সুন্দরবনে বারবার আগুন কেন?

পুড়ে গেছে ৭০ একর বনভূমি

সুন্দরবনে গত দুইদশকে বারবার আগুন লেগেছে কিংবা পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনটির। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য মাইকিং এবং কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা ছাড়া বাস্তবে তেমন কোন কাজই হয়নি। দ্রুত আগুন নেভানোর জন্য রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। সেক্ষেত্রেও নেই তেমন কোন অগ্রগতি।

বাগেরহাটে অবস্থিত সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ অফিসের তথ্যানুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ২৪ বার সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে আগুন লেগেছে। তবে স্থানীয় লোকজন ও বনজীবীদের তথ্যানুযায়ী এইসংখ্যা অন্তত ৩০। আগুনে পুড়েছে কমপক্ষে ৭০ একর বনভূমির গাছপালা।

অগ্নিকাণ্ড অধিকাংশ ঘটেছে বনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে। খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে কখনও আগুন লাগেনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাছ ও কাঁকড়া ধরা, মধু আহরণ, গোলপাতা কাটাসহ বনজ সম্পদ আহরণে সুন্দরবনে যান বনজীবীরা। তাদের ফেলে দেয়া বিড়ি-সিগারেটের আগুন থেকে বনে আগুন লাগে। মধু সংগ্রহের পর মৌয়ালদের ফেলে দেয়া মশাল থেকেও আগুন লাগে। মাছ ধরার সুবিধার্থেও বেশ কয়েকবার আগুন লাগিয়েছে স্থানীয় কিছুলোক। এসব ঘটনায় একাধিক মামলাও হয়েছে কিন্তু জড়িতদের বেশিরভাগই ধরা পড়েনি।

স্থানীয়রা জানান, দাসের ভারানি, নাংলি ও ধানসাগরসহ কয়েকটি এলাকায় বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা হয়। সেখানে বর্ষাকালে শিং মাছসহ বিভিন্ন রকমের মাছ পাওয়া যায়। গাছপালা-লতাগুল্ম না থাকলে মাছ ধরতে সুবিধা হয়। তাই একটি অসাধুচক্র আগুন লাগিয়ে গাছপালা-লতাগুল্ম পরিষ্কার করে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার জানান, ইতোপূর্বে মানুষের কারণে আগুন লাগার কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে এবার আগুন লেগেছে প্রাকৃতিক কারণে।

তিনি বলেন, বনের মধ্যে গাছের পাতা পড়ে পুরু স্তর তৈরি হয়, জোয়ারের পানিতে ওই পাতা পচে যায়। এর ফলে পাতার মধ্যে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়। সেই মিথেন থেকেই এবার আগুন লেগেছে।

সর্বশেষ গত ৩ মে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লাগে। দুর্গম এলাকা হওয়ায় ঘটনাস্থলে পৌঁছতে বিড়ম্বনায় পড়ে ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া পানির অভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বনের ধানসাগর এলাকায় আগুন লেগেছিল।

প্রতিটি ঘটনার পর বন বিভাগ তদন্ত কমিটি গঠন করে। এসব তদন্ত কমিটি গত দুই দশকে যেসব সুপারিশ করেছে তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল- বনরক্ষীদের টহল কার্যক্রম জোরদার, তিনটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি, সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় নাইলনের দড়ি দিয়ে বেড়া নির্মাণ, আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগের জনবল বাড়ানো, রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণ, বনসংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা নদী, ৪০ কিলোমিটার খাল ও তিনটি পুকুর পুনঃখনন। আগুন লাগা প্রতিরোধে বন বিভাগ সচেতনতা তৈরির জন্য মাইকিং করে কিন্তু এর বাইরে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে বন বিভাগের দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম নেই।

সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির খুলনা শাখার সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, আগুন প্রতিরোধে বন বিভাগের উদাসীনতা রয়েছে।

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, আগুন প্রতিরোধে বন বিভাগের তেমন কোন পদক্ষেপ নেই। বিষয়টি সবচেয়ে উদ্বেগজনক।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, আগুন যাতে না লাগে সেজন্য তাদের কোন পদক্ষেপ নেই।

উদাসীনতার অভিযোগ অস্বীকার করে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, মাছ ধরার সুবিধার্থে এর আগে যারা আগুন লাগিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে বন বিভাগের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছিল। তাদের বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

তিনি জানান, বন বিভাগের নিজস্ব কোন অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। আগুন লাগলে তারা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেন। এছাড়া তারা যেখানে আগুন লেগেছে তার চারপাশে দ্রুত ফায়ার লাইন কাটেন, যাতে আগুন আর বাইরে ছড়াতে না পারে।

ফায়ার সার্ভিসের খুলনার উপপরিচালক মো. আকরাম হোসেন বলেন, বনসংলগ্ন শরণখোলা ও শ্যামনগরে দুটি রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে।

খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খান বলেন, যে এলাকাগুলোতে বারবার আগুন লাগছে, সেখানকার নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় লোকজন সহজেই বনের মধ্যে ঢুকতে পারছে। অনেক সময় তাদের বিড়ি-সিগারেটের উচ্ছিষ্টাংশ থেকে আগুন লাগছে।

তিনি আরও বলেন, আগুন লাগা প্রতিরোধের জন্য সুন্দরবনে বনজীবীদের প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন তাদের বিকল্প জীবিকায়ন। সে উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য বন অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। নাইলনের দড়ি দিয়ে বেড়া নির্মাণের বিষয়টি আরেকটি প্রকল্পের আওতায় পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, আগুন লাগা প্রতিরোধে সুন্দরবনের লোকালয় সংলগ্ন যেসব নদী-খাল ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো শুষ্ক মৌসুমের সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় পুনঃখনন করা হবে।

মঙ্গলবার, ১১ মে ২০২১ , ২৮ বৈশাখ ১৪২৮ ২৮ রমজান ১৪৪২

সুন্দরবনে বারবার আগুন কেন?

পুড়ে গেছে ৭০ একর বনভূমি

শুভ্র শচীন, খুলনা

image

সুন্দরবনে গত দুইদশকে বারবার আগুন লেগেছে কিংবা পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনটির। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য মাইকিং এবং কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা ছাড়া বাস্তবে তেমন কোন কাজই হয়নি। দ্রুত আগুন নেভানোর জন্য রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। সেক্ষেত্রেও নেই তেমন কোন অগ্রগতি।

বাগেরহাটে অবস্থিত সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ অফিসের তথ্যানুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ২৪ বার সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে আগুন লেগেছে। তবে স্থানীয় লোকজন ও বনজীবীদের তথ্যানুযায়ী এইসংখ্যা অন্তত ৩০। আগুনে পুড়েছে কমপক্ষে ৭০ একর বনভূমির গাছপালা।

অগ্নিকাণ্ড অধিকাংশ ঘটেছে বনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে। খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে কখনও আগুন লাগেনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাছ ও কাঁকড়া ধরা, মধু আহরণ, গোলপাতা কাটাসহ বনজ সম্পদ আহরণে সুন্দরবনে যান বনজীবীরা। তাদের ফেলে দেয়া বিড়ি-সিগারেটের আগুন থেকে বনে আগুন লাগে। মধু সংগ্রহের পর মৌয়ালদের ফেলে দেয়া মশাল থেকেও আগুন লাগে। মাছ ধরার সুবিধার্থেও বেশ কয়েকবার আগুন লাগিয়েছে স্থানীয় কিছুলোক। এসব ঘটনায় একাধিক মামলাও হয়েছে কিন্তু জড়িতদের বেশিরভাগই ধরা পড়েনি।

স্থানীয়রা জানান, দাসের ভারানি, নাংলি ও ধানসাগরসহ কয়েকটি এলাকায় বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা হয়। সেখানে বর্ষাকালে শিং মাছসহ বিভিন্ন রকমের মাছ পাওয়া যায়। গাছপালা-লতাগুল্ম না থাকলে মাছ ধরতে সুবিধা হয়। তাই একটি অসাধুচক্র আগুন লাগিয়ে গাছপালা-লতাগুল্ম পরিষ্কার করে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার জানান, ইতোপূর্বে মানুষের কারণে আগুন লাগার কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে এবার আগুন লেগেছে প্রাকৃতিক কারণে।

তিনি বলেন, বনের মধ্যে গাছের পাতা পড়ে পুরু স্তর তৈরি হয়, জোয়ারের পানিতে ওই পাতা পচে যায়। এর ফলে পাতার মধ্যে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়। সেই মিথেন থেকেই এবার আগুন লেগেছে।

সর্বশেষ গত ৩ মে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লাগে। দুর্গম এলাকা হওয়ায় ঘটনাস্থলে পৌঁছতে বিড়ম্বনায় পড়ে ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া পানির অভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বনের ধানসাগর এলাকায় আগুন লেগেছিল।

প্রতিটি ঘটনার পর বন বিভাগ তদন্ত কমিটি গঠন করে। এসব তদন্ত কমিটি গত দুই দশকে যেসব সুপারিশ করেছে তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল- বনরক্ষীদের টহল কার্যক্রম জোরদার, তিনটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি, সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় নাইলনের দড়ি দিয়ে বেড়া নির্মাণ, আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগের জনবল বাড়ানো, রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণ, বনসংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা নদী, ৪০ কিলোমিটার খাল ও তিনটি পুকুর পুনঃখনন। আগুন লাগা প্রতিরোধে বন বিভাগ সচেতনতা তৈরির জন্য মাইকিং করে কিন্তু এর বাইরে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে বন বিভাগের দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম নেই।

সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির খুলনা শাখার সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, আগুন প্রতিরোধে বন বিভাগের উদাসীনতা রয়েছে।

সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, আগুন প্রতিরোধে বন বিভাগের তেমন কোন পদক্ষেপ নেই। বিষয়টি সবচেয়ে উদ্বেগজনক।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, আগুন যাতে না লাগে সেজন্য তাদের কোন পদক্ষেপ নেই।

উদাসীনতার অভিযোগ অস্বীকার করে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, মাছ ধরার সুবিধার্থে এর আগে যারা আগুন লাগিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে বন বিভাগের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছিল। তাদের বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

তিনি জানান, বন বিভাগের নিজস্ব কোন অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। আগুন লাগলে তারা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেন। এছাড়া তারা যেখানে আগুন লেগেছে তার চারপাশে দ্রুত ফায়ার লাইন কাটেন, যাতে আগুন আর বাইরে ছড়াতে না পারে।

ফায়ার সার্ভিসের খুলনার উপপরিচালক মো. আকরাম হোসেন বলেন, বনসংলগ্ন শরণখোলা ও শ্যামনগরে দুটি রিভার ফায়ার স্টেশন নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে।

খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খান বলেন, যে এলাকাগুলোতে বারবার আগুন লাগছে, সেখানকার নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় লোকজন সহজেই বনের মধ্যে ঢুকতে পারছে। অনেক সময় তাদের বিড়ি-সিগারেটের উচ্ছিষ্টাংশ থেকে আগুন লাগছে।

তিনি আরও বলেন, আগুন লাগা প্রতিরোধের জন্য সুন্দরবনে বনজীবীদের প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন তাদের বিকল্প জীবিকায়ন। সে উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য বন অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। নাইলনের দড়ি দিয়ে বেড়া নির্মাণের বিষয়টি আরেকটি প্রকল্পের আওতায় পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, আগুন লাগা প্রতিরোধে সুন্দরবনের লোকালয় সংলগ্ন যেসব নদী-খাল ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো শুষ্ক মৌসুমের সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় পুনঃখনন করা হবে।