২০০৭ সালের ২০ জানুয়ারি নিখোঁজ হয় সাত বছরের শিশু রুবেল। ওই ঘটনায় জমি সংক্রান্ত বিরোধে ১৯ জনকে আসামি করে অপহরণ মামলা করেন রুবেলের মা। মামলার ৬ আসামি গ্রেপ্তার হয়ে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগও করেছেন। তবে ঘটনার ১৪ বছর ৪ মাস পর গত বুধবার এলাকায় ফিরে আসে কথিত অপহরণের শিকার রুবেল। বর্তমানে তিনি ২২ বছর বয়সী যুবক। ঘটনাটি ঘটেছে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার আলীরটেক ইউনিয়নের কুড়েরপাড়ে। এ নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে আসা হয় থানায়।
মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৯ জনকে আসামি করে অপহরণ মামলা দায়ের করেন রাহিমা বেগম। মামলার আসামিরা হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা জুলহাস উদ্দিন, কালাই চান, মনা, আমান, মুসলিম, মানিক, আজিজ, জিন্নাত আলী, সিরি মিয়া, ছালা উদ্দিন, শহর আলী, বাদশা মিয়া, সিরাজুল হক, শুক্কুর মেম্বার, ইয়ানুছ, আউয়াল, রাজু, হোসেন মিস্ত্রি।
মামলার এজাহারে বাদী বলেন, ওই বছরের ২০ জানুয়ারি বিকেলে আসামি কালাই ও নুরুল ইসলাম তার ছেলে রুবেলকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর রুবেল আর ফিরে আসেনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও রুবেলকে না পেয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন রাহিমা বেগম। পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে অপহরণ মামলা করেন। মামলায় জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে আসামিরা তার ছেলেকে অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ করেন বাদী। মামলাটি তদন্ত করে থানা পুলিশ, ডিবি, র্যাব ও সিআইডি। তবে কেউই ঘটনার সঙ্গে আসামিদের সম্পৃক্ততা পাননি। সর্বশেষ ২০১০ সালে ডিবি চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) দিলে আদালত মামলাটি নিষ্পত্তি করে দেন।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ওই বছর মামলার তদন্তভার পান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোখলেসুর রহমান। মামলায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। পরের বছরের ৩০ জুলাই মামলার অভিযোগের সঙ্গে আসামির সম্পৃক্ততা না পেয়ে তাদের অব্যাহতি দিয়ে আদালতে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। তবে বাদী এতে নারাজি দেয়। সর্বশেষ জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের এসআই আসাদুজ্জামান ফরাজী তদন্ত শেষে ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে মামলাটি নিষ্পত্তি করে দেন আদালত।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘটনার ১৪ বছর পর রুবেলকে এলাকায় দেখতে পান এলাকাবাসী। এ নিয়ে এলাকাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাকে থানায় নিয়ে আসা হয়। সঙ্গে আসেন ওই মামলায় অভিযুক্ত আসামিরাও।
১৪ বছর পর ফিরে আসা রুবেল এখন ২২ বছর বয়সী যুবক। বিয়েও করেছেন তিনি। রুবেল সংবাদকে বলেন, তার মা তিনটি বিবাহ করেছেন। তিনি তৃতীয় ঘরের সন্তান। তার পিতার নাম মৃত জানু মিয়া। শিশু বয়সে বাড়িতে অনেক কাজ করতে হতো রুবেলকে। মা একদিন মারধর করায় সিদ্ধান্ত নেন তিনি পালিয়ে যাবেন। ২০০৭ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি স্বেচ্ছায় ঘর থেকে পালিয়ে ট্রেনে চড়ে রাজধানীর কমলাপুর চলে যান। এরপর ঢাকার মগবাজার, হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন স্থানে রঙের কাজ, ফাস্টফুডের দোকানে চাকরি করেছেন। পরে ঢাকাতেই এক মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করেন তিনি। এর মধ্যে বাবা-মায়ের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না তার। তবে গত বছর ঢাকায় পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে মোবাইল নম্বর জোগার করে মায়ের সঙ্গে কথা বলেন রুবেল।
রুবেল বলেন, ‘মায়ের সঙ্গে কথা হলে সে গ্রামে ফিরতে নিষেধ করে। সে নাকি আমাকে অপহরণের মামলা করছে। আমি গ্রামে ফিরলে ঝামেলা হবে। ভয়ে আমি গ্রামে আসি নাই। গত বুধবার কাউরে কিছু না কইয়া গ্রামে আসছিলাম। মায়ের সঙ্গেও দেখা হইছে। পরে লোকজন আমারে চিনতে পাইরা থানায় নিয়া আসে।’
এদিকে রুবেলকে অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে আড়াই মাস কারাভোগ করতে হয়েছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা জুলহাস উদ্দিন আহম্মেদকে। তিনি বলেন, রুবেলকে তিনি চিনতেন না। এই প্রথম তাকে দেখেছেন। অথচ তাকে অপহরণের দায়ে কারাভোগ করা বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘মামলার কয়েক মাস পর র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হই। আমার মতো আরও কয়েকজন জেল খাটছে। এই হয়রানির বিচার চাই।’
ওই মামলায় কারাভোগ করতে হয়নি বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামকে। তবে গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় নিয়ে পালিয়ে বেরিয়েছেন দীর্ঘদিন। নুরুল ইসলাম বলেন, ‘মামলার পর থেইকা পলায়ে পলায়ে ছিলাম। কয়েকজনরে ধরছিলও। আইজ দেখি পোলায় ফিইরা আসছে।’ নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি শাহ্ জামান বলেন, ১৪ বছর পর ফিরে আসা যুবক রুবেলকে থানায় আনা হলে মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা এবং ভুক্তভোগীর কাছে ঘটনার বিবরণ জানতে চাওয়া হয়। পরে পরিবারের লোকজন ও মামলার বাদী ভুক্তভোগীকে শনাক্ত করলে গত শুক্রবার তাকে আদালতে পাঠানো হয়।
তিনি বলেন, মিথ্যা মামলা করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে চাইলে ওই মামলায় হয়রানির শিকার ব্যক্তিরা পাল্টা মামলা করতে পারেন।
শনিবার, ২২ মে ২০২১ , ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৯ শাওয়াল ১৪৪২
সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ
২০০৭ সালের ২০ জানুয়ারি নিখোঁজ হয় সাত বছরের শিশু রুবেল। ওই ঘটনায় জমি সংক্রান্ত বিরোধে ১৯ জনকে আসামি করে অপহরণ মামলা করেন রুবেলের মা। মামলার ৬ আসামি গ্রেপ্তার হয়ে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগও করেছেন। তবে ঘটনার ১৪ বছর ৪ মাস পর গত বুধবার এলাকায় ফিরে আসে কথিত অপহরণের শিকার রুবেল। বর্তমানে তিনি ২২ বছর বয়সী যুবক। ঘটনাটি ঘটেছে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার আলীরটেক ইউনিয়নের কুড়েরপাড়ে। এ নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে আসা হয় থানায়।
মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ ১৯ জনকে আসামি করে অপহরণ মামলা দায়ের করেন রাহিমা বেগম। মামলার আসামিরা হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা জুলহাস উদ্দিন, কালাই চান, মনা, আমান, মুসলিম, মানিক, আজিজ, জিন্নাত আলী, সিরি মিয়া, ছালা উদ্দিন, শহর আলী, বাদশা মিয়া, সিরাজুল হক, শুক্কুর মেম্বার, ইয়ানুছ, আউয়াল, রাজু, হোসেন মিস্ত্রি।
মামলার এজাহারে বাদী বলেন, ওই বছরের ২০ জানুয়ারি বিকেলে আসামি কালাই ও নুরুল ইসলাম তার ছেলে রুবেলকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর রুবেল আর ফিরে আসেনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও রুবেলকে না পেয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন রাহিমা বেগম। পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি আদালতে অপহরণ মামলা করেন। মামলায় জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে আসামিরা তার ছেলেকে অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ করেন বাদী। মামলাটি তদন্ত করে থানা পুলিশ, ডিবি, র্যাব ও সিআইডি। তবে কেউই ঘটনার সঙ্গে আসামিদের সম্পৃক্ততা পাননি। সর্বশেষ ২০১০ সালে ডিবি চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) দিলে আদালত মামলাটি নিষ্পত্তি করে দেন।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ওই বছর মামলার তদন্তভার পান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোখলেসুর রহমান। মামলায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। পরের বছরের ৩০ জুলাই মামলার অভিযোগের সঙ্গে আসামির সম্পৃক্ততা না পেয়ে তাদের অব্যাহতি দিয়ে আদালতে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। তবে বাদী এতে নারাজি দেয়। সর্বশেষ জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের এসআই আসাদুজ্জামান ফরাজী তদন্ত শেষে ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে মামলাটি নিষ্পত্তি করে দেন আদালত।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘটনার ১৪ বছর পর রুবেলকে এলাকায় দেখতে পান এলাকাবাসী। এ নিয়ে এলাকাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাকে থানায় নিয়ে আসা হয়। সঙ্গে আসেন ওই মামলায় অভিযুক্ত আসামিরাও।
১৪ বছর পর ফিরে আসা রুবেল এখন ২২ বছর বয়সী যুবক। বিয়েও করেছেন তিনি। রুবেল সংবাদকে বলেন, তার মা তিনটি বিবাহ করেছেন। তিনি তৃতীয় ঘরের সন্তান। তার পিতার নাম মৃত জানু মিয়া। শিশু বয়সে বাড়িতে অনেক কাজ করতে হতো রুবেলকে। মা একদিন মারধর করায় সিদ্ধান্ত নেন তিনি পালিয়ে যাবেন। ২০০৭ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি স্বেচ্ছায় ঘর থেকে পালিয়ে ট্রেনে চড়ে রাজধানীর কমলাপুর চলে যান। এরপর ঢাকার মগবাজার, হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন স্থানে রঙের কাজ, ফাস্টফুডের দোকানে চাকরি করেছেন। পরে ঢাকাতেই এক মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করেন তিনি। এর মধ্যে বাবা-মায়ের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না তার। তবে গত বছর ঢাকায় পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে মোবাইল নম্বর জোগার করে মায়ের সঙ্গে কথা বলেন রুবেল।
রুবেল বলেন, ‘মায়ের সঙ্গে কথা হলে সে গ্রামে ফিরতে নিষেধ করে। সে নাকি আমাকে অপহরণের মামলা করছে। আমি গ্রামে ফিরলে ঝামেলা হবে। ভয়ে আমি গ্রামে আসি নাই। গত বুধবার কাউরে কিছু না কইয়া গ্রামে আসছিলাম। মায়ের সঙ্গেও দেখা হইছে। পরে লোকজন আমারে চিনতে পাইরা থানায় নিয়া আসে।’
এদিকে রুবেলকে অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে আড়াই মাস কারাভোগ করতে হয়েছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা জুলহাস উদ্দিন আহম্মেদকে। তিনি বলেন, রুবেলকে তিনি চিনতেন না। এই প্রথম তাকে দেখেছেন। অথচ তাকে অপহরণের দায়ে কারাভোগ করা বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘মামলার কয়েক মাস পর র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হই। আমার মতো আরও কয়েকজন জেল খাটছে। এই হয়রানির বিচার চাই।’
ওই মামলায় কারাভোগ করতে হয়নি বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামকে। তবে গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় নিয়ে পালিয়ে বেরিয়েছেন দীর্ঘদিন। নুরুল ইসলাম বলেন, ‘মামলার পর থেইকা পলায়ে পলায়ে ছিলাম। কয়েকজনরে ধরছিলও। আইজ দেখি পোলায় ফিইরা আসছে।’ নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি শাহ্ জামান বলেন, ১৪ বছর পর ফিরে আসা যুবক রুবেলকে থানায় আনা হলে মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা এবং ভুক্তভোগীর কাছে ঘটনার বিবরণ জানতে চাওয়া হয়। পরে পরিবারের লোকজন ও মামলার বাদী ভুক্তভোগীকে শনাক্ত করলে গত শুক্রবার তাকে আদালতে পাঠানো হয়।
তিনি বলেন, মিথ্যা মামলা করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে চাইলে ওই মামলায় হয়রানির শিকার ব্যক্তিরা পাল্টা মামলা করতে পারেন।