ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর প্রভাব

জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে উপকূলের ১৪ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত

দু’লাখ মানুষ পানিবন্দী : তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বাংলাদেশে আঘাত না হানলেও জলোচ্ছ্বাস ও বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে। এর মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় ধসে গেছে প্রায় শতাধিক বেড়িবাঁধ। এছাড়া জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে বরগুনার ২৬টি গ্রাম, বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে পটুয়াখালীর ৩৪টি গ্রাম, ৩-৪ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে ফেনীতে পানিতে ডুবে মারা গেছেন এক জেলে, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে নি¤œাঞ্চল ও ঝিনাইদহে ঝড়ো হাওয়ায় অর্ধশত বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এতে সারাদেশে প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বলে স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানান।

তবে সরকারি হিসাবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ১৪ জেলার ২৭টি উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত এসব উপজেলার মানুষের সহায়তায় সাড়ে ১৬ হাজার শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৭৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, আনসার ভিডিপির স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন বলে জানান তিনি। গতকাল সচিবালয় মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি ?ও ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের উড়িষ্যা, বালেশ^র ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আঘাত হানে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ সময় ঘণ্টায় ১৫৫ কিলোমিটার গতিবেগে স্থলভাগ অতিক্রম করার সময় ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড়টি। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের উত্তরের উপকূলে আঘাত হানার পর দুর্বল হয়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। গতকাল দুপুর ৩টার দিকে এটি দুর্বল হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আকারে উত্তর উড়িষ্যা উপকূলীয় এলাকায় অবস্থার করছিল। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্য বিরাজ করছে। তাই চট্টগ্রাম, কক্সবাজার,মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।

স্থানীয়রা জানায়, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ৩-৬ ফুট উ””তার জলোচ্ছ্বাসের কারণে প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন চর এলাকায় নি¤œাঞ্চল। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

সাতক্ষীরা : ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে সাতক্ষীরার ৬ উপজেলার শতাধিক গ্রাম, চিংড়ি ঘের ও ফসলী জমি প্লাবিত, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগর ও আশশুনিসহ ছয়টি উপজেলার শতাধিক গ্রাম বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে পড়া জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব গ্রামের বিপুল সংখ্যক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে ছয়টি উপজেলার কয়েকশত চিংড়ি ঘের ও ফসলী জমি। নষ্ট হয়েছে সুপেয় পানির আধারগুলো। পানির তোড়ে সাতক্ষীরার সঙ্গে শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রধান প্রধান সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

পটুয়াখালী : উপকূলীয় কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী ও পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় ইয়াস এবং পূর্ণীমা জোয়ের প্রভাবে বিস্তৃর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত খুবই কম। দমকা বাতাস বইছে। পূবাল বাতাসে সাগর উত্তাল। কলাপাড়া উপজেলা ১৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ২টি মুজিব কিল্লা আশ্রয়ের জন্য প্রস্তুত রাখা হলেও সেখানে আশ্রয় নেয়ার জন্য মানুষের দেখা মেলেনি বলে আমাদের উপজেলা প্রতিনিধি জানান। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, কলাপাড়া উপজেলায় খাপড়াভাঙ্গা নদীর দুই পাড়ের প্রায় ৫ হাজার মানুষ পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

নোয়াখালী : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নিন্মাঞ্চলের ২৫টি গ্রাম। জোয়ারে নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের ৯টি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে হাতিয়ার চারপাশে নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩-৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে উপজেলার চরঈশ্বর ইউনিয়নের ৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিবন্দী হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ।

কক্সবাজার : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপড়ে পড়েছে গাছপালা, বিধ্বস্ত হয়েছে বহু ঘরবাড়ি। জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের অর্ধশতাধিক গ্রামে ঢুকে পড়েছে জোয়ারের পানি। কক্সবাজার শহরের অন্তত তিনটি এলাকায় বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে হাজারও মানুষ। কক্সাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কেও আচড়ে পড়ছে জোয়ারের পানি।

ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের আড়মুখী গ্রামে হঠাৎ ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়েছে অর্ধশত বাড়িঘর। উপড়ে গেছে শত শত গাছপালা। মঙ্গলবার রাতে সদর উপজেলার আড়মুখী গ্রামে এ ঝড় আঘাত হানে।

ফেনী : উপকূলীয় উপজেলা সোনাগাজীতে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’র প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে ডুবে হাদিউজ্জামান নামে এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। মৃত ওই জেলের বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার শেখপাড়া গ্রামে। গত মঙ্গলবার দুপুরে পোনা মাছ ধরতে গিয়ে ছোট ফেনী নদীর চরচান্দিয়ার বাইরে চর এলাকায় জোয়ারের পানিতে ডুবে নিখোঁজ হন তিনি।

চট্টগ্রাম : বাঁশখালী উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে পানিতে তলিয়ে গেছে নি¤œাঞ্চল। বুধবার সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও প্রবল বাতাসের বেগে উপজেলার উপকূলীয় গন্ডামারা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মধুখালী, ৩নং ওয়ার্ডের ওয়াপদা বেড়িবাঁধসংলগ্ন লালপুরী বাপের বাড়ি ও পশ্চিম বড়ঘোনার আলেকদিয়া, ছনুয়া ইউনিয়নের হাবাখালী, ছনুয়ার টেক ও শেলবন, পশ্চিম সাধনপুর, খানখানাবাদের প্রেমাশিয়া, শেখেরখীল ইউনিয়নের গুইল্যাখালী, শীলকূপের মনকিচর এলাকার নি¤œাঞ্চলসমূহ পানিতে তলিয়ে যায়।

বরগুনা : ইয়াসের প্রভাবে আমতলী ও তালতলী উপজেলার পায়রা নদী তীরবর্তী ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে অবস্থিত ২৬টি গ্রাম মঙ্গলবার রাতে এবং বুধবার সকালে জোয়ারের সময় প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে নদীতে বিপদ সীমার প্রায় ৮৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পনি প্রবাহিত হওয়ায় শতাধিক পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ২ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক কাঁচা ঘড়বাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলো হচ্ছে আমতলী উপজেলার লোছা, পশ্চিম আমতলী, নয়ভাঙ্গলী, গরুর বাজার, ফেরিঘাট, লঞ্চঘাট, শ্মশানঘাট, পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকার ব্লক, বেঠাকাটা জেলে পাড়া, আঙ্গুলকাটা, বালিয়াতলী, গাজীপুর বন্দর, আমড়া গাছিয়া, চরখালী, গুলিশাখালী জেলেপাড়া, হরিদ্রাবাড়িয়া। তালতলী উপজেলার খোট্টার চর, জয়ালভাঙ্গা, তেঁতুল বাড়িয়া, নিন্দ্রা, ইদুপাড়া, ছকিনা, মালিপাড়া, তালতলী মাছ বাজার, ছোটবগীর বেড়িবাঁধের বাইরে অবস্থিত গ্রাম, ঠংপাড়া, তালুকদার পাড়াসহ আরও কয়েকটি গ্রাম।

ভোলা : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন নদী তীরবর্তী নয়টি ইউনিয়নের ৩৫ হাজার মানুষ। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। পানির নিচে রয়েছে রাস্তাঘাট, ভেঙে গেছে বহু ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ভেসে গেছে মাছের ঘের ও পুকুর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দুশ্চিন্তায় কাটাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো।

মুন্সীগঞ্জ : ইয়াসের প্রভাবে পদ্মায় প্রচণ্ড ঢেউয়ের মুখে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ঘাটে পাঁচ শতাধিক গাড়িসহ কয়েক হাজার মানুষ আটকা পড়েছে। ঢেউয়ের মধ্যে ফেরি ও পন্টুন রক্ষায় হিমশিম খেতে হচ্ছে ঘাট বিআইডব্লিউটিএ। বুধবার সকালে প্রচণ্ড ঢেউয়ে শিমুলিয়া ফেরিঘাটে পন্টুনটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য তিনটি ঘাটও ঝুঁকিতে পড়েছে বলে জানান ঘাট কর্তৃপক্ষ।

গতকাল দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বা বাঁধ ভেঙে যেসব মৎস্য ও কৃষিজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মৎস্যজীবী যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৎস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হবে। যাদের ফসলের ক্ষতি হয়েছে তাদের কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে স্বল্প সুদে ঋণ এবং বিনামূল্যে বীজ, চারা ও সার সরবরাহ করা হবে।

বৃহস্পতিবার, ২৭ মে ২০২১ , ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৪ শাওয়াল ১৪৪২

ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর প্রভাব

জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে উপকূলের ১৪ জেলা ক্ষতিগ্রস্ত

দু’লাখ মানুষ পানিবন্দী : তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

পটুয়াখালী : কলাপাড়ায় জলোচ্ছ্বাসে রাবার ড্যাম ভেঙে প্লাবিত গ্রাম -সংবাদ

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বাংলাদেশে আঘাত না হানলেও জলোচ্ছ্বাস ও বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে। এর মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় ধসে গেছে প্রায় শতাধিক বেড়িবাঁধ। এছাড়া জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে বরগুনার ২৬টি গ্রাম, বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে পটুয়াখালীর ৩৪টি গ্রাম, ৩-৪ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে ফেনীতে পানিতে ডুবে মারা গেছেন এক জেলে, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে নি¤œাঞ্চল ও ঝিনাইদহে ঝড়ো হাওয়ায় অর্ধশত বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এতে সারাদেশে প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বলে স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানান।

তবে সরকারি হিসাবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ১৪ জেলার ২৭টি উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত এসব উপজেলার মানুষের সহায়তায় সাড়ে ১৬ হাজার শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৭৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, আনসার ভিডিপির স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন বলে জানান তিনি। গতকাল সচিবালয় মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি ?ও ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের উড়িষ্যা, বালেশ^র ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আঘাত হানে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ সময় ঘণ্টায় ১৫৫ কিলোমিটার গতিবেগে স্থলভাগ অতিক্রম করার সময় ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড়টি। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের উত্তরের উপকূলে আঘাত হানার পর দুর্বল হয়ে পড়েছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। গতকাল দুপুর ৩টার দিকে এটি দুর্বল হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আকারে উত্তর উড়িষ্যা উপকূলীয় এলাকায় অবস্থার করছিল। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্য বিরাজ করছে। তাই চট্টগ্রাম, কক্সবাজার,মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।

স্থানীয়রা জানায়, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ৩-৬ ফুট উ””তার জলোচ্ছ্বাসের কারণে প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন চর এলাকায় নি¤œাঞ্চল। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

সাতক্ষীরা : ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে সাতক্ষীরার ৬ উপজেলার শতাধিক গ্রাম, চিংড়ি ঘের ও ফসলী জমি প্লাবিত, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগর ও আশশুনিসহ ছয়টি উপজেলার শতাধিক গ্রাম বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে পড়া জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব গ্রামের বিপুল সংখ্যক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে ছয়টি উপজেলার কয়েকশত চিংড়ি ঘের ও ফসলী জমি। নষ্ট হয়েছে সুপেয় পানির আধারগুলো। পানির তোড়ে সাতক্ষীরার সঙ্গে শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রধান প্রধান সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

পটুয়াখালী : উপকূলীয় কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী ও পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় ইয়াস এবং পূর্ণীমা জোয়ের প্রভাবে বিস্তৃর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত খুবই কম। দমকা বাতাস বইছে। পূবাল বাতাসে সাগর উত্তাল। কলাপাড়া উপজেলা ১৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ২টি মুজিব কিল্লা আশ্রয়ের জন্য প্রস্তুত রাখা হলেও সেখানে আশ্রয় নেয়ার জন্য মানুষের দেখা মেলেনি বলে আমাদের উপজেলা প্রতিনিধি জানান। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, কলাপাড়া উপজেলায় খাপড়াভাঙ্গা নদীর দুই পাড়ের প্রায় ৫ হাজার মানুষ পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

নোয়াখালী : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নিন্মাঞ্চলের ২৫টি গ্রাম। জোয়ারে নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের ৯টি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে হাতিয়ার চারপাশে নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩-৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে উপজেলার চরঈশ্বর ইউনিয়নের ৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিবন্দী হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ।

কক্সবাজার : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপড়ে পড়েছে গাছপালা, বিধ্বস্ত হয়েছে বহু ঘরবাড়ি। জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের অর্ধশতাধিক গ্রামে ঢুকে পড়েছে জোয়ারের পানি। কক্সবাজার শহরের অন্তত তিনটি এলাকায় বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে হাজারও মানুষ। কক্সাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কেও আচড়ে পড়ছে জোয়ারের পানি।

ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের আড়মুখী গ্রামে হঠাৎ ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়েছে অর্ধশত বাড়িঘর। উপড়ে গেছে শত শত গাছপালা। মঙ্গলবার রাতে সদর উপজেলার আড়মুখী গ্রামে এ ঝড় আঘাত হানে।

ফেনী : উপকূলীয় উপজেলা সোনাগাজীতে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’র প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে ডুবে হাদিউজ্জামান নামে এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। মৃত ওই জেলের বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার শেখপাড়া গ্রামে। গত মঙ্গলবার দুপুরে পোনা মাছ ধরতে গিয়ে ছোট ফেনী নদীর চরচান্দিয়ার বাইরে চর এলাকায় জোয়ারের পানিতে ডুবে নিখোঁজ হন তিনি।

চট্টগ্রাম : বাঁশখালী উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে পানিতে তলিয়ে গেছে নি¤œাঞ্চল। বুধবার সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও প্রবল বাতাসের বেগে উপজেলার উপকূলীয় গন্ডামারা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মধুখালী, ৩নং ওয়ার্ডের ওয়াপদা বেড়িবাঁধসংলগ্ন লালপুরী বাপের বাড়ি ও পশ্চিম বড়ঘোনার আলেকদিয়া, ছনুয়া ইউনিয়নের হাবাখালী, ছনুয়ার টেক ও শেলবন, পশ্চিম সাধনপুর, খানখানাবাদের প্রেমাশিয়া, শেখেরখীল ইউনিয়নের গুইল্যাখালী, শীলকূপের মনকিচর এলাকার নি¤œাঞ্চলসমূহ পানিতে তলিয়ে যায়।

বরগুনা : ইয়াসের প্রভাবে আমতলী ও তালতলী উপজেলার পায়রা নদী তীরবর্তী ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে অবস্থিত ২৬টি গ্রাম মঙ্গলবার রাতে এবং বুধবার সকালে জোয়ারের সময় প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে নদীতে বিপদ সীমার প্রায় ৮৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পনি প্রবাহিত হওয়ায় শতাধিক পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ২ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক কাঁচা ঘড়বাড়ি। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলো হচ্ছে আমতলী উপজেলার লোছা, পশ্চিম আমতলী, নয়ভাঙ্গলী, গরুর বাজার, ফেরিঘাট, লঞ্চঘাট, শ্মশানঘাট, পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকার ব্লক, বেঠাকাটা জেলে পাড়া, আঙ্গুলকাটা, বালিয়াতলী, গাজীপুর বন্দর, আমড়া গাছিয়া, চরখালী, গুলিশাখালী জেলেপাড়া, হরিদ্রাবাড়িয়া। তালতলী উপজেলার খোট্টার চর, জয়ালভাঙ্গা, তেঁতুল বাড়িয়া, নিন্দ্রা, ইদুপাড়া, ছকিনা, মালিপাড়া, তালতলী মাছ বাজার, ছোটবগীর বেড়িবাঁধের বাইরে অবস্থিত গ্রাম, ঠংপাড়া, তালুকদার পাড়াসহ আরও কয়েকটি গ্রাম।

ভোলা : ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন নদী তীরবর্তী নয়টি ইউনিয়নের ৩৫ হাজার মানুষ। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। পানির নিচে রয়েছে রাস্তাঘাট, ভেঙে গেছে বহু ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ভেসে গেছে মাছের ঘের ও পুকুর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দুশ্চিন্তায় কাটাচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো।

মুন্সীগঞ্জ : ইয়াসের প্রভাবে পদ্মায় প্রচণ্ড ঢেউয়ের মুখে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ঘাটে পাঁচ শতাধিক গাড়িসহ কয়েক হাজার মানুষ আটকা পড়েছে। ঢেউয়ের মধ্যে ফেরি ও পন্টুন রক্ষায় হিমশিম খেতে হচ্ছে ঘাট বিআইডব্লিউটিএ। বুধবার সকালে প্রচণ্ড ঢেউয়ে শিমুলিয়া ফেরিঘাটে পন্টুনটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য তিনটি ঘাটও ঝুঁকিতে পড়েছে বলে জানান ঘাট কর্তৃপক্ষ।

গতকাল দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বা বাঁধ ভেঙে যেসব মৎস্য ও কৃষিজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মৎস্যজীবী যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মৎস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হবে। যাদের ফসলের ক্ষতি হয়েছে তাদের কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে স্বল্প সুদে ঋণ এবং বিনামূল্যে বীজ, চারা ও সার সরবরাহ করা হবে।