ভরাট, দখল ও দূষণের শিকার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে খাল ও নদীগুলো। খালগুলো পরিণত হয়েছে নর্দমায়। নদী হয়ে গেছে খাল। ঢাকায় কয়টি খাল ছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সরকারি এক একটি সংস্থা এক এক রকম তথ্য। কেউ বলছে ৫১টি, কেউ বলছে ৪৬টি কেউ বলছে ৩২টি খাল। এছাড়া ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু ও ধলেশ^রী নদীর পানি হয়ে গেছে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত। ঢাকার খাল ও নদীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ শেষ পর্ব।
ঢাকার চারপাশের নদীগুলো বেদখল থেকে রক্ষা এবং সৌন্দর্য বর্ধনের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী তিন পর্যায়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এই মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চারমাসে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ^রী নদীর তীরে অভিযান চালিয়ে ৪ হাজার ১৫টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এছাড়া ১১৩ একর ভূমি অবমুক্ত করা হয়েছে। উচ্ছেদকৃত নদীর তীরে প্রথম পর্যায়ে ১০ হাজার সীমানা পিলার স্থাপন, ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ৩টি ইকোপার্ক ও ১৯ জেটি নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের অধীনে বাবুবাজার ব্রিজ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সৌন্দর্য বর্ধন করা হবে। বিনোদনের জন্য ইকোপার্ক নির্মাণ করা হবে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সিন্নিকটে এবং তুরাগ নদীর তীরে আশুলিয়া ও টঙ্গীতে। এছাড়া কেরানীগঞ্জের খোলামোড়া এলাকায় একটি হেলিপ্যাড নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বিআইডব্লিউটিএ’র সূত্র জানায়।
জানা গেছে, ঢাকার চারপাশ নদী দখল ও দূষণরোধে ২০ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ওয়ার্কওয়ে নির্মাণ ও বনায়ণ তৈরিতে কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া নদী দূষণরোধে বর্র্জ্যরে উৎসমুখ বন্ধ করে বর্জ্য দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে সরকার। নদীগুলো দূষণ ও দখলরোধ এবং নাব্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাস্টারপ্ল্যানটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানটি ৩টি অংশে ভাগ করা হয়েছে। দূষণ, দখল এবং নাব্যতা। মাস্টারপ্ল্যানটি ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষণ, দখল এবং নাব্যতা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলাসমূহের শাখা নদী ও খাল এগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া ‘নদী দূষণ প্রতিরোধ কমিটি-২০০৮’ এর প্রতিবেদন বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চলমান বর্তমান প্রজেক্টসমূহ পর্যালোচনা করে এই মহাপরিকল্পটি তৈরি করা হয়েছে। দূষণ, দখলরোধ এবং নাব্যতা বৃদ্ধিকল্পে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে ৪টি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ১ বছরের মধ্যে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, ৩ বছরের মধ্যে স্বল্প মেয়াদী, ৫ বছরের মধ্যে মধ্য মেয়াদী এবং ১০ বছরের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। মাস্টারপ্ল্যানে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব ও কার্যাবলী নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ এর মতামত গ্রহণ করা হয়েছে বলে নৌ-মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে নদী রক্ষা টাস্কফোর্স কমিটির সভপতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ধাপে ধাপে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রথম পর্যায়ে নদীগুলো ড্রেজিং করতে হবে। পলি পড়ে নদীর বেডগুলো উঁচু হয়ে গেছে, সেগুলোতে আগের জায়গায় নিতে হবে। পানি দূষিত হয়ে গেছে, পানি ট্রিট করতে হবে। পানিতে আর যাতে দূষিত পদার্থ না যায় সেজন্য সোর্সগুলো বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি গৃহস্থালি ও শিল্প বর্জ্য যাতে আর নদীতে না যায়, সেই ব্যবস্থা নেয়া কথাও পরিকল্পনায় রয়েছে। বর্জ্য সংগ্রহ করে আমরা ডিসপোজাল করে দেব। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কত টাকা লাগবে তা ওয়ার্কিং গ্রুপ নির্ধারণ করবে। ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজগুলো ভাগ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবে। ইতোমধ্যে সেই কাজ শুরু হয়ে গেছে।
মন্ত্রী বলেন, একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তারা অনুমোদিত এই খসড়া এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করবেন। প্রাথমিকভাবে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এজন্য নদীর তীর দখলমুক্ত করা হচ্ছে, ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এরপর ওয়াসার নেতৃত্বে স্যানিটেশনের কাজ শুরু হচ্ছে। দূষিত পানি যেন নদীতে না যায় সেজন্য ঢাকার স্যুয়ারেজ লাইনও ঠিক করার কথা রয়েছে এই মহাপরিকল্পনায়। বর্জ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। বর্জ্য যাতে নদীতে এখানে-সেখানে ডাম্প করা না হয় সেজন্য বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে কাজ করছি।
বিআইডব্লিউটিএ’র সূত্র জানায়, নদীর রক্ষার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঢাকা চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ^রী নদীর দুই তীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব নদীর তীর অভিযান চালিয়ে ৯ হাজার ৮৯২টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এ সময় ২৭৭ দশমিক ৬৭ একর তীর ভূমি উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত তীর ভূমিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে ৮৪৮ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা তীর ভূমিতে পিলার স্থাপন, তীর রক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুসঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ নির্মাণ (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।
এর মধ্যে নদীর দু’পাড়ে ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, তীর রক্ষা বাঁধ, ভরাটকৃত মাটি খনন, ১০০টি আরসিসি সিঁড়ি, ১ কিলোমিটার কি-ওয়াল, সেতু ও রেলিং নির্মাণ, ৪০৯টি বসার বেঞ্চ, ১০ হাজার ৮২০টি সীমানা পিলার, ৩টি ইকোপার্ক, ১৯টি জেটি, ৬টি লংবুম এক্সেভেটর ক্রয় ও নদীর তীরে বনায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে ৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ৩ হাজার স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন, ৬টি লংবুম এক্সেভেটর, ১ হাজার বৃক্ষরোপণ শেষ হয়েছে। এছাড়া ওয়াকয়ে, জেটি ও ইকোপার্ক নির্মাণসহ অন্যান্য কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ২০২৩ সালে জুনে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে বলে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্র জানায়।
প্রবল্প সূত্র জানায়, ঢাকা চারদিকে নৌপথে একটি দৃষ্টিনন্দন ও কার্যকরী নৌপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্পে নতুন কিছু স্থাপনা সংযোজন করে সংশোধিত প্রকল্প (আরডিপিপি) তৈরি করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আরডিপিপি’র ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। এর মাটি খনন, ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ৭ হাজার ৫৬২টি স্থায়ী সীমানা পিলার, ৮০টি আরসিসি জেটি, ২৯১টি বসার বেঞ্চ, ১৪টি ভারি জেটি, পার্কিং ইয়ার্ড, ৩টি রাস্তা নির্মাণ, ইকোপার্ক, সীমানা প্রাচীর, রেলিং, সেতু কি-ওয়াল নির্মাণ, সদরঘাট ও কেরানীগঞ্জে ৪টি ঘাট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী চলমান ২য় পর্যায় এবং প্রস্তাবিত ৩য় পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকার চারপাশে ১১০ কিলোমিটার নৌ-পথে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে। এছাড়া নদীর দু’পাড়ে ২২০ কিলোমিটার তীরভূমিত স্থায়ীভাবে সীমানা পিলার, ওয়াকওয়ে, আরসিসি জেটি, ইকোপার্ক ও বনায়নের মাধ্যমে নদী দখল দূষণ রোধ হবে ও নদী তীরে পরিবেশ দৃষ্টিনন্দন হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকা শহরের চারিদিকে নৌপথ উন্নয়নের মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে এই প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ৩ হাজার স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন ও বৃক্ষরোপণসহ অন্যান্য কাজ শেষ হয়েছে। আরডিপিপিতে ৭ হাজার ৫৬২টি স্থায়ী সীমানা পিলার, ৮০টি আরসিসি জেটি, ২৯১টি বসার বেঞ্চ, ১৪টি ভারি জেটি, পার্কিং ইয়ার্ড ও ইকোপার্কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নদী দখল রোধ হবে এবং দৃষ্টিনন্দন পরিবেশে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে বলে জানান তিনি।
শুক্রবার, ২১ মে ২০২১ , ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৮ শাওয়াল ১৪৪২
ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ
ভরাট, দখল ও দূষণের শিকার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে খাল ও নদীগুলো। খালগুলো পরিণত হয়েছে নর্দমায়। নদী হয়ে গেছে খাল। ঢাকায় কয়টি খাল ছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সরকারি এক একটি সংস্থা এক এক রকম তথ্য। কেউ বলছে ৫১টি, কেউ বলছে ৪৬টি কেউ বলছে ৩২টি খাল। এছাড়া ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু ও ধলেশ^রী নদীর পানি হয়ে গেছে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত। ঢাকার খাল ও নদীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ শেষ পর্ব।
ঢাকার চারপাশের নদীগুলো বেদখল থেকে রক্ষা এবং সৌন্দর্য বর্ধনের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী তিন পর্যায়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এই মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চারমাসে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ^রী নদীর তীরে অভিযান চালিয়ে ৪ হাজার ১৫টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এছাড়া ১১৩ একর ভূমি অবমুক্ত করা হয়েছে। উচ্ছেদকৃত নদীর তীরে প্রথম পর্যায়ে ১০ হাজার সীমানা পিলার স্থাপন, ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ৩টি ইকোপার্ক ও ১৯ জেটি নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের অধীনে বাবুবাজার ব্রিজ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সৌন্দর্য বর্ধন করা হবে। বিনোদনের জন্য ইকোপার্ক নির্মাণ করা হবে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সিন্নিকটে এবং তুরাগ নদীর তীরে আশুলিয়া ও টঙ্গীতে। এছাড়া কেরানীগঞ্জের খোলামোড়া এলাকায় একটি হেলিপ্যাড নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বিআইডব্লিউটিএ’র সূত্র জানায়।
জানা গেছে, ঢাকার চারপাশ নদী দখল ও দূষণরোধে ২০ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ওয়ার্কওয়ে নির্মাণ ও বনায়ণ তৈরিতে কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া নদী দূষণরোধে বর্র্জ্যরে উৎসমুখ বন্ধ করে বর্জ্য দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে সরকার। নদীগুলো দূষণ ও দখলরোধ এবং নাব্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাস্টারপ্ল্যানটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানটি ৩টি অংশে ভাগ করা হয়েছে। দূষণ, দখল এবং নাব্যতা। মাস্টারপ্ল্যানটি ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষণ, দখল এবং নাব্যতা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলাসমূহের শাখা নদী ও খাল এগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া ‘নদী দূষণ প্রতিরোধ কমিটি-২০০৮’ এর প্রতিবেদন বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চলমান বর্তমান প্রজেক্টসমূহ পর্যালোচনা করে এই মহাপরিকল্পটি তৈরি করা হয়েছে। দূষণ, দখলরোধ এবং নাব্যতা বৃদ্ধিকল্পে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে ৪টি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ১ বছরের মধ্যে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, ৩ বছরের মধ্যে স্বল্প মেয়াদী, ৫ বছরের মধ্যে মধ্য মেয়াদী এবং ১০ বছরের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। মাস্টারপ্ল্যানে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব ও কার্যাবলী নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ এর মতামত গ্রহণ করা হয়েছে বলে নৌ-মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে নদী রক্ষা টাস্কফোর্স কমিটির সভপতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ধাপে ধাপে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রথম পর্যায়ে নদীগুলো ড্রেজিং করতে হবে। পলি পড়ে নদীর বেডগুলো উঁচু হয়ে গেছে, সেগুলোতে আগের জায়গায় নিতে হবে। পানি দূষিত হয়ে গেছে, পানি ট্রিট করতে হবে। পানিতে আর যাতে দূষিত পদার্থ না যায় সেজন্য সোর্সগুলো বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি গৃহস্থালি ও শিল্প বর্জ্য যাতে আর নদীতে না যায়, সেই ব্যবস্থা নেয়া কথাও পরিকল্পনায় রয়েছে। বর্জ্য সংগ্রহ করে আমরা ডিসপোজাল করে দেব। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কত টাকা লাগবে তা ওয়ার্কিং গ্রুপ নির্ধারণ করবে। ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজগুলো ভাগ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবে। ইতোমধ্যে সেই কাজ শুরু হয়ে গেছে।
মন্ত্রী বলেন, একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তারা অনুমোদিত এই খসড়া এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করবেন। প্রাথমিকভাবে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এজন্য নদীর তীর দখলমুক্ত করা হচ্ছে, ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এরপর ওয়াসার নেতৃত্বে স্যানিটেশনের কাজ শুরু হচ্ছে। দূষিত পানি যেন নদীতে না যায় সেজন্য ঢাকার স্যুয়ারেজ লাইনও ঠিক করার কথা রয়েছে এই মহাপরিকল্পনায়। বর্জ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। বর্জ্য যাতে নদীতে এখানে-সেখানে ডাম্প করা না হয় সেজন্য বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে কাজ করছি।
বিআইডব্লিউটিএ’র সূত্র জানায়, নদীর রক্ষার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঢাকা চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ^রী নদীর দুই তীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব নদীর তীর অভিযান চালিয়ে ৯ হাজার ৮৯২টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এ সময় ২৭৭ দশমিক ৬৭ একর তীর ভূমি উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত তীর ভূমিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে ৮৪৮ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা তীর ভূমিতে পিলার স্থাপন, তীর রক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুসঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ নির্মাণ (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।
এর মধ্যে নদীর দু’পাড়ে ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, তীর রক্ষা বাঁধ, ভরাটকৃত মাটি খনন, ১০০টি আরসিসি সিঁড়ি, ১ কিলোমিটার কি-ওয়াল, সেতু ও রেলিং নির্মাণ, ৪০৯টি বসার বেঞ্চ, ১০ হাজার ৮২০টি সীমানা পিলার, ৩টি ইকোপার্ক, ১৯টি জেটি, ৬টি লংবুম এক্সেভেটর ক্রয় ও নদীর তীরে বনায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে ৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ৩ হাজার স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন, ৬টি লংবুম এক্সেভেটর, ১ হাজার বৃক্ষরোপণ শেষ হয়েছে। এছাড়া ওয়াকয়ে, জেটি ও ইকোপার্ক নির্মাণসহ অন্যান্য কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ২০২৩ সালে জুনে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে বলে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্র জানায়।
প্রবল্প সূত্র জানায়, ঢাকা চারদিকে নৌপথে একটি দৃষ্টিনন্দন ও কার্যকরী নৌপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্পে নতুন কিছু স্থাপনা সংযোজন করে সংশোধিত প্রকল্প (আরডিপিপি) তৈরি করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আরডিপিপি’র ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। এর মাটি খনন, ৫২ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ৭ হাজার ৫৬২টি স্থায়ী সীমানা পিলার, ৮০টি আরসিসি জেটি, ২৯১টি বসার বেঞ্চ, ১৪টি ভারি জেটি, পার্কিং ইয়ার্ড, ৩টি রাস্তা নির্মাণ, ইকোপার্ক, সীমানা প্রাচীর, রেলিং, সেতু কি-ওয়াল নির্মাণ, সদরঘাট ও কেরানীগঞ্জে ৪টি ঘাট অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী চলমান ২য় পর্যায় এবং প্রস্তাবিত ৩য় পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকার চারপাশে ১১০ কিলোমিটার নৌ-পথে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে। এছাড়া নদীর দু’পাড়ে ২২০ কিলোমিটার তীরভূমিত স্থায়ীভাবে সীমানা পিলার, ওয়াকওয়ে, আরসিসি জেটি, ইকোপার্ক ও বনায়নের মাধ্যমে নদী দখল দূষণ রোধ হবে ও নদী তীরে পরিবেশ দৃষ্টিনন্দন হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক সংবাদকে বলেন, ‘ঢাকা শহরের চারিদিকে নৌপথ উন্নয়নের মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে এই প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ৩ হাজার স্থায়ী সীমানা পিলার স্থাপন ও বৃক্ষরোপণসহ অন্যান্য কাজ শেষ হয়েছে। আরডিপিপিতে ৭ হাজার ৫৬২টি স্থায়ী সীমানা পিলার, ৮০টি আরসিসি জেটি, ২৯১টি বসার বেঞ্চ, ১৪টি ভারি জেটি, পার্কিং ইয়ার্ড ও ইকোপার্কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নদী দখল রোধ হবে এবং দৃষ্টিনন্দন পরিবেশে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে বলে জানান তিনি।