করোনা মোকাবিলায় চীনের সিনোফার্ম ভ্যাকসিন

শফিকুর রহমান

ফাইজার, মডার্না, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসন পর চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ কোম্পানি সিনোফার্মের তৈরি করোনাভাইরাসের সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটি জরুরি ব্যবহারের জন্য গত ৭ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নিয়ে বর্তমানে পাঁচ নম্বর প্রতিযোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। নিষ্ক্রিয় (ইনেক্টিভ) করোনাভাইরাস ব্যবহার করে ভেরো সেল (বিবিআইবিপি-করভি) ভ্যাকসিনটি উদ্ভাবন করেছে চীনের বেইজিং ইনস্টিটিউট অফ বায়োলজিকাল প্রডাক্টস। এটি পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে প্রথম কোন দেশের উদ্ভাবিত টিকা, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেল।

তিন ধাপের পরীক্ষার পর গত বছরের ৩০ জুন সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটি কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে ৭৯.৩৪ শতাংশ কার্যকর হিসেবে এর ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে চীন। ইতোমধ্যে আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকার অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশসহ ৫০টিরও বেশি দেশ জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের তাগিদে চীনা ভ্যাকসিনটি অনুমোদন করেছে। প্রথম দিকে চীন তাদের করোনা ভ্যাকসিনগুলো সম্পর্কে আন্তর্জাতিকভাবে খুবই কম তথ্য প্রকাশ করায় এর কার্যকারিতা সম্পর্কে অনেকদিন থেকেই নিশ্চয়তার অভাব থেকে গিয়েছিল।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনটির সংগ্রহে অনিশ্চয়তা সৃষ্টির পর ভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গত ২৯ এপ্রিল সিনোফার্মের টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশের ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং ইতোমধ্যেই চীন সরকারের উপহার হিসাবে ৫ লক্ষ ডোজ ভ্যাকসিন বাংলাদেশে পৌঁছেছে। এর আগে রাশিয়ায় তৈরি স্পুটনিক-ভি টিকাও বাংলাদেশে অনুমোদন পায়।

প্রশ্ন হলোÑফাইজার, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিনের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে উৎপাদিত সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটির ভিন্নতা কী, কীভাবে কাজ করে এবং বাংলাদেশসহ নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য এটি ব্যবহারে কী কী সুবিধা রয়েছে?

সিনোফার্ম ভ্যাকসিন তৈরির জন্য করোনাভাইরাসের একটি বড় স্টক উৎপাদন করার পর বিটা-প্রোপিওল্যাকটোন নামে একটি রাসায়নিক দ্রব্য করোনার জিনের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে করোনভাইরাসগুলোকে অক্ষম (ডিজেবল্ড) করার ফলে নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাসটি আর প্রতিলিপি বা বংশবৃদ্ধি করতে পারে না এবং স্পাইকসহ ভাইরাসটির প্রোটিন অক্ষত থাকে। এরপর নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাসগুলোর সঙ্গে একটি অ্যালুমিনিয়ামভিত্তিক যৌগ অল্প পরিমাণে মিশ্রিত করা হয় যা অ্যাডজভ্যান্ট নামে পরিচিত। অ্যাডজভ্যান্ট সাধারণত একটি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বাড়াতে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাটিকে উদ্দীপিত করে। এভাবে নিষ্ক্রিয় ভাইরাসগুলো ভ্যাকসিন তৈরিতে এক শতাব্দী ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং একই পদ্ধতিতে নিষ্ক্রিয় ভাইরাসগুলো ব্যবহার করে পোলিও, রেবিজ ও হেপাটাইটিসসহ অনেক ভ্যাকসিন তৈরি করে ঐসব রোগের বিরুদ্ধে মানবদেহে সাড়া জাগানো ইমিউনিটি (সংক্রমণ বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা) সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে।

সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটি শরীরে ইঞ্জেক্ট করার পর দেহের অভ্যন্তরে নিষ্ক্রিয় ভাইরাসগুলোকে এক ধরনের প্রতিরোধক কোষ গ্রাস করে, যাকে অ্যান্টিজেন-উপস্থাপক কোষ বলে। অ্যান্টিজেন-উপস্থাপক কোষগুলো ভাইরাসকে পৃথক করে এর কিছু অংশকে কোষের পৃষ্ঠের ওপর প্রদর্শন করে। এরপর একটি সহায়ক টি-কোষ (হেলপার টি-সেল) ভাইরাসের ওই অংশকে শনাক্ত করার পর টি-কোষটি সক্রিয় হয়ে যায় এবং ভ্যাকসিনের প্রতিক্রিয়া জানাতে অন্যান্য প্রতিরোধক কোষকে নিয়োগে সহায়তা করে ও সঙ্গে সঙ্গে বি-কোষও সক্রিয় হয়ে যায়। সাধারণত বি-কোষগুলো অ্যান্টিবডি তৈরি করে, যা আক্রমণকারী করোনার স্পাইকের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করে তাকে আমাদের দেহের কোষের সঙ্গে সংযুক্ত হতে দেয় না, ফলে করোনাভাইরাসটি কোষের ভেতর প্রবেশ করতে পারে না বলে সংক্রমণও সৃষ্টি করতে পারে না। অন্যান্য ধরনের অ্যান্টিবডিগুলোও ভাইরাসটিকে অন্য উপায়ে ব্লক করতে এগিয়ে আসে।

সিনোফর্মের ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলো প্রমাণ করেছে যে বিবিআইবিপি-করভি মানুষকে কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে রক্ষা করতে পারে। তবে সেই সুরক্ষা কত দিন স্থায়ী হয় তা এখনই বলা কঠিন। এটি সম্ভব যে, কয়েক মাস পরে হয়ত অ্যান্টিবডিগুলোর স্তর হ্রাস পাবে, তবে ইমিউন সিস্টেমের মেমোরি বি-কোষ কয়েক বছর, এমনকি কয়েক দশক ধরে করোনাভাইরাস সম্পর্কে তথ্য বজায় রাখতে পারে এবং আমাদের করোনা থেকে সুরক্ষা দিতে পারে।

সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটির তৃতীয় ধাপে শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতেই ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ৩১ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষে এর কার্যকারিতা ও সুরক্ষা পরীক্ষা করা হয়েছে। আরব আমিরাতের ট্রায়াল শেষে দেখা গেছে যে, এ ভ্যাকসিনটির দুটি ডোজ দেয়ার পর করোনা সংক্রমণ থেকে ৮৬ শতাংশ, মধ্যম ও গুরুতর অসুস্থতা থেকে ১০০ শতাংশ এবং হাসপাতালে ও আইসিউ এ ভর্তি থেকে যথাক্রমে ৯৩ ও ৯৫ শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারে। এরপর, আবারও তৃতীয় ধাপে মিসর, বাহরাইন, জর্ডান, পাকিস্তান, পেরু, আর্জেন্টিনা ও মরক্কোতে আরও প্রায় ২৯ হাজার লোকের ওপর ট্রায়াল শেষে ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটির ৩য় পর্যায়ের ট্রায়ালগুলো পর্যবেক্ষণ করে এবং এটি ১৮-৫৯ বছর বয়সীদের ৭৮.১ শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারে বলে স্বীকৃতি দেয়।

যদিও ৫৯ বছরের বেশি বয়সী খুব অল্পসংখ্যক লোকদের ওপর এ ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়েছে, তবুও ৫৯ বছরের বেশি বয়সীরা ও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান এমন মায়েরাও এ ভ্যাকসিনটি নিতে পারবে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মত দিয়েছে। এ ভ্যাকসিনটির মতো নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের অনেক ভ্যাকসিন গর্ববতী মহিলাদের নিয়মিত দেয়া হচ্ছে, তাই তাদের এ ভ্যাকসিনটি নিতে সমস্যা নেই।

ফাইজার ও মডার্নার এমআরএনএ ভ্যাকসিনে করোনার স্পাইক প্রোটিনের জন্য শুধু রাসায়নিক উপায়ে তৈরি জিনগত কোড (এমাইনো এসিড) ব্যবহার করা হয়েছে, অন্য কোন ভাইরাস ব্যবহার করা হয়নি। আবার, ভ্যাক্টর বাহিত অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিনে করোনার স্পাইক জিনকে পৃথক করে অন্য একটি অ্যাডেনোভাইরাসে স্থানান্তর করা হয় এবং এ ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে সংক্ষমণ সৃষ্টি বা সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে না। কাজেই সরাসরি নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাস ব্যবহার করে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটি তৈরি করা হয় বলে এর উৎপাদন খরচও অন্যান্য ভ্যাকসিনের তুলনায় খুবই কম। এটি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনটির মতোই ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়।

সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটির ট্রায়ালের সময় ১.৫৮ শতাংশ মহিলা ও ০.৭২ শতাংশ পুরুষের মধ্যে সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল এবং ভ্যাকসিন প্রয়োগের স্থান ফুলে যাওয়াসহ সামান্য ব্যাথা, মাথাব্যাথা, ক্লান্তি ভাব ও জ্বর আসার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কারও দেখা দিতে পারে। এ ভ্যাকসিনটির ০.৫ মিলি এর ১ম ডোজ নেয়ার ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পর ২য় ডোজ নিতে হয়। যাদের যেকোন ভ্যাকসিন গ্রহণের পর মারাত্মক অ্যালার্জিক সমস্যা হয় বা যারা জ্বরে ভুগছেন তাদের করোনা ভ্যাকসিনটি নেয়া উচিত নয়।

সম্প্রতি আইইডিসিআরের একটি গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রথম ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন গ্রহণকারীদের টিকা গ্রহণের এক মাস পর ৯২ শতাংশের ও দুই মাস পর ৯৭ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। সব বয়সী টিকা গ্রহণকারীর শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কাজেই, করোনার এ মহামারি থেকে মানুষের আপাতত মুক্তি পাওয়ার জন্য এসব ভ্যাকসিনের কোন বিকল্প নেই। ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য আগ্রহী হয়েই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। একমাত্র টিকাই পারবে আমাদের সবাইকে করোনার কারণে মৃত্যুর ঝুঁকিপূর্ণ জীবন থেকে রক্ষা করে আবার প্রাণের স্পন্দন ফিরিয়ে দিতে।

[লেখক : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]

mrahman7@lakeheadu.ca

বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১ , ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৭ শাওয়াল ১৪৪২

করোনা মোকাবিলায় চীনের সিনোফার্ম ভ্যাকসিন

শফিকুর রহমান

image

ফাইজার, মডার্না, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসন পর চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ কোম্পানি সিনোফার্মের তৈরি করোনাভাইরাসের সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটি জরুরি ব্যবহারের জন্য গত ৭ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নিয়ে বর্তমানে পাঁচ নম্বর প্রতিযোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। নিষ্ক্রিয় (ইনেক্টিভ) করোনাভাইরাস ব্যবহার করে ভেরো সেল (বিবিআইবিপি-করভি) ভ্যাকসিনটি উদ্ভাবন করেছে চীনের বেইজিং ইনস্টিটিউট অফ বায়োলজিকাল প্রডাক্টস। এটি পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে প্রথম কোন দেশের উদ্ভাবিত টিকা, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেল।

তিন ধাপের পরীক্ষার পর গত বছরের ৩০ জুন সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটি কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে ৭৯.৩৪ শতাংশ কার্যকর হিসেবে এর ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে চীন। ইতোমধ্যে আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকার অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশসহ ৫০টিরও বেশি দেশ জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের তাগিদে চীনা ভ্যাকসিনটি অনুমোদন করেছে। প্রথম দিকে চীন তাদের করোনা ভ্যাকসিনগুলো সম্পর্কে আন্তর্জাতিকভাবে খুবই কম তথ্য প্রকাশ করায় এর কার্যকারিতা সম্পর্কে অনেকদিন থেকেই নিশ্চয়তার অভাব থেকে গিয়েছিল।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনটির সংগ্রহে অনিশ্চয়তা সৃষ্টির পর ভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গত ২৯ এপ্রিল সিনোফার্মের টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশের ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং ইতোমধ্যেই চীন সরকারের উপহার হিসাবে ৫ লক্ষ ডোজ ভ্যাকসিন বাংলাদেশে পৌঁছেছে। এর আগে রাশিয়ায় তৈরি স্পুটনিক-ভি টিকাও বাংলাদেশে অনুমোদন পায়।

প্রশ্ন হলোÑফাইজার, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিনের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে উৎপাদিত সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটির ভিন্নতা কী, কীভাবে কাজ করে এবং বাংলাদেশসহ নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য এটি ব্যবহারে কী কী সুবিধা রয়েছে?

সিনোফার্ম ভ্যাকসিন তৈরির জন্য করোনাভাইরাসের একটি বড় স্টক উৎপাদন করার পর বিটা-প্রোপিওল্যাকটোন নামে একটি রাসায়নিক দ্রব্য করোনার জিনের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে করোনভাইরাসগুলোকে অক্ষম (ডিজেবল্ড) করার ফলে নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাসটি আর প্রতিলিপি বা বংশবৃদ্ধি করতে পারে না এবং স্পাইকসহ ভাইরাসটির প্রোটিন অক্ষত থাকে। এরপর নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাসগুলোর সঙ্গে একটি অ্যালুমিনিয়ামভিত্তিক যৌগ অল্প পরিমাণে মিশ্রিত করা হয় যা অ্যাডজভ্যান্ট নামে পরিচিত। অ্যাডজভ্যান্ট সাধারণত একটি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বাড়াতে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাটিকে উদ্দীপিত করে। এভাবে নিষ্ক্রিয় ভাইরাসগুলো ভ্যাকসিন তৈরিতে এক শতাব্দী ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং একই পদ্ধতিতে নিষ্ক্রিয় ভাইরাসগুলো ব্যবহার করে পোলিও, রেবিজ ও হেপাটাইটিসসহ অনেক ভ্যাকসিন তৈরি করে ঐসব রোগের বিরুদ্ধে মানবদেহে সাড়া জাগানো ইমিউনিটি (সংক্রমণ বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা) সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে।

সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটি শরীরে ইঞ্জেক্ট করার পর দেহের অভ্যন্তরে নিষ্ক্রিয় ভাইরাসগুলোকে এক ধরনের প্রতিরোধক কোষ গ্রাস করে, যাকে অ্যান্টিজেন-উপস্থাপক কোষ বলে। অ্যান্টিজেন-উপস্থাপক কোষগুলো ভাইরাসকে পৃথক করে এর কিছু অংশকে কোষের পৃষ্ঠের ওপর প্রদর্শন করে। এরপর একটি সহায়ক টি-কোষ (হেলপার টি-সেল) ভাইরাসের ওই অংশকে শনাক্ত করার পর টি-কোষটি সক্রিয় হয়ে যায় এবং ভ্যাকসিনের প্রতিক্রিয়া জানাতে অন্যান্য প্রতিরোধক কোষকে নিয়োগে সহায়তা করে ও সঙ্গে সঙ্গে বি-কোষও সক্রিয় হয়ে যায়। সাধারণত বি-কোষগুলো অ্যান্টিবডি তৈরি করে, যা আক্রমণকারী করোনার স্পাইকের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করে তাকে আমাদের দেহের কোষের সঙ্গে সংযুক্ত হতে দেয় না, ফলে করোনাভাইরাসটি কোষের ভেতর প্রবেশ করতে পারে না বলে সংক্রমণও সৃষ্টি করতে পারে না। অন্যান্য ধরনের অ্যান্টিবডিগুলোও ভাইরাসটিকে অন্য উপায়ে ব্লক করতে এগিয়ে আসে।

সিনোফর্মের ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলো প্রমাণ করেছে যে বিবিআইবিপি-করভি মানুষকে কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে রক্ষা করতে পারে। তবে সেই সুরক্ষা কত দিন স্থায়ী হয় তা এখনই বলা কঠিন। এটি সম্ভব যে, কয়েক মাস পরে হয়ত অ্যান্টিবডিগুলোর স্তর হ্রাস পাবে, তবে ইমিউন সিস্টেমের মেমোরি বি-কোষ কয়েক বছর, এমনকি কয়েক দশক ধরে করোনাভাইরাস সম্পর্কে তথ্য বজায় রাখতে পারে এবং আমাদের করোনা থেকে সুরক্ষা দিতে পারে।

সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটির তৃতীয় ধাপে শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতেই ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ৩১ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষে এর কার্যকারিতা ও সুরক্ষা পরীক্ষা করা হয়েছে। আরব আমিরাতের ট্রায়াল শেষে দেখা গেছে যে, এ ভ্যাকসিনটির দুটি ডোজ দেয়ার পর করোনা সংক্রমণ থেকে ৮৬ শতাংশ, মধ্যম ও গুরুতর অসুস্থতা থেকে ১০০ শতাংশ এবং হাসপাতালে ও আইসিউ এ ভর্তি থেকে যথাক্রমে ৯৩ ও ৯৫ শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারে। এরপর, আবারও তৃতীয় ধাপে মিসর, বাহরাইন, জর্ডান, পাকিস্তান, পেরু, আর্জেন্টিনা ও মরক্কোতে আরও প্রায় ২৯ হাজার লোকের ওপর ট্রায়াল শেষে ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটির ৩য় পর্যায়ের ট্রায়ালগুলো পর্যবেক্ষণ করে এবং এটি ১৮-৫৯ বছর বয়সীদের ৭৮.১ শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারে বলে স্বীকৃতি দেয়।

যদিও ৫৯ বছরের বেশি বয়সী খুব অল্পসংখ্যক লোকদের ওপর এ ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়েছে, তবুও ৫৯ বছরের বেশি বয়সীরা ও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান এমন মায়েরাও এ ভ্যাকসিনটি নিতে পারবে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মত দিয়েছে। এ ভ্যাকসিনটির মতো নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের অনেক ভ্যাকসিন গর্ববতী মহিলাদের নিয়মিত দেয়া হচ্ছে, তাই তাদের এ ভ্যাকসিনটি নিতে সমস্যা নেই।

ফাইজার ও মডার্নার এমআরএনএ ভ্যাকসিনে করোনার স্পাইক প্রোটিনের জন্য শুধু রাসায়নিক উপায়ে তৈরি জিনগত কোড (এমাইনো এসিড) ব্যবহার করা হয়েছে, অন্য কোন ভাইরাস ব্যবহার করা হয়নি। আবার, ভ্যাক্টর বাহিত অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিনে করোনার স্পাইক জিনকে পৃথক করে অন্য একটি অ্যাডেনোভাইরাসে স্থানান্তর করা হয় এবং এ ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে সংক্ষমণ সৃষ্টি বা সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে না। কাজেই সরাসরি নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাস ব্যবহার করে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটি তৈরি করা হয় বলে এর উৎপাদন খরচও অন্যান্য ভ্যাকসিনের তুলনায় খুবই কম। এটি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনটির মতোই ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়।

সিনোফার্ম ভ্যাকসিনটির ট্রায়ালের সময় ১.৫৮ শতাংশ মহিলা ও ০.৭২ শতাংশ পুরুষের মধ্যে সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল এবং ভ্যাকসিন প্রয়োগের স্থান ফুলে যাওয়াসহ সামান্য ব্যাথা, মাথাব্যাথা, ক্লান্তি ভাব ও জ্বর আসার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কারও দেখা দিতে পারে। এ ভ্যাকসিনটির ০.৫ মিলি এর ১ম ডোজ নেয়ার ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ পর ২য় ডোজ নিতে হয়। যাদের যেকোন ভ্যাকসিন গ্রহণের পর মারাত্মক অ্যালার্জিক সমস্যা হয় বা যারা জ্বরে ভুগছেন তাদের করোনা ভ্যাকসিনটি নেয়া উচিত নয়।

সম্প্রতি আইইডিসিআরের একটি গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রথম ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন গ্রহণকারীদের টিকা গ্রহণের এক মাস পর ৯২ শতাংশের ও দুই মাস পর ৯৭ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। সব বয়সী টিকা গ্রহণকারীর শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। কাজেই, করোনার এ মহামারি থেকে মানুষের আপাতত মুক্তি পাওয়ার জন্য এসব ভ্যাকসিনের কোন বিকল্প নেই। ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য আগ্রহী হয়েই সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। একমাত্র টিকাই পারবে আমাদের সবাইকে করোনার কারণে মৃত্যুর ঝুঁকিপূর্ণ জীবন থেকে রক্ষা করে আবার প্রাণের স্পন্দন ফিরিয়ে দিতে।

[লেখক : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]

mrahman7@lakeheadu.ca