অতিরিক্ত সচিব পরিচয়ে প্রতারণা, গ্রেপ্তার

১২ মে জামালপুর এলাকায় এক সরকারি কর্মকর্তার কাছে একটি ফোন আসে। ফোন করা ব্যক্তি নিজেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাসানুজ্জামান কল্লোল বলে পরিচয় দেয়। জামালপুর জেলার কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক রাজিয়া সুলতানার নাম্বারে ফোন করে সচিব পরিচয়ে বলা হয়, কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের শালিকার বিয়ে হয়েছে তোমার জেলায়। তার শালিকার শ্বশুরবাড়িতে ২৫ হাজার টাকা পাঠাতে হবে। তুমি আমার বিকাশ অথবা নগদ নম্বরে ২৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দাও।

একজন অতিরিক্ত সচিবের কাছ থেকে ফোনে এমনভাবে টাকা চাওয়ার বিষয়টি সন্দেহ হয় রাজিয়া সুলতানার। পরে তিনি সচিবের ব্যক্তিগত নম্বর সংগ্রহ করে ফোন করে নিশ্চিত হন ওই সচিব টাকার জন্য তাকে ফোন করেননি। শুধু জাকিয়া সুলতানাই নয় এমন একাধিক সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে ওইদিন টাকা চাওয়া হয়। পরে এ ঘটনায় হৈচে শুরু হলে তদন্তে নামে পুলিশ। অভিযান চালিয়ে সোহেল রানা নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। এরপর বেরিয়ে আসে প্রতারক সোহেল রানার নানা কাহিনী।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মহিদুল ইসলাম জানান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত উপ-সচিবের পরিচয় দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা চাওয়া এবং বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় ভাটারা থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। মামলাটি করেন সচিবের অফিস সহকারী মোস্তাফিজুর রহমান। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলার সূত্র ধরে তদন্ত করতে গিয়ে সোহেল রানার খোঁজ পান তারা। তারা এনালাইসিস করে নিশ্চিত হন প্রতারণার কাজটি সোহেৎ রানাই করেছেন। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করে সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি টিম। গ্রেপ্তার করতে গেলে সে টিমের ওপর মরিচের গুঁড়া ছড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে অনেক কষ্টে তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। এরপর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের প্রতারণার আদ্যোপান্ত স্বীকার করে সোহেল রানা।

ডিবির একই বিভাগের একজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সংবাদকে জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুল হক, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, ভোলা ২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল, সাবেক শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক আইজিপি ও কিশোরগঞ্জ আসনের এমপি নুর মোহাম্মদসহ একাধিক মন্ত্রী এমপির সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের শক্ত অবস্থান প্রচার করত ৪৭ বছর বয়সী সোহেল রানা। মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে হাসিমুখের সেলফি দেখে অনেকেই তাকে সমিহ করতেন। আর এ দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব পরিচয় দিয়ে প্রতরণার মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অভিযানে এ প্রতারককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা মোবাইল। মোবাইল পরীক্ষা করে প্রতারক সোহেল রানার সঙ্গে দেশের এমন কোন মন্ত্রী এমপি বা সরকারি পদস্ত কর্মকর্তা নেই যে যার সঙ্গে সোহেল রানার ছবি পাওয়া যায়নি।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সচিবসহ সরকারি পদস্ত কর্মকর্তাদের অনেকেরই জীবনবৃত্তান্তও তার তার পকেটে। অনলাইন থেকে সচিবদের নাম পরিচয় ফোন নম্বরসহ সবকিছু সংগ্রহ করে। কোন সচিব কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন এর সবকিছুই প্রতারক সোহেল রানার নখদর্পণে।

ডিবির সাইবার টিমের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রতারক সোহেল রানা মিরপুর এলাকার সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী মোল্লার পেছনে পেছনে ঘোরাঘুরি করতেন। তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন। ইলিয়াস আলী মোল্লার সঙ্গে ছবি তুলে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পোস্ট করেছেন। সেই সুবাধে সে নিজেকে ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিতেন। এভাবে সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপিসহ সরকার দলীয় নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিয়ে নানারকম অনৈতিক তদবিরও করতেন। পড়াশুনা খুব বেশি না হলেও চলনে কথাবার্তায় খুব স্মার্ট ছিলেন সোহেল রানা। কোর্ট, টাই পড়ে এমনভাবে চলাফেরা করতেন অনেকেই তাকে দেখে কখনও কখনও সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা বলেও মনে করতেন। আমার আনেক সময় সরকারি দলের নেতা বলেও পরিচয় দিতেন। এভাবে ভুয়া পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ডিবি জানিয়েছে, প্রতারক সোহেল রানার প্রতারণার শিকার হয়েছেন অনেকেই। এখন পর্যন্ত ডিবি প্রতারিত হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজছেন। এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

ডিবির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার টেলিফোনে সংবাদকে জানান, প্রতারক সোহেল রানার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে প্রতারণার অভিযোগে ৪টি, মাদক সংক্রান্ত আইনে ৩টি, মারামারির ঘটনায় ২টি, নারী নির্যাতন আইনে ১টি এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১টি মামলা রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করার সময় শাকিল ইসলাম নামে আরও একজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শাহিনের বিরুদ্ধেও মাদক আইনে দুটি মামলা রয়েছে। প্রতারক সোহেল সংসদ সদস্য স্টিকার ব্যবহার করে গাড়ি নিয়ে চলাফেরার করার সময় ২০১৫ সালে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। পরে তার বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলাও দায়ের হয়েছে।

বুধবার, ২৬ মে ২০২১ , ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৩ শাওয়াল ১৪৪২

অতিরিক্ত সচিব পরিচয়ে প্রতারণা, গ্রেপ্তার

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

১২ মে জামালপুর এলাকায় এক সরকারি কর্মকর্তার কাছে একটি ফোন আসে। ফোন করা ব্যক্তি নিজেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাসানুজ্জামান কল্লোল বলে পরিচয় দেয়। জামালপুর জেলার কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক রাজিয়া সুলতানার নাম্বারে ফোন করে সচিব পরিচয়ে বলা হয়, কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের শালিকার বিয়ে হয়েছে তোমার জেলায়। তার শালিকার শ্বশুরবাড়িতে ২৫ হাজার টাকা পাঠাতে হবে। তুমি আমার বিকাশ অথবা নগদ নম্বরে ২৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দাও।

একজন অতিরিক্ত সচিবের কাছ থেকে ফোনে এমনভাবে টাকা চাওয়ার বিষয়টি সন্দেহ হয় রাজিয়া সুলতানার। পরে তিনি সচিবের ব্যক্তিগত নম্বর সংগ্রহ করে ফোন করে নিশ্চিত হন ওই সচিব টাকার জন্য তাকে ফোন করেননি। শুধু জাকিয়া সুলতানাই নয় এমন একাধিক সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে ওইদিন টাকা চাওয়া হয়। পরে এ ঘটনায় হৈচে শুরু হলে তদন্তে নামে পুলিশ। অভিযান চালিয়ে সোহেল রানা নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। এরপর বেরিয়ে আসে প্রতারক সোহেল রানার নানা কাহিনী।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মহিদুল ইসলাম জানান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত উপ-সচিবের পরিচয় দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা চাওয়া এবং বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় ভাটারা থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। মামলাটি করেন সচিবের অফিস সহকারী মোস্তাফিজুর রহমান। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলার সূত্র ধরে তদন্ত করতে গিয়ে সোহেল রানার খোঁজ পান তারা। তারা এনালাইসিস করে নিশ্চিত হন প্রতারণার কাজটি সোহেৎ রানাই করেছেন। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করে সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি টিম। গ্রেপ্তার করতে গেলে সে টিমের ওপর মরিচের গুঁড়া ছড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে অনেক কষ্টে তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। এরপর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের প্রতারণার আদ্যোপান্ত স্বীকার করে সোহেল রানা।

ডিবির একই বিভাগের একজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সংবাদকে জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুল হক, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, ভোলা ২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল, সাবেক শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক আইজিপি ও কিশোরগঞ্জ আসনের এমপি নুর মোহাম্মদসহ একাধিক মন্ত্রী এমপির সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের শক্ত অবস্থান প্রচার করত ৪৭ বছর বয়সী সোহেল রানা। মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে হাসিমুখের সেলফি দেখে অনেকেই তাকে সমিহ করতেন। আর এ দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব পরিচয় দিয়ে প্রতরণার মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অভিযানে এ প্রতারককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা মোবাইল। মোবাইল পরীক্ষা করে প্রতারক সোহেল রানার সঙ্গে দেশের এমন কোন মন্ত্রী এমপি বা সরকারি পদস্ত কর্মকর্তা নেই যে যার সঙ্গে সোহেল রানার ছবি পাওয়া যায়নি।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সচিবসহ সরকারি পদস্ত কর্মকর্তাদের অনেকেরই জীবনবৃত্তান্তও তার তার পকেটে। অনলাইন থেকে সচিবদের নাম পরিচয় ফোন নম্বরসহ সবকিছু সংগ্রহ করে। কোন সচিব কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন এর সবকিছুই প্রতারক সোহেল রানার নখদর্পণে।

ডিবির সাইবার টিমের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রতারক সোহেল রানা মিরপুর এলাকার সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী মোল্লার পেছনে পেছনে ঘোরাঘুরি করতেন। তার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন। ইলিয়াস আলী মোল্লার সঙ্গে ছবি তুলে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পোস্ট করেছেন। সেই সুবাধে সে নিজেকে ইলিয়াস আলীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিতেন। এভাবে সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপিসহ সরকার দলীয় নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিয়ে নানারকম অনৈতিক তদবিরও করতেন। পড়াশুনা খুব বেশি না হলেও চলনে কথাবার্তায় খুব স্মার্ট ছিলেন সোহেল রানা। কোর্ট, টাই পড়ে এমনভাবে চলাফেরা করতেন অনেকেই তাকে দেখে কখনও কখনও সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা বলেও মনে করতেন। আমার আনেক সময় সরকারি দলের নেতা বলেও পরিচয় দিতেন। এভাবে ভুয়া পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ডিবি জানিয়েছে, প্রতারক সোহেল রানার প্রতারণার শিকার হয়েছেন অনেকেই। এখন পর্যন্ত ডিবি প্রতারিত হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজছেন। এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

ডিবির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার টেলিফোনে সংবাদকে জানান, প্রতারক সোহেল রানার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে প্রতারণার অভিযোগে ৪টি, মাদক সংক্রান্ত আইনে ৩টি, মারামারির ঘটনায় ২টি, নারী নির্যাতন আইনে ১টি এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১টি মামলা রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করার সময় শাকিল ইসলাম নামে আরও একজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শাহিনের বিরুদ্ধেও মাদক আইনে দুটি মামলা রয়েছে। প্রতারক সোহেল সংসদ সদস্য স্টিকার ব্যবহার করে গাড়ি নিয়ে চলাফেরার করার সময় ২০১৫ সালে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। পরে তার বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলাও দায়ের হয়েছে।