মোস্তাফা জব্বার
এক ॥
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর খুনিরা কেবল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিই বাতিল করেনি, কালক্রমে দ্বিতীয় বিপ্লব বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি যে রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ ওরফে বাকশাল গঠন করেন তাকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি গালিতে পরিণত করেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ স্বনামে আবির্ভূত হয়। বাকশাল নামক একটি রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের মূল স্রোতের চাইতে স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিরুদ্ধাচরণকারীরা ক্ষমতায় থাকার ফলে, আওয়ামী লীগ বাকশাল ভুলে থাকারই চেষ্টা করে এবং ১৯৯৬ বা তার পরে সরকারে থেকেও বাকশাল বা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব বিষয়ে কোন আলোচনাই করেনি। এখনো বাকশাল বা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের আলোচিত বিষয় নয়। অতি সাম্প্রতিককালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির কথা বলেন এবং একটি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। নতুন বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের বিভিন্ন কর্মসূচির ইতিবাচক দিকগুলোও তুলে ধরেন। এটি নিশ্চত করেই বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু যদি তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারতেন তবে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা অনেক আগেই পেতাম। এমনকি বৈষম্য নামক কোন শব্দকেই রাষ্ট্রের কোথাও খুঁজে পেতাম না। বাংলাদেশের অগ্রগতিকেও আজ ২১ সালে উন্নয়নশীল দেশের হিসাব করতে হতো নাÑ এটি উন্নত দেশে পরিণত হতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের নতুন প্রজন্ম তো দূরের কথা প্রৌঢ়রাও দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাই রাখেন না। এ বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা বা গ্রন্থাদিও তেমন নেই। তবে আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুকে সম্পূর্ণ জানতে হলে বাকশাল বা তার দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পর্কেও জানতে হবে। খুব সংক্ষেপে আমি চেষ্টা করবো দ্বিতীয় বিপ্লবের সারাংশটুকু তুলে ধরতে।
দ্বিতীয় বিপ্লবের পটভূমি : বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব আকাশ থেকে ঝরেপড়া কোন বিষয় নয়। এটি বস্তুত সারা বিশ্বে বিশ শতকে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্রের যে বিকাশ ঘটে তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর নিজের মতো করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধুর এই নীতি ও আদর্শকে মুজিববাদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো। অনেকে বলতেন এটি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের অনন্য এক সংমিশ্রণ। তবে এটি বলতেই হবে যে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র বঙ্গবন্ধুর সময়েরই প্রথম ধারনা নয়। বরং রুশ বিপ্লব থেকে এর বিকাশ। সূচনা কার্ল মার্ক্সের দর্শনের ওপর। বস্তুত বিশ্বের ইতিহাসে এটি একটি অসাধারণ ধারণা; যা প্রচলিত পুঁজিবাদী দুনিয়ার চাইতে অবশ্যই ব্যতিক্রমী।
মনে করা হয়, ১৯০৫ সালে রুশ বিপ্লবের সূচনা হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের বা লড়াইর এর মধ্য দিয়ে ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সমাজতন্ত্রীরা জয়ী হয়।
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর ১৯১৯ কমিনটার্ণ জন্ম নেয়। এই পটভূমিকায় ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য) সক্রিয়তায় সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ শহরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠার সময় পার্টির সদস্য হন ৭ জনÑ ১. মানবেন্দ্রনাথ রায়, ২. এভেলিন ট্রেন্ট রায়, ৩. অবনী মুখার্জি, ৪. রোজা ফিটিংহফ, ৫. মুহম্মদ আলি (আহ্মদ হাসান), ৬. মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী ও ৭. এম বি টি আচার্য বা এম প্রতিবাদী আচার্য। পার্টির সম্পাদক হন মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী। কমিনটার্ন (১৯১৯-৪৩) নির্ধারিত নীতি অনুসরণ করার এবং ভারতের পরিস্থিতির উপযোগী একটি কর্মসূচি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় পার্টি তার প্রতিষ্ঠা সভায়। কমিনটার্ন ১৯২১ সালে সিপিআইকে কমিউনিস্ট গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, লাহোর, কানপুর শহরকে কেন্দ্র করে পার্টি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন মুজফ্ফর আহ্মদ, এস এ ডাঙ্গে, সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার, গোলাম হুসেন প্রমুখ নেতারা।
অন্যদিকে পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির জন্মের বিবরণটা উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে এরকম : ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানে একটি স্বতন্ত্র কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং এতদুদ্দেশ্যে ঢাকায় ৭ সদস্যের একটি আঞ্চলিক কমিটি গঠন করা হয় (১৯৪৭)। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত কাউন্সিলররা ৬ মার্চ পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। সাজ্জাদ জহিরকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। একই দিনে পূর্ববঙ্গের কাউন্সিলররা ১৯ সদস্যের পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন খোকা রায়।
উইকিপিডিয়ার মতে, চীন-সোভিয়েত দ্বন্দে্বর পরিপ্রেক্ষিতে পার্টিতে অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য দেখা দিলে ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি ভাঙনের শিকার হয়। ফলত পার্টি মণি সিংহের নেতৃত্বে মস্কোপন্থী গ্রুপ এবং মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে চীনপন্থী গ্রুপ এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচিকে (১৯৬৬) পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ ভারত বা পাকিস্তানে রাজনীতির এই ধারার সঙ্গে মোটেই যুক্ত ছিলেন না। তিনি বস্তুত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি মুসলিম লীগকে অবলম্বন করেই অংশগ্রহণ করেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি বা অন্য কোন দলের রাজনীতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। বরং স্বাধীনতা উত্তরকালের জনগণের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সম্মেলনের সভাপতি মাওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ৬-১০ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার কগমারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন ও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন এবং তারও পরে মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্বে ভাসানীর দল ন্যাপ দুই ভাগে বিভক্ত হয়। মাওলানা ভাসানী পিকিংপন্থি ও মোজাফফর আহমেদ মস্কোপন্থি ন্যাপের নেতা থেকে যান। কালক্রমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কাছে তারা নিভু নিভু প্রদীপে পরিণত হন।
তবে আওয়ামী লীগ কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রের ধারার রাজনৈতিক দল না হলেও সময়ের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহে বামধারার রাজনীতির প্রভাব পড়ে। বস্তুত তখনকার নতুন প্রজন্মের কাছে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র একটি প্রচণ্ড আকর্ষণ হিসেবে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি অংশ সমাজতান্ত্রিক চেতনায় বেড়ে ওঠে এবং এরই প্রকাশ ঘটে স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এর জন্মের মধ্য দিয়ে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূল ৪ নীতির একটি হিসেবে গ্রহণ করেন। এই সংবিধানের অনেক কাটা ছেড়া হলেও এই মূল নীতির কোন পরিবর্তন নেই। আজকের দুনিয়াতে সমাজতন্ত্র তেমন বেশি উচ্চারিত শব্দ নয়। বিশেষত বার্লিন দেয়ালের পতনের পর, রুশ প্রজাতন্ত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ায় এবং চীনও সমাজতন্ত্রের আদি ধারণা থেকে সংশোধনবাদী সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়ে পড়ায় এখন সারা বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটা সমাজতান্ত্রিক দেশ আছে যারাও সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ধনবাদী ব্যবস্থাকে মিশ্রণ করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তুলছে। কমিউনিস্ট পার্টি বা সমাজতান্ত্রিক দল সমূহের বিস্তারও গ্রহণযোগ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে এক সময়ে সমাজতন্ত্রের প্রচণ্ড দাপট ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে না পারলেও পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ইত্যাদি রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিস্ট দল বা বাম ফ্রন্ট দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। বাংলাদেশকে প্রচলিত ধারণার বাইরে নিজস্ব ধরনের সমাজতান্ত্রিক ধারণার দেশে পরিণত করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর এ প্রচেষ্টার প্রথম প্রকাশ ১৯৭২ সালের সংবিধান; যা এখনও কার্যকর রয়েছে। তিনি ১৯৭৫ সালে তার দল আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে রূপান্তর করে তার রাজনৈতিক ভাবনার কিছু মৌলিক পরিবর্তন করেন। অনেকেই বাকশালকে একদলীয় শাসন বলে না জেনেই গালি দেয়। তবে বিজ্ঞজনেরা বঙ্গবন্ধুর সেই দুঃসাহসী পদক্ষেপকে তার দ্বিতীয় বিপ্লব বা শোষিতের গণতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেন। তাদের মতে, স্বাধীনতা যুদ্ধ করে আমরা প্রথম বিপ্লবটা সম্পন্ন করি। শোষিতের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে আমরা দ্বিতীয় বিপ্লবটা সম্পন্ন করতে চেয়েছি।
কাকতালীয় বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোও এখন তাদের মূল ভাবনা অনুসারে সমাজতন্ত্রের কথা ভুলেও উচ্চারণ করে না।
যারা পুরো বিষয়টা বোঝেন না তাদের ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব, চীনের মাওসেতুংয়ের বিপ্লব, কিউবার ফিডেল ক্যাস্ট্রো, ভিয়েতনামের হোচিমিনের লড়াই ইত্যাদি পাঠ কেেত পারেন। মার্কসের দ্যস ক্যাপিটাল, কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস, লেনিন ও মাওসেতুংয়ের রচনাবলীসমূহ পাঠ করলে সমাজতন্ত্র/কমিউনিজম সম্পর্কে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। বস্তুত রুশ বিপ্লবের পরেই সারা বিশ্বে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্রের ব্যাপক প্রভাব পড়তে থাকে। ভারতবর্ষ তার ব্যতিক্রম নয়।
সমাজতন্ত্রের ইতিহাসের উৎপত্তি ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব এবং তার থেকে উদ্ভূত পরিবর্তনের ভেতরে নিহিত। যদিও এটি আগের আন্দোলন এবং ধারণা থেকেও বিভিন্ন ধারনা গ্রহণ করেছে। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের লেখা কমিউনিস্ট ইশতেহার বইটিতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কথাটি ব্যবহার করা হয়। বইটি ১৮৪৮ সালের সামান্য আগে লেখা হয় এবং বইটি পুরো ইউরোপকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ইউরোপে ১৯ শতকের শেষ তৃতীয়াংশে মার্কসবাদকে গ্রহণ করে সমাজতান্ত্রিক দলগুলো উপরে আসতে শুরু করে। অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টি বিশ্বের প্রথম নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক পার্টি; যখন পার্টি ১৮৯৯ সালে কুইন্সল্যান্ড রাজ্যে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল।
এছাড়া উনিশ শতকের কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রীদের দ্বারা কল্পিত নানা ব্যবস্থাগুলো পরবর্তীকালে পরিণত হয়েছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নানা তাত্ত্বিক উৎস্যে।
১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীবলে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং দেশের সমগ্র রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল নামক একটি একক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই এ দলের চেয়ারম্যান এবং সম্পাদক হন এম মনসুর আলী। সংসদে উত্থাপনের মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে এই বিল সংসদে পাস হয়ে যায়। ইত্তেফাক, বাংলাদেশ টাইমস, দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ অবজারভার- এ চারটি দৈনিক ছাড়া বাকশাল ব্যবস্থায় সব সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়। ১৮টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাকশাল গঠিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল ছিল দেশ বদলে দেয়ার কর্মসূচি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, আবদুল মালেক উকিলসহ মোট ১৫ জন সদস্য নিয়ে বাকশালের নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে তিনি জনগণের অভূতপূর্ব সাড়া পান। মানুষ বঙ্গবন্ধুর এ দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রতি ব্যাপকহারে সাড়া দেয় এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এরপরের মর্মান্তিক ঘটনাপ্রবাহ আমাদের স্মৃতিতে আছে। এ নিবন্ধে আমরা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও তার ভাবনাগুলো পরের অধ্যায়গুলোতে তুলে ধরব।
ঢাকা। ২৬ মার্চ, ২০১৯। আপডেট : ১৬ মে, ২০২১।
[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]
mustafajabbar@gmail.com
মঙ্গলবার, ১৮ মে ২০২১ , ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৫ শাওয়াল ১৪৪২
মোস্তাফা জব্বার
এক ॥
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর খুনিরা কেবল বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিই বাতিল করেনি, কালক্রমে দ্বিতীয় বিপ্লব বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি যে রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ ওরফে বাকশাল গঠন করেন তাকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি গালিতে পরিণত করেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ স্বনামে আবির্ভূত হয়। বাকশাল নামক একটি রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের মূল স্রোতের চাইতে স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিরুদ্ধাচরণকারীরা ক্ষমতায় থাকার ফলে, আওয়ামী লীগ বাকশাল ভুলে থাকারই চেষ্টা করে এবং ১৯৯৬ বা তার পরে সরকারে থেকেও বাকশাল বা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব বিষয়ে কোন আলোচনাই করেনি। এখনো বাকশাল বা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের আলোচিত বিষয় নয়। অতি সাম্প্রতিককালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির কথা বলেন এবং একটি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। নতুন বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের বিভিন্ন কর্মসূচির ইতিবাচক দিকগুলোও তুলে ধরেন। এটি নিশ্চত করেই বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু যদি তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারতেন তবে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা অনেক আগেই পেতাম। এমনকি বৈষম্য নামক কোন শব্দকেই রাষ্ট্রের কোথাও খুঁজে পেতাম না। বাংলাদেশের অগ্রগতিকেও আজ ২১ সালে উন্নয়নশীল দেশের হিসাব করতে হতো নাÑ এটি উন্নত দেশে পরিণত হতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের নতুন প্রজন্ম তো দূরের কথা প্রৌঢ়রাও দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাই রাখেন না। এ বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা বা গ্রন্থাদিও তেমন নেই। তবে আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুকে সম্পূর্ণ জানতে হলে বাকশাল বা তার দ্বিতীয় বিপ্লব সম্পর্কেও জানতে হবে। খুব সংক্ষেপে আমি চেষ্টা করবো দ্বিতীয় বিপ্লবের সারাংশটুকু তুলে ধরতে।
দ্বিতীয় বিপ্লবের পটভূমি : বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব আকাশ থেকে ঝরেপড়া কোন বিষয় নয়। এটি বস্তুত সারা বিশ্বে বিশ শতকে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্রের যে বিকাশ ঘটে তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর নিজের মতো করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধুর এই নীতি ও আদর্শকে মুজিববাদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো। অনেকে বলতেন এটি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের অনন্য এক সংমিশ্রণ। তবে এটি বলতেই হবে যে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র বঙ্গবন্ধুর সময়েরই প্রথম ধারনা নয়। বরং রুশ বিপ্লব থেকে এর বিকাশ। সূচনা কার্ল মার্ক্সের দর্শনের ওপর। বস্তুত বিশ্বের ইতিহাসে এটি একটি অসাধারণ ধারণা; যা প্রচলিত পুঁজিবাদী দুনিয়ার চাইতে অবশ্যই ব্যতিক্রমী।
মনে করা হয়, ১৯০৫ সালে রুশ বিপ্লবের সূচনা হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের বা লড়াইর এর মধ্য দিয়ে ১৯১৭ সালের অক্টোবরে সমাজতন্ত্রীরা জয়ী হয়।
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর ১৯১৯ কমিনটার্ণ জন্ম নেয়। এই পটভূমিকায় ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য) সক্রিয়তায় সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ শহরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠার সময় পার্টির সদস্য হন ৭ জনÑ ১. মানবেন্দ্রনাথ রায়, ২. এভেলিন ট্রেন্ট রায়, ৩. অবনী মুখার্জি, ৪. রোজা ফিটিংহফ, ৫. মুহম্মদ আলি (আহ্মদ হাসান), ৬. মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী ও ৭. এম বি টি আচার্য বা এম প্রতিবাদী আচার্য। পার্টির সম্পাদক হন মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী। কমিনটার্ন (১৯১৯-৪৩) নির্ধারিত নীতি অনুসরণ করার এবং ভারতের পরিস্থিতির উপযোগী একটি কর্মসূচি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় পার্টি তার প্রতিষ্ঠা সভায়। কমিনটার্ন ১৯২১ সালে সিপিআইকে কমিউনিস্ট গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, লাহোর, কানপুর শহরকে কেন্দ্র করে পার্টি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন মুজফ্ফর আহ্মদ, এস এ ডাঙ্গে, সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার, গোলাম হুসেন প্রমুখ নেতারা।
অন্যদিকে পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির জন্মের বিবরণটা উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে এরকম : ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানে একটি স্বতন্ত্র কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং এতদুদ্দেশ্যে ঢাকায় ৭ সদস্যের একটি আঞ্চলিক কমিটি গঠন করা হয় (১৯৪৭)। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত কাউন্সিলররা ৬ মার্চ পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। সাজ্জাদ জহিরকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। একই দিনে পূর্ববঙ্গের কাউন্সিলররা ১৯ সদস্যের পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন খোকা রায়।
উইকিপিডিয়ার মতে, চীন-সোভিয়েত দ্বন্দে্বর পরিপ্রেক্ষিতে পার্টিতে অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য দেখা দিলে ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি ভাঙনের শিকার হয়। ফলত পার্টি মণি সিংহের নেতৃত্বে মস্কোপন্থী গ্রুপ এবং মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে চীনপন্থী গ্রুপ এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচিকে (১৯৬৬) পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ ভারত বা পাকিস্তানে রাজনীতির এই ধারার সঙ্গে মোটেই যুক্ত ছিলেন না। তিনি বস্তুত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি মুসলিম লীগকে অবলম্বন করেই অংশগ্রহণ করেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি বা অন্য কোন দলের রাজনীতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। বরং স্বাধীনতা উত্তরকালের জনগণের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সম্মেলনের সভাপতি মাওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ৬-১০ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার কগমারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন ও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন এবং তারও পরে মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্বে ভাসানীর দল ন্যাপ দুই ভাগে বিভক্ত হয়। মাওলানা ভাসানী পিকিংপন্থি ও মোজাফফর আহমেদ মস্কোপন্থি ন্যাপের নেতা থেকে যান। কালক্রমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কাছে তারা নিভু নিভু প্রদীপে পরিণত হন।
তবে আওয়ামী লীগ কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রের ধারার রাজনৈতিক দল না হলেও সময়ের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহে বামধারার রাজনীতির প্রভাব পড়ে। বস্তুত তখনকার নতুন প্রজন্মের কাছে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র একটি প্রচণ্ড আকর্ষণ হিসেবে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি অংশ সমাজতান্ত্রিক চেতনায় বেড়ে ওঠে এবং এরই প্রকাশ ঘটে স্বাধীনতার পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এর জন্মের মধ্য দিয়ে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় মূল ৪ নীতির একটি হিসেবে গ্রহণ করেন। এই সংবিধানের অনেক কাটা ছেড়া হলেও এই মূল নীতির কোন পরিবর্তন নেই। আজকের দুনিয়াতে সমাজতন্ত্র তেমন বেশি উচ্চারিত শব্দ নয়। বিশেষত বার্লিন দেয়ালের পতনের পর, রুশ প্রজাতন্ত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ায় এবং চীনও সমাজতন্ত্রের আদি ধারণা থেকে সংশোধনবাদী সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়ে পড়ায় এখন সারা বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটা সমাজতান্ত্রিক দেশ আছে যারাও সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ধনবাদী ব্যবস্থাকে মিশ্রণ করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তুলছে। কমিউনিস্ট পার্টি বা সমাজতান্ত্রিক দল সমূহের বিস্তারও গ্রহণযোগ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে এক সময়ে সমাজতন্ত্রের প্রচণ্ড দাপট ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে না পারলেও পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ইত্যাদি রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিস্ট দল বা বাম ফ্রন্ট দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। বাংলাদেশকে প্রচলিত ধারণার বাইরে নিজস্ব ধরনের সমাজতান্ত্রিক ধারণার দেশে পরিণত করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর এ প্রচেষ্টার প্রথম প্রকাশ ১৯৭২ সালের সংবিধান; যা এখনও কার্যকর রয়েছে। তিনি ১৯৭৫ সালে তার দল আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে রূপান্তর করে তার রাজনৈতিক ভাবনার কিছু মৌলিক পরিবর্তন করেন। অনেকেই বাকশালকে একদলীয় শাসন বলে না জেনেই গালি দেয়। তবে বিজ্ঞজনেরা বঙ্গবন্ধুর সেই দুঃসাহসী পদক্ষেপকে তার দ্বিতীয় বিপ্লব বা শোষিতের গণতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেন। তাদের মতে, স্বাধীনতা যুদ্ধ করে আমরা প্রথম বিপ্লবটা সম্পন্ন করি। শোষিতের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে আমরা দ্বিতীয় বিপ্লবটা সম্পন্ন করতে চেয়েছি।
কাকতালীয় বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোও এখন তাদের মূল ভাবনা অনুসারে সমাজতন্ত্রের কথা ভুলেও উচ্চারণ করে না।
যারা পুরো বিষয়টা বোঝেন না তাদের ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব, চীনের মাওসেতুংয়ের বিপ্লব, কিউবার ফিডেল ক্যাস্ট্রো, ভিয়েতনামের হোচিমিনের লড়াই ইত্যাদি পাঠ কেেত পারেন। মার্কসের দ্যস ক্যাপিটাল, কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস, লেনিন ও মাওসেতুংয়ের রচনাবলীসমূহ পাঠ করলে সমাজতন্ত্র/কমিউনিজম সম্পর্কে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। বস্তুত রুশ বিপ্লবের পরেই সারা বিশ্বে কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্রের ব্যাপক প্রভাব পড়তে থাকে। ভারতবর্ষ তার ব্যতিক্রম নয়।
সমাজতন্ত্রের ইতিহাসের উৎপত্তি ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব এবং তার থেকে উদ্ভূত পরিবর্তনের ভেতরে নিহিত। যদিও এটি আগের আন্দোলন এবং ধারণা থেকেও বিভিন্ন ধারনা গ্রহণ করেছে। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের লেখা কমিউনিস্ট ইশতেহার বইটিতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কথাটি ব্যবহার করা হয়। বইটি ১৮৪৮ সালের সামান্য আগে লেখা হয় এবং বইটি পুরো ইউরোপকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ইউরোপে ১৯ শতকের শেষ তৃতীয়াংশে মার্কসবাদকে গ্রহণ করে সমাজতান্ত্রিক দলগুলো উপরে আসতে শুরু করে। অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টি বিশ্বের প্রথম নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক পার্টি; যখন পার্টি ১৮৯৯ সালে কুইন্সল্যান্ড রাজ্যে নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল।
এছাড়া উনিশ শতকের কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রীদের দ্বারা কল্পিত নানা ব্যবস্থাগুলো পরবর্তীকালে পরিণত হয়েছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নানা তাত্ত্বিক উৎস্যে।
১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীবলে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং দেশের সমগ্র রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল নামক একটি একক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই এ দলের চেয়ারম্যান এবং সম্পাদক হন এম মনসুর আলী। সংসদে উত্থাপনের মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে এই বিল সংসদে পাস হয়ে যায়। ইত্তেফাক, বাংলাদেশ টাইমস, দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ অবজারভার- এ চারটি দৈনিক ছাড়া বাকশাল ব্যবস্থায় সব সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়। ১৮টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাকশাল গঠিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল ছিল দেশ বদলে দেয়ার কর্মসূচি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, আবদুল মালেক উকিলসহ মোট ১৫ জন সদস্য নিয়ে বাকশালের নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে তিনি জনগণের অভূতপূর্ব সাড়া পান। মানুষ বঙ্গবন্ধুর এ দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রতি ব্যাপকহারে সাড়া দেয় এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এরপরের মর্মান্তিক ঘটনাপ্রবাহ আমাদের স্মৃতিতে আছে। এ নিবন্ধে আমরা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও তার ভাবনাগুলো পরের অধ্যায়গুলোতে তুলে ধরব।
ঢাকা। ২৬ মার্চ, ২০১৯। আপডেট : ১৬ মে, ২০২১।
[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]
mustafajabbar@gmail.com