রোজিনার ওপর আঘাত, সাংবাদিকতার ওপর আঘাত

সরকার বিবেচকের ভূমিকা নেবে : আশা বিশিষ্টজনের

রোজিনা ইসলামের ওপর আঘাত সাংবাদিকতার ওপর আঘত বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিকরা। সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের মতে, বর্তমান সময়ে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমলের করা আইনে মামলা দায়ের সংশ্লিষ্টদের সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের অশুভ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বের চেষ্টার পাশাপাশি আগামী দিনের স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের জন্য হুমকি।

সরকারি অফিস যেখানে ৫টায় বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে রাত পর্যন্ত একজন নারী সাংবাদিককে একটি নির্জন কক্ষে আটকে রাখার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। রোজিনা ইসলামকে বিকেল ৩টার দিকে আটক করা হয়। এরপর তাকে ফাঁসানোর জন্য এই কালক্ষেপন, যা ষড়যন্ত্রের অংশ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তথ্য প্রাপ্তির অধিকার এবং দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি বিবেচনায় রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করে অবিলম্বে তার মুক্তিলাভে সরকার বিবেচকের ভূমিকা পালন করবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক নেতা ও বিশিষ্ট নাগরিকরা।

একজন পেশাদার সাংবাদিকের সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা এমন হেনস্থার শিকার হওয়ার ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিরা।

নিন্দা জানিয়েছেন সাংবাদিক, শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদী মানববন্ধন করেছেন সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। দেশের পাশপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ ঘটনার খবর এসেছে।

সোমবার রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেইসবুকে) বইছে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড়।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ প্রিজন ভ্যানের ভেতরে থাকা সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের একটি ছবি নিজের পেজে পোস্ট করে লেখেন, ‘এই ছবির মাধ্যমে পাঠানো বার্তা হিমশীতল ও পরিষ্কার। মিডিয়ার বস্তুনিষ্ট সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতাটুকুও যদি আর না থাকে, তাহলে কোথায় যাব আমরা? রোজিনা ইসলামের মুক্তি চাই।’

সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও ‘আজকের পত্রিকা’র সম্পাদক গোলাম রহমান ফেইসবুকে লেখেন, ‘সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটক রেখে নির্যাতন করার অধিকার কে দিল? নির্যাতনকারীদের বিচার চাই। এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’

অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দীন মাহমুদ লেখেন, ‘দুর্নীতি কী ‘অফিসিয়াল সিক্রেট’ -যে আইনে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হলো? বাংলাদেশের দুর্নীতি কী বিশ্বব্যাপী কোন গোপন বিষয়? দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা তো সরকারের জবাবদিহির জন্য সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি, কারণ শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে জবাবদিহি ছাড়া কোন দেশের উন্নয়ন টেকসই হয়নি-গণতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী যেকোন ধরনের শাসনব্যবস্থাই হোক।’

আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি এম ইকবাল আর্সলান লেখেন, ‘একজন সাংবাদিকের পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে সত্যের সন্ধান, উদ্ঘাটন এবং জনসমক্ষে প্রকাশ/উপস্থাপন। সারা বিশ্বজুড়েই সাংবাদিকেরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য অনেক পথ অবলম্বন করে থাকেন, তাই বলে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, আটকে রাখা থেকে গ্রেপ্তার কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রোজিনা একজন স্বনামধন্য সিনিয়র সাংবাদিক। তিনি তার সাংবাদিকতার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত, তার সঙ্গে আজ যা ঘটল, তা অবাধ তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হলো। পেশাজীবী হিসেবে এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন লেখেন, ‘ঘুরে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। রোজিনা আমাদের স্বর। আমাদেরই গলা চেপে ধরা।’

জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দীন তার পোস্টে লেখেন, ‘ঢাকার নয়টি হাসপাতালের কেনাকাটার অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে ডয়চে ভেলেতে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেই প্রতিবেদনগুলো একটি সরকারি নথির ভিত্তিতেই করা হয়েছে। সেটিও আমরা চুরি করেছি। রোজিনার বিরুদ্ধে চুরির দোষে মামলা হলে আমার বিরুদ্ধেও সেই নথি চুরির মামলা দেন।’

সাংবাদিক প্রণব সাহা ‘হ্যাশট্যাগ ফ্রিরোজিনাইসলাম’ দিয়ে লেখেন, ‘গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ নতুন কিছু নয়, সবাই চান সংবাদমাধ্যম আমার পক্ষে থাকবে। অনেকে থাকেও হয়তো, কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গলা টিপে একজন সাংবাদিককে হত্যার চেষ্টা, তা মেনে নেব না। অসুস্থ রোজিনার চিকিৎসা সবার আগে হতে হবে। আরও দাবি মামলার আগে আটকে রেখে হত্যাচেষ্টার বিচার চাই।’

মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) বাংলাদেশ ব্যুরোপ্রধান জুলহাস আলম লেখেন, ‘সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের অনেকের জন্যই আতঙ্কের এক নাম। রোজিনা দেশে সাংবাদিকতাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি সে বিচারে প্রথম সারির একজন সৈনিক এটাই সত্যি।’

ডয়চে ভেলের আরেক সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম পোস্ট দেন, ‘সাংবাদিকতা কোন অপরাধ নয়। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে হেনস্তা করার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি হওয়া জরুরি।’

বুধবার, ১৯ মে ২০২১ , ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৬ শাওয়াল ১৪৪২

রোজিনার ওপর আঘাত, সাংবাদিকতার ওপর আঘাত

সরকার বিবেচকের ভূমিকা নেবে : আশা বিশিষ্টজনের

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

রোজিনা ইসলামের ওপর আঘাত সাংবাদিকতার ওপর আঘত বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিকরা। সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের মতে, বর্তমান সময়ে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আমলের করা আইনে মামলা দায়ের সংশ্লিষ্টদের সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের অশুভ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বের চেষ্টার পাশাপাশি আগামী দিনের স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের জন্য হুমকি।

সরকারি অফিস যেখানে ৫টায় বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে রাত পর্যন্ত একজন নারী সাংবাদিককে একটি নির্জন কক্ষে আটকে রাখার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। রোজিনা ইসলামকে বিকেল ৩টার দিকে আটক করা হয়। এরপর তাকে ফাঁসানোর জন্য এই কালক্ষেপন, যা ষড়যন্ত্রের অংশ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তথ্য প্রাপ্তির অধিকার এবং দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি বিবেচনায় রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করে অবিলম্বে তার মুক্তিলাভে সরকার বিবেচকের ভূমিকা পালন করবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক নেতা ও বিশিষ্ট নাগরিকরা।

একজন পেশাদার সাংবাদিকের সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা এমন হেনস্থার শিকার হওয়ার ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিরা।

নিন্দা জানিয়েছেন সাংবাদিক, শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদী মানববন্ধন করেছেন সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। দেশের পাশপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ ঘটনার খবর এসেছে।

সোমবার রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেইসবুকে) বইছে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড়।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ প্রিজন ভ্যানের ভেতরে থাকা সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের একটি ছবি নিজের পেজে পোস্ট করে লেখেন, ‘এই ছবির মাধ্যমে পাঠানো বার্তা হিমশীতল ও পরিষ্কার। মিডিয়ার বস্তুনিষ্ট সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতাটুকুও যদি আর না থাকে, তাহলে কোথায় যাব আমরা? রোজিনা ইসলামের মুক্তি চাই।’

সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও ‘আজকের পত্রিকা’র সম্পাদক গোলাম রহমান ফেইসবুকে লেখেন, ‘সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটক রেখে নির্যাতন করার অধিকার কে দিল? নির্যাতনকারীদের বিচার চাই। এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’

অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দীন মাহমুদ লেখেন, ‘দুর্নীতি কী ‘অফিসিয়াল সিক্রেট’ -যে আইনে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হলো? বাংলাদেশের দুর্নীতি কী বিশ্বব্যাপী কোন গোপন বিষয়? দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা তো সরকারের জবাবদিহির জন্য সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি, কারণ শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে জবাবদিহি ছাড়া কোন দেশের উন্নয়ন টেকসই হয়নি-গণতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী যেকোন ধরনের শাসনব্যবস্থাই হোক।’

আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি এম ইকবাল আর্সলান লেখেন, ‘একজন সাংবাদিকের পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে সত্যের সন্ধান, উদ্ঘাটন এবং জনসমক্ষে প্রকাশ/উপস্থাপন। সারা বিশ্বজুড়েই সাংবাদিকেরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য অনেক পথ অবলম্বন করে থাকেন, তাই বলে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, আটকে রাখা থেকে গ্রেপ্তার কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রোজিনা একজন স্বনামধন্য সিনিয়র সাংবাদিক। তিনি তার সাংবাদিকতার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত, তার সঙ্গে আজ যা ঘটল, তা অবাধ তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হলো। পেশাজীবী হিসেবে এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন লেখেন, ‘ঘুরে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। রোজিনা আমাদের স্বর। আমাদেরই গলা চেপে ধরা।’

জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দীন তার পোস্টে লেখেন, ‘ঢাকার নয়টি হাসপাতালের কেনাকাটার অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে ডয়চে ভেলেতে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেই প্রতিবেদনগুলো একটি সরকারি নথির ভিত্তিতেই করা হয়েছে। সেটিও আমরা চুরি করেছি। রোজিনার বিরুদ্ধে চুরির দোষে মামলা হলে আমার বিরুদ্ধেও সেই নথি চুরির মামলা দেন।’

সাংবাদিক প্রণব সাহা ‘হ্যাশট্যাগ ফ্রিরোজিনাইসলাম’ দিয়ে লেখেন, ‘গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ নতুন কিছু নয়, সবাই চান সংবাদমাধ্যম আমার পক্ষে থাকবে। অনেকে থাকেও হয়তো, কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গলা টিপে একজন সাংবাদিককে হত্যার চেষ্টা, তা মেনে নেব না। অসুস্থ রোজিনার চিকিৎসা সবার আগে হতে হবে। আরও দাবি মামলার আগে আটকে রেখে হত্যাচেষ্টার বিচার চাই।’

মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) বাংলাদেশ ব্যুরোপ্রধান জুলহাস আলম লেখেন, ‘সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের অনেকের জন্যই আতঙ্কের এক নাম। রোজিনা দেশে সাংবাদিকতাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি সে বিচারে প্রথম সারির একজন সৈনিক এটাই সত্যি।’

ডয়চে ভেলের আরেক সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম পোস্ট দেন, ‘সাংবাদিকতা কোন অপরাধ নয়। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে হেনস্তা করার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি হওয়া জরুরি।’