ফারাক্কা বাঁধ : জলপ্রবাহের চাপ প্রয়োগ জরুরি

মনজুরুল হক

গত ১৬ মে তারিখে পার হয়ে গেল ৪৫তম ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস। এইদিনটি আসলেই কেবল বাংলাদেশের উপরতলার মানুষজনের মনে পড়ে ফারাক্কা বাঁধ আর তার কৃতকর্মের কথা। তখন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর স্মৃতিতর্পণ আরম্ভ হয়। ৪৫ বছর আগে ১৯৭৬ সালের এই দিনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ শুরু করেন। ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব ও এর বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে লংমার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট হাইস্কুল মাঠে শেষ হয়। সে সময় ওই অঞ্চলের জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে লংমার্চকে সমর্থন করে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। তখন মওলানা ভাসানীর পক্ষেও বলা সম্ভব হয়নি; এই বাঁধ কয়েক দশক পরই এদেশের জন্য কী ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। তিনি শুধু সতর্ক করে বলেছিলেন- ‘আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ঐতিহাসিক লংমার্চ শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’

ইতোমধ্যে পাকিস্তান ভেঙে ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হলো। স্বাধীনতা যুদ্ধে আগাগোড়াই ভারত পূর্ণ সমর্থন করেছিল। সেই কৃতজ্ঞতায় সে সময় তারা বাঁধ চালু করেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর গঙ্গার জল বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন। এই সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত হয় যে, উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না। যদিও বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে দশ (২১ এপ্রিল ১৯৭৫ থেকে ২১ মে ১৯৭৫) দিনের জন্য ভারতকে গঙ্গা হতে ৩১০-৪৫০ কিউসেক পানি অপসারণ করার অনুমতি দেয়। কিন্তু ভারত ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত গঙ্গা নদী হতে ১১৩০ কিউসেক পানি অপসারণ করে পশ্চিমবঙ্গের ভাগরথি-হুগলি নদীতে প্রবাহিত করে।

১৯৭৫ সালে বাঁধ চালুর পর দেখা গেল ভারতের আশ্বাস ফাঁপাবুলিসর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌপরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়; যদি পরোক্ষ হিসাব করা হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। ভাটিতে বাংলাদেশের যে ক্ষতি শুরু হয় তা সেই ১৯৭৫ সালেও ধারণা করা যায়নি। আজ ৪৫ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে এই একটি বাঁধের মাধ্যমে একতরফা জলপ্রবাহ প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং প্রতি বছরই সেই ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে চলেছে।

পদ্মা নদী দিয়ে পলিপ্রবাহ প্রায় ২০% কমে গেছে। কার্বন প্রবাহ কমেছে ৩০%। পলিপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে ভাটির পুরো অঞ্চলে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থল আরিচাঘাটে সমীক্ষা থেকে যে ফিশ ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়েছে তাতে দেখা যায় ৪৫ বছর আগের তুলনায় বর্তমান মৎস্য উৎপাদন মাত্র ২২%। ইলিশ মাছ এখানে পাওয়া যায় না। বৎসরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই মাছ নোনা পানি থেকে মিঠা পানিতে আসে ডিম পাড়ার জন্য। উজানে এদের আগমন বাঁধ কিম্বা ওই ধরনের বাধার পরিপ্রেক্ষিতে মিঠাপানির অভাবে মাছ আর উজিয়ে আসে না। ফারাক্কা চালুর আগে এক সময় রাজশাহী পদ্মা অবধি ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। এখন আরিচাতেই এ মাছ পাওয়া যায় না। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুধারী তলোয়ারের মতো কাজ করছে। একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূল অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের সমতল ভূমির ক্রমান্বয়ে দেবে যাওয়া যাকে বলা হয় সাবসিডেন্স। উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ কমে গেলে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীগুলোতে সমুদ্রের জোয়ারের পানি উঠে আসে। যে জোয়ারের পানি এক সময় সমুদ্র থেকে বড়জোর ২০/২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত আসত, সেই জোয়ার এখন ৪০/৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে আসে, এবং পুনরায় ভাটির আগে থিতু হওয়ায় পানি তার সবটুকু পলি নদীতে রেখে যায়। এই প্রক্রিয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের সব নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এমনকি দেড়শ কিলোমিটার উজানের গড়াই নদীও পলি পড়ে নাব্যতা হারিয়েছে।

পদ্মা থেকে জন্ম নেয়া শত শত নদ-নদী এবং খাল ভরাট হতে হতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অনেক জায়গায় নদীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই! ফারাক্কার কারণে নদী বাহিত পলির গ্রেইন সাইজ স্পেকট্রাল প্যার্টান অর্থাৎ পলি কতার সাইজ-এর তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের মাটির ভৌত কাঠামোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

পদ্মার পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর অববাহিকায় বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভূগর্ভস্থ পানির প্রথম স্তর ২০-৩০ ফুট জায়গা বিশেষে ৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। মৌসুমি বৃষ্টি ও এই স্তরের সারফেস রিচার্য করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। পানির অভাবে মাটির আদ্রতা শুষ্ক মৌসুমে ৪৫% কমে গেছে। পানি প্রবাহের এমন করুণ অবস্থা থেকে সৃষ্ট হয় মরুকরণ প্রক্রিয়া। নদীর পানি থেকে জলীয় বাষ্প সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বায়ুর আদ্রতা সৃষ্টিতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। খরার সময় পদ্মা নিজেই যখন বিশুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয় সে তখন স্থলভূমির বায়ুতে আদ্রতার জোগান দিতে পারে না।

ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের মাটির লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। মিঠা পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে লবণ, ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিতে প্রবেশ করতে পারে না।

কৃষির অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। পানির স্তর অনেক নেমে যাওয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের গড়াইকেন্দ্রিক জিকে সেচ প্রকল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেচযন্ত্রগুলো হয়ত বন্ধ হয়ে আছে অথবা সেগুলোর ওপর তার ক্ষমতার চাইতে বেশি চাপ পড়ছে।

শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ৩২০ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ নৌ-চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এর ফলে কয়েক হাজার লোক বেকার হয়ে পড়ে, নৌ-পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়। এই নৌপথ এখন বর্ষা মৌসুমের পুরোপুরি চলাচলের উপযোগী থাকে না। সে কারণে ভরা বর্ষায়ও আরিচা-পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া বা মাও-মিমুলবাড়িয়া ঘাটে সারা বছরই নাব্যতা রাখতে ড্রেজিং চালু রাখতে হয় এবং কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়।

ভূ-অভ্যন্তরে পানির স্তর কমে গিয়ে গোটা উত্তরাঞ্চলে মরুভূমিকরণের স্পষ্ট আলামত দেখা যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন ফসলি জমিতে আগে জমির কোণে ৫/৬ ফুট ছোট ছোট গর্ত করলেই পানি উঠে আসত। সেই পানি দিয়ে বাঁশকলের মাধ্যমে সেচের কাজ চলত। এখন চলে না। এখন ২০/৩০ ফুট মাটির তলা থেকেও পানি পাওয়া যায় না।

ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে পানি অপসারণ নিয়ে বিভিন্ন সরকার দূতিয়ালি করেছে। কিন্তু পানি অপসারণে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে, বাংলাদেশ এই বিষয়টি জাতিসংঘে উপস্থাপন করে। “২৬ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়টির সুরাহার করার নির্দেশ দিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। কয়েকবার বৈঠকের পর উভয় দেশ ৫ নভেম্বর ১৯৭৭ সালে একটি চুক্তি করে। চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারত পরবর্তী পাঁচ বছরের (১৯৭৮-৮২) জন্য শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি ভাগ করে নেবে। ১৯৮২ এর অক্টোবরে উভয় দেশ ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে পানি বণ্টনের একটি চুক্তি করে। নভেম্বর ১৯৮৫ সালে আরও তিন (১৯৮৬-৮৮) বছরের জন্য পানি বণ্টনের চুক্তি হয়। কিন্তু একটি দীর্ঘ চুক্তির অভাবে বাংলাদেশ তার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য গঙ্গার পানি ব্যবহারে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এর পেছনে আরও অনেক জিও-পলিটিক্যাল কারণও নিহীত। সেসবও স্থায়ী চুক্তি না হওয়া এবং চুক্তির বরখেলাফ করলে ভারতকে দায়ী করার সুযোগ থাকেনি। কোনো চুক্তি না থাকায় ১৯৮৯ সালের শুষ্ক মৌসুম থেকে ভারত একতরফা প্রচুর পরিমাণ পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নেয়, ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশর নদ-নদীতে পানি প্রবাহের চরম অবনতি ঘটে। ১৯৯৩ সালের মার্চে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অঞ্চলে মাত্র ২৬১ কিউসেক পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়, যেখানে ফারাক্কা-পূর্ব সময়ে একই অঞ্চলে ১৯৮০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো। ১৯৯৩ সালের মে মাসে যখন উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীরা আবার মিলিত হন, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশেকে দেয়া তার কথা রাখতে ব্যর্থ হন। অবশেষে, ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সই করেন (ইন্টারনেট)।”

এখন ভারত বলছে; তারা চুক্তি মোতাবেক পানি দিচ্ছে। আর বাংলাদেশ দেখছে ক্রমান্বয়ে তাদের একটার পর একটা নদী জলহীন হয়ে ধু ধু বালুচর হয়ে পড়ছে। আমরা রাজনীতিক নই, তাই প্রোটোকল কী, কে সেটা ভাঙল, কীভাবে এর সমাধান আমরা জানি কিন্তু বলতে পারি না। সরকারে ডজন ডজন টগবগ করে ফুটতে থাকা ঘিলুভর্তি মাথা আছে ‘নীতিনির্ধারক’ নামে। তারা ভাবুন। আজকে নদী মরছে। ভূমি জলহীন হচ্ছে। সবুজ জমি মরুভূমি হচ্ছে। নৌপথ বন্ধ হয়ে আশেপাশের বৃক্ষরাজি মরছে। কালকে সুন্দরবনও মরবে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

শনিবার, ২২ মে ২০২১ , ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৯ শাওয়াল ১৪৪২

ফারাক্কা বাঁধ : জলপ্রবাহের চাপ প্রয়োগ জরুরি

মনজুরুল হক

গত ১৬ মে তারিখে পার হয়ে গেল ৪৫তম ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস। এইদিনটি আসলেই কেবল বাংলাদেশের উপরতলার মানুষজনের মনে পড়ে ফারাক্কা বাঁধ আর তার কৃতকর্মের কথা। তখন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর স্মৃতিতর্পণ আরম্ভ হয়। ৪৫ বছর আগে ১৯৭৬ সালের এই দিনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ শুরু করেন। ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব ও এর বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে লংমার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট হাইস্কুল মাঠে শেষ হয়। সে সময় ওই অঞ্চলের জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে লংমার্চকে সমর্থন করে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। তখন মওলানা ভাসানীর পক্ষেও বলা সম্ভব হয়নি; এই বাঁধ কয়েক দশক পরই এদেশের জন্য কী ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। তিনি শুধু সতর্ক করে বলেছিলেন- ‘আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ঐতিহাসিক লংমার্চ শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’

ইতোমধ্যে পাকিস্তান ভেঙে ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হলো। স্বাধীনতা যুদ্ধে আগাগোড়াই ভারত পূর্ণ সমর্থন করেছিল। সেই কৃতজ্ঞতায় সে সময় তারা বাঁধ চালু করেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর গঙ্গার জল বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন। এই সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত হয় যে, উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না। যদিও বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে দশ (২১ এপ্রিল ১৯৭৫ থেকে ২১ মে ১৯৭৫) দিনের জন্য ভারতকে গঙ্গা হতে ৩১০-৪৫০ কিউসেক পানি অপসারণ করার অনুমতি দেয়। কিন্তু ভারত ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত গঙ্গা নদী হতে ১১৩০ কিউসেক পানি অপসারণ করে পশ্চিমবঙ্গের ভাগরথি-হুগলি নদীতে প্রবাহিত করে।

১৯৭৫ সালে বাঁধ চালুর পর দেখা গেল ভারতের আশ্বাস ফাঁপাবুলিসর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌপরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়; যদি পরোক্ষ হিসাব করা হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। ভাটিতে বাংলাদেশের যে ক্ষতি শুরু হয় তা সেই ১৯৭৫ সালেও ধারণা করা যায়নি। আজ ৪৫ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে এই একটি বাঁধের মাধ্যমে একতরফা জলপ্রবাহ প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং প্রতি বছরই সেই ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে চলেছে।

পদ্মা নদী দিয়ে পলিপ্রবাহ প্রায় ২০% কমে গেছে। কার্বন প্রবাহ কমেছে ৩০%। পলিপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে ভাটির পুরো অঞ্চলে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থল আরিচাঘাটে সমীক্ষা থেকে যে ফিশ ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়েছে তাতে দেখা যায় ৪৫ বছর আগের তুলনায় বর্তমান মৎস্য উৎপাদন মাত্র ২২%। ইলিশ মাছ এখানে পাওয়া যায় না। বৎসরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই মাছ নোনা পানি থেকে মিঠা পানিতে আসে ডিম পাড়ার জন্য। উজানে এদের আগমন বাঁধ কিম্বা ওই ধরনের বাধার পরিপ্রেক্ষিতে মিঠাপানির অভাবে মাছ আর উজিয়ে আসে না। ফারাক্কা চালুর আগে এক সময় রাজশাহী পদ্মা অবধি ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। এখন আরিচাতেই এ মাছ পাওয়া যায় না। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুধারী তলোয়ারের মতো কাজ করছে। একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূল অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের সমতল ভূমির ক্রমান্বয়ে দেবে যাওয়া যাকে বলা হয় সাবসিডেন্স। উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ কমে গেলে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীগুলোতে সমুদ্রের জোয়ারের পানি উঠে আসে। যে জোয়ারের পানি এক সময় সমুদ্র থেকে বড়জোর ২০/২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত আসত, সেই জোয়ার এখন ৪০/৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে আসে, এবং পুনরায় ভাটির আগে থিতু হওয়ায় পানি তার সবটুকু পলি নদীতে রেখে যায়। এই প্রক্রিয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের সব নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এমনকি দেড়শ কিলোমিটার উজানের গড়াই নদীও পলি পড়ে নাব্যতা হারিয়েছে।

পদ্মা থেকে জন্ম নেয়া শত শত নদ-নদী এবং খাল ভরাট হতে হতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অনেক জায়গায় নদীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই! ফারাক্কার কারণে নদী বাহিত পলির গ্রেইন সাইজ স্পেকট্রাল প্যার্টান অর্থাৎ পলি কতার সাইজ-এর তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের মাটির ভৌত কাঠামোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

পদ্মার পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর অববাহিকায় বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভূগর্ভস্থ পানির প্রথম স্তর ২০-৩০ ফুট জায়গা বিশেষে ৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। মৌসুমি বৃষ্টি ও এই স্তরের সারফেস রিচার্য করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। পানির অভাবে মাটির আদ্রতা শুষ্ক মৌসুমে ৪৫% কমে গেছে। পানি প্রবাহের এমন করুণ অবস্থা থেকে সৃষ্ট হয় মরুকরণ প্রক্রিয়া। নদীর পানি থেকে জলীয় বাষ্প সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বায়ুর আদ্রতা সৃষ্টিতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। খরার সময় পদ্মা নিজেই যখন বিশুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয় সে তখন স্থলভূমির বায়ুতে আদ্রতার জোগান দিতে পারে না।

ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের মাটির লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। মিঠা পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে লবণ, ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিতে প্রবেশ করতে পারে না।

কৃষির অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। পানির স্তর অনেক নেমে যাওয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের গড়াইকেন্দ্রিক জিকে সেচ প্রকল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেচযন্ত্রগুলো হয়ত বন্ধ হয়ে আছে অথবা সেগুলোর ওপর তার ক্ষমতার চাইতে বেশি চাপ পড়ছে।

শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ৩২০ কিলোমিটারের বেশি নৌপথ নৌ-চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এর ফলে কয়েক হাজার লোক বেকার হয়ে পড়ে, নৌ-পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়। এই নৌপথ এখন বর্ষা মৌসুমের পুরোপুরি চলাচলের উপযোগী থাকে না। সে কারণে ভরা বর্ষায়ও আরিচা-পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া বা মাও-মিমুলবাড়িয়া ঘাটে সারা বছরই নাব্যতা রাখতে ড্রেজিং চালু রাখতে হয় এবং কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়।

ভূ-অভ্যন্তরে পানির স্তর কমে গিয়ে গোটা উত্তরাঞ্চলে মরুভূমিকরণের স্পষ্ট আলামত দেখা যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন ফসলি জমিতে আগে জমির কোণে ৫/৬ ফুট ছোট ছোট গর্ত করলেই পানি উঠে আসত। সেই পানি দিয়ে বাঁশকলের মাধ্যমে সেচের কাজ চলত। এখন চলে না। এখন ২০/৩০ ফুট মাটির তলা থেকেও পানি পাওয়া যায় না।

ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে পানি অপসারণ নিয়ে বিভিন্ন সরকার দূতিয়ালি করেছে। কিন্তু পানি অপসারণে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে, বাংলাদেশ এই বিষয়টি জাতিসংঘে উপস্থাপন করে। “২৬ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়টির সুরাহার করার নির্দেশ দিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। কয়েকবার বৈঠকের পর উভয় দেশ ৫ নভেম্বর ১৯৭৭ সালে একটি চুক্তি করে। চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারত পরবর্তী পাঁচ বছরের (১৯৭৮-৮২) জন্য শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি ভাগ করে নেবে। ১৯৮২ এর অক্টোবরে উভয় দেশ ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে পানি বণ্টনের একটি চুক্তি করে। নভেম্বর ১৯৮৫ সালে আরও তিন (১৯৮৬-৮৮) বছরের জন্য পানি বণ্টনের চুক্তি হয়। কিন্তু একটি দীর্ঘ চুক্তির অভাবে বাংলাদেশ তার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য গঙ্গার পানি ব্যবহারে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এর পেছনে আরও অনেক জিও-পলিটিক্যাল কারণও নিহীত। সেসবও স্থায়ী চুক্তি না হওয়া এবং চুক্তির বরখেলাফ করলে ভারতকে দায়ী করার সুযোগ থাকেনি। কোনো চুক্তি না থাকায় ১৯৮৯ সালের শুষ্ক মৌসুম থেকে ভারত একতরফা প্রচুর পরিমাণ পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নেয়, ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশর নদ-নদীতে পানি প্রবাহের চরম অবনতি ঘটে। ১৯৯৩ সালের মার্চে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অঞ্চলে মাত্র ২৬১ কিউসেক পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়, যেখানে ফারাক্কা-পূর্ব সময়ে একই অঞ্চলে ১৯৮০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো। ১৯৯৩ সালের মে মাসে যখন উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীরা আবার মিলিত হন, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশেকে দেয়া তার কথা রাখতে ব্যর্থ হন। অবশেষে, ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সই করেন (ইন্টারনেট)।”

এখন ভারত বলছে; তারা চুক্তি মোতাবেক পানি দিচ্ছে। আর বাংলাদেশ দেখছে ক্রমান্বয়ে তাদের একটার পর একটা নদী জলহীন হয়ে ধু ধু বালুচর হয়ে পড়ছে। আমরা রাজনীতিক নই, তাই প্রোটোকল কী, কে সেটা ভাঙল, কীভাবে এর সমাধান আমরা জানি কিন্তু বলতে পারি না। সরকারে ডজন ডজন টগবগ করে ফুটতে থাকা ঘিলুভর্তি মাথা আছে ‘নীতিনির্ধারক’ নামে। তারা ভাবুন। আজকে নদী মরছে। ভূমি জলহীন হচ্ছে। সবুজ জমি মরুভূমি হচ্ছে। নৌপথ বন্ধ হয়ে আশেপাশের বৃক্ষরাজি মরছে। কালকে সুন্দরবনও মরবে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]