বিপ্লবীর বীজমন্ত্র সিরাজীর কাব্য

মিলটন রহমান

এই ব্রহ্মাণ্ডে ‘কবিতা‘ একটি বিস্ময়! এর শরীর এবং মনের খবর পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। একে ভালোবেসে যে কবি নয় সেও হেমলক পান করতে চায়। কেন? কে কবিতা? কী কবিতা? এ প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। আবার আছে অজস্র উত্তর। কথা হচ্ছে অজস্র উত্তর থাকলে তা আর উত্তর হয় না। হয়ে যায় মানুষের ব্যক্তিগত চিন্তা। হাজার বছর ধরে ‘কবিতা’ মানুষকে বুদ করে রেখেছে। কেনো? এ প্রশ্ন করলেই চোখে খোলা আকাশ দাঁড়িয়ে থাকে। সহস্র তারা কিংবা উল্কাপিণ্ডের মধ্য থেকে কোনটা কবিতার রসদ তা আর বলতে পারে না। যদিও কবিরা নানান কথা বলেছেন ‘কবিতা’ নিয়ে। ‘আবেগ যখন চিন্তার সন্ধান পায়, সে চিন্তা খুঁজে পায় শব্দ’ এমন সরল উক্তি করেছেন, রবার্ট ফ্রস্ট। পি বি শেলি একটু ভিন্নভাবে বলেছেন-‘Poetry lifts the veil from

the hidden

beauty of the world,

and makes

familiar object be

as if they were not familiar’ একেও কি আমরা কবিতার জুতসই মাহাত্ম্য বলতে পারি? এরকম তো গল্প, উপন্যাসেও হতে পারে। অজানাকে জানায় স্থাপন করা। তাতে একজন পাঠক কেবল বিস্মিত হতে পারেন।

কবিতা এমনই ঘোরের মধ্যে পতিত করে পাঠক কিংবা কবিকে। আধুনিক শিল্পকলা প্রথাগত শিল্পীদের সূচনাতেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। ফলে সেই সময় থেকেই শিল্পকলার সমজদার শ্রেণির মধ্যে দু’টো ভাগ তৈরি হয়। যারা আধুনিক শিল্পকলা বুঝতে পারতেন আর যারা পারতেন না। সে সময় আধুনিক কবিতা আমাদের একটি জটিল বিশ্বের সন্ধান দিয়েছিলো, সেটিকে টান মেরে উত্তরাধুনিকরা একটি ঘুরপথে উঠিয়ে দিলো কবিতাকে। ফলে কবিতাকে বোঝার যে সময় কিংবা চিন্তা তার উত্তরণেরও একটা সময় দরকার। ফলে কবিতার পাঠককে প্রস্তুতির জন্য কিছু সময় দেয়া প্রয়োজন। সব পাঠকের তো রুচি কিংবা চিন্তা এক নয়। সবাইতো এক রঙ পছন্দ করে না। কবিতা পাঠকদের প্রত্যাশা নিয়েও জটিলতা রয়েছে। বলা হয় মানসিক প্রশান্তির জন্য একজন পাঠক কবিতা পাঠ করে। ঠিক কি তাই? না। আমার অন্তত তা মনে হয় না। কোনো কবিতা যদি সকল প্রতিবন্ধকতা ঠেলে পাঠককে অন্য একটি স্তরে নিয়ে যায় তাকে কি মানসিক প্রশান্তির বলবো। তাও তো না। রাইনার মারিয়া রিলকের এই কবিতাটা পাঠ করে দেখা যেতে পারে- For beauty is nothing but the beginning of terror

Which we are barely able to endure, and it amazes us so,

because it serenely disdains to destroy us.

Every angel is terrible.

(First Elegy)এখনকি মনে হচ্ছে আমার মস্তিষ্কের কোষ এই কবিতা পাঠ শেষে

নিথর-নিশ্চিন্ত! নাকি একজন পাঠক যে কিনা হতাশা-শূন্যতা নিয়ে কবিতা পাঠে নিযুক্ত হলেন তাকে অন্য একটি চিন্তা এবং সেই সাথে কবিতা পাঠের ভিন্ন একটি অনুভূতি দিলো? ষাটের কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ‘আমি জেনারেল‘ কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করতে করতে আমার মনে এসব প্রশ্নই তৈরি হয়েছে। ২০১৮ সালে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। এর পরের বছর ২০১৯ সারে ‘সুভাষিত’ ও ‘ঈহা’ নামে আরো দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অজস্র কবিতা রচিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। প্রাসঙ্গিকভাবে এসব রচনা রাজনৈতিকও বটে। সাতচল্লিশের পরে কাব্যের উদ্ভট একটা ভাষা তৈরি হতে চেয়েছিলো। যদিও জাতীয় চিন্তাচেতনার কাছে পাকিস্তানি সে ধারা টিকে থাকতে পারে নি। যেমন, ভাষা আন্দোলনের আগে ‘পাতলা মেঘের নেকাব খুলিয়া দাও।/হিলাল চাঁদের বাঁকা দুলে ফের চন্দ্রিকা-দোল দাও’-এর মতো অজ¯্র কবিতা রচিত হয়েছিলো। তাতে স্পষ্টতই পাকিস্তানি কাব্য ঘরাণার ছাপ দৃশ্যমান। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যে কাব্যজোছনার বিস্তার হলো তাতে আমরা দেখি বাংলা ভাষা এবং দেশের প্রতি অভাবনীয় প্রকাশ। বায়ান্নর আগে-পরে কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাসে বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলন বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। গানে বিশেষ করে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, আব্দুল লতিফ, কবিতায় মাহবুব উল আলম চৌধুরী, শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, উপন্যাস-চলচ্চিত্রে জহির রায়হান, শওকত ওসমান এবং মঞ্চে মুনির চৌধুরী আমাদের ভাষাসত্তার উপস্থাপন এবং এর গুরুত্ব অনুধাবন করালেন। এরপর ঘুরেফিরে ভাষা এবং ভাষা আন্দোলন আমাদের পরবর্তী শিল্প চর্চায় অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে থেকেছে। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ‘আমি জেনারেল’ কাব্যগ্রন্থ তারই ফসল। একজন জেনারেল নিজের জবানীতে বলছেন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং সমসাময়িক রাজনীতি সম্পর্কে। প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই লক্ষণীয় ক্ষোভ, অভিমান এবং উঠে দাঁড়ানোর বীজমন্ত্র। কবির অভিমান দিয়ে কথা টানা যাক-জল স’রে গেলে ধরা দেয়/এইখানে জলাশয় ছিলো,/আগুন নিভে গেলে অগ্নিমুখ অসহায়-/পাকা ধান ঝরে গেলে মাঠে ইঁদুরও পাবে না তার গর্তের প্রমাণ।‘ (একজন হাবীবুল্লাহ সিরাজী, আমি জেনারেল)।

‘কর্ম’ এবং ‘সময়’ এতটাই ধাবমান। একে দেয়ালে খোদাই করে চিহ্নিত করে রাখা না হলে তার আর নাগাল পাওয়া যায় দায়। একজন বিপ্লবী কিংবা একজন শিল্পীর জন্য এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফরাসি বিপ্লবের যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব তা কিন্তু লিপিবদ্ধ না হলে বিশ্বমানস চেতনায় তা স্থাপন করা সম্ভব হতো না। ঠিক একজন শিল্পীর কাজও একই গুরুত্ব বহন করে। একজন শিল্পী এবং তাঁর কাজ যদি গুরুত্ব না পায় সে দুর্ভাগ্য পাঠক এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের। ‘যদি মরি নিস্তব্ধ প্রহরে/ যদি মরি তোমার গোচরে/ হে পুত্র! প্রিয় আমার/কবরে নামবার আগে ভষ্ম করে দিও/ আমার সকল কর্ম-সমাচার/ মুছে ফেলো চেনা কোন নাম/একজন হাবীবুল্লাহ সিরাজী।’ একই কবিতায় জেনারেল তাঁর সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিলেন। কবি নিজের সম্পর্কে এ কথা বলছেন কিনা তা কিন্তু বিবেচ্য বিষয় নয়। এই কবিতায় আমরা দেখি বিবিধ অনুরণন। আমরা বিস্মৃতিপ্রবণ এক জাতি। জ্ঞাতী চিহ্ন মুছে ফেলতেও উদ্যত আমাদের হাত। আমাদের ভাষা আন্দোলন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের গণঅভ্যুত্থান এমন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে বিতর্ক করতে আমরা কুণ্ঠাবোধ করি। এই যে হতাশা তা থেকে উত্থিত ক্ষোভ এই কবিতায় বিধৃত। আসেলই কি তিনি সব কর্ম মুছে ফেলতে বলেছেন? না, কবি যে অভিমান প্রকাশ করেছেন, তাতে রয়েছে বিক্ষোভ, যা কিনা একজন পাঠক, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে ‘লিগেসি’ সংরক্ষণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

কবি নিজেও কিন্তু সেই শর্ত মানছেন। দেখুন কবি কীভাবে নিজের স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখছেন, ‘তাঁর সঙ্গে ছিলাম/তাঁর সঙ্গে বেঁচেছিলাম ঝুল কারাগারে/ নষ্টদের ক্ষুর থেকে শত হাত দূরে/প্রকৃতির রূপে এক মধুর আড়ালে/ভয়হীন শর্তহীন রঙের আশায়।’ কবি কার সঙ্গে থাকার কথা বলছেন? কার সঙ্গে ঝুল কারাগারে বেঁচেছিলেন? কোন সে রঙের খোঁজ করছিলেন কবি? একটু এগিয়ে গেলেই পাওয়া যায় সে খবর। ‘তাঁর সঙ্গে আছি/ বত্রিশ বিস্তার ক’রে একাত্তর যাচি/ মানুষের নিশ্বাসের অতি কাছাকাছি/ একখণ্ড মাটির মৌমাছি/ জীবন বন্ধুর, বঙ্গবন্ধুতেই বাঁচি।’ ‘তাঁর সঙ্গ’ আমি জেনারেল কাব্যগ্রন্থের এমন একটি কবিতা। সেই একাত্তরে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে বেঁচেছিলেন। যুদ্ধ রঙের একটি স্বাধীনতা এনেছিলেন। যে রঙের প্রত্যাশায় জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ছিলেন। যে জীবন যাপন স্বাধীনতা অর্জনের পরেও শেষ হয় নি। এখনো তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথেই বেঁচে থাকেন। কবি এতে করে আরো একটি চ্যালেঞ্জ আমাদের ছুঁড়ে দিলেন, বললেন পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু মরে নাই। তিনি কবির মতো অসংখ্য যোদ্ধা এবং মানুষের মধ্যে বেঁচে আছেন। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড যতদিন থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন। এটাই একজন জেনারেল আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

আরো পিছনে যদি ফিরে তাকাই জেনারেলের চোখে, দেখি ভাষার উদার জমিন। যে জমিনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো বাড়াবাড়ি নেই। আছে ভাষার জন্য প্রয়োজনীয় সাহস এবং আকাক্সক্ষা। তার জন্য ভাষাজ্ঞানী কিংবা কবি হওয়ার প্রয়োজন নেই। জেনারেল বলছেন, ‘আমার বাবা কবি ছিলেন না/ময়দানে উড়েছিলো তন্ত্র/শিমুলের জন্য লাল/এবং সোনালীর জন্য পাট/মাটি তো অপরাজেয়/ফাল্গুন ছিটিয়ে মূল।’ মানুষের চিন্তা উস্কে দেয় প্রকৃতি। সেই চিন্তা প্রকাশের সূত্রই ভাষা। এর প্রকাশের জন্য কবি হতে হয় না। প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশ মানুষের মুখে ভাষার বুলি তুলে দেয়। একজন মানুষ ভাষার ছন্দ তখনই খুঁজে পায় যখন আশপাশের প্রকৃতি এবং পার্শ্বস্থিত মানবকুল তার টোন বুঝতে পারে। এই ভাষারই অধিকারী কবির পিতা। এঁরাই আমাদের প্রকৃত ভাষাবিদ। একটি ভাষা তাদের মধ্যেই অজ¯্র সময়ের ভাষা হয়ে বেঁচে থাকে। কবিতো এখানে নিজের পিতার কথা বলেছেন। তাই কি? আপাতদৃশ্যে তা মনে হলেও এ ‘বাবা’ একটি ভাষাভাষি মানবগোষ্ঠির পিতা। তিনি একক নন অসংখ্য। ভাষা তো সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। এর জন্য বিদ্যার প্রয়োজন পড়ে কি? সাধারণ অর্থে না। ভাষার কাছে একটি সংস্কৃতির মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং রীতিনীতির গুরুত্ব রয়েছে। সেভাবেই মানুষের মুখে ‘কালচার’ পরিবাহিত ভাষার প্রকাশ।

বিশ্ব চরাচরে ‘বাংলাদেশ’ একটি ভিন্ন চরিত্র-ভূমি। এর বিভিন্ন স্তরে যে ফ্লেবার তা বিভিন্নভাবে গীত হয়ে আছে, সঙ্গীত, সাহিত্য এবং শিল্পকলায়। স্বাধীন এবং স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ কাব্যসাহিত্যে বিপুল বৈভবে উচ্চকিত। অসংখ্য পঙ্ক্তি বাংলাদেশের বর্ণনায় শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে। শামসুর রাহমান নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, আবুল হাসান, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং হেলাল হাফিজসহ অনেক নমস্য কবি রচনায় স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ বিবিধ মূর্ছনায় রণিত হয়েছে। আবুল হাসান যখন বলেন, ‘...তবে কি বউটি রাজহাস? তবে কি শিশুটি আজ/সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ?/অনেক রক্ত যুদ্ধ গেলো / অনেক রক্ত গেলো,/ শিমুল তুলোর মতো সোনারুপো ছড়ালো বাতাস।/... তবে কি আমার ভাই আজ /ঐ স্বাধীন পতাকা?/ তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদিতে উৎসব?’ তখন ভিন্ন ব্যঞ্জনায় স্বাধীনতা আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়। আমরা যাবতীয় হারানো এবং তার বদলে প্রাপ্তির রেখাগুলো নানানভাবে দৃশ্যমান দেখি। এ দৃশ্য অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। এ দৃশ্য ‘তিমিরের বেদিতে উৎসব’-এর মতো অদম্য শক্তিতে আমাদের সম্মুখে দাঁড়ায়। আর এর বিস্তৃত প্রকাশ আমরা দেখতে পাই হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা ‘তিনি বাংলাদেশের কথা বললেন’-এ। আবুল হাসানের কবিতায় যেভাবে হারানো এবং প্রাপ্তির সময় ধারণ করার আছে, সে একই সময় ও সে সময়ের কণ্ঠস্বর ধরে রাখলেন কবি- ‘নুন ব’লেছিলো চাই, কাঁটাও বলেছে চাই/ মেঘ ব’লেছিলো চাই, টিয়া বলে চাই/ সূর্যের গন্ধের মতো মার্চ বলে চাই/ তিনি ব’ললেন চাই- আমাদের স্বাধীনতা চাই।’ আমার কাছে এই কবিতাটি অনতিক্রম্য ইতিহাস- যা কখনো অতিক্রম করা সম্ভব নয়। সেই ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের পৌরুষদীপ্ত অবিচল নের্র্তৃত্বের বক্তব্য তিনি কবিতায় লিপিবদ্ধ করেছেন। ফলে এই কবিতাটি কেবল কাব্যগুণেই সমৃদ্ধ নয়, এর রয়েছে ঐতিহাসিক ভিত্তি। একই কবিতাতেই কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলে দিলেন ভবিষ্যতের কথা- ‘আস্তিনের ঝুল আর স্যান্ডেলের ফিতে/ পাইপের ডাঁটি ছুঁয়ে চশমার কাচ/গাঢ় হ’লে ঘন হ’লে বঙ্গবন্ধু হয়/ নামে-নামে ধূলিকণা বাংলাদেশ কয়।’ পাঠকের আর বুঝতে অসুবিধা হয় না কবি কার কথা বলছেন। সেই মহান পুরুষ, যিনি একটি কবিতা রচেছিলেন ‘বাংলাদেশ’ নামে। এই কবিতাকে ঘিরেই রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা-গল্প-উপন্যাস। সে সবের মধ্যে ‘আমি জেনারেল’ কাব্যগ্রন্থের এ কবিতাটি পাঠকের কাছে চেনা হয়ে রইবে তার ঐতিহাসিকতার কারণে। আমরা একটা প্রশ্নের সম্মুখিন প্রায়ই হই। কবিতা সমাজে বা রাষ্ট্রে কী প্রভাব ফেলে? এ প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত। তবে ‘তিনি বাংলাদেশের কথা বললেন’- এমন প্রশ্নের উত্তর জারি রেখেছে। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির সম্মানিত ফেলো স্যার কী আজেগবু একবার গোলটেবিল বৈঠকে বলেছিলেন, ‘একটি জাতি এবং ব্যক্তির বিকাশের জন্য ইতিহাস অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানানো অবশ্যকীয়। তাহলে তারা একজন নাগরিক হিসেবে নিজের করণীয় সম্পর্কে সচেতন হবে।’ আমি মনে করি হাবীবুল্লাহ সিরাজী কাব্যগ্রন্থ ‘আমি জেনারেল’-এ সে চিহ্নই খোদাই করে দিলেন। সেই গুরু দায়িত্ব পালন করলেন। আজকের প্রজজেন্মর হাত ধরে আগামী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এ কাব্যগ্রন্থ ইতিহাসের কথা বলবে। নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের সন্ধান দেবে।

একজন সংগ্রামীর মুখে তার অভিমানও অহংবোধে বেজে ওঠে। পশ্চিমা বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের স্মরণে এবং যে সব যোদ্ধা বেঁচে আছেন তাদের সম্মানে যে আয়োজন চোখে পড়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্মানে তেমন চোখে পড়ে না। এটা জাতি হিসেবে আমাদের অক্ষমতা। কিন্তু যে একবার যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে তাঁর তো অহংবোধের কমতি থাকার কথা নয়। ফলে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী যখন বলেন- ‘আমি তো তাহার কোন পথ নই/আমি তো তোমার কোন মত নই/ নই অসম্ভবের খনি/যাতে ননী জমবে পাতে-/প্রভাত অপূর্ব হ’লে সূর্যবর্ণে/ অগ্নিময় হবে যত ক্ষত/আমারি মতো জেনারেল/ সবুজ ও লাল।’ তখন পাঠক হিসেবে আমি প্রচণ্ড স্নায়ু টান করে স্থির করি ইন্দ্রীয়। সেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীয় ঘোষণায় আমি আর কারো উদযাপনের অপেক্ষা করি না। বুঝে যাই এমন সংগ্রামীর ত্যাগের অহংবোধ নিজে থেকেই উদযাপিত হতে থাকে প্রতিটা ক্ষণ। ‘আমি জেনারেল’-এর এ কাব্যনিশ্বাস পুরো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী দীর্ঘ নিশ্বাসকে কবিতায় টিউন করে বাজিয়ে দিলেন পাঠকের তন্ত্রীতে। যেভাবে অন্য কাউকে বলতে দেখি নি। কবিতাটি পাঠ করতে করতে আমার চোখে একটি দৃশ্য ভেসে উঠেছে বারবার। আমি দেখছি একজন মুক্তিযোদ্ধা, নিজের বীরগাথা স্মরণ করতে করতে নানান অসঙ্গতির মুখোমুখি হচ্ছেন। কোনো কিছুকেই আর নিজের মনে হয় না। কোনো মতই আর নিজের মত মনে হয় না। এই অমিলের যে ক্ষত তাই প্রতিবাদী হয়ে উঠছে। নিজেকে সে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ভাবতে চায়। নিজেকে সে ‘জেনারেল’ ভাবে। এই জেনারেল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মুখপাত্র। তাঁর বক্তব্যই আমাদের নিহত-জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষা।

সৃষ্টির উন্মাদনা অনেক সময় শিল্পীকে স্বার্থপর করে তোলে। কোথায় তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ হলো তাই প্রধান। ক্লড মোনের একটি ঘটনা শিল্পীর এই মন বুঝতে আমাদের সহায়তা করতে পারে। মৃত্যুর পর শায়িত স্ত্রী কেমিলার মুখের উপর যে ছায়া পড়েছিলো সেই ফর্মের দিকেই নাকি মোনে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। সে সময় শোক নয়, তার মনে সৃষ্টির প্রণোদনাই আন্দোলিত হয়েছিলো। যদিও স্বম্বিত ফিরে পেয়ে তিনি লজ্জিত হয়েছিলেন। কিন্তু মোনে মৃত স্ত্রীর মুখের ওপর যে বেগুনি ছায়ার দিকে ঘোরগ্রস্ত হয়েছিলেন সেটি ছিলো শিল্পীর মন। তা কখনোই একজন মৃত স্ত্রীর স্বামীর নয়। সে হিসেবে তাতে কোনো অপরাধ কিংবা লজ্জার কিছু নেই। ‘আমি জেনারেল’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে কোথাও কোথাও আমার এমন ঘোরগ্রস্ত মোনেই মনে হয়েছে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে। অসামান্য পাপ,/ আর অরণ্য প্রান্তর,/ সঞ্চয়ের ক্ষুদ্র জলাশয়, জাগে যে পিপাসায়/ নেই কোন ইতি/ মানা করো চাকার প্রনতি/ জেনারেল, এসো এই বেলা/ মাথাটি ঘুরিয়ে দিয়ে/ পশ্চাৎ বা শূন্যে ধরি/ বারুদ-বেহালা’।

কিংবা “দূর থেকে তো এলাম, ঘুম।/পায়ের ভার যে জোড়াতালি/ কোথায় ওড়ো সর্ষেমধু/কথা ছিলো/শীত ফুরোলে হরিণ দেখার!/চা-পাতা আর বরফকুচি/রাজারবাগে রাত্রিশেষের গলি/ ও মলি, তোর চাঁদ নামিয়ে আন/মুখটা এবার দেখি! খুব দূর থেকে এলাম, মরি?’

এ কাব্যগ্রন্থের মজ্জায় এমন হাড়ের খবর রক্তের নালিতে কান পাতলেই টের পাওয়া যায়। একজন কবির এটাই দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। কবি যে সময়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে যায়, তা থেকে মুঠো মুঠো দানা তুলে যে প্রান্তরে ছড়িয়ে দেয় তাই শিল্পভূমিতে রূপান্তর হয়। এ ভূমি হতে পারে পুষ্পস্নাত কিংবা হতে পারে রক্ত¯œাত।

‘আকাশের নীচে কি আর মাথা তোলার অধিকার নেই?/মাটির উপর কি তাদের দাঁড়ানোর এক্তিয়ার নেই?/ খুব ছোট এই ধরাধামে খুব বড়ো-বড়ো ফাঁক/ তার মধ্যে কসরৎ চলে, গন্ধ বলে বর্ণ-ধর্ম-বিত্ত-ভাষা।/ মানুষ বলার জন্য আজ মানুষের খুব টানাটানি লেগেছে/ এক তিল আশা, মৃত্যু সম্মুখে রেখে সামান্য ভালোবাসা/ রোহিঙ্গাও যে চায়!’

এখানে মানুষের মৌলিক অধিকারের দাবি নিয়ে কবি দাঁড়িয়েছেন। ‘মানুষ বলার জন্য আজ মানুষের খুব টানাটানি লেগেছে’ এই যে ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ এখানেই কবি সংকটের ভেতর দিয়ে সম্মুখে নিয়ে এসেছেন ভৌগোলিক রাজনীতি। কবি যে রাজনীতি সচেতন তা আমরা পুরো কাব্যগ্রন্থেই বুঝতে পারি। তারপরও এই কবিতায় এসে সেই চিহ্নটি স্মারকে রূপ নিয়েছে। ‘রোহিঙ্গা’ একটি রাজনৈতিক সংকট। একটি জাতি রাজনীতির কলে কীভাবে পিষ্ঠ হচ্ছে, যাদের মানুষ পরিচয় আজ প্রশ্নের সম্মুখিন, সে সংটাপন্ন ভূমিতে কবি আলো ফেলেছেন। যদিও ‘রোহিঙ্গা’ বিষয়টি নানান বিতর্কে দু‘টি রাষ্ট্রের শীড় পীড়ার কারণ হয়েছে। এর যে একটি রাজনৈতিক ভুল রয়েছে তার দিকেই কবি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। আইরিশ কবি সিমাস হিনির একটি বক্তব্য মনে পড়ছে। সম্ভবত নোবেল প্রাপ্তির পর দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, সভ্যতার দলিলগুলো রক্ত এবং অশ্রুতে লেখা হয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা, স্বাধীন বাংলাদেশের দলিল রক্তেই লেখা। ‘রোহিঙ্গা’ এই বুর্জোয়া রাজনীতিরই অংশ। হাবীবুল্লাহ সিরাজী সেই ইতিহাস এবং ঘটনাগুলোর কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়াস জারি রেখেছেন।

‘আমি জেনারেল’ কাব্যগ্রন্থটির জেনারেল একজন বাঁশিওয়ালা। যে কিনা বিভিন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্বের ভেতর দিয়ে পরিপার্শ্বকে দাঁড় করাচ্ছে সমসাময়িকতায়। যে বাঁশি সকরুণ সুরে যেমন অসঙ্গতির কথা বলছে, তেমন ভিন্ন সুরে কেঁপে উঠছে ক্ষোভে। আবার সে বাঁশি কখনো মানবিক কখনোবা প্রণত নেতার প্রতি। কবিতায় কোমল প্রেম নূপুরের মতো বাজে। তাহলে ‘আমি জেনারেল’ পাঠকের মনে কেমন অনুভূতি জাগায়! এটি বিউগলের সুরে রণতরীর মতো চলে। আবার অভিমানে বক্ষ বিদীর্ণ করে কেটে ফেলে প্রেম ও অপ্রেমের সকল জড়তা। এমন একটি কাব্যগ্রন্থই তো মহাকালের বুকে তিলক এঁকে দেবে। তাই নয় কি?

বৃহস্পতিবার, ২৭ মে ২০২১ , ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৪ শাওয়াল ১৪৪২

বিপ্লবীর বীজমন্ত্র সিরাজীর কাব্য

মিলটন রহমান

image

এই ব্রহ্মাণ্ডে ‘কবিতা‘ একটি বিস্ময়! এর শরীর এবং মনের খবর পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। একে ভালোবেসে যে কবি নয় সেও হেমলক পান করতে চায়। কেন? কে কবিতা? কী কবিতা? এ প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। আবার আছে অজস্র উত্তর। কথা হচ্ছে অজস্র উত্তর থাকলে তা আর উত্তর হয় না। হয়ে যায় মানুষের ব্যক্তিগত চিন্তা। হাজার বছর ধরে ‘কবিতা’ মানুষকে বুদ করে রেখেছে। কেনো? এ প্রশ্ন করলেই চোখে খোলা আকাশ দাঁড়িয়ে থাকে। সহস্র তারা কিংবা উল্কাপিণ্ডের মধ্য থেকে কোনটা কবিতার রসদ তা আর বলতে পারে না। যদিও কবিরা নানান কথা বলেছেন ‘কবিতা’ নিয়ে। ‘আবেগ যখন চিন্তার সন্ধান পায়, সে চিন্তা খুঁজে পায় শব্দ’ এমন সরল উক্তি করেছেন, রবার্ট ফ্রস্ট। পি বি শেলি একটু ভিন্নভাবে বলেছেন-‘Poetry lifts the veil from

the hidden

beauty of the world,

and makes

familiar object be

as if they were not familiar’ একেও কি আমরা কবিতার জুতসই মাহাত্ম্য বলতে পারি? এরকম তো গল্প, উপন্যাসেও হতে পারে। অজানাকে জানায় স্থাপন করা। তাতে একজন পাঠক কেবল বিস্মিত হতে পারেন।

কবিতা এমনই ঘোরের মধ্যে পতিত করে পাঠক কিংবা কবিকে। আধুনিক শিল্পকলা প্রথাগত শিল্পীদের সূচনাতেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। ফলে সেই সময় থেকেই শিল্পকলার সমজদার শ্রেণির মধ্যে দু’টো ভাগ তৈরি হয়। যারা আধুনিক শিল্পকলা বুঝতে পারতেন আর যারা পারতেন না। সে সময় আধুনিক কবিতা আমাদের একটি জটিল বিশ্বের সন্ধান দিয়েছিলো, সেটিকে টান মেরে উত্তরাধুনিকরা একটি ঘুরপথে উঠিয়ে দিলো কবিতাকে। ফলে কবিতাকে বোঝার যে সময় কিংবা চিন্তা তার উত্তরণেরও একটা সময় দরকার। ফলে কবিতার পাঠককে প্রস্তুতির জন্য কিছু সময় দেয়া প্রয়োজন। সব পাঠকের তো রুচি কিংবা চিন্তা এক নয়। সবাইতো এক রঙ পছন্দ করে না। কবিতা পাঠকদের প্রত্যাশা নিয়েও জটিলতা রয়েছে। বলা হয় মানসিক প্রশান্তির জন্য একজন পাঠক কবিতা পাঠ করে। ঠিক কি তাই? না। আমার অন্তত তা মনে হয় না। কোনো কবিতা যদি সকল প্রতিবন্ধকতা ঠেলে পাঠককে অন্য একটি স্তরে নিয়ে যায় তাকে কি মানসিক প্রশান্তির বলবো। তাও তো না। রাইনার মারিয়া রিলকের এই কবিতাটা পাঠ করে দেখা যেতে পারে- For beauty is nothing but the beginning of terror

Which we are barely able to endure, and it amazes us so,

because it serenely disdains to destroy us.

Every angel is terrible.

(First Elegy)এখনকি মনে হচ্ছে আমার মস্তিষ্কের কোষ এই কবিতা পাঠ শেষে

নিথর-নিশ্চিন্ত! নাকি একজন পাঠক যে কিনা হতাশা-শূন্যতা নিয়ে কবিতা পাঠে নিযুক্ত হলেন তাকে অন্য একটি চিন্তা এবং সেই সাথে কবিতা পাঠের ভিন্ন একটি অনুভূতি দিলো? ষাটের কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ‘আমি জেনারেল‘ কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করতে করতে আমার মনে এসব প্রশ্নই তৈরি হয়েছে। ২০১৮ সালে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। এর পরের বছর ২০১৯ সারে ‘সুভাষিত’ ও ‘ঈহা’ নামে আরো দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অজস্র কবিতা রচিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। প্রাসঙ্গিকভাবে এসব রচনা রাজনৈতিকও বটে। সাতচল্লিশের পরে কাব্যের উদ্ভট একটা ভাষা তৈরি হতে চেয়েছিলো। যদিও জাতীয় চিন্তাচেতনার কাছে পাকিস্তানি সে ধারা টিকে থাকতে পারে নি। যেমন, ভাষা আন্দোলনের আগে ‘পাতলা মেঘের নেকাব খুলিয়া দাও।/হিলাল চাঁদের বাঁকা দুলে ফের চন্দ্রিকা-দোল দাও’-এর মতো অজ¯্র কবিতা রচিত হয়েছিলো। তাতে স্পষ্টতই পাকিস্তানি কাব্য ঘরাণার ছাপ দৃশ্যমান। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যে কাব্যজোছনার বিস্তার হলো তাতে আমরা দেখি বাংলা ভাষা এবং দেশের প্রতি অভাবনীয় প্রকাশ। বায়ান্নর আগে-পরে কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাসে বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলন বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। গানে বিশেষ করে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, আব্দুল লতিফ, কবিতায় মাহবুব উল আলম চৌধুরী, শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, উপন্যাস-চলচ্চিত্রে জহির রায়হান, শওকত ওসমান এবং মঞ্চে মুনির চৌধুরী আমাদের ভাষাসত্তার উপস্থাপন এবং এর গুরুত্ব অনুধাবন করালেন। এরপর ঘুরেফিরে ভাষা এবং ভাষা আন্দোলন আমাদের পরবর্তী শিল্প চর্চায় অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে থেকেছে। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ‘আমি জেনারেল’ কাব্যগ্রন্থ তারই ফসল। একজন জেনারেল নিজের জবানীতে বলছেন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং সমসাময়িক রাজনীতি সম্পর্কে। প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই লক্ষণীয় ক্ষোভ, অভিমান এবং উঠে দাঁড়ানোর বীজমন্ত্র। কবির অভিমান দিয়ে কথা টানা যাক-জল স’রে গেলে ধরা দেয়/এইখানে জলাশয় ছিলো,/আগুন নিভে গেলে অগ্নিমুখ অসহায়-/পাকা ধান ঝরে গেলে মাঠে ইঁদুরও পাবে না তার গর্তের প্রমাণ।‘ (একজন হাবীবুল্লাহ সিরাজী, আমি জেনারেল)।

‘কর্ম’ এবং ‘সময়’ এতটাই ধাবমান। একে দেয়ালে খোদাই করে চিহ্নিত করে রাখা না হলে তার আর নাগাল পাওয়া যায় দায়। একজন বিপ্লবী কিংবা একজন শিল্পীর জন্য এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফরাসি বিপ্লবের যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব তা কিন্তু লিপিবদ্ধ না হলে বিশ্বমানস চেতনায় তা স্থাপন করা সম্ভব হতো না। ঠিক একজন শিল্পীর কাজও একই গুরুত্ব বহন করে। একজন শিল্পী এবং তাঁর কাজ যদি গুরুত্ব না পায় সে দুর্ভাগ্য পাঠক এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের। ‘যদি মরি নিস্তব্ধ প্রহরে/ যদি মরি তোমার গোচরে/ হে পুত্র! প্রিয় আমার/কবরে নামবার আগে ভষ্ম করে দিও/ আমার সকল কর্ম-সমাচার/ মুছে ফেলো চেনা কোন নাম/একজন হাবীবুল্লাহ সিরাজী।’ একই কবিতায় জেনারেল তাঁর সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিলেন। কবি নিজের সম্পর্কে এ কথা বলছেন কিনা তা কিন্তু বিবেচ্য বিষয় নয়। এই কবিতায় আমরা দেখি বিবিধ অনুরণন। আমরা বিস্মৃতিপ্রবণ এক জাতি। জ্ঞাতী চিহ্ন মুছে ফেলতেও উদ্যত আমাদের হাত। আমাদের ভাষা আন্দোলন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের গণঅভ্যুত্থান এমন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে বিতর্ক করতে আমরা কুণ্ঠাবোধ করি। এই যে হতাশা তা থেকে উত্থিত ক্ষোভ এই কবিতায় বিধৃত। আসেলই কি তিনি সব কর্ম মুছে ফেলতে বলেছেন? না, কবি যে অভিমান প্রকাশ করেছেন, তাতে রয়েছে বিক্ষোভ, যা কিনা একজন পাঠক, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে ‘লিগেসি’ সংরক্ষণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

কবি নিজেও কিন্তু সেই শর্ত মানছেন। দেখুন কবি কীভাবে নিজের স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখছেন, ‘তাঁর সঙ্গে ছিলাম/তাঁর সঙ্গে বেঁচেছিলাম ঝুল কারাগারে/ নষ্টদের ক্ষুর থেকে শত হাত দূরে/প্রকৃতির রূপে এক মধুর আড়ালে/ভয়হীন শর্তহীন রঙের আশায়।’ কবি কার সঙ্গে থাকার কথা বলছেন? কার সঙ্গে ঝুল কারাগারে বেঁচেছিলেন? কোন সে রঙের খোঁজ করছিলেন কবি? একটু এগিয়ে গেলেই পাওয়া যায় সে খবর। ‘তাঁর সঙ্গে আছি/ বত্রিশ বিস্তার ক’রে একাত্তর যাচি/ মানুষের নিশ্বাসের অতি কাছাকাছি/ একখণ্ড মাটির মৌমাছি/ জীবন বন্ধুর, বঙ্গবন্ধুতেই বাঁচি।’ ‘তাঁর সঙ্গ’ আমি জেনারেল কাব্যগ্রন্থের এমন একটি কবিতা। সেই একাত্তরে তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে বেঁচেছিলেন। যুদ্ধ রঙের একটি স্বাধীনতা এনেছিলেন। যে রঙের প্রত্যাশায় জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ছিলেন। যে জীবন যাপন স্বাধীনতা অর্জনের পরেও শেষ হয় নি। এখনো তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথেই বেঁচে থাকেন। কবি এতে করে আরো একটি চ্যালেঞ্জ আমাদের ছুঁড়ে দিলেন, বললেন পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু মরে নাই। তিনি কবির মতো অসংখ্য যোদ্ধা এবং মানুষের মধ্যে বেঁচে আছেন। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড যতদিন থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবেন। এটাই একজন জেনারেল আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

আরো পিছনে যদি ফিরে তাকাই জেনারেলের চোখে, দেখি ভাষার উদার জমিন। যে জমিনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোনো বাড়াবাড়ি নেই। আছে ভাষার জন্য প্রয়োজনীয় সাহস এবং আকাক্সক্ষা। তার জন্য ভাষাজ্ঞানী কিংবা কবি হওয়ার প্রয়োজন নেই। জেনারেল বলছেন, ‘আমার বাবা কবি ছিলেন না/ময়দানে উড়েছিলো তন্ত্র/শিমুলের জন্য লাল/এবং সোনালীর জন্য পাট/মাটি তো অপরাজেয়/ফাল্গুন ছিটিয়ে মূল।’ মানুষের চিন্তা উস্কে দেয় প্রকৃতি। সেই চিন্তা প্রকাশের সূত্রই ভাষা। এর প্রকাশের জন্য কবি হতে হয় না। প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশ মানুষের মুখে ভাষার বুলি তুলে দেয়। একজন মানুষ ভাষার ছন্দ তখনই খুঁজে পায় যখন আশপাশের প্রকৃতি এবং পার্শ্বস্থিত মানবকুল তার টোন বুঝতে পারে। এই ভাষারই অধিকারী কবির পিতা। এঁরাই আমাদের প্রকৃত ভাষাবিদ। একটি ভাষা তাদের মধ্যেই অজ¯্র সময়ের ভাষা হয়ে বেঁচে থাকে। কবিতো এখানে নিজের পিতার কথা বলেছেন। তাই কি? আপাতদৃশ্যে তা মনে হলেও এ ‘বাবা’ একটি ভাষাভাষি মানবগোষ্ঠির পিতা। তিনি একক নন অসংখ্য। ভাষা তো সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। এর জন্য বিদ্যার প্রয়োজন পড়ে কি? সাধারণ অর্থে না। ভাষার কাছে একটি সংস্কৃতির মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং রীতিনীতির গুরুত্ব রয়েছে। সেভাবেই মানুষের মুখে ‘কালচার’ পরিবাহিত ভাষার প্রকাশ।

বিশ্ব চরাচরে ‘বাংলাদেশ’ একটি ভিন্ন চরিত্র-ভূমি। এর বিভিন্ন স্তরে যে ফ্লেবার তা বিভিন্নভাবে গীত হয়ে আছে, সঙ্গীত, সাহিত্য এবং শিল্পকলায়। স্বাধীন এবং স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ কাব্যসাহিত্যে বিপুল বৈভবে উচ্চকিত। অসংখ্য পঙ্ক্তি বাংলাদেশের বর্ণনায় শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে উঠেছে। শামসুর রাহমান নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, আবুল হাসান, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং হেলাল হাফিজসহ অনেক নমস্য কবি রচনায় স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ বিবিধ মূর্ছনায় রণিত হয়েছে। আবুল হাসান যখন বলেন, ‘...তবে কি বউটি রাজহাস? তবে কি শিশুটি আজ/সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ?/অনেক রক্ত যুদ্ধ গেলো / অনেক রক্ত গেলো,/ শিমুল তুলোর মতো সোনারুপো ছড়ালো বাতাস।/... তবে কি আমার ভাই আজ /ঐ স্বাধীন পতাকা?/ তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদিতে উৎসব?’ তখন ভিন্ন ব্যঞ্জনায় স্বাধীনতা আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়। আমরা যাবতীয় হারানো এবং তার বদলে প্রাপ্তির রেখাগুলো নানানভাবে দৃশ্যমান দেখি। এ দৃশ্য অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। এ দৃশ্য ‘তিমিরের বেদিতে উৎসব’-এর মতো অদম্য শক্তিতে আমাদের সম্মুখে দাঁড়ায়। আর এর বিস্তৃত প্রকাশ আমরা দেখতে পাই হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা ‘তিনি বাংলাদেশের কথা বললেন’-এ। আবুল হাসানের কবিতায় যেভাবে হারানো এবং প্রাপ্তির সময় ধারণ করার আছে, সে একই সময় ও সে সময়ের কণ্ঠস্বর ধরে রাখলেন কবি- ‘নুন ব’লেছিলো চাই, কাঁটাও বলেছে চাই/ মেঘ ব’লেছিলো চাই, টিয়া বলে চাই/ সূর্যের গন্ধের মতো মার্চ বলে চাই/ তিনি ব’ললেন চাই- আমাদের স্বাধীনতা চাই।’ আমার কাছে এই কবিতাটি অনতিক্রম্য ইতিহাস- যা কখনো অতিক্রম করা সম্ভব নয়। সেই ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের পৌরুষদীপ্ত অবিচল নের্র্তৃত্বের বক্তব্য তিনি কবিতায় লিপিবদ্ধ করেছেন। ফলে এই কবিতাটি কেবল কাব্যগুণেই সমৃদ্ধ নয়, এর রয়েছে ঐতিহাসিক ভিত্তি। একই কবিতাতেই কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলে দিলেন ভবিষ্যতের কথা- ‘আস্তিনের ঝুল আর স্যান্ডেলের ফিতে/ পাইপের ডাঁটি ছুঁয়ে চশমার কাচ/গাঢ় হ’লে ঘন হ’লে বঙ্গবন্ধু হয়/ নামে-নামে ধূলিকণা বাংলাদেশ কয়।’ পাঠকের আর বুঝতে অসুবিধা হয় না কবি কার কথা বলছেন। সেই মহান পুরুষ, যিনি একটি কবিতা রচেছিলেন ‘বাংলাদেশ’ নামে। এই কবিতাকে ঘিরেই রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা-গল্প-উপন্যাস। সে সবের মধ্যে ‘আমি জেনারেল’ কাব্যগ্রন্থের এ কবিতাটি পাঠকের কাছে চেনা হয়ে রইবে তার ঐতিহাসিকতার কারণে। আমরা একটা প্রশ্নের সম্মুখিন প্রায়ই হই। কবিতা সমাজে বা রাষ্ট্রে কী প্রভাব ফেলে? এ প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত। তবে ‘তিনি বাংলাদেশের কথা বললেন’- এমন প্রশ্নের উত্তর জারি রেখেছে। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির সম্মানিত ফেলো স্যার কী আজেগবু একবার গোলটেবিল বৈঠকে বলেছিলেন, ‘একটি জাতি এবং ব্যক্তির বিকাশের জন্য ইতিহাস অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানানো অবশ্যকীয়। তাহলে তারা একজন নাগরিক হিসেবে নিজের করণীয় সম্পর্কে সচেতন হবে।’ আমি মনে করি হাবীবুল্লাহ সিরাজী কাব্যগ্রন্থ ‘আমি জেনারেল’-এ সে চিহ্নই খোদাই করে দিলেন। সেই গুরু দায়িত্ব পালন করলেন। আজকের প্রজজেন্মর হাত ধরে আগামী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এ কাব্যগ্রন্থ ইতিহাসের কথা বলবে। নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের সন্ধান দেবে।

একজন সংগ্রামীর মুখে তার অভিমানও অহংবোধে বেজে ওঠে। পশ্চিমা বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের স্মরণে এবং যে সব যোদ্ধা বেঁচে আছেন তাদের সম্মানে যে আয়োজন চোখে পড়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্মানে তেমন চোখে পড়ে না। এটা জাতি হিসেবে আমাদের অক্ষমতা। কিন্তু যে একবার যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে তাঁর তো অহংবোধের কমতি থাকার কথা নয়। ফলে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী যখন বলেন- ‘আমি তো তাহার কোন পথ নই/আমি তো তোমার কোন মত নই/ নই অসম্ভবের খনি/যাতে ননী জমবে পাতে-/প্রভাত অপূর্ব হ’লে সূর্যবর্ণে/ অগ্নিময় হবে যত ক্ষত/আমারি মতো জেনারেল/ সবুজ ও লাল।’ তখন পাঠক হিসেবে আমি প্রচণ্ড স্নায়ু টান করে স্থির করি ইন্দ্রীয়। সেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীয় ঘোষণায় আমি আর কারো উদযাপনের অপেক্ষা করি না। বুঝে যাই এমন সংগ্রামীর ত্যাগের অহংবোধ নিজে থেকেই উদযাপিত হতে থাকে প্রতিটা ক্ষণ। ‘আমি জেনারেল’-এর এ কাব্যনিশ্বাস পুরো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী দীর্ঘ নিশ্বাসকে কবিতায় টিউন করে বাজিয়ে দিলেন পাঠকের তন্ত্রীতে। যেভাবে অন্য কাউকে বলতে দেখি নি। কবিতাটি পাঠ করতে করতে আমার চোখে একটি দৃশ্য ভেসে উঠেছে বারবার। আমি দেখছি একজন মুক্তিযোদ্ধা, নিজের বীরগাথা স্মরণ করতে করতে নানান অসঙ্গতির মুখোমুখি হচ্ছেন। কোনো কিছুকেই আর নিজের মনে হয় না। কোনো মতই আর নিজের মত মনে হয় না। এই অমিলের যে ক্ষত তাই প্রতিবাদী হয়ে উঠছে। নিজেকে সে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ভাবতে চায়। নিজেকে সে ‘জেনারেল’ ভাবে। এই জেনারেল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মুখপাত্র। তাঁর বক্তব্যই আমাদের নিহত-জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষা।

সৃষ্টির উন্মাদনা অনেক সময় শিল্পীকে স্বার্থপর করে তোলে। কোথায় তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ হলো তাই প্রধান। ক্লড মোনের একটি ঘটনা শিল্পীর এই মন বুঝতে আমাদের সহায়তা করতে পারে। মৃত্যুর পর শায়িত স্ত্রী কেমিলার মুখের উপর যে ছায়া পড়েছিলো সেই ফর্মের দিকেই নাকি মোনে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। সে সময় শোক নয়, তার মনে সৃষ্টির প্রণোদনাই আন্দোলিত হয়েছিলো। যদিও স্বম্বিত ফিরে পেয়ে তিনি লজ্জিত হয়েছিলেন। কিন্তু মোনে মৃত স্ত্রীর মুখের ওপর যে বেগুনি ছায়ার দিকে ঘোরগ্রস্ত হয়েছিলেন সেটি ছিলো শিল্পীর মন। তা কখনোই একজন মৃত স্ত্রীর স্বামীর নয়। সে হিসেবে তাতে কোনো অপরাধ কিংবা লজ্জার কিছু নেই। ‘আমি জেনারেল’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে কোথাও কোথাও আমার এমন ঘোরগ্রস্ত মোনেই মনে হয়েছে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে। অসামান্য পাপ,/ আর অরণ্য প্রান্তর,/ সঞ্চয়ের ক্ষুদ্র জলাশয়, জাগে যে পিপাসায়/ নেই কোন ইতি/ মানা করো চাকার প্রনতি/ জেনারেল, এসো এই বেলা/ মাথাটি ঘুরিয়ে দিয়ে/ পশ্চাৎ বা শূন্যে ধরি/ বারুদ-বেহালা’।

কিংবা “দূর থেকে তো এলাম, ঘুম।/পায়ের ভার যে জোড়াতালি/ কোথায় ওড়ো সর্ষেমধু/কথা ছিলো/শীত ফুরোলে হরিণ দেখার!/চা-পাতা আর বরফকুচি/রাজারবাগে রাত্রিশেষের গলি/ ও মলি, তোর চাঁদ নামিয়ে আন/মুখটা এবার দেখি! খুব দূর থেকে এলাম, মরি?’

এ কাব্যগ্রন্থের মজ্জায় এমন হাড়ের খবর রক্তের নালিতে কান পাতলেই টের পাওয়া যায়। একজন কবির এটাই দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। কবি যে সময়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে যায়, তা থেকে মুঠো মুঠো দানা তুলে যে প্রান্তরে ছড়িয়ে দেয় তাই শিল্পভূমিতে রূপান্তর হয়। এ ভূমি হতে পারে পুষ্পস্নাত কিংবা হতে পারে রক্ত¯œাত।

‘আকাশের নীচে কি আর মাথা তোলার অধিকার নেই?/মাটির উপর কি তাদের দাঁড়ানোর এক্তিয়ার নেই?/ খুব ছোট এই ধরাধামে খুব বড়ো-বড়ো ফাঁক/ তার মধ্যে কসরৎ চলে, গন্ধ বলে বর্ণ-ধর্ম-বিত্ত-ভাষা।/ মানুষ বলার জন্য আজ মানুষের খুব টানাটানি লেগেছে/ এক তিল আশা, মৃত্যু সম্মুখে রেখে সামান্য ভালোবাসা/ রোহিঙ্গাও যে চায়!’

এখানে মানুষের মৌলিক অধিকারের দাবি নিয়ে কবি দাঁড়িয়েছেন। ‘মানুষ বলার জন্য আজ মানুষের খুব টানাটানি লেগেছে’ এই যে ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ এখানেই কবি সংকটের ভেতর দিয়ে সম্মুখে নিয়ে এসেছেন ভৌগোলিক রাজনীতি। কবি যে রাজনীতি সচেতন তা আমরা পুরো কাব্যগ্রন্থেই বুঝতে পারি। তারপরও এই কবিতায় এসে সেই চিহ্নটি স্মারকে রূপ নিয়েছে। ‘রোহিঙ্গা’ একটি রাজনৈতিক সংকট। একটি জাতি রাজনীতির কলে কীভাবে পিষ্ঠ হচ্ছে, যাদের মানুষ পরিচয় আজ প্রশ্নের সম্মুখিন, সে সংটাপন্ন ভূমিতে কবি আলো ফেলেছেন। যদিও ‘রোহিঙ্গা’ বিষয়টি নানান বিতর্কে দু‘টি রাষ্ট্রের শীড় পীড়ার কারণ হয়েছে। এর যে একটি রাজনৈতিক ভুল রয়েছে তার দিকেই কবি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। আইরিশ কবি সিমাস হিনির একটি বক্তব্য মনে পড়ছে। সম্ভবত নোবেল প্রাপ্তির পর দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, সভ্যতার দলিলগুলো রক্ত এবং অশ্রুতে লেখা হয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা, স্বাধীন বাংলাদেশের দলিল রক্তেই লেখা। ‘রোহিঙ্গা’ এই বুর্জোয়া রাজনীতিরই অংশ। হাবীবুল্লাহ সিরাজী সেই ইতিহাস এবং ঘটনাগুলোর কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়াস জারি রেখেছেন।

‘আমি জেনারেল’ কাব্যগ্রন্থটির জেনারেল একজন বাঁশিওয়ালা। যে কিনা বিভিন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্বের ভেতর দিয়ে পরিপার্শ্বকে দাঁড় করাচ্ছে সমসাময়িকতায়। যে বাঁশি সকরুণ সুরে যেমন অসঙ্গতির কথা বলছে, তেমন ভিন্ন সুরে কেঁপে উঠছে ক্ষোভে। আবার সে বাঁশি কখনো মানবিক কখনোবা প্রণত নেতার প্রতি। কবিতায় কোমল প্রেম নূপুরের মতো বাজে। তাহলে ‘আমি জেনারেল’ পাঠকের মনে কেমন অনুভূতি জাগায়! এটি বিউগলের সুরে রণতরীর মতো চলে। আবার অভিমানে বক্ষ বিদীর্ণ করে কেটে ফেলে প্রেম ও অপ্রেমের সকল জড়তা। এমন একটি কাব্যগ্রন্থই তো মহাকালের বুকে তিলক এঁকে দেবে। তাই নয় কি?