ধারাবাহিক উপন্যাস : চার

শিকিবু

আবুল কাসেম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

পাঁচ.

ইঝোমি শিকিবুর বাবা ইচিঝেন থেকে ফিরে এসে মেয়ের সম্পর্কে যা শুনলেন তাতে তার চিন্তিত হবার কারণ ছিল। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে স্থির করে ফেললেন মেয়ের বিয়ে দেবেন। এক্ষত্রে মেয়ের মতামত এবং গভর্নর তাইরা নো ইয়াসুহিরার সাহায্য দরকার।

ইয়াসুহিরা ইঝোমির বিয়ের জন্য ভালো এক পাত্রই ঠিক করে ফেললেন। ইঝোমি প্রদেশের গভর্নর। নিজে ইতচো প্রদেশের গভর্নর বলে যোগাযোগের কাজটা সহজেই হয়ে গেল। পাত্র তাচিবানা নো মিচিসাডা। বয়স একটু বেশি। মাতামহের যুক্তি ছেলেদের বেশি বয়স কোনো সমস্যা না। জাপানে তা অহরহ ঘটছে। অভিজাত মহলেই বেশি।

বাবা-মা ভাবলেন, এখন পাত্রস্থ করতে না পারলে, যে কোনো দুর্ঘটনা বা অঘটন ঘটে যেতে পারে। সুতরাং বিদায় কর। ইঝোমি রাজি হল অন্য কারণে। তাকে স্থায়ীভাবে স্বামীর কাছে যেতে হবে না। বাবার বাড়ি এই টোমাচি লেনেই থাকবে এবং ছেলে বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাবে। বাবা সম্রাটের দরবারে যে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছেন তাতে রাজি হয়ে যাবে। তার ফলে মেলামেশার পরিধি বাড়বে।

হেইয়ান অভিজাত সমাজে পুরুষদেরই প্রাধান্য। এখানে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বিয়ের ক্ষেত্রেও তাই। মিচিসাদা ইয়াসুহিরার সহায়তায় পাত্রী দেখেছেন। দেখেই পাত্রী পছন্দ হয়েছে। কথাও হয়েছে। ইঝোমি তার হবু স্বামীকে ওয়াকা কবিতায় পত্র লিখেছে।

হবু স্বামী তাতেই চিত্তহারা। তিনি কবিতা লিখতে পারেন না। হবু স্ত্রীর কবিতা মনের একেবারে মণিকোঠায় পৌঁছে গেছে। হেইয়ান সাম্রাজ্যের উচ্চপর্যায়ে কবিতা ও কবির মর্যাদা সর্বাধিক। মিচিসাদা তাতেই কাবু। তার মনে ভাব জমা হয়েছে, কিন্তু তিনি কবিতা লিখতে পারেন না। তাই গদ্যেই লিখলেন, ‘হে আমার প্রেম জাগানিয়া চিত্তহারিণী, জানিনা কখন তোমার সান্নিধ্য পাব। একা একা এখন সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। তোমার মুখচ্ছবি সবসময় সর্বত্র ভাসতে থাকে, অন্তর পুড়তে থাকে অবিরাম দহন যন্ত্রণায়। একেই কি প্রেম বলে?’

জবাবে কবিতায় ইঝোমি লিখলেন, ‘নোদোকা নারু অরি কোসো নাকেরে হানা/ও ওমোউ কোকোরো নো ইউচি নি কাঝে ওয়া/, ফুকানেডো।’ অর্থাৎ ‘শান্ত মুহূর্তগুলোও বিদায় নিয়ে গেছে তলানিই মূল/অন্তরের ভেতর ফুটছে ভালোবাসার ফুল/বাতাস তাতে দিচ্ছে আরো যন্ত্রণার দোল।’

ওয়াকা কবিতা। আয়তনে ছোট, কিন্তু অর্থবহ।

বিয়েটা হয়ে গেল কনফুসিয়ানরীতি মেনে। এ রীতিটা চীন থেকে আমদানি করা হলেও বহু বছরের চর্চায় এই ক্লাসিক্যাল জাপানি নিজস্বরীতিতে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে হেইয়ান জৌলুসে যুক্ত হয়েছে শিন্টু ধর্মের ধর্মীয় অনুশাসন। রীতি এবং অনুশাসনে কোনো বিরোধ নেই, আছে মেলবন্ধন।

উচ্চ অভিজাত সমাজে বিয়েটা এখানে সাংঘাতিক কিছু নয়। একাধিক বিয়ে, সাময়িক বিয়ে, ব্যতিক্রমও আছে।

ইমন তাদের বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের কথা চিঠি লিখে মুরাসাকিকে জানান। মুরাসাকি খুশিই হলে এ জন্য যে, ইঝোমি কোনো অঘটন ঘটাবার আগেই তাদের বিয়ে হয়েছে এবং বর আচিবানা গোত্রের হলেও একটি প্রদেশের গভর্নর। পাশাপাশি নিজের কথাও ভাবলো। মন উদাস করে দেয়া ইচিঝেনের প্রকৃতিতে বসন্তের বাতাস। চারদিকে ফুটে আছে নানা ফুল। এ সময় কারো সান্নিধ্য এবং কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে।

চিঠিটি পড়ার সময়ই গভর্নরের দপ্তর থেকে বাবা ফিরলেন। মুরাসাকি বলল, বাবা, ইঝোমি শিকিবুর বিয়ে হয়েছে।

বাবা বললেন, হ্যাঁ, আমিও তা শুনতে পেলাম। হেইয়ানকিউ থেকে লোক এসেছিল, জানাল। পাত্রকে আমি চিনি। তাইরা গোত্রের। তার মাতামহের গোত্র। বাবার গোত্র ওয়ে।

ইমন যে লিখলো তাচিবানা গোত্রের?

হতে পারে। তাহলে তা আরো নিম্ন গোত্রের।

তাতে কী এসে যায়, এখন তো এরকম ঘটছে।

তা ঘটছে। সম্রাটের দরবারে ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্থান পাওয়া কঠিন হবে।

মুরাসাকি মনে মনে বলল, সে ঠিকই জায়গা করে নেবে।

ইমন লিখেছেন, বিয়ের অনুষ্ঠানেই মনে হলো ওরা হরিহর আত্মা, ইজোমি আগে কাউকে ভালোবাসত বুঝবার কোনো উপায় নেই। সে কথা মনে করে মুরাসাকির খুব হাসি পেল। পরক্ষণেই মনে মনে বলল, ভুলে যাক সে সর্বনাশা অতীত, ভুলে থাক। তবে ছেলেটির অবস্থা কী? ওর জন্য মায়া হয় তার।

মুরাসাকির বাবার মধ্যেও ভাবনা ঢুকে গেছে। ইঝোমির বিয়ে, তার মেয়ে সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলছে। তাকেও তো বিয়ে দেয়া উচিত। হেইয়ান জাপানের নিয়ম অনুযায়ী কন্যার বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব মা-বাবার। তারাই উদ্যোগী হয়ে মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজে নেন। গভর্নরের ঐতিহ্যবাহী বাংলোর ওপর তলায় বসলে জাপান সাগর দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে তামেতোকি মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন। পাত্রের বংশ গোত্র, শিক্ষা-দীক্ষা, সাংস্কৃতিক আচার এবং অর্থকড়ি থাকাটা জরুরি।

চিন্তার স্রোত তাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। স্ত্রী বেঁচে থাকলে তিনিই এসব নিয়ে ভাবতেন। তাকে তাগাদা দিতেন। নিজেও হয়ত পাত্রও খুঁজতেন। কত শান্ত এবং হৃদয়বতী ছিলেন ভদ্রমহিলা। উত্তরের ফুজিওয়ারারা উচ্চ বংশ, তা সত্ত্বেও কোনো অহংকার ছিল না। তাকাকুও হয়েছে সে রকম। মায়ের স্বভাব পেয়েছে। কে জানে কী ভাগ্য নিয়ে এসেছে। তার মা কেন অকালে মারা গেলেন? জাপানে হেইয়ানদের সময়ে গড়

আয়ু খুবই কম। অন্য সব দিকে উন্নতি হয়েছে, সাজপোশাকের চাকচিক্য বেড়েছে, সৌন্দর্যচর্চা সর্বকালকে ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নতি হয়নি, মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না, গড় আয়ু বাড়ছে না। রাজন্যবর্গ, সম্রাটের দরবারের মন্ত্রী-অমাত্য সকলেরই বিশাল বপু। ঐতিহ্যবাহী জাতীয় পোশাক কিমোনো পরিধান করে বসলে বিশাল জায়গার প্রয়োজন হয়। শরীর বাড়ছে, স্বাস্থ্য না। মোটা হওয়া স্বাস্থ্য বা সুস্থতা নয়, তা তখন পর্যন্ত অভিজাত লোকজন বুঝে উঠতে পারেনি, তাই স্বাস্থ্য সচেতনতারও জন্ম হয়নি।

তাকাকুর মায়ের মৃত্যু তাকে বড় বেশি শূন্যতায় ফেলে দিয়েছে। কিয়োটোতে তা ভুলে থাকা যেত, এখানে নয়। বিশাল জাপান সাগর, উন্মুক্ত আকাশ ও উদার প্রকৃতি যেন স্ত্রীর অভাব এবং শূন্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে। আকাশের কোল ঘেঁষে পাহাড় শ্রেণি আছড়ে পড়া সমুদ্র ঢেউকে প্রতিনিয়ত সামলে নিচ্ছে। এ যেন সমুদ্র ঢেউয়ের পাহাড়ের ওপর নির্ভরতা, ভালোবাসা। তার নির্ভর করার মানুষটি তাকে ছেড়ে গেছে।

মুরাসাকি এসে তার চিন্তায় ছেদ ঘটালো। বাবা আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম।

বসো। নোবুনোরি কোথায়?

চীনা ধ্রুপদী নিয়ে ব্যস্ত আছে।

তার জন্য চিন্তা হয়।

সে তো চেষ্টা করছে, বাবা।

হ্যাঁ, চেষ্টা করছে, তার দোষ দিয়ে লাভ নেই।

বাড়ি ভর্তি কাজের লোক। হেইয়ান সম্রাটের প্রাসাদের মতো স্বরগরম। তামেতোকি উৎসব অনুষ্ঠানের মানুষ। এখানেও তাই উৎসব-অনুষ্ঠানের কমতি নেই। স্ত্রীর শূন্যতা এবং চিন্তা কাটাতে মাঝে মধ্যেই উৎসব অনুষ্ঠানে মেতে ওঠেন। সামুরাই সেনাপতি, রাজস্ব বিভাগের প্রধান, শিন্টু শ্রাইনের প্রধান এবং গণ্যমান্য অভিজাত লোকেরা অংশ নেন। সাংস্কৃতিক ঔজ্জ্বল্য শুধু হেইয়ান কিউতে নয়, সমস্ত জাপানে। শিন্টু শ্রাইন, বৌদ্ধকেয়াং, গভর্নরের দরবার, লোকেদের পোশাক-আশাক, সাজসজ্জা, জীবনবোধ, সাহিত্য চর্চা, নো, কাবুকি-বুনরাকু থিয়েটার- সর্বত্র একটা নবজাগরণ যেন সূচিত হয়েছে। দৃশ্যত লোকজ জাপান চীনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে বের হয়ে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র তৈরি করছে, যদিও সম্রাটের দরবারে চীনা ক্লাসিকের চর্চা করা হচ্ছে এবং চায়না সংস্কৃতিকে তখনও আভিজাত্যের মাপকাঠিতে দেখা হচ্ছে। তবে নারীরা দরবার বা প্রাসাদ-অভ্যন্তরে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চাটা করছে নিজেদের কানা ভাষায়, চীনা সাহিত্যের ভূত মাথায় নেই- তা নয়, তা আছে আভিজাত্যের এক পোশাকি অহংকারে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে এবং অবস্থানগত প্রতিযোগিতায়।

হেইয়ান জাপানি সমাজ এ নিয়ে ভাবছে। তার ছিটেফোঁটা ঢেউ এসে লেগেছে এই সমুদ্র উপকূলের প্রত্যন্ত প্রদেশ ইচিঝেনেও। তামেতোকি গভর্নর হলেও অগ্রসর কবি এবং পণ্ডিত ব্যক্তি, তাকেও ব্যাপারটি ভাবায়। মেয়েকে তার বিয়ে ভাবনা কিংবা স্ত্রী বিয়োগের দুর্ভাবনার কোনোটাই বুঝতে না দিয়ে এ ব্যাপারটি নিয়েই কথা বললেন এবং গল্প করতে শুরু করলেন।

তামেতোকি বললেন, বুঝলে তাকাকুণ্ড একটা সময় ছিল যখন জাপান ছিল সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। চীনের তেঙ সম্রাটদের সময়ে (সপ্তম থেকে নবম শতক) জাপান থেকে বিশটি দল চীনে নানা মিশনে যায়। এরা ফিরে এসে জাপানের পুরো সাংস্কৃতিক পরিম-লে পরিবর্তন আনে। তাতে চীনা ভাষা এবং সংস্কৃতির সংস্পর্শে গিয়ে জাপানি সংস্কৃতিতে এক শক্তিশালী উত্থান ঘটে। কানা ভাষাকে চীনা ভাষার বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ করে তুলতে থাকে। সপ্তম শতকে বৌদ্ধ ধর্ম এখানে আসে। সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মীয় সংস্কৃতি। কিন্তু তাতে শিন্টু ধর্মের সঙ্গে বিরোধ বাঁধেনি। মানুষ দুটোকেই গ্রহণ করেছে। আমাদের এই মিশ্র ধর্মীয় সংস্কৃতিকে বলা হয় আসুকা সংস্কৃতি।

এতে কী ভালো হলো? প্রশ্নটা নোবুনোরির। চীনা সংস্কৃতিই তাকে ঝামেলায় ফেলেছে।

তাকাকু বলল, নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। এরকম পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল।

বাবা বললেন, নোবুনোরির প্রশ্নও ঠিক। কারণ তা অনুভব করেই নবম শতকের শেষদিকে হেইয়ান সম্রাট চীনা এবং কোরিয়ার সঙ্গে সরকারি যোগাযোগ ছিন্ন করে দেন, নিজস্ব কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির বিকাশ কল্পে।

নোবুনোরি বলল, তাহলে সম্রাটের দরবারে কেন চীনা ভাষার চর্চা হয়?

অত্যন্ত যৌক্তিক প্রশ্ন। দেখো, হেইয়ান কিউ সমাজটা কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদম উচ্চস্তরে সম্রাট ও রাজন্যবর্গ। তাদের নিচে সামরিক বাহিনী। তাদের নিচে কৃষি জমির মালিক, কারিগর এবং হস্তশিল্পীরা। সবার নিচে বণিক আর ব্যবসায়ীরা।

মুরাসাকি বলল, সামরিক বাহিনীকে এতটা গুরুত্ব দেয়া ঠিক হয়নি। শিন্টু ধর্মের পুরোহিতদের স্থান কোথায়?

নতুন সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় উদারতার পাশাপাশি শিন্টু এবং বৌদ্ধ দু’টি ধর্মের পুরোহিতদের জন্য সম্মানজনক স্থান নির্ধারণ করা আছে- যদিও বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসীদের মহাযান, বজ্রযান এবং হীনযানে বিভক্তি রয়েছে। কনফুসিয়াসের অনুসারীদেরও সম্মানের সঙ্গে দেখা হয়। সামাজিক বিকাশ কিংবা আর্মির পেশা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডকে ধর্মীয় বলয় মুক্ত বলেই মনে করা হয়। সামরিক বাহিনীকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারটা রাজনৈতিক।

এই বিভাজনে আমাদের সাংস্কৃতিক নিজস্বতা তৈরি হয়েছে এবং পূর্বের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য ফিরে যাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় আমাদের এ সময়ে হেইয়ান সাম্রাজ্য রাজনীতি, ধর্মচর্চা, শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতির নতুন দিগন্তের দিকে পাখা মেলেছে। সঙ্গে ধারণ করেছে নিজস্ব ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে। আশা করা যায় তা একদিন গগনচুম্বী হবে।

বাবার কথাগুলো ভারি শোনালেও দুই ভাইবোন তা মনোযোগ দিয়ে শোনে। নোবুনোরি দেখতে চায় চীনাভাষা শেখার ভার লাঘবের পথ। মুরাসাকি উপলব্ধি করে এক ধরনের উত্তেজনা, যার মধ্যে শত সম্ভাবনার স্বপ্ন।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামে। শ্রাইন এবং প্যাগোডাগুলোয় ধর্মীয় সঙ্গীতের সুর বেজে ওঠে। পাশাপাশি পুরোহিতের মন্ত্রধ্বনি। মূল শিন্টু শ্রাইনটি গভর্নর প্রাসাদের কাছেই।

আকাশে চাঁদ উঠেছে, পূর্ণিমার চাঁদ। পাহাড়গুলোর চূড়ায় বরফ জমেছে। পাহাড়গুলোর কোল ঘেঁষে জাপান সাগর তীরে তীব্র শীতকে উপেক্ষা করে ফুটে আছে নাম না জানা অসংখ্য বুনোফুল। মুরাসাকিদের প্রাসাদের বিশাল জানালা দিয়ে এসব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়। বাবা প্রার্থনা শেষে তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন। তিনি নিজে কবি। পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা তুষারে চন্দ্রালোক পড়ে ভূস্বর্গ তৈরির দৃশ্যটা হয়ত স্থির দেখাতো। কিন্তু পাদদেশে বাতাসে দোল খাওয়া ফুল আর জাপান সাগরের আছড়েপড়া ঢেউ যেন তাতেও গতি যুক্ত করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে তা এই বুঝি স্বর্গে উড়ে যাবে। তাই বাবার চিত্ত-চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এরকম চিত্ত-চাঞ্চল্য কবিতার জন্ম দেয়।

ছয়.

আকাঝুমি ইমন সম্রাটের প্রাসাদে চাকরি করছেন অনেক দিন হলো। কাজটা তিনি করছেন এখন রিনশির সহচরী হিসেবে। তার আগে রিনশির বাবা প্রিন্স মিনামাতো নো মাসানোবুর দরবারে কাজ করেছেন বেশ কিছু দিন।

রিনশি প্রিন্স ফুজিওয়ারা নো মিচিনাগার স্ত্রী। ছোট সম্রাজ্ঞী শোশির মাতা। ইমনকে নানা বাড়িতে চাকরি করা থেকে চেনেন শোশি। সম্রাটের প্রাসাদে সম্রাজ্ঞী হিসেবে আসার পর তাকে এক শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হয়। এই প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ নন সম্রাটের জ্যেষ্ঠ সম্রাজ্ঞী তেইশি। ইতোমধ্যেই এই সম্রাজ্ঞী কোগো বা ‘উজ্জ্বল কুন্তলা সুন্দরীর’ খেতাব পেয়ে গেছেন। প্রাসাদের লোকজনই তাকে এ খেতাব দিয়ে রেখেছে। শোশিকে বলে চুণ্ডু বা ‘ভেতরে রুচিকর এক শান্ত তরুণী’- যার বয়স মাত্র বারো।

হেইয়ান আভিজাত্য এবং সৌন্দর্র্যের একটি বৈশিষ্ট্যে লম্বা সুন্দর চুল। তা শোশির পক্ষে অর্জন সম্ভব নয়। এই যন্ত্রণা তো আছেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কবি সেই শোনাগন। তিনি সম্রাজ্ঞী তেইশির লেডি-ইন ওয়েটিং। তার বাবা বা পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ তৃতীয় সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন সম্রাটের দরবারে। নামটা সে পদবিকে অনুসরণ করে ‘শোনাগন’। সম্রাজ্ঞী, তেইশির সুখ্যাতির সবচেয়ে বর্ণিল পালক হচ্ছেন এই সেই শোনাগন। বালিকা সম্রাজ্ঞীর এমন কেউ নেই যে তার সভা সেই শোনাগনের মতো উজ্জ্বল করে রাখবে।

এরই মধ্যে কবি সেই শোনাগনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য পিলু বুকের’ কিছু লেখা নাম করে ফেলেছে। এই অহংকারে সেই শোনাগন এবং সম্রাজ্ঞী তেইশি যেন হাওয়ায় ভাসছেন।

তা দেখে শোশির সহচরীদের পিত্ত জ্বলে যায়। তারা শোশির কানভারী করতে থাকে। ক্রমে শোশি উত্তেজিত হতে শুরু করেন। বাবা মিচিনাগার কাছে গিয়ে বললেন, আমার একজন লেডি-ইন-ওয়েটিং চাই, সেই শোনাগনের মতো।

বাবা মেয়ের মনোকষ্ট বুঝতে পারেন। বাকি তিন মেয়ে সম্রাজ্ঞীকেও তো দেখেছেন। এখানে বাঁচতে হলে মর্যাদার সঙ্গে গৌরব আর অহংকার নিয়ে প্রতিযোগিতা করে বাঁচতে হয়। সকল কাজে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হয় । স্ত্রীকে বললেন, আকাঝুমি ইমনকে শোশির দরবারে লেডি-ইন-ওয়েটিং করে পাঠাতে হবে। কবি হিসেবে সে নাম করেছে। রিনশি বললেন, কবি দিয়ে সে কী করবে?

মিচিনাগা কারণ ব্যাখ্যা করলেন।

রিনশি এবারে মেয়ের কষ্টটা বুঝতে পারলেন। তিনি শোশির দরবারে লেডি-ইন-ওয়েটিং করে ইমনকে পাঠিয়ে দিলেন।

ইমনের জন্য ব্যাপারটা সাধারণ নয়, একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবার মতো অবস্থা। তার স্বামী কনফুসিয়ান স্কলার এবং কবি মাসাহিরা বললেন, দরকার নেই। আমার চাকরির স্থল ওয়ারি প্রদেশে চল। আকাঝুমি ইমন দুসন্তানের মা। আদর্শ মা এবং উত্তম স্ত্রী হিসেবে তার সুনাম আছে। ইতোমধ্যে তার নিজস্ব ওয়াকা কবিতা সংকলন ‘আকাঝুমি ইমোনশো’ সম্রাটের প্রাসাদসহ বাইরেও অনেকের হাতে পৌঁছে গেছেন। তিনি পেছাতে পারেন না। স্বামীকে বুঝিয়ে বললেন, অন্যকথা। তিনি বললেন, এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না, দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ তার সঙ্গে জড়িত। একবার রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে গেলে আর প্রবেশ করা যাবে না। স্বামীকে ‘কাগোরো নিক্কির’ লেখিকার সন্তানের জন্য আত্মত্যাগের কথা বললেন। অনেক কষ্টের মধ্যে থেকেও জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে চাননি। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফিরে আসেন। সে কথা অবশ্য কনফুসিয়ান স্কলারও জানেন। অগত্যা আর কী করা, নানা উপদেষ্টা দিয়ে স্ত্রীকে সম্মতি দিলেন।

ইমোন শোশিদের পুরো পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। সেখানকার পারিবারিক পরিবেশ আর সম্রাটের প্রাসাদের পরিবেশ এক নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে যাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, এরা বয়সের কারণে পরিপক্ব এবং ভারসাম্যপূর্ণ- যদিও এরা খুবই প্রতিপত্তিশীল মানুষ। এখানে সম্রাজ্ঞীর স্বল্প বয়সটাই প্রধান সমস্যা। বুঝে, না বুঝে কথা বলেন। মনে করেন সম্রাজ্ঞী হওয়ার অর্থই হচ্ছে সবকিছু বুঝে যাওয়্ াতার কথা অন্যদের শুনতে বাধ্য করা।

ইমন দেখলেন তার যুদ্ধটা শুধু কবি সেই শোনাগনের সঙ্গে নয়। সম্রাজ্ঞীর সঙ্গেও এবং এ যুদ্ধটাই বেশি কঠিন। বুঝতে চাইলে সম্রাজ্ঞী খুব রাগ করেন। তার অর্থহীন রাগ এবং অমূলক ইচ্ছা সব সময় হজম করা যায় না। মাঝে-মধ্যে মনে করেন সম্রাজ্ঞীর মাতা রিনশির সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবেন, আবার ভাবেন তিনি কী ভাববেন আর শুনলে সম্রাজ্ঞীই বা কী মনে করবেন। কথা আর বলা হয় না। কনফুসিয়ান স্কলার স্বামীকেও এখন কিছু বলতে পারছেন না।

সম্রাজ্ঞীর আরো লেডি-ইন-ওয়েটিং রয়েছে। ওরা কবি বা মনোগাতারি লেখিকা নন। সম্রাজ্ঞীর রূপচর্চার সহায়তা করেন। তাদের সঙ্গে তার মনের মিল খায় না। তবুও মানিয়ে চলার চেষ্টা করেন।

ইমন সেই শোনাগনকে সম্মান করে চলেন। সম্রাজ্ঞীর দরবারে সেই শোনাগনের অবস্থান সংহত এবং সুদৃঢ়। অবজ্ঞা করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে শোনাগন তার চেয়ে বয়সে ছোট। এটি জানতে পারেন শোনাগনের সহচরীদের মুখে। সেই শোনাগন অহংকারী কবি। সম্রাজ্ঞী তেইশি সুবিধাজনক অবস্থান তাকে অহমিকার অধিকারী করেছে। তিনি পুরো প্রাসাদ অন্তঃপুরের খবর রাখেন। বলা হয় তথ্যজ্ঞানই শক্তি। সেই শোনাগন তা ভালোভাবেই জানেন।

তার কাছ থেকে ইমোন একটি চমকপ্রদ তথ্য জানতে পারলেন। ওই ছেলেটি ছাড়াও বিয়ের আগে প্রাসাদে আরেকজন প্রেমিক ছিল। বাবার সঙ্গে কয়েকদিন প্রাসাদে আসা-যাওয়ার কালেই এই প্রণয়ন ঘটে। পাত্রের নাম ওমোতোমারো। তিনি বিধবা মহিয়সী শোকোর দরবারে কর্মরত। মাত্র কয়েক দিনে সম্পর্ক এমন পর্যায়ে গড়ায় যে, কেউ কেউ ইঝোমিকে তার স্ত্রী ভাবতে শুরু করে।

ইঝোমির বাবা বাইরের কোনো ছেলের কথা শুনে নয়, তার কর্মস্থল কিয়োটোর সম্রাটের প্রাসাদের এই ব্যক্তির কথা শুনেই মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইমনের তাতে ভুল ভাঙ্গে। কিন্তু তিনি যে ভাবছেন ইঝোমিকে আরেক লেডি-ইন-ওয়েটিং করে সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে নিয়ে আসবেন সম্রাজ্ঞী এবং সেই শোনাগনকে টেক্কা দেয়ার জন্য, তার কী হবে। দুর্ভাবনায় পড়ে গেলেন। পরে স্থির করলেন যেভাবেই হোক ইঝোমিকে শোশির দরবারে আনবেনই।

তিনি সম্রাজ্ঞী শোশিকে বললেন, ইঝোমি শুধু নাম করা কবিই না, বাকপটু ও বুদ্ধিমতি এক মহিলা, বিয়ে হওয়া, সেই শোনাগন তার কাছে কিছুই না। দেখবেন সম্রাজ্ঞী তেইশিসহ সেই শোনাগন কী নাকানি চুবানিই- না খাবে।

শোশির বাবা ক্ষমতাশালী মানুষ। সম্রাজ্ঞী তোইশি এবং তার ভাইয়ের বেলায় আপসহীন। ইঝোমির বাবাকে তার দরবারে ডাকলেন। প্রস্তাব শুনে বাবা বললেন, এটা আমার জন্য সৌভাগ্য। প্রিন্স মিচিনাগার কন্যা সম্রাজ্ঞী শোশির সঙ্গে থাকতে পারা তার সাত জন্মের ভাগ্যি। কালই আসবে সে।

ইমন শেশির কথা আগেও একবার বলেছিলেন ইঝোমি শিকিবুকে। ইঝোমি সম্রাজ্ঞীর বয়স নিয়ে কথা তুলেছিলেন। বাবার কথায় তুচ্ছই মনে হলো। পর দিন মিচিনাগার দরবারে হাজির হলেন।

মিচিনাগা কথা বলে আশ্বস্ত হলেন এবং সম্রাজ্ঞী কন্যার দরবারে নিয়ে এলেন তাকে। শেশি ইঝোমিকে প্রথম দেখলেন। বললেন, সাজগোজ ভালো। শুনেছি কবি। কবিতা শোনাতে পার? ইঝোমি বললেন, আমার সৌভাগ্য মহামান্যা।

ইঝোমি সম্রাজ্ঞীকে তার লেখা একটি ওয়াকা কবিতা শুনিয়ে দিলেন। কবিতাটি এরকম : ‘আমার কালো চুল অবিন্যস্ত/ নির্বিকার উদাসীন/পাশে শুয়ে পড়ল সে/এবং প্রথমবার আলতো ভাবে বিন্যস্ত করে দিল/প্রিয় আমার।’

চমৎকার তো। মন্তব্য করলেন সম্রাজ্ঞী। কবিতা পড়াকালেই ইমন এসে দাঁড়িয়েছেন। সম্রাজ্ঞীর মন্তব্যে হাততালি দিলেন। সম্রাজ্ঞী বললেন, ইমন আপনি এসেছেন? ইঝোমি শিকিবু তো চমৎকার কবিতা লেখে।

মিচিনাগা বললেন, ভালোই হলো শোশি তুমি দু’জন কবি পেলে। এবার সেই শোনাগনের সাম্রাজ্ঞী বেশ জব্দ হবে। ইমন কিন্তু আমাকে নিয়ে মনোগাতারি শুরু করেনি।

মাননীয় প্রিন্স, নামটা ঠিক করেছি এবং আমার সময় থেকে তথ্য টুকে রেখেছি এখনও রাখছি।

নামটা কি? ‘এইগা মনোগাতারি’।

শুনে খুশি হলাম। ইঝোমিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখন থেকে তুমিও লিখবে।

ইঝোমি বললেন, অবশ্যই আমার মাননীয় প্রিন্স, এটা হবে আমার সৌভাগ্যের উজ্জ্বল এক পালক।

ইঝোমির স্মার্ট কথা শুনে প্রিন্স ভাবলেন, এ মেয়ে তো খুবই চালু। বললেন, আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করো, তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ইমনতো আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে, তুমিও হবে।

মিচিনাগা উঠে গেলেন।

শোশি প্রথম দিনেই তার দুই কবি লেডি-ইন-ওয়েটিংকে কিভাবে সেই শোনাগনকে টপকাতে হবে তার পরিকল্পনা চাইলেন এবং নিজের কাঁচা পরামর্শও দিলেন।

ইমন এবং ইঝোমি তা শুনে পরস্পরের দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকালেন।

সাত.

সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মুরাসাকির বাবা তামেতোকি অপেক্ষা করছেন। সম্রাট ইচিজো তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এখানে অপেক্ষায় আছেন ইঝোমির বাবা মাসামুনেও। কথা হল তামেতোকির সঙ্গে। প্রথমে অবশ্য তামেতোকি মেয়ের বিয়ের জন্য মাসামুনেকে অভিন্দন জানান এবং বলেন, তাকাকুর বিয়ের বয়স হয়েছে এনিয়ে ভাবতে পারেন।

পাত্র কি জানা আছে?

আপনার আত্মীয় ফুজিওয়ারা নো নোবুতাকা তো আছে।

হ্যাঁ, সে আমার মামার ছেলে। বয়সটা একটু বেশি।

জাপানের অভিজাত মহলে বয়স কোনো ব্যাপারই না। তার ভালো অর্থকড়ি রয়েছে, কম বয়সেই গভর্নর ছিল দুজায়গায়। এছাড়া ভালো নৃত্যশিল্পী সে। আমার মেয়ের জন্য প্রস্তাব এলে তখনই হ্যাঁ করে দিতাম।

তামেতোকি ভাবছিলেন।

আপনি চাইলে আজই কথা বলতে পারি। এরকম সংস্কৃতিবান বড়লোক পাত্র পাওয়া সহজ নয়।

খাওয়া-দাওয়া পোশাক-আশাকে অপচয় বেশি করে।

অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এসবের প্রয়োজন আছে।

তা আছে। একটু ভেবে নিই। আপনার দপ্তরে আসব আমি।

ওটা তো আপনার দপ্তরই ছিল।

এ সময় সম্রাটের দরবারে দুজনেরই একসঙ্গে ডাক পড়ল। সম্রাট তাদের উভয়কে বললেন, তোমাদের দুজনকে এক সঙ্গে ডাকার কারণ হলো, আগে তোমাদের নিয়ে একসঙ্গে বসে কথা হয়নি। তামেতোকিকে বললেন, ইচিঝেন সাধারণ প্রদেশ নয়, তার ভৌগোলিক গুরুত্ব রয়েছে। রাজনৈতিকভাবেও বেশ গুরুত্ব বহন করে।

কিছু সমস্যা আছে। ভেবেছিলেন সেসব বলবেন। প্রাক্তন গভর্নরের উপস্থিতিতে না বলার মনোস্থির করলেন।

সেসব সমস্যার কথা মাসামুনে বললেন। তাতে অবাক হলেন তামেতোকি। কারণ কথাগুলো মাসামুনের বিরুদ্ধেই যায়।

সম্রাট মাসামুনের উদারতা দেখে বললেন, তুমি তো চেষ্টা কম করোনি। তোমার কাজে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। তামেতোকি, তুমি মাসামুনের কাছ থেকে পরামর্শ নিও। তোমাদের নিয়ে আমি আজ মধ্যাহ্নভোজ গ্রহণ করবো এটাই আসল উদ্দেশ্য।

এরা দুজন কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলেন।

সম্রাট তামেতোকিকে বললেন, তোমার প্রেরিত উপঢৌকন আমার পছন্দ হয়েছে। উৎসব-অনুষ্ঠানে বিভাগে কাজ করেছে বা করছে এমন লোকদের পছন্দ এবং রুচিবোধই আলাদা।

দুজন আবারও কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলেন।

মধ্যাহ্ন ভোজের পর আসল কথাটা বললেন সম্রাট ইচিজেন। সামুরাই সেনা প্রধানের কার্যক্রম সম্পর্কে তোমাদের কি মতামত? সম্রাটের প্রশ্নে বর্তমান এবং সাবেক দুই গভর্নর পরস্পরের দিকে তাকালেন। সাবেক গভর্নর বললেন, সে উচ্চাভিলাষী।

আমারও তাই মনে হয় মহামান্য সম্রাট।

ওসব কথা চিন্তা করে তাকে এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছি। আমার কানে যা আসছে তা হলে সবই সত্য। শত্রু-সামনেই থাকুক কি বল, একে এখানেই নিয়ে আসি?

মাসামুনে বললেন, তা হলে তো ভালো হয়। তামেতোকি নিশ্চিন্তে প্রশাসন চালাতে পারেন।

সম্রাটের মনে ছিল অন্য কিছু, তা তিনি তাঁদের বললেন না।

সম্রাটের দরবার থেকে বের হয়ে তামেতোকি গেলেন সম্রাটের ডেইগাকু রিউতে। তিনি এ আকাদেমির সম্মানিত সদস্য। চীনা ধ্রুপদী সাহিত্য এবং জাপানি কবিতায় তার অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি এই আকাদেমির সম্মানিত সদস্য। এখানে একটি সভায় তাকে অংশ নিতে হবে। সমকালীন জাপানের জনপ্রিয় কবি কি নো সুরেইয়োকির কবিতা নিয়ে এখানে একটি আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে, তাতে তিনি বক্তব্য রাখবেন। কবি সুরেইয়োকিকে তাদের বাড়িতে বহুবার দেখেছেন। তার বাবা এবং পিতামহকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। কবি সুরেইয়োকিকে ছেলেবেলায় দেখেছেন এবং তার পিতামহের সঙ্গে বন্ধু ছিল, সে সুবাদে তাকে মূল বক্তা করা হয়েছে। কবি সুরেইয়োকি তার মতো গভর্নর ছিলেন। তাকে কেমন দেখেছেন তা বয়ান করলেন। সম্রাট ডেইগো সর্বপ্রথম রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জাপানে যে কবিতা সংকলনের উদ্যোগ নেন, চারজন কবির মধ্যে তিনি একজন যারা সংকলনটি সম্পাদনা করেন। কোকিন ওয়াকাশো নামের রাজকীয় কবির সংকলনটি অমর হয়ে আছে। ফুজিওয়ারা নো কিন্তু নির্বাচিত অমর ৩৬টি কবিতার মধ্যে সুরেইয়োকির একটি কবিতা রয়েছে। তবে কোকিন ওয়াকাশোর যে ভূমিকা তিনি লিখেছেন একে ওয়াকা কবিতার প্রথম মূল্যবান সমালোচনা বলে মনে করা হয়। তার লেখা তোসা নিক্কির সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম।

তামেতোকির ব্যক্তিগত পরিচয়ের গল্প এবং সুরেইয়োকির কবিতার ঋদ্ধ আলোচনায় মুগ্ধ হলেন সবাই।

তামেতোকি তার পুরোনো দপ্তরে গেলেন, মাসামুনে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। তার সামনে নোবুতাকা। মাসামুনে বিয়ের কথা তুললেন। নোবুতাকা মাথা নত করে আছেন। অর্থাৎ বিয়েতে তার সম্মতি রয়েছে।

ইচিঝেনের প্রকৃতি ভালো লেগে গেছে মুরাসাকির। সেদিন রাতে জাপান সাগরের তীর ঘেঁষে বরফ পাহাড় এবং তার পাদদেশে ফুলের এসব চাদের আলো পড়ার দৃশ্যটা মনে গেঁথে আছে। বাবা কিয়োটো গেছেন। যেতে আসতে কয়েক দিনের প্রয়োজন হয়। এ সময় প্রকৃতি তাকে খুব টানছে। চলে গেলেন সে পাহাড়ের কাছে। সঙ্গে গেছে ভাই নোবুনোরি। গভর্নর সাহেবের পরিবারের নিরাপত্তা বাহিনী তো রয়েছেই। পুরো সিটির তিন দিকে পাহাড়। প্রথমে এরা গেছে বিখ্যাত মুরাকুনি পর্বত দেখতে। তা এত সুউচ্চ যে ওপর থেকে পুরো নগরীকে দেখা যায়। বরফ পড়ে আছে চূড়ায়। নোবুনোরি বলল, সে চূড়ায় উঠবে। পথ আছে একটা গিরিপথ, খুবই সরু। সামুরাই সেনারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে উপরের দিকে। আশপাশের দৃশ্য দেখে রোমাঞ্চিত মুরাসাকি, ভেতরে দারুণ আলোড়ন। নোবুনোরি আনন্দিত সে পর্বতে উঠছে বলে। পর্বতচূড়া থেকে দেখা যায়, শিন্টু শ্রাইন এবং বৌদ্ধ প্যাগোডাগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। নগরজুড়ে যেন ফুলের মেলা। মুরাসাকি ভাবলেন, জ্যোৎস্না রাতে যদি এখানে আসা যেতো। কী অপরূপ দৃশ্যই না দেখছেন কিছুটা বাস্তবে, কিছুটা কবির কল্পনায়। তার মনে হয় শুধু চার/পাঁচ লাইনের ওয়াকায় এই সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি প্রকাশ সম্ভব নয়। চিত্রাঙ্কনেও পারদর্শী মুরাসাকি। দৃশ্যগুলো তাই অন্তরে মুদ্রিত হয়ে যাচ্ছে। পর্বতশৃঙ্গ স্পর্শ করে মেঘেরা ছুটে চলেছে। মুরাসাকি ভাসমান মেঘ স্পর্শ করে যেন মেঘের মতো উড়ে যেতে চাইছে।

ওপর থেকে জাপান সাগর দেখা যাচ্ছে, সফেন ঢেউ তার। সঙ্গে গর্জন। মর্ত্যলোকে পাহাড়-জঙ্গল ফুল, সমুদ্রের সফেন ঢেউ এবং পর্বতশৃঙ্গে বরফের ওপর প্রতিফলিত সূর্যালোক এমন এক স্বর্গলোক সৃষ্টি করেছে যে, মুরাসাকির মনে হলো, এ রকম স্বর্গীয় পরিবেশেও সে একা। এতটা বছরেও কাউকে মন দেয়া নেয়া হয়নি, সাথী কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। শূন্য হৃদয় তার। বৌদ্ধ সহজিয়া সঙ্গীত ‘শূন্যমন্দির মোররে’।

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছার বাইরে নেমে এলো পর্বত থেকে। আরও কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে। নিরাপত্তাদানকারীদের একজন বলল, সম্রাটের সিলমোহরে ব্যবহৃত ক্রিসানথ্যমম ফুলের বিশাল বাগান রয়েছে এখানে।

মহিলা নিরাপত্তাকর্মীর কথায় মুরাসাকি বললেন, কোথায়?

সে বলল, কাছেই।

ফুলটির রাজকীয় গৌরব রয়েছে। মুরাসাকি বাবার দরবারে সম্রাটের স্বাক্ষর করা কাগজপত্রের সিলে এই ফুল দেখেছে। ফুলটি জাপানে আসে পঞ্চম শতকে চীন থেকে। হেইয়ান সম্রাটদের সময়ে তা রাজকীয় গৌরবের আসনে বসে। এই ফুল নিয়ে জাপানিদের নানা বিশ্বাস ও সংস্কার রয়েছে। হেইয়ান জাপানিরা জাপানজুড়ে সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা ও আন্তরিক সমর্থনের জন্য এই ফুলের গাছ লাগায় এবং পরিচর্যা করে। যার বাগান যতবড়, তাঁর শ্রদ্ধার প্রকাশ তত বেশি। তাদের কাছে লাল বর্ণের ফুলটা ভালোবাসার প্রতীক। তেমনি নানা রঙের নানা বিশেষত্ব।

মুরাসাকি এবং নোবুনোরি এই ফুল দেখে দারুণ উচ্ছ্বসিত। বাগান মালিকের গৃহিণী তাদের কথা শুনে ছুটে এসেছেন। তারা অভিজাত শ্রেণীর মানুষ। এই ফুলও আভিজাত্যের বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক। জাপানি কায়দায় পরস্পর অভিবাদন জানালেন। মুরাসাকি বলল, ফুল দেখতে এলাম।

কী সৌভাগ্য আমাদের। মহামান্য সম্রাট ইচিজোকে আনুগত্য, তাঁর প্রিয় গভর্নরকে সমীহ। উৎসবে এলে খুব মজা হতো।

উৎসব?

হ্যাঁ, কিকোনিনগিয়ো উৎসব। তা অনুষ্ঠিত হয়- ক্রিসানথ্যমম প্যাগোডায়। মুরাসাকি বললেন, সেখানেই যাই।

চলুন আমিও যাব। তবে কিছু একটা মুখে দিয়ে যেতে হবে। না হয় আমাদের অমঙ্গল হবে।

মুরাসাকি হেসে দিয়ে বলল, আপনি একজন চমৎকার মানুষ। খুবই হাসি-খুশি।

অতিথিদের কেনকেরা খেতে দেয়া হলো। কেনকেরা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ধরনের মিষ্টি। বাড়িতেই বানানো হয়। এ মিষ্টির স্বাদে মুগ্ধ মুরাসাকি এবং তার ভাই।

ক্রিসানথ্যমম প্যাগোডা ফুলের এক সাম্রাজ্য। তা দেখে অভিভূত এরা। প্যাগোডার বৌদ্ধ ভিক্ষু তাদের স্বাগত জানালেন। জনসাধারণ ফুলের নামে ডাকে বলে প্যাগোডাটির প্রকৃত নাম চাপা পড়ে গেছে। বললেন ভান্তে। এই ফুলটার জনপ্রিয়তা শুধু জাপান বা চীন নয়, সারা বিশ্বে। বললেন আবার তিনি।

কথাটা বিশ্বাসযোগ্য। সভ্যতার মধ্যপ্রাচ্যে, প্রাচীন পারস্যে এই ফুল সমান জনপ্রিয় এবং তাকে কেন্দ্র করে নানা বিশ্বাস শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আছে। এ বিস্তার শাহনামা মহাকাব্য পর্যন্ত বিস্তৃত। জোরাস্ট্রিয়ান অধ্যাত্মবাদের শুভশক্তির কল্যাণ খোজা এর মধ্যে।

প্যাগোডায় প্রার্থনার আগে ভদ্রমহিলা মুরাসাকির কানের কাছে মুখ এনে যা বললেন তাতে মুরাসাকি লজ্জা-বিনম্র হয়ে প্রার্থনাকালে তাই চেয়ে বসলেন। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই দেখতে পাচ্ছেন একটি লাল ফুল ফুটছে।

বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১ , ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৭ শাওয়াল ১৪৪২

ধারাবাহিক উপন্যাস : চার

শিকিবু

আবুল কাসেম

image

(পূর্ব প্রকাশের পর)

পাঁচ.

ইঝোমি শিকিবুর বাবা ইচিঝেন থেকে ফিরে এসে মেয়ের সম্পর্কে যা শুনলেন তাতে তার চিন্তিত হবার কারণ ছিল। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে স্থির করে ফেললেন মেয়ের বিয়ে দেবেন। এক্ষত্রে মেয়ের মতামত এবং গভর্নর তাইরা নো ইয়াসুহিরার সাহায্য দরকার।

ইয়াসুহিরা ইঝোমির বিয়ের জন্য ভালো এক পাত্রই ঠিক করে ফেললেন। ইঝোমি প্রদেশের গভর্নর। নিজে ইতচো প্রদেশের গভর্নর বলে যোগাযোগের কাজটা সহজেই হয়ে গেল। পাত্র তাচিবানা নো মিচিসাডা। বয়স একটু বেশি। মাতামহের যুক্তি ছেলেদের বেশি বয়স কোনো সমস্যা না। জাপানে তা অহরহ ঘটছে। অভিজাত মহলেই বেশি।

বাবা-মা ভাবলেন, এখন পাত্রস্থ করতে না পারলে, যে কোনো দুর্ঘটনা বা অঘটন ঘটে যেতে পারে। সুতরাং বিদায় কর। ইঝোমি রাজি হল অন্য কারণে। তাকে স্থায়ীভাবে স্বামীর কাছে যেতে হবে না। বাবার বাড়ি এই টোমাচি লেনেই থাকবে এবং ছেলে বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাবে। বাবা সম্রাটের দরবারে যে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছেন তাতে রাজি হয়ে যাবে। তার ফলে মেলামেশার পরিধি বাড়বে।

হেইয়ান অভিজাত সমাজে পুরুষদেরই প্রাধান্য। এখানে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বিয়ের ক্ষেত্রেও তাই। মিচিসাদা ইয়াসুহিরার সহায়তায় পাত্রী দেখেছেন। দেখেই পাত্রী পছন্দ হয়েছে। কথাও হয়েছে। ইঝোমি তার হবু স্বামীকে ওয়াকা কবিতায় পত্র লিখেছে।

হবু স্বামী তাতেই চিত্তহারা। তিনি কবিতা লিখতে পারেন না। হবু স্ত্রীর কবিতা মনের একেবারে মণিকোঠায় পৌঁছে গেছে। হেইয়ান সাম্রাজ্যের উচ্চপর্যায়ে কবিতা ও কবির মর্যাদা সর্বাধিক। মিচিসাদা তাতেই কাবু। তার মনে ভাব জমা হয়েছে, কিন্তু তিনি কবিতা লিখতে পারেন না। তাই গদ্যেই লিখলেন, ‘হে আমার প্রেম জাগানিয়া চিত্তহারিণী, জানিনা কখন তোমার সান্নিধ্য পাব। একা একা এখন সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। তোমার মুখচ্ছবি সবসময় সর্বত্র ভাসতে থাকে, অন্তর পুড়তে থাকে অবিরাম দহন যন্ত্রণায়। একেই কি প্রেম বলে?’

জবাবে কবিতায় ইঝোমি লিখলেন, ‘নোদোকা নারু অরি কোসো নাকেরে হানা/ও ওমোউ কোকোরো নো ইউচি নি কাঝে ওয়া/, ফুকানেডো।’ অর্থাৎ ‘শান্ত মুহূর্তগুলোও বিদায় নিয়ে গেছে তলানিই মূল/অন্তরের ভেতর ফুটছে ভালোবাসার ফুল/বাতাস তাতে দিচ্ছে আরো যন্ত্রণার দোল।’

ওয়াকা কবিতা। আয়তনে ছোট, কিন্তু অর্থবহ।

বিয়েটা হয়ে গেল কনফুসিয়ানরীতি মেনে। এ রীতিটা চীন থেকে আমদানি করা হলেও বহু বছরের চর্চায় এই ক্লাসিক্যাল জাপানি নিজস্বরীতিতে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে হেইয়ান জৌলুসে যুক্ত হয়েছে শিন্টু ধর্মের ধর্মীয় অনুশাসন। রীতি এবং অনুশাসনে কোনো বিরোধ নেই, আছে মেলবন্ধন।

উচ্চ অভিজাত সমাজে বিয়েটা এখানে সাংঘাতিক কিছু নয়। একাধিক বিয়ে, সাময়িক বিয়ে, ব্যতিক্রমও আছে।

ইমন তাদের বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। বিয়ের কথা চিঠি লিখে মুরাসাকিকে জানান। মুরাসাকি খুশিই হলে এ জন্য যে, ইঝোমি কোনো অঘটন ঘটাবার আগেই তাদের বিয়ে হয়েছে এবং বর আচিবানা গোত্রের হলেও একটি প্রদেশের গভর্নর। পাশাপাশি নিজের কথাও ভাবলো। মন উদাস করে দেয়া ইচিঝেনের প্রকৃতিতে বসন্তের বাতাস। চারদিকে ফুটে আছে নানা ফুল। এ সময় কারো সান্নিধ্য এবং কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে।

চিঠিটি পড়ার সময়ই গভর্নরের দপ্তর থেকে বাবা ফিরলেন। মুরাসাকি বলল, বাবা, ইঝোমি শিকিবুর বিয়ে হয়েছে।

বাবা বললেন, হ্যাঁ, আমিও তা শুনতে পেলাম। হেইয়ানকিউ থেকে লোক এসেছিল, জানাল। পাত্রকে আমি চিনি। তাইরা গোত্রের। তার মাতামহের গোত্র। বাবার গোত্র ওয়ে।

ইমন যে লিখলো তাচিবানা গোত্রের?

হতে পারে। তাহলে তা আরো নিম্ন গোত্রের।

তাতে কী এসে যায়, এখন তো এরকম ঘটছে।

তা ঘটছে। সম্রাটের দরবারে ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্থান পাওয়া কঠিন হবে।

মুরাসাকি মনে মনে বলল, সে ঠিকই জায়গা করে নেবে।

ইমন লিখেছেন, বিয়ের অনুষ্ঠানেই মনে হলো ওরা হরিহর আত্মা, ইজোমি আগে কাউকে ভালোবাসত বুঝবার কোনো উপায় নেই। সে কথা মনে করে মুরাসাকির খুব হাসি পেল। পরক্ষণেই মনে মনে বলল, ভুলে যাক সে সর্বনাশা অতীত, ভুলে থাক। তবে ছেলেটির অবস্থা কী? ওর জন্য মায়া হয় তার।

মুরাসাকির বাবার মধ্যেও ভাবনা ঢুকে গেছে। ইঝোমির বিয়ে, তার মেয়ে সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলছে। তাকেও তো বিয়ে দেয়া উচিত। হেইয়ান জাপানের নিয়ম অনুযায়ী কন্যার বিয়ে দেয়ার দায়িত্ব মা-বাবার। তারাই উদ্যোগী হয়ে মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজে নেন। গভর্নরের ঐতিহ্যবাহী বাংলোর ওপর তলায় বসলে জাপান সাগর দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে তামেতোকি মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন। পাত্রের বংশ গোত্র, শিক্ষা-দীক্ষা, সাংস্কৃতিক আচার এবং অর্থকড়ি থাকাটা জরুরি।

চিন্তার স্রোত তাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। স্ত্রী বেঁচে থাকলে তিনিই এসব নিয়ে ভাবতেন। তাকে তাগাদা দিতেন। নিজেও হয়ত পাত্রও খুঁজতেন। কত শান্ত এবং হৃদয়বতী ছিলেন ভদ্রমহিলা। উত্তরের ফুজিওয়ারারা উচ্চ বংশ, তা সত্ত্বেও কোনো অহংকার ছিল না। তাকাকুও হয়েছে সে রকম। মায়ের স্বভাব পেয়েছে। কে জানে কী ভাগ্য নিয়ে এসেছে। তার মা কেন অকালে মারা গেলেন? জাপানে হেইয়ানদের সময়ে গড়

আয়ু খুবই কম। অন্য সব দিকে উন্নতি হয়েছে, সাজপোশাকের চাকচিক্য বেড়েছে, সৌন্দর্যচর্চা সর্বকালকে ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নতি হয়নি, মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না, গড় আয়ু বাড়ছে না। রাজন্যবর্গ, সম্রাটের দরবারের মন্ত্রী-অমাত্য সকলেরই বিশাল বপু। ঐতিহ্যবাহী জাতীয় পোশাক কিমোনো পরিধান করে বসলে বিশাল জায়গার প্রয়োজন হয়। শরীর বাড়ছে, স্বাস্থ্য না। মোটা হওয়া স্বাস্থ্য বা সুস্থতা নয়, তা তখন পর্যন্ত অভিজাত লোকজন বুঝে উঠতে পারেনি, তাই স্বাস্থ্য সচেতনতারও জন্ম হয়নি।

তাকাকুর মায়ের মৃত্যু তাকে বড় বেশি শূন্যতায় ফেলে দিয়েছে। কিয়োটোতে তা ভুলে থাকা যেত, এখানে নয়। বিশাল জাপান সাগর, উন্মুক্ত আকাশ ও উদার প্রকৃতি যেন স্ত্রীর অভাব এবং শূন্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে। আকাশের কোল ঘেঁষে পাহাড় শ্রেণি আছড়ে পড়া সমুদ্র ঢেউকে প্রতিনিয়ত সামলে নিচ্ছে। এ যেন সমুদ্র ঢেউয়ের পাহাড়ের ওপর নির্ভরতা, ভালোবাসা। তার নির্ভর করার মানুষটি তাকে ছেড়ে গেছে।

মুরাসাকি এসে তার চিন্তায় ছেদ ঘটালো। বাবা আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম।

বসো। নোবুনোরি কোথায়?

চীনা ধ্রুপদী নিয়ে ব্যস্ত আছে।

তার জন্য চিন্তা হয়।

সে তো চেষ্টা করছে, বাবা।

হ্যাঁ, চেষ্টা করছে, তার দোষ দিয়ে লাভ নেই।

বাড়ি ভর্তি কাজের লোক। হেইয়ান সম্রাটের প্রাসাদের মতো স্বরগরম। তামেতোকি উৎসব অনুষ্ঠানের মানুষ। এখানেও তাই উৎসব-অনুষ্ঠানের কমতি নেই। স্ত্রীর শূন্যতা এবং চিন্তা কাটাতে মাঝে মধ্যেই উৎসব অনুষ্ঠানে মেতে ওঠেন। সামুরাই সেনাপতি, রাজস্ব বিভাগের প্রধান, শিন্টু শ্রাইনের প্রধান এবং গণ্যমান্য অভিজাত লোকেরা অংশ নেন। সাংস্কৃতিক ঔজ্জ্বল্য শুধু হেইয়ান কিউতে নয়, সমস্ত জাপানে। শিন্টু শ্রাইন, বৌদ্ধকেয়াং, গভর্নরের দরবার, লোকেদের পোশাক-আশাক, সাজসজ্জা, জীবনবোধ, সাহিত্য চর্চা, নো, কাবুকি-বুনরাকু থিয়েটার- সর্বত্র একটা নবজাগরণ যেন সূচিত হয়েছে। দৃশ্যত লোকজ জাপান চীনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে বের হয়ে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র তৈরি করছে, যদিও সম্রাটের দরবারে চীনা ক্লাসিকের চর্চা করা হচ্ছে এবং চায়না সংস্কৃতিকে তখনও আভিজাত্যের মাপকাঠিতে দেখা হচ্ছে। তবে নারীরা দরবার বা প্রাসাদ-অভ্যন্তরে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চাটা করছে নিজেদের কানা ভাষায়, চীনা সাহিত্যের ভূত মাথায় নেই- তা নয়, তা আছে আভিজাত্যের এক পোশাকি অহংকারে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে এবং অবস্থানগত প্রতিযোগিতায়।

হেইয়ান জাপানি সমাজ এ নিয়ে ভাবছে। তার ছিটেফোঁটা ঢেউ এসে লেগেছে এই সমুদ্র উপকূলের প্রত্যন্ত প্রদেশ ইচিঝেনেও। তামেতোকি গভর্নর হলেও অগ্রসর কবি এবং পণ্ডিত ব্যক্তি, তাকেও ব্যাপারটি ভাবায়। মেয়েকে তার বিয়ে ভাবনা কিংবা স্ত্রী বিয়োগের দুর্ভাবনার কোনোটাই বুঝতে না দিয়ে এ ব্যাপারটি নিয়েই কথা বললেন এবং গল্প করতে শুরু করলেন।

তামেতোকি বললেন, বুঝলে তাকাকুণ্ড একটা সময় ছিল যখন জাপান ছিল সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। চীনের তেঙ সম্রাটদের সময়ে (সপ্তম থেকে নবম শতক) জাপান থেকে বিশটি দল চীনে নানা মিশনে যায়। এরা ফিরে এসে জাপানের পুরো সাংস্কৃতিক পরিম-লে পরিবর্তন আনে। তাতে চীনা ভাষা এবং সংস্কৃতির সংস্পর্শে গিয়ে জাপানি সংস্কৃতিতে এক শক্তিশালী উত্থান ঘটে। কানা ভাষাকে চীনা ভাষার বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ করে তুলতে থাকে। সপ্তম শতকে বৌদ্ধ ধর্ম এখানে আসে। সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মীয় সংস্কৃতি। কিন্তু তাতে শিন্টু ধর্মের সঙ্গে বিরোধ বাঁধেনি। মানুষ দুটোকেই গ্রহণ করেছে। আমাদের এই মিশ্র ধর্মীয় সংস্কৃতিকে বলা হয় আসুকা সংস্কৃতি।

এতে কী ভালো হলো? প্রশ্নটা নোবুনোরির। চীনা সংস্কৃতিই তাকে ঝামেলায় ফেলেছে।

তাকাকু বলল, নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। এরকম পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল।

বাবা বললেন, নোবুনোরির প্রশ্নও ঠিক। কারণ তা অনুভব করেই নবম শতকের শেষদিকে হেইয়ান সম্রাট চীনা এবং কোরিয়ার সঙ্গে সরকারি যোগাযোগ ছিন্ন করে দেন, নিজস্ব কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির বিকাশ কল্পে।

নোবুনোরি বলল, তাহলে সম্রাটের দরবারে কেন চীনা ভাষার চর্চা হয়?

অত্যন্ত যৌক্তিক প্রশ্ন। দেখো, হেইয়ান কিউ সমাজটা কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদম উচ্চস্তরে সম্রাট ও রাজন্যবর্গ। তাদের নিচে সামরিক বাহিনী। তাদের নিচে কৃষি জমির মালিক, কারিগর এবং হস্তশিল্পীরা। সবার নিচে বণিক আর ব্যবসায়ীরা।

মুরাসাকি বলল, সামরিক বাহিনীকে এতটা গুরুত্ব দেয়া ঠিক হয়নি। শিন্টু ধর্মের পুরোহিতদের স্থান কোথায়?

নতুন সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় উদারতার পাশাপাশি শিন্টু এবং বৌদ্ধ দু’টি ধর্মের পুরোহিতদের জন্য সম্মানজনক স্থান নির্ধারণ করা আছে- যদিও বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসীদের মহাযান, বজ্রযান এবং হীনযানে বিভক্তি রয়েছে। কনফুসিয়াসের অনুসারীদেরও সম্মানের সঙ্গে দেখা হয়। সামাজিক বিকাশ কিংবা আর্মির পেশা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডকে ধর্মীয় বলয় মুক্ত বলেই মনে করা হয়। সামরিক বাহিনীকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারটা রাজনৈতিক।

এই বিভাজনে আমাদের সাংস্কৃতিক নিজস্বতা তৈরি হয়েছে এবং পূর্বের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য ফিরে যাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় আমাদের এ সময়ে হেইয়ান সাম্রাজ্য রাজনীতি, ধর্মচর্চা, শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতির নতুন দিগন্তের দিকে পাখা মেলেছে। সঙ্গে ধারণ করেছে নিজস্ব ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে। আশা করা যায় তা একদিন গগনচুম্বী হবে।

বাবার কথাগুলো ভারি শোনালেও দুই ভাইবোন তা মনোযোগ দিয়ে শোনে। নোবুনোরি দেখতে চায় চীনাভাষা শেখার ভার লাঘবের পথ। মুরাসাকি উপলব্ধি করে এক ধরনের উত্তেজনা, যার মধ্যে শত সম্ভাবনার স্বপ্ন।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামে। শ্রাইন এবং প্যাগোডাগুলোয় ধর্মীয় সঙ্গীতের সুর বেজে ওঠে। পাশাপাশি পুরোহিতের মন্ত্রধ্বনি। মূল শিন্টু শ্রাইনটি গভর্নর প্রাসাদের কাছেই।

আকাশে চাঁদ উঠেছে, পূর্ণিমার চাঁদ। পাহাড়গুলোর চূড়ায় বরফ জমেছে। পাহাড়গুলোর কোল ঘেঁষে জাপান সাগর তীরে তীব্র শীতকে উপেক্ষা করে ফুটে আছে নাম না জানা অসংখ্য বুনোফুল। মুরাসাকিদের প্রাসাদের বিশাল জানালা দিয়ে এসব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়। বাবা প্রার্থনা শেষে তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন। তিনি নিজে কবি। পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা তুষারে চন্দ্রালোক পড়ে ভূস্বর্গ তৈরির দৃশ্যটা হয়ত স্থির দেখাতো। কিন্তু পাদদেশে বাতাসে দোল খাওয়া ফুল আর জাপান সাগরের আছড়েপড়া ঢেউ যেন তাতেও গতি যুক্ত করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে তা এই বুঝি স্বর্গে উড়ে যাবে। তাই বাবার চিত্ত-চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এরকম চিত্ত-চাঞ্চল্য কবিতার জন্ম দেয়।

ছয়.

আকাঝুমি ইমন সম্রাটের প্রাসাদে চাকরি করছেন অনেক দিন হলো। কাজটা তিনি করছেন এখন রিনশির সহচরী হিসেবে। তার আগে রিনশির বাবা প্রিন্স মিনামাতো নো মাসানোবুর দরবারে কাজ করেছেন বেশ কিছু দিন।

রিনশি প্রিন্স ফুজিওয়ারা নো মিচিনাগার স্ত্রী। ছোট সম্রাজ্ঞী শোশির মাতা। ইমনকে নানা বাড়িতে চাকরি করা থেকে চেনেন শোশি। সম্রাটের প্রাসাদে সম্রাজ্ঞী হিসেবে আসার পর তাকে এক শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হয়। এই প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ নন সম্রাটের জ্যেষ্ঠ সম্রাজ্ঞী তেইশি। ইতোমধ্যেই এই সম্রাজ্ঞী কোগো বা ‘উজ্জ্বল কুন্তলা সুন্দরীর’ খেতাব পেয়ে গেছেন। প্রাসাদের লোকজনই তাকে এ খেতাব দিয়ে রেখেছে। শোশিকে বলে চুণ্ডু বা ‘ভেতরে রুচিকর এক শান্ত তরুণী’- যার বয়স মাত্র বারো।

হেইয়ান আভিজাত্য এবং সৌন্দর্র্যের একটি বৈশিষ্ট্যে লম্বা সুন্দর চুল। তা শোশির পক্ষে অর্জন সম্ভব নয়। এই যন্ত্রণা তো আছেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কবি সেই শোনাগন। তিনি সম্রাজ্ঞী তেইশির লেডি-ইন ওয়েটিং। তার বাবা বা পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ তৃতীয় সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন সম্রাটের দরবারে। নামটা সে পদবিকে অনুসরণ করে ‘শোনাগন’। সম্রাজ্ঞী, তেইশির সুখ্যাতির সবচেয়ে বর্ণিল পালক হচ্ছেন এই সেই শোনাগন। বালিকা সম্রাজ্ঞীর এমন কেউ নেই যে তার সভা সেই শোনাগনের মতো উজ্জ্বল করে রাখবে।

এরই মধ্যে কবি সেই শোনাগনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য পিলু বুকের’ কিছু লেখা নাম করে ফেলেছে। এই অহংকারে সেই শোনাগন এবং সম্রাজ্ঞী তেইশি যেন হাওয়ায় ভাসছেন।

তা দেখে শোশির সহচরীদের পিত্ত জ্বলে যায়। তারা শোশির কানভারী করতে থাকে। ক্রমে শোশি উত্তেজিত হতে শুরু করেন। বাবা মিচিনাগার কাছে গিয়ে বললেন, আমার একজন লেডি-ইন-ওয়েটিং চাই, সেই শোনাগনের মতো।

বাবা মেয়ের মনোকষ্ট বুঝতে পারেন। বাকি তিন মেয়ে সম্রাজ্ঞীকেও তো দেখেছেন। এখানে বাঁচতে হলে মর্যাদার সঙ্গে গৌরব আর অহংকার নিয়ে প্রতিযোগিতা করে বাঁচতে হয়। সকল কাজে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হয় । স্ত্রীকে বললেন, আকাঝুমি ইমনকে শোশির দরবারে লেডি-ইন-ওয়েটিং করে পাঠাতে হবে। কবি হিসেবে সে নাম করেছে। রিনশি বললেন, কবি দিয়ে সে কী করবে?

মিচিনাগা কারণ ব্যাখ্যা করলেন।

রিনশি এবারে মেয়ের কষ্টটা বুঝতে পারলেন। তিনি শোশির দরবারে লেডি-ইন-ওয়েটিং করে ইমনকে পাঠিয়ে দিলেন।

ইমনের জন্য ব্যাপারটা সাধারণ নয়, একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবার মতো অবস্থা। তার স্বামী কনফুসিয়ান স্কলার এবং কবি মাসাহিরা বললেন, দরকার নেই। আমার চাকরির স্থল ওয়ারি প্রদেশে চল। আকাঝুমি ইমন দুসন্তানের মা। আদর্শ মা এবং উত্তম স্ত্রী হিসেবে তার সুনাম আছে। ইতোমধ্যে তার নিজস্ব ওয়াকা কবিতা সংকলন ‘আকাঝুমি ইমোনশো’ সম্রাটের প্রাসাদসহ বাইরেও অনেকের হাতে পৌঁছে গেছেন। তিনি পেছাতে পারেন না। স্বামীকে বুঝিয়ে বললেন, অন্যকথা। তিনি বললেন, এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না, দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ তার সঙ্গে জড়িত। একবার রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে গেলে আর প্রবেশ করা যাবে না। স্বামীকে ‘কাগোরো নিক্কির’ লেখিকার সন্তানের জন্য আত্মত্যাগের কথা বললেন। অনেক কষ্টের মধ্যে থেকেও জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে চাননি। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফিরে আসেন। সে কথা অবশ্য কনফুসিয়ান স্কলারও জানেন। অগত্যা আর কী করা, নানা উপদেষ্টা দিয়ে স্ত্রীকে সম্মতি দিলেন।

ইমোন শোশিদের পুরো পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। সেখানকার পারিবারিক পরিবেশ আর সম্রাটের প্রাসাদের পরিবেশ এক নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে যাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, এরা বয়সের কারণে পরিপক্ব এবং ভারসাম্যপূর্ণ- যদিও এরা খুবই প্রতিপত্তিশীল মানুষ। এখানে সম্রাজ্ঞীর স্বল্প বয়সটাই প্রধান সমস্যা। বুঝে, না বুঝে কথা বলেন। মনে করেন সম্রাজ্ঞী হওয়ার অর্থই হচ্ছে সবকিছু বুঝে যাওয়্ াতার কথা অন্যদের শুনতে বাধ্য করা।

ইমন দেখলেন তার যুদ্ধটা শুধু কবি সেই শোনাগনের সঙ্গে নয়। সম্রাজ্ঞীর সঙ্গেও এবং এ যুদ্ধটাই বেশি কঠিন। বুঝতে চাইলে সম্রাজ্ঞী খুব রাগ করেন। তার অর্থহীন রাগ এবং অমূলক ইচ্ছা সব সময় হজম করা যায় না। মাঝে-মধ্যে মনে করেন সম্রাজ্ঞীর মাতা রিনশির সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবেন, আবার ভাবেন তিনি কী ভাববেন আর শুনলে সম্রাজ্ঞীই বা কী মনে করবেন। কথা আর বলা হয় না। কনফুসিয়ান স্কলার স্বামীকেও এখন কিছু বলতে পারছেন না।

সম্রাজ্ঞীর আরো লেডি-ইন-ওয়েটিং রয়েছে। ওরা কবি বা মনোগাতারি লেখিকা নন। সম্রাজ্ঞীর রূপচর্চার সহায়তা করেন। তাদের সঙ্গে তার মনের মিল খায় না। তবুও মানিয়ে চলার চেষ্টা করেন।

ইমন সেই শোনাগনকে সম্মান করে চলেন। সম্রাজ্ঞীর দরবারে সেই শোনাগনের অবস্থান সংহত এবং সুদৃঢ়। অবজ্ঞা করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে শোনাগন তার চেয়ে বয়সে ছোট। এটি জানতে পারেন শোনাগনের সহচরীদের মুখে। সেই শোনাগন অহংকারী কবি। সম্রাজ্ঞী তেইশি সুবিধাজনক অবস্থান তাকে অহমিকার অধিকারী করেছে। তিনি পুরো প্রাসাদ অন্তঃপুরের খবর রাখেন। বলা হয় তথ্যজ্ঞানই শক্তি। সেই শোনাগন তা ভালোভাবেই জানেন।

তার কাছ থেকে ইমোন একটি চমকপ্রদ তথ্য জানতে পারলেন। ওই ছেলেটি ছাড়াও বিয়ের আগে প্রাসাদে আরেকজন প্রেমিক ছিল। বাবার সঙ্গে কয়েকদিন প্রাসাদে আসা-যাওয়ার কালেই এই প্রণয়ন ঘটে। পাত্রের নাম ওমোতোমারো। তিনি বিধবা মহিয়সী শোকোর দরবারে কর্মরত। মাত্র কয়েক দিনে সম্পর্ক এমন পর্যায়ে গড়ায় যে, কেউ কেউ ইঝোমিকে তার স্ত্রী ভাবতে শুরু করে।

ইঝোমির বাবা বাইরের কোনো ছেলের কথা শুনে নয়, তার কর্মস্থল কিয়োটোর সম্রাটের প্রাসাদের এই ব্যক্তির কথা শুনেই মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইমনের তাতে ভুল ভাঙ্গে। কিন্তু তিনি যে ভাবছেন ইঝোমিকে আরেক লেডি-ইন-ওয়েটিং করে সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে নিয়ে আসবেন সম্রাজ্ঞী এবং সেই শোনাগনকে টেক্কা দেয়ার জন্য, তার কী হবে। দুর্ভাবনায় পড়ে গেলেন। পরে স্থির করলেন যেভাবেই হোক ইঝোমিকে শোশির দরবারে আনবেনই।

তিনি সম্রাজ্ঞী শোশিকে বললেন, ইঝোমি শুধু নাম করা কবিই না, বাকপটু ও বুদ্ধিমতি এক মহিলা, বিয়ে হওয়া, সেই শোনাগন তার কাছে কিছুই না। দেখবেন সম্রাজ্ঞী তেইশিসহ সেই শোনাগন কী নাকানি চুবানিই- না খাবে।

শোশির বাবা ক্ষমতাশালী মানুষ। সম্রাজ্ঞী তোইশি এবং তার ভাইয়ের বেলায় আপসহীন। ইঝোমির বাবাকে তার দরবারে ডাকলেন। প্রস্তাব শুনে বাবা বললেন, এটা আমার জন্য সৌভাগ্য। প্রিন্স মিচিনাগার কন্যা সম্রাজ্ঞী শোশির সঙ্গে থাকতে পারা তার সাত জন্মের ভাগ্যি। কালই আসবে সে।

ইমন শেশির কথা আগেও একবার বলেছিলেন ইঝোমি শিকিবুকে। ইঝোমি সম্রাজ্ঞীর বয়স নিয়ে কথা তুলেছিলেন। বাবার কথায় তুচ্ছই মনে হলো। পর দিন মিচিনাগার দরবারে হাজির হলেন।

মিচিনাগা কথা বলে আশ্বস্ত হলেন এবং সম্রাজ্ঞী কন্যার দরবারে নিয়ে এলেন তাকে। শেশি ইঝোমিকে প্রথম দেখলেন। বললেন, সাজগোজ ভালো। শুনেছি কবি। কবিতা শোনাতে পার? ইঝোমি বললেন, আমার সৌভাগ্য মহামান্যা।

ইঝোমি সম্রাজ্ঞীকে তার লেখা একটি ওয়াকা কবিতা শুনিয়ে দিলেন। কবিতাটি এরকম : ‘আমার কালো চুল অবিন্যস্ত/ নির্বিকার উদাসীন/পাশে শুয়ে পড়ল সে/এবং প্রথমবার আলতো ভাবে বিন্যস্ত করে দিল/প্রিয় আমার।’

চমৎকার তো। মন্তব্য করলেন সম্রাজ্ঞী। কবিতা পড়াকালেই ইমন এসে দাঁড়িয়েছেন। সম্রাজ্ঞীর মন্তব্যে হাততালি দিলেন। সম্রাজ্ঞী বললেন, ইমন আপনি এসেছেন? ইঝোমি শিকিবু তো চমৎকার কবিতা লেখে।

মিচিনাগা বললেন, ভালোই হলো শোশি তুমি দু’জন কবি পেলে। এবার সেই শোনাগনের সাম্রাজ্ঞী বেশ জব্দ হবে। ইমন কিন্তু আমাকে নিয়ে মনোগাতারি শুরু করেনি।

মাননীয় প্রিন্স, নামটা ঠিক করেছি এবং আমার সময় থেকে তথ্য টুকে রেখেছি এখনও রাখছি।

নামটা কি? ‘এইগা মনোগাতারি’।

শুনে খুশি হলাম। ইঝোমিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এখন থেকে তুমিও লিখবে।

ইঝোমি বললেন, অবশ্যই আমার মাননীয় প্রিন্স, এটা হবে আমার সৌভাগ্যের উজ্জ্বল এক পালক।

ইঝোমির স্মার্ট কথা শুনে প্রিন্স ভাবলেন, এ মেয়ে তো খুবই চালু। বললেন, আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করো, তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ইমনতো আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে, তুমিও হবে।

মিচিনাগা উঠে গেলেন।

শোশি প্রথম দিনেই তার দুই কবি লেডি-ইন-ওয়েটিংকে কিভাবে সেই শোনাগনকে টপকাতে হবে তার পরিকল্পনা চাইলেন এবং নিজের কাঁচা পরামর্শও দিলেন।

ইমন এবং ইঝোমি তা শুনে পরস্পরের দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকালেন।

সাত.

সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মুরাসাকির বাবা তামেতোকি অপেক্ষা করছেন। সম্রাট ইচিজো তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এখানে অপেক্ষায় আছেন ইঝোমির বাবা মাসামুনেও। কথা হল তামেতোকির সঙ্গে। প্রথমে অবশ্য তামেতোকি মেয়ের বিয়ের জন্য মাসামুনেকে অভিন্দন জানান এবং বলেন, তাকাকুর বিয়ের বয়স হয়েছে এনিয়ে ভাবতে পারেন।

পাত্র কি জানা আছে?

আপনার আত্মীয় ফুজিওয়ারা নো নোবুতাকা তো আছে।

হ্যাঁ, সে আমার মামার ছেলে। বয়সটা একটু বেশি।

জাপানের অভিজাত মহলে বয়স কোনো ব্যাপারই না। তার ভালো অর্থকড়ি রয়েছে, কম বয়সেই গভর্নর ছিল দুজায়গায়। এছাড়া ভালো নৃত্যশিল্পী সে। আমার মেয়ের জন্য প্রস্তাব এলে তখনই হ্যাঁ করে দিতাম।

তামেতোকি ভাবছিলেন।

আপনি চাইলে আজই কথা বলতে পারি। এরকম সংস্কৃতিবান বড়লোক পাত্র পাওয়া সহজ নয়।

খাওয়া-দাওয়া পোশাক-আশাকে অপচয় বেশি করে।

অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এসবের প্রয়োজন আছে।

তা আছে। একটু ভেবে নিই। আপনার দপ্তরে আসব আমি।

ওটা তো আপনার দপ্তরই ছিল।

এ সময় সম্রাটের দরবারে দুজনেরই একসঙ্গে ডাক পড়ল। সম্রাট তাদের উভয়কে বললেন, তোমাদের দুজনকে এক সঙ্গে ডাকার কারণ হলো, আগে তোমাদের নিয়ে একসঙ্গে বসে কথা হয়নি। তামেতোকিকে বললেন, ইচিঝেন সাধারণ প্রদেশ নয়, তার ভৌগোলিক গুরুত্ব রয়েছে। রাজনৈতিকভাবেও বেশ গুরুত্ব বহন করে।

কিছু সমস্যা আছে। ভেবেছিলেন সেসব বলবেন। প্রাক্তন গভর্নরের উপস্থিতিতে না বলার মনোস্থির করলেন।

সেসব সমস্যার কথা মাসামুনে বললেন। তাতে অবাক হলেন তামেতোকি। কারণ কথাগুলো মাসামুনের বিরুদ্ধেই যায়।

সম্রাট মাসামুনের উদারতা দেখে বললেন, তুমি তো চেষ্টা কম করোনি। তোমার কাজে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। তামেতোকি, তুমি মাসামুনের কাছ থেকে পরামর্শ নিও। তোমাদের নিয়ে আমি আজ মধ্যাহ্নভোজ গ্রহণ করবো এটাই আসল উদ্দেশ্য।

এরা দুজন কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলেন।

সম্রাট তামেতোকিকে বললেন, তোমার প্রেরিত উপঢৌকন আমার পছন্দ হয়েছে। উৎসব-অনুষ্ঠানে বিভাগে কাজ করেছে বা করছে এমন লোকদের পছন্দ এবং রুচিবোধই আলাদা।

দুজন আবারও কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলেন।

মধ্যাহ্ন ভোজের পর আসল কথাটা বললেন সম্রাট ইচিজেন। সামুরাই সেনা প্রধানের কার্যক্রম সম্পর্কে তোমাদের কি মতামত? সম্রাটের প্রশ্নে বর্তমান এবং সাবেক দুই গভর্নর পরস্পরের দিকে তাকালেন। সাবেক গভর্নর বললেন, সে উচ্চাভিলাষী।

আমারও তাই মনে হয় মহামান্য সম্রাট।

ওসব কথা চিন্তা করে তাকে এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছি। আমার কানে যা আসছে তা হলে সবই সত্য। শত্রু-সামনেই থাকুক কি বল, একে এখানেই নিয়ে আসি?

মাসামুনে বললেন, তা হলে তো ভালো হয়। তামেতোকি নিশ্চিন্তে প্রশাসন চালাতে পারেন।

সম্রাটের মনে ছিল অন্য কিছু, তা তিনি তাঁদের বললেন না।

সম্রাটের দরবার থেকে বের হয়ে তামেতোকি গেলেন সম্রাটের ডেইগাকু রিউতে। তিনি এ আকাদেমির সম্মানিত সদস্য। চীনা ধ্রুপদী সাহিত্য এবং জাপানি কবিতায় তার অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি এই আকাদেমির সম্মানিত সদস্য। এখানে একটি সভায় তাকে অংশ নিতে হবে। সমকালীন জাপানের জনপ্রিয় কবি কি নো সুরেইয়োকির কবিতা নিয়ে এখানে একটি আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে, তাতে তিনি বক্তব্য রাখবেন। কবি সুরেইয়োকিকে তাদের বাড়িতে বহুবার দেখেছেন। তার বাবা এবং পিতামহকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। কবি সুরেইয়োকিকে ছেলেবেলায় দেখেছেন এবং তার পিতামহের সঙ্গে বন্ধু ছিল, সে সুবাদে তাকে মূল বক্তা করা হয়েছে। কবি সুরেইয়োকি তার মতো গভর্নর ছিলেন। তাকে কেমন দেখেছেন তা বয়ান করলেন। সম্রাট ডেইগো সর্বপ্রথম রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জাপানে যে কবিতা সংকলনের উদ্যোগ নেন, চারজন কবির মধ্যে তিনি একজন যারা সংকলনটি সম্পাদনা করেন। কোকিন ওয়াকাশো নামের রাজকীয় কবির সংকলনটি অমর হয়ে আছে। ফুজিওয়ারা নো কিন্তু নির্বাচিত অমর ৩৬টি কবিতার মধ্যে সুরেইয়োকির একটি কবিতা রয়েছে। তবে কোকিন ওয়াকাশোর যে ভূমিকা তিনি লিখেছেন একে ওয়াকা কবিতার প্রথম মূল্যবান সমালোচনা বলে মনে করা হয়। তার লেখা তোসা নিক্কির সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম।

তামেতোকির ব্যক্তিগত পরিচয়ের গল্প এবং সুরেইয়োকির কবিতার ঋদ্ধ আলোচনায় মুগ্ধ হলেন সবাই।

তামেতোকি তার পুরোনো দপ্তরে গেলেন, মাসামুনে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। তার সামনে নোবুতাকা। মাসামুনে বিয়ের কথা তুললেন। নোবুতাকা মাথা নত করে আছেন। অর্থাৎ বিয়েতে তার সম্মতি রয়েছে।

ইচিঝেনের প্রকৃতি ভালো লেগে গেছে মুরাসাকির। সেদিন রাতে জাপান সাগরের তীর ঘেঁষে বরফ পাহাড় এবং তার পাদদেশে ফুলের এসব চাদের আলো পড়ার দৃশ্যটা মনে গেঁথে আছে। বাবা কিয়োটো গেছেন। যেতে আসতে কয়েক দিনের প্রয়োজন হয়। এ সময় প্রকৃতি তাকে খুব টানছে। চলে গেলেন সে পাহাড়ের কাছে। সঙ্গে গেছে ভাই নোবুনোরি। গভর্নর সাহেবের পরিবারের নিরাপত্তা বাহিনী তো রয়েছেই। পুরো সিটির তিন দিকে পাহাড়। প্রথমে এরা গেছে বিখ্যাত মুরাকুনি পর্বত দেখতে। তা এত সুউচ্চ যে ওপর থেকে পুরো নগরীকে দেখা যায়। বরফ পড়ে আছে চূড়ায়। নোবুনোরি বলল, সে চূড়ায় উঠবে। পথ আছে একটা গিরিপথ, খুবই সরু। সামুরাই সেনারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে উপরের দিকে। আশপাশের দৃশ্য দেখে রোমাঞ্চিত মুরাসাকি, ভেতরে দারুণ আলোড়ন। নোবুনোরি আনন্দিত সে পর্বতে উঠছে বলে। পর্বতচূড়া থেকে দেখা যায়, শিন্টু শ্রাইন এবং বৌদ্ধ প্যাগোডাগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। নগরজুড়ে যেন ফুলের মেলা। মুরাসাকি ভাবলেন, জ্যোৎস্না রাতে যদি এখানে আসা যেতো। কী অপরূপ দৃশ্যই না দেখছেন কিছুটা বাস্তবে, কিছুটা কবির কল্পনায়। তার মনে হয় শুধু চার/পাঁচ লাইনের ওয়াকায় এই সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি প্রকাশ সম্ভব নয়। চিত্রাঙ্কনেও পারদর্শী মুরাসাকি। দৃশ্যগুলো তাই অন্তরে মুদ্রিত হয়ে যাচ্ছে। পর্বতশৃঙ্গ স্পর্শ করে মেঘেরা ছুটে চলেছে। মুরাসাকি ভাসমান মেঘ স্পর্শ করে যেন মেঘের মতো উড়ে যেতে চাইছে।

ওপর থেকে জাপান সাগর দেখা যাচ্ছে, সফেন ঢেউ তার। সঙ্গে গর্জন। মর্ত্যলোকে পাহাড়-জঙ্গল ফুল, সমুদ্রের সফেন ঢেউ এবং পর্বতশৃঙ্গে বরফের ওপর প্রতিফলিত সূর্যালোক এমন এক স্বর্গলোক সৃষ্টি করেছে যে, মুরাসাকির মনে হলো, এ রকম স্বর্গীয় পরিবেশেও সে একা। এতটা বছরেও কাউকে মন দেয়া নেয়া হয়নি, সাথী কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। শূন্য হৃদয় তার। বৌদ্ধ সহজিয়া সঙ্গীত ‘শূন্যমন্দির মোররে’।

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছার বাইরে নেমে এলো পর্বত থেকে। আরও কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে। নিরাপত্তাদানকারীদের একজন বলল, সম্রাটের সিলমোহরে ব্যবহৃত ক্রিসানথ্যমম ফুলের বিশাল বাগান রয়েছে এখানে।

মহিলা নিরাপত্তাকর্মীর কথায় মুরাসাকি বললেন, কোথায়?

সে বলল, কাছেই।

ফুলটির রাজকীয় গৌরব রয়েছে। মুরাসাকি বাবার দরবারে সম্রাটের স্বাক্ষর করা কাগজপত্রের সিলে এই ফুল দেখেছে। ফুলটি জাপানে আসে পঞ্চম শতকে চীন থেকে। হেইয়ান সম্রাটদের সময়ে তা রাজকীয় গৌরবের আসনে বসে। এই ফুল নিয়ে জাপানিদের নানা বিশ্বাস ও সংস্কার রয়েছে। হেইয়ান জাপানিরা জাপানজুড়ে সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা ও আন্তরিক সমর্থনের জন্য এই ফুলের গাছ লাগায় এবং পরিচর্যা করে। যার বাগান যতবড়, তাঁর শ্রদ্ধার প্রকাশ তত বেশি। তাদের কাছে লাল বর্ণের ফুলটা ভালোবাসার প্রতীক। তেমনি নানা রঙের নানা বিশেষত্ব।

মুরাসাকি এবং নোবুনোরি এই ফুল দেখে দারুণ উচ্ছ্বসিত। বাগান মালিকের গৃহিণী তাদের কথা শুনে ছুটে এসেছেন। তারা অভিজাত শ্রেণীর মানুষ। এই ফুলও আভিজাত্যের বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক। জাপানি কায়দায় পরস্পর অভিবাদন জানালেন। মুরাসাকি বলল, ফুল দেখতে এলাম।

কী সৌভাগ্য আমাদের। মহামান্য সম্রাট ইচিজোকে আনুগত্য, তাঁর প্রিয় গভর্নরকে সমীহ। উৎসবে এলে খুব মজা হতো।

উৎসব?

হ্যাঁ, কিকোনিনগিয়ো উৎসব। তা অনুষ্ঠিত হয়- ক্রিসানথ্যমম প্যাগোডায়। মুরাসাকি বললেন, সেখানেই যাই।

চলুন আমিও যাব। তবে কিছু একটা মুখে দিয়ে যেতে হবে। না হয় আমাদের অমঙ্গল হবে।

মুরাসাকি হেসে দিয়ে বলল, আপনি একজন চমৎকার মানুষ। খুবই হাসি-খুশি।

অতিথিদের কেনকেরা খেতে দেয়া হলো। কেনকেরা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ধরনের মিষ্টি। বাড়িতেই বানানো হয়। এ মিষ্টির স্বাদে মুগ্ধ মুরাসাকি এবং তার ভাই।

ক্রিসানথ্যমম প্যাগোডা ফুলের এক সাম্রাজ্য। তা দেখে অভিভূত এরা। প্যাগোডার বৌদ্ধ ভিক্ষু তাদের স্বাগত জানালেন। জনসাধারণ ফুলের নামে ডাকে বলে প্যাগোডাটির প্রকৃত নাম চাপা পড়ে গেছে। বললেন ভান্তে। এই ফুলটার জনপ্রিয়তা শুধু জাপান বা চীন নয়, সারা বিশ্বে। বললেন আবার তিনি।

কথাটা বিশ্বাসযোগ্য। সভ্যতার মধ্যপ্রাচ্যে, প্রাচীন পারস্যে এই ফুল সমান জনপ্রিয় এবং তাকে কেন্দ্র করে নানা বিশ্বাস শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আছে। এ বিস্তার শাহনামা মহাকাব্য পর্যন্ত বিস্তৃত। জোরাস্ট্রিয়ান অধ্যাত্মবাদের শুভশক্তির কল্যাণ খোজা এর মধ্যে।

প্যাগোডায় প্রার্থনার আগে ভদ্রমহিলা মুরাসাকির কানের কাছে মুখ এনে যা বললেন তাতে মুরাসাকি লজ্জা-বিনম্র হয়ে প্রার্থনাকালে তাই চেয়ে বসলেন। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই দেখতে পাচ্ছেন একটি লাল ফুল ফুটছে।