্তন থেকে রক্ষা করার জন্য ভ্রষ্ট প্রমাণিত হয়েছি- ...এর অর্থ শরীরে-বুকে বিবিধ আঘাত ও ব্যথার জগত; ব্যথায়-আঘাতে গলায় কালশিটে দাগ পড়ে এবং চোখের নিচে সাতটি দীর্ঘ-মলিন-নির্বান্ধব সেলাই। নৌকা বিষয়ক বই আড়াল করে, কখনো কি গরিবের ঈশ্বর নিয়ে জার্নাল করার বুদ্ধি এসেছিল? চোখের নিচে সেলাইয়ের আত্মবিশ্বাসী দাগ নিয়ে, মনে হয়েছিল- স্বর্গরাজ্য একটি মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে- ছোট ছোট মিথ্যা, ছোট ছোট ঘর এবং ছাদ- ছাদের দুইপাশ দিয়ে দুই মিথ্যা- সাদা মিথ্যা এবং কালো মিথ্যা! [তুমি দার্শনিক হওয়ার লোভে পড়েছ- ...এনাফ ফিলোসোফাইজিং...; খেয়াল কর যেন ঠাণ্ডায় না পড়ো]।

এরকম, এক শীত-শীত ঠাণ্ডায় গরিব মেয়েটি, গরিবের ঈশ্বর খোঁজার জন্য, গার্মেন্টস প্রশিক্ষণে নাম অন্তর্ভুক্ত করে, পুরনো শাড়ি-ব্যাগে টুকিটাকি জড়ো করে এবং পরিত্যক্ত স্টেডিয়ামের গা-ঘেঁষে টেনিস কোর্ট পেরিয়ে নতুন ঘর-বাড়িতে পৌঁছায়। অপর মানুষের এই প্রকার গৃহত্যাগ পর্যবেক্ষণ শেষে, নজিবর রহমান, জানালা বন্ধের সময় দূরের জামরুল গাছে মৌচাক আন্দাজ করলো। কলতলা থেকে কথা আসে- এই কয়টা থালা বাসন নিজেরা মাজতে পারো না? নজিবর রহমান, মিছেমিছি টর্চ ঠিক করে, বিনুনি খুলতে দেখে মেয়ের, আর ছিপছিপে ঘাসের ভেতর ফড়িং ও বিধবা রেনু কাকীর সাদা শাড়ির মেঘ দেখে অন্য উপকথায় জড়িয়ে যায়; হয়তো বলে, জানেন তো, সময় হলো তিন রকম- বেলা-অবেলা-কালবেলা! জগৎ-প্রান্তর জুড়ে কত বৃহৎ আকাশ, মাটি, পাহাড়, নদী- ...আর কী তীব্র ক্ষুদ্র হয়ে বেঁচে থাকা। নৌকা বিষয়ক গ্রন্থ প্রণেতা নজিবর রহমান, লেখার কালে- নদীর ভেতর জ্যোৎস্না, দূর প্রতিবেশীর গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠানে সমবেত ছায়াচ্ছন্ন-মদ্দা সমষ্টি, উদ্ভট্টি আলোকসামান্য ছোট ষড়যন্ত্র, এবং ব্রাহ্ম-মুহূর্ত উদ্যাপন দেখে বেলা-অবেলা-কালবেলার স্রোতে- লোকেরা নদীর মাঝখানে মদের বোতল খুলছে, শাড়ি-ব্লাউজের সেফটিপিন খুলে কেউ ডুব দিচ্ছে, অন্য নৌকায় বিচুলি আর নৌকার পাড় জুড়ে সীমান্ত রক্ষীদের তীব্র আলো। কে জানে, এইরকম কতিপয় নদী এবং নৌকার ছবিসমূহ সংগ্রহ করেই নজিবর রহমান হয়তো নৌকা বিষয়ক গ্রন্থ সৃষ্টির দখলি স্বত্বে আগ্রহশীল হয়- বলা যায় এই প্রকার অন্যমনস্কতা ও ভাবুকতায়- এক ফাঁকে হয়তো ধানের ক্ষেত দেখে, স্রোতে ডুবে যাওয়া ভাতের হাঁড়ি দেখে, নিজেকে ক্ষুধার্ত করে এবং শেষমেশ তৈরি করে এক নির্জন লেখার টেবিল- যে টেবিলে কালো কফি স্থাপনের সময় নৌকা বিষয়ক ম্যানুস্ক্রিপ্টের ২২নং পৃষ্ঠায় বাদামি দাগ ছড়িয়ে দেয় অকালমৃত সেই গৃহপারিচারিকা। নজিবর রহমান সামান্য ময়লা হয়ে যাওয়া ম্যানুস্ক্রিপ্টের, অনন্ত-কালক্রম পর্যবেক্ষণের অনুমতি পাঠায় নিজের কাছে। [ঈশ্বর তার মনস্কামনা পূর্ণ করে] : ...অনেক দিন অবধি সকল জ্ঞান গোপন করে, একটি নির্মিয়মাণ গ্রন্থের সম্মানে আরোগ্যহীন-জনশূন্য কাগজ-কলমে আয়ুষ্কাল ক্ষয় করতে হয়েছে : ...একবারই বেপরোয়া হয়েছিলাম টানা চারদিন। তারপর নিজের দোষে, নিজের মুদ্রাদোষে অনন্যোপায় হয়ে নজিবর রহমান নৌকা-রচনা লিখে চলে। ...নৌকার সঙ্গে অনেক মানুষ যুক্ত থাকে- নৌকার চালক, নৌকার মালিক, ঠিকাদার, মাঝি ইত্যাদি; সব নৌকার নাম তুমি জান না। বরিশালের নৌকা, কুমিল্লার নৌকা এবং ময়মনসিংহের নৌকা এক নয়। ঢাকার নৌকাও আলাদা নামের- ঘাসি/ কোশা/ রপ্তানি/ : কোনো নৌকায় ফল, কোনো নৌকায় পাট, ধান, কৃষি সরঞ্জাম, ...আবার বালি বহনের নৌকা খানিকটা আলাদা বটে। নদী এবং নৌকা, ধরা যাক- এইভাবে অন্তত এক অপ্রবীণ-অনাদি ছবি নির্মাণ করে একদিন এবং জলের শরীরে তা প্রক্ষেপণ করে : পাল তুলে যাওয়া নৌকার নাম দিন, জালি। লবণপূর্ণ এই নৌকাটি দেখবেন কক্সবাজারে। এই নৌকাটির গলুই এবং হাল চামচের মতো। আপনাদের পাশের ঘাটে নৌকা থেকে কাঠ সরানো হচ্ছে। নৌকায় মাটির হাঁড়িও অনেক সময় বহন করা হয়। ডুবে-ডুবে বালি তোলা হয়, ...এরকম নৌকা চোখে পড়েছে কখনো? দেখবেন নৌকার ভেতর অন্য এক বিপুল বাজার-ব্যবস্থা লুকিয়ে থাকে। যদি এই নৌকাটি পাট বহন করে, তবে আপনি পাবেন- মাঝি, ফড়িয়া, বেপারী, আড়তদার এবং পাটকলের এজেন্ট; যদি নৌকাটি ইটভাটার কাজে ব্যবহৃত হয়- তবে নৌকায় কখনো মাটি, কখনো কয়লা, কখনো ফার্নেসওয়েল, কখনো জ্বালানি কাঠ বহন করা হয়। বলা যায়- নৌকা বর্ণনা এইভাবে আবশ্যক-অনাবশ্যক ভবিতব্যের দিকে ধাবিত হয়, ভেতর-বাইরে সমান্তরাল হয়, সংকুচিত হয়, পরিব্যাপ্ত হয়, কৃশ হয় এবং চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। নৌকা বর্ণনা শেষ হলে, নজিবর রহমান অতঃপর জলের স্তর ক্ষীণ হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে একটি পরিচ্ছেদ লেখে- পত্রিকা অফিস এবং বিআইডব্লুটিএ তার বক্তব্যের সাক্ষ্যদাতা হয় : ...নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহীর প্রায় চার লাখ একর জমিতে বর্তমানে বোরো ও গম চাষের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে, ...পদ্মার সকল শাখা এখন জলশূন্য। ড্রেজিং কি সমাধান? নজিবর রহমান লেখে, অন্তত ছয় ফিট গভীরতা চাই সর্বত্র- ঢাকা-বরিশাল-চাঁদপুর-আড়িয়ালখাঁ/ খুলনা-কালিগঞ্জ সীমান্ত/ নারায়ণগঞ্জ-লাখপুর/ চাঁদপুর-আরিচা/ আরিচা-বাহাদুরাবাদ/ চাঁদপুর-ভৈরব/ ভৈরব-ছাতক/ ভৈরব-ফেঞ্চুগঞ্জ /কুষ্টিয়া-খুলনা- ...এই বিস্তীর্ণ জলরাশি সচল রাখার দায় কার? অন্তত ৫৮টি নদীর উৎসমুখ ভারত-বাংলাদেশের জন্য অভিন্ন! আমাদের নৌকাসমূহ উজান-ভাটিতে চলাচলের সুবিধা বারোমাস সমানভাবে পায় না : যেমন- আশ্বিনে উজানযাত্রা কষ্টকর, ভাটাতে যাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ; অগ্রহায়ণে উজানে অসুবিধা, ভাটিতে সুবিধে; বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে উজানযাত্রা মধ্যম মানের, ভাটিতে কষ্ট তীব্রতর; পৌষ থেকে চৈত্র উজান-ভাটি, দুইটিই সুবিধাজনক। আবার আষাঢ়-শ্রাবণ, পুরো মাসই নৌকা ভাসান অনেক সহজ। নজিবর রহমান বিশেষজ্ঞদের বই থেকে সমাধান লেখার চেষ্টা করে : ছোট নোটস্ ছিল, খুঁজে পেতে অসুবিধে হচ্ছে; স্বরুপকাঠিতে ৫০০ মণী নৌকা তৈরিতে কাঠের পরিমাণ কত ছিল? অকালমৃত গৃহপরিচারিকা, অনেকদিন আগে ওয়েস্টবিন থেকে রকমারি নৌকার একটি-দুটি উড়ে যাওয়া ফটোগ্রাফ কুড়িয়ে নজিবুর রহমানকে চমৎকৃত করে- বাঘাবাড়ি, কাপাশিয়া এবং বেড়া থেকে সংগৃহীত নৌকার ছবি : একটি ছবির পেছনে পেন্সিলে আলতো লেখা- স্বরুপকাঠিতে তৈরি নৌকার বিবরণ।

নদী-বিষয়ক এই পাণ্ডুলিপি স্পর্শে নজিবর রহমান কখনো, এজন্যও বাড়তি সময় সঞ্চয় করে- ২০শে জুন, ২০২০-এ অকালমৃত গৃহপরিচারিকাকে ভেবে। এই বাবু শহরে লোকেরা- গেঞ্জি খুলে, বাথরুমে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ হয়ে সাবান মাখে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিবিধ আলকাতরার রঙ-তামাশা মাখে এবং বাড়িওয়ালাকে গালি দেয়, সঠিক সময় জল সরবরাহ না করার জন্য। মাঝরাতে ছটফট করে- কে-কার পাশে শোবে; অন্য মানুষের পেট নিয়ে ইয়ার্কি করে বিস্তর, আর অবিবাহিত শ্যালিকার হঠাৎ পেট নিয়ে সম্মিলিত ভয় পায়। বাবু শহরে লোকেরা মাতাল হয়, চাঁদ দেখে, স্নান করে এবং ড্রাংক হয়ে অচেনা মেয়ের কাঁধে হাত রাখে। লোকেদের পুরুষযন্ত্র সচল হয়, উত্তেজক গালাগালি করে জিপারের আড়াল থেকে, আর ফোক সং গাইবে যে কন্যাটি তার আগুনে-সরিসৃপ ভঙ্গি দেখে অপেক্ষমাণ অন্ধকারের জন্য ছোট ষড়যন্ত্র করে প্রায়শ- এসব লীলা-নৈপুণ্যে দেখা যাবে, হয়তো সারা সকাল সে ছিল বেজায় সৎ, কিন্তু সাঁঝবাতির পর থেকেই তার চোখ বদল হতে থাকে- এই মেয়েটি কার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যায় রে? তারপর আবার সেই ভুল-ভুল খুনসুটি- কতকাল তোমার স্নান করা চুলের গন্ধ পায় নি, ...এই দেখ চোখের ভেতর জল জমা হচ্ছে। নজিবর রহমানের ধূসর জলে চোখ কলরব করে; স্বর হয়- স্থির, স্বজ্ঞাময়, অপ্রসন্ন ও ভাসমান। সারাদিন-সারারাত ছায়া আসে এবং অবিরত স্বপ্নের প্রতিরূপ প্লাবিত হয়- নিভুনিভু চোখে সে মুখোশ পরে, স্কুলে যায়, হাসপাতালে যায়, ওজনহীন মেঘ হয়, ছায়া আঁকে, মৃতবৎ শান্ত-শীতল হয় জলের স্রোতে এবং প্লাবিত হয় অদ্ভুত স্বাতন্ত্র্যে।

এই প্রকার স্মৃতিলেখ তৈরির আগে, সহজেই অনুমেয়- নজিবর রহমানের পাণ্ডুলিপিতে কালো কফির সীলমোহর তৈরির আগে, তার দূর আত্মীয়া- একদা গৃহপরিচারিকা মোমেনা খাতুনের অন্য এক পরিবৃত্ত, অন্য এক পরিব্রাজন ও পরিলেখ সঞ্চয়ে ছিল। হাতে কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে পুনশ্চ ভাবুন... গরিব মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারী, যিনি শহর থেকে নিখোঁজ হন- তিনি নজিবর রহমান অথবা মোমেনা খাতুনের আত্মীয়, নাকি এই আত্মীয়তার প্রতিভা, রডেনড্রনগুচ্ছ হয়ে, প্যান অপটিকান তত্ত্ব হয়ে, উন্নয়নের সংজ্ঞা হয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে-ভিজে মুচি ডোম-চামার হয়ে অবশেষে নির্বংশ ও নির্বিষ হয়ে পড়ে। মোমেনা খাতুন যখন গৃহপরিচারিকা নয়, তখনও গার্মেন্টস প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত হয় নি, শহরমুখো হয় নি... সকল মানবাধিকার চূর্ণ করে অপর মানবকুলের মতো তার জীবনও প্রতিষ্ঠা পায়, কলহাস্যময় হয়, হয় পুষ্পবৎ; তারপর রুক্ষ ছায়ার ধারাবর্ষণে জীবন ছিন্নভিন্ন হয়, জীবন পরীক্ষিত হয় এবং পুনর্নির্মিত হয়। মোমেনা খাতুন, মোমেনা খাতুনের বাবা-মা, আত্মীয়কূল- সবাই অক্ষরজ্ঞান-রহিত হয়ে তীব্র অন্নচিন্তায়... সকালবেলা জাগে, ঠোঙা বানায়, টিভি দেখে, শ্যাম্পু কেনে, বাসন মাজে, রুটি কেনে, হাইওয়ে মাড়ায়, যৌনসঙ্গম করে, ঝগড়া করে, আর হয়ে ওঠে কচুপাতার ওপর জমে থাকা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলবিন্দু ও দণ্ডাধীন আত্মক্ষয়ী-ক্রন্দসী।

[আপনি যা বললেন, তা সব কর্জকরা ধারণা; প্রতিনিধিত্বশীল কথা বলুন...]! মোমেনা খাতুন এবং মোমেনা খাতুনের অপর আত্মীয়কুল এবং প্রতিবেশীদের জীবন- তাদের আলাদা ঘর বাড়ি বটে, কিন্তু প্রায়শ তারা প্রাচীন এক অভিসম্পাতে একক পরিসর হয়ে ওঠে; যেমন, এইসব ঘর-বাড়িতে শিশুর জন্মলাভ উৎসবের মতো এবং পরক্ষণেই ক্ষুধার্ত হওয়ার ভয়। কখনো ভয় আসে নিষিদ্ধ গর্ভবতীর অনুষঙ্গে- ঘটনাটি বলি : একবার কোনভাবেই প্রমাণ করা যাচ্ছে না, এই শিশুটি তোমার পলাতক ভাইয়ের! শিশুর বিকাশ রোধ করার জন্য, তোমাদের মুখরক্ষা করার জন্য, লাল মরিচের গুড়া এবং ছয়টি লেবুর রস একত্রে পান করি। সুখ্যাত গুণিনের পরামর্শে তাৎক্ষণিক গর্ভপাতের জন্য জীবন্ত তামাক পাতা খাই... তীব্র বমি, যেন শেকড় সমেত বৃক্ষ উৎপাটন হবে। তাবিজ নিই, ...আর জানাজানি বাড়তে থাকে। আমি লুকাই; একদিন তীব্র ব্যথা, সকাল থেকেই ব্যথা ছড়িয়ে যাচ্ছে তলপেট জুড়ে। দেয়াল চেপে দাঁড়াই। শিশুর পা বেরিয়েছে প্রথম। আমি চুল ছিড়ঁছি- ভয়ে-অসহায় হয়ে, আর গোঙানি। এর পরে অপর পা, মাথা এবং গর্ভফুল : ...একটি ধবধবে মৃতশিশু। কেউ রক্ত মুছিয়ে দেয়। আমি তোয়ালে জড়িয়ে ঐ মৃতমানব শিশুকে নদীতে ভাসিয়ে দেই। আমার কোনো উপায় সেদিন জানা ছিল না। ভয় আড়াল হলে খেয়াল করো- ইজারাদারের জলাশয়ের পাড়ে, মেয়েটির আত্মীয়কুল অনানুষ্ঠানিক পেশার সুবাদে, দলবদ্ধ চা খায় কখনো দিঘি-পুষ্করিণীতে চুন ছড়ানোর কালে অথবা মৎস্য শিকারের আগে পরে। জলে কুমির ডাঙায় বাঘ, গভীর জলের মাছ, তেলে জলে মিশ খায় না ইত্যাদি প্রবাদ মিলিয়ে তারা কখনো গল্পগাছা শোনায়। বিকেল-সন্ধ্যায় তাদের প্রপিতামহরা নদের চাঁদের মুখে মহুয়ার প্রত্যুত্তর সাজায়... কোথায় পাব কলসী কইন্যা কোথায় পাব দড়ি। তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুব্যা মরি। ...প্রতিবেশীদের গল্পে উঠোন জুড়ে চাঁদ ঝিকমিক করে। কেউ তখন হাতিডুবা দিঘির গল্প বলে : অনেককাল আগে এক রাজার হাতি এই পুকুরে ডুবে যায়। ধীরে-ধীরে গল্প ছড়ায়- এই ঘাটে আরো বহুকাল আগে সহমরণ হতো। একবার কোথায় দিঘি কাটা হলো উত্তর-দক্ষিণে, ...কোনভাবেই জল আসে না। মৌলানা আতাউল্লা আসেন সাতজন সেবক নিয়ে। পুকুর ঘুরিয়ে দিলেন পূর্ব-পশ্চিমে, ...আর থৈথৈ পানি। বুড়ো দেওয়ান সাহেবের পুষ্করিণীতে, যদি তোমাকে কুত্তা-বিড়াল কামড়ায়, তবে স্নান করবা। নাপিত বাড়ি নিশ্চয় চেনা আছে? তেনারা এখন কেউ নাপিত নয়- ডাক্তার, টিচার, পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার; এই বাড়ির গল্পটা শুনেছি মায়ের ছোট ফুপুর কাছ থেকে- বৈশাখ মাস। দুপুর, খাঁখাঁ রোদে নাপিত যাচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে এক গাছের নিচে বিশ্রাম নেয়। সেখানে এক বয়স্ক লোক বসে আছেন আগেভাগেই... আমারে একটু কামিয়ে দাও ভাই। নাপিত বলে, জল পাব কোথায়, আমার কাছে যে জল নেই, ...কাছে-পিঠে খাল-বিলও নেই! জলের চিন্তা নেই, তোমার পাত্রটা দাও- লোকটি বাটি নিয়ে হাত বাড়ায়, হাত বাড়তে-বাড়তে অনেক দূরের বিল অবধি পৌঁছে যায় এবং জলভর্তি হয়ে বাটি আবার নাপিতের হাতে পৌঁছায়। নাপিত যত্ন করে দাড়ি কামিয়ে, বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে চারুদর্শন লোকটিকে গড় হয়ে প্রণাম করে; তুই কী বর চাস? সে বললো আমাকে এমন বর দিন যেন কাউকে ক্ষুর-কাঁচি ধরতে না হয়, আর যেন ভাতের অভাব না হয়; সেই থেকে নাপিত বাড়ির উন্নতি- সবাই এখন ডাক্তার, টিচার, পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার...। (আগামী সংখ্যায় পড়ুন)