সামসুজ্জামান
১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই রাজাকার এবং শান্তি কমিটির সহায়তায় খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় শুরু হয় গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ। ১৪ এপ্রিল পাক সেনারা প্রথম বটিয়াঘাটার চক্রাখালী স্কুলের সামনে অবস্থান নেয়। গানবোট থেকে তারা শেল নিক্ষেপ শুরু করে। এই এলাকাটি হিন্দু অধ্যুসিত। একই সময় নকশালপন্থিদের তৎপরতাও বৃদ্ধি পায়। দেশে যেখানে শাসন নেই, সর্বত্র চলছে ভীতি-সন্ত্রাস। রণকৌশল হিসেবে তারা তখন নির্ধারণ করে শ্রেণীশত্রু খতমের পরিকল্পনা। ১৭ মে আবাদের বিখ্যাত ধনী পরিবারের পুলিন সরদার, অনন্ত সরদার, দয়াল সরদার এবং বিষ্ণু সরদারকে হত্যা করে। একদিকে পাক সেনাদের গণহত্যা, স্থানীয় মানুষদের লুটপাট, অন্য দিকে নকশালদের মানুষ হত্যা। এমতাবস্থায় কালবিলম্ব না করে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় ভারতের উদ্দেশে রওনা দেয়। সোনাদানা, টাকা পয়সা এবং কিছু প্রয়োজনীয় খাদ্য সঙ্গে করে জীবন বাঁচানোর তাগিদে তারা এসে জড়ো হয় চুকনগর বাজারে। এর আগেও কয়েক হাজার মানুষ এই পথ দিয়ে ভারতে ঢুকেছে। দিন যত যাচ্ছিল মানুষের আগমনও ততই বাড়ছিল। ১৯-২০ মে রাত দিন ছিল বিরামহীন জনস্রোত। বাজার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। চুকনগর মালতিয়া এবং চাকুন্দিয়া গ্রামে প্রায় ৪ কি:মি: এলাকা জুড়ে সমাগম হয়েছিল প্রায় ২ লাখ মানুষ।
পানির দামে বিক্রি হচ্ছে জিনিসপত্র। সংঘবদ্ধ চক্র আড়ালে আবডালে জিনিসপত্র চুরি করছে। অনেক জায়গায় জোর-জবরদস্তি করে চলছে লুটপাট। শরণার্থীদের চোখেমুখে চাপা আতঙ্ক। ভারতে পৌঁছে দেয়া দালালদের সঙ্গে চলছে শলাপরামর্শ। ইতোমধ্যে ভারত সরকার পশ্চিমবঙ্গে খুলেছে শরণার্থী শিবির। আমার এটুকু আলোই সবার স্বান্ত¡না। তাই ভারতে পৌঁছানোর আকুলতা।
চুকনগর থেকে ২৫-৩০ কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিতে পারলেই সীমান্ত পার হওয়া যাবে। কিছু দিন আগেও যে বাস ট্রাক চলাচল করতো তা পাক সেনারা নিয়ে নিয়েছে। ফলে পায়ে হাঁটা ছাড়া বিকল্প কোন রাস্তা নেই। স্থানীয় আওয়ামী নেতারা যতটা সম্ভব শরণার্থীদের সহযোগিতার সক্রীয় ছিল। গ্রুপ তৈরি করে পাহারা দিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেবারও প্রস্তুতি নিয়েছিল ১৯ মে। কিন্তু বিধি বাম ২০ মে চুকনগরে সৃষ্টি হলো রক্তাক্ত ইতিহাস। চুকনগরে সংগঠিত বাংলাদেশের তথা বিশ্বের ইতিহাসে বৃহত্তম গণহত্যার ইতিহাস। স্বাধীনতা অর্জন করতে যে মূল্য আমাদের দিতে হয়েছে তা ভুলে যেতে বসেছে জাতি। ফলে নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করতে চুকনগর গণহত্যাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
ভৌগলিক দিক থেকে চুকনগর বাজারের অবস্থান খুবই সুবিধাজনক। যশোর-খুলনা এবং সাতক্ষীরা জেলার সংযোগ স্থল হওয়ায় প্রায় সপ্তাহ ধরে বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, ফুলতলা, তেরখাদা, দিঘলিয়া, দৌলতপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রায় দু’লাখ মানুষ সড়ক ও নৌপথে এখানে জড়ো হয়েছিল ভারতে যাবার উদ্দেশে। ২০ মে বেলা বারোটার দিকে যশোর এবং সাতক্ষীরা সাব ক্যান্টনমেন্ট থেকে দ্বিমুখী আক্রমণ চালায় সেনারা। ৫৭টি আর্মি ভ্যানে এসেছিল তারা। ব্রাশ ফায়ারে পাখির মতো মারতে থাকে মানুষ। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নদীর পাড়ের বড় গাছের শিকড় ধরে নাক উঁচু করে থেকেও রেহাই পায়নি কেউ। নদীর মধ্যে বৃষ্টির মতো ব্রাশ ফায়ার করছে তারা। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাগ্যে এবং বিশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এখানে। ইতিহাস থেকে যানা যায়, ভিয়েতনামের মাইলাট গ্রামে মার্কিন সেনারা এক জায়গায় হত্যা করেছিল ১৫/১৬ জন মানুষকে।
তার পর যুদ্ধকালীন বড় হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হয় পাঞ্জাবের ভালিয়ানাওয়ালাবাগে। বিট্রিশ জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে হত্যা করা হয় ২২শ’ মানুষকে। ৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে এতোবড় নৃশংস হত্যাকাণ্ড বিশ্বের আর কোথাও ঘটেনি। মাত্র পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে পাক সেনারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ৭১-এর ২০ মে বাংলা ৫ জ্যৈষ্ঠ ছিল এ ঘটনার দিন। আজও প্রত্যক্ষদর্শীদের মানসপটে এ দৃশ্য ভেসে উঠলে শিহরিত হয়ে ওঠে তারা। তারা ঘুমের মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। তারা যে নৃশংসতা দেখেছে তা বর্ণনাতীত। তারা দেখেছে পাক-হানাদারদের নৃশংসতা। দেখেছে প্রকাশ্য ধর্ষণের দৃশ্য। দেখেছে যুবতী মেয়েদের বাবা-মার চোখের সামনে থেকে টেনে-হিঁচড়ে আর্মি ভ্যানে তোলা হচ্ছে। দেখেছে প্রকাশ্য যৌনাচারের দৃশ্য। গণহত্যার পর এলাকার ৪২ জন মানুষ পরম মমতাভরে দুদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে এসব মৃতদেহ গণকবর দেয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকর্তৃক সেদিন বাংলাদেশের বৃহত্তম গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল চুকনগরের পবিত্র মাটিতে। স্মরণকালের সাড়া জাগানো এতবড় গণহত্যার খবরটি ৯০ দশকের পূর্ব পর্যন্ত দেশবাসীর কাছে ছিল অজানা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ১৫ খণ্ড সংকলিত স্বাধীনতা যুদ্ধের মুদ্রিত দলিল এবং প্রকাশিত গণহত্যা বিষয়ক পুস্তকে চুকনগরে সংগঠিত গণহত্যার বিষয়টি স্থান পায়নি। ১৯৯৩ সালে গঠিত হয় চুকনগর গণহত্যা ‘৭১ স্মৃতি রক্ষা পরিশোধ’। সেই থেকে প্রতি বছর এই ব্যানারের আওতায় পালিত হচ্ছে ২০ মে চুকনগর গণহত্যা দিবস।
চুকনগর গণহত্যার বিষয়টি এখন জাতীয় পর্যায়ে বহুল আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাতাখোলা বিলে ২০০৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘চুকনগর গণহত্যা ৭১ স্মৃতি স্তম্ভ’। এখানে এসেছেন অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান, কেএম শফিউল্লাহ, সাবেক ডেপুটি স্পিকার, লে. কর্নেল শওকত আলী, অধ্যাপক মুন্তাছির মামুন, ডা. বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, বিচারপতি গোলাম রব্বানী, ব্যারিস্টার সাহারা বেগম, রাশেদা কে চৌধুরী প্রমুখ।
চুকনগর গণহত্যা স্মৃতি রক্ষার্থে, চুকনগর গণহত্যা স্মৃতি পাঠাগার ৭১, চুকনগর কলেজ শহীদ মিনার, চুনকগর বাজার কালীমন্দির স্মৃতি ফলক নির্মিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর অব. রফিকুল ইসলামের ‘মুক্তির সোপান তলে’ মুন্তাছির মামুনের ‘১৯৭১ চুনকনগর গণহত্যা’, ‘আক্তার হোসেনের চুকনগরের লাশ’, ‘ইব্রাহীম রেজার গণহত্যা চুকনগর গ্রন্থ’। চুকনগর ছোট পরিসরে একটি গ্রামীণ জনপথ। একমাত্র ৭১-এর গণহত্যাই এলাকাটি পরিচিতি এনে দিয়েছে। অথচ আজও রাষ্ট্রীয়ভাবে মেলেনি এর স্বীকৃতি। এলাকার মানুষের দুঃখকষ্ট এবং আক্ষেপ এটাই।
স্বাধীনতার অর্জন ও মুক্তিযোদ্ধা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনায় বিষয়টি তুলে ধরা হয়। সেই তুলনায় মানুষের মন-মননে ততটা স্থান পায়নি। ৫২’র ভাষার আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আমরা বিশ্ব মাতৃ ভাষা দিবসের স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছি ৪৫ বছর পর। কিন্তু চুকনগর গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি নিয়ে নেই কোন মাথাব্যথা। স্বাধীনতার প্রাপ্তির ৪৮ বছর পার হয়ে গেলেও এ বিষয়টি আজও পর্যন্ত জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়নি। নেয়া হয়নি কোন সরেজমিন প্রতিবেদনের উদ্যোগ। কোন এলাকার কোন সংসারে কতজনকে হত্যা করা হয়েছে তার চূড়ান্ত কোন তালিকা প্রকাশ করা হয়নি আজও। অথচ এটি তদন্তের পাশাপাশি চুকনগর গণহত্যা বিষয়টি বিশ্ব স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি। সরকারি সদিচ্ছাই যথেষ্ট এর জন্য।
[লেখক : ব্যবসায়ী]
বৃহস্পতিবার, ২০ মে ২০২১ , ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৭ শাওয়াল ১৪৪২
সামসুজ্জামান
১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই রাজাকার এবং শান্তি কমিটির সহায়তায় খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় শুরু হয় গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ। ১৪ এপ্রিল পাক সেনারা প্রথম বটিয়াঘাটার চক্রাখালী স্কুলের সামনে অবস্থান নেয়। গানবোট থেকে তারা শেল নিক্ষেপ শুরু করে। এই এলাকাটি হিন্দু অধ্যুসিত। একই সময় নকশালপন্থিদের তৎপরতাও বৃদ্ধি পায়। দেশে যেখানে শাসন নেই, সর্বত্র চলছে ভীতি-সন্ত্রাস। রণকৌশল হিসেবে তারা তখন নির্ধারণ করে শ্রেণীশত্রু খতমের পরিকল্পনা। ১৭ মে আবাদের বিখ্যাত ধনী পরিবারের পুলিন সরদার, অনন্ত সরদার, দয়াল সরদার এবং বিষ্ণু সরদারকে হত্যা করে। একদিকে পাক সেনাদের গণহত্যা, স্থানীয় মানুষদের লুটপাট, অন্য দিকে নকশালদের মানুষ হত্যা। এমতাবস্থায় কালবিলম্ব না করে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় ভারতের উদ্দেশে রওনা দেয়। সোনাদানা, টাকা পয়সা এবং কিছু প্রয়োজনীয় খাদ্য সঙ্গে করে জীবন বাঁচানোর তাগিদে তারা এসে জড়ো হয় চুকনগর বাজারে। এর আগেও কয়েক হাজার মানুষ এই পথ দিয়ে ভারতে ঢুকেছে। দিন যত যাচ্ছিল মানুষের আগমনও ততই বাড়ছিল। ১৯-২০ মে রাত দিন ছিল বিরামহীন জনস্রোত। বাজার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। চুকনগর মালতিয়া এবং চাকুন্দিয়া গ্রামে প্রায় ৪ কি:মি: এলাকা জুড়ে সমাগম হয়েছিল প্রায় ২ লাখ মানুষ।
পানির দামে বিক্রি হচ্ছে জিনিসপত্র। সংঘবদ্ধ চক্র আড়ালে আবডালে জিনিসপত্র চুরি করছে। অনেক জায়গায় জোর-জবরদস্তি করে চলছে লুটপাট। শরণার্থীদের চোখেমুখে চাপা আতঙ্ক। ভারতে পৌঁছে দেয়া দালালদের সঙ্গে চলছে শলাপরামর্শ। ইতোমধ্যে ভারত সরকার পশ্চিমবঙ্গে খুলেছে শরণার্থী শিবির। আমার এটুকু আলোই সবার স্বান্ত¡না। তাই ভারতে পৌঁছানোর আকুলতা।
চুকনগর থেকে ২৫-৩০ কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিতে পারলেই সীমান্ত পার হওয়া যাবে। কিছু দিন আগেও যে বাস ট্রাক চলাচল করতো তা পাক সেনারা নিয়ে নিয়েছে। ফলে পায়ে হাঁটা ছাড়া বিকল্প কোন রাস্তা নেই। স্থানীয় আওয়ামী নেতারা যতটা সম্ভব শরণার্থীদের সহযোগিতার সক্রীয় ছিল। গ্রুপ তৈরি করে পাহারা দিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেবারও প্রস্তুতি নিয়েছিল ১৯ মে। কিন্তু বিধি বাম ২০ মে চুকনগরে সৃষ্টি হলো রক্তাক্ত ইতিহাস। চুকনগরে সংগঠিত বাংলাদেশের তথা বিশ্বের ইতিহাসে বৃহত্তম গণহত্যার ইতিহাস। স্বাধীনতা অর্জন করতে যে মূল্য আমাদের দিতে হয়েছে তা ভুলে যেতে বসেছে জাতি। ফলে নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করতে চুকনগর গণহত্যাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
ভৌগলিক দিক থেকে চুকনগর বাজারের অবস্থান খুবই সুবিধাজনক। যশোর-খুলনা এবং সাতক্ষীরা জেলার সংযোগ স্থল হওয়ায় প্রায় সপ্তাহ ধরে বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, ফুলতলা, তেরখাদা, দিঘলিয়া, দৌলতপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রায় দু’লাখ মানুষ সড়ক ও নৌপথে এখানে জড়ো হয়েছিল ভারতে যাবার উদ্দেশে। ২০ মে বেলা বারোটার দিকে যশোর এবং সাতক্ষীরা সাব ক্যান্টনমেন্ট থেকে দ্বিমুখী আক্রমণ চালায় সেনারা। ৫৭টি আর্মি ভ্যানে এসেছিল তারা। ব্রাশ ফায়ারে পাখির মতো মারতে থাকে মানুষ। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নদীর পাড়ের বড় গাছের শিকড় ধরে নাক উঁচু করে থেকেও রেহাই পায়নি কেউ। নদীর মধ্যে বৃষ্টির মতো ব্রাশ ফায়ার করছে তারা। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাগ্যে এবং বিশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এখানে। ইতিহাস থেকে যানা যায়, ভিয়েতনামের মাইলাট গ্রামে মার্কিন সেনারা এক জায়গায় হত্যা করেছিল ১৫/১৬ জন মানুষকে।
তার পর যুদ্ধকালীন বড় হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হয় পাঞ্জাবের ভালিয়ানাওয়ালাবাগে। বিট্রিশ জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে হত্যা করা হয় ২২শ’ মানুষকে। ৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে এতোবড় নৃশংস হত্যাকাণ্ড বিশ্বের আর কোথাও ঘটেনি। মাত্র পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে পাক সেনারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ৭১-এর ২০ মে বাংলা ৫ জ্যৈষ্ঠ ছিল এ ঘটনার দিন। আজও প্রত্যক্ষদর্শীদের মানসপটে এ দৃশ্য ভেসে উঠলে শিহরিত হয়ে ওঠে তারা। তারা ঘুমের মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। তারা যে নৃশংসতা দেখেছে তা বর্ণনাতীত। তারা দেখেছে পাক-হানাদারদের নৃশংসতা। দেখেছে প্রকাশ্য ধর্ষণের দৃশ্য। দেখেছে যুবতী মেয়েদের বাবা-মার চোখের সামনে থেকে টেনে-হিঁচড়ে আর্মি ভ্যানে তোলা হচ্ছে। দেখেছে প্রকাশ্য যৌনাচারের দৃশ্য। গণহত্যার পর এলাকার ৪২ জন মানুষ পরম মমতাভরে দুদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে এসব মৃতদেহ গণকবর দেয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকর্তৃক সেদিন বাংলাদেশের বৃহত্তম গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল চুকনগরের পবিত্র মাটিতে। স্মরণকালের সাড়া জাগানো এতবড় গণহত্যার খবরটি ৯০ দশকের পূর্ব পর্যন্ত দেশবাসীর কাছে ছিল অজানা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ১৫ খণ্ড সংকলিত স্বাধীনতা যুদ্ধের মুদ্রিত দলিল এবং প্রকাশিত গণহত্যা বিষয়ক পুস্তকে চুকনগরে সংগঠিত গণহত্যার বিষয়টি স্থান পায়নি। ১৯৯৩ সালে গঠিত হয় চুকনগর গণহত্যা ‘৭১ স্মৃতি রক্ষা পরিশোধ’। সেই থেকে প্রতি বছর এই ব্যানারের আওতায় পালিত হচ্ছে ২০ মে চুকনগর গণহত্যা দিবস।
চুকনগর গণহত্যার বিষয়টি এখন জাতীয় পর্যায়ে বহুল আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাতাখোলা বিলে ২০০৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘চুকনগর গণহত্যা ৭১ স্মৃতি স্তম্ভ’। এখানে এসেছেন অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান, কেএম শফিউল্লাহ, সাবেক ডেপুটি স্পিকার, লে. কর্নেল শওকত আলী, অধ্যাপক মুন্তাছির মামুন, ডা. বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, বিচারপতি গোলাম রব্বানী, ব্যারিস্টার সাহারা বেগম, রাশেদা কে চৌধুরী প্রমুখ।
চুকনগর গণহত্যা স্মৃতি রক্ষার্থে, চুকনগর গণহত্যা স্মৃতি পাঠাগার ৭১, চুকনগর কলেজ শহীদ মিনার, চুনকগর বাজার কালীমন্দির স্মৃতি ফলক নির্মিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর অব. রফিকুল ইসলামের ‘মুক্তির সোপান তলে’ মুন্তাছির মামুনের ‘১৯৭১ চুনকনগর গণহত্যা’, ‘আক্তার হোসেনের চুকনগরের লাশ’, ‘ইব্রাহীম রেজার গণহত্যা চুকনগর গ্রন্থ’। চুকনগর ছোট পরিসরে একটি গ্রামীণ জনপথ। একমাত্র ৭১-এর গণহত্যাই এলাকাটি পরিচিতি এনে দিয়েছে। অথচ আজও রাষ্ট্রীয়ভাবে মেলেনি এর স্বীকৃতি। এলাকার মানুষের দুঃখকষ্ট এবং আক্ষেপ এটাই।
স্বাধীনতার অর্জন ও মুক্তিযোদ্ধা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনায় বিষয়টি তুলে ধরা হয়। সেই তুলনায় মানুষের মন-মননে ততটা স্থান পায়নি। ৫২’র ভাষার আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আমরা বিশ্ব মাতৃ ভাষা দিবসের স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছি ৪৫ বছর পর। কিন্তু চুকনগর গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি নিয়ে নেই কোন মাথাব্যথা। স্বাধীনতার প্রাপ্তির ৪৮ বছর পার হয়ে গেলেও এ বিষয়টি আজও পর্যন্ত জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়নি। নেয়া হয়নি কোন সরেজমিন প্রতিবেদনের উদ্যোগ। কোন এলাকার কোন সংসারে কতজনকে হত্যা করা হয়েছে তার চূড়ান্ত কোন তালিকা প্রকাশ করা হয়নি আজও। অথচ এটি তদন্তের পাশাপাশি চুকনগর গণহত্যা বিষয়টি বিশ্ব স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি। সরকারি সদিচ্ছাই যথেষ্ট এর জন্য।
[লেখক : ব্যবসায়ী]