বেড়িবাঁধ সংস্কার হয়নি, ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটে এলাকাবাসীর
এক বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি আমপান দুর্গত উপকূলীয় এলাকার মানুষ। বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত পার করেন তারা। আমপানের তা-বে বাড়ি ধসে পড়ায় তাদের অনেকেরই ঠিকানা এখন বেড়িবাঁধের খুপড়ি ঘরে। রাস্তা সংস্কার না হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। লবণাক্ততার প্রভাবে হাজার হাজার গাছ মারা যাওয়ায় মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সুপেয় পানি, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানসহ সংকট আর সংকটে বিপর্যস্ত উপকূলবাসী।
২০ মে ঘূর্ণিঝড় আমপানের তা-বে ল-ভ- হয় পুরো উপকূলীয় এলাকা। আমপানে উপকূলীয় এলাকায় পানিবন্দী হয়ে পড়ে লাখো মানুষ। ঘরবাড়ি ধসে পড়ে ২ হাজারেরও বেশি। এখনও ডুবে আছে শতাধিক ঘর। মাছের ক্ষতি হয়েছে ১শ’ ৭৬ কোটি টাকার। কাজ না থাকায় লোকজন হয়ে পড়েছে বেকার। এলজিইডি ও সড়ক বিভাগের ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ৩০ কি.মি. সড়ক।
কপোতাক্ষ নদ তীরবর্তী আশাশুনি উপজেলার সুভদ্রাকাটি গ্রামের আতাউর রহমান জানান, নদীর পাশ দিয়ে বেড়িবাঁধই হলো আমাদের যাতায়াতের রাস্তা। বেড়িবাঁধ ভাঙতে ভাঙতে একহাতেরও কম চিকন হয়ে গেছে। সাইকেল চালানো যায় না। সাইকেল চালাতে গিয়ে অনেকে ডিগবাজি খেয়ে কপোতাক্ষে পড়েছে।
আতাউর রহমান আরও জানান, নদ তীরবর্তী চাকলা, সুভদ্রাকাটি গ্রামের কোন মানুষ যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে, তবে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হবে।
দীর্ঘ ১ বছর বেড়িবাঁধের ওপর বসবাসকারী তাহেরা খাতুন জানান, সরকারি কোন ঘর পাইনি। আমার স্বামী মারা গেছে ১০ বছর। ছেলে নেই। ৫টিই মেয়ে। কাঠাপাঁচেক জমিতে ঘর ছিল। একবছর ধরে তলিয়ে আছে। বাধ্য হয়ে খুব কষ্টে বেড়িবাঁধের ওপর খুপড়ি ঘর করে মেয়ে কয়টা নিয়ে আছি।
বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়া আরেক নারী নাসিমা খাতুন জানান, আমপানে আমাদের বাড়িঘর সব ভেসে গেছে। ভেসে গেছে গৃহস্থালি সামগ্রীও। বেড়িবাঁধের ওপর টং বেঁধে ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। টঙের মধ্যেই রান্না-বান্না করতে হয়। খাবার পানির তীব্র অভাব। গায়ে ঘা-পাঁচড়া হচ্ছে। অবিলম্বে সরকারি ঘরের দাবি জানান নাসিমা।
কুড়িকাহুনিয়া গ্রামের আফজাল হোসেন জানান, আমপানের তা-বে কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর ২৯টি পয়েন্ট ভেঙে লবণাক্ততায় ভরে যায় পুরো এলাকা। গাছপালা সব মরে যাচ্ছে। এমনকি লবণাক্ততায় লবণসহিষ্ণু কেউড়া গাছও মরে যাচ্ছে। ঘের সব ভেসে গেছে। তীব্র বেকারত্ব বেড়েছে এলাকায়।
একই গ্রামের হাফেজ আফছার হোসেন জানান, আগে এই এলাকায় দুটো করে ফসল হতো। আমপানের পরে একটি ফসলও হয় না। এলাকায় বেড়েছে তীব্র বেকারত্ব। জীবন-জীবিকা হয়ে পড়েছে খুবই কষ্টসাধ্য। অনেকে নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।
উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট তীব্র। আমপানে মিষ্টি পানির আধার ভরে গেছে লবণে। কিছু বেসরকারি সংস্থার সরবরাহকৃত জারের পানি ভরসা উপকূলবাসীর। সরকারের কাছে তাদের দাবি, অবিলম্বে পানির প্লান্ট স্থাপন করে এলাকার মানুষকে মুক্তি দেয়া হোকÑ সুপেয় পানির সংকট থেকে।
শ্যামনগর উপজেলার দুর্গাবাটি গ্রামের রীতা রায় জানান, এক কলস জল আনতে দু’ কি.মি. হাঁটতে হয়। এখানে এসে লাইনে দাঁড়াতে হয়। এক বেলা যদি জল নিতে পার করি, অন্যকাজ করব কখন।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আরশেদ আলী জানান, উপকূলীয় এলাকার প্রধান সমস্যা হলো, যত গভীরেই পাইপ বসানো হোক না কেন, লবণ উঠবেই। সেই কারণে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বৃষ্টির পানিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ধরে রাখতে হবে আর সরকারিভাবে পিসিএফের মাধ্যমে পুকুরের পানি বিশুদ্ধকরণের কাজটি তার অফিস করে দেবে।
বেড়িবাঁধের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, শ্যামনগর এলাকায় জাইকার অর্থায়নে কাজ শুরু হবে। ভেঙে যাওয়া দুর্গাবাটি এলাকায় কাজ চলমান রয়েছে। গাবুরা অঞ্চলে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে। ডিপিপি ইতোমধ্যে প্রি-একনেকে রয়েছে। ভিজিট করে পরবর্তীতে প্রি-একনেক থেকে একনেকে উঠবে প্রকল্পটি।
সার্বিক বিষয়ে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, আমপানের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে অনেক আগেই। এ বছরের মধ্যে ১ হাজার ৩শ’ ৫০টি ঘর নির্মাণ করে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে ৩ হাজার মে. টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। ১শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার করার কাজ চলছে।
সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, আগামী ২৩ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাইক্লোন শেল্টার ও মুজিব কেল্লা নির্মাণের ঘোষণা দেবেন। এছাড়া সাতক্ষীরাকে অতি দুর্যোগপ্রবণ জেলা হিসেবে ঘোষণা দেয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১ , ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৭ শাওয়াল ১৪৪২
বেড়িবাঁধ সংস্কার হয়নি, ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটে এলাকাবাসীর
আবুল কাসেম, সাতক্ষীরা
এক বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি আমপান দুর্গত উপকূলীয় এলাকার মানুষ। বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত পার করেন তারা। আমপানের তা-বে বাড়ি ধসে পড়ায় তাদের অনেকেরই ঠিকানা এখন বেড়িবাঁধের খুপড়ি ঘরে। রাস্তা সংস্কার না হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। লবণাক্ততার প্রভাবে হাজার হাজার গাছ মারা যাওয়ায় মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সুপেয় পানি, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানসহ সংকট আর সংকটে বিপর্যস্ত উপকূলবাসী।
২০ মে ঘূর্ণিঝড় আমপানের তা-বে ল-ভ- হয় পুরো উপকূলীয় এলাকা। আমপানে উপকূলীয় এলাকায় পানিবন্দী হয়ে পড়ে লাখো মানুষ। ঘরবাড়ি ধসে পড়ে ২ হাজারেরও বেশি। এখনও ডুবে আছে শতাধিক ঘর। মাছের ক্ষতি হয়েছে ১শ’ ৭৬ কোটি টাকার। কাজ না থাকায় লোকজন হয়ে পড়েছে বেকার। এলজিইডি ও সড়ক বিভাগের ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ৩০ কি.মি. সড়ক।
কপোতাক্ষ নদ তীরবর্তী আশাশুনি উপজেলার সুভদ্রাকাটি গ্রামের আতাউর রহমান জানান, নদীর পাশ দিয়ে বেড়িবাঁধই হলো আমাদের যাতায়াতের রাস্তা। বেড়িবাঁধ ভাঙতে ভাঙতে একহাতেরও কম চিকন হয়ে গেছে। সাইকেল চালানো যায় না। সাইকেল চালাতে গিয়ে অনেকে ডিগবাজি খেয়ে কপোতাক্ষে পড়েছে।
আতাউর রহমান আরও জানান, নদ তীরবর্তী চাকলা, সুভদ্রাকাটি গ্রামের কোন মানুষ যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে, তবে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হবে।
দীর্ঘ ১ বছর বেড়িবাঁধের ওপর বসবাসকারী তাহেরা খাতুন জানান, সরকারি কোন ঘর পাইনি। আমার স্বামী মারা গেছে ১০ বছর। ছেলে নেই। ৫টিই মেয়ে। কাঠাপাঁচেক জমিতে ঘর ছিল। একবছর ধরে তলিয়ে আছে। বাধ্য হয়ে খুব কষ্টে বেড়িবাঁধের ওপর খুপড়ি ঘর করে মেয়ে কয়টা নিয়ে আছি।
বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়া আরেক নারী নাসিমা খাতুন জানান, আমপানে আমাদের বাড়িঘর সব ভেসে গেছে। ভেসে গেছে গৃহস্থালি সামগ্রীও। বেড়িবাঁধের ওপর টং বেঁধে ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। টঙের মধ্যেই রান্না-বান্না করতে হয়। খাবার পানির তীব্র অভাব। গায়ে ঘা-পাঁচড়া হচ্ছে। অবিলম্বে সরকারি ঘরের দাবি জানান নাসিমা।
কুড়িকাহুনিয়া গ্রামের আফজাল হোসেন জানান, আমপানের তা-বে কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর ২৯টি পয়েন্ট ভেঙে লবণাক্ততায় ভরে যায় পুরো এলাকা। গাছপালা সব মরে যাচ্ছে। এমনকি লবণাক্ততায় লবণসহিষ্ণু কেউড়া গাছও মরে যাচ্ছে। ঘের সব ভেসে গেছে। তীব্র বেকারত্ব বেড়েছে এলাকায়।
একই গ্রামের হাফেজ আফছার হোসেন জানান, আগে এই এলাকায় দুটো করে ফসল হতো। আমপানের পরে একটি ফসলও হয় না। এলাকায় বেড়েছে তীব্র বেকারত্ব। জীবন-জীবিকা হয়ে পড়েছে খুবই কষ্টসাধ্য। অনেকে নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।
উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট তীব্র। আমপানে মিষ্টি পানির আধার ভরে গেছে লবণে। কিছু বেসরকারি সংস্থার সরবরাহকৃত জারের পানি ভরসা উপকূলবাসীর। সরকারের কাছে তাদের দাবি, অবিলম্বে পানির প্লান্ট স্থাপন করে এলাকার মানুষকে মুক্তি দেয়া হোকÑ সুপেয় পানির সংকট থেকে।
শ্যামনগর উপজেলার দুর্গাবাটি গ্রামের রীতা রায় জানান, এক কলস জল আনতে দু’ কি.মি. হাঁটতে হয়। এখানে এসে লাইনে দাঁড়াতে হয়। এক বেলা যদি জল নিতে পার করি, অন্যকাজ করব কখন।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আরশেদ আলী জানান, উপকূলীয় এলাকার প্রধান সমস্যা হলো, যত গভীরেই পাইপ বসানো হোক না কেন, লবণ উঠবেই। সেই কারণে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বৃষ্টির পানিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ধরে রাখতে হবে আর সরকারিভাবে পিসিএফের মাধ্যমে পুকুরের পানি বিশুদ্ধকরণের কাজটি তার অফিস করে দেবে।
বেড়িবাঁধের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, শ্যামনগর এলাকায় জাইকার অর্থায়নে কাজ শুরু হবে। ভেঙে যাওয়া দুর্গাবাটি এলাকায় কাজ চলমান রয়েছে। গাবুরা অঞ্চলে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে। ডিপিপি ইতোমধ্যে প্রি-একনেকে রয়েছে। ভিজিট করে পরবর্তীতে প্রি-একনেক থেকে একনেকে উঠবে প্রকল্পটি।
সার্বিক বিষয়ে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, আমপানের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে অনেক আগেই। এ বছরের মধ্যে ১ হাজার ৩শ’ ৫০টি ঘর নির্মাণ করে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে ৩ হাজার মে. টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। ১শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার করার কাজ চলছে।
সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, আগামী ২৩ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাইক্লোন শেল্টার ও মুজিব কেল্লা নির্মাণের ঘোষণা দেবেন। এছাড়া সাতক্ষীরাকে অতি দুর্যোগপ্রবণ জেলা হিসেবে ঘোষণা দেয়ার অনুরোধ করেন তিনি।