অর্ধশত পাচারকারী চিহ্নিত

৫ জনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড এলার্ট

আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্র আশি হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা মাসিক বেতনের লোভ দেখিয়ে সমুদ্র পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠাচ্ছে। সর্বশেষ গত সোমবার ইউরোপে যাওয়ার সময় ভূ-মধ্যসাগরে নৌকা ডুবে অর্ধশতাধিক অভিবাসী নিখোঁজ হয়েছেন। সাগর থেকে ভাসমান অবস্থায় ৩৩ বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।

এর আগেও বিভিন্ন সময় কাজের সন্ধানে বেআইনিভাবে সমুদ্র পথে বিদেশ যাওয়ার সময় নৌকা ডুবে ও পাচারকারী চক্রের নির্যাতনে বেশ কিছু বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করেছেন।

সিআইডির মানব পাচার প্রতিরোধ সেলের কর্মকর্তারা তদন্ত করে ইতোমধ্যে মানব পাচারকারী চক্রের প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে। তাদের মধ্যে ৫ জনের বিরুদ্ধে জারি করা হচ্ছে রেড নোটিশ। মানবপাচারকারী এই চক্রকে আইনের আওতায় আনার জন্য স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট মন্ত্রণালয় এবং ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

পাচারকারীদের কবল থেকে ফিরে একাধিক ভুক্তভোগী পুলিশের কাছে তাদের পাচার হওয়ার কাহিনী এবং লিবিয়ায় বন্দী অবস্থায় নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তেমনি এক ভুক্তভোগী হলেন ভৈরবের জানু মিয়া।

মানব পাচারকারী মাফিয়াদের লোভনীয় চাকরির প্ররোচনায় লিবিয়া গিয়ে চরম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনর ভোগ করে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ফিরে আসেন ভৈরবের জানু মিয়া। দেশে ফিরে জানু মিয়া পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়ে লিবিয়ায় তার ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।

জানু মিয়া জানায়, তার পরিচিত মানব পাচারকারীদের দালাল সোহাগ তাকে ভালো বেতনে লিবিয়ায় চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখায়। পরে সোহাগের সঙ্গে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে লিবিয়া যাওয়ার চুক্তি করে। এরপর দালাল সোহাগ ও তার সহযোগীরা তাকে প্রথমে ভারতে পাঠায়। এরপর দুবাই থেকে মিশর ও মিশর থেকে লিবিয়ার বেনগাজীতে পাঠায়। বেনগাজীতে লিবিয়ার দালালরা তাকে রিসিভ করে। লিবিয়ার গুয়ার নামক জায়গার একটি ক্যাম্পে নিয়ে যায় তাকেসহ কয়েকজনের দলকে। ওই ক্যাম্পে ১৬ দিন থাকার পর আরেক দালালের বাসায় নেয়া হয় তাদের। ওই দালালের বাসায় এক সপ্তাহ থাকার পর তাদের কাজ দেয়। কিন্তু যে বেতন দেয়ার কথা ছিল তার থেকে অনেক কম বেতন দেয়া হয়। চুক্তি ছিল ২৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন দেয়া হবে। কিন্তু বেতন দেয় ১৫ হাজার টাকা। কোন উপায় না থাকায় তাতেই রাজি হয়ে কাজ শুরু করে তারা। পরে তারা আরেক দালাল তানজিরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ত্রিপোলিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। দালাল তানজিরুল ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে ত্রিপোলিতে নিয়ে যাবে বলে জানায়। এরপর ২০২০ সালের ১৫ মে সকালে ২টি মাইক্রোবাসযোগে জানুসহ ২০ জন ত্রিপোলির উদ্দেশে রওনা হয়। পথে একদল লোক রাস্তার মাঝখানে তাদের গাড়ি আটকায়। তাদের ২৯ জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নামিয়ে তাদের আস্তানায় নিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় তাদের দুর্ভোগের জীবন। সে মাফিয়া দালাল গ্রুপটি তাদের অন্য একটি গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। নতুন এই গ্রুপ তাদের নিয়ে একটি আস্তানায় আটকে রাখে সবাইকে। ওই আস্তানার দালালদের অত্যাচারে মারা যাওয়া একটি লাশ আস্তানার পাশেই পড়েছিল। মানব পাচারকারীরা লাশ দেখিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে জনপ্রতি ১২ হাজার মার্কিন ডলার দাবি করে। এরপর পাচারকারী চক্র লোহার রড, প্লস্টিকের পাইপ দিয়ে তাদের এলোপাতাড়ি পিটায় এবং ইলেকট্রিক শক দেয়। এভাবে তাদের নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের সদস্যদের শুনিয়ে তাদের কাছে টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে হত্যা করা হবে বলে জানায়। এক পর্যায়ে গুরুতর অবস্থায় দালাল ও মানব পাচারকারী চক্রের আস্তানা থেকে ২০২০ সালের সেপ্টম্বর মাসে দেশে ফিরে জানু মিয়া আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে সব ঘটনা প্রকাশ করে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, সিআইডির প্রধান কার্যালয় থেকে জানা গেছে, তিউনেশিয়ার উপকূলে নৌকা ডুবে যাওয়ার ঘটনায় জীবিত উদ্ধার করা ৩৩ জনের পরিচয় ও তাদের ঠিকানা ও কার মাধ্যমে তারা বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করেছে তা জানার জন্য গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) সঙ্গে যোগযোগ করা হয়েছে। এরপর সেখানে উদ্ধার হওয়া লোকদের সঙ্গে কথা বলে মানবপাচারকারী এই চক্রকে চিহ্নিত ও আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তবে এখন পর্যন্ত মানব পাচারকারী চক্রের যাদের চিহ্নিত করা গেছে সিআইডির একাধিক সূত্র জানায়, তাদের একাধিক সদস্যের বাড়ি সিলেটে। সিলেটের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার এলাকার বাসিন্দা তারা। তাদের মূল হোতা সিলেটের পারভেজ। তার বাবার নাম রফিকুল। তাদের একাধিক সদস্য ইতালি, দুবাই ও লিবিয়ায় থাকে।

সিআইডির তালিকায় মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের মধ্যে সিলেটের পারভেজ, ভৈরবের তানজিল, জাফর, মিন্টু, মাদারীপুরের আমির শেখ, নোয়াখালীর রিপন, রুবেল, নাসির মির্জা ও মাদারীপুরের নজরুলের নাম রয়েছে।

পাচারকারী হিসেবে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, সিআইডি জানিয়েছে এদের বেশির ভাগই বিদেশে থাকেন। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সিআইডির টিম কাজ করছে।

তদন্তে জানা যাচ্ছে, এই চক্র প্রথমে সাত থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে ইউরোপে লোক পাঠানোর টোপ দিয়ে বিভিন্নজনকে প্রলুব্ধ করে। দালাল চক্র বিভিন্ন জেলায় বিদেশ যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের টার্গেট করে। তারা লোভ দেখিয়ে বোঝায় লিবিয়া, দুবাই মালয়েশিয়া গেলে বেশি হলে ৩০ হাজার টাকা বেতন পাবেন, আর ইউরোপে গেলে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা বেতন পাবেন। অতিরিক্ত কাজ করলে টাকা আরও বেশি হবে। কয়েক বছর থেকে দেশে আসলে কোটি টাকা নিয়ে আসতে পারবেন। এরপর নিজেই ইউরোপে লোক পাঠিয়ে টাকা উপার্জন করতে পারবেন।

এভাবে প্রলুব্ধ করে বিদেশ যেতে আগ্রহীদের বাছাই এবং টাকা নেয়া হয়ে গেলে তাদের প্রথমে ঢাকা থেকে ভারতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে দুবাইতে দালালের কাছে পাঠায়। দুবাই থেকে লিবিয়ায় নেয়া নেয়। সেখান থেকে বড় বড় পণ্যবহনকারী খালি জাহাজে তুলে ভূ-মধ্যসাগরের উপকূলে বা মাঝখান পর্যন্ত নেয়া হয়।

এরপর সাগরের মাঝখানে বড় জাহাজ থেকে তাদের প্লাস্টিকের নৌকায় নামিয়ে দেয়া হয়। জনপ্রতি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্লাস্টিকের নৌকা ভাড়া নেয়া হয়। নৌকায় ৩০ থেকে ৪০ জন ধারণ ক্ষমতা থাকলেও এক সঙ্গে ৮০ থেকে ৯০ জনকে উঠানো হয়। ওই সময় সমূদ্র উত্তাল থাকলে ঢেউয়ের কবলে পড়ে নৌকা ডুবে যায়। তাতে সমূদ্রে ডুবে অনেকেই মারা যান। আবার কেউ জীবিত উদ্ধার হয়।

সিআইডির তদন্তে জানা গেছে, এই চক্র বিশ্বাস অর্জন করার জন্য প্রথমে এলাকাভিত্তিক এক থেকে দুইজনকে ঠিকমত ইউরোপে পাঠায়। এরপর তাদের দেখে অন্য বেকার যুবকরা জমি, গরু বিক্রি করে বেশি টাকা বেতনের লোভে ইউরোপে যাওয়ার জন্য দালালকে টাকা দেয়।

সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশ, ভারত, দুবাই ও লিবিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই চক্রের নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে লোকজনকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাঠায়। বিনিময়ে পথে পথে টাকা নেয়। প্রতিটি দেশে তাদের দালাল রয়েছে।

সিআইডির কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, পাচারকারী ও ভিকটিমদের সঙ্গে কথা বলে সমুদ্র পথে পাচারের নানা কাহিনী জেনে সেই অনুযায়ী তদন্ত চলছে।

এ সম্পর্কে অপরাধবিষয়ক আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী বলেন, মানব পাচারের আইন সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। প্রচলিত আইনে বিচার হলে অপরাধীরা শাস্তি পাবে।

রবিবার, ২৩ মে ২০২১ , ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১০ শাওয়াল ১৪৪২

সমুদ্রপথে মানবপাচার

অর্ধশত পাচারকারী চিহ্নিত

৫ জনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড এলার্ট

বাকী বিল্লাহ

আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্র আশি হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা মাসিক বেতনের লোভ দেখিয়ে সমুদ্র পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠাচ্ছে। সর্বশেষ গত সোমবার ইউরোপে যাওয়ার সময় ভূ-মধ্যসাগরে নৌকা ডুবে অর্ধশতাধিক অভিবাসী নিখোঁজ হয়েছেন। সাগর থেকে ভাসমান অবস্থায় ৩৩ বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।

এর আগেও বিভিন্ন সময় কাজের সন্ধানে বেআইনিভাবে সমুদ্র পথে বিদেশ যাওয়ার সময় নৌকা ডুবে ও পাচারকারী চক্রের নির্যাতনে বেশ কিছু বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করেছেন।

সিআইডির মানব পাচার প্রতিরোধ সেলের কর্মকর্তারা তদন্ত করে ইতোমধ্যে মানব পাচারকারী চক্রের প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে। তাদের মধ্যে ৫ জনের বিরুদ্ধে জারি করা হচ্ছে রেড নোটিশ। মানবপাচারকারী এই চক্রকে আইনের আওতায় আনার জন্য স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট মন্ত্রণালয় এবং ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

পাচারকারীদের কবল থেকে ফিরে একাধিক ভুক্তভোগী পুলিশের কাছে তাদের পাচার হওয়ার কাহিনী এবং লিবিয়ায় বন্দী অবস্থায় নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তেমনি এক ভুক্তভোগী হলেন ভৈরবের জানু মিয়া।

মানব পাচারকারী মাফিয়াদের লোভনীয় চাকরির প্ররোচনায় লিবিয়া গিয়ে চরম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনর ভোগ করে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ফিরে আসেন ভৈরবের জানু মিয়া। দেশে ফিরে জানু মিয়া পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়ে লিবিয়ায় তার ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।

জানু মিয়া জানায়, তার পরিচিত মানব পাচারকারীদের দালাল সোহাগ তাকে ভালো বেতনে লিবিয়ায় চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখায়। পরে সোহাগের সঙ্গে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে লিবিয়া যাওয়ার চুক্তি করে। এরপর দালাল সোহাগ ও তার সহযোগীরা তাকে প্রথমে ভারতে পাঠায়। এরপর দুবাই থেকে মিশর ও মিশর থেকে লিবিয়ার বেনগাজীতে পাঠায়। বেনগাজীতে লিবিয়ার দালালরা তাকে রিসিভ করে। লিবিয়ার গুয়ার নামক জায়গার একটি ক্যাম্পে নিয়ে যায় তাকেসহ কয়েকজনের দলকে। ওই ক্যাম্পে ১৬ দিন থাকার পর আরেক দালালের বাসায় নেয়া হয় তাদের। ওই দালালের বাসায় এক সপ্তাহ থাকার পর তাদের কাজ দেয়। কিন্তু যে বেতন দেয়ার কথা ছিল তার থেকে অনেক কম বেতন দেয়া হয়। চুক্তি ছিল ২৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন দেয়া হবে। কিন্তু বেতন দেয় ১৫ হাজার টাকা। কোন উপায় না থাকায় তাতেই রাজি হয়ে কাজ শুরু করে তারা। পরে তারা আরেক দালাল তানজিরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ত্রিপোলিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। দালাল তানজিরুল ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে ত্রিপোলিতে নিয়ে যাবে বলে জানায়। এরপর ২০২০ সালের ১৫ মে সকালে ২টি মাইক্রোবাসযোগে জানুসহ ২০ জন ত্রিপোলির উদ্দেশে রওনা হয়। পথে একদল লোক রাস্তার মাঝখানে তাদের গাড়ি আটকায়। তাদের ২৯ জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নামিয়ে তাদের আস্তানায় নিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় তাদের দুর্ভোগের জীবন। সে মাফিয়া দালাল গ্রুপটি তাদের অন্য একটি গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। নতুন এই গ্রুপ তাদের নিয়ে একটি আস্তানায় আটকে রাখে সবাইকে। ওই আস্তানার দালালদের অত্যাচারে মারা যাওয়া একটি লাশ আস্তানার পাশেই পড়েছিল। মানব পাচারকারীরা লাশ দেখিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে জনপ্রতি ১২ হাজার মার্কিন ডলার দাবি করে। এরপর পাচারকারী চক্র লোহার রড, প্লস্টিকের পাইপ দিয়ে তাদের এলোপাতাড়ি পিটায় এবং ইলেকট্রিক শক দেয়। এভাবে তাদের নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের সদস্যদের শুনিয়ে তাদের কাছে টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে হত্যা করা হবে বলে জানায়। এক পর্যায়ে গুরুতর অবস্থায় দালাল ও মানব পাচারকারী চক্রের আস্তানা থেকে ২০২০ সালের সেপ্টম্বর মাসে দেশে ফিরে জানু মিয়া আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে সব ঘটনা প্রকাশ করে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, সিআইডির প্রধান কার্যালয় থেকে জানা গেছে, তিউনেশিয়ার উপকূলে নৌকা ডুবে যাওয়ার ঘটনায় জীবিত উদ্ধার করা ৩৩ জনের পরিচয় ও তাদের ঠিকানা ও কার মাধ্যমে তারা বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করেছে তা জানার জন্য গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) সঙ্গে যোগযোগ করা হয়েছে। এরপর সেখানে উদ্ধার হওয়া লোকদের সঙ্গে কথা বলে মানবপাচারকারী এই চক্রকে চিহ্নিত ও আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তবে এখন পর্যন্ত মানব পাচারকারী চক্রের যাদের চিহ্নিত করা গেছে সিআইডির একাধিক সূত্র জানায়, তাদের একাধিক সদস্যের বাড়ি সিলেটে। সিলেটের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার এলাকার বাসিন্দা তারা। তাদের মূল হোতা সিলেটের পারভেজ। তার বাবার নাম রফিকুল। তাদের একাধিক সদস্য ইতালি, দুবাই ও লিবিয়ায় থাকে।

সিআইডির তালিকায় মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের মধ্যে সিলেটের পারভেজ, ভৈরবের তানজিল, জাফর, মিন্টু, মাদারীপুরের আমির শেখ, নোয়াখালীর রিপন, রুবেল, নাসির মির্জা ও মাদারীপুরের নজরুলের নাম রয়েছে।

পাচারকারী হিসেবে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, সিআইডি জানিয়েছে এদের বেশির ভাগই বিদেশে থাকেন। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সিআইডির টিম কাজ করছে।

তদন্তে জানা যাচ্ছে, এই চক্র প্রথমে সাত থেকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে ইউরোপে লোক পাঠানোর টোপ দিয়ে বিভিন্নজনকে প্রলুব্ধ করে। দালাল চক্র বিভিন্ন জেলায় বিদেশ যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের টার্গেট করে। তারা লোভ দেখিয়ে বোঝায় লিবিয়া, দুবাই মালয়েশিয়া গেলে বেশি হলে ৩০ হাজার টাকা বেতন পাবেন, আর ইউরোপে গেলে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা বেতন পাবেন। অতিরিক্ত কাজ করলে টাকা আরও বেশি হবে। কয়েক বছর থেকে দেশে আসলে কোটি টাকা নিয়ে আসতে পারবেন। এরপর নিজেই ইউরোপে লোক পাঠিয়ে টাকা উপার্জন করতে পারবেন।

এভাবে প্রলুব্ধ করে বিদেশ যেতে আগ্রহীদের বাছাই এবং টাকা নেয়া হয়ে গেলে তাদের প্রথমে ঢাকা থেকে ভারতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে দুবাইতে দালালের কাছে পাঠায়। দুবাই থেকে লিবিয়ায় নেয়া নেয়। সেখান থেকে বড় বড় পণ্যবহনকারী খালি জাহাজে তুলে ভূ-মধ্যসাগরের উপকূলে বা মাঝখান পর্যন্ত নেয়া হয়।

এরপর সাগরের মাঝখানে বড় জাহাজ থেকে তাদের প্লাস্টিকের নৌকায় নামিয়ে দেয়া হয়। জনপ্রতি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্লাস্টিকের নৌকা ভাড়া নেয়া হয়। নৌকায় ৩০ থেকে ৪০ জন ধারণ ক্ষমতা থাকলেও এক সঙ্গে ৮০ থেকে ৯০ জনকে উঠানো হয়। ওই সময় সমূদ্র উত্তাল থাকলে ঢেউয়ের কবলে পড়ে নৌকা ডুবে যায়। তাতে সমূদ্রে ডুবে অনেকেই মারা যান। আবার কেউ জীবিত উদ্ধার হয়।

সিআইডির তদন্তে জানা গেছে, এই চক্র বিশ্বাস অর্জন করার জন্য প্রথমে এলাকাভিত্তিক এক থেকে দুইজনকে ঠিকমত ইউরোপে পাঠায়। এরপর তাদের দেখে অন্য বেকার যুবকরা জমি, গরু বিক্রি করে বেশি টাকা বেতনের লোভে ইউরোপে যাওয়ার জন্য দালালকে টাকা দেয়।

সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, বাংলাদেশ, ভারত, দুবাই ও লিবিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই চক্রের নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে লোকজনকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাঠায়। বিনিময়ে পথে পথে টাকা নেয়। প্রতিটি দেশে তাদের দালাল রয়েছে।

সিআইডির কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, পাচারকারী ও ভিকটিমদের সঙ্গে কথা বলে সমুদ্র পথে পাচারের নানা কাহিনী জেনে সেই অনুযায়ী তদন্ত চলছে।

এ সম্পর্কে অপরাধবিষয়ক আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী বলেন, মানব পাচারের আইন সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। প্রচলিত আইনে বিচার হলে অপরাধীরা শাস্তি পাবে।