করোনাকালের উৎসব

রণেশ মৈত্র

ঈদ আনন্দের উৎসব। মুসলিম সমাজের উৎসব সত্ত্বেও বাংলাদেশে অন্তত এটি একটি জাতীয় উৎসব। অপরাপর জাতীয় উৎসবগুলোর অন্যতম। তাই এ উৎসব সবার উৎসব, সব মানুষের জীবনের বাৎসরিক আনন্দের উৎসব।

ঈদ দেখে আসছি সেই ছোটবেলা থেকে; পাকিস্তান আমল থেকে। ব্রিটিশ আমলেও ঈদ নিশ্চয়ই হতো; কিন্তু তখন আমি ছোট। বয়স ১৯৪৭ সালে মাত্র ১৪ বছর। গ্রামে ভিন্নপাড়ায় মুসলিমদের এবং অন্যপাড়ায় হিন্দুদের নিবাস ছিল সাধারণত। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে থাকলেও হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কোন ঘাটতি হতে দেখিনি।

যারা আমরা মুসলিম ঘরের সন্তান ছিলাম না তাদের কাছে দিনটিতে বিশেষ বিশেষ খাবারের সুযোগ এসে হাজির হতো বিশেষ করে ঈদুল ফিতরে। মুসলিম বন্ধুরা নাছোড়বান্দা খেতেই হবে তাদের বাড়িতে দলে বলে। আর এই সুযোগটি কখনও হাতছাড়া করিনি। বাড়িতে মা-বাবা আপত্তি করতে পারেন ভেবে তাদেরকে না জানিয়েই যেতাম। একা কী? না দলে বলে। শুধু হিন্দু ঘরের সন্তানেরাই কি? না হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলে মিলে একসঙ্গে বসে যেতাম। বন্ধুদের মা-বোনেরা পরম আদরে খাওয়াতেন।

কিন্তু খেতাম কি এক বাড়িতে? না অনেক বাড়িতে ওই একইভাবে দলে বলে। মনে হতো পেটে আর আঁটবে না কিন্তু খাওয়াতো থামতো না। পরদিন কোন কষ্টও অনুভব করিনি পেটের অসুখ জাতীয় কোন কিছু হয়নি।

ঈদের পর দিনও কোন কোন বছর কোন বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকতো। সুযোগ পেলেই যেতাম। শুধুই কি খাওয়ার আনন্দ? না, তা নয় আদৌ। মেলামেশার আনন্দ-দূর দূর থেকে বাড়িতে ঈদ করতে আসা বন্ধুদের সাথে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মেলামেশার আনন্দ-প্রিয়জনদের সান্নিধ্য পাবার আনন্দ। সবার সাথে হাত মেলানোর আনন্দ-কোলাকুলির আনন্দ। দিব্যি সবাই ভুলে যেতাম কেউ আমরা হিন্দু-কেউ মুসলমান। ধর্মের চাইতে বন্ধুত্বই বড় হয়ে উঠতো। তাই তো এমন খাওয়া দাওয়া-সম্মিলিতভাবে ঈদ উদযাপন।

করোনার বৈশি^ক মহামারীর মধ্যে এলো ঈদ। বাংলাদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাসাধিকাল আগে থেকে সরকার লকডাউন ঘোষণা করে অফিস-আদালত, যান-বাহন চলাচল বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করায় জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। তবে এই লকডাউন আদৌ প্রয়োজন ছিল না-বরং মানুষ বাঁচানোর করোনা সংক্রমন ও মৃত্যু প্রতিরোধের জন্য তার প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু হঠাৎ করে কী দেখা গেল? বিভাগীয় শহরগুলোতে গণ পরিবহন চালু করে আন্তঃজেলা যাত্রী পরিবহন বন্ধ করেই রাখা হলো। বিভাগীয় শহরগুলোতেই নয় শুধু-প্রতি জেলার পরিবহন জেলার অভ্যন্তরে চলা বৈধ করে দেওয়া হলো। ফলাফল? ভয়াবহ।

যেমন ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে, জেলাগুলোর অভ্যন্তরে, বড় বড় নদীর ফেরিঘাটগুলোতে, ফেরির অভ্যন্তরে হাজার হাজার মানুষ পড়ি কি মরি করে ওইসব যানবাহনে উঠছেন, ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ বা ফেরিতে উঠতে গিয়ে ভিড়ের চাপে নদীর জলে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারান-প্রাণ হারান সারাদেশে ট্রাকে-বাসে ঠক্কর লেগে বাস-মোটর সাইকেল, বাসে-বাসে, অপরাপর যান-বাহনে ধাক্কা লেগে বহু লোক প্রাণ হারিয়েছেন-যার সংখ্যা আজও সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয় নি।

সরকারের হুশিয়ারি মাস্ক পরাসহ পথে-ঘাটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বাধ্যতামূলক এবং তা নিশ্চিত করতে পুলিশকে ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা দেওয়া হলো। কিন্তু কার্যত পুলিশকে কোথাও ম্যাজিস্ট্রেসীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি-তবে কোথাও কোথাও আগে থেকেই পথচারীদের মাস্ক পরতে বাধ্য করতে দেখা গেছে। যা হোক সরকারের কোন নিষেধাজ্ঞাই কাজে লাগেনি। জনসমুদ্র গড়ে ওঠে সারা দেশজুড়ে-মাস্ক অল্পসংখ্যক মানুষকে পরতে দেখা গেল-সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই।

আন্তঃজেলা পরিবহন বন্ধ থাকলো। কিন্তু ঈদমুখী, ঘরমুখী মানুষ জেলার আভ্যন্তরীন পরিবহনে চড়ে সীমান্তে গিয়ে নেমে-আবার অপর জেলার সীমান্তে গিয়ে বাসে উঠে বউ-বাচ্চা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশুসহ কী দুর্ভোগেই না পড়লেন। তাদের ভোগ করতে হলো সীমাহীন কষ্ট, গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় লাগলো চারগুণ, খরচ হলো সাত থেকে আটগুন। যে মানুষদের জন্য দেশ, যে মানুষদের জন্য ঈদ-সেই মানুষদের কষ্টের সীমা রইল না। এর চাইতে আন্তঃজেলা গণপরিবহন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু করতে দিলে অন্তত কিছু সংখ্যক মানুষের কষ্টের লাঘব হতো।

না, আমি অস্বাভাবিক এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে যানবাহন, হাট-বাজার, বিপণি-শপিং মল প্রভৃতি স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে দেওয়া বা বাজার বিপণি খোলা রাখার পক্ষে নই। জীবন সর্বাগ্রে। তাই সমস্ত কিছু বন্ধ রাখলে যেমন বিভাগীয়, জেলাগুলোতে, ট্রেন, ফেরি, জাহাজ সকল কিছু বন্ধ রাখা উচিত ছিল বলেই মনে করি। সরকারি এবড়োখেবড়ো সিদ্ধান্তের ফল কারও পক্ষেই মঙ্গল জনক হয়নি-অর্জিত অভিজ্ঞতা তাই বলে।

আমার প্রস্তাবিত অমন কঠোর সিদ্ধান্ত কি ঈদের সময় যৌক্তিক হতো? এমন প্রশ্নের জবাবে বলবে অবশ্যই না। কারণ মানুষের জীবন সর্বাপেক্ষ বিশেষ করে বাংলাদেশে ভারতীয় করোনা ভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়ার বা কঠোরতম বিধি নিষেধের বিকল্প নেই। দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞর তেমনই অভিমত বারংবার দিলেন তা পূরোদস্তুর উপেক্ষিত হয়েছে।

আবার ঈদের জামায়াত খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত না হলেও মসজিদগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানা হয়নি-সবার মুখে মাস্ক ছিল না (ছিল অল্প সংখ্যকের) শারীরিক দূরত্ব আদৌ বজায় রাখা হয়নি। আবার বিধি মেনে ঈদের জামাত হচ্ছে কিনা-সরকারিভাবে তা পর্যবেক্ষণের কোন ব্যবস্থাও চোখে পড়েনি।

সব মিলে গোটা ঈদের সিজনটাই অস্বাভাবিকতায় ভরা। মানুষও মনের আনন্দে, স্বাচ্ছন্দে ঈদের জামাত করতে পারেন নি-পারেন নি নামায শেষে হাত মেলাতে, পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করতে। অথচ ঈদ মানেই তো আনন্দ, পরস্পর পরস্পরের কাছাকাছি আসা, হাত মেলানো, আলিঙ্গন, আহারাদি এবং সর্বোপরি সম্মীলিত নামাজ আদায় ও প্রার্থনার। কিন্তু তা এবার হলো না। হয়নি ২০২০ সালের ঈদুল আজহাতে এবং ঈদ-উজ-জোহাতেও একই বিভীষিকাময় করোনার কারণে।

এমন গণবিচ্ছিন্ন, হুমকি-ধামকি ভরা ঈদকে স্বাভাবিক ঈদ বলা যায় না। মনে পড়ে গেলো, আমাদের বাল্যকালে তখন পাকিস্তান আমল হওয়া সত্ত্বেও পাড়ায় পাড়ায় আমরা ঈদের পরপরই অনুষ্ঠিত করতাম ঈদ-প্রীতি-সম্মেলনী। আজ আর তেমন নাচ, গান, আবৃত্তি, আলোচনা, নাটক সবই আয়োজিত হতো। মানুষ আনন্দের সাথে আরও কাছাকাছি আসতো। আজ আর-তা নেই। করোনার জন্যে কি? না, আদৌ তা নয়। বরং প্রচ্ছন্নভাবে হলেও এক ধরনের ধর্মান্ধতা যেন গ্রাস করতে চলেছে সমাজটাকে।

দুই মাস পরে আবার আসছে ঈদ। আসছে ঈদুল আজহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদ। তখনও যেন এমন দৃশ্য দেখতে না হয়। করোনা দূর হলে তো কথাই নেই-কিন্তু যদি না হয় (যার সম্ভাবনাই বেশি) তা হলে আবার যেন যানজট, জটলা, হাজারে হাজারে দেশে ফেরা-আবার কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার বিপজ্জনক কিছু ঘটার দৃশ্য না দেখতে হয়।

[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

সোমবার, ২৪ মে ২০২১ , ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১১ শাওয়াল ১৪৪২

করোনাকালের উৎসব

রণেশ মৈত্র

image

ঈদ আনন্দের উৎসব। মুসলিম সমাজের উৎসব সত্ত্বেও বাংলাদেশে অন্তত এটি একটি জাতীয় উৎসব। অপরাপর জাতীয় উৎসবগুলোর অন্যতম। তাই এ উৎসব সবার উৎসব, সব মানুষের জীবনের বাৎসরিক আনন্দের উৎসব।

ঈদ দেখে আসছি সেই ছোটবেলা থেকে; পাকিস্তান আমল থেকে। ব্রিটিশ আমলেও ঈদ নিশ্চয়ই হতো; কিন্তু তখন আমি ছোট। বয়স ১৯৪৭ সালে মাত্র ১৪ বছর। গ্রামে ভিন্নপাড়ায় মুসলিমদের এবং অন্যপাড়ায় হিন্দুদের নিবাস ছিল সাধারণত। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে থাকলেও হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কোন ঘাটতি হতে দেখিনি।

যারা আমরা মুসলিম ঘরের সন্তান ছিলাম না তাদের কাছে দিনটিতে বিশেষ বিশেষ খাবারের সুযোগ এসে হাজির হতো বিশেষ করে ঈদুল ফিতরে। মুসলিম বন্ধুরা নাছোড়বান্দা খেতেই হবে তাদের বাড়িতে দলে বলে। আর এই সুযোগটি কখনও হাতছাড়া করিনি। বাড়িতে মা-বাবা আপত্তি করতে পারেন ভেবে তাদেরকে না জানিয়েই যেতাম। একা কী? না দলে বলে। শুধু হিন্দু ঘরের সন্তানেরাই কি? না হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলে মিলে একসঙ্গে বসে যেতাম। বন্ধুদের মা-বোনেরা পরম আদরে খাওয়াতেন।

কিন্তু খেতাম কি এক বাড়িতে? না অনেক বাড়িতে ওই একইভাবে দলে বলে। মনে হতো পেটে আর আঁটবে না কিন্তু খাওয়াতো থামতো না। পরদিন কোন কষ্টও অনুভব করিনি পেটের অসুখ জাতীয় কোন কিছু হয়নি।

ঈদের পর দিনও কোন কোন বছর কোন বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকতো। সুযোগ পেলেই যেতাম। শুধুই কি খাওয়ার আনন্দ? না, তা নয় আদৌ। মেলামেশার আনন্দ-দূর দূর থেকে বাড়িতে ঈদ করতে আসা বন্ধুদের সাথে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মেলামেশার আনন্দ-প্রিয়জনদের সান্নিধ্য পাবার আনন্দ। সবার সাথে হাত মেলানোর আনন্দ-কোলাকুলির আনন্দ। দিব্যি সবাই ভুলে যেতাম কেউ আমরা হিন্দু-কেউ মুসলমান। ধর্মের চাইতে বন্ধুত্বই বড় হয়ে উঠতো। তাই তো এমন খাওয়া দাওয়া-সম্মিলিতভাবে ঈদ উদযাপন।

করোনার বৈশি^ক মহামারীর মধ্যে এলো ঈদ। বাংলাদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাসাধিকাল আগে থেকে সরকার লকডাউন ঘোষণা করে অফিস-আদালত, যান-বাহন চলাচল বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করায় জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। তবে এই লকডাউন আদৌ প্রয়োজন ছিল না-বরং মানুষ বাঁচানোর করোনা সংক্রমন ও মৃত্যু প্রতিরোধের জন্য তার প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু হঠাৎ করে কী দেখা গেল? বিভাগীয় শহরগুলোতে গণ পরিবহন চালু করে আন্তঃজেলা যাত্রী পরিবহন বন্ধ করেই রাখা হলো। বিভাগীয় শহরগুলোতেই নয় শুধু-প্রতি জেলার পরিবহন জেলার অভ্যন্তরে চলা বৈধ করে দেওয়া হলো। ফলাফল? ভয়াবহ।

যেমন ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে, জেলাগুলোর অভ্যন্তরে, বড় বড় নদীর ফেরিঘাটগুলোতে, ফেরির অভ্যন্তরে হাজার হাজার মানুষ পড়ি কি মরি করে ওইসব যানবাহনে উঠছেন, ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ বা ফেরিতে উঠতে গিয়ে ভিড়ের চাপে নদীর জলে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারান-প্রাণ হারান সারাদেশে ট্রাকে-বাসে ঠক্কর লেগে বাস-মোটর সাইকেল, বাসে-বাসে, অপরাপর যান-বাহনে ধাক্কা লেগে বহু লোক প্রাণ হারিয়েছেন-যার সংখ্যা আজও সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয় নি।

সরকারের হুশিয়ারি মাস্ক পরাসহ পথে-ঘাটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বাধ্যতামূলক এবং তা নিশ্চিত করতে পুলিশকে ম্যাজিস্ট্রেসির ক্ষমতা দেওয়া হলো। কিন্তু কার্যত পুলিশকে কোথাও ম্যাজিস্ট্রেসীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি-তবে কোথাও কোথাও আগে থেকেই পথচারীদের মাস্ক পরতে বাধ্য করতে দেখা গেছে। যা হোক সরকারের কোন নিষেধাজ্ঞাই কাজে লাগেনি। জনসমুদ্র গড়ে ওঠে সারা দেশজুড়ে-মাস্ক অল্পসংখ্যক মানুষকে পরতে দেখা গেল-সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই।

আন্তঃজেলা পরিবহন বন্ধ থাকলো। কিন্তু ঈদমুখী, ঘরমুখী মানুষ জেলার আভ্যন্তরীন পরিবহনে চড়ে সীমান্তে গিয়ে নেমে-আবার অপর জেলার সীমান্তে গিয়ে বাসে উঠে বউ-বাচ্চা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশুসহ কী দুর্ভোগেই না পড়লেন। তাদের ভোগ করতে হলো সীমাহীন কষ্ট, গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় লাগলো চারগুণ, খরচ হলো সাত থেকে আটগুন। যে মানুষদের জন্য দেশ, যে মানুষদের জন্য ঈদ-সেই মানুষদের কষ্টের সীমা রইল না। এর চাইতে আন্তঃজেলা গণপরিবহন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু করতে দিলে অন্তত কিছু সংখ্যক মানুষের কষ্টের লাঘব হতো।

না, আমি অস্বাভাবিক এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে যানবাহন, হাট-বাজার, বিপণি-শপিং মল প্রভৃতি স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে দেওয়া বা বাজার বিপণি খোলা রাখার পক্ষে নই। জীবন সর্বাগ্রে। তাই সমস্ত কিছু বন্ধ রাখলে যেমন বিভাগীয়, জেলাগুলোতে, ট্রেন, ফেরি, জাহাজ সকল কিছু বন্ধ রাখা উচিত ছিল বলেই মনে করি। সরকারি এবড়োখেবড়ো সিদ্ধান্তের ফল কারও পক্ষেই মঙ্গল জনক হয়নি-অর্জিত অভিজ্ঞতা তাই বলে।

আমার প্রস্তাবিত অমন কঠোর সিদ্ধান্ত কি ঈদের সময় যৌক্তিক হতো? এমন প্রশ্নের জবাবে বলবে অবশ্যই না। কারণ মানুষের জীবন সর্বাপেক্ষ বিশেষ করে বাংলাদেশে ভারতীয় করোনা ভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়ার বা কঠোরতম বিধি নিষেধের বিকল্প নেই। দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞর তেমনই অভিমত বারংবার দিলেন তা পূরোদস্তুর উপেক্ষিত হয়েছে।

আবার ঈদের জামায়াত খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত না হলেও মসজিদগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানা হয়নি-সবার মুখে মাস্ক ছিল না (ছিল অল্প সংখ্যকের) শারীরিক দূরত্ব আদৌ বজায় রাখা হয়নি। আবার বিধি মেনে ঈদের জামাত হচ্ছে কিনা-সরকারিভাবে তা পর্যবেক্ষণের কোন ব্যবস্থাও চোখে পড়েনি।

সব মিলে গোটা ঈদের সিজনটাই অস্বাভাবিকতায় ভরা। মানুষও মনের আনন্দে, স্বাচ্ছন্দে ঈদের জামাত করতে পারেন নি-পারেন নি নামায শেষে হাত মেলাতে, পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করতে। অথচ ঈদ মানেই তো আনন্দ, পরস্পর পরস্পরের কাছাকাছি আসা, হাত মেলানো, আলিঙ্গন, আহারাদি এবং সর্বোপরি সম্মীলিত নামাজ আদায় ও প্রার্থনার। কিন্তু তা এবার হলো না। হয়নি ২০২০ সালের ঈদুল আজহাতে এবং ঈদ-উজ-জোহাতেও একই বিভীষিকাময় করোনার কারণে।

এমন গণবিচ্ছিন্ন, হুমকি-ধামকি ভরা ঈদকে স্বাভাবিক ঈদ বলা যায় না। মনে পড়ে গেলো, আমাদের বাল্যকালে তখন পাকিস্তান আমল হওয়া সত্ত্বেও পাড়ায় পাড়ায় আমরা ঈদের পরপরই অনুষ্ঠিত করতাম ঈদ-প্রীতি-সম্মেলনী। আজ আর তেমন নাচ, গান, আবৃত্তি, আলোচনা, নাটক সবই আয়োজিত হতো। মানুষ আনন্দের সাথে আরও কাছাকাছি আসতো। আজ আর-তা নেই। করোনার জন্যে কি? না, আদৌ তা নয়। বরং প্রচ্ছন্নভাবে হলেও এক ধরনের ধর্মান্ধতা যেন গ্রাস করতে চলেছে সমাজটাকে।

দুই মাস পরে আবার আসছে ঈদ। আসছে ঈদুল আজহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদ। তখনও যেন এমন দৃশ্য দেখতে না হয়। করোনা দূর হলে তো কথাই নেই-কিন্তু যদি না হয় (যার সম্ভাবনাই বেশি) তা হলে আবার যেন যানজট, জটলা, হাজারে হাজারে দেশে ফেরা-আবার কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার বিপজ্জনক কিছু ঘটার দৃশ্য না দেখতে হয়।

[লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]