ধারাবাহিক উপন্যাস : পাঁচ

শিকিবু

আবুল কাসেম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আট.

প্যাগোডার ঘটনাটা মুরাসাকিকে খুবই অবাক করে দিয়েছে। তা নিয়ে তার নানা ভাবনা হচ্ছে। এই প্রাচীন জাপানে নানা বিশ্বাস আর সংস্কার প্রচলিত। হেইয়ান সাম্রাজ্য যথেষ্ট এগিয়েছে, কিন্তু এসব সংস্কার ও বিশ্বাস থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।

ফুলটা তার ভালো লেগেছে। বেশি মোহনীয় মনে হয়েছে লাল ফুলটা ফুটছে দেখে। এখন অনুভূতিটা হচ্ছে মিশ্র। ব্যাপারটা যেন অণু-পরমাণুতে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। তেমনি তার মানসিক অবস্থা।

ব্যাপারটাকে হালকা বা সহজভাবে নিলে পারত। মজা করা ভাবলেও ক্ষতি ছিল না। পাহাড় পর্বতের নান্দনিক দৃশ্য দেখে প্রকৃতিনির্ভর ওয়াকা কবিতা লেখার আগ্রহ হয়েছিল। এখন উৎসাহে ভাটা পড়েছে। মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রপিতামহের লেখা ‘ইয়ামাতো মনোগাতারি’ নিয়ে বসলেন। না মন বসছে না।

জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। জাপান সাগর, পাহাড়ের পাদদেশ, ঢেউয়ের আছড়ে পড়া পর্বতচূড়ায় বরফ সবই আছে। কোনোটাই টানছে না। ফিরে এল জানালা থেকে। ভাবলো ঘটনাগুলো লিখবে। লিখে রাখবে। কাউকে জানাবে। কিন্তু কাকে? আকাঝোমি ইমনকে জানাতে পারে।

এ সময় সামুরাই দপ্তর থেকে সংবাদ এল ওয়াশি ভিলেজ বা কাগজগ্রামের ওকামোতো ওতাকি শ্রাইনের বাৎসরিক উৎসবে গর্ভনর সাহেবের যাবার কথা ছিল, তিনি যেহেতু নেই, সামুরাই সেনাপতি যাচ্ছেন। গভর্নর সাহেবের পরিবারের সদস্যরা অনুষ্ঠানে যেতে চাইলে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে।

মুরাসাকিকে বাবা এই উৎসব অনুষ্ঠানের কথা বলেছিলেন। মুরাসাকি তা ভুলে গেছে। বার্তা বাহককে সে বলল, বিকেলের অনুষ্ঠানে সে যাবে, যেন যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

ইচিঝেন কামি (কাগজ) উৎসব হাতে কাগজ প্রস্তুতকারী লোকগুলোর একটি বাৎসরিক উৎসব। পৃথিবীতে যা বিরল, এদের একজন কাগজদেবতা রয়েছেন। কাগজ প্রস্তুতকারী লোকগুলো তার উপাসনা করেন। তার কাছে আয় উন্নতি প্রার্থনা করেন এবং বিপদ আপদ থেকে পরিত্রাণ চান।

ওতাকি শ্রাইনের সামনে একটি বহনযোগ্য একটি শ্রাইন তৈরি করে সুসজ্জিত অবস্থায় রাখা আছে। তার ভেতর কাগজদেবতার বিগ্রহ। এই বহনযোগ্য শ্রাইন নিয়ে কাগজ প্রস্তুতকারকেরা শোভাযাত্রা বের করবেন। অতিথিদের জন্য অপেক্ষা মাত্র।

অশ্বশকটে মুরাসাকিকে দেখে উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন এরা। মুরাসাকিকে রাজকন্যার মতো লাগছে। কাগজগ্রামের বাসিন্দারা ভাবলেন কিংবদন্তির সেই রাজকুমারী আবার এসেছেন। তাদের মধ্যে এ গল্প এবং বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, পনেরশ’ বছর আগে ওকামোতো নদীর উজান থেকে সোনার তরী বেয়ে বেয়ে এক অপরূপ রাজকন্যা আসেন তাদের দরিদ্র গ্রামটিতে। তাদের দুঃখ কষ্টে তিনি অন্তরে পীড়া বোধ করেন এবং থেকে যান কিছু দিন। তার ভাবনায় ছিল কীভাবে আর্থিক উন্নতি ঘটিয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা যায়। তিনি কাগজ তৈরি করা যায় এমন গাছ পেয়ে গেলেন এবং কীভাবে কাগজ তৈরি করতে হয়। হাতে কলমে তা শিখিয়ে দিলেন। শ্রাইনের এক দেবতাকে চিহ্নিত করে গেলেন কাগজ দেবতা হিসেবে। তার আরাধনা চালু করে দিয়ে বিদায় নিলেন।

সেই রাজকুমারী আবার এসেছেন ভেবে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এরা। মুরাসাকি তাদের বুঝাতে চাইলেন তিনি রাজকুমারী বা দেবী নন। তিনি তাদের গভর্নরের মেয়ে। কিন্তু তারা মানতে নারাজ। তাদের প্রবীণ লোকেরা অবতারে বিশ্বাস করেন। শতসহস্র বৎসর পরপর ভগবান তার অবতারকে মানবমানবীরূপে পৃথিবীতে পাঠান।

এই অবস্থায় সামুরাই সেনাপতি গুরুত্বহীন হয়ে পড়লেন। তার ভেতর গোস্বা জাগল। উৎসবের লোকজনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলেন না। বিশ্বাস, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ও মনুষ্যত্ব নিয়ে মানুষ বাঁচে। তারাও এই বোধ নিয়েই বেঁচে আছেন। সেনাপতির ব্যবহারে মনোক্ষুণœ হলেও ধৈর্য ধরে সব সহ্য করে গেলেন। পাছে রাজকুমারীরূপী দেবীর প্রতি অসম্মান হয়, অমর্যাদা হয়-এই ভেবে সবই হজম করলেন।

সামুরাই সেনাপতির রাগটা গিয়ে পড়ল মুরাসাকির ওপর। তাকে ডেকে না আনাই উত্তম ছিল। তার মাথায় এক দুষ্টবুদ্ধি ঘুরপাক খেতে শুরু করে। তিনি প্রতিশোধ নেবেন।

এদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। শোভাযাত্রা শুরু করতে হবে। গ্রামটা প্রদক্ষিণ করে সন্ধ্যার আগে ফিরে আসতে হবে শ্রাইনে। মুরাসাকিকে প্রদীপ জ্বালিয়ে শোভাযাত্রা শুরু করে দিতে হলো। শোভাযাত্রা বের হয়ে গেল। দুদিনের উৎসব হলো শুরু।

শোভাযাত্রার সঙ্গে নিরাপত্তার অজুহাতে সেনাপতি তার লোকজন নিয়ে চলে গেলেন। শিন্টু শ্রাইন ওতাকির পুরোহিত এসে বললেন, মা আজকে আপনি এই শ্রাইনের অতিথিশালায় থাকবেন। আপনার কোনো অযতœ হবে না। আমাদের উৎসব দেখে তবে বিদায়। মুরাসাকির সারাটা দিনই অদ্ভুত কিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কেটেছে। শিন্টু শ্রাইনে নানা দেব-দেবীর সামনে বসে সেসব কথাই ভাবছিল। ব্যাপারগুলো স্বপ্নের মতো মনে হলো।

নোবুনোরির কথায় তার চিন্তায় ছেদ পড়ল। সে বলল, আমার প্রাসাদে যেতে ইচ্ছে করছে।

ওরা ফিরে এলেই আমরা বিদায় নেব।

পুরোহিতকেও একই কথা বললো সে। পুরোহিত সম্মতি দিলেন।

এদিকে তামেতোকি তার ভ্রাতুষ্পুত্র সম্পর্কীয় নোবুতাকার সঙ্গে একান্তে কথা বললেন। তার মনোভাব, বিষয় আশয়, ব্যক্তি ও পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। বড় মেয়ে এবং জামাতার সঙ্গে কথা বললেন। সবই অনুকূল মনে হলো।

তবে অভিজাত হেইয়ান সমাজে বিয়ের রীতি ভিন্ন। পাত্র পাত্রীর সঙ্গে গোপনে মিলিত হবে। তারপর পত্র (কবিতা)

লেখালেখি, মতবিনিময়, অতঃপর বিয়ে। এজন্য মুরাসাকিকে ইচিঝেন থেকে কিয়োটোয় আসতে হবে। কিছু কাজ বাকি রেখে তামেতোকি ইচিঝেন ফিরে গেলেন। তাকে আবার আসতে হবে মেয়েকে নিয়ে।

সামুরাই সেনাপতি কিছু সমস্যার জাল বিস্তার করে ফেলেছেন ইচিঝেনে। সম্রাটের কাছে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। তার সত্যতা জানতে প্রাক্তন এবং বর্তমান গভর্নরের বক্তব্য শুনেছেন সম্রাট। তিনি এক হন্তা দল পাঠিয়েছেন যাতে ইচিঝেনেই তাকে হত্যা করা হয়। তা জানেন না সেনাপতি।

মুরাসাকির দিকে দৃষ্টি গেছে তার। তাকে ওতাকি শ্রাইনে মুরাসাকির জন্য গুরুত্বহীন হতে হয়েছে। প্রতিশোধ স্পৃহার সঙ্গে লালসা যুক্ত হয়েছে। অনুগত দল পাঠিয়ে তুলে নেয়ার পরিকল্পনা তার।

সম্রােেটর পাঠানো দলটি সামুরাই সেনাদের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডকে সামুরাই সেনাপতির নিয়োগপত্র দিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা জানায়। এখানে দুয়েকজন ছাড়া সবাই সেনাপতির বিরুদ্ধে। তার নিগ্রহে সবাই অতিষ্ঠ। নতুন সেনাপতি পুরনো সেনাপতির অনুগতদের আটকাতে পারলেন। না হয় শিঘ্রই অঘটন ঘটিয়ে ফেলছিল। সেনাপতিকে আটক করেই হত্যা করল এরা। তার মস্তক নিয়ে গেল সম্রাটকে দেখাবে বলে।

তামেতোকি ফিরে এলে এসব জানানো হয় তাঁকে। তিনি বললেন, তাকাকুকে তা জানাবার প্রয়োজন নেই।

সম্রাজ্ঞী তেইশি শোশির নতুন লেডি-ইন-ওয়েটিং এর কথা জানতে পেরে তার লেডি-ইন-ওয়েটিং সেই শোনাগনকে ডাকালেন। বললেন, তোমার প্রতিপক্ষের সংখ্যা বেড়েছে সে খবর কি জানো?

শোনাগন বললেন, আমি তাকে চিনি সম্রাজ্ঞী। পুচকে কবি। আমাকেও চেনে সে। আকাঝোমি ইমনের মতোই চুপসে যাবে সে।

আমার মনে হয় তোমার হিসাবে ভুল আছে শোনাগন। সে খুবই ছটপটে আর করিৎকর্মা। প্রাসাদে আসার আগেই শোকোর দরবারের ওমোতো মারুকে হাত করে নিয়ে এখানে শিকড় বিস্তার করেছে।

সে সংবাদ আমি জানি সম্রাজ্ঞী। বালিকা সম্রাজ্ঞীর সহকারী ভুল পথ ধরেছিল। পথের শেষটা হারিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে আরেক জনকে বিয়ে করেছে। তার অর্থ তার মধ্যে দৃঢ়তা বা স্থিরতা বলতে কিছু নেই।

মিচিনাগা তাকে শক্তি জোগাবে।

ইমনকে শক্তি জোগানোর কাজ তার ব্যর্থ হয়েছে। শিকিবুরটাও ব্যর্থ হবে।

তোমার আস্থা ও আত্মবিশ্বাস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।

আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, মহামান্যা।

সেই শোনাগন এক সাহসী কবি এবং লেখক। তাঁর বাবা কিয়োহারা নো মোতোসুকে পণ্ডিত এবং সুপরিচিত কবি ছিলেন। কোনো একটি প্রদেশে চাকরি করতেন। তার পিতামহ ফুকাইয়াবু ওয়াকা কবি ছিলেন। শোনাগন ১৬ বৎসর বয়সে প্রথম বিয়ে করেন। বিয়েটা টেকেনি। ২৭ বৎসর বয়সে সম্রাজ্ঞী তেইশির লেডি-ইন-ওয়েটিং হিসেবে যোগ। পরে তিনি তিনি আরো দুটো বিয়ে করেছেন বলে মনে করা হয়।

তিনি অত্যন্ত মেধাবী বলে আকাঝোমি ইমন কিংবা ইঝোমি শিকিবুর দুর্বলতাগুলো ধরতে পারেন। প্রাসাদ রাজনীতি এবং সম্রাজ্ঞীদের পারস্পরিক বিরোধ ঈর্ষা-বিদ্বেষটা ভালো বুঝেন। তাই আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে পারেন। সম্রাজ্ঞী তেইশি (সাদাকা) অনেকাংশে তার ওপর নির্ভর করেন।

শোনাগন ইঝোমি শিকিবু কিংবা আকাঝোমি ইমনকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনেই করেন না। সম্রাট ইচিজোর স্ত্রী পাঁচজন। তাই প্রাসাদে অসংখ্য লেডি ইন ওয়েটিং আছেন। তাই মনে হতে পারে সম্র্রাজ্ঞী তেইশি এবং শোশির মধ্যেই এত বিরোধ কেন। শোশি তেইশির চাচাতো বোন। তাদের বাবাদের মধ্যে বিরোধ চরমে। উত্তরাধিকার সূত্রে এরা দু’জনও এ বিরোধীয় মনোভাব, হিংসা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার উত্তাপ লাভ করেছেন এবং তা নিয়ে আছেন।

নয়.

তামেতোকি মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা বলেছেন। হেইয়ান জাপানে কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়। সম্রাজ্ঞী শোশির বিয়ে হয়েছে মাত্র বারো বছর বয়সে। মুরাসাকির বয়স হয়েছে। বিয়ের ভাবনা তার মাথায়ও আছে। বিয়ের জন্য তাকে কিয়োটোয় যেতে হবে।

এখানকার দিনগুলো ভালোই কাটছিল। বাবার সঙ্গে কিয়োটোয় যাবার পথে এখানকার প্রকৃতি, শ্রাইন, উৎসব এবং সদা হাস্যময় ও আন্তরিক মানুষগুলোর কথা মনে পড়ল। কত সহজে তারা ভেবে নিয়েছে, মুরাসাকি সেই রাজকন্যা, যিনি তাদের কাগজ তৈরির কৌশল বাতলে দিয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছেন। রূপকথার রাজকন্যার মতোই মনে হলো নিজেকে।

নোবুনোরিও সঙ্গে যাচ্ছে। তার ইচিঝেন ভালো লেগেছিল এখানে চীনা ক্লাসিকের শিক্ষক নেই বলে। মাঝে মধ্যে অবশ্য গভর্নর বাবাই সে কাজটি করতেন। তখন তার বাবাকে রাগি শিক্ষকই মনে হত, বাবা নয়। কিয়োটোতে বাবা থাকবেন না, মজা হবে। তাই ইচিঝেন ছাড়তে পেরে তার খুব আনন্দ হচ্ছে।

মুরসাকির কানের কাছে এসে বলা ফুল মালিকার কথাটা খুব মনে পড়ছে। ব্যাপারটা তা হলে সত্য হতে চলেছে। তাকে বলে আসার সময় পর্যন্ত হলো না। আর কি বর চাওয়া যেতো ওই ক্রিসানথ্যমম শ্রাইনের দেবতাদের কাছে? খুব পিছুটান অনুভব করছে সে।

নোবুতাকাকে চেনে সে। একটু দূর সম্পর্কের কাজিন। বয়স চল্লিশের কোঠায়। প্রতিভাবান নৃত্যশিল্পী। পোশাকের বিলাসিতা, শরীরের আকর্ষণ সৃষ্টি, চুলের ফ্যাশন এবং দামী সুগন্ধি ব্যবহারে মাতিয়ে রাখেন সারা সম্রাটের প্রাসাদ, বিশেষ করে উৎসব অনুষ্ঠান মন্ত্রণালয়। বিবাহিত অবিবাহিত সকলেরই দৃষ্টি তার প্রতি। এরা সুযোগ পেলেই তার সান্নিধ্যে আসতে চায়। সম্পদও করেছেন প্রচুর। সে কথাও তারা জানে। তাই তার মন জয় করতে আপ্রাণ চেষ্টা তাদের। তিনি কাউকে জীবনসঙ্গী করার কথা ভাবেন না। বরং ব্যাপারটা উপভোগ করেন। মেলামেশা করতে তো সমস্যা নেই। হেইয়ান প্রাসাদে তা সবাই করছে। তার চাহিদা একটু বেশি এই যা।

ব্যাপারটি নিয়ে তামেতোকি ভাবেননি তা নয়; চিন্তাও করেছেন। পরে সিদ্ধান্তে এলেন এই ভেবে যে, বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।

মুরাসিকির কাছে নোবুতাকার আকর্ষণ প্রাসাদের অন্য নারীদের মতোই। পোশাক আশাক, রসরুচিবোধ, শিল্পেপ্রতিভা, সবকিছুই তার ভালো লাগে। বয়সটা ত্রিশের কোঠায় হলে ভালো হত। মুরাসিকির কাছে এটাই একটু সমস্যা। কম বয়সে গভর্নর হন। একাধিক প্রদেশে এই পদে শাসন পরিচালনা করে এই আমলা আবার সম্রাটের দরবারে গুরুত্বপূর্ণ পদে ফিরে আসেন।

সবকিছু মিলিয়ে মুরাসাকির মনোভাব ইতিবাচক। এতে তামেতোকির ওপর থেকে চাপ চলে গেলেও মনের ভেতর একটা সূক্ষ্ম দুঃখবোধ কাজ করছে।

নোবুতাকা নিজের সম্পর্কে সচেতন। নিজের যেসব সমস্যা আছে এগুলো নিয়ে মুরাসাকির সামনে কী করে দাঁড়াবেন, তাই তাকে তিনি সমীহ করে চলেন। মুরাসাকি গম্ভীর এবং নির্ভেজাল প্রকৃতির একজন নারী। নোবুতাকা সুদর্শন, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি এবং সেজেগুজে ফিটফাট ধরনের মানুষ। অনেকে তাকে এই স্মার্ট অবস্থার জন্য তোয়াজ করে কবিতা পাঠালেও, মুরাসাকি ফিরেও তাকায়নি। নোবুতাকা একে মুরাসাকির অহংকার ভেবে নিয়েছিলেন। তাই একটা বাড়তি আকর্ষণও ছিল তার প্রতি। এখন স্ত্রী হয়ে এলে কীভাবে নিবেন তাকে।

তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, হেইয়ান কিয়োটোর বিবাহরীতি অনুসরণ করে গোপনে পাত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবেন না, পত্র লিখে পাঠাবেন না। কবিতা তো নয়ই। ফুজিওযারা লোকজন সবাই জানে মুরাসাকিরা চার পুরুষ ধরে নামি-দামি কবি। মুরাসাকি এরই মধ্যে কবি প্রতিভার পরিচয় দিতে শুরু করেছে। ভুল কবিতা লিখে পাঠালে সেজেগুজে ফিটফাটের কোনো ইজ্জৎই থাকবে না। হবু স্ত্রীর কাছে এরকম লজ্জা পাওয়ার কোনো অর্থই হয় না। নৃত্যটা তিনি ভালো পারেন। কিন্তু তা তো স্ত্রীকে দেখাবার জন্য নয়। অনুষ্ঠানে সম্রাজ্ঞী-সম্রাটসহ অভিজাত সব দর্শকদের দেখাবার জন্য।

একটা রোমাঞ্চিতভাব, শিহরণ, অনুভব করছেন তিনি এসব চিন্তার মধ্যেও। বিবাহের কথায় প্রকৃতি কেমন যেন হাওয়া দিতে শুরু করেছে। উৎসব-অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকার সুবাদে সুদর্শন দেহকান্তি এবং দামি সাজপোশাকে অনেকের অন্তরে দোলা দিয়েছেন, নিজে দোল অনুভব করেননি, আজ কেমন যেন অন্তর দুলে উঠছে, বুক ফুলে উঠছে। জগৎ আনন্দময় লাগছে।

মুরাসাকি যৌক্তিক এবং ভারসাম্যপূর্ণ নারী। বিয়ের বাস্তবতা তার কাছে এখন পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধন ছাড়া আর কিছু নয়। মনোগতভাবে হয়ত রোমান্টিক, বাইরে তার প্রকাশ নেই। বাবা তার মনোভাবের সঙ্গে পরিচিত। তাই কথা বলার ক্ষেত্রে সতর্ক, বুঝে শুনে পরিমাপ করে কথা বলেন তার সঙ্গে।

এদিকে ইঝোমি শিকিবু শোশির দরবারে শেডি-ইন-ওয়েটিং হিসেবে এসে যে সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিলেন, ক্রমেই তাতে ভাটা পড়ল বলে শোশি এবং আকাঝোমি ইমন দুজনই দারুণ হতাশ।

ইমন সম্রাজ্ঞীকে বুঝালেন, নতুন বিয়ে হয়েছে সে জন্য দরবারি কাজ মনোযোগ দিতে পারছে না। ঠিক হয়ে যাবে। নিয়মিত হবে।

ইঝোমি তার কাজে ব্যস্ত আছেন। প্রাসাদে আসা-যাওয়া কালে একটি অনুষ্ঠানে প্রিন্স তামেতাকার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে তার। তামেতাকা সম্রাট রেইঝেই এর তৃতীয় পুত্র। তামেতাকা অর্থপূর্ণভাবে তার দিকে তাকান। তাতেই ইঝোমি ব্যাকুল হয়ে পড়েন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি ওয়াকা কবিতা লিখে পরদিনই তামেতাকার কছে পাঠিয়ে দেন। কবিতাটি এ রকম : ‘পদদলিত শুকন ঘাসে পুরুষ শুকর/পেতেছে বিছানা তার, ঘুমোচ্ছে সুখে/আমার সুখ নিদ্রা উধাও হয়ে গেছে/কালকের হৃদয় কারা দৃষ্টি ছাড়া আমার অনুভবে আর কিছু নেই। ’

পত্র পেয়ে প্রিন্স তামেতাকা ইঝোমি শিকিবুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি কবিতা লিখতে পারেন না। তবুও লিখলেন, ‘কিমোনোর মধ্যে ফোটা চন্দ্রমল্লিকা ফুল/দেখে চোখ ফেরানো কি সম্ভব হয়/দেখে অতৃপ্ত হৃদয়, পত্র সুগন্ধে বিমোহিত/পরস্পরকে দেখার কি এই আলামত?’

ওয়াকা কবিতার নিয়ম জানা নেই, তাই মানা হয়নি। কিছু হৃদয়ের আকুতি প্রকাশ পেয়েছে তাতে। ইঝোমি এই অবস্থায়ই প্রেমে পড়ে গেলেন প্রিন্সের। স্বামীর কথা একবারও মনে হল না তার। সম্রাটের দরবারের অমত্য-আমলা-যুবরাজদের একসাথে একাধিক স্ত্রী এবং প্রেমিকা থাকতে পারে, নারীদের নয়। তাকে এখানে গৌরবের বিষয় মনে করা হয়। রমণীদের ক্ষেত্রে তা কলঙ্ক ও নিজেকে বলী দেয়ার শামিল।

কিন্তু ইঝোমির যে চিত্ত চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে, তা যেন দমে যাবার নয়, তিনি নিজেই প্রিন্স তামেতাকার সঙ্গে তার দরবারে গিয়ে সাক্ষাৎ করলেন। প্রিন্সকে দেখে, কাছে পেয়ে পাগল হয়ে যাবার মত অবস্থা তার। প্রিন্সও যেন উন্মাদ হয়ে গেছেন, এমনি অবস্থা তার। প্রথম দেখায় যে প্রেম, তা এত সাড়া জাগানিয়া, কেউ ভাবতেও পারেননি। অতি কষ্টে দুজন নিজেকে সামলালেন।

প্রিন্স বললেন, এতকাল তুমি কোথায় ছিলে প্রিয়তম?

আমিও যেন আপনাকেই খুঁজছিলাম।

মনে হতে পারে তাদের প্রেম ও কথোপকথনে অতিনাটকীয়তায় আন্তরিকতার ঘাটতি থাকা স্বাভাবিক। প্রথম দর্শনে কেউ এতটা উতলাভাব দেখায় না। কবির উচ্ছ্বাস বলে কথা। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন ইঝোমি শিকিবু। প্রিন্স হয়ত তাকে ভুলাবার জন্যই অতিকথা বলছেন।

হেইয়ান কিয়োতে দিন যাচ্ছে এভাবেই। একদিন ইঝোমির স্বামী মিচিসাদা তার খোঁজে সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে উপস্থিত হন। ইমনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তার। ইঝোমিকে নিয়ে যেতে এসেছেন। ইঝোমি সকালে এসে বের হয়ে গেছেন। ইমন বললেন, এই মাত্র সম্রাজ্ঞীর অতি গোপনীয় কাজে বের হয়ে গেছে। আসামাত্রই আমি পাঠিয়ে দেব। মিচিসাদা ফিরে গেলেন। এরকমটা এখন প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। ইঝোমি এসেই সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বের হয়ে যান। কখনো ফিরে আসেন, কখনো না।

আজ ফিরে আসার পর ইমন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাকে বলতে পারো প্রায় প্রতিদিন কোথায় যাওয়া হয়?

কেন?

আজ তোমার স্বামী এসেছিলেন।

এখান পর্যন্ত? কেন এসেছিল?

তোমাকে নিয়ে যেতে। বলতে চাও না, ভালো। আমি বলেছি মহামান্যের কাজে বাইরে গেছ। তুমি এখনই স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করো। আরেকটা কথা, মহামান্যা বিরক্ত হচ্ছে বলে মনে হয়।

আপনি সামলে নেবেন, আমি এখনই যাচ্ছি।

বেশ যাও।

ইমন আবারো হতাশ। যে জন্য তাকে আনা হয়েছিল তা ব্যর্থ হয়ে গেল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। কিন্তু তিনি জানেন না, এ চেয়েও দুঃখজনক সংবাদ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

সম্রাজ্ঞী শোশি আজ রাতে সম্রাট ইচিজোর কক্ষে যাবেন। তাই তার সাজসজ্জাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার তদারকি করছেন ইমন। সাজনেদার সাজাচ্ছে, দাসী-বাদীরা অন্য কাজকর্ম করে দিচ্ছে। ইমন ভাবলেন, অনেক ভালো আছেন তিনি এককভাবে স্বামীর ভালোবাসা নিয়ে। অথচ এই সম্রাজ্ঞীকে পাঁচজন সতীনের সঙ্গে ভালোবাসা ভাগাভাগি করতে হয়। একে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি বলা যায়। মা-বাবার সংসারেও তিনি ছোট্ট শোশিকে বড় হতে দেখেছেন। বড় হওয়া অর্থ বারো বছর বয়স হওয়া। বারো বছর বয়সে সম্রাটের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এখন অবশ্য বয়স কিছুটা বেড়েছে।

সম্রাট ইচিজোর বয়সও খুব বেশি নয়। ছয় বৎসর বয়সে উত্তরাধিকারী হিসেবে সিংহাসনে আরোহন করেন। চব্বিশ বছর হতে না হতেই পাঁচ-পাঁচজন স্ত্রী তার। তবে সকল বিয়ে তিনি ব্যক্তিগত উৎসাহে করেননি। সম্রাটের দরবারে ফুজিওয়ারাদের অসম্ভব প্রভাব ও প্রতিপত্তি। তাদের অনুরোধে (চাপে) তাকে বিয়ে করতে হয়। শোশি এবং তেইশি ছাড়া অপর তিন স্ত্রী হচ্ছেন ফুজিওয়ারা নো গিশি, ফুজিয়ারা নো গেনশি এবং ফুজিওয়ারা সোনশি।

তারা অবশ্য সবাই সম্রাটের ইয়ামাতো প্রাসাদে বাস করেন না। শেষের তিনজন ভিন্ন ভিন্ন প্রাসাদে থাকেন। (ক্রমশ...)

বৃহস্পতিবার, ২৭ মে ২০২১ , ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৪ শাওয়াল ১৪৪২

ধারাবাহিক উপন্যাস : পাঁচ

শিকিবু

আবুল কাসেম

image

(পূর্ব প্রকাশের পর)

আট.

প্যাগোডার ঘটনাটা মুরাসাকিকে খুবই অবাক করে দিয়েছে। তা নিয়ে তার নানা ভাবনা হচ্ছে। এই প্রাচীন জাপানে নানা বিশ্বাস আর সংস্কার প্রচলিত। হেইয়ান সাম্রাজ্য যথেষ্ট এগিয়েছে, কিন্তু এসব সংস্কার ও বিশ্বাস থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।

ফুলটা তার ভালো লেগেছে। বেশি মোহনীয় মনে হয়েছে লাল ফুলটা ফুটছে দেখে। এখন অনুভূতিটা হচ্ছে মিশ্র। ব্যাপারটা যেন অণু-পরমাণুতে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। তেমনি তার মানসিক অবস্থা।

ব্যাপারটাকে হালকা বা সহজভাবে নিলে পারত। মজা করা ভাবলেও ক্ষতি ছিল না। পাহাড় পর্বতের নান্দনিক দৃশ্য দেখে প্রকৃতিনির্ভর ওয়াকা কবিতা লেখার আগ্রহ হয়েছিল। এখন উৎসাহে ভাটা পড়েছে। মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রপিতামহের লেখা ‘ইয়ামাতো মনোগাতারি’ নিয়ে বসলেন। না মন বসছে না।

জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। জাপান সাগর, পাহাড়ের পাদদেশ, ঢেউয়ের আছড়ে পড়া পর্বতচূড়ায় বরফ সবই আছে। কোনোটাই টানছে না। ফিরে এল জানালা থেকে। ভাবলো ঘটনাগুলো লিখবে। লিখে রাখবে। কাউকে জানাবে। কিন্তু কাকে? আকাঝোমি ইমনকে জানাতে পারে।

এ সময় সামুরাই দপ্তর থেকে সংবাদ এল ওয়াশি ভিলেজ বা কাগজগ্রামের ওকামোতো ওতাকি শ্রাইনের বাৎসরিক উৎসবে গর্ভনর সাহেবের যাবার কথা ছিল, তিনি যেহেতু নেই, সামুরাই সেনাপতি যাচ্ছেন। গভর্নর সাহেবের পরিবারের সদস্যরা অনুষ্ঠানে যেতে চাইলে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে।

মুরাসাকিকে বাবা এই উৎসব অনুষ্ঠানের কথা বলেছিলেন। মুরাসাকি তা ভুলে গেছে। বার্তা বাহককে সে বলল, বিকেলের অনুষ্ঠানে সে যাবে, যেন যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

ইচিঝেন কামি (কাগজ) উৎসব হাতে কাগজ প্রস্তুতকারী লোকগুলোর একটি বাৎসরিক উৎসব। পৃথিবীতে যা বিরল, এদের একজন কাগজদেবতা রয়েছেন। কাগজ প্রস্তুতকারী লোকগুলো তার উপাসনা করেন। তার কাছে আয় উন্নতি প্রার্থনা করেন এবং বিপদ আপদ থেকে পরিত্রাণ চান।

ওতাকি শ্রাইনের সামনে একটি বহনযোগ্য একটি শ্রাইন তৈরি করে সুসজ্জিত অবস্থায় রাখা আছে। তার ভেতর কাগজদেবতার বিগ্রহ। এই বহনযোগ্য শ্রাইন নিয়ে কাগজ প্রস্তুতকারকেরা শোভাযাত্রা বের করবেন। অতিথিদের জন্য অপেক্ষা মাত্র।

অশ্বশকটে মুরাসাকিকে দেখে উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন এরা। মুরাসাকিকে রাজকন্যার মতো লাগছে। কাগজগ্রামের বাসিন্দারা ভাবলেন কিংবদন্তির সেই রাজকুমারী আবার এসেছেন। তাদের মধ্যে এ গল্প এবং বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, পনেরশ’ বছর আগে ওকামোতো নদীর উজান থেকে সোনার তরী বেয়ে বেয়ে এক অপরূপ রাজকন্যা আসেন তাদের দরিদ্র গ্রামটিতে। তাদের দুঃখ কষ্টে তিনি অন্তরে পীড়া বোধ করেন এবং থেকে যান কিছু দিন। তার ভাবনায় ছিল কীভাবে আর্থিক উন্নতি ঘটিয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা যায়। তিনি কাগজ তৈরি করা যায় এমন গাছ পেয়ে গেলেন এবং কীভাবে কাগজ তৈরি করতে হয়। হাতে কলমে তা শিখিয়ে দিলেন। শ্রাইনের এক দেবতাকে চিহ্নিত করে গেলেন কাগজ দেবতা হিসেবে। তার আরাধনা চালু করে দিয়ে বিদায় নিলেন।

সেই রাজকুমারী আবার এসেছেন ভেবে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এরা। মুরাসাকি তাদের বুঝাতে চাইলেন তিনি রাজকুমারী বা দেবী নন। তিনি তাদের গভর্নরের মেয়ে। কিন্তু তারা মানতে নারাজ। তাদের প্রবীণ লোকেরা অবতারে বিশ্বাস করেন। শতসহস্র বৎসর পরপর ভগবান তার অবতারকে মানবমানবীরূপে পৃথিবীতে পাঠান।

এই অবস্থায় সামুরাই সেনাপতি গুরুত্বহীন হয়ে পড়লেন। তার ভেতর গোস্বা জাগল। উৎসবের লোকজনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলেন না। বিশ্বাস, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ও মনুষ্যত্ব নিয়ে মানুষ বাঁচে। তারাও এই বোধ নিয়েই বেঁচে আছেন। সেনাপতির ব্যবহারে মনোক্ষুণœ হলেও ধৈর্য ধরে সব সহ্য করে গেলেন। পাছে রাজকুমারীরূপী দেবীর প্রতি অসম্মান হয়, অমর্যাদা হয়-এই ভেবে সবই হজম করলেন।

সামুরাই সেনাপতির রাগটা গিয়ে পড়ল মুরাসাকির ওপর। তাকে ডেকে না আনাই উত্তম ছিল। তার মাথায় এক দুষ্টবুদ্ধি ঘুরপাক খেতে শুরু করে। তিনি প্রতিশোধ নেবেন।

এদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। শোভাযাত্রা শুরু করতে হবে। গ্রামটা প্রদক্ষিণ করে সন্ধ্যার আগে ফিরে আসতে হবে শ্রাইনে। মুরাসাকিকে প্রদীপ জ্বালিয়ে শোভাযাত্রা শুরু করে দিতে হলো। শোভাযাত্রা বের হয়ে গেল। দুদিনের উৎসব হলো শুরু।

শোভাযাত্রার সঙ্গে নিরাপত্তার অজুহাতে সেনাপতি তার লোকজন নিয়ে চলে গেলেন। শিন্টু শ্রাইন ওতাকির পুরোহিত এসে বললেন, মা আজকে আপনি এই শ্রাইনের অতিথিশালায় থাকবেন। আপনার কোনো অযতœ হবে না। আমাদের উৎসব দেখে তবে বিদায়। মুরাসাকির সারাটা দিনই অদ্ভুত কিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কেটেছে। শিন্টু শ্রাইনে নানা দেব-দেবীর সামনে বসে সেসব কথাই ভাবছিল। ব্যাপারগুলো স্বপ্নের মতো মনে হলো।

নোবুনোরির কথায় তার চিন্তায় ছেদ পড়ল। সে বলল, আমার প্রাসাদে যেতে ইচ্ছে করছে।

ওরা ফিরে এলেই আমরা বিদায় নেব।

পুরোহিতকেও একই কথা বললো সে। পুরোহিত সম্মতি দিলেন।

এদিকে তামেতোকি তার ভ্রাতুষ্পুত্র সম্পর্কীয় নোবুতাকার সঙ্গে একান্তে কথা বললেন। তার মনোভাব, বিষয় আশয়, ব্যক্তি ও পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। বড় মেয়ে এবং জামাতার সঙ্গে কথা বললেন। সবই অনুকূল মনে হলো।

তবে অভিজাত হেইয়ান সমাজে বিয়ের রীতি ভিন্ন। পাত্র পাত্রীর সঙ্গে গোপনে মিলিত হবে। তারপর পত্র (কবিতা)

লেখালেখি, মতবিনিময়, অতঃপর বিয়ে। এজন্য মুরাসাকিকে ইচিঝেন থেকে কিয়োটোয় আসতে হবে। কিছু কাজ বাকি রেখে তামেতোকি ইচিঝেন ফিরে গেলেন। তাকে আবার আসতে হবে মেয়েকে নিয়ে।

সামুরাই সেনাপতি কিছু সমস্যার জাল বিস্তার করে ফেলেছেন ইচিঝেনে। সম্রাটের কাছে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। তার সত্যতা জানতে প্রাক্তন এবং বর্তমান গভর্নরের বক্তব্য শুনেছেন সম্রাট। তিনি এক হন্তা দল পাঠিয়েছেন যাতে ইচিঝেনেই তাকে হত্যা করা হয়। তা জানেন না সেনাপতি।

মুরাসাকির দিকে দৃষ্টি গেছে তার। তাকে ওতাকি শ্রাইনে মুরাসাকির জন্য গুরুত্বহীন হতে হয়েছে। প্রতিশোধ স্পৃহার সঙ্গে লালসা যুক্ত হয়েছে। অনুগত দল পাঠিয়ে তুলে নেয়ার পরিকল্পনা তার।

সম্রােেটর পাঠানো দলটি সামুরাই সেনাদের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডকে সামুরাই সেনাপতির নিয়োগপত্র দিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা জানায়। এখানে দুয়েকজন ছাড়া সবাই সেনাপতির বিরুদ্ধে। তার নিগ্রহে সবাই অতিষ্ঠ। নতুন সেনাপতি পুরনো সেনাপতির অনুগতদের আটকাতে পারলেন। না হয় শিঘ্রই অঘটন ঘটিয়ে ফেলছিল। সেনাপতিকে আটক করেই হত্যা করল এরা। তার মস্তক নিয়ে গেল সম্রাটকে দেখাবে বলে।

তামেতোকি ফিরে এলে এসব জানানো হয় তাঁকে। তিনি বললেন, তাকাকুকে তা জানাবার প্রয়োজন নেই।

সম্রাজ্ঞী তেইশি শোশির নতুন লেডি-ইন-ওয়েটিং এর কথা জানতে পেরে তার লেডি-ইন-ওয়েটিং সেই শোনাগনকে ডাকালেন। বললেন, তোমার প্রতিপক্ষের সংখ্যা বেড়েছে সে খবর কি জানো?

শোনাগন বললেন, আমি তাকে চিনি সম্রাজ্ঞী। পুচকে কবি। আমাকেও চেনে সে। আকাঝোমি ইমনের মতোই চুপসে যাবে সে।

আমার মনে হয় তোমার হিসাবে ভুল আছে শোনাগন। সে খুবই ছটপটে আর করিৎকর্মা। প্রাসাদে আসার আগেই শোকোর দরবারের ওমোতো মারুকে হাত করে নিয়ে এখানে শিকড় বিস্তার করেছে।

সে সংবাদ আমি জানি সম্রাজ্ঞী। বালিকা সম্রাজ্ঞীর সহকারী ভুল পথ ধরেছিল। পথের শেষটা হারিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে আরেক জনকে বিয়ে করেছে। তার অর্থ তার মধ্যে দৃঢ়তা বা স্থিরতা বলতে কিছু নেই।

মিচিনাগা তাকে শক্তি জোগাবে।

ইমনকে শক্তি জোগানোর কাজ তার ব্যর্থ হয়েছে। শিকিবুরটাও ব্যর্থ হবে।

তোমার আস্থা ও আত্মবিশ্বাস দেখে আমি অবাক হচ্ছি।

আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, মহামান্যা।

সেই শোনাগন এক সাহসী কবি এবং লেখক। তাঁর বাবা কিয়োহারা নো মোতোসুকে পণ্ডিত এবং সুপরিচিত কবি ছিলেন। কোনো একটি প্রদেশে চাকরি করতেন। তার পিতামহ ফুকাইয়াবু ওয়াকা কবি ছিলেন। শোনাগন ১৬ বৎসর বয়সে প্রথম বিয়ে করেন। বিয়েটা টেকেনি। ২৭ বৎসর বয়সে সম্রাজ্ঞী তেইশির লেডি-ইন-ওয়েটিং হিসেবে যোগ। পরে তিনি তিনি আরো দুটো বিয়ে করেছেন বলে মনে করা হয়।

তিনি অত্যন্ত মেধাবী বলে আকাঝোমি ইমন কিংবা ইঝোমি শিকিবুর দুর্বলতাগুলো ধরতে পারেন। প্রাসাদ রাজনীতি এবং সম্রাজ্ঞীদের পারস্পরিক বিরোধ ঈর্ষা-বিদ্বেষটা ভালো বুঝেন। তাই আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে পারেন। সম্রাজ্ঞী তেইশি (সাদাকা) অনেকাংশে তার ওপর নির্ভর করেন।

শোনাগন ইঝোমি শিকিবু কিংবা আকাঝোমি ইমনকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনেই করেন না। সম্রাট ইচিজোর স্ত্রী পাঁচজন। তাই প্রাসাদে অসংখ্য লেডি ইন ওয়েটিং আছেন। তাই মনে হতে পারে সম্র্রাজ্ঞী তেইশি এবং শোশির মধ্যেই এত বিরোধ কেন। শোশি তেইশির চাচাতো বোন। তাদের বাবাদের মধ্যে বিরোধ চরমে। উত্তরাধিকার সূত্রে এরা দু’জনও এ বিরোধীয় মনোভাব, হিংসা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার উত্তাপ লাভ করেছেন এবং তা নিয়ে আছেন।

নয়.

তামেতোকি মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা বলেছেন। হেইয়ান জাপানে কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়। সম্রাজ্ঞী শোশির বিয়ে হয়েছে মাত্র বারো বছর বয়সে। মুরাসাকির বয়স হয়েছে। বিয়ের ভাবনা তার মাথায়ও আছে। বিয়ের জন্য তাকে কিয়োটোয় যেতে হবে।

এখানকার দিনগুলো ভালোই কাটছিল। বাবার সঙ্গে কিয়োটোয় যাবার পথে এখানকার প্রকৃতি, শ্রাইন, উৎসব এবং সদা হাস্যময় ও আন্তরিক মানুষগুলোর কথা মনে পড়ল। কত সহজে তারা ভেবে নিয়েছে, মুরাসাকি সেই রাজকন্যা, যিনি তাদের কাগজ তৈরির কৌশল বাতলে দিয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছেন। রূপকথার রাজকন্যার মতোই মনে হলো নিজেকে।

নোবুনোরিও সঙ্গে যাচ্ছে। তার ইচিঝেন ভালো লেগেছিল এখানে চীনা ক্লাসিকের শিক্ষক নেই বলে। মাঝে মধ্যে অবশ্য গভর্নর বাবাই সে কাজটি করতেন। তখন তার বাবাকে রাগি শিক্ষকই মনে হত, বাবা নয়। কিয়োটোতে বাবা থাকবেন না, মজা হবে। তাই ইচিঝেন ছাড়তে পেরে তার খুব আনন্দ হচ্ছে।

মুরসাকির কানের কাছে এসে বলা ফুল মালিকার কথাটা খুব মনে পড়ছে। ব্যাপারটা তা হলে সত্য হতে চলেছে। তাকে বলে আসার সময় পর্যন্ত হলো না। আর কি বর চাওয়া যেতো ওই ক্রিসানথ্যমম শ্রাইনের দেবতাদের কাছে? খুব পিছুটান অনুভব করছে সে।

নোবুতাকাকে চেনে সে। একটু দূর সম্পর্কের কাজিন। বয়স চল্লিশের কোঠায়। প্রতিভাবান নৃত্যশিল্পী। পোশাকের বিলাসিতা, শরীরের আকর্ষণ সৃষ্টি, চুলের ফ্যাশন এবং দামী সুগন্ধি ব্যবহারে মাতিয়ে রাখেন সারা সম্রাটের প্রাসাদ, বিশেষ করে উৎসব অনুষ্ঠান মন্ত্রণালয়। বিবাহিত অবিবাহিত সকলেরই দৃষ্টি তার প্রতি। এরা সুযোগ পেলেই তার সান্নিধ্যে আসতে চায়। সম্পদও করেছেন প্রচুর। সে কথাও তারা জানে। তাই তার মন জয় করতে আপ্রাণ চেষ্টা তাদের। তিনি কাউকে জীবনসঙ্গী করার কথা ভাবেন না। বরং ব্যাপারটা উপভোগ করেন। মেলামেশা করতে তো সমস্যা নেই। হেইয়ান প্রাসাদে তা সবাই করছে। তার চাহিদা একটু বেশি এই যা।

ব্যাপারটি নিয়ে তামেতোকি ভাবেননি তা নয়; চিন্তাও করেছেন। পরে সিদ্ধান্তে এলেন এই ভেবে যে, বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।

মুরাসিকির কাছে নোবুতাকার আকর্ষণ প্রাসাদের অন্য নারীদের মতোই। পোশাক আশাক, রসরুচিবোধ, শিল্পেপ্রতিভা, সবকিছুই তার ভালো লাগে। বয়সটা ত্রিশের কোঠায় হলে ভালো হত। মুরাসিকির কাছে এটাই একটু সমস্যা। কম বয়সে গভর্নর হন। একাধিক প্রদেশে এই পদে শাসন পরিচালনা করে এই আমলা আবার সম্রাটের দরবারে গুরুত্বপূর্ণ পদে ফিরে আসেন।

সবকিছু মিলিয়ে মুরাসাকির মনোভাব ইতিবাচক। এতে তামেতোকির ওপর থেকে চাপ চলে গেলেও মনের ভেতর একটা সূক্ষ্ম দুঃখবোধ কাজ করছে।

নোবুতাকা নিজের সম্পর্কে সচেতন। নিজের যেসব সমস্যা আছে এগুলো নিয়ে মুরাসাকির সামনে কী করে দাঁড়াবেন, তাই তাকে তিনি সমীহ করে চলেন। মুরাসাকি গম্ভীর এবং নির্ভেজাল প্রকৃতির একজন নারী। নোবুতাকা সুদর্শন, পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি এবং সেজেগুজে ফিটফাট ধরনের মানুষ। অনেকে তাকে এই স্মার্ট অবস্থার জন্য তোয়াজ করে কবিতা পাঠালেও, মুরাসাকি ফিরেও তাকায়নি। নোবুতাকা একে মুরাসাকির অহংকার ভেবে নিয়েছিলেন। তাই একটা বাড়তি আকর্ষণও ছিল তার প্রতি। এখন স্ত্রী হয়ে এলে কীভাবে নিবেন তাকে।

তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, হেইয়ান কিয়োটোর বিবাহরীতি অনুসরণ করে গোপনে পাত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবেন না, পত্র লিখে পাঠাবেন না। কবিতা তো নয়ই। ফুজিওযারা লোকজন সবাই জানে মুরাসাকিরা চার পুরুষ ধরে নামি-দামি কবি। মুরাসাকি এরই মধ্যে কবি প্রতিভার পরিচয় দিতে শুরু করেছে। ভুল কবিতা লিখে পাঠালে সেজেগুজে ফিটফাটের কোনো ইজ্জৎই থাকবে না। হবু স্ত্রীর কাছে এরকম লজ্জা পাওয়ার কোনো অর্থই হয় না। নৃত্যটা তিনি ভালো পারেন। কিন্তু তা তো স্ত্রীকে দেখাবার জন্য নয়। অনুষ্ঠানে সম্রাজ্ঞী-সম্রাটসহ অভিজাত সব দর্শকদের দেখাবার জন্য।

একটা রোমাঞ্চিতভাব, শিহরণ, অনুভব করছেন তিনি এসব চিন্তার মধ্যেও। বিবাহের কথায় প্রকৃতি কেমন যেন হাওয়া দিতে শুরু করেছে। উৎসব-অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকার সুবাদে সুদর্শন দেহকান্তি এবং দামি সাজপোশাকে অনেকের অন্তরে দোলা দিয়েছেন, নিজে দোল অনুভব করেননি, আজ কেমন যেন অন্তর দুলে উঠছে, বুক ফুলে উঠছে। জগৎ আনন্দময় লাগছে।

মুরাসাকি যৌক্তিক এবং ভারসাম্যপূর্ণ নারী। বিয়ের বাস্তবতা তার কাছে এখন পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধন ছাড়া আর কিছু নয়। মনোগতভাবে হয়ত রোমান্টিক, বাইরে তার প্রকাশ নেই। বাবা তার মনোভাবের সঙ্গে পরিচিত। তাই কথা বলার ক্ষেত্রে সতর্ক, বুঝে শুনে পরিমাপ করে কথা বলেন তার সঙ্গে।

এদিকে ইঝোমি শিকিবু শোশির দরবারে শেডি-ইন-ওয়েটিং হিসেবে এসে যে সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিলেন, ক্রমেই তাতে ভাটা পড়ল বলে শোশি এবং আকাঝোমি ইমন দুজনই দারুণ হতাশ।

ইমন সম্রাজ্ঞীকে বুঝালেন, নতুন বিয়ে হয়েছে সে জন্য দরবারি কাজ মনোযোগ দিতে পারছে না। ঠিক হয়ে যাবে। নিয়মিত হবে।

ইঝোমি তার কাজে ব্যস্ত আছেন। প্রাসাদে আসা-যাওয়া কালে একটি অনুষ্ঠানে প্রিন্স তামেতাকার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে তার। তামেতাকা সম্রাট রেইঝেই এর তৃতীয় পুত্র। তামেতাকা অর্থপূর্ণভাবে তার দিকে তাকান। তাতেই ইঝোমি ব্যাকুল হয়ে পড়েন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি ওয়াকা কবিতা লিখে পরদিনই তামেতাকার কছে পাঠিয়ে দেন। কবিতাটি এ রকম : ‘পদদলিত শুকন ঘাসে পুরুষ শুকর/পেতেছে বিছানা তার, ঘুমোচ্ছে সুখে/আমার সুখ নিদ্রা উধাও হয়ে গেছে/কালকের হৃদয় কারা দৃষ্টি ছাড়া আমার অনুভবে আর কিছু নেই। ’

পত্র পেয়ে প্রিন্স তামেতাকা ইঝোমি শিকিবুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি কবিতা লিখতে পারেন না। তবুও লিখলেন, ‘কিমোনোর মধ্যে ফোটা চন্দ্রমল্লিকা ফুল/দেখে চোখ ফেরানো কি সম্ভব হয়/দেখে অতৃপ্ত হৃদয়, পত্র সুগন্ধে বিমোহিত/পরস্পরকে দেখার কি এই আলামত?’

ওয়াকা কবিতার নিয়ম জানা নেই, তাই মানা হয়নি। কিছু হৃদয়ের আকুতি প্রকাশ পেয়েছে তাতে। ইঝোমি এই অবস্থায়ই প্রেমে পড়ে গেলেন প্রিন্সের। স্বামীর কথা একবারও মনে হল না তার। সম্রাটের দরবারের অমত্য-আমলা-যুবরাজদের একসাথে একাধিক স্ত্রী এবং প্রেমিকা থাকতে পারে, নারীদের নয়। তাকে এখানে গৌরবের বিষয় মনে করা হয়। রমণীদের ক্ষেত্রে তা কলঙ্ক ও নিজেকে বলী দেয়ার শামিল।

কিন্তু ইঝোমির যে চিত্ত চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে, তা যেন দমে যাবার নয়, তিনি নিজেই প্রিন্স তামেতাকার সঙ্গে তার দরবারে গিয়ে সাক্ষাৎ করলেন। প্রিন্সকে দেখে, কাছে পেয়ে পাগল হয়ে যাবার মত অবস্থা তার। প্রিন্সও যেন উন্মাদ হয়ে গেছেন, এমনি অবস্থা তার। প্রথম দেখায় যে প্রেম, তা এত সাড়া জাগানিয়া, কেউ ভাবতেও পারেননি। অতি কষ্টে দুজন নিজেকে সামলালেন।

প্রিন্স বললেন, এতকাল তুমি কোথায় ছিলে প্রিয়তম?

আমিও যেন আপনাকেই খুঁজছিলাম।

মনে হতে পারে তাদের প্রেম ও কথোপকথনে অতিনাটকীয়তায় আন্তরিকতার ঘাটতি থাকা স্বাভাবিক। প্রথম দর্শনে কেউ এতটা উতলাভাব দেখায় না। কবির উচ্ছ্বাস বলে কথা। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন ইঝোমি শিকিবু। প্রিন্স হয়ত তাকে ভুলাবার জন্যই অতিকথা বলছেন।

হেইয়ান কিয়োতে দিন যাচ্ছে এভাবেই। একদিন ইঝোমির স্বামী মিচিসাদা তার খোঁজে সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে উপস্থিত হন। ইমনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তার। ইঝোমিকে নিয়ে যেতে এসেছেন। ইঝোমি সকালে এসে বের হয়ে গেছেন। ইমন বললেন, এই মাত্র সম্রাজ্ঞীর অতি গোপনীয় কাজে বের হয়ে গেছে। আসামাত্রই আমি পাঠিয়ে দেব। মিচিসাদা ফিরে গেলেন। এরকমটা এখন প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। ইঝোমি এসেই সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বের হয়ে যান। কখনো ফিরে আসেন, কখনো না।

আজ ফিরে আসার পর ইমন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাকে বলতে পারো প্রায় প্রতিদিন কোথায় যাওয়া হয়?

কেন?

আজ তোমার স্বামী এসেছিলেন।

এখান পর্যন্ত? কেন এসেছিল?

তোমাকে নিয়ে যেতে। বলতে চাও না, ভালো। আমি বলেছি মহামান্যের কাজে বাইরে গেছ। তুমি এখনই স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করো। আরেকটা কথা, মহামান্যা বিরক্ত হচ্ছে বলে মনে হয়।

আপনি সামলে নেবেন, আমি এখনই যাচ্ছি।

বেশ যাও।

ইমন আবারো হতাশ। যে জন্য তাকে আনা হয়েছিল তা ব্যর্থ হয়ে গেল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। কিন্তু তিনি জানেন না, এ চেয়েও দুঃখজনক সংবাদ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

সম্রাজ্ঞী শোশি আজ রাতে সম্রাট ইচিজোর কক্ষে যাবেন। তাই তার সাজসজ্জাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার তদারকি করছেন ইমন। সাজনেদার সাজাচ্ছে, দাসী-বাদীরা অন্য কাজকর্ম করে দিচ্ছে। ইমন ভাবলেন, অনেক ভালো আছেন তিনি এককভাবে স্বামীর ভালোবাসা নিয়ে। অথচ এই সম্রাজ্ঞীকে পাঁচজন সতীনের সঙ্গে ভালোবাসা ভাগাভাগি করতে হয়। একে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি বলা যায়। মা-বাবার সংসারেও তিনি ছোট্ট শোশিকে বড় হতে দেখেছেন। বড় হওয়া অর্থ বারো বছর বয়স হওয়া। বারো বছর বয়সে সম্রাটের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এখন অবশ্য বয়স কিছুটা বেড়েছে।

সম্রাট ইচিজোর বয়সও খুব বেশি নয়। ছয় বৎসর বয়সে উত্তরাধিকারী হিসেবে সিংহাসনে আরোহন করেন। চব্বিশ বছর হতে না হতেই পাঁচ-পাঁচজন স্ত্রী তার। তবে সকল বিয়ে তিনি ব্যক্তিগত উৎসাহে করেননি। সম্রাটের দরবারে ফুজিওয়ারাদের অসম্ভব প্রভাব ও প্রতিপত্তি। তাদের অনুরোধে (চাপে) তাকে বিয়ে করতে হয়। শোশি এবং তেইশি ছাড়া অপর তিন স্ত্রী হচ্ছেন ফুজিওয়ারা নো গিশি, ফুজিয়ারা নো গেনশি এবং ফুজিওয়ারা সোনশি।

তারা অবশ্য সবাই সম্রাটের ইয়ামাতো প্রাসাদে বাস করেন না। শেষের তিনজন ভিন্ন ভিন্ন প্রাসাদে থাকেন। (ক্রমশ...)