ডাল মিল মালিক মন্টু এখন বাসচালক

সেনাবাহিনীর চাকরি অবসর শেষে গ্রামে ফিরে ডালের মিল করেছিলেন মো. মন্টু। তিনি বলেন, ‘ডাল ব্যবসায়ীরা শুধু মানুষ রূপে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে কিচ্ছু নাই। আয়-ইনকাম কিছু নাই, সুদের ভয়ে ঋণ পরিশোধ করতে করতে সব শেষ। আমার ডাল মিল থেকে কোন আয় নাই। তাই হানিফ পরিবহনের গাড়ি চালাচ্ছি। এই দিয়েই সংসারটা চালিয়ে নেয়া যাচ্ছে। মিলে খুব লস।’

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আর বাইরে থেকে ডাল আমদানির কারণে রাজশাহীর ব্যবসায়ীদের দুর্দিন চলছে। টানা লোকসানে অনেকে মিল বন্ধ করে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে অন্তত ১৫০টি মিল বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলো চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। ডাল ভাঙালেও মিল থেকে বিক্রি হচ্ছে না।

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর ও বেলপুকুর এলাকায় এক-দেড় বছর আগেও অন্তত ২৫০টি ডাল মিল চলত। এখন সেই সংখ্যা ১০০তে নেমে এসেছে। রমজান মাসে সাধারণত মসুর ডালের চাহিদা বাড়লেও এবার চিত্র ছিল ভিন্ন। মিলারদের লাখ লাখ টাকার ডাল পড়ে আছে গুদামে। বিক্রি হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশি ডালের চাহিদা কমে গেছে।

বানেশ্বর এলাকার ভাই ভাই ডাল মিলের স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, রমজান মাসে ভর্তার জন্য মসুর ডালের চাহিদা বেড়ে যায়। সে অনুযায়ী তারা অতিরিক্ত ডাল কিনে মিলে প্রক্রিয়াজাত করে রাখেন। কিন্তু এবার রমজানে মসুর ডালের চাহিদা ছিল না বললেই চলে। তিনি বলেন, মানুষ এখন আমদানি করা মোটা মসুর ডাল খাচ্ছেন। সেটা কম দামে পাওয়া যায়। ফলে দেশি চিকন মসুর ডালের চাহিদা কমে গেছে। তাছাড়া এবার লকডাউন দেয়ার পর ব্যবসা একেবারেই থেমে গেছে। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশি মসুর, ছোলা, মাসকালাই এবং খেসারি ডালের ব্যবসা খারাপ হয়ে পড়ায় বানেশ্বরের অনেক ব্যবসায়ীও আমদানির দিকে নজর দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার নিম্নমানের ডাল এনে প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করছেন। তবে দু’একজন স্থানীয় ডালের ব্যবসা ছেড়ে আমদানির দিকে ঝুঁকছেন বলে তারা স্বীকার করছেন। তারা বলছেন, সবকিছুই টিকে থাকার জন্য। বাধ্য হয়ে তারাও ডাল আমদানি করছেন।

তবে এখনও বানেশ্বরের বেশিরভাগ মিল মালিক বানেশ্বর বাজারে চাষিদের ডাল কিনে থাকেন। সেই ডাল রোদে শুকানোর পর নিজেদের মিলে ভাঙ্গান। প্রক্রিয়াজাতের পর এসব মিল থেকে ডাল যায় ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য প্রান্তে। বর্তমানে ডালের দাম নিয়ে চাষিদেরও পোষাচ্ছে না, মিলারদেরও পোষাচ্ছে না। ফলে ডাল নিয়ে সবাই বেকায়দায় পড়ছেন। আগে পরিস্থিতি এত খারাপ ছিল না। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

পুঠিয়ার বেলঘরিয়া এলাকার শাহীন ডাল মিলের মালিক শাহীন আলম বলেন, ‘আমরা খুব খারাপ আছি। আমাদের খোঁজ নেয়ার কেউ নাই।’

ডাল মিলের আরেক মালিক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘গুদামে ২০ লাখ টাকার ডাল পড়ে আছে। কেনার মানুষ নাই। ডালে পোকা ধরছে, শুটি ধরছে। দুদিন পর পর বের করে রোদে শুকাতে হচ্ছে। পরিস্থিতি এত খারাপ যে, ডাল বের করে রোদ দেয়ার শ্রমিকের মজুরিই দিতে পারছি না। তাও বের করতে হচ্ছে। তা না হলে তো সবই পঁচে যাবে। এমন খারাপ পরিস্থিতি আর দেখিনি। এবার ডালগুলো বিক্রি করতে পারলে নতুন করে আর কিনব না। এত টেনশন নেয়া যায় না।’

বানেশ্বর ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহজাহান আলী বলেন, দেশি ডালের বাজার নিশ্চিত করতে হলে কম দামে বিদেশি মোটা ডাল আমদানি বন্ধ করতে হবে। অন্তত দেশি ডাল যতদিন থাকে, ততদিন বাইরে থেকে যেন ডাল আমদানি করা না হয়। শুধু এটা নিশ্চিত করা হলেই ডাল ব্যবসায়ী-চাষিরা উপকৃত হবেন। তা না হলে করোনা কেটে গেলেও আমাদের দুর্দশা কাটবে না। সরকার আমাদের যদি প্রণোদনা দিত, তাহলে কোন রকমে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম।’

শনিবার, ২২ মে ২০২১ , ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৯ শাওয়াল ১৪৪২

রাজশাহীতে ১৫০ ডাল মিল বন্ধ

ডাল মিল মালিক মন্টু এখন বাসচালক

জেলা বার্তা পরিবেশক, রাজশাহী

সেনাবাহিনীর চাকরি অবসর শেষে গ্রামে ফিরে ডালের মিল করেছিলেন মো. মন্টু। তিনি বলেন, ‘ডাল ব্যবসায়ীরা শুধু মানুষ রূপে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে কিচ্ছু নাই। আয়-ইনকাম কিছু নাই, সুদের ভয়ে ঋণ পরিশোধ করতে করতে সব শেষ। আমার ডাল মিল থেকে কোন আয় নাই। তাই হানিফ পরিবহনের গাড়ি চালাচ্ছি। এই দিয়েই সংসারটা চালিয়ে নেয়া যাচ্ছে। মিলে খুব লস।’

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আর বাইরে থেকে ডাল আমদানির কারণে রাজশাহীর ব্যবসায়ীদের দুর্দিন চলছে। টানা লোকসানে অনেকে মিল বন্ধ করে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে অন্তত ১৫০টি মিল বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলো চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। ডাল ভাঙালেও মিল থেকে বিক্রি হচ্ছে না।

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর ও বেলপুকুর এলাকায় এক-দেড় বছর আগেও অন্তত ২৫০টি ডাল মিল চলত। এখন সেই সংখ্যা ১০০তে নেমে এসেছে। রমজান মাসে সাধারণত মসুর ডালের চাহিদা বাড়লেও এবার চিত্র ছিল ভিন্ন। মিলারদের লাখ লাখ টাকার ডাল পড়ে আছে গুদামে। বিক্রি হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশি ডালের চাহিদা কমে গেছে।

বানেশ্বর এলাকার ভাই ভাই ডাল মিলের স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, রমজান মাসে ভর্তার জন্য মসুর ডালের চাহিদা বেড়ে যায়। সে অনুযায়ী তারা অতিরিক্ত ডাল কিনে মিলে প্রক্রিয়াজাত করে রাখেন। কিন্তু এবার রমজানে মসুর ডালের চাহিদা ছিল না বললেই চলে। তিনি বলেন, মানুষ এখন আমদানি করা মোটা মসুর ডাল খাচ্ছেন। সেটা কম দামে পাওয়া যায়। ফলে দেশি চিকন মসুর ডালের চাহিদা কমে গেছে। তাছাড়া এবার লকডাউন দেয়ার পর ব্যবসা একেবারেই থেমে গেছে। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশি মসুর, ছোলা, মাসকালাই এবং খেসারি ডালের ব্যবসা খারাপ হয়ে পড়ায় বানেশ্বরের অনেক ব্যবসায়ীও আমদানির দিকে নজর দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার নিম্নমানের ডাল এনে প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করছেন। তবে দু’একজন স্থানীয় ডালের ব্যবসা ছেড়ে আমদানির দিকে ঝুঁকছেন বলে তারা স্বীকার করছেন। তারা বলছেন, সবকিছুই টিকে থাকার জন্য। বাধ্য হয়ে তারাও ডাল আমদানি করছেন।

তবে এখনও বানেশ্বরের বেশিরভাগ মিল মালিক বানেশ্বর বাজারে চাষিদের ডাল কিনে থাকেন। সেই ডাল রোদে শুকানোর পর নিজেদের মিলে ভাঙ্গান। প্রক্রিয়াজাতের পর এসব মিল থেকে ডাল যায় ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য প্রান্তে। বর্তমানে ডালের দাম নিয়ে চাষিদেরও পোষাচ্ছে না, মিলারদেরও পোষাচ্ছে না। ফলে ডাল নিয়ে সবাই বেকায়দায় পড়ছেন। আগে পরিস্থিতি এত খারাপ ছিল না। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

পুঠিয়ার বেলঘরিয়া এলাকার শাহীন ডাল মিলের মালিক শাহীন আলম বলেন, ‘আমরা খুব খারাপ আছি। আমাদের খোঁজ নেয়ার কেউ নাই।’

ডাল মিলের আরেক মালিক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘গুদামে ২০ লাখ টাকার ডাল পড়ে আছে। কেনার মানুষ নাই। ডালে পোকা ধরছে, শুটি ধরছে। দুদিন পর পর বের করে রোদে শুকাতে হচ্ছে। পরিস্থিতি এত খারাপ যে, ডাল বের করে রোদ দেয়ার শ্রমিকের মজুরিই দিতে পারছি না। তাও বের করতে হচ্ছে। তা না হলে তো সবই পঁচে যাবে। এমন খারাপ পরিস্থিতি আর দেখিনি। এবার ডালগুলো বিক্রি করতে পারলে নতুন করে আর কিনব না। এত টেনশন নেয়া যায় না।’

বানেশ্বর ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহজাহান আলী বলেন, দেশি ডালের বাজার নিশ্চিত করতে হলে কম দামে বিদেশি মোটা ডাল আমদানি বন্ধ করতে হবে। অন্তত দেশি ডাল যতদিন থাকে, ততদিন বাইরে থেকে যেন ডাল আমদানি করা না হয়। শুধু এটা নিশ্চিত করা হলেই ডাল ব্যবসায়ী-চাষিরা উপকৃত হবেন। তা না হলে করোনা কেটে গেলেও আমাদের দুর্দশা কাটবে না। সরকার আমাদের যদি প্রণোদনা দিত, তাহলে কোন রকমে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম।’