কৃষকের হাসি : লবণ সহিষ্ণু ব্রিধান-৬৭

আবদুর রহমান

রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামের আদর্শ কৃষক যুধিষ্টির পাল ব্রিধান-৬৭ জাতের ধান চাষ করে বাম্পার ফলন পেয়েছেন। তিনি এ বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রূপসা, খুলনা এর সহায়তায় জিকেবিএসপি কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পঞ্চাশ শতক জমিতে ব্রিধান-৬৭ জাতের একটি বোরো ধানের প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করেন। এ প্রদর্শনীর নমুনা কর্তন করে হেক্টর প্রতি ১০ মেট্রিক টন ধানের ফলন পাওয়া গেছে। এতে বিঘা প্রতি ফলন হয়েছে প্রায় ৩৭ মণ। ধানের এ বাম্পার ফলন পেয়ে কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসির ঝিলিক।

যুধিষ্টির পাল জানান, বীজতলায় বীজবপণ ও চারা রোপণের পর ১৪৪ দিনের মধ্যে তিনি এ ধান কর্তন করে বিঘাপ্রতি ৩৭ মণ ফলন পেয়েছেন। অধিক ফলন হওয়ায় এলাকার অন্যান্য কৃষকদের মাঝেও এ জাতের ধান চাষে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে এ গ্রামের অনেক কৃষক তার নিকট বীজের জন্য এ ধান ক্রয় করতে চেয়েছেন। তিনি এধান বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করে তা আগ্রহী কৃষকদের মাঝে বিক্রি করবেন। যাতে আগামীতে পিঠাভোগ গ্রামে ব্রিধান-৬৭ ধানের ব্যাপক চাষ হয়। কৃষক যুধিষ্টির পাল আরও বলেন, এ উপজেলার ঘাটভোগ ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রামপ্রসাদ বালা সার্বক্ষণিক পাশে থেকে এ ধান চাষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।

একই গ্রামের সুজন পাল, নুর ইসলাম ভূঁইয়া, আজমল খাঁ, বাবুল রায়, শংকর রায় ও কানাই ম-লসহ বেশ কয়েকজন কৃষক এ বছর ব্রিধান-৬৭ জাতের ভালো ফলন দেখে খুব খুশি। কৃষকরা জানান, এ জাতের ধানের ফলন অনেক ভালো এবং পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ অনেক কম। বিশেষ করে ক্ষতিকর ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হয় না।

রূপসা উপজেলার কৃষি অফিসার মো. ফরিদুজ্জামান বলেন, এ বছর এ উপজেলায় মোট ১৭৩ হেক্টর জমিতে ব্রিধান-৬৭ জাতের ধান চাষ হয়েছে। এ জাতটি লবণ সহনশীল এবং অধিক ফলন দেয়। এটি জনপ্রিয় ব্রিধান-২৮ জাতের মতো। ব্রিধান-২৮ দীর্ঘদিন ধরে চাষ হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। তাছাড়া এজাতটিতে পোকামাকড় ও রোগবারাইয়ের আক্রমণ বেশি হয়। সেজন্য ব্রিধান-৬৭ জাতের ধান চাষ ও বীজ উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহী করতে এ উপজেলায় জিকেবিএসপি কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১৫টি প্রদর্শনী বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি আরও জানান, এসব প্রদর্শনীর ব্রিধান-৬৭ জাতের নমুনা শস্য কর্তন করে অনেক ভালো ফলন পাওয়া গেছে। এসব প্রদর্শনীতে উৎপাদিত ধান বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হবে, যা কৃষক পর্যায়ে সম্প্র্রসারণ করা হবে। চাষিরাও ব্রিধান-৬৭ জাতটি চাষে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাই আগামীতে এ ধানের চাষ আরও বাড়বে বলে তিনি আশা করেন।

ব্রিধান-৬৭ লবণ সহিষ্ণু একটি জনপ্রিয় উচ্চফলনশীল জাতের বোরো ধান। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলোÑ চারা অবস্থায় ১২-১৪ ডি এস/মিটার (৩ সপ্তাহ পর্যন্ত) লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তাছাড়া এ জাতটি অংগজ বৃদ্ধি থেকে প্রজনন পর্যায় পর্যন্ত লবণাক্ততা সংবেদনশীল সকল ধাপে (Salt sensitive stage) ৮ ডিএস/মিটার মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করে ফলন দিতে সক্ষম, যা প্রচলিত উচ্চ ফলনশীল জাত ব্রিধান-২৮ পারে না। এ জাতটি ব্রিধান-৪৭ এর মতো লবণ সহ্য করতে পারে। শিষ থেকে ধান সহজে ঝরে পড়ে না। পূর্ণ বয়স্ক ধানগাছ ১০০ সেমি. পর্যন্ত লম্বা হয়। ডিগ পাতা প্রচলিত ব্রিধান-২৮ এর চেয়ে খাড়া থাকে। এর জীবনকাল ১৪০-১৫০ দিন। এ জাতের ধানে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ অনেক কম। বিশেষ করে ক্ষতিকর ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হয় না। লবণাক্ততার মাত্রা ভেদে হেক্টর প্রতি ৭.৪ টন পর্যন্ত ফলন দিতে পারে, যা ব্রিধান-২৮ এর থেকে ১.৫ টন/হে. বেশি। এ ধানের চাল মাঝারি চিকন ও সাদা এবং ভাত ঝরঝরে।

ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য। দেশে জনসংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, অন্যদিকে নানা কারণে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ক্যালরির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই আসে ভাত থেকে। এ দেশের মাটি ও আবহাওয়া ধান চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। করোনাকালে বাংলাদেশের মানুষের ভাত খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। তাই করোনা-পরবর্তী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে লবণাক্ত সহিষ্ণু ও অধিক ফলনশীল ব্রিধান-৬৭সহ এ জাতীয় ধান চাষের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া একান্ত প্রয়োজন। এতে দেশের ধানের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে এবং খাদ্য নিরাপত্তায় আশানুরূপ ভূমিকা রাখবে।

[লেখক : উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, রূপসা, খুলনা]

শনিবার, ২২ মে ২০২১ , ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ৯ শাওয়াল ১৪৪২

কৃষকের হাসি : লবণ সহিষ্ণু ব্রিধান-৬৭

আবদুর রহমান

রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামের আদর্শ কৃষক যুধিষ্টির পাল ব্রিধান-৬৭ জাতের ধান চাষ করে বাম্পার ফলন পেয়েছেন। তিনি এ বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রূপসা, খুলনা এর সহায়তায় জিকেবিএসপি কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পঞ্চাশ শতক জমিতে ব্রিধান-৬৭ জাতের একটি বোরো ধানের প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করেন। এ প্রদর্শনীর নমুনা কর্তন করে হেক্টর প্রতি ১০ মেট্রিক টন ধানের ফলন পাওয়া গেছে। এতে বিঘা প্রতি ফলন হয়েছে প্রায় ৩৭ মণ। ধানের এ বাম্পার ফলন পেয়ে কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসির ঝিলিক।

যুধিষ্টির পাল জানান, বীজতলায় বীজবপণ ও চারা রোপণের পর ১৪৪ দিনের মধ্যে তিনি এ ধান কর্তন করে বিঘাপ্রতি ৩৭ মণ ফলন পেয়েছেন। অধিক ফলন হওয়ায় এলাকার অন্যান্য কৃষকদের মাঝেও এ জাতের ধান চাষে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে এ গ্রামের অনেক কৃষক তার নিকট বীজের জন্য এ ধান ক্রয় করতে চেয়েছেন। তিনি এধান বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করে তা আগ্রহী কৃষকদের মাঝে বিক্রি করবেন। যাতে আগামীতে পিঠাভোগ গ্রামে ব্রিধান-৬৭ ধানের ব্যাপক চাষ হয়। কৃষক যুধিষ্টির পাল আরও বলেন, এ উপজেলার ঘাটভোগ ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রামপ্রসাদ বালা সার্বক্ষণিক পাশে থেকে এ ধান চাষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।

একই গ্রামের সুজন পাল, নুর ইসলাম ভূঁইয়া, আজমল খাঁ, বাবুল রায়, শংকর রায় ও কানাই ম-লসহ বেশ কয়েকজন কৃষক এ বছর ব্রিধান-৬৭ জাতের ভালো ফলন দেখে খুব খুশি। কৃষকরা জানান, এ জাতের ধানের ফলন অনেক ভালো এবং পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ অনেক কম। বিশেষ করে ক্ষতিকর ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হয় না।

রূপসা উপজেলার কৃষি অফিসার মো. ফরিদুজ্জামান বলেন, এ বছর এ উপজেলায় মোট ১৭৩ হেক্টর জমিতে ব্রিধান-৬৭ জাতের ধান চাষ হয়েছে। এ জাতটি লবণ সহনশীল এবং অধিক ফলন দেয়। এটি জনপ্রিয় ব্রিধান-২৮ জাতের মতো। ব্রিধান-২৮ দীর্ঘদিন ধরে চাষ হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। তাছাড়া এজাতটিতে পোকামাকড় ও রোগবারাইয়ের আক্রমণ বেশি হয়। সেজন্য ব্রিধান-৬৭ জাতের ধান চাষ ও বীজ উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহী করতে এ উপজেলায় জিকেবিএসপি কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১৫টি প্রদর্শনী বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি আরও জানান, এসব প্রদর্শনীর ব্রিধান-৬৭ জাতের নমুনা শস্য কর্তন করে অনেক ভালো ফলন পাওয়া গেছে। এসব প্রদর্শনীতে উৎপাদিত ধান বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হবে, যা কৃষক পর্যায়ে সম্প্র্রসারণ করা হবে। চাষিরাও ব্রিধান-৬৭ জাতটি চাষে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাই আগামীতে এ ধানের চাষ আরও বাড়বে বলে তিনি আশা করেন।

ব্রিধান-৬৭ লবণ সহিষ্ণু একটি জনপ্রিয় উচ্চফলনশীল জাতের বোরো ধান। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলোÑ চারা অবস্থায় ১২-১৪ ডি এস/মিটার (৩ সপ্তাহ পর্যন্ত) লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তাছাড়া এ জাতটি অংগজ বৃদ্ধি থেকে প্রজনন পর্যায় পর্যন্ত লবণাক্ততা সংবেদনশীল সকল ধাপে (Salt sensitive stage) ৮ ডিএস/মিটার মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করে ফলন দিতে সক্ষম, যা প্রচলিত উচ্চ ফলনশীল জাত ব্রিধান-২৮ পারে না। এ জাতটি ব্রিধান-৪৭ এর মতো লবণ সহ্য করতে পারে। শিষ থেকে ধান সহজে ঝরে পড়ে না। পূর্ণ বয়স্ক ধানগাছ ১০০ সেমি. পর্যন্ত লম্বা হয়। ডিগ পাতা প্রচলিত ব্রিধান-২৮ এর চেয়ে খাড়া থাকে। এর জীবনকাল ১৪০-১৫০ দিন। এ জাতের ধানে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ অনেক কম। বিশেষ করে ক্ষতিকর ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হয় না। লবণাক্ততার মাত্রা ভেদে হেক্টর প্রতি ৭.৪ টন পর্যন্ত ফলন দিতে পারে, যা ব্রিধান-২৮ এর থেকে ১.৫ টন/হে. বেশি। এ ধানের চাল মাঝারি চিকন ও সাদা এবং ভাত ঝরঝরে।

ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য। দেশে জনসংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, অন্যদিকে নানা কারণে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে। আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ক্যালরির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই আসে ভাত থেকে। এ দেশের মাটি ও আবহাওয়া ধান চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। করোনাকালে বাংলাদেশের মানুষের ভাত খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। তাই করোনা-পরবর্তী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে লবণাক্ত সহিষ্ণু ও অধিক ফলনশীল ব্রিধান-৬৭সহ এ জাতীয় ধান চাষের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া একান্ত প্রয়োজন। এতে দেশের ধানের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে এবং খাদ্য নিরাপত্তায় আশানুরূপ ভূমিকা রাখবে।

[লেখক : উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, রূপসা, খুলনা]