মামুন হুসাইন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বলাবাহুল্য- নাপিত বাড়ির শনৈঃশনৈ উন্নয়ন এলেও, গাঁয়ের আর-আর মানুষের অভাব এবং চাকুরিহীনতা হয় নিত্য দিনের ঘটনা। স্মরণ হয়- নাপিত বাড়ির মধুশ্রী চিরকালের মতো কলকাতা শহরে নিখোঁজ হওয়ার আগে, গোপনে পরস্পর গঙ্গাজল ছড়িয়ে মিষ্টিমুখ করে মোমেনা খাতুনের সই হয়েছিল... দেখা হলে, একে-অপরকে বলতো গঙ্গাজল। গঙ্গাজল নামক দুই সখী প্রাচীন বৃক্ষের গায়ে নাম লেখে- মধুশ্রী + মোমেনা; বৃক্ষ বিকশিত হয় এবং দুই সখী ক্রমশ বৃক্ষের বাকল জুড়ে উদ্ভাসিত হয়... উদ্ভাসিত অক্ষরসমূহ জলজ হয়, ম্রিয়মান হয় এবং একদিন দ্রুত আবিষ্কৃত হয়- মধুশ্রী ও মোমেনা এখন বিযুক্ত দেশ-গাঁয়ের মানুষ বটে! বৃক্ষের শরীরে প্রতিস্থাপিত অক্ষরসমূহ মোমেনা খাতুন কান্নায় দ্রবীভূত হয়ে স্পর্শ করে এবং অচিরেই জাতপাতের ব্যবধান, অন্তঃস্থলের রক্তক্ষরণ ও আত্মীয়তার বিধি-নিষেধ নিংড়ে নিখোঁজ গঙ্গাজল-সখী মধুশ্রীর অন্তর্ধান পর্ব উন্মোচনের সুযোগ খুঁজতে বসে। লোকসকল আড়ম্বরহীন স্বচ্ছ-স্বচ্ছল কণ্ঠে শোনায়- মধুশ্রী জলচৌকিপাতা ঘরদোর, স্কুলব্যাগ, আলপথ, আলু চাষীদের ভোরবেলা ও শাড়ির রঙের মতো ধানক্ষেত পরিত্যাগ করে একটি রোগা শরীর নিয়ে, কোনো এক গোপন সন্ধ্যারাতে, কিছুমাত্র অবহিত না করেই, বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রতিবেশী-দেশে উদ্বাস্তু হয়ে যায় জিন্স-টপ পরিহিত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাদাম চিবুনোর মহড়ায়। দুপুরবেলা মধুশ্রী হয়তো আগুন-লাগা সাঁকো দেখে, কলকাতার রাস্তায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে সদ্য প্রস্তুতকৃত ডেডবডির প্রযতেœ সাদা খই উড়তে দেখে, আর কী চমৎকার কালচারাল কলেজ স্ট্রিট! মধুশ্রীদের আমলেই চিঠি যুগ শেষ হয়ে যায়; ফলে মধুশ্রী ও মোমেনা খাতুন নামক এক জোড়া গঙ্গাজল অচিরেই ট্রেন-নৌকা হয়ে শত শত অন্ধ-বালকের গান শোনে নিরুপায়- ল্যায়লা ও ল্যায়লা/...মেরা জীবন কোরা কাগজ...! কলকাতা শহরের আগুন লাগা মারুতিময় সড়ক থেকে ভেসে আসা এই গান নিশ্চয় মোমেনা খাতুন শুনতে পায় না। তার ভাগ্য নাপিত বাড়ির ছেলেমেয়েদের মতো উজ্জ্বল নয়। মোমেনা খাতুন, তার অপর আত্মীয়বর্গ এবং পাড়ার আর আর সবাই তীব্র ধ্বস্ত, খণ্ডিত এবং অনাহারী। তাদের জমিতে কেউ ইনজাংশান করায় ধানের মওসুমে ঘরে ধান তোলা যাবে না- কারণ সেকান্দার আলীর লাঠিয়াল বাহিনী উপস্থিত। প্রায়শ তাদের ছাগল-হাঁস-মুরগি চুরি হয়। কখনো নদী-পুকুরের পানি খাওয়া হয় সরাসরি, কখনো ফিটকারি; ডায়রিয়া হলে, মুদি দোকানদারকে অগ্রিম অনুরোধ করা হয়, ঔষধ রাখার জন্য। সাহায্য সংস্থার উন্নয়ন- তৃষ্ণা নিবারণের জন্য নলকূপ বসানো হয় জোতদারের দরজায়; আমরা পানি আনতে যাই, কিন্তু নলকূপে তালা লাগিয়ে রাখা হয়। দুই একর জমি চাষ করি গেল বছর : ধান হলো ২২ থেকে ২০ মণ; মালিক পায় অর্ধেক, অবশিষ্ট ধানে কোনোরকম দু’মাসের খোরাক হয়। ওদের কাছ থেকে ঋণ নিই। ধান শেষ হলে মাছ ধরি নদীতে। মাছধরা শেষ হয়, বীজ করা শুরু করি। বীজ করতে যেয়ে পায়ে ঘা হয়, ফিটকারির চাকা পানিতে গুলিয়ে প্রথমে পা ধুয়ে নিই। তারপর চুন-পানিতে গুলিয়ে সেই পানি সারারাত পায়ে দিয়ে রাখি। পা একটু শুকনা হয়, তারপর ফের বীজতলায়। জমি করি আমরা, আর জোতদার পায় ডিসিআর। উন্নয়নের দ্যুতিচিহ্ন কিংবা ভীষণমূর্তি প্রসন্নমনে দেখার জন্য আমাদের এখানে কখনো প্রকল্পের লোকজন আসে, সরকারের গাড়ি আসে, ইউনিসেফের জিপ আসে; প্রজেক্ট অফিসার গ্রুপ তৈরি করে এবং আমরা ভিক্ষাপাত্র ফেলে, পরমান্নের আশায় একনিষ্ঠ বিরামহীন মন্ত্রোচ্চারণে কাজ শিখি- তাঁতবোনা, জামা-সেলাই, রুটি-বিস্কুট, পোলট্রি, মোমবাতি, বাঁশ-বেতের কাজ, ধূপকাঠি, বই বাঁধাই ইত্যাদি; বই বাঁধানোর মেশিন দেখে আমাদের ভয় হয়েছিল... বইয়ের ধারগুলো সমানভাবে কাটতে যেয়ে আঙুল না নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রজেক্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে মোমেনা খাতুনের আত্মীয়বর্গ তর্ক করে... আমাদের গ্রুপের জিনিসপত্র উঁই এবং ইঁদুর কেটে দিচ্ছে, একটা ট্রাঙ্ক বা আলমারি পাঠানো দরকার।
প্রজেক্টের আলমারি সঠিক সময়ে পৌঁছতে পৌঁছতে মোমেনা খাতুনের পাড়া-গাঁয়ে সবুজ বৃষ্টি নামে, ড্রপ-আউট ছড়ায় এবং ক্ষেত-খামার ছুঁয়ে মানুষের ক্ষুধা ও পদাহত কুকুরের কান্না হয় অধিকতর জটিল, কুৎসিত, ভীতিমুগ্ধ ও প্রসারিত। মোমেনা খাতুনের আত্মীয়-স্বজন জঠরচক্রে বন্দি হয় এবং আর্তরব ছড়ায়। মানুষ ক্রন্দসী হয়, পথচারিণী হয় এবং আত্মীয় সভাচূর্ণ করে হীনবল হয়। লোকেদের শস্যঋণ ক্রমশ বদলায় এবং ভারি হয়- চাষের ঋণ, সমিতির ঋণ, ব্যাংকের ঋণ, মহাজনের ঋণ হয়ে আবর্তিত হয়। একবার অবিরাম পুড়ে যাওয়া মে মাসের ৮ তারিখ, ঘরের জ্যেষ্ঠ জন- লাগাতার অভুক্ত হয়ে, অর্ধভুক্ত হয়ে, কর্মহীন হয়ে শহরে যায়... ৯ই মে মোমেনার মতো বয়সী ভ্রাতুষ্পুত্রীর বিয়ে; লোকটি শহর থেকে ফিরেই সমিতির
সুবৃহৎ ঋণচক্রকে কোমলঋজু আঙুলে পরাজিত করার জন্য বোধিচিত্তের শান্ত দোলাচাল ও বৈরিতায় উদ্বন্ধনে জড়ায়। বিয়ে পিছায়-পিছায় না; বিয়ের আচারাদি সুসমাধার জন্য লাঞ্ছিত লাশ, কাটা-ছেঁড়া লাশ, হত্যা হয়ে যাওয়া লাশ... মানব দায়িত্বের শেষ অংশ হিসেবে মর্গে শুয়ে থেকে কালক্ষেপণ করে। অনেক পরে যখন লাশ গৃহ-অভিমুখী, তখন পথের একপ্রান্তে নব বিবাহিত-দম্পতির সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়... লোকেরা পথের রুক্ষবেশ ভুলে, ধুলোতে মাথা ঠুকে, শরীরের-হাড়ের ক্ষতচিহ্ন আড়াল করে, অবসন্ন-নতমুখে বুঁনো ঝোঁপের ভেতর লুকোয় যেন কন্যাদানের আশীর্বাদ মুহূর্তে মন্দ ছোঁয়াছুঁয়ি এড়ানো যায়। লোকেরা সভা করে বেঁচে থাকার জন্য; আর স্মৃতির আকাশ ভাঙা অন্ধকারে তৎক্ষণাৎ কাউকে কোথাও আগুনে পুড়তে দেখে; আর দেখ, ‘বীজধান এজেন্সির দপ্তর ঘেরাও হয়েছে’- এই অজুহাতে অতর্কিতে স্বরাষ্ট্র-বিভাগের শান্তিকাক্সক্ষী গুলি এবং একজন দু’জন রূপান্তরিত-নিশ্চল মানবমূর্তিকে দু’এক লক্ষ টাকার রাজকীয়-উদাসীন ক্ষতিপূরণ, কিংবা আমাদের বিস্তর কথোপকথন এবং নিছক মানব প্রেমবন্দনা।
যৎসামান্য এই ক্ষতিপূরণের জন্য জীবন নামক অনন্ত ক্ষমাহীন ক্ষতচিহ্ন আড়াল করে, লাগাতার বিধবা হওয়া সমীচীন মনে হয় না- অভাবদীর্ণ গ্রামবাসীর। সুবৃহৎ অন্ধকারের সমাপ্তি রেখায় ছোট ছোট হিসেব লেখা হয় মস্তিষ্কজুড়ে... ঘাস ছাটার খরচ + ট্রাক্টর চাষ + মইচাষ + বীজধানের দাম + ধানরোপণ + সার + ধান কেনা + ধান মাড়াই...? তারপর সেচের জল? ততদিনে লোকেদের জমি নিশ্চেতন হয়, খাসজমি হয় এবং এক গূঢ় সংকেতে অনিবার্যভাবে তারা উদ্বাস্তু হয় খাসজমি থেকে। ইউনিসেফের কাগজে এদের রক্তশূন্যতা চিহ্নিত করা হয়। তেজস্বী মধ্যাহ্নের প্রশ্বাসে ঘর-সংসার আরও অভাবদীর্ণ হয়, শীর্ণ হয়, নির্বল হয়, অখণ্ড উদাসীনতায় তাদের লাগাতার সন্তান উৎপাদিত হয় এবং গৃহস্থ বাড়িতে প্রায়শ অস্পষ্ট-অনির্ণীত কালব্যাপী তারা অনন্ত মুণ্ডিতমস্তক চাকরে রূপান্তরিত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে এদের সরকারি আইডি মিশে যায় আকাশ রাজ্যের আনন্দমহলে [...কার্তিক মাসে নুন মেশানো ভাত আসে/ আসে না!] এরা দাদন নেয়, খাদ্যের বিনিময়ে ক্ষয়স্নাত-উন্নয়নের রাস্তা বানায়, ...এমব্রয়ডারি কাজ শেখে, খেজুরপাতার ঝুড়ি বানায়, বাঁশের ঝুড়ি বানায়, ভিক্ষে করে, বাস্তুজমি হারায়, রক্তবমি করে এবং গালমন্দ শোনে- এত বড় গতর কাম-কাজ করবি, ...রোজগার করবি... খালি সাহায্য দাও-সাহায্য দাও...! মানুষের এই অনাহার-প্রক্রিয়া আরও সঠিক বুঝবার জন্য, মধুশ্রী নামক একদা সই অথবা গঙ্গাজল কর্তৃক উপহারে পাওয়া গ্রন্থ থেকে মোমেনা খাতুনকে পাঠ করতে বলা যায় : ...মোমেনা খাতুন বঙ্কিমচন্দ্রের পাগড়ি থেকে মাকড়সার মমি পরিচ্ছন্ন করে খাদ্য সংকটের অংশটি ময়ূরের পালক দিয়ে চিহ্নিত করে। অনুমান হয় এই বর্ণনা ‘আনন্দমঠ’-এর; ‘...ফসল ভাল হয় নাই, সুতরাং...চাল কিছু মহার্ঘ হইল- লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজত্ব কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়া লইল।...লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিতে আরম্ভ করিল। তারপর কে ভিক্ষা দেয়!...উপহাস করিতে আরম্ভ করিল। তারপর রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল। গরু বেচিল, লাঙ্গল জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল। জোতজমি বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী, কে কিনে! খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল, ইতর ও বন্যের কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। যাহারা পালাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পালাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।’
অজ্ঞাতবাসের আগে, অনিঃশেষ ঘণায়মান ঝরাপাতার আগে- সে বহুদিনের কথা, মোমেনা খাতুনের গ্রাম জুড়ে এই প্রকার অনাত্মীয়প্রলয় মিশে থাকে। লোকেরা তারপর অতি-প্রত্যুষ মায়াব্রত-জন্মবন্ধন অন্যত্র সঞ্চয় করে একদিন স্তূপকৃত বাঁশ পাতায় শব্দ তুলতে তুলতে শুষ্ককণ্ঠে হাঁটে, ...যেন বন্ধনহীন মুক্তির পথেই হেঁটে চলেছে। কতিপয় নামহীন নদীর ধার, পাখির নীরবতা, আমাদের কাতর-ক্ষয়প্রাপ্ত মন- পশ্চাতে-সমুখে রেখে, বিষণœ মৃত্তিকা ছুঁয়ে, দুধের আড়ৎ পেরিয়ে উৎচ্ছন্নে যাওয়া লোকসকল তুমুল ঘণ্ঠাধ্বনির মতো পৌঁছে যায় নগর-পৌরসভার ছায়াছায়া ডুমুর-গড়িয়ে যাওয়া অসচ্ছল-লক্ষ্মীছাড়া বারান্দায়।
[‘গাছ তুলে অন্য জায়গায় লাগালে, বাপু ইহজীবনে শেকড় গজায় না আর’.../ ‘হত্যা ছাড়া পরবর্তী অতিশয় দুঃসহ ঘটনা, শোকবিহ্বল ঘটনা- তোমাকে বাস্তুচ্যুত করা’।] অভাবদীর্ণ নিস্তরঙ্গ চেনা এই গ্রামজীবনে, ততদিনে আরও সব অকারণ দুঃসময় অতর্কিতে আছড়ে পড়ে। দীর্ঘায়িত ক্রন্দনের মতো সেই এবড়ো-থেবড়ো ঘর-দুয়ার, কাছারি, ধান-শস্য ও ক্ষমাহীন হাড়-মাংসের সংসারে- ...আর কীভাবে ফেরা যায়? অন্ধ ফুফু হাত-মুখ স্পর্শ করে- তোরাই তো আমার চোখ! ...বৃষ্টি আসছেরে। শুকনো কাপড় তুলে ফেল। পায়রা নামছে, পিছল মাটি থেকে দুর্গন্ধ, ভিজে খড়, হিমশীতল শ্যাওলার কণা নখে, ...বিবমিষা, ...আর ইট ফেলে-ফেলে পৌরসভার পরিত্যক্ত দালান এবং ফুটপাত দখল। এর অর্থ- আমাদের সমুদয় অমৃতসভা নিশ্চিহ্ন হচ্ছে ধীরে ধীরে। অভাবদীর্ণ-নিস্তরঙ্গ সেই গ্রাম্য জীবনে... ধরা যাক, লাগাতার কতিপয় জন্মান্ধ-আর্তরব প্রতিষ্ঠা পায়, উদ্বাস্তু হওয়ার আরও খানিকটা আগে। হয়তো এই প্রকার কুশাসন মোমেনাদের গ্রামে নয়, মোমেনাদের গ্রাম হয়ে আরো দূর সংসার-পাতালে, আরও ধূসর-খর্বকায় শেষতম মশালের আর্তনাদ ছুঁইছুঁই পদচিহ্নের রাজ্যে পৌঁছায়। এরকম সন্ধ্যা নেমে আসা প্লাবনভূমিতে মানুষ ভাসমান হয়, মলিন হয়, আর তাদের তাবৎ মধুক্ষরণ বাক্যরাশি নিশ্চেষ্ট হয়, নিশুতি হয় এবং খোলা আকাশ প্রান্তে কেবলই নির্মিয়মাণ ভৌতিক বৃক্ষরাজি ও অবিরাম ছায়ামূর্তি হয়। এবার মোমেনাদের জন্ম-জন্মান্তের দীর্ঘ ক্রন্দনের মতো প্রাক্তন গ্রাম-পৃথিবীতে- অনিন্দ্যসুন্দর উন্নয়ন শোভা-বর্ধনের জন্য অপার্থিব দেয়াল গেঁথে, ভেতরে কৃত্রিম ডাইনোসর এবং বাঘ রাখা হয়- থিম-বাগান প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। বলাবাহুল্য, ভূমি আক্রমণের অপব্যাখ্যায়, জ্বালাময় একপ্রকার ক্রোধ ও মৃত্যু-সংযুক্তিতে নাকাল- রক্ষাকবচহীন এই লোকদের স্মৃতিচিত্রময় ক্ষুদ্রাকায় কিচেন-গার্ডেনের বহুবিধ সমষ্টি বিসর্জিত হয় এই বালি সিমেন্টের ডাইনোসোর ও বাঘের নকল থাবায়... কারণ একনিষ্ঠ মন্ত্রোচ্চারণে, থিম-বাগানের পাশাপাশি এখানে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে অনন্ত নক্ষত্রের মতো এক থার্মাল পাওয়ার। বিদ্ব্যৎ সমাজে অভিজ্ঞান হয়- আলো উৎপাদনের যুদ্ধস্রোতে প্রতিদিন ছয় মিলিয়ন ছাইভস্ম আসবে আমাদের উঠোনে। ভূমি অধিগ্রহণে বাধা আসায় পুলিশ অনেকগুলো মামলা দায়ের করেছে ইতোমধ্যে। দেখা যাবে- উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় নদীর ঐ প্রান্তে কোথাও বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে। নিমার্ণ হচ্ছে ইকোপার্ক, পার্টি সেন্টার অথবা পিকনিক স্পট। ফলে জমির বদলে জমি চাই... এই শব্দরাশি অচিরেই ভূতলে পথ হারায় এবং সত্তরোর্ধ্ব এবাদউদ্দিন প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্যে, অভুক্ত ও তৃষ্ণার্ত কাল পাড়ি দিতে-দিতে দিক চিহ্নহীন হয়ে জেলা প্রশাসকের সামনে বিষপানে আত্মহননের পথ উন্মুক্ত করে নিশ্চিন্তে। স্মরণ করুন- উন্নয়নজনিত রিফিউজি হওয়ার কালে, সে বছরইে এক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান এলো গ্রামে... যেহেতু তোমাদেরকে গৃহত্যাগী হতে হবে, অন্তত বেঁচেবর্তে থাকার জন্য, এক্ষনি সঞ্চয় কর, ...পাঁচ বছরেই দ্বিগুন; একমাসের মাথায় পঁচিশ লাখ টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠান নিখোঁজ! লোকেরা কপর্দকহীন হওয়ার ভেল্কিবাজিতে হতবিহ্বল হয় এবং লাগাতার হুমকির সম্মুখিন হয়- গ্রাম ছেঁড়ে যাও : হাইওয়ে হয়ে, বাঁধ হয়ে, বিদ্যুৎ হয়ে, নতুন এয়ারপোর্ট হবে, রপ্তানি বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প হবে, আর হবে তেজস্বী প্রতিভাবান এক বিস্তারিত সেনা-ছাউনি! প্রায় অন্তঃপুরিকা-স্ত্রী অধুনা দূরের কনস্ট্রাকশন ফার্মের মেসে গৃহপারিচারিকা হওয়ায় বাস্তুচ্যুত মুহম্মদ মহসিন লজ্জায়-ক্রোধে নিজেকে দগ্ধীভূত করে। অপর হীনজন্ম-প্রতিবেশী দবির মৃধা, কন্যাকে- মুম্বাই-কলকাতার নিষিদ্ধ লাল অঞ্চলে চূর্ণ করার জন্য, পরিবারের বাকি পাঁচজনের খাদ্য হবে দিন পাঁচেকের- সেই লোভে-ভয়ে উন্মাদের মতো অর্থ গ্রহণ করে, অচেনা এক আপাত মধুক্ষরা জিন্স টি-শার্ট পরিহিত, পৃথুল মধ্যবয়সীর হাত থেকে। উদ্বাস্তু লোকেরা ভেবে ভেবে- বহনকৃত পুরনো ভারগ্রস্ত বিছানা বালিশ পুড়িয়ে দেয়, মোটর গ্যারেজের আঁধার-বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে নাগরিক হওয়ার শপথবাক্য পাঠ করে এবং শুদ্ধ অন্ধকার গায়ে মাখে। লোকেরা ক্লান্ত হয়, নিরুদ্বিগ্ন হয়, নতুন সম্ভাব্য এয়ায়পোর্ট-বাঁধ ও বিদ্যুত কেন্দ্রের সারিসারি কাল্পনিক অদৃশ্য আলোয় মুখ দেখে ভাঙা আয়নায় এবং অখ- এক শোকদিবসের কিনারায় নতুন চিরনতুন কতিপয় দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হয়। পাড়ায় পোষা একটি কুকুর ছিল তাদের অনন্তদিনের... লোকেরা চূড়ান্ত অজ্ঞাতবাসের আগে, খেয়াল করে- রুটি ছিনতাই নিয়ে দুটি প্রাণী... দ্বিপদ বনাম চতুষ্পদ, সমবেত মানুষের করতালিতে সাধ্যাতীত এক লড়াই শুরু করেছে; পোষা কুকুর রুটির অপেক্ষায় দ্বিপদ-জন্তুর শত্রু হয়, বিবশ হয় এবং পুরনো মানুষ-বন্ধুকে সকল গৌরবময় শপথবাক্য বিস্মৃত হয়ে কামড়ে দেয়- লোকটি অরক্ষিত শরীরে ক্ষত নিয়ে, ক্ষুধা নিয়ে, ভয় নিয়ে, অচেতন হতে-হতে পঞ্চম দিবসে অবশেষে প্রদোষকালের জনহীন তীরে জলাতঙ্কের আবহ তৈরির আগেই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে। বলা যায়, নতুন নতুন মৃতদেহ এইভাবে অগাধরাত্রির দিকে প্রবাহিত হলে জনবসতি ক্রমশ একলা হয়, নীরব হয়, উদাস হয় এবং তাদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ হয় কেবলমাত্র জলের অক্ষরে। উৎপাটন-যজ্ঞ এই প্রকার সুপ্রচুর মসৃণ হওয়ায় প্রজেক্ট অফিসারের মুখম-ল শান্ত এবং আনন্দঘন এবেলা; লোকেরা যখন গৃহত্যাগী হচ্ছে, বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে প্রজেক্ট অফিসের খোলা বারান্দায় মিষ্টান্ন বিতরণ ও যৎকিঞ্চিৎ ফলাহারের ব্যবস্থা হয়। উন্মূল মানুষ নক্ষত্রের ছায়ায়, অন্ধকারে, মৃত্তিকার কোমল মনের ভেতর সভয়ে হাঁটে... অবলোকন করে বিপুল তরঙ্গ, বাতাসে শোকগাথা ছড়ায়, মৃতদেহের সৎকার সম্পন্ন করে, আর হঠাৎ-ই মনে দাবানল ছড়িয়ে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা তথা আধিপত্যমূলক বকব্রতী উন্নয়ন-পর্ষদকে মৃদু উত্ত্যক্ত করে- ফলে গুলি হয় অচেনা এক আঁধার নিরাপদ জায়গা থেকে; এই অজ্ঞাত গুলিবর্ষণ তথা ‘বাঁধ বনাম বিশুদ্ধ পানি’ নিয়ে- রাতভর দলীয় ও নির্দলীয় সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবির ভেতর বেসুরো-অব্যাকুল-বিবশ তর্ক হয় মধ্যরাতের ঘুমক্লান্ত টেলিভিশনে; আর লোকেরা ভাবে- জমি এত গুরুত্বপুর্ণ কেন মানুষের কাছে? ডুবে যাওয়া এইসব অতিধীর নিদারুণ ক্ষতচিহ্ন, অবিরল ঘনহরিৎবর্ণ পরিহাস এবং অশান্ত মনের প্রভা নিয়ে... মোমেনা খাতুন ও তার দূর-নিকট উন্মূল আত্মীয়সভা জীবিকার সুতীক্ষ্ণ প্রহারে অবশেষে ঝলসে ওঠে, ভিক্ষাপাত্র জমায় এবং প্রাচীন গুহাচিত্রের দিকে ছিন্নদেহ বহনের কালে রাতের আকাশজুড়ে কম্পিত হস্তাক্ষর পাঠায় অথবা নির্মাণ করে এক গোপন মরণলেখ।
মোমেনা খাতুন, সামান্য এই জীবনের অংশবিশেষসহ, ক্রন্দসী হয়, সুদীর্ঘ অপেক্ষা করে এবং কাদাজল রেললাইন পেরিয়ে... নৌকা বিষয়ক লেখক নজিবর রহমানের গৃহে সাময়িক অবস্থান করার অনুমতি পায় এবং অজান্তেই পাণ্ডুলিপির ২২নং পৃষ্ঠায় কালো কফির সীলমোহর অঙ্কনে সক্ষমতা প্রকাশ করে। কাজের ফাঁকে কখনো অচিন শোকগাথা প্রবাহিত হলে, নারিকেল-দড়িতে বাঁধা বাঁশের কঞ্চির একটি প্রাচীন ভগ্নপ্রায় তোরণ কেন প্রতিদিন মস্তিষ্ক ও বুকের ভেতর প্রহরীর মতো দাঁড়ায়? মোমেনা খাতুন তার তুলনাহীন মøানতায় এই দৃশ্যজগৎ অবলোকনের চেষ্টা করে। মোমেনা খাতুন অগম্য সেই ধ্বংসাবশেষ ভেবে উদ্বিগ্ন হয়, সান্ত¡না বাক্য খোঁজে এবং থমকে দাঁড়ায়, অথবা মনের পথে-পথে হাঁটে- ঘন সবুজ আগাছা, কাঁটা ঝোপ, ভাঙা ডাল, শুকনো পাতা, পাতা মাড়াবার শব্দ আর অযোগ্য-অসমতল সেই রাস্তা বিবিধ মানবজমিন হয়ে পৌঁছে গেছে গ্রামের পরিত্যক্ত রেল স্টেশনে। স্থির এক ট্রেনের জানালা গলিয়ে দেখা গেল... জন্মান্ধ অন্ধরা ট্রেনের কামরায় ভিক্ষা করে আর কামরা বদল হতে-হতে ক্লান্তিতে অবশেষে হাতের সাদা লাঠিকে করে চিরন্তন শয়নযান।
এরকম অটুট নিদ্রার ভেতর বাক্যালাপ হয়, ...পানি খাবি : অটুট নিদ্রার ভেতর গা পুড়ে যায়, পাতা উড়ে, গঙ্গাজল-সই মধুশ্রীর আনন্দ মঠ-এর লণ্ডভণ্ড পৃষ্ঠা কাঁপে, হেঁটে হেঁটে আয়ুষ্কাল আসে, বৃক্ষশাখা আসে, করুণাধারা আসে, বইয়ের ধুলো আসে, আর আসে এক জনশূন্য আরোগ্যহীন আরোগ্যের পথ। হয়তো খেলাশেষের অবশিষ্ট ধুলোবালিতে নির্মাণ হয় আমাদের সুদীর্ঘ প্রশ্বাস, সাদা-কালো আলোকচিত্র এবং মধুর-নির্জনতম পরাজয়। কে ঘুম পাড়ানি মাঝির গান শোনাবে? মৌন-দিগম্বর-অবশিষ্ট পথ থেকে যায় আমাদের অগোচরে... আমরা কথা বলি, আর আমাদের সঙ্গে কথা হয় : ...এত তীব্র ঘণ্টাধ্বনির ভেতর কিসের স্বপ্ন দেখ? ভাতের। ভাত বুঝতে পার আঁধার চোখ দিয়ে? পারি। ভাতের আগুন-গন্ধ... অতীত, বারুদ, ব্যারিকেড ও আস্থাজ্ঞাপন ভাষা হয়ে হাতের ভেতর চক্ষু প্রতিষ্ঠা করে। ...তুমি মর নাই? মরি না কেন? সেইতো ...মরণ হয় না ক্যান...! আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে, কারা যেন আজও ভাত রাঁধে নদীর ভেতর ডুবে যাওয়া আকাশের কোলঘেঁষে। মোমেনা খাতুনের ভাসমান অতীত গাঁয়ের লোকসকল শহর প্রান্তর আলো-ছায়ায়, ফুটপাতে, মাঠে, নদীর পাড়ে- এইভাবে কখনো শূন্যস্থান পূরণ করে বৃষ্টি পতনের মতো এবং সেইসব ভেজা বৃক্ষশাখা দেখতে দেখতে আত্মবিস্মৃত হয়, ...হয়তো বসন্তদিনের অপেক্ষাতেই দীর্ঘক্ষণ বৃক্ষশাখা দেখে এবং ঝুপড়ির প্লাস্টিক-ছাদে ঝুলে থাকা নাগরিক বাদুড় ও পেঁচার সঙ্গে ভাব করে। নিশাচার জীবকূলের সঙ্গে এবার ভাব বিনিময় হয়, দৃষ্টিগোচর হয় এবং কথা হয় মস্তিষ্কে অনর্গল : ...বীজ ধান ফেলার কথা, খেয়ে ফেললাম; অর্থাৎ শপথবাক্য নিশ্চিহ্ন হলো; বিবিধ অভিশাপে সর্বশরীর জ্বলে, ভিজে যায় এবং ঘনঘোর সংঘর্ষ ছড়ায়। ঘনহরিৎবর্ণ পাতা খসে পড়ে এবং ভিক্ষাপাত্র থেকে শূন্যে অস্ত্রশালার প্রতিধ্বনি হয়। লোকেদের মৃতদেহ অগাধ রাত্রির পথে ভেসে উঠলে তীব্র ক্ষোভ হয়, ...ক্ষুধা হয়। ক্ষুধার অশেষ ঘনছায়া নিবারণের জন্য এবার মৃত্যুমথিত কীটলোক থেকে চূর্ণবিচূর্ণ-ম্লান বাক্যস্রোত মেঘাবৃত সংখ্যাহীন চিহ্ন আঁকে মস্তিষ্কে : সেই এক অসাড়-অর্থঘ্ন কাল হয় ক্রমশ অহিতকর ও নিস্পৃহ- শাকপাতা গাছের শিকড় চিবুনো শুরু হয় অলক্ষ্মীর দশায় এবং অন্নাভাবে। পুকুরে নেমে কাদা ঘাঁটাই সার...; মানুষ গাঁয়ে থাকে না। শহরে আসে। ভনভন মাছি, আর অচিরেই উন্নয়ন নগরের ফুটপাতে পুলিৎজার জয়ের সেরা সাদা-কালো ফটোগ্রাফ হয়ে ওঠে... ‘ঘুমন্ত মায়ের কোলে মৃত শিশু’ ...বলা যায়- লোকসকল এইভাবে অবিরাম অঘটন ঘটায়, অবিরাম হস্তপদ চালনা করে এবং মেগাসিটির বাকরুদ্ধ রচনাশৈলীতে মাগীর দালাল হয়, দেশি মদ বিক্রি করে, দিন মজুর হয়, বাবুর্চি হয়, গুণ্ডা হয়, পকেটমার হয়, রিকশাওয়ালা হয় এবং সুসভ্য ক্ষমতাপূর্ণ দলের অন্ধকার-কুয়াশাচ্ছন্ন-গুপ্ত হিটম্যান সাজে। ...আপনার জানা আছে, এত মানুষ শহরে আসে কেন প্রতিরোজ? গ্রাম-ঘরে কী অনাবিল আকাশ, মেঠোপথ, আদিগন্ত ধানক্ষেত? সব ছেড়ে এরা আসে শহরে। আসে বীভৎস মজার আকর্ষণে! এ দিকটায় দাঁড়ান- আপনাকে ইন্সট্যান্ট কাজের সন্ধান দিই, ...থ্রি ইন ওয়ান : একটু ভালো গতর এবং যুবতী হওয়া চাই- ভিক্ষে করুন, চাকরগিরি করুন এবং বেশ্যা হন! ভোরে ঝাঁট দিন ঝুপড়ি সংলগ্ন কতিপয় দোকান-হোটেল, ঘর মুছে দিন এক-দু’জনের, তারপর ভিক্ষে শুরু করুন। দুপুরে কোথাও বাসন মেজে আসুন; যদি গৃহকর্তার ঝলমলে লিবিডো-উদ্ভাসিত রাজপুত্তুর থাকে বা গৃহকর্তা নিজেই যদি ভায়াগ্রা-পীড়িত হয়, তাহলে ঐ দুপুরেই যৎকিঞ্চিৎ ছোঁওয়া-ছুঁয়ি, এতেও অর্থাগম আছে নিষ্কণ্টক ও সাবলীল। আর যদি-বা রাতে দেহ মেলে দিন, খদ্দেরের হাতেও দেয়া যায়, তাতে হবে নগদ পয়সা। মানুষের এই প্রকার বীভৎস মজা, মোমেনা খাতুনের আত্মীয়সভায় আরও বিস্তৃত প্রলয়কাল রচনা করে ও প্রায়শ হিম করা প্রতিধ্বনি আনে; লোকেরা ও নারী পুরুষেরা জীবিকার অত্যুগ্র প্রহারে নগরীর ক্ষীণকায় গলি খোঁজে লোহা-লক্কর, ছেঁড়া জুতা, মুরগির পালক, ডাবের খোলা, পোড়া কয়লা ইত্যাদি বিক্রি করার কলাকৌশল শেখে। রাস্তায়-ফুটপাতে সরকারি উন্নয়নমূলক গর্ত খোঁড়ার সহযোগী হয়, কখনো রক্ত বেচে এবং লিঙ্গ মোটা তাজাকরণ ও বন্ধ্যা-নারীদের চিকিৎসা সম্পর্কিত উর্বর-পোস্টার মারে। পোস্টার মারলে খাবার জোটে, পয়সাও জোটে। ঐ পয়সায় আপনি আয়েশ করে ফুটপাত দেখুন : শাড়ি, টিপ, লিপস্টিক, চিকেন রোল, পরোটা, সন্দেশ, সিগারেট, পর্নোগ্রাফি, স্যান্ডউইচ, ডিম সিদ্ধ, কন্ডোম, জুতো, লিটল ম্যাগাজিন, কী নয়, ...আমরা শুনতাম বাঘের দুধ, এখন শুনি সাপের দুধও পাওয়া যায়! (ক্রমশ...)
বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১ , ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৭ শাওয়াল ১৪৪২
মামুন হুসাইন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বলাবাহুল্য- নাপিত বাড়ির শনৈঃশনৈ উন্নয়ন এলেও, গাঁয়ের আর-আর মানুষের অভাব এবং চাকুরিহীনতা হয় নিত্য দিনের ঘটনা। স্মরণ হয়- নাপিত বাড়ির মধুশ্রী চিরকালের মতো কলকাতা শহরে নিখোঁজ হওয়ার আগে, গোপনে পরস্পর গঙ্গাজল ছড়িয়ে মিষ্টিমুখ করে মোমেনা খাতুনের সই হয়েছিল... দেখা হলে, একে-অপরকে বলতো গঙ্গাজল। গঙ্গাজল নামক দুই সখী প্রাচীন বৃক্ষের গায়ে নাম লেখে- মধুশ্রী + মোমেনা; বৃক্ষ বিকশিত হয় এবং দুই সখী ক্রমশ বৃক্ষের বাকল জুড়ে উদ্ভাসিত হয়... উদ্ভাসিত অক্ষরসমূহ জলজ হয়, ম্রিয়মান হয় এবং একদিন দ্রুত আবিষ্কৃত হয়- মধুশ্রী ও মোমেনা এখন বিযুক্ত দেশ-গাঁয়ের মানুষ বটে! বৃক্ষের শরীরে প্রতিস্থাপিত অক্ষরসমূহ মোমেনা খাতুন কান্নায় দ্রবীভূত হয়ে স্পর্শ করে এবং অচিরেই জাতপাতের ব্যবধান, অন্তঃস্থলের রক্তক্ষরণ ও আত্মীয়তার বিধি-নিষেধ নিংড়ে নিখোঁজ গঙ্গাজল-সখী মধুশ্রীর অন্তর্ধান পর্ব উন্মোচনের সুযোগ খুঁজতে বসে। লোকসকল আড়ম্বরহীন স্বচ্ছ-স্বচ্ছল কণ্ঠে শোনায়- মধুশ্রী জলচৌকিপাতা ঘরদোর, স্কুলব্যাগ, আলপথ, আলু চাষীদের ভোরবেলা ও শাড়ির রঙের মতো ধানক্ষেত পরিত্যাগ করে একটি রোগা শরীর নিয়ে, কোনো এক গোপন সন্ধ্যারাতে, কিছুমাত্র অবহিত না করেই, বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রতিবেশী-দেশে উদ্বাস্তু হয়ে যায় জিন্স-টপ পরিহিত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাদাম চিবুনোর মহড়ায়। দুপুরবেলা মধুশ্রী হয়তো আগুন-লাগা সাঁকো দেখে, কলকাতার রাস্তায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে সদ্য প্রস্তুতকৃত ডেডবডির প্রযতেœ সাদা খই উড়তে দেখে, আর কী চমৎকার কালচারাল কলেজ স্ট্রিট! মধুশ্রীদের আমলেই চিঠি যুগ শেষ হয়ে যায়; ফলে মধুশ্রী ও মোমেনা খাতুন নামক এক জোড়া গঙ্গাজল অচিরেই ট্রেন-নৌকা হয়ে শত শত অন্ধ-বালকের গান শোনে নিরুপায়- ল্যায়লা ও ল্যায়লা/...মেরা জীবন কোরা কাগজ...! কলকাতা শহরের আগুন লাগা মারুতিময় সড়ক থেকে ভেসে আসা এই গান নিশ্চয় মোমেনা খাতুন শুনতে পায় না। তার ভাগ্য নাপিত বাড়ির ছেলেমেয়েদের মতো উজ্জ্বল নয়। মোমেনা খাতুন, তার অপর আত্মীয়বর্গ এবং পাড়ার আর আর সবাই তীব্র ধ্বস্ত, খণ্ডিত এবং অনাহারী। তাদের জমিতে কেউ ইনজাংশান করায় ধানের মওসুমে ঘরে ধান তোলা যাবে না- কারণ সেকান্দার আলীর লাঠিয়াল বাহিনী উপস্থিত। প্রায়শ তাদের ছাগল-হাঁস-মুরগি চুরি হয়। কখনো নদী-পুকুরের পানি খাওয়া হয় সরাসরি, কখনো ফিটকারি; ডায়রিয়া হলে, মুদি দোকানদারকে অগ্রিম অনুরোধ করা হয়, ঔষধ রাখার জন্য। সাহায্য সংস্থার উন্নয়ন- তৃষ্ণা নিবারণের জন্য নলকূপ বসানো হয় জোতদারের দরজায়; আমরা পানি আনতে যাই, কিন্তু নলকূপে তালা লাগিয়ে রাখা হয়। দুই একর জমি চাষ করি গেল বছর : ধান হলো ২২ থেকে ২০ মণ; মালিক পায় অর্ধেক, অবশিষ্ট ধানে কোনোরকম দু’মাসের খোরাক হয়। ওদের কাছ থেকে ঋণ নিই। ধান শেষ হলে মাছ ধরি নদীতে। মাছধরা শেষ হয়, বীজ করা শুরু করি। বীজ করতে যেয়ে পায়ে ঘা হয়, ফিটকারির চাকা পানিতে গুলিয়ে প্রথমে পা ধুয়ে নিই। তারপর চুন-পানিতে গুলিয়ে সেই পানি সারারাত পায়ে দিয়ে রাখি। পা একটু শুকনা হয়, তারপর ফের বীজতলায়। জমি করি আমরা, আর জোতদার পায় ডিসিআর। উন্নয়নের দ্যুতিচিহ্ন কিংবা ভীষণমূর্তি প্রসন্নমনে দেখার জন্য আমাদের এখানে কখনো প্রকল্পের লোকজন আসে, সরকারের গাড়ি আসে, ইউনিসেফের জিপ আসে; প্রজেক্ট অফিসার গ্রুপ তৈরি করে এবং আমরা ভিক্ষাপাত্র ফেলে, পরমান্নের আশায় একনিষ্ঠ বিরামহীন মন্ত্রোচ্চারণে কাজ শিখি- তাঁতবোনা, জামা-সেলাই, রুটি-বিস্কুট, পোলট্রি, মোমবাতি, বাঁশ-বেতের কাজ, ধূপকাঠি, বই বাঁধাই ইত্যাদি; বই বাঁধানোর মেশিন দেখে আমাদের ভয় হয়েছিল... বইয়ের ধারগুলো সমানভাবে কাটতে যেয়ে আঙুল না নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রজেক্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে মোমেনা খাতুনের আত্মীয়বর্গ তর্ক করে... আমাদের গ্রুপের জিনিসপত্র উঁই এবং ইঁদুর কেটে দিচ্ছে, একটা ট্রাঙ্ক বা আলমারি পাঠানো দরকার।
প্রজেক্টের আলমারি সঠিক সময়ে পৌঁছতে পৌঁছতে মোমেনা খাতুনের পাড়া-গাঁয়ে সবুজ বৃষ্টি নামে, ড্রপ-আউট ছড়ায় এবং ক্ষেত-খামার ছুঁয়ে মানুষের ক্ষুধা ও পদাহত কুকুরের কান্না হয় অধিকতর জটিল, কুৎসিত, ভীতিমুগ্ধ ও প্রসারিত। মোমেনা খাতুনের আত্মীয়-স্বজন জঠরচক্রে বন্দি হয় এবং আর্তরব ছড়ায়। মানুষ ক্রন্দসী হয়, পথচারিণী হয় এবং আত্মীয় সভাচূর্ণ করে হীনবল হয়। লোকেদের শস্যঋণ ক্রমশ বদলায় এবং ভারি হয়- চাষের ঋণ, সমিতির ঋণ, ব্যাংকের ঋণ, মহাজনের ঋণ হয়ে আবর্তিত হয়। একবার অবিরাম পুড়ে যাওয়া মে মাসের ৮ তারিখ, ঘরের জ্যেষ্ঠ জন- লাগাতার অভুক্ত হয়ে, অর্ধভুক্ত হয়ে, কর্মহীন হয়ে শহরে যায়... ৯ই মে মোমেনার মতো বয়সী ভ্রাতুষ্পুত্রীর বিয়ে; লোকটি শহর থেকে ফিরেই সমিতির
সুবৃহৎ ঋণচক্রকে কোমলঋজু আঙুলে পরাজিত করার জন্য বোধিচিত্তের শান্ত দোলাচাল ও বৈরিতায় উদ্বন্ধনে জড়ায়। বিয়ে পিছায়-পিছায় না; বিয়ের আচারাদি সুসমাধার জন্য লাঞ্ছিত লাশ, কাটা-ছেঁড়া লাশ, হত্যা হয়ে যাওয়া লাশ... মানব দায়িত্বের শেষ অংশ হিসেবে মর্গে শুয়ে থেকে কালক্ষেপণ করে। অনেক পরে যখন লাশ গৃহ-অভিমুখী, তখন পথের একপ্রান্তে নব বিবাহিত-দম্পতির সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়... লোকেরা পথের রুক্ষবেশ ভুলে, ধুলোতে মাথা ঠুকে, শরীরের-হাড়ের ক্ষতচিহ্ন আড়াল করে, অবসন্ন-নতমুখে বুঁনো ঝোঁপের ভেতর লুকোয় যেন কন্যাদানের আশীর্বাদ মুহূর্তে মন্দ ছোঁয়াছুঁয়ি এড়ানো যায়। লোকেরা সভা করে বেঁচে থাকার জন্য; আর স্মৃতির আকাশ ভাঙা অন্ধকারে তৎক্ষণাৎ কাউকে কোথাও আগুনে পুড়তে দেখে; আর দেখ, ‘বীজধান এজেন্সির দপ্তর ঘেরাও হয়েছে’- এই অজুহাতে অতর্কিতে স্বরাষ্ট্র-বিভাগের শান্তিকাক্সক্ষী গুলি এবং একজন দু’জন রূপান্তরিত-নিশ্চল মানবমূর্তিকে দু’এক লক্ষ টাকার রাজকীয়-উদাসীন ক্ষতিপূরণ, কিংবা আমাদের বিস্তর কথোপকথন এবং নিছক মানব প্রেমবন্দনা।
যৎসামান্য এই ক্ষতিপূরণের জন্য জীবন নামক অনন্ত ক্ষমাহীন ক্ষতচিহ্ন আড়াল করে, লাগাতার বিধবা হওয়া সমীচীন মনে হয় না- অভাবদীর্ণ গ্রামবাসীর। সুবৃহৎ অন্ধকারের সমাপ্তি রেখায় ছোট ছোট হিসেব লেখা হয় মস্তিষ্কজুড়ে... ঘাস ছাটার খরচ + ট্রাক্টর চাষ + মইচাষ + বীজধানের দাম + ধানরোপণ + সার + ধান কেনা + ধান মাড়াই...? তারপর সেচের জল? ততদিনে লোকেদের জমি নিশ্চেতন হয়, খাসজমি হয় এবং এক গূঢ় সংকেতে অনিবার্যভাবে তারা উদ্বাস্তু হয় খাসজমি থেকে। ইউনিসেফের কাগজে এদের রক্তশূন্যতা চিহ্নিত করা হয়। তেজস্বী মধ্যাহ্নের প্রশ্বাসে ঘর-সংসার আরও অভাবদীর্ণ হয়, শীর্ণ হয়, নির্বল হয়, অখণ্ড উদাসীনতায় তাদের লাগাতার সন্তান উৎপাদিত হয় এবং গৃহস্থ বাড়িতে প্রায়শ অস্পষ্ট-অনির্ণীত কালব্যাপী তারা অনন্ত মুণ্ডিতমস্তক চাকরে রূপান্তরিত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে এদের সরকারি আইডি মিশে যায় আকাশ রাজ্যের আনন্দমহলে [...কার্তিক মাসে নুন মেশানো ভাত আসে/ আসে না!] এরা দাদন নেয়, খাদ্যের বিনিময়ে ক্ষয়স্নাত-উন্নয়নের রাস্তা বানায়, ...এমব্রয়ডারি কাজ শেখে, খেজুরপাতার ঝুড়ি বানায়, বাঁশের ঝুড়ি বানায়, ভিক্ষে করে, বাস্তুজমি হারায়, রক্তবমি করে এবং গালমন্দ শোনে- এত বড় গতর কাম-কাজ করবি, ...রোজগার করবি... খালি সাহায্য দাও-সাহায্য দাও...! মানুষের এই অনাহার-প্রক্রিয়া আরও সঠিক বুঝবার জন্য, মধুশ্রী নামক একদা সই অথবা গঙ্গাজল কর্তৃক উপহারে পাওয়া গ্রন্থ থেকে মোমেনা খাতুনকে পাঠ করতে বলা যায় : ...মোমেনা খাতুন বঙ্কিমচন্দ্রের পাগড়ি থেকে মাকড়সার মমি পরিচ্ছন্ন করে খাদ্য সংকটের অংশটি ময়ূরের পালক দিয়ে চিহ্নিত করে। অনুমান হয় এই বর্ণনা ‘আনন্দমঠ’-এর; ‘...ফসল ভাল হয় নাই, সুতরাং...চাল কিছু মহার্ঘ হইল- লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজত্ব কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়া লইল।...লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিতে আরম্ভ করিল। তারপর কে ভিক্ষা দেয়!...উপহাস করিতে আরম্ভ করিল। তারপর রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল। গরু বেচিল, লাঙ্গল জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল। জোতজমি বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী, কে কিনে! খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল, ইতর ও বন্যের কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। যাহারা পালাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পালাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।’
অজ্ঞাতবাসের আগে, অনিঃশেষ ঘণায়মান ঝরাপাতার আগে- সে বহুদিনের কথা, মোমেনা খাতুনের গ্রাম জুড়ে এই প্রকার অনাত্মীয়প্রলয় মিশে থাকে। লোকেরা তারপর অতি-প্রত্যুষ মায়াব্রত-জন্মবন্ধন অন্যত্র সঞ্চয় করে একদিন স্তূপকৃত বাঁশ পাতায় শব্দ তুলতে তুলতে শুষ্ককণ্ঠে হাঁটে, ...যেন বন্ধনহীন মুক্তির পথেই হেঁটে চলেছে। কতিপয় নামহীন নদীর ধার, পাখির নীরবতা, আমাদের কাতর-ক্ষয়প্রাপ্ত মন- পশ্চাতে-সমুখে রেখে, বিষণœ মৃত্তিকা ছুঁয়ে, দুধের আড়ৎ পেরিয়ে উৎচ্ছন্নে যাওয়া লোকসকল তুমুল ঘণ্ঠাধ্বনির মতো পৌঁছে যায় নগর-পৌরসভার ছায়াছায়া ডুমুর-গড়িয়ে যাওয়া অসচ্ছল-লক্ষ্মীছাড়া বারান্দায়।
[‘গাছ তুলে অন্য জায়গায় লাগালে, বাপু ইহজীবনে শেকড় গজায় না আর’.../ ‘হত্যা ছাড়া পরবর্তী অতিশয় দুঃসহ ঘটনা, শোকবিহ্বল ঘটনা- তোমাকে বাস্তুচ্যুত করা’।] অভাবদীর্ণ নিস্তরঙ্গ চেনা এই গ্রামজীবনে, ততদিনে আরও সব অকারণ দুঃসময় অতর্কিতে আছড়ে পড়ে। দীর্ঘায়িত ক্রন্দনের মতো সেই এবড়ো-থেবড়ো ঘর-দুয়ার, কাছারি, ধান-শস্য ও ক্ষমাহীন হাড়-মাংসের সংসারে- ...আর কীভাবে ফেরা যায়? অন্ধ ফুফু হাত-মুখ স্পর্শ করে- তোরাই তো আমার চোখ! ...বৃষ্টি আসছেরে। শুকনো কাপড় তুলে ফেল। পায়রা নামছে, পিছল মাটি থেকে দুর্গন্ধ, ভিজে খড়, হিমশীতল শ্যাওলার কণা নখে, ...বিবমিষা, ...আর ইট ফেলে-ফেলে পৌরসভার পরিত্যক্ত দালান এবং ফুটপাত দখল। এর অর্থ- আমাদের সমুদয় অমৃতসভা নিশ্চিহ্ন হচ্ছে ধীরে ধীরে। অভাবদীর্ণ-নিস্তরঙ্গ সেই গ্রাম্য জীবনে... ধরা যাক, লাগাতার কতিপয় জন্মান্ধ-আর্তরব প্রতিষ্ঠা পায়, উদ্বাস্তু হওয়ার আরও খানিকটা আগে। হয়তো এই প্রকার কুশাসন মোমেনাদের গ্রামে নয়, মোমেনাদের গ্রাম হয়ে আরো দূর সংসার-পাতালে, আরও ধূসর-খর্বকায় শেষতম মশালের আর্তনাদ ছুঁইছুঁই পদচিহ্নের রাজ্যে পৌঁছায়। এরকম সন্ধ্যা নেমে আসা প্লাবনভূমিতে মানুষ ভাসমান হয়, মলিন হয়, আর তাদের তাবৎ মধুক্ষরণ বাক্যরাশি নিশ্চেষ্ট হয়, নিশুতি হয় এবং খোলা আকাশ প্রান্তে কেবলই নির্মিয়মাণ ভৌতিক বৃক্ষরাজি ও অবিরাম ছায়ামূর্তি হয়। এবার মোমেনাদের জন্ম-জন্মান্তের দীর্ঘ ক্রন্দনের মতো প্রাক্তন গ্রাম-পৃথিবীতে- অনিন্দ্যসুন্দর উন্নয়ন শোভা-বর্ধনের জন্য অপার্থিব দেয়াল গেঁথে, ভেতরে কৃত্রিম ডাইনোসর এবং বাঘ রাখা হয়- থিম-বাগান প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। বলাবাহুল্য, ভূমি আক্রমণের অপব্যাখ্যায়, জ্বালাময় একপ্রকার ক্রোধ ও মৃত্যু-সংযুক্তিতে নাকাল- রক্ষাকবচহীন এই লোকদের স্মৃতিচিত্রময় ক্ষুদ্রাকায় কিচেন-গার্ডেনের বহুবিধ সমষ্টি বিসর্জিত হয় এই বালি সিমেন্টের ডাইনোসোর ও বাঘের নকল থাবায়... কারণ একনিষ্ঠ মন্ত্রোচ্চারণে, থিম-বাগানের পাশাপাশি এখানে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে অনন্ত নক্ষত্রের মতো এক থার্মাল পাওয়ার। বিদ্ব্যৎ সমাজে অভিজ্ঞান হয়- আলো উৎপাদনের যুদ্ধস্রোতে প্রতিদিন ছয় মিলিয়ন ছাইভস্ম আসবে আমাদের উঠোনে। ভূমি অধিগ্রহণে বাধা আসায় পুলিশ অনেকগুলো মামলা দায়ের করেছে ইতোমধ্যে। দেখা যাবে- উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় নদীর ঐ প্রান্তে কোথাও বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে। নিমার্ণ হচ্ছে ইকোপার্ক, পার্টি সেন্টার অথবা পিকনিক স্পট। ফলে জমির বদলে জমি চাই... এই শব্দরাশি অচিরেই ভূতলে পথ হারায় এবং সত্তরোর্ধ্ব এবাদউদ্দিন প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্যে, অভুক্ত ও তৃষ্ণার্ত কাল পাড়ি দিতে-দিতে দিক চিহ্নহীন হয়ে জেলা প্রশাসকের সামনে বিষপানে আত্মহননের পথ উন্মুক্ত করে নিশ্চিন্তে। স্মরণ করুন- উন্নয়নজনিত রিফিউজি হওয়ার কালে, সে বছরইে এক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান এলো গ্রামে... যেহেতু তোমাদেরকে গৃহত্যাগী হতে হবে, অন্তত বেঁচেবর্তে থাকার জন্য, এক্ষনি সঞ্চয় কর, ...পাঁচ বছরেই দ্বিগুন; একমাসের মাথায় পঁচিশ লাখ টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠান নিখোঁজ! লোকেরা কপর্দকহীন হওয়ার ভেল্কিবাজিতে হতবিহ্বল হয় এবং লাগাতার হুমকির সম্মুখিন হয়- গ্রাম ছেঁড়ে যাও : হাইওয়ে হয়ে, বাঁধ হয়ে, বিদ্যুৎ হয়ে, নতুন এয়ারপোর্ট হবে, রপ্তানি বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প হবে, আর হবে তেজস্বী প্রতিভাবান এক বিস্তারিত সেনা-ছাউনি! প্রায় অন্তঃপুরিকা-স্ত্রী অধুনা দূরের কনস্ট্রাকশন ফার্মের মেসে গৃহপারিচারিকা হওয়ায় বাস্তুচ্যুত মুহম্মদ মহসিন লজ্জায়-ক্রোধে নিজেকে দগ্ধীভূত করে। অপর হীনজন্ম-প্রতিবেশী দবির মৃধা, কন্যাকে- মুম্বাই-কলকাতার নিষিদ্ধ লাল অঞ্চলে চূর্ণ করার জন্য, পরিবারের বাকি পাঁচজনের খাদ্য হবে দিন পাঁচেকের- সেই লোভে-ভয়ে উন্মাদের মতো অর্থ গ্রহণ করে, অচেনা এক আপাত মধুক্ষরা জিন্স টি-শার্ট পরিহিত, পৃথুল মধ্যবয়সীর হাত থেকে। উদ্বাস্তু লোকেরা ভেবে ভেবে- বহনকৃত পুরনো ভারগ্রস্ত বিছানা বালিশ পুড়িয়ে দেয়, মোটর গ্যারেজের আঁধার-বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে নাগরিক হওয়ার শপথবাক্য পাঠ করে এবং শুদ্ধ অন্ধকার গায়ে মাখে। লোকেরা ক্লান্ত হয়, নিরুদ্বিগ্ন হয়, নতুন সম্ভাব্য এয়ায়পোর্ট-বাঁধ ও বিদ্যুত কেন্দ্রের সারিসারি কাল্পনিক অদৃশ্য আলোয় মুখ দেখে ভাঙা আয়নায় এবং অখ- এক শোকদিবসের কিনারায় নতুন চিরনতুন কতিপয় দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হয়। পাড়ায় পোষা একটি কুকুর ছিল তাদের অনন্তদিনের... লোকেরা চূড়ান্ত অজ্ঞাতবাসের আগে, খেয়াল করে- রুটি ছিনতাই নিয়ে দুটি প্রাণী... দ্বিপদ বনাম চতুষ্পদ, সমবেত মানুষের করতালিতে সাধ্যাতীত এক লড়াই শুরু করেছে; পোষা কুকুর রুটির অপেক্ষায় দ্বিপদ-জন্তুর শত্রু হয়, বিবশ হয় এবং পুরনো মানুষ-বন্ধুকে সকল গৌরবময় শপথবাক্য বিস্মৃত হয়ে কামড়ে দেয়- লোকটি অরক্ষিত শরীরে ক্ষত নিয়ে, ক্ষুধা নিয়ে, ভয় নিয়ে, অচেতন হতে-হতে পঞ্চম দিবসে অবশেষে প্রদোষকালের জনহীন তীরে জলাতঙ্কের আবহ তৈরির আগেই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে। বলা যায়, নতুন নতুন মৃতদেহ এইভাবে অগাধরাত্রির দিকে প্রবাহিত হলে জনবসতি ক্রমশ একলা হয়, নীরব হয়, উদাস হয় এবং তাদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ হয় কেবলমাত্র জলের অক্ষরে। উৎপাটন-যজ্ঞ এই প্রকার সুপ্রচুর মসৃণ হওয়ায় প্রজেক্ট অফিসারের মুখম-ল শান্ত এবং আনন্দঘন এবেলা; লোকেরা যখন গৃহত্যাগী হচ্ছে, বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে প্রজেক্ট অফিসের খোলা বারান্দায় মিষ্টান্ন বিতরণ ও যৎকিঞ্চিৎ ফলাহারের ব্যবস্থা হয়। উন্মূল মানুষ নক্ষত্রের ছায়ায়, অন্ধকারে, মৃত্তিকার কোমল মনের ভেতর সভয়ে হাঁটে... অবলোকন করে বিপুল তরঙ্গ, বাতাসে শোকগাথা ছড়ায়, মৃতদেহের সৎকার সম্পন্ন করে, আর হঠাৎ-ই মনে দাবানল ছড়িয়ে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা তথা আধিপত্যমূলক বকব্রতী উন্নয়ন-পর্ষদকে মৃদু উত্ত্যক্ত করে- ফলে গুলি হয় অচেনা এক আঁধার নিরাপদ জায়গা থেকে; এই অজ্ঞাত গুলিবর্ষণ তথা ‘বাঁধ বনাম বিশুদ্ধ পানি’ নিয়ে- রাতভর দলীয় ও নির্দলীয় সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবির ভেতর বেসুরো-অব্যাকুল-বিবশ তর্ক হয় মধ্যরাতের ঘুমক্লান্ত টেলিভিশনে; আর লোকেরা ভাবে- জমি এত গুরুত্বপুর্ণ কেন মানুষের কাছে? ডুবে যাওয়া এইসব অতিধীর নিদারুণ ক্ষতচিহ্ন, অবিরল ঘনহরিৎবর্ণ পরিহাস এবং অশান্ত মনের প্রভা নিয়ে... মোমেনা খাতুন ও তার দূর-নিকট উন্মূল আত্মীয়সভা জীবিকার সুতীক্ষ্ণ প্রহারে অবশেষে ঝলসে ওঠে, ভিক্ষাপাত্র জমায় এবং প্রাচীন গুহাচিত্রের দিকে ছিন্নদেহ বহনের কালে রাতের আকাশজুড়ে কম্পিত হস্তাক্ষর পাঠায় অথবা নির্মাণ করে এক গোপন মরণলেখ।
মোমেনা খাতুন, সামান্য এই জীবনের অংশবিশেষসহ, ক্রন্দসী হয়, সুদীর্ঘ অপেক্ষা করে এবং কাদাজল রেললাইন পেরিয়ে... নৌকা বিষয়ক লেখক নজিবর রহমানের গৃহে সাময়িক অবস্থান করার অনুমতি পায় এবং অজান্তেই পাণ্ডুলিপির ২২নং পৃষ্ঠায় কালো কফির সীলমোহর অঙ্কনে সক্ষমতা প্রকাশ করে। কাজের ফাঁকে কখনো অচিন শোকগাথা প্রবাহিত হলে, নারিকেল-দড়িতে বাঁধা বাঁশের কঞ্চির একটি প্রাচীন ভগ্নপ্রায় তোরণ কেন প্রতিদিন মস্তিষ্ক ও বুকের ভেতর প্রহরীর মতো দাঁড়ায়? মোমেনা খাতুন তার তুলনাহীন মøানতায় এই দৃশ্যজগৎ অবলোকনের চেষ্টা করে। মোমেনা খাতুন অগম্য সেই ধ্বংসাবশেষ ভেবে উদ্বিগ্ন হয়, সান্ত¡না বাক্য খোঁজে এবং থমকে দাঁড়ায়, অথবা মনের পথে-পথে হাঁটে- ঘন সবুজ আগাছা, কাঁটা ঝোপ, ভাঙা ডাল, শুকনো পাতা, পাতা মাড়াবার শব্দ আর অযোগ্য-অসমতল সেই রাস্তা বিবিধ মানবজমিন হয়ে পৌঁছে গেছে গ্রামের পরিত্যক্ত রেল স্টেশনে। স্থির এক ট্রেনের জানালা গলিয়ে দেখা গেল... জন্মান্ধ অন্ধরা ট্রেনের কামরায় ভিক্ষা করে আর কামরা বদল হতে-হতে ক্লান্তিতে অবশেষে হাতের সাদা লাঠিকে করে চিরন্তন শয়নযান।
এরকম অটুট নিদ্রার ভেতর বাক্যালাপ হয়, ...পানি খাবি : অটুট নিদ্রার ভেতর গা পুড়ে যায়, পাতা উড়ে, গঙ্গাজল-সই মধুশ্রীর আনন্দ মঠ-এর লণ্ডভণ্ড পৃষ্ঠা কাঁপে, হেঁটে হেঁটে আয়ুষ্কাল আসে, বৃক্ষশাখা আসে, করুণাধারা আসে, বইয়ের ধুলো আসে, আর আসে এক জনশূন্য আরোগ্যহীন আরোগ্যের পথ। হয়তো খেলাশেষের অবশিষ্ট ধুলোবালিতে নির্মাণ হয় আমাদের সুদীর্ঘ প্রশ্বাস, সাদা-কালো আলোকচিত্র এবং মধুর-নির্জনতম পরাজয়। কে ঘুম পাড়ানি মাঝির গান শোনাবে? মৌন-দিগম্বর-অবশিষ্ট পথ থেকে যায় আমাদের অগোচরে... আমরা কথা বলি, আর আমাদের সঙ্গে কথা হয় : ...এত তীব্র ঘণ্টাধ্বনির ভেতর কিসের স্বপ্ন দেখ? ভাতের। ভাত বুঝতে পার আঁধার চোখ দিয়ে? পারি। ভাতের আগুন-গন্ধ... অতীত, বারুদ, ব্যারিকেড ও আস্থাজ্ঞাপন ভাষা হয়ে হাতের ভেতর চক্ষু প্রতিষ্ঠা করে। ...তুমি মর নাই? মরি না কেন? সেইতো ...মরণ হয় না ক্যান...! আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে, কারা যেন আজও ভাত রাঁধে নদীর ভেতর ডুবে যাওয়া আকাশের কোলঘেঁষে। মোমেনা খাতুনের ভাসমান অতীত গাঁয়ের লোকসকল শহর প্রান্তর আলো-ছায়ায়, ফুটপাতে, মাঠে, নদীর পাড়ে- এইভাবে কখনো শূন্যস্থান পূরণ করে বৃষ্টি পতনের মতো এবং সেইসব ভেজা বৃক্ষশাখা দেখতে দেখতে আত্মবিস্মৃত হয়, ...হয়তো বসন্তদিনের অপেক্ষাতেই দীর্ঘক্ষণ বৃক্ষশাখা দেখে এবং ঝুপড়ির প্লাস্টিক-ছাদে ঝুলে থাকা নাগরিক বাদুড় ও পেঁচার সঙ্গে ভাব করে। নিশাচার জীবকূলের সঙ্গে এবার ভাব বিনিময় হয়, দৃষ্টিগোচর হয় এবং কথা হয় মস্তিষ্কে অনর্গল : ...বীজ ধান ফেলার কথা, খেয়ে ফেললাম; অর্থাৎ শপথবাক্য নিশ্চিহ্ন হলো; বিবিধ অভিশাপে সর্বশরীর জ্বলে, ভিজে যায় এবং ঘনঘোর সংঘর্ষ ছড়ায়। ঘনহরিৎবর্ণ পাতা খসে পড়ে এবং ভিক্ষাপাত্র থেকে শূন্যে অস্ত্রশালার প্রতিধ্বনি হয়। লোকেদের মৃতদেহ অগাধ রাত্রির পথে ভেসে উঠলে তীব্র ক্ষোভ হয়, ...ক্ষুধা হয়। ক্ষুধার অশেষ ঘনছায়া নিবারণের জন্য এবার মৃত্যুমথিত কীটলোক থেকে চূর্ণবিচূর্ণ-ম্লান বাক্যস্রোত মেঘাবৃত সংখ্যাহীন চিহ্ন আঁকে মস্তিষ্কে : সেই এক অসাড়-অর্থঘ্ন কাল হয় ক্রমশ অহিতকর ও নিস্পৃহ- শাকপাতা গাছের শিকড় চিবুনো শুরু হয় অলক্ষ্মীর দশায় এবং অন্নাভাবে। পুকুরে নেমে কাদা ঘাঁটাই সার...; মানুষ গাঁয়ে থাকে না। শহরে আসে। ভনভন মাছি, আর অচিরেই উন্নয়ন নগরের ফুটপাতে পুলিৎজার জয়ের সেরা সাদা-কালো ফটোগ্রাফ হয়ে ওঠে... ‘ঘুমন্ত মায়ের কোলে মৃত শিশু’ ...বলা যায়- লোকসকল এইভাবে অবিরাম অঘটন ঘটায়, অবিরাম হস্তপদ চালনা করে এবং মেগাসিটির বাকরুদ্ধ রচনাশৈলীতে মাগীর দালাল হয়, দেশি মদ বিক্রি করে, দিন মজুর হয়, বাবুর্চি হয়, গুণ্ডা হয়, পকেটমার হয়, রিকশাওয়ালা হয় এবং সুসভ্য ক্ষমতাপূর্ণ দলের অন্ধকার-কুয়াশাচ্ছন্ন-গুপ্ত হিটম্যান সাজে। ...আপনার জানা আছে, এত মানুষ শহরে আসে কেন প্রতিরোজ? গ্রাম-ঘরে কী অনাবিল আকাশ, মেঠোপথ, আদিগন্ত ধানক্ষেত? সব ছেড়ে এরা আসে শহরে। আসে বীভৎস মজার আকর্ষণে! এ দিকটায় দাঁড়ান- আপনাকে ইন্সট্যান্ট কাজের সন্ধান দিই, ...থ্রি ইন ওয়ান : একটু ভালো গতর এবং যুবতী হওয়া চাই- ভিক্ষে করুন, চাকরগিরি করুন এবং বেশ্যা হন! ভোরে ঝাঁট দিন ঝুপড়ি সংলগ্ন কতিপয় দোকান-হোটেল, ঘর মুছে দিন এক-দু’জনের, তারপর ভিক্ষে শুরু করুন। দুপুরে কোথাও বাসন মেজে আসুন; যদি গৃহকর্তার ঝলমলে লিবিডো-উদ্ভাসিত রাজপুত্তুর থাকে বা গৃহকর্তা নিজেই যদি ভায়াগ্রা-পীড়িত হয়, তাহলে ঐ দুপুরেই যৎকিঞ্চিৎ ছোঁওয়া-ছুঁয়ি, এতেও অর্থাগম আছে নিষ্কণ্টক ও সাবলীল। আর যদি-বা রাতে দেহ মেলে দিন, খদ্দেরের হাতেও দেয়া যায়, তাতে হবে নগদ পয়সা। মানুষের এই প্রকার বীভৎস মজা, মোমেনা খাতুনের আত্মীয়সভায় আরও বিস্তৃত প্রলয়কাল রচনা করে ও প্রায়শ হিম করা প্রতিধ্বনি আনে; লোকেরা ও নারী পুরুষেরা জীবিকার অত্যুগ্র প্রহারে নগরীর ক্ষীণকায় গলি খোঁজে লোহা-লক্কর, ছেঁড়া জুতা, মুরগির পালক, ডাবের খোলা, পোড়া কয়লা ইত্যাদি বিক্রি করার কলাকৌশল শেখে। রাস্তায়-ফুটপাতে সরকারি উন্নয়নমূলক গর্ত খোঁড়ার সহযোগী হয়, কখনো রক্ত বেচে এবং লিঙ্গ মোটা তাজাকরণ ও বন্ধ্যা-নারীদের চিকিৎসা সম্পর্কিত উর্বর-পোস্টার মারে। পোস্টার মারলে খাবার জোটে, পয়সাও জোটে। ঐ পয়সায় আপনি আয়েশ করে ফুটপাত দেখুন : শাড়ি, টিপ, লিপস্টিক, চিকেন রোল, পরোটা, সন্দেশ, সিগারেট, পর্নোগ্রাফি, স্যান্ডউইচ, ডিম সিদ্ধ, কন্ডোম, জুতো, লিটল ম্যাগাজিন, কী নয়, ...আমরা শুনতাম বাঘের দুধ, এখন শুনি সাপের দুধও পাওয়া যায়! (ক্রমশ...)