কালোটাকা সাদা করার সুযোগ

এসএম জাহাঙ্গীর আলম

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য আসছে ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি জাতীয় বাজেট। গত অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় আগামী বাজেটের আকার খুব একটা বেশি নয়। দেশে করোনা প্রেক্ষাপটের কারণে নতুন অর্থবছরের বাজেটের খুব একটা বড় আকারে করা হচ্ছে না। করোনায় দেশের আর্থ-সামাজিক খাত অনেকটাই বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তবে সার্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধার লক্ষ্যে নতুন বাজেটের মূল লক্ষ্য আসছে- জাতীয় বাজেটে কালোটাকা সাদা করার বিধান থাকছে। সম্প্রতি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যতদিন অপ্রদর্শিত আয় থাকবে ততদিন পর্যন্ত এ সুযোগ থাকবে। পুঁজিবাজার, ব্যাংক আমানতে, নগদ টাকা, ফ্ল্যাট কেনাসহ সব ক্ষেত্রে বিনাপ্রশ্নে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে।

দেশে অপ্রদর্শিত আয় তথা কালোটাকার পরিমাণ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই নির্দিষ্ট হারে কর প্রদান করে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি সাদা করা হয়েছে। করোনার মধ্যেও এ পরিমাণ টাকা সাদা করা হয়েছে। অবশ্য এতে লাভ হয়েছে কর ফাঁকি দেয়া ব্যক্তিদের। আমি মনে করি, এ সুবিধা বন্ধ করে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে নজরদারি জোরদার করা প্রয়োজন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৬ বার এ সুযোগ দেয়া হয়। তাতে মাত্র ৩০ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। উল্লেখ্য, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সবচেয়ে বেশি কালোটাকা সাদা করা হয়েছে।

বাংলাদেশে কালোটাকার পরিমাণ কত তা নিয়ে আছে নানা বিভ্রান্তি। অবশ্য এ নিয়ে কোন গবেষণা নেই বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অথবা কোন দফতর গবেষণা বিষয়ে চিন্তাও করে না। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে কালোটাকার পরিমাণ ছিল ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। আর ২০১১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায় ২০১০ সালে কালোটাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬২ শতাংশ ৭ ভাগ। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে কালোটাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৩৫ দশমিক ৬ ভাগ। তবে বাংলাদেশ অর্র্থনীতি সমিতি ২০২০ সালে বলেছিল যে, দেশে বর্তমানে কালোটাকার পরিমাণ ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি। ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কালোটাকা সাদা করতে গিয়ে আয়ের উৎস নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হয়নি।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, সভ্যতার গোড়া থেকে সাদা ও কালো পরস্পর হাত ধরাধরি করে আসছে; যা পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি রয়েছে একটি সীমারেখার মধ্যে। যেমন পশ্চিমা বিশ্ব, মধ্যম আয়ের দেশ ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার কিছু দেশে; যেখানে অফশোর হিসাব বলে একটি কার্যক্রম প্রচলিত আছে। যেখানে বিশেষায়িক অঞ্চলে কালোটাকা বিনিয়োগ করলে কোন প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হয় না; যা অর্থনীতিতে বিনিয়োগের একটি বৃহৎ অংশ দখল করে রয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বলেছে যে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়- যেটাকে কালো টাকাই মনে করা হয়।

এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, প্রথমত- কালো টাকার মালিকদের ভয় থাকে যে, তারা পরবর্তীতে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে এবং ভাগ্য খারাপ হলে আইনের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা হতে পারে। দ্বিতীয়ত- নিকট বা দূর অতীতে কালোটাকা সাদা করার জন্য ছুটবেন আর বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনতে কাউকে বাধ্য করা হয়নি বা এ ধরনের ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি টাকা সাদা করার জন্য ছুটবেন এবং বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনতে কাউকে বাধ্য করা হয়নি বা এ ধরনের দৃশ্যমান কোন সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ে না; যার দ্বারা কালোটাকার মালিকরা বিদেশে টাকা পাচার করতে নিরুৎসাহিত হবেন। অর্থনীতিতে কালোটাকার প্রভাব কমাতে হবে, না হলে সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে কালোটাকা যে অর্থনীতির জন্য শুধু ক্ষতি বয়ে আনে ব্যাপারটা তেমন নয়। কালোটাকা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তথা উন্নয়নেও ভূমিকা আছে; তবে সমাজের অসমতা, দুর্নীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক অপরাধ, ঘুষবাণিজ্য, অসততা- এগুলো জিইয়ে রাখা এবং বাড়িয়ে দেয়ার জন্য কালোটাকার ভূমিকা আছে।

তবে কালোটাকা যেহেতু অর্থনীতিতে ঢুকে থাকে তাই এতে দুই ধরনের সমস্যা হয়। সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় আর সৎ ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারীরা কালোটাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে ওঠেন না। ফলে অর্থনীতিতে নষ্ট হয় ভারসাম্য। বর্তমান সরকার আগেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে আর আসছে বাজেটেও এ সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। এ সুযোগে যদি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা সাদা হয়ে দেশের এ ক্রান্তিকালে কাজে আসে তাহলে খারাপ কী? তবে এ সুযোগের অপব্যবহার করে যারা টাকা সাদা করবে না, টাকা পাচার করবে, তাদের উল্লেখযোগ্য ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যদিও ব্যাপারটা বেশ জঠিল ও কঠিন। যদি তা না পারা যায় তবে সমাজে অপরাধ, ঘুষ, দুর্নীতি জবাবহীনতা, সিন্ডিকেট বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি তথা সমাজে অপরাধের পরিমাণ বেড়ে যাবে। আসছে বাজেটে কালোটাকা ঢালাওভাবে সাদা করার সুযোগ না থাকলেও আগের মতো নির্ধারিত অতিরিক্ত জরিমানা দিয়ে টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল থাকছে। অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের অনুরোধে এ সুযোগ রাখা হচ্ছে।

চলতি ২০২০-২১ জাতীয় বাজেটের বিশেষ সুযোগ হিসেবে ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত বিনিয়োগ, নগদ অর্থ, স্থায়ী আমানত, জামি-ফ্ল্যাট রিটার্নে দেখানোর সুযোগ দেয়া হয়। গেল বছর মূলধারার অর্থনীতিতে কালোটাকা আনতে এক বছরের জন্য এ সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এনবিআর থেকে জানা গেছে, এ সুযোগ আর বাড়ানো হবে না। কারণ দেশে ব্যক্তিশ্রেণীর সর্বোচ্চ কর হার ২৫ শতাংশ। এ সুযোগ অব্যাহত রাখা হলে করদাতারা নিয়মিত কর না দিয়ে তা লুকিয়ে রেখে পরবর্তীকালে কম হারে কর দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। এ পদ্ধতি চালু রাখলে সৎ ও নিয়মিত করদাতাদের নিরুৎসাহিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এ বিশেষ বিধান বাতিল করে আগের সব পদ্ধতি বহাল রাখা হচ্ছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।

উল্লেখ্য, আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(ই) ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে যে কোনো খাতেই কালোটাকা বিনিয়োগ করা যায়। বাজেটে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে টাকা সাদা করা যাবে বলে জানিয়েছে এনবিআর। বিনিয়োগ করা যাবে শেয়ারবাজার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, ডিবেঞ্জার এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির অন্যান্য সিকিউরিটিতে। তবে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে এক বছরের জন্য। এছাড়া ১০ শতাংশ কর দিয়ে ব্যাংকেও জমা রাখা যাবে এই টাকা। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে বলা হয়- নগদ, ব্যাংক জমা, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন ধরনের স্কিমে এ টাকা বিনিয়োগ করা যাবে। সবচেয়ে বড় যে সুবিধা হলো- এ বিনিয়োগ নিয়ে কোন সংস্থা প্রশ্ন করতে পারবে না। প্রশ্ন করতে পারবে না দুর্নীতি দমন কমিশনও। পূর্ববর্তী সময়ে এ সুযোগ রাখা হতো না।

[লেখক : সাবেক কর কমিশনার, এনবিআর]

বৃহস্পতিবার, ২৭ মে ২০২১ , ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৪ শাওয়াল ১৪৪২

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ

এসএম জাহাঙ্গীর আলম

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য আসছে ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি জাতীয় বাজেট। গত অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় আগামী বাজেটের আকার খুব একটা বেশি নয়। দেশে করোনা প্রেক্ষাপটের কারণে নতুন অর্থবছরের বাজেটের খুব একটা বড় আকারে করা হচ্ছে না। করোনায় দেশের আর্থ-সামাজিক খাত অনেকটাই বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তবে সার্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধার লক্ষ্যে নতুন বাজেটের মূল লক্ষ্য আসছে- জাতীয় বাজেটে কালোটাকা সাদা করার বিধান থাকছে। সম্প্রতি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী এ কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যতদিন অপ্রদর্শিত আয় থাকবে ততদিন পর্যন্ত এ সুযোগ থাকবে। পুঁজিবাজার, ব্যাংক আমানতে, নগদ টাকা, ফ্ল্যাট কেনাসহ সব ক্ষেত্রে বিনাপ্রশ্নে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে।

দেশে অপ্রদর্শিত আয় তথা কালোটাকার পরিমাণ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই নির্দিষ্ট হারে কর প্রদান করে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি সাদা করা হয়েছে। করোনার মধ্যেও এ পরিমাণ টাকা সাদা করা হয়েছে। অবশ্য এতে লাভ হয়েছে কর ফাঁকি দেয়া ব্যক্তিদের। আমি মনে করি, এ সুবিধা বন্ধ করে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে নজরদারি জোরদার করা প্রয়োজন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৬ বার এ সুযোগ দেয়া হয়। তাতে মাত্র ৩০ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। উল্লেখ্য, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সবচেয়ে বেশি কালোটাকা সাদা করা হয়েছে।

বাংলাদেশে কালোটাকার পরিমাণ কত তা নিয়ে আছে নানা বিভ্রান্তি। অবশ্য এ নিয়ে কোন গবেষণা নেই বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অথবা কোন দফতর গবেষণা বিষয়ে চিন্তাও করে না। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে কালোটাকার পরিমাণ ছিল ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। আর ২০১১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায় ২০১০ সালে কালোটাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬২ শতাংশ ৭ ভাগ। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে কালোটাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৩৫ দশমিক ৬ ভাগ। তবে বাংলাদেশ অর্র্থনীতি সমিতি ২০২০ সালে বলেছিল যে, দেশে বর্তমানে কালোটাকার পরিমাণ ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি। ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কালোটাকা সাদা করতে গিয়ে আয়ের উৎস নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হয়নি।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, সভ্যতার গোড়া থেকে সাদা ও কালো পরস্পর হাত ধরাধরি করে আসছে; যা পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি রয়েছে একটি সীমারেখার মধ্যে। যেমন পশ্চিমা বিশ্ব, মধ্যম আয়ের দেশ ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার কিছু দেশে; যেখানে অফশোর হিসাব বলে একটি কার্যক্রম প্রচলিত আছে। যেখানে বিশেষায়িক অঞ্চলে কালোটাকা বিনিয়োগ করলে কোন প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হয় না; যা অর্থনীতিতে বিনিয়োগের একটি বৃহৎ অংশ দখল করে রয়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি বলেছে যে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়- যেটাকে কালো টাকাই মনে করা হয়।

এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, প্রথমত- কালো টাকার মালিকদের ভয় থাকে যে, তারা পরবর্তীতে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে এবং ভাগ্য খারাপ হলে আইনের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা হতে পারে। দ্বিতীয়ত- নিকট বা দূর অতীতে কালোটাকা সাদা করার জন্য ছুটবেন আর বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনতে কাউকে বাধ্য করা হয়নি বা এ ধরনের ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি টাকা সাদা করার জন্য ছুটবেন এবং বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনতে কাউকে বাধ্য করা হয়নি বা এ ধরনের দৃশ্যমান কোন সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ে না; যার দ্বারা কালোটাকার মালিকরা বিদেশে টাকা পাচার করতে নিরুৎসাহিত হবেন। অর্থনীতিতে কালোটাকার প্রভাব কমাতে হবে, না হলে সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। তবে কালোটাকা যে অর্থনীতির জন্য শুধু ক্ষতি বয়ে আনে ব্যাপারটা তেমন নয়। কালোটাকা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে তথা উন্নয়নেও ভূমিকা আছে; তবে সমাজের অসমতা, দুর্নীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক অপরাধ, ঘুষবাণিজ্য, অসততা- এগুলো জিইয়ে রাখা এবং বাড়িয়ে দেয়ার জন্য কালোটাকার ভূমিকা আছে।

তবে কালোটাকা যেহেতু অর্থনীতিতে ঢুকে থাকে তাই এতে দুই ধরনের সমস্যা হয়। সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় আর সৎ ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারীরা কালোটাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে ওঠেন না। ফলে অর্থনীতিতে নষ্ট হয় ভারসাম্য। বর্তমান সরকার আগেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে আর আসছে বাজেটেও এ সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। এ সুযোগে যদি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা সাদা হয়ে দেশের এ ক্রান্তিকালে কাজে আসে তাহলে খারাপ কী? তবে এ সুযোগের অপব্যবহার করে যারা টাকা সাদা করবে না, টাকা পাচার করবে, তাদের উল্লেখযোগ্য ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যদিও ব্যাপারটা বেশ জঠিল ও কঠিন। যদি তা না পারা যায় তবে সমাজে অপরাধ, ঘুষ, দুর্নীতি জবাবহীনতা, সিন্ডিকেট বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি তথা সমাজে অপরাধের পরিমাণ বেড়ে যাবে। আসছে বাজেটে কালোটাকা ঢালাওভাবে সাদা করার সুযোগ না থাকলেও আগের মতো নির্ধারিত অতিরিক্ত জরিমানা দিয়ে টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল থাকছে। অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের অনুরোধে এ সুযোগ রাখা হচ্ছে।

চলতি ২০২০-২১ জাতীয় বাজেটের বিশেষ সুযোগ হিসেবে ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত বিনিয়োগ, নগদ অর্থ, স্থায়ী আমানত, জামি-ফ্ল্যাট রিটার্নে দেখানোর সুযোগ দেয়া হয়। গেল বছর মূলধারার অর্থনীতিতে কালোটাকা আনতে এক বছরের জন্য এ সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এনবিআর থেকে জানা গেছে, এ সুযোগ আর বাড়ানো হবে না। কারণ দেশে ব্যক্তিশ্রেণীর সর্বোচ্চ কর হার ২৫ শতাংশ। এ সুযোগ অব্যাহত রাখা হলে করদাতারা নিয়মিত কর না দিয়ে তা লুকিয়ে রেখে পরবর্তীকালে কম হারে কর দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। এ পদ্ধতি চালু রাখলে সৎ ও নিয়মিত করদাতাদের নিরুৎসাহিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এ বিশেষ বিধান বাতিল করে আগের সব পদ্ধতি বহাল রাখা হচ্ছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।

উল্লেখ্য, আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(ই) ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে যে কোনো খাতেই কালোটাকা বিনিয়োগ করা যায়। বাজেটে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে টাকা সাদা করা যাবে বলে জানিয়েছে এনবিআর। বিনিয়োগ করা যাবে শেয়ারবাজার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, ডিবেঞ্জার এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির অন্যান্য সিকিউরিটিতে। তবে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে এক বছরের জন্য। এছাড়া ১০ শতাংশ কর দিয়ে ব্যাংকেও জমা রাখা যাবে এই টাকা। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে বলা হয়- নগদ, ব্যাংক জমা, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন ধরনের স্কিমে এ টাকা বিনিয়োগ করা যাবে। সবচেয়ে বড় যে সুবিধা হলো- এ বিনিয়োগ নিয়ে কোন সংস্থা প্রশ্ন করতে পারবে না। প্রশ্ন করতে পারবে না দুর্নীতি দমন কমিশনও। পূর্ববর্তী সময়ে এ সুযোগ রাখা হতো না।

[লেখক : সাবেক কর কমিশনার, এনবিআর]