সালাম জুবায়ের
দৈনিক পত্রিকা হিসেবে সংবাদ যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৫১ সালের ১৭ মে। কাল পরিক্রমায় আজ সংবাদ তার জীবনের ৭০ বছর পেরিয়ে ৭১ বছরে পা রাখল। এ ৭০ বছরের পথ চলায় সংবাদের মুকুটে যুক্ত হয়েছে সাফল্যের অনেক সোনালি পালক। সংবাদের এ সাফল্যগুলোকে মূল্যায়ন করতে অনেক গবেষণা প্রয়োজন। তবে কোন গবেষণায় না গিয়ে সাধারণ সংবাদপত্র পাঠকের সাদা চোখে দেখলে বলা যায়Ñ সংবাদের এ সাফল্যের সবচেয়ে বড় বিষয় হলো তার আদর্শের চেতনায় অবিনশ্বর অবস্থান। আর এ আদর্শ ছিল মুক্তবুদ্ধির বিকাশ, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পথ চলা। যাত্রা শুরুর বছর কয়েক পর থেকে সংবাদ এ আদর্শ-চেতনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে, অনন্তকাল চলবেÑ এমন প্রত্যাশা সংবাদের অতি সাধারণ এবং বোদ্ধা পাঠকদের।
সংবাদ সংবাদপত্র হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল সাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে। জন্মলগ্ন ১৯৫১ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত সংবাদ ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের মুখপত্র। কিন্তু ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগ গো-হারা হেরে যখন প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় তখন সংবাদেরও ক্ষমতা বদল হয়ে যায়। সংবাদ চলে আসে তখনকার ডাকসাইটে শিল্পোদ্যোক্তা এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শে অভিষিক্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আহমদুল কবিরের হাতে। আহমদুল কবির দায়িত্ব নিয়েই সংবাদকে প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শ থেকে প্রগতিশীল আদর্শে অভিষিক্ত করেন। সংবাদ হয়ে ওঠে মুক্তবুদ্ধির বিকাশ, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাসিক্ত সংবাদপত্র। তারপর একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা লাভের পর সংবাদের আদর্শের পথচলায় যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শ। আহমদুল কবির সংবাদে যে আদর্শ ও চেতনা নিজে প্রজ্বলিত করেছিলেন তা তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যেমন তেমনি তার পরিবারের উত্তরপ্রজন্ম স্বমহিমায় এবং গৌরবের সঙ্গে সংবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
দীর্ঘ ৭০ বছরের পদচলার পর শুধু নয়, ’৫৪ সালে সংবাদের নবযাত্রার শুরুতেও বাংলাদেশের সংবাদপত্রের যে আধুনিক ধারা, সংবাদ প্রকাশের বস্তুনিষ্ঠতা বা ব্যবসায়িক চিন্তার বাইরে সংবাপত্রের মাধ্যমে জাতির মনন গঠনের যে ধারণা প্রচলন ঘটেছে তা দৈনিক সংবাদের মাধ্যমেই হয়েছে। যদিও পরবর্তী প্রজন্ম এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন বা নতুনত্ব এনেছে। কিন্তু এটা পরম সত্য যে, সংবাদের দেখানো পথ বেয়েই বাংলাদেশে একদিকে সাংবাদিকতা, অন্যদিকে সংবাদপত্রের নিজস্ব ধারা গড়ে উঠেছে।
’৪৭ পরবর্তী সময়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সংবাদপত্রের নতুন ধারা সৃষ্টি এবং এগিয়ে নেয়ার আগে এ অঞ্চলে দৈনিক সংবাদপত্র ছিল কলকাতাভিত্তিক সংবাদপত্রের সংবাদ পরিবেশন ধারার অনেকটা অনুকরণ-অনুসরণ। সে ধারা থেকে বেরিয়ে আসা এবং স্বদেশী সংস্কৃতির শিকড় সমৃদ্ধ করার মানসিকতায় যে পথ চলা শুরু হয়েছিল সে পথ দেখিয়েছিল সংবাদই। সংবাদের এ অবদান এবং অবস্থান নিয়ে অতীতে অনেক কথা হয়েছে, বিশ্লেষণও কম হয়নি। হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু সংবাদপত্র জগতে সংবাদ যে প্রবাদপ্রতিম ভূমিকা পালন করেছে, অবধান রেখেছে তা নিয়ে দ্বিমত করার কোন কারণ নেই বলে জোর দিয়ে বলা যায়। সংবাদ যে অবস্থান তৈরি করেছে একদল মেধাবী ও সৃষ্টিশীল সাংবাদিকের শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে তার কোন বিকল্প ছিল না। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার প্রথম যুগে দৈনিক সংবাদ আধুনিক সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাকে পথ দেখিয়েছে। অন্যভাবে; সংবাদের আলোয় আলোকিত হয়েছে বাংলাদেশের আধুনিক সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা। আর সংবাদের সে দীপ্তি ও প্রখরতা যে দীর্ঘ জীবন লাভ করেছে তার প্রমাণ এখনকার সংবাদ।
সংবাদের অনেক কিছুই আগের মতো নেই। যুগের সঙ্গে, সময়ের নানা ঘটনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বা আধুনিকতাকে ধরে রাখতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু যে ধারা সংবাদের মাধ্যমে অঙ্কুুরিত হয়েছিল তার আলো এখনও ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাসের পাতায় পাতায়। এর পাশাপাশি আরেকটি তথ্য সংযোজন করা অত্যাবশ্যক, তা হচ্ছে দৈনিক সংবাদ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একটি কথা প্রথমেই বলতে হয় বা শুনতে হয়, তা হলো দৈনিক সংবাদ তার দীর্ঘ চলার পথে সব সময়ই সবচেয়ে মর্যাদাকর ঘটনা এবং প্রতিভাদীপ্ত মানুষের সঙ্গে থেকেছে। পেশাগত আলো ছড়ানোর পেছনে এসব ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা এবং মেধা সম্পন্ন মানুষের কর্মকা- প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে, পরবর্তী যুগে যদিও অন্য অনেক পত্রিকা এবং অনলাইন শুরু হওয়ার পর এ জগতের অনেক কিছুই নতুন ভাব ও অভিধা পেয়েছে।
সংবাদের জন্মকালে সেই ১৯৫১ সালে বাংলাদেশে, কলকাতা থেকে আনন্দবাজার এবং অন্য দু-একটি পত্রিকা ডাকে আসত। আর ছিল কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকা। এর মধ্যদিয়েই বাংলাদেশÑ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্র পাঠকদের চাহিদা পূরণ হতো। দৈনিক সংবাদপত্র হিসেবে সংবাদ প্রকাশের বছর পাঁচ পর সেই অবস্থা আমূল পাল্টে যায়। আহমদুল কবির দায়িত্ব নিয়েই সংবাদের খোলনলচে পাল্টে ফেলেন। এই পাল্টে ফেলার পেছনে তার রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শন কাজ করেছে। আহমদুল কবির মূলত ছিলেন বাম ঘরানার প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত এবং একজন আধুনিক মানুষ। এ অর্জন তার ছিল উচ্চমার্গের পড়াশোনা এবং সাধারন মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের মানসিকতা থেকে উদ্ভূত। তিনি যে কতটা মেধাবী ও আধুনিক মানসিকতাসম্পন্ন ছিলেন তা অনুধাবন করা যায় সেই সময়ে তার রাজনৈতিক অর্জন বিশ্লেষণ করলে। তিনি তার মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনযাপনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের প্রথম সহ-সভাপতি হওয়ার গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা তার জীবনের একটি বিরল অধ্যায়। আহমদুল কবির একটি জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও তার মধ্যে বাম প্রগতিশীল এবং সমাজের অবহেলিত মেহনতি মানুষের ভালো জীবনযাপন প্রাপ্তির চিন্তা স্থান করে নিয়েছিল। তার এই আদর্শ দেশের নানা উত্থান-পতনের পরও অব্যাহত ছিল মৃত্যু পর্যন্ত। বিলাসী জীবন ত্যাগ করে তিনি সাধারণ জীবনযাপন করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি অসাধারণ উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। এটা যেমন তার জীবনযাপন বিশ্লেষণ করে বলা যায়, তেমনি দৈনিক সংবাদ পরিচালনার ক্ষেত্রে বলা যায়। সবখানেই ছিল তার ভিন্নধর্মী আদর্শবাদিতা। তিনি এভাবে নির্লোভ ও আদর্শবাদী জীবনের দিকে নিজেকে ধাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই তিনি বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের দিকপাল হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। আর সংবাদ বাংলাদেশের সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি নতুন রূপ দিতে পেরেছিল। এ নতুন রূপটি হলো, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের সংবাদপত্র পড়ার সংস্কৃতিকে আরও বিস্তৃত করে সাধারণ মানুষের সংগ্রামশীল জীবন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার মুখপত্র হিসেবে তুলে ধরা। এ অসাধারণ কাজটি করেছিল সেই সময়ে একমাত্র সংবাদ। ফলে তখন দৈনিক সংবাদ হয়ে উঠে পথপ্রদর্শক। এখানে সংবাদের কৃতিত্ব যে, পরে অন্য সংবাদপত্রগুলোও প্রায় একই ধরনের পথে চলা শুরু করে।
সোমবার, ১৭ মে ২০২১ , ৩০ বৈশাখ ১৪২৮ ৩০ রমজান ১৪৪২
সালাম জুবায়ের
দৈনিক পত্রিকা হিসেবে সংবাদ যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৫১ সালের ১৭ মে। কাল পরিক্রমায় আজ সংবাদ তার জীবনের ৭০ বছর পেরিয়ে ৭১ বছরে পা রাখল। এ ৭০ বছরের পথ চলায় সংবাদের মুকুটে যুক্ত হয়েছে সাফল্যের অনেক সোনালি পালক। সংবাদের এ সাফল্যগুলোকে মূল্যায়ন করতে অনেক গবেষণা প্রয়োজন। তবে কোন গবেষণায় না গিয়ে সাধারণ সংবাদপত্র পাঠকের সাদা চোখে দেখলে বলা যায়Ñ সংবাদের এ সাফল্যের সবচেয়ে বড় বিষয় হলো তার আদর্শের চেতনায় অবিনশ্বর অবস্থান। আর এ আদর্শ ছিল মুক্তবুদ্ধির বিকাশ, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পথ চলা। যাত্রা শুরুর বছর কয়েক পর থেকে সংবাদ এ আদর্শ-চেতনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে, অনন্তকাল চলবেÑ এমন প্রত্যাশা সংবাদের অতি সাধারণ এবং বোদ্ধা পাঠকদের।
সংবাদ সংবাদপত্র হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল সাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে। জন্মলগ্ন ১৯৫১ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত সংবাদ ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের মুখপত্র। কিন্তু ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগ গো-হারা হেরে যখন প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় তখন সংবাদেরও ক্ষমতা বদল হয়ে যায়। সংবাদ চলে আসে তখনকার ডাকসাইটে শিল্পোদ্যোক্তা এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শে অভিষিক্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আহমদুল কবিরের হাতে। আহমদুল কবির দায়িত্ব নিয়েই সংবাদকে প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শ থেকে প্রগতিশীল আদর্শে অভিষিক্ত করেন। সংবাদ হয়ে ওঠে মুক্তবুদ্ধির বিকাশ, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাসিক্ত সংবাদপত্র। তারপর একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা লাভের পর সংবাদের আদর্শের পথচলায় যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শ। আহমদুল কবির সংবাদে যে আদর্শ ও চেতনা নিজে প্রজ্বলিত করেছিলেন তা তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যেমন তেমনি তার পরিবারের উত্তরপ্রজন্ম স্বমহিমায় এবং গৌরবের সঙ্গে সংবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
দীর্ঘ ৭০ বছরের পদচলার পর শুধু নয়, ’৫৪ সালে সংবাদের নবযাত্রার শুরুতেও বাংলাদেশের সংবাদপত্রের যে আধুনিক ধারা, সংবাদ প্রকাশের বস্তুনিষ্ঠতা বা ব্যবসায়িক চিন্তার বাইরে সংবাপত্রের মাধ্যমে জাতির মনন গঠনের যে ধারণা প্রচলন ঘটেছে তা দৈনিক সংবাদের মাধ্যমেই হয়েছে। যদিও পরবর্তী প্রজন্ম এ ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন বা নতুনত্ব এনেছে। কিন্তু এটা পরম সত্য যে, সংবাদের দেখানো পথ বেয়েই বাংলাদেশে একদিকে সাংবাদিকতা, অন্যদিকে সংবাদপত্রের নিজস্ব ধারা গড়ে উঠেছে।
’৪৭ পরবর্তী সময়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সংবাদপত্রের নতুন ধারা সৃষ্টি এবং এগিয়ে নেয়ার আগে এ অঞ্চলে দৈনিক সংবাদপত্র ছিল কলকাতাভিত্তিক সংবাদপত্রের সংবাদ পরিবেশন ধারার অনেকটা অনুকরণ-অনুসরণ। সে ধারা থেকে বেরিয়ে আসা এবং স্বদেশী সংস্কৃতির শিকড় সমৃদ্ধ করার মানসিকতায় যে পথ চলা শুরু হয়েছিল সে পথ দেখিয়েছিল সংবাদই। সংবাদের এ অবদান এবং অবস্থান নিয়ে অতীতে অনেক কথা হয়েছে, বিশ্লেষণও কম হয়নি। হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু সংবাদপত্র জগতে সংবাদ যে প্রবাদপ্রতিম ভূমিকা পালন করেছে, অবধান রেখেছে তা নিয়ে দ্বিমত করার কোন কারণ নেই বলে জোর দিয়ে বলা যায়। সংবাদ যে অবস্থান তৈরি করেছে একদল মেধাবী ও সৃষ্টিশীল সাংবাদিকের শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে তার কোন বিকল্প ছিল না। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার প্রথম যুগে দৈনিক সংবাদ আধুনিক সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাকে পথ দেখিয়েছে। অন্যভাবে; সংবাদের আলোয় আলোকিত হয়েছে বাংলাদেশের আধুনিক সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতা। আর সংবাদের সে দীপ্তি ও প্রখরতা যে দীর্ঘ জীবন লাভ করেছে তার প্রমাণ এখনকার সংবাদ।
সংবাদের অনেক কিছুই আগের মতো নেই। যুগের সঙ্গে, সময়ের নানা ঘটনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বা আধুনিকতাকে ধরে রাখতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু যে ধারা সংবাদের মাধ্যমে অঙ্কুুরিত হয়েছিল তার আলো এখনও ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাসের পাতায় পাতায়। এর পাশাপাশি আরেকটি তথ্য সংযোজন করা অত্যাবশ্যক, তা হচ্ছে দৈনিক সংবাদ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একটি কথা প্রথমেই বলতে হয় বা শুনতে হয়, তা হলো দৈনিক সংবাদ তার দীর্ঘ চলার পথে সব সময়ই সবচেয়ে মর্যাদাকর ঘটনা এবং প্রতিভাদীপ্ত মানুষের সঙ্গে থেকেছে। পেশাগত আলো ছড়ানোর পেছনে এসব ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা এবং মেধা সম্পন্ন মানুষের কর্মকা- প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে, পরবর্তী যুগে যদিও অন্য অনেক পত্রিকা এবং অনলাইন শুরু হওয়ার পর এ জগতের অনেক কিছুই নতুন ভাব ও অভিধা পেয়েছে।
সংবাদের জন্মকালে সেই ১৯৫১ সালে বাংলাদেশে, কলকাতা থেকে আনন্দবাজার এবং অন্য দু-একটি পত্রিকা ডাকে আসত। আর ছিল কিছু সাপ্তাহিক পত্রিকা। এর মধ্যদিয়েই বাংলাদেশÑ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্র পাঠকদের চাহিদা পূরণ হতো। দৈনিক সংবাদপত্র হিসেবে সংবাদ প্রকাশের বছর পাঁচ পর সেই অবস্থা আমূল পাল্টে যায়। আহমদুল কবির দায়িত্ব নিয়েই সংবাদের খোলনলচে পাল্টে ফেলেন। এই পাল্টে ফেলার পেছনে তার রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শন কাজ করেছে। আহমদুল কবির মূলত ছিলেন বাম ঘরানার প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত এবং একজন আধুনিক মানুষ। এ অর্জন তার ছিল উচ্চমার্গের পড়াশোনা এবং সাধারন মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের মানসিকতা থেকে উদ্ভূত। তিনি যে কতটা মেধাবী ও আধুনিক মানসিকতাসম্পন্ন ছিলেন তা অনুধাবন করা যায় সেই সময়ে তার রাজনৈতিক অর্জন বিশ্লেষণ করলে। তিনি তার মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনযাপনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের প্রথম সহ-সভাপতি হওয়ার গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা তার জীবনের একটি বিরল অধ্যায়। আহমদুল কবির একটি জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও তার মধ্যে বাম প্রগতিশীল এবং সমাজের অবহেলিত মেহনতি মানুষের ভালো জীবনযাপন প্রাপ্তির চিন্তা স্থান করে নিয়েছিল। তার এই আদর্শ দেশের নানা উত্থান-পতনের পরও অব্যাহত ছিল মৃত্যু পর্যন্ত। বিলাসী জীবন ত্যাগ করে তিনি সাধারণ জীবনযাপন করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি অসাধারণ উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। এটা যেমন তার জীবনযাপন বিশ্লেষণ করে বলা যায়, তেমনি দৈনিক সংবাদ পরিচালনার ক্ষেত্রে বলা যায়। সবখানেই ছিল তার ভিন্নধর্মী আদর্শবাদিতা। তিনি এভাবে নির্লোভ ও আদর্শবাদী জীবনের দিকে নিজেকে ধাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই তিনি বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের দিকপাল হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। আর সংবাদ বাংলাদেশের সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি নতুন রূপ দিতে পেরেছিল। এ নতুন রূপটি হলো, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের সংবাদপত্র পড়ার সংস্কৃতিকে আরও বিস্তৃত করে সাধারণ মানুষের সংগ্রামশীল জীবন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার মুখপত্র হিসেবে তুলে ধরা। এ অসাধারণ কাজটি করেছিল সেই সময়ে একমাত্র সংবাদ। ফলে তখন দৈনিক সংবাদ হয়ে উঠে পথপ্রদর্শক। এখানে সংবাদের কৃতিত্ব যে, পরে অন্য সংবাদপত্রগুলোও প্রায় একই ধরনের পথে চলা শুরু করে।