আমলাতন্ত্রের মোগলাই দর্পণ

শঙ্কর প্রসাদ দে

সম্রাট আকবর মজলিসে ব্যস্ত, এক খানসামা হন্তদন্ত হয়ে দরবারে উপস্থিত।

হুজুর, জরুরি সংবাদ দিতেই অপারগ হয়ে ঢুকলাম। আকবর-বল কি তোমার বয়ান?

হুজুর, এক পণ্ডিতকে গারদে ঢুকিয়ে, তবেই এসেছি।

আকবর : পণ্ডিতের অপরাধ কি?

হুজুর, পণ্ডিত ক্লাসে ছাত্রদের বলছিল, এবার ফসল ভালো হয়নি, খাজনা মওকুফের জন্য বাদশার দরবারে যেতে হবে।

ব্যাটার বক্তব্য আমি শুনে ফেলেছি, রাজদ্রোহ বলে কথা।

আকবর : তোমাদের মতো রাজকর্মচারীদের কারণেই মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংস হতে বাধ্য। বেচারা পণ্ডিতকে গারদে ঢুকানোর অনুমতি তোমাকে কে দিয়েছে? পণ্ডিতের কাজ হলো ছাত্রদের সত্য, ন্যায় ও নীতিবোধ শিক্ষা দেয়া। পণ্ডিতকে গারদে দেয়ার খবর রটে গেলে, প্রজা বিদ্রোহ অনিবার্য। যে রাজ্যে পণ্ডিতদের কথা বলতে দেয়া হয় না, সে রাজ্যের ধ্বংস অনিবার্য। এক্ষুণি পণ্ডিতকে সসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দাও। সঙ্গে ১০০ মোহর দিয়ে বলবা, সে যেন মোহরগুলো দিয়ে আরেকটি টোল প্রতিষ্ঠা করে।

কথা বলতে দেয়া হয়নি বলে সমাজতন্ত্রের মতো একটি উন্নত ব্যবস্থার পতন হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে। বিরুদ্ধ মত স্তব্ধ করা হয়েছিল বলেই হিটলারের মতো এক নায়কের উদ্ভব হয়েছিল। কথার মূল্য দেয়া হয়নি পাকিস্তানে। আইয়ুব-ইয়াহিয়া জনতার বয়ান বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই, পাকিস্তান ভেঙেছে। গোলাম আজমরা জনতার ভাষা বোঝেনি বলেই, এদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ডুবন্ত একটি জাহাজ, সবাই লাফিয়ে পড়ে বাঁচতে চাইছে।

যে কোন বিচারে, যে কোন মানদণ্ডে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সঙ্গে শোভন, ন্যায়সংগত ও সাংবিধানিক আচরণ করা হয়নি। তাকে হেনস্তা করার জন্য শুধু অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসাই একমাত্র দায়ী তাও নয়। ওই সময় সচিবালয়ে পূর্ণ কর্মচাঞ্চল্য ছিল। পূর্বে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় সবাই রোজিনার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। ১৭ মে হাতের নাগালে পাওয়া গেল। রোজিনার ভেবে রাখা উচিত ছিল, তিনি হায়েনার আস্তানায় ঢুকতে যাচ্ছেন।

এদেশের আমলাতন্ত্রকে কেন হায়নাতন্ত্র বললাম, তা বুঝতে হলে একটু পেছনের পাতা উল্টোতেই হয়। লর্ড কর্ণওয়ালিশ বঙ্গে ভূমি ব্যবস্থাপনায় চালু করলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এর আগে পাঁচসনা বা দশসনা বন্দোবস্তি ছিল। ভারত বর্ষের চতুর্দিকে ব্যপ্ত হচ্ছিল ব্রিটিশ শাসন। স্থানীয় একটি ব্রিটিশ অনুগত শ্রেণীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। একদল জমিদারের আবির্ভাব হলো, দেশের সমস্ত সম্পত্তি জমিদারদের ভাগ করে দিয়ে দেয়া হলো। কর্ণওয়ালিশের এই ভূমি ব্যবস্থাপনা গোটা ভারতবর্ষে জাদুর মতো কাজ করেছিল। এই নব্য শ্রেণী ও দেশীয় রাজারা খাজনা আদায়তো করতোই, তার উপর দু’শো বছরের জন্য ব্রিটিশ শাসনের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। এই জমিদার আর রাজারা কি মাত্রায় ব্রিটিশ তোষামোদকারী ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৭৯৯ সালের ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে। হায়দ্রাবাদের নিজাম বাহিনী ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে যোগ না দিলে শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতানকে পরাজিত করা যেতো না।

১৭৯৩ সালেই কর্ণওয়ালিশ চার্টার এ্যাক্ট প্রবর্তন করে কোম্পানি কর্তৃক প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থা করলেন। উচ্চ পদস্থ অফিসার নিয়োগের ব্যবস্থা হল। এরা সাদা চামড়ার ব্রিটিশ। এদের বলা হতো সনদী সিভিল সার্ভেন্ট। নি¤œপদস্থ কিছু কর্মচারী যেমন, মুন্সেফ-পণ্ডিত-মুন্সী-সেরেস্তাদার নিয়োগ দেয়া হলো দেশীয়দের মধ্য থেকে। এদের বলা হলো অ-সনদী সিভিল সার্ভেন্ট। ১৮৩৩ সালে লর্ড বেন্টিংক গণমুখী কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও কোম্পানি তা গ্রাহ্য করেনি।

রীতিমতো পণ্ডিতেরও পণ্ডিত লর্ড ব্যাবিংটন ম্যাকলেকে দণ্ডবিধি প্রণয়নের বাইরে দায়িত্ব দেয়া হলো প্রশাসনিক সংস্কারের। তাকে নিয়োগ করা হলো সিভিল সার্ভিস কমিশনার্স। তার সুপারিশের ভিত্তিতে ১৮৬১ সালে সিভিল সার্ভিস এ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়। এবারও উচ্চপদে সাদা চামড়াওয়ালা ছাড়া ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার রইলোনা। অ-সনদী সার্ভিসের মতোই নিম্নপদস্থ কর্মচারী পদে ভারতীয়দের নিয়োগ লাভের সুযোগ রেখে প্রনীত হল সাব-অর্ডিন্যান্ট এক্সিকিউটিভ সার্ভিস। ১৮৮৬ সালে এসে পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নিত হয়। আইচিসন কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়া শুরু হল কিছু কিছু উচ্চ পদে। তবে এদের লন্ডন গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। ঘোড়সওয়ার পরীক্ষায় অংশ নিতে, জমিদার সন্তান ছাড়া অন্য কারো এই সুযোগ নেয়ার প্রশ্নই ছিল না। এখনও কিন্তু উচ্চবিত্ত আর উচ্চ মধ্যবিত্তের সন্তান ছাড়া অন্যদের প্রশাসন ক্যাডারে ঢুকার দৃষ্টান্ত মেলে না। অল্প কয়েকজন সুযোগ পান তাও আবার শিক্ষা ক্যাডারে।

১৯২২ সালে প্রথম আইসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এক তৃতীয়াংশ ভারতীয় আইসিএস অফিসার হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। মোদ্দা কথায় এদের ক্ষমতা একজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যের অনুরূপ নির্ধারিত হয়। প্রশিক্ষণ শেষে এদের উপরই জেলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্পিত হয়। জেলার প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব ছিল বহুবিধ। তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কালেক্টর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা তথা পুলিশ বাহিনীর জবাবদিহি ছিল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এর হাতে। জেলার শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হতো জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস থেকে। ১৯৪৭ পর্যন্ত এ পদ্ধতিতে ভারতবর্ষের শাসনকার্য পরিচালিত হয়েছে এসব ‘জেলা-প্রভুদের’ মাধ্যমে। ১৯৭১ পর্যন্ত এ ব্যবস্থাই প্রচলিত ছিল। পঞ্চাশের দশকে জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব বাঙালিদের দেয়া হয়নি। ষাটের দশকে সিএসপি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিছু যুবককে মহকুমা প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আকবর আলী খান, এইচটি ইমাম, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীরা বিদ্রোহ করে মুজিবনগর সরকারের আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং প্রবাসী সরকারের অধীনে হুবহু ব্রিটিশ কাঠামো নিয়ে এগোতে থাকেন।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং এই সিএসপি অফিসাররা তাদের ডায়রি থেকে জনযুদ্ধের ৯ মাসকে মুছে দিলেন বা ৯ মাসের পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন ডাস্টবিনে। রক্তাক্ত ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ভাষা আমরা কেউ বুঝিনি। যার যার ধান্দায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ব্রিটিশ প্রবর্তিত এবং পাকিস্তানি লালিত প্রশাসনটিই হুবহু বসিয়ে দিলাম। একদিন আগেও যারা পাকিস্তানের দালালি করেছে, তারা বলে উঠলো মারহাবা, মারহাবা।

দেশের কোন কোন ডিসির বাড়িতে উঠতে গেলে ৪টি নিরাপত্তা গেইট অতিক্রম করতে হবে। ১৭৯৩ তে এরা ছিল জেলার প্রভু, ১৮৬১ তেও প্রভু, ১৯৪৭ এও রইলো প্রভু, ১৯৭২ এ আবার ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিলাম পুরোনো প্রভুদের। অথচ সংবিধানে লিখে দিলাম জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। রাষ্ট্রকে ঘোষণা করা হলো প্রজাতন্ত্র। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মালিক জনগণ।

রোজিনাকে হেনস্তা করাটা অসাংবিধানিক হয়েছে এ কারণে যে, রোজিনা কেন? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে আমারও জানার অধিকার রয়েছে কত টাকার জিনিস কিনেছ হিসাব দাও। সবাই তো আর হিসাব নিতে যাবে না। যাবে হয় জনপ্রতিনিধি চেয়ারম্যান, মেম্বার বা এমপি সাহেবরা। একজন সাংবাদিকের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া যে কোন নথি দেখার, সংবাদ প্রকাশ করার। দেখতে চাইলে যত বড় কর্মকর্তাই হোন না কেন, দেখাতে বাধ্য। সাংবিধানিকভাবে রোজিনারা সচিবালয়ের মালিক। রোজিনাদের টাকায় ক্যাডারদের বেতন চলে। জেবুন্নেসারা রাষ্ট্রের সেবক, সরকারের সেবক, জনগণের সেবক, রোজিনাদের সেবক।

আসলে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে ১৯৭২ সালে। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করলেন। হুবহু পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কাঠামোতে বহাল করলেন স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনী। এরা স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধুকেই পাঠিয়ে দিল জান্নাতে। জনগণ দেশ স্বাধীন করলো আর জনগণকে শাসন করার কর্তৃত্ব তুলে দেয়া হলো ডিসি, এস, পি, সচিবদের হাতে। স্বপ্ন ছিল, দেশ স্বাধীন হলে ডিসি, এসপি, সচিবরা রাষ্ট্রীয় সেবা নিয়ে গ্রামে যাবে, স্কুলে যাবে, রাস্তা তৈরির দেখভাল করবে। স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হলো। এখন জনগণকে দৌড়াতে হয় ডিসি, এসপি, সচিবদের দ্বারে। দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকে আরদালি, অনুমতি ছাড়া ঢোকা যায় না, ঢুকলে বসতেও বলে না, অথচ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শই ছিল, নাগরিক ঢুকলেই কর্তা বেটাকে দাঁড়িয়ে সম্মান করতে হবে।

স্বাধীনতার পর উন্নয়ন বরাদ্দের এক চতুর্থাংশ এই আমলাতন্ত্র একাই খেয়ে ফেলেছে। এদের দেশে ফ্ল্যাটের অভাব নেই। বিদেশে বাড়ির অভাব নেই, অনেকের তো অফিসের ভেতরে নিত্যনতুন মুতাবিবি বা পটের বিবিদের আনাগোনা। লজ্জা শরম থাকলে ডিসি অফিসের ভেতর কুকাজ করত না।

স¤্রাট আকবর যদি এসব দেখার সুযোগ পেতেন, তবে দুঃখ করে বলতেন- যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা জোরে জোরে বলা হচ্ছে, তা এই আমলাতন্ত্রের কারণে ব্যর্থ হতে বাধ্য।

[লেখক : আইনজীবী]

spdey2011@gmail.com

রবিবার, ২৩ মে ২০২১ , ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১০ শাওয়াল ১৪৪২

আমলাতন্ত্রের মোগলাই দর্পণ

শঙ্কর প্রসাদ দে

সম্রাট আকবর মজলিসে ব্যস্ত, এক খানসামা হন্তদন্ত হয়ে দরবারে উপস্থিত।

হুজুর, জরুরি সংবাদ দিতেই অপারগ হয়ে ঢুকলাম। আকবর-বল কি তোমার বয়ান?

হুজুর, এক পণ্ডিতকে গারদে ঢুকিয়ে, তবেই এসেছি।

আকবর : পণ্ডিতের অপরাধ কি?

হুজুর, পণ্ডিত ক্লাসে ছাত্রদের বলছিল, এবার ফসল ভালো হয়নি, খাজনা মওকুফের জন্য বাদশার দরবারে যেতে হবে।

ব্যাটার বক্তব্য আমি শুনে ফেলেছি, রাজদ্রোহ বলে কথা।

আকবর : তোমাদের মতো রাজকর্মচারীদের কারণেই মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংস হতে বাধ্য। বেচারা পণ্ডিতকে গারদে ঢুকানোর অনুমতি তোমাকে কে দিয়েছে? পণ্ডিতের কাজ হলো ছাত্রদের সত্য, ন্যায় ও নীতিবোধ শিক্ষা দেয়া। পণ্ডিতকে গারদে দেয়ার খবর রটে গেলে, প্রজা বিদ্রোহ অনিবার্য। যে রাজ্যে পণ্ডিতদের কথা বলতে দেয়া হয় না, সে রাজ্যের ধ্বংস অনিবার্য। এক্ষুণি পণ্ডিতকে সসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দাও। সঙ্গে ১০০ মোহর দিয়ে বলবা, সে যেন মোহরগুলো দিয়ে আরেকটি টোল প্রতিষ্ঠা করে।

কথা বলতে দেয়া হয়নি বলে সমাজতন্ত্রের মতো একটি উন্নত ব্যবস্থার পতন হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে। বিরুদ্ধ মত স্তব্ধ করা হয়েছিল বলেই হিটলারের মতো এক নায়কের উদ্ভব হয়েছিল। কথার মূল্য দেয়া হয়নি পাকিস্তানে। আইয়ুব-ইয়াহিয়া জনতার বয়ান বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই, পাকিস্তান ভেঙেছে। গোলাম আজমরা জনতার ভাষা বোঝেনি বলেই, এদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ডুবন্ত একটি জাহাজ, সবাই লাফিয়ে পড়ে বাঁচতে চাইছে।

যে কোন বিচারে, যে কোন মানদণ্ডে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সঙ্গে শোভন, ন্যায়সংগত ও সাংবিধানিক আচরণ করা হয়নি। তাকে হেনস্তা করার জন্য শুধু অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসাই একমাত্র দায়ী তাও নয়। ওই সময় সচিবালয়ে পূর্ণ কর্মচাঞ্চল্য ছিল। পূর্বে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় সবাই রোজিনার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। ১৭ মে হাতের নাগালে পাওয়া গেল। রোজিনার ভেবে রাখা উচিত ছিল, তিনি হায়েনার আস্তানায় ঢুকতে যাচ্ছেন।

এদেশের আমলাতন্ত্রকে কেন হায়নাতন্ত্র বললাম, তা বুঝতে হলে একটু পেছনের পাতা উল্টোতেই হয়। লর্ড কর্ণওয়ালিশ বঙ্গে ভূমি ব্যবস্থাপনায় চালু করলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এর আগে পাঁচসনা বা দশসনা বন্দোবস্তি ছিল। ভারত বর্ষের চতুর্দিকে ব্যপ্ত হচ্ছিল ব্রিটিশ শাসন। স্থানীয় একটি ব্রিটিশ অনুগত শ্রেণীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। একদল জমিদারের আবির্ভাব হলো, দেশের সমস্ত সম্পত্তি জমিদারদের ভাগ করে দিয়ে দেয়া হলো। কর্ণওয়ালিশের এই ভূমি ব্যবস্থাপনা গোটা ভারতবর্ষে জাদুর মতো কাজ করেছিল। এই নব্য শ্রেণী ও দেশীয় রাজারা খাজনা আদায়তো করতোই, তার উপর দু’শো বছরের জন্য ব্রিটিশ শাসনের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। এই জমিদার আর রাজারা কি মাত্রায় ব্রিটিশ তোষামোদকারী ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৭৯৯ সালের ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে। হায়দ্রাবাদের নিজাম বাহিনী ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে যোগ না দিলে শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতানকে পরাজিত করা যেতো না।

১৭৯৩ সালেই কর্ণওয়ালিশ চার্টার এ্যাক্ট প্রবর্তন করে কোম্পানি কর্তৃক প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থা করলেন। উচ্চ পদস্থ অফিসার নিয়োগের ব্যবস্থা হল। এরা সাদা চামড়ার ব্রিটিশ। এদের বলা হতো সনদী সিভিল সার্ভেন্ট। নি¤œপদস্থ কিছু কর্মচারী যেমন, মুন্সেফ-পণ্ডিত-মুন্সী-সেরেস্তাদার নিয়োগ দেয়া হলো দেশীয়দের মধ্য থেকে। এদের বলা হলো অ-সনদী সিভিল সার্ভেন্ট। ১৮৩৩ সালে লর্ড বেন্টিংক গণমুখী কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও কোম্পানি তা গ্রাহ্য করেনি।

রীতিমতো পণ্ডিতেরও পণ্ডিত লর্ড ব্যাবিংটন ম্যাকলেকে দণ্ডবিধি প্রণয়নের বাইরে দায়িত্ব দেয়া হলো প্রশাসনিক সংস্কারের। তাকে নিয়োগ করা হলো সিভিল সার্ভিস কমিশনার্স। তার সুপারিশের ভিত্তিতে ১৮৬১ সালে সিভিল সার্ভিস এ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়। এবারও উচ্চপদে সাদা চামড়াওয়ালা ছাড়া ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার রইলোনা। অ-সনদী সার্ভিসের মতোই নিম্নপদস্থ কর্মচারী পদে ভারতীয়দের নিয়োগ লাভের সুযোগ রেখে প্রনীত হল সাব-অর্ডিন্যান্ট এক্সিকিউটিভ সার্ভিস। ১৮৮৬ সালে এসে পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নিত হয়। আইচিসন কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়া শুরু হল কিছু কিছু উচ্চ পদে। তবে এদের লন্ডন গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। ঘোড়সওয়ার পরীক্ষায় অংশ নিতে, জমিদার সন্তান ছাড়া অন্য কারো এই সুযোগ নেয়ার প্রশ্নই ছিল না। এখনও কিন্তু উচ্চবিত্ত আর উচ্চ মধ্যবিত্তের সন্তান ছাড়া অন্যদের প্রশাসন ক্যাডারে ঢুকার দৃষ্টান্ত মেলে না। অল্প কয়েকজন সুযোগ পান তাও আবার শিক্ষা ক্যাডারে।

১৯২২ সালে প্রথম আইসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এক তৃতীয়াংশ ভারতীয় আইসিএস অফিসার হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। মোদ্দা কথায় এদের ক্ষমতা একজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যের অনুরূপ নির্ধারিত হয়। প্রশিক্ষণ শেষে এদের উপরই জেলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্পিত হয়। জেলার প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব ছিল বহুবিধ। তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কালেক্টর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা তথা পুলিশ বাহিনীর জবাবদিহি ছিল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এর হাতে। জেলার শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হতো জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস থেকে। ১৯৪৭ পর্যন্ত এ পদ্ধতিতে ভারতবর্ষের শাসনকার্য পরিচালিত হয়েছে এসব ‘জেলা-প্রভুদের’ মাধ্যমে। ১৯৭১ পর্যন্ত এ ব্যবস্থাই প্রচলিত ছিল। পঞ্চাশের দশকে জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব বাঙালিদের দেয়া হয়নি। ষাটের দশকে সিএসপি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিছু যুবককে মহকুমা প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আকবর আলী খান, এইচটি ইমাম, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীরা বিদ্রোহ করে মুজিবনগর সরকারের আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং প্রবাসী সরকারের অধীনে হুবহু ব্রিটিশ কাঠামো নিয়ে এগোতে থাকেন।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং এই সিএসপি অফিসাররা তাদের ডায়রি থেকে জনযুদ্ধের ৯ মাসকে মুছে দিলেন বা ৯ মাসের পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন ডাস্টবিনে। রক্তাক্ত ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ভাষা আমরা কেউ বুঝিনি। যার যার ধান্দায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ব্রিটিশ প্রবর্তিত এবং পাকিস্তানি লালিত প্রশাসনটিই হুবহু বসিয়ে দিলাম। একদিন আগেও যারা পাকিস্তানের দালালি করেছে, তারা বলে উঠলো মারহাবা, মারহাবা।

দেশের কোন কোন ডিসির বাড়িতে উঠতে গেলে ৪টি নিরাপত্তা গেইট অতিক্রম করতে হবে। ১৭৯৩ তে এরা ছিল জেলার প্রভু, ১৮৬১ তেও প্রভু, ১৯৪৭ এও রইলো প্রভু, ১৯৭২ এ আবার ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিলাম পুরোনো প্রভুদের। অথচ সংবিধানে লিখে দিলাম জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। রাষ্ট্রকে ঘোষণা করা হলো প্রজাতন্ত্র। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মালিক জনগণ।

রোজিনাকে হেনস্তা করাটা অসাংবিধানিক হয়েছে এ কারণে যে, রোজিনা কেন? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে আমারও জানার অধিকার রয়েছে কত টাকার জিনিস কিনেছ হিসাব দাও। সবাই তো আর হিসাব নিতে যাবে না। যাবে হয় জনপ্রতিনিধি চেয়ারম্যান, মেম্বার বা এমপি সাহেবরা। একজন সাংবাদিকের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া যে কোন নথি দেখার, সংবাদ প্রকাশ করার। দেখতে চাইলে যত বড় কর্মকর্তাই হোন না কেন, দেখাতে বাধ্য। সাংবিধানিকভাবে রোজিনারা সচিবালয়ের মালিক। রোজিনাদের টাকায় ক্যাডারদের বেতন চলে। জেবুন্নেসারা রাষ্ট্রের সেবক, সরকারের সেবক, জনগণের সেবক, রোজিনাদের সেবক।

আসলে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে ১৯৭২ সালে। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করলেন। হুবহু পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কাঠামোতে বহাল করলেন স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনী। এরা স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধুকেই পাঠিয়ে দিল জান্নাতে। জনগণ দেশ স্বাধীন করলো আর জনগণকে শাসন করার কর্তৃত্ব তুলে দেয়া হলো ডিসি, এস, পি, সচিবদের হাতে। স্বপ্ন ছিল, দেশ স্বাধীন হলে ডিসি, এসপি, সচিবরা রাষ্ট্রীয় সেবা নিয়ে গ্রামে যাবে, স্কুলে যাবে, রাস্তা তৈরির দেখভাল করবে। স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হলো। এখন জনগণকে দৌড়াতে হয় ডিসি, এসপি, সচিবদের দ্বারে। দ্বারে দাঁড়িয়ে থাকে আরদালি, অনুমতি ছাড়া ঢোকা যায় না, ঢুকলে বসতেও বলে না, অথচ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শই ছিল, নাগরিক ঢুকলেই কর্তা বেটাকে দাঁড়িয়ে সম্মান করতে হবে।

স্বাধীনতার পর উন্নয়ন বরাদ্দের এক চতুর্থাংশ এই আমলাতন্ত্র একাই খেয়ে ফেলেছে। এদের দেশে ফ্ল্যাটের অভাব নেই। বিদেশে বাড়ির অভাব নেই, অনেকের তো অফিসের ভেতরে নিত্যনতুন মুতাবিবি বা পটের বিবিদের আনাগোনা। লজ্জা শরম থাকলে ডিসি অফিসের ভেতর কুকাজ করত না।

স¤্রাট আকবর যদি এসব দেখার সুযোগ পেতেন, তবে দুঃখ করে বলতেন- যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা জোরে জোরে বলা হচ্ছে, তা এই আমলাতন্ত্রের কারণে ব্যর্থ হতে বাধ্য।

[লেখক : আইনজীবী]

spdey2011@gmail.com