হারিয়ে গেছে ঢাকার ১০ খাল

খালের নামে সড়ক, বৃষ্টি হলেই জলাবব্ধতা

বক্স কালভার্ট : দ্বিতীয় পর্ব

ভরাট, দখল ও দূষণের শিকার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার খাল ও নদীগুলো। খালগুলো পরিণত হয়েছে নর্দমায়। নদী হয়ে গেছে খাল। ঢাকায় কয়টি খাল ছিল তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। সরকারি এক একটি সংস্থা এক এক রকম তথ্য। কেউ বলছে ৫১টি, কেউ বলছে ৪৬টি, কেউ বলছে ৩২টি খাল। এছাড়া ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু ও ধলেশ্বরী নদীর পানি হয়ে গেছে ময়লা ও দুর্গন্ধ যুক্ত। খালের উপরে বক্স কালভার্টের মাধ্যমে সড়ক নির্মাণের কারণে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

খাল এখন সড়ক, বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) প্রকল্প। ১৯৬৪ সালে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরকে বন্যা থেকে রক্ষা, পানি নিষ্কাশন ও সেচ কাজের জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। চারবছর পর ১৯৬৮ সালে প্রকল্পটি শেষ হয়। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা-যাত্রাবাড়ী সড়কটি ডিএনডি বাঁধ নামে পরিচিত। এই সড়কের কাজলার পাড় খালের উপর একটি সেতু ছিল।

খালটি ব্যবহার করে নৌকা যোগে কুতুবখালী দিয়ে ধোলাইরপাড় হয়ে পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করত স্থানীয়রা। সেই খাল এখন কাজলা-কুতুবখালী সড়ক হিসেবে পরিচিত। ধোলাইখাল ও দয়াগঞ্জ খাল এখন ভরাট হয়ে ধোলাইখাল-দয়াগঞ্জ-মীরহাজীরবাগ সড়কে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টি হলেই এসব সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

ধোলাইখাল-১ দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু থেকে উৎপত্তি হয়ে ধোলাইখাল-২ পর্যন্ত, ধোলাইখাল-২ বুড়িগঙ্গার নদী হতে উৎপত্তি হয়ে সূত্রাপুর, গে-ারিয়া, দয়াগঞ্জ, ওয়ারী শহর হয়ে দয়াগঞ্জ বাজার পর্যন্ত ছিল। এই খাল দু’টির একটি অংশ পুরান ঢাকার বেগমগঞ্জ, রায়সাহেবের বাজার ও বাবুবাজার দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে মিলিত হয়েছে। এই খালটি ধোলাইখাল-১ নামে পরিচিত। অপর অংশটি দয়াগঞ্জ, মীরহাজিরবাগ, ধোলাইপাড়, কুতুরখালী ও কাজলাপাড় হয়ে মুগদা খালের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই খালটি ধোলাইখাল-২ নামে পরিচিত। ঢাকা জেলা প্রশাসনের তফসিলে ধোলাইখাল মৌজায় এই খালটি অবস্থিত। সিটি জরিপ অনুযায়ী ১৩৫৪৬, ১৩৫৫৩, ১৩৫৫৪ ও ১৩৪৫৭ দাগ নম্বরে খালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু কত কিলোমিটার ও জমির পরিমাণ কত তা উল্লেখ করা হয়নি। অবৈধ দখলদারদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে কিন্তু কতজন দখলদার রয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনে। বাস্তবে ধোলাইখালের কোন অস্তিত্ব নেই। বক্স কালভার্টের মাধ্যমে খালটি এখন ধোলাইখাল-দয়াগঞ্জ-সূত্রাপুর সড়কে পরিণত হয়েছে। ১০ কিলোমিটারের দীর্ঘ ছিল ধোলাইখালটি। বর্তমানে খালের কিছু অংশ উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে সূত্রাপুরের নারিন্দায় খোকা মাঠের পাশে সিএনবি পুকুর। ধোলাইরপাড়-কুতুবখালী ও কাজলাপাড় অংশের প্রায় ৪ কিলোমিটার নর্দমা ও ড্রেনে পরিণত হয়েছে। ধোলাইরপাড় চৌরাস্তার পূর্বদিক থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীর আগে ২ কিলোমিটার উন্মুক্ত নর্দমা। ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ রয়েছে। তাই বর্ষার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে এই এলাকায় হাঁটুপানি, কোথাও কোমর পানির জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

এ বিষয়ে ধোলাইরপাড়ের স্থানীয় বাসিন্দা আসলাম মিয়া সংবাদকে বলেন, ‘এই খালটির কারণে আমাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মূল ধোলাইখাল বন্ধ হওয়ার কারণে এই খালটিও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলে খালটি পানি নষ্ট হয়ে গেছে। ধোলাইরপাড় এলাকায় ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের নিচ দিয়ে পাইপ দেয়া আছে কিন্তু বৃষ্টি হলে পানি চাপ বেড়ে যায়। ময়লা-আবর্জনার কারণে পাইপের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর মহাসড়ক কুতুবখালীর অংশেও বড় পাইপ দেয়া আছে। তাতে কাজ হয় না। পানি দ্রুত সরে না। বেশি বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।’

ধোলাইখালের কুতুবখালী থেকে কাজলাপাড় পর্যন্ত ৫০০ মিটার অংশে বক্স কালভার্ট দিয়ে কুতুবখালী সড়কটি তৈরি করা হয়েছে। এই এলাকাও অতি বৃষ্টিপাতে জলাদ্ধতা সৃষ্টি হয় কিন্তু কাজলাপাড় অংশে উন্মুক্ত নর্দমা থাকায় পানি দ্রুত নেমে যায় বলে স্থানীয়রা জানান।

এ বিষয়ে আব্দুস সাত্তার নামের স্থানীয় বাসিন্দা সংবাদকে বলেন, ‘১৯৮৬ সালেও কুতুবখালী থেকে নৌকায় সদরঘাটে যাতায়াত করা হতো। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের আমলে গুলিস্তান থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত ঢাকা রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তখনও এই এলাকায় নৌকা চলাচল করত। পুরো এলাকাটি একটি বিল ছিল। ঢাকার শহরের সব ময়লা এই এলাকায় ফেলা হতো। ময়লা ফেলে এই এলাকা উঁচু করে যাত্রাবাড়ীর কাঁচাবাজার আড়ত তৈরি করা হয়। এরপর ২০০০ সালে খালের ওপর বক্স কালভার্ট দিয়ে এই কুতুবখালী সড়ক তৈরি করা হয়। বেশি বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।’

কাজলা খাল এখন ময়লার ড্রেন

ডেমরা-সারুলিয়া সড়কের কাজলাপাড় মোড় থেকে উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়েছে ধোলাইখালের এই অংশটি কাজলাখাল। কাজলাপাড় দিয়ে খালটি মুগদা খালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কাজলার অংশে এই খালটির নাম কাজলা খাল হিসেবে পরিচিত। দেড় থেকে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ খালটির দুই পাড় ভরাট করে তৈরি হয়েছে সড়ক, দোকানপাট ও ঘরবাড়ি। এসব স্থাপনার বেশিরভাগই খালের জায়গা ভরাট করে অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলে খালটি নর্দমায় পরিণত করা হয়েছে। খালটিতে ময়লাযুক্ত কালো রঙের পানি প্রবাহ থাকলেও মাঝে মধ্যে পাইপ দিয়ে কালভার্ট তৈরির কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই অতি বৃষ্টিপাত হলে সড়ক ও বাসাবাড়িতে ময়লা পানি প্রবেশ করে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

এ বিষয়ে কাজলাপাড়ের বাসিন্দা আব্দুস সবুর সংবাদকে বলেন, ‘ছোট সময় থেকে আমরা খালটি ব্যবহার করতাম। এই খালে মাছ ধরা ও নৌকা চালানোর অনেক স্মৃতি আমার মনে আছে। ডিএনডি বাঁধ নির্মাণের পর এই এলাকায় বসতি নির্মাণ শুরু হয়। এর আগে এই এলাকায় তেমন ঘরবাড়ি ছিল না। খালটি ধোলাইখালের শাখা খাল। এই এলাকায় কাজলার খাল হিসেবে পরিচিত। এটি কাজলারপাড় দিয়ে মুগদা খালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে মিলিত হয়েছে। এখনও বর্ষার সময় এই খালে জোয়ার আসে কিন্তু ময়লা-আবর্জনা ফেলে খালটি ভরা হয়ে যাচ্ছে।’ তাই খালটি সংস্কার করে পানি প্রবাহ সৃষ্টি করলে পুরো যাত্রাবাড়ী এলাকার জলাবদ্ধতা অনেকটা নিরসন হতো বলে মনে করেন তিনি।

স্থানীয়রা জানান, পুরান ঢাকার অন্যতম বিনোদন ছিল ধোলাইখালে নৌকাবাইচ কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে এটা এখন রূপকথার গল্প মনে হচ্ছে। বক্স কালভার্টের কারণে খালটি এখন ধোলাই-দয়াগঞ্জ সড়কে পরিণত হয়েছে। এক সময় মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে ধোলাইখালের ওপর লোহারপুল তৈরি করা হয়। যেটি এখন গে-ারিয়ার লোহারপুল এলাকা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এখানে পুলও নেই, খালও নেই। বর্তমানে সেখানে ঢাকা সিটি করপোরেশন বক্স কালভার্টে সড়ক তৈরি করেছে। খালের যেটুকু অংশ আছে তা বর্তমানে ডোবা হিসেবেই পরিচিত। ধোলাইখালের একটি শাখা ছিল দয়াগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী হয়ে সায়েদাবাদ ব্রিজ দিয়ে ধলপুর হয়ে ডিএনডি অঞ্চলের নিম্ন এলাকার সঙ্গে মিশেছে। যেটি ধলপুর সুতিখালপাড় হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে সেখানে ঢাকা সিটি করপোরেশন রাস্তা তৈরি করেছে। গত ২০ বছর আগেও এখানে খাল ছিল। খাল ভরাট করে সড়ক তৈরির কারণে এই এলাকায় জলাবদ্ধতার জন্য দুর্ভোগের শিকার হতে হয় জানান পুরান ঢাকাবাসী।

১০টি খালের অস্তিত্ব নেই

বক্স কালভার্ট সড়কের কারণে ১০টি খালের এখন অস্তিত্ব নেই। শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত একটি খাল ছিল। ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে এর নাম পরীবাগ খাল। তবে সেখানে গিয়ে দেখা গেল খালের কোন চিহ্ন নেই। সেখানে এখন সোনারগাঁও সড়ক। পরীবাগ খালের মতোই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঢাকার ১০টি খাল। এর মধ্যে পরীবাগ খাল, ধোলাইখাল, রায়েরবাজার খাল, আরামবাগ খাল, গোপীবাগ খাল, সেগুনবাগিচা খাল, গোবিন্দপুর খাল, কাঁঠাল বাগান খাল, নারিন্দা খাল, ধানমন্ডি খালের কোন অস্তিত্ব নেই।

স্থানীয়রা জানান, পান্থপথের পিচঢালা সড়কের নিচে চাপা পড়ে আছে একটি বিশাল খাল ও জলাভূমি। যেখানে ধানমন্ডি খাল দিয়ে এই এলাকার পানি নিষ্কাশিত হয়ে পান্থপথ হয়ে বেগুনবাড়ী খালে পড়ত। বর্ষায় পান্থপথ খালে সাঁতার কেটে এপার থেকে ওপার যাওয়া খুব সহজ ছিল না। আধুনিকতার নামে পান্থপথে বর্তমানে সড়ক ও বড় বড় অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবাই যায় না এখানে এক সময় নৌকা চলাচল করত বা সাঁতার কাঁটা যেত।

জানা গেছে, প্রায় এক যুগ আগে শাহবাগ থেকে উৎপত্তি হয়ে বড় মগবাজার পর্যন্ত পরীবাগ খাল, কাঁটাসুর খাল হতে উৎপত্তি হয়ে সরাই জাফরাবাদ ও সুলতানগঞ্জ মৌজার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রায়েরবাজারের বেড়িবাঁধ পর্যন্ত রায়েরবাজার খাল, বিজয়নগর পানির ট্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত আরামবাগ খাল এবং গোপীবাগ থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছন দিয়ে আরামবাগ খাল পর্যন্ত গোপীবাগ খাল ছিল। সময়ের ব্যবধানে খালগুলো সড়কে পরিণত হয়েছে। রাজাবাজার খালটি রাজাবাজার পশ্চিম পাশ থেকে হোটেল সুন্দরবন পর্যন্ত ছিল। যা এখন বক্স কালভার্ট সড়ক। এছাড়া ধানমন্ডি খাল ও নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খালে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমান মৎস্য ভবন থেকে সেগুনবাগিচা মসজিদ হয়ে বিজয়নগর, পুরানা পল্টন দিয়ে আরামবাগ, নটরডেম কলেজের পেছন দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছন দিয়ে দক্ষিণ কমলাপুর হয়ে গোপীবাগ পর্যন্ত দীর্ঘ একটি খাল ছিল যা বর্তমানে বক্স কালভার্ট তৈরি করে রাস্তা করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

খাল উদ্ধারের বিষয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ওয়াসার নিকট হতে খাল হস্তান্তরের পর থেকেই ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দুই মেয়র খালসমূহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছেন। শুধু তাই নয় যারা এ সব খাল দখল করে দুই পাশে ভবন নির্মাণসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন সেগুলো অপসারণ করা হয়েছে।’ নগরীর সব খাল রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে দুই মেয়রকে নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

মঙ্গলবার, ১৮ মে ২০২১ , ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৫ শাওয়াল ১৪৪২

হারিয়ে গেছে ঢাকার ১০ খাল

খালের নামে সড়ক, বৃষ্টি হলেই জলাবব্ধতা

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

image

বক্স কালভার্ট : দ্বিতীয় পর্ব

ভরাট, দখল ও দূষণের শিকার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার খাল ও নদীগুলো। খালগুলো পরিণত হয়েছে নর্দমায়। নদী হয়ে গেছে খাল। ঢাকায় কয়টি খাল ছিল তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। সরকারি এক একটি সংস্থা এক এক রকম তথ্য। কেউ বলছে ৫১টি, কেউ বলছে ৪৬টি, কেউ বলছে ৩২টি খাল। এছাড়া ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু ও ধলেশ্বরী নদীর পানি হয়ে গেছে ময়লা ও দুর্গন্ধ যুক্ত। খালের উপরে বক্স কালভার্টের মাধ্যমে সড়ক নির্মাণের কারণে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

খাল এখন সড়ক, বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) প্রকল্প। ১৯৬৪ সালে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরকে বন্যা থেকে রক্ষা, পানি নিষ্কাশন ও সেচ কাজের জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। চারবছর পর ১৯৬৮ সালে প্রকল্পটি শেষ হয়। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা-যাত্রাবাড়ী সড়কটি ডিএনডি বাঁধ নামে পরিচিত। এই সড়কের কাজলার পাড় খালের উপর একটি সেতু ছিল।

খালটি ব্যবহার করে নৌকা যোগে কুতুবখালী দিয়ে ধোলাইরপাড় হয়ে পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করত স্থানীয়রা। সেই খাল এখন কাজলা-কুতুবখালী সড়ক হিসেবে পরিচিত। ধোলাইখাল ও দয়াগঞ্জ খাল এখন ভরাট হয়ে ধোলাইখাল-দয়াগঞ্জ-মীরহাজীরবাগ সড়কে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টি হলেই এসব সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

ধোলাইখাল-১ দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু থেকে উৎপত্তি হয়ে ধোলাইখাল-২ পর্যন্ত, ধোলাইখাল-২ বুড়িগঙ্গার নদী হতে উৎপত্তি হয়ে সূত্রাপুর, গে-ারিয়া, দয়াগঞ্জ, ওয়ারী শহর হয়ে দয়াগঞ্জ বাজার পর্যন্ত ছিল। এই খাল দু’টির একটি অংশ পুরান ঢাকার বেগমগঞ্জ, রায়সাহেবের বাজার ও বাবুবাজার দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে মিলিত হয়েছে। এই খালটি ধোলাইখাল-১ নামে পরিচিত। অপর অংশটি দয়াগঞ্জ, মীরহাজিরবাগ, ধোলাইপাড়, কুতুরখালী ও কাজলাপাড় হয়ে মুগদা খালের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই খালটি ধোলাইখাল-২ নামে পরিচিত। ঢাকা জেলা প্রশাসনের তফসিলে ধোলাইখাল মৌজায় এই খালটি অবস্থিত। সিটি জরিপ অনুযায়ী ১৩৫৪৬, ১৩৫৫৩, ১৩৫৫৪ ও ১৩৪৫৭ দাগ নম্বরে খালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু কত কিলোমিটার ও জমির পরিমাণ কত তা উল্লেখ করা হয়নি। অবৈধ দখলদারদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে কিন্তু কতজন দখলদার রয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনে। বাস্তবে ধোলাইখালের কোন অস্তিত্ব নেই। বক্স কালভার্টের মাধ্যমে খালটি এখন ধোলাইখাল-দয়াগঞ্জ-সূত্রাপুর সড়কে পরিণত হয়েছে। ১০ কিলোমিটারের দীর্ঘ ছিল ধোলাইখালটি। বর্তমানে খালের কিছু অংশ উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে সূত্রাপুরের নারিন্দায় খোকা মাঠের পাশে সিএনবি পুকুর। ধোলাইরপাড়-কুতুবখালী ও কাজলাপাড় অংশের প্রায় ৪ কিলোমিটার নর্দমা ও ড্রেনে পরিণত হয়েছে। ধোলাইরপাড় চৌরাস্তার পূর্বদিক থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীর আগে ২ কিলোমিটার উন্মুক্ত নর্দমা। ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ রয়েছে। তাই বর্ষার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে এই এলাকায় হাঁটুপানি, কোথাও কোমর পানির জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

এ বিষয়ে ধোলাইরপাড়ের স্থানীয় বাসিন্দা আসলাম মিয়া সংবাদকে বলেন, ‘এই খালটির কারণে আমাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মূল ধোলাইখাল বন্ধ হওয়ার কারণে এই খালটিও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলে খালটি পানি নষ্ট হয়ে গেছে। ধোলাইরপাড় এলাকায় ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের নিচ দিয়ে পাইপ দেয়া আছে কিন্তু বৃষ্টি হলে পানি চাপ বেড়ে যায়। ময়লা-আবর্জনার কারণে পাইপের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর মহাসড়ক কুতুবখালীর অংশেও বড় পাইপ দেয়া আছে। তাতে কাজ হয় না। পানি দ্রুত সরে না। বেশি বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।’

ধোলাইখালের কুতুবখালী থেকে কাজলাপাড় পর্যন্ত ৫০০ মিটার অংশে বক্স কালভার্ট দিয়ে কুতুবখালী সড়কটি তৈরি করা হয়েছে। এই এলাকাও অতি বৃষ্টিপাতে জলাদ্ধতা সৃষ্টি হয় কিন্তু কাজলাপাড় অংশে উন্মুক্ত নর্দমা থাকায় পানি দ্রুত নেমে যায় বলে স্থানীয়রা জানান।

এ বিষয়ে আব্দুস সাত্তার নামের স্থানীয় বাসিন্দা সংবাদকে বলেন, ‘১৯৮৬ সালেও কুতুবখালী থেকে নৌকায় সদরঘাটে যাতায়াত করা হতো। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের আমলে গুলিস্তান থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত ঢাকা রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তখনও এই এলাকায় নৌকা চলাচল করত। পুরো এলাকাটি একটি বিল ছিল। ঢাকার শহরের সব ময়লা এই এলাকায় ফেলা হতো। ময়লা ফেলে এই এলাকা উঁচু করে যাত্রাবাড়ীর কাঁচাবাজার আড়ত তৈরি করা হয়। এরপর ২০০০ সালে খালের ওপর বক্স কালভার্ট দিয়ে এই কুতুবখালী সড়ক তৈরি করা হয়। বেশি বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।’

কাজলা খাল এখন ময়লার ড্রেন

ডেমরা-সারুলিয়া সড়কের কাজলাপাড় মোড় থেকে উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়েছে ধোলাইখালের এই অংশটি কাজলাখাল। কাজলাপাড় দিয়ে খালটি মুগদা খালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কাজলার অংশে এই খালটির নাম কাজলা খাল হিসেবে পরিচিত। দেড় থেকে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ খালটির দুই পাড় ভরাট করে তৈরি হয়েছে সড়ক, দোকানপাট ও ঘরবাড়ি। এসব স্থাপনার বেশিরভাগই খালের জায়গা ভরাট করে অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে। ময়লা-আবর্জনা ফেলে খালটি নর্দমায় পরিণত করা হয়েছে। খালটিতে ময়লাযুক্ত কালো রঙের পানি প্রবাহ থাকলেও মাঝে মধ্যে পাইপ দিয়ে কালভার্ট তৈরির কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই অতি বৃষ্টিপাত হলে সড়ক ও বাসাবাড়িতে ময়লা পানি প্রবেশ করে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

এ বিষয়ে কাজলাপাড়ের বাসিন্দা আব্দুস সবুর সংবাদকে বলেন, ‘ছোট সময় থেকে আমরা খালটি ব্যবহার করতাম। এই খালে মাছ ধরা ও নৌকা চালানোর অনেক স্মৃতি আমার মনে আছে। ডিএনডি বাঁধ নির্মাণের পর এই এলাকায় বসতি নির্মাণ শুরু হয়। এর আগে এই এলাকায় তেমন ঘরবাড়ি ছিল না। খালটি ধোলাইখালের শাখা খাল। এই এলাকায় কাজলার খাল হিসেবে পরিচিত। এটি কাজলারপাড় দিয়ে মুগদা খালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে মিলিত হয়েছে। এখনও বর্ষার সময় এই খালে জোয়ার আসে কিন্তু ময়লা-আবর্জনা ফেলে খালটি ভরা হয়ে যাচ্ছে।’ তাই খালটি সংস্কার করে পানি প্রবাহ সৃষ্টি করলে পুরো যাত্রাবাড়ী এলাকার জলাবদ্ধতা অনেকটা নিরসন হতো বলে মনে করেন তিনি।

স্থানীয়রা জানান, পুরান ঢাকার অন্যতম বিনোদন ছিল ধোলাইখালে নৌকাবাইচ কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে এটা এখন রূপকথার গল্প মনে হচ্ছে। বক্স কালভার্টের কারণে খালটি এখন ধোলাই-দয়াগঞ্জ সড়কে পরিণত হয়েছে। এক সময় মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে ধোলাইখালের ওপর লোহারপুল তৈরি করা হয়। যেটি এখন গে-ারিয়ার লোহারপুল এলাকা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এখানে পুলও নেই, খালও নেই। বর্তমানে সেখানে ঢাকা সিটি করপোরেশন বক্স কালভার্টে সড়ক তৈরি করেছে। খালের যেটুকু অংশ আছে তা বর্তমানে ডোবা হিসেবেই পরিচিত। ধোলাইখালের একটি শাখা ছিল দয়াগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী হয়ে সায়েদাবাদ ব্রিজ দিয়ে ধলপুর হয়ে ডিএনডি অঞ্চলের নিম্ন এলাকার সঙ্গে মিশেছে। যেটি ধলপুর সুতিখালপাড় হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে সেখানে ঢাকা সিটি করপোরেশন রাস্তা তৈরি করেছে। গত ২০ বছর আগেও এখানে খাল ছিল। খাল ভরাট করে সড়ক তৈরির কারণে এই এলাকায় জলাবদ্ধতার জন্য দুর্ভোগের শিকার হতে হয় জানান পুরান ঢাকাবাসী।

১০টি খালের অস্তিত্ব নেই

বক্স কালভার্ট সড়কের কারণে ১০টি খালের এখন অস্তিত্ব নেই। শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত একটি খাল ছিল। ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে এর নাম পরীবাগ খাল। তবে সেখানে গিয়ে দেখা গেল খালের কোন চিহ্ন নেই। সেখানে এখন সোনারগাঁও সড়ক। পরীবাগ খালের মতোই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঢাকার ১০টি খাল। এর মধ্যে পরীবাগ খাল, ধোলাইখাল, রায়েরবাজার খাল, আরামবাগ খাল, গোপীবাগ খাল, সেগুনবাগিচা খাল, গোবিন্দপুর খাল, কাঁঠাল বাগান খাল, নারিন্দা খাল, ধানমন্ডি খালের কোন অস্তিত্ব নেই।

স্থানীয়রা জানান, পান্থপথের পিচঢালা সড়কের নিচে চাপা পড়ে আছে একটি বিশাল খাল ও জলাভূমি। যেখানে ধানমন্ডি খাল দিয়ে এই এলাকার পানি নিষ্কাশিত হয়ে পান্থপথ হয়ে বেগুনবাড়ী খালে পড়ত। বর্ষায় পান্থপথ খালে সাঁতার কেটে এপার থেকে ওপার যাওয়া খুব সহজ ছিল না। আধুনিকতার নামে পান্থপথে বর্তমানে সড়ক ও বড় বড় অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবাই যায় না এখানে এক সময় নৌকা চলাচল করত বা সাঁতার কাঁটা যেত।

জানা গেছে, প্রায় এক যুগ আগে শাহবাগ থেকে উৎপত্তি হয়ে বড় মগবাজার পর্যন্ত পরীবাগ খাল, কাঁটাসুর খাল হতে উৎপত্তি হয়ে সরাই জাফরাবাদ ও সুলতানগঞ্জ মৌজার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রায়েরবাজারের বেড়িবাঁধ পর্যন্ত রায়েরবাজার খাল, বিজয়নগর পানির ট্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত আরামবাগ খাল এবং গোপীবাগ থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছন দিয়ে আরামবাগ খাল পর্যন্ত গোপীবাগ খাল ছিল। সময়ের ব্যবধানে খালগুলো সড়কে পরিণত হয়েছে। রাজাবাজার খালটি রাজাবাজার পশ্চিম পাশ থেকে হোটেল সুন্দরবন পর্যন্ত ছিল। যা এখন বক্স কালভার্ট সড়ক। এছাড়া ধানমন্ডি খাল ও নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খালে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমান মৎস্য ভবন থেকে সেগুনবাগিচা মসজিদ হয়ে বিজয়নগর, পুরানা পল্টন দিয়ে আরামবাগ, নটরডেম কলেজের পেছন দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছন দিয়ে দক্ষিণ কমলাপুর হয়ে গোপীবাগ পর্যন্ত দীর্ঘ একটি খাল ছিল যা বর্তমানে বক্স কালভার্ট তৈরি করে রাস্তা করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

খাল উদ্ধারের বিষয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ওয়াসার নিকট হতে খাল হস্তান্তরের পর থেকেই ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দুই মেয়র খালসমূহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছেন। শুধু তাই নয় যারা এ সব খাল দখল করে দুই পাশে ভবন নির্মাণসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন সেগুলো অপসারণ করা হয়েছে।’ নগরীর সব খাল রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে দুই মেয়রকে নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।