বজ্রপাতে বাড়ছে ঝুঁকি

মিহির কুমার রায়

প্রতি বছর এ সময়ে বজ্রপাতসহ বৃষ্টি হওয়া খুবই সাভাবিক ঘটনা। সম্প্রতি বাংলাদেশে এর প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যদিও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিলে। কিন্তু সেখানকার তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার বেশি। গত ১৮ মে ঢাকাসহ সারাদেশে প্রবল ঝর ও বজ্রপাত ১৮ জন লোক মারা গেছে বিশেষত: হাওরবেষ্টিত জেলা নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ আরও এলাকয় যাদের মধ্যে অনেকেই মাঠে ধান কাটা নিয়ে ব্যস্ত ছিল কিন্তু এ বছর বেশ কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষণীয় যাকে অনেকই বলছে জলবায়ু পরিবর্তন ফল এটি। তাহলে পরিবর্তনটা কি?

প্রকৃতিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলছে বিধায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মেঘে মেঘে সংঘর্ষ বজ্রপাতকে ত্বরান্বিত করছে। আবার বিভিন্ন গবেষক বিজ্ঞানীরা বলছেন বজ্রপাত বেড়ে যাওয়া সঙ্গে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি সম্পর্ক রয়েছে, যা প্রামাণিত এবং প্রাকৃতির এক ভয়াবহ পরিণাম যে বজ্রপাতে কয়েক মিলি সেকেন্ডে তাপমাত্রা সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার কাছাকাছি চলে যায়। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে বিগত কয়েক বছরে ঢাকার বাতাসে কার্বনের পরিমাণ ৪% এর বেশি বেড়েছে এবং বাতাসে ধূলিকণার মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রোগ্রামের মনে করা হলেও এলাকা ভেদে প্রতি ঘনমিটারে ৬৬৫ থেকে ২০০০ পর্যন্ত মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে। তাহলে ঢাকা শহরে দেশের সবচাইতে বজ্রপাত প্রবণ এলাকা হওয়ার কথা থাকলেও তা বৈদ্যুতিক তাদের বেরাজালের কারণে বোঝা যায় না সত্যি কিন্তু বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রপাতি যেমন বাল্ব, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, ওবেন, এয়ারকুলার ইত্যাদি মূলধন যন্ত্রপাতির ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। এই ক্ষতি আবার সাধারণ ভোক্তাদের মেরামত খরচ বাড়িয়ে তোলে যা তাদের সাংসারিক বাজেটবহির্ভূত।

বজ্রপাত একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বর্তমানে এর ব্যাপকতা জনজীবনকে ভাবিয়ে তুলছে এবং ক্ষয়ক্ষতি নিযে এখন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ কিংবা ডাটাবেইস সৃষ্টিতে কর্তৃপক্ষ খুবই তৎপর। সরাকারি পর্যায়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন এনজিও গণমাধ্যম কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যে দেখা যায় যে বিগত পাঁচ বছরে সারাদেশে বজ্রপাতে প্রায় তিন হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছে এবং ২০১১ সালে পর থেকে এর প্রবণতা ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলছে যেমন ২০১৫ সালে ৯৯ জন, ২০১৬ সালে ৩৫১ জন ও ২০১৭ সালে ২৬২ আর ২০১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৭ জনের মৃত্যু, ২০২১ সালে মে পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যু ও চার শতাধিক আহত হওয়ায় খবর রয়েছে, যা গ্রামাঞ্চলে ফসলের মাঠে, পুকুরের পারে ও হাওরে বেশি সংঘটিত হচ্ছে। বজ্রপাতে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, বুয়েট, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমসহ একাধিক তথ্যমতে, বজ্রপাতে ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ২ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। এত বেশি মৃত্যুহারের জন্য মানুষের অসচেতনাকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকগণ। তারা বলেছেন, বজ্রপাত সম্পর্কে দেশের প্রান্তিক ও নিরক্ষর জনসাধারণের সঠিক ধারণা না থাকার দরুন মৃত্যুহার বেশি। ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাতের সময়ও এদেশের লোকজন খোলা মাঠে কাজ করে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের কৃষক ও জেলে সম্প্রদায়।

এর কারণ হিসাবে দেখা দিয়েছে তাল, নারিকেল, সুপারি ও বট বৃক্ষের মতো বড় গাছের অভার, কৃষি যন্ত্রপাতিতে ধাতব দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি, নদনদী শুকিয়ে যাওয়া, জলভূমি ভরাট হওয়া, গাছ পালা ধ্বংসের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাতের হার বাড়ার অন্যতম কারণ। আবার আবহাওয়াবীদরা বলছেন দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আর্দ্র বায়ু এবং উত্তর হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বাতাসের মিলনে বজ্রমেঘ, বজ্রঝর ও বজ্রপাতের সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় গড়ে ৪০টি বজ্রপাত হয়ে থাকে। এই বিষয়টি যেহেতু পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই গবেষণা, গবেষক ও জাতীয় নীতিনির্ধারণীতে তার প্রভাব নিয়ে তেমন কোন খবরাখবর পাওয়া যায় না এই কারণে যে গবেষণা বিষয়টি সবসমই একটি অনগ্রাধিকারের বিষয়, যা জাতীয় পরিকল্পনা কিংবা জাতীয় বাজেটেই হউক। তারপরও সারা পৃথিবীব্যাপী কিংবা বাংলাদেশে কিছুকিছু গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বজ্রপাতের অবস্থান নির্ণয়ের গবেষণায় দেখা যায় যে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে মোট বজ্রপাতের সংখ্যা ১৮০০ ছাড়িছে গেছে প্রতি বর্গকিলোমিটারে।

নাসার জিআইএসএস-এর গবেষক কাল প্রাইস তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন দুটি প্রকৃতিক দুর্যোগ যেমন বজ্রপাত ও দাবানলকে বিশেষভাবে প্রবাভিত করে থাকে এবং পরিবেশে এখন যে পরিমাণ কার্বন আছে তার যদি দ্বিগুণ বৃদ্ধি ঘটে তা হলে বজ্রপাত ঘটবে ৩২ ভাগ। তারমতে বায়ু দূষণের সঙ্গে বজ্রপাতের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। বেশিরভাগ গবেষকই মনে করেন বাসাতে সালফার ও নাইট্রোজেনের যৌগগুলোর পরিমাণ, তাপ শোষণ ও সাময়িক সংরক্ষণকারী গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বজ্রপাত বাড়া কিংবা কমার সম্পর্ক রয়েছে। অস্ট্রেলীয় প্রবাসি বাঙালি গবেষক উল্লেখ করেছেন দেশের উচ্চশীল গাছপালা কিংবা বনায়ন কমে যাওয়ায় বজ্রপাত ঘটনা ত্বরান্বিত হয়েছে।

বাংলাদেশে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকার ২০১৬ সালে ১৭ মে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করলেও এর কারণ অনুসন্ধান কিংবা প্রতিকারের কি উপায় হতে পারে সে বিষয় দেশের আবহাওয়াবিধরা বা দুর্যোগ বিজ্ঞানীরা সে সম্পর্কে কোন তথ্য-উপাত্ত দিতে পারছে না। অথচ বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে যাদের পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার পরিমাণ কিংবা গুণগত ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। এছাড়াও আবহাওয়া নিয়ে গবেষণা করার মতো গবেষক কিংবা বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেশে সরকারি পর্যায়ে থেকেও না থাকার মতো এ অবস্থায় রয়েছে। এ ব্যাপারে দু’একজন গবেষকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় জানা যায় একাধারে অত্যাধুনিক গবেষণার স্বল্পতা অপরদিকে অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, যা আবহাওয়া গবেষণার প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আরও উৎকণ্ঠার বিষয় হলোÑবাংলাদেশে মৃত্যুহার বেশি হলেও বজ্রপাত নিয়ে কোন গবেষণা ও তা থেকে মৃত্যুরোধের কোন কার্যক্রম নেই। সীমিত পরিসরে বজ্রপাত সম্পর্কে শুধু পুস্তিকা এবং সেমিনারের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে। সচেতনতার অভাব, বজ্রনিরোধক এবং উল্লেখযোগ্য সরকারি কোন কার্যক্রম না থাকায় প্রতি বছর এতগুলো প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। বজ্রপাতের কারণে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যেহেতু বজ্রপাত প্রতিরোধের কোন উপায় বের হয়নি সেহেতু বজ্রপাতের সময় আমাদের বেশকিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এ নিয়ে অনেক গবেষকের মধ্যে অসন্তুষ্টিও রয়েছে। তারপরও কোন সমস্যা যদি ঘরে এসে উপস্থিত হয় তখন সবই সজাক হয় কি করা যায় এবং বিষয়টি আসলে এত সহজ নয়। আমরা আমাদের জীবন বাঁচানোর তাগিদে এখন কিছুটা নড়ে চড়ে বসেছি এবং প্রবাদ আছে ‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’ তার সঙ্গে আরও একটি যোগ হয়েছে ‘আকাশে বজ্রপাত’ এখন মানুষ যাবে কোথায়। এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় সরকার কি ভাবছে বা কি আয়োজন তা নিয়ে জনমনে কিছুটা আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। এরি মধ্যে দুর্যোগ, এাণ ও পুনর্বাসন ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় বলছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মতে দেশের সবকটি জেলায় তাল বীজ বপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলছে এরই মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ তালবীজ রোপণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

এখন তাল গাছকে বজ্রপাতের উপশম হিসেবে কাজে কেন বাছাই করা হলো তা অনেকেরই মনে প্রশ্ন এবং কৃষিও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. এমএ ফারুক অনেক আগেই বলেছেন তাল গাছ একটি বহুজীবী উদ্ভিদ যার জীবনকাল নব্বই থেকে ১০০ বছর, ভূমি সংরক্ষণের সহায়ক সব জমিতে আইলে জম্মায়, মাটির মূল গভীরে বিধায় ফসল ক্ষতিকারক নয়, কম বৃষ্টিতে অধিক তাপমাত্রায় ও তীব্র বায়ু প্রবাহ সহ্য করতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু বীজ বপনের পর বজ্রপাতের ঝুঁকি হ্রাসের উপযোগী করতে ১৪ থেকে ১৬ বছরের অধিক সময় লাগবে। তবে এই পরিকল্পনার সঙ্গে সুপারি গাছও বিবেচনায় আনা যায় যা দ্রুত বর্ধনশীল ৫০-৬০ ফুট উঁচুতে হয় এবং তাল গাছের প্রতি ৩০ ফুটের মধ্যবর্তী স্থানে রোপণ করা যায় ইত্যাদি।

এই ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুফল পাওয়া গেছে। তবে স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা হিসাবে বজ্রপাতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসাবে এক: দেশের বজ্রপাত প্রবণ এলাকাগুলো শনাক্ত করতে হবে আবহাওয়া জরিপের ভিত্তিতে। বর্তমানে গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা যে সব তথ্য পাই তা থেকে দেখা যায় যে দেশের ১৪টি জেলা বজ্রপাতের ঝুঁকির আওতায় রয়েছে তার মধ্যে সুনামগঞ্জের নাম সর্বাগ্রে রয়েছে। তাই এলাকার মানুষকে এই বার্তাটি দেয়ার দায়িত্ব কার? অবশ্যি সরকারের তবে স্থানীয়ভাবে কর্মরত সামাজিক সংগঠন গুলোর দায়িত্বও কম নয়। যেহেতু মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এই বজ্রপাতের প্রকোপ খুবই বেশি তাই বিভিন্নভাবে প্রচারণা, সতর্কীকরণ, সামাজিক সভা ও মাইকিং করা যেতে পারে।

যে সব বিষয় এতে স্থান পাবে তা হলো বজ্রপাতের সময় পাকা ভবনের নিচে আশ্রয় নেয়া, উঁচু গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে থাকা, বাড়ির জানালা থেকে দূরে থাকা, ধাতব বস্তু স্পর্শ না করা, বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র থেকে দূরে থাকা, গাড়ির ভেতরে না থাকা, পানি থেকে দূরে থাকা, বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে নিচু হয়ে বসা, রাবারের জুতো ব্যবহার করা, বজ্রপাতজনিত আহত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি;

দুই: দেখা গেছে বজ্রপাতের কারণে মহিলাদের তুলনায় কর্মক্ষম পুরুষের মধ্যে মৃত কিংবা আহতের সংখ্যাই বেশি, যা সামাজিকভাবে একটা দুশ্চিন্তার কারণ। এই সব পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করার দয়িত্ব সরকারের এবং এর জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্ধ থাকা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, চাকরির ক্ষেত্রেও এই পরিবারের প্রার্থীদেরও অগ্রধিকার দিতে হবে;

তৃতীয়ত: মাঠে ঘাটে কিংবা জলাধারে মংস্য শিকারের সময় বেশি মানুষ দর্ঘটনায় পতিত হয় বিষেত হাওরের এসব জায়গায মুঠোফোনের টাওয়ার লইটেনিং এরস্টোর লাগিয়ে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানো যায়, যা কোম্পানিগুলো তাদের দায়িত্বের অংশ হিসেবে কাজটি করতে পারে। কারণ গত কয়েক বছরে প্রায় চার হজার নারী পুরুষ বজ্রপাতের কারণে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছে। তাদের বেঁচে থাকার জন্য ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে হবে।

[লেখক : ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি]

শনিবার, ২৯ মে ২০২১ , ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৮ ১৬ শাওয়াল ১৪৪২

বজ্রপাতে বাড়ছে ঝুঁকি

মিহির কুমার রায়

প্রতি বছর এ সময়ে বজ্রপাতসহ বৃষ্টি হওয়া খুবই সাভাবিক ঘটনা। সম্প্রতি বাংলাদেশে এর প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যদিও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিলে। কিন্তু সেখানকার তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার বেশি। গত ১৮ মে ঢাকাসহ সারাদেশে প্রবল ঝর ও বজ্রপাত ১৮ জন লোক মারা গেছে বিশেষত: হাওরবেষ্টিত জেলা নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ আরও এলাকয় যাদের মধ্যে অনেকেই মাঠে ধান কাটা নিয়ে ব্যস্ত ছিল কিন্তু এ বছর বেশ কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষণীয় যাকে অনেকই বলছে জলবায়ু পরিবর্তন ফল এটি। তাহলে পরিবর্তনটা কি?

প্রকৃতিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলছে বিধায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মেঘে মেঘে সংঘর্ষ বজ্রপাতকে ত্বরান্বিত করছে। আবার বিভিন্ন গবেষক বিজ্ঞানীরা বলছেন বজ্রপাত বেড়ে যাওয়া সঙ্গে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি সম্পর্ক রয়েছে, যা প্রামাণিত এবং প্রাকৃতির এক ভয়াবহ পরিণাম যে বজ্রপাতে কয়েক মিলি সেকেন্ডে তাপমাত্রা সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার কাছাকাছি চলে যায়। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে বিগত কয়েক বছরে ঢাকার বাতাসে কার্বনের পরিমাণ ৪% এর বেশি বেড়েছে এবং বাতাসে ধূলিকণার মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ২০০ মাইক্রোগ্রামের মনে করা হলেও এলাকা ভেদে প্রতি ঘনমিটারে ৬৬৫ থেকে ২০০০ পর্যন্ত মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেছে। তাহলে ঢাকা শহরে দেশের সবচাইতে বজ্রপাত প্রবণ এলাকা হওয়ার কথা থাকলেও তা বৈদ্যুতিক তাদের বেরাজালের কারণে বোঝা যায় না সত্যি কিন্তু বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রপাতি যেমন বাল্ব, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, ওবেন, এয়ারকুলার ইত্যাদি মূলধন যন্ত্রপাতির ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। এই ক্ষতি আবার সাধারণ ভোক্তাদের মেরামত খরচ বাড়িয়ে তোলে যা তাদের সাংসারিক বাজেটবহির্ভূত।

বজ্রপাত একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বর্তমানে এর ব্যাপকতা জনজীবনকে ভাবিয়ে তুলছে এবং ক্ষয়ক্ষতি নিযে এখন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ কিংবা ডাটাবেইস সৃষ্টিতে কর্তৃপক্ষ খুবই তৎপর। সরাকারি পর্যায়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন এনজিও গণমাধ্যম কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যে দেখা যায় যে বিগত পাঁচ বছরে সারাদেশে বজ্রপাতে প্রায় তিন হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছে এবং ২০১১ সালে পর থেকে এর প্রবণতা ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলছে যেমন ২০১৫ সালে ৯৯ জন, ২০১৬ সালে ৩৫১ জন ও ২০১৭ সালে ২৬২ আর ২০১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৭ জনের মৃত্যু, ২০২১ সালে মে পর্যন্ত ১৬ জনের মৃত্যু ও চার শতাধিক আহত হওয়ায় খবর রয়েছে, যা গ্রামাঞ্চলে ফসলের মাঠে, পুকুরের পারে ও হাওরে বেশি সংঘটিত হচ্ছে। বজ্রপাতে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, বুয়েট, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমসহ একাধিক তথ্যমতে, বজ্রপাতে ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ২ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। এত বেশি মৃত্যুহারের জন্য মানুষের অসচেতনাকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকগণ। তারা বলেছেন, বজ্রপাত সম্পর্কে দেশের প্রান্তিক ও নিরক্ষর জনসাধারণের সঠিক ধারণা না থাকার দরুন মৃত্যুহার বেশি। ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাতের সময়ও এদেশের লোকজন খোলা মাঠে কাজ করে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের কৃষক ও জেলে সম্প্রদায়।

এর কারণ হিসাবে দেখা দিয়েছে তাল, নারিকেল, সুপারি ও বট বৃক্ষের মতো বড় গাছের অভার, কৃষি যন্ত্রপাতিতে ধাতব দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি, নদনদী শুকিয়ে যাওয়া, জলভূমি ভরাট হওয়া, গাছ পালা ধ্বংসের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাতের হার বাড়ার অন্যতম কারণ। আবার আবহাওয়াবীদরা বলছেন দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আর্দ্র বায়ু এবং উত্তর হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বাতাসের মিলনে বজ্রমেঘ, বজ্রঝর ও বজ্রপাতের সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় গড়ে ৪০টি বজ্রপাত হয়ে থাকে। এই বিষয়টি যেহেতু পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই গবেষণা, গবেষক ও জাতীয় নীতিনির্ধারণীতে তার প্রভাব নিয়ে তেমন কোন খবরাখবর পাওয়া যায় না এই কারণে যে গবেষণা বিষয়টি সবসমই একটি অনগ্রাধিকারের বিষয়, যা জাতীয় পরিকল্পনা কিংবা জাতীয় বাজেটেই হউক। তারপরও সারা পৃথিবীব্যাপী কিংবা বাংলাদেশে কিছুকিছু গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বজ্রপাতের অবস্থান নির্ণয়ের গবেষণায় দেখা যায় যে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে মোট বজ্রপাতের সংখ্যা ১৮০০ ছাড়িছে গেছে প্রতি বর্গকিলোমিটারে।

নাসার জিআইএসএস-এর গবেষক কাল প্রাইস তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন দুটি প্রকৃতিক দুর্যোগ যেমন বজ্রপাত ও দাবানলকে বিশেষভাবে প্রবাভিত করে থাকে এবং পরিবেশে এখন যে পরিমাণ কার্বন আছে তার যদি দ্বিগুণ বৃদ্ধি ঘটে তা হলে বজ্রপাত ঘটবে ৩২ ভাগ। তারমতে বায়ু দূষণের সঙ্গে বজ্রপাতের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। বেশিরভাগ গবেষকই মনে করেন বাসাতে সালফার ও নাইট্রোজেনের যৌগগুলোর পরিমাণ, তাপ শোষণ ও সাময়িক সংরক্ষণকারী গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বজ্রপাত বাড়া কিংবা কমার সম্পর্ক রয়েছে। অস্ট্রেলীয় প্রবাসি বাঙালি গবেষক উল্লেখ করেছেন দেশের উচ্চশীল গাছপালা কিংবা বনায়ন কমে যাওয়ায় বজ্রপাত ঘটনা ত্বরান্বিত হয়েছে।

বাংলাদেশে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সরকার ২০১৬ সালে ১৭ মে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করলেও এর কারণ অনুসন্ধান কিংবা প্রতিকারের কি উপায় হতে পারে সে বিষয় দেশের আবহাওয়াবিধরা বা দুর্যোগ বিজ্ঞানীরা সে সম্পর্কে কোন তথ্য-উপাত্ত দিতে পারছে না। অথচ বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে যাদের পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার পরিমাণ কিংবা গুণগত ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। এছাড়াও আবহাওয়া নিয়ে গবেষণা করার মতো গবেষক কিংবা বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেশে সরকারি পর্যায়ে থেকেও না থাকার মতো এ অবস্থায় রয়েছে। এ ব্যাপারে দু’একজন গবেষকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় জানা যায় একাধারে অত্যাধুনিক গবেষণার স্বল্পতা অপরদিকে অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, যা আবহাওয়া গবেষণার প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আরও উৎকণ্ঠার বিষয় হলোÑবাংলাদেশে মৃত্যুহার বেশি হলেও বজ্রপাত নিয়ে কোন গবেষণা ও তা থেকে মৃত্যুরোধের কোন কার্যক্রম নেই। সীমিত পরিসরে বজ্রপাত সম্পর্কে শুধু পুস্তিকা এবং সেমিনারের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে। সচেতনতার অভাব, বজ্রনিরোধক এবং উল্লেখযোগ্য সরকারি কোন কার্যক্রম না থাকায় প্রতি বছর এতগুলো প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। বজ্রপাতের কারণে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যেহেতু বজ্রপাত প্রতিরোধের কোন উপায় বের হয়নি সেহেতু বজ্রপাতের সময় আমাদের বেশকিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এ নিয়ে অনেক গবেষকের মধ্যে অসন্তুষ্টিও রয়েছে। তারপরও কোন সমস্যা যদি ঘরে এসে উপস্থিত হয় তখন সবই সজাক হয় কি করা যায় এবং বিষয়টি আসলে এত সহজ নয়। আমরা আমাদের জীবন বাঁচানোর তাগিদে এখন কিছুটা নড়ে চড়ে বসেছি এবং প্রবাদ আছে ‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’ তার সঙ্গে আরও একটি যোগ হয়েছে ‘আকাশে বজ্রপাত’ এখন মানুষ যাবে কোথায়। এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় সরকার কি ভাবছে বা কি আয়োজন তা নিয়ে জনমনে কিছুটা আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। এরি মধ্যে দুর্যোগ, এাণ ও পুনর্বাসন ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় বলছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মতে দেশের সবকটি জেলায় তাল বীজ বপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলছে এরই মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ তালবীজ রোপণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

এখন তাল গাছকে বজ্রপাতের উপশম হিসেবে কাজে কেন বাছাই করা হলো তা অনেকেরই মনে প্রশ্ন এবং কৃষিও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. এমএ ফারুক অনেক আগেই বলেছেন তাল গাছ একটি বহুজীবী উদ্ভিদ যার জীবনকাল নব্বই থেকে ১০০ বছর, ভূমি সংরক্ষণের সহায়ক সব জমিতে আইলে জম্মায়, মাটির মূল গভীরে বিধায় ফসল ক্ষতিকারক নয়, কম বৃষ্টিতে অধিক তাপমাত্রায় ও তীব্র বায়ু প্রবাহ সহ্য করতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু বীজ বপনের পর বজ্রপাতের ঝুঁকি হ্রাসের উপযোগী করতে ১৪ থেকে ১৬ বছরের অধিক সময় লাগবে। তবে এই পরিকল্পনার সঙ্গে সুপারি গাছও বিবেচনায় আনা যায় যা দ্রুত বর্ধনশীল ৫০-৬০ ফুট উঁচুতে হয় এবং তাল গাছের প্রতি ৩০ ফুটের মধ্যবর্তী স্থানে রোপণ করা যায় ইত্যাদি।

এই ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুফল পাওয়া গেছে। তবে স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা হিসাবে বজ্রপাতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসাবে এক: দেশের বজ্রপাত প্রবণ এলাকাগুলো শনাক্ত করতে হবে আবহাওয়া জরিপের ভিত্তিতে। বর্তমানে গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা যে সব তথ্য পাই তা থেকে দেখা যায় যে দেশের ১৪টি জেলা বজ্রপাতের ঝুঁকির আওতায় রয়েছে তার মধ্যে সুনামগঞ্জের নাম সর্বাগ্রে রয়েছে। তাই এলাকার মানুষকে এই বার্তাটি দেয়ার দায়িত্ব কার? অবশ্যি সরকারের তবে স্থানীয়ভাবে কর্মরত সামাজিক সংগঠন গুলোর দায়িত্বও কম নয়। যেহেতু মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এই বজ্রপাতের প্রকোপ খুবই বেশি তাই বিভিন্নভাবে প্রচারণা, সতর্কীকরণ, সামাজিক সভা ও মাইকিং করা যেতে পারে।

যে সব বিষয় এতে স্থান পাবে তা হলো বজ্রপাতের সময় পাকা ভবনের নিচে আশ্রয় নেয়া, উঁচু গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে থাকা, বাড়ির জানালা থেকে দূরে থাকা, ধাতব বস্তু স্পর্শ না করা, বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র থেকে দূরে থাকা, গাড়ির ভেতরে না থাকা, পানি থেকে দূরে থাকা, বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে নিচু হয়ে বসা, রাবারের জুতো ব্যবহার করা, বজ্রপাতজনিত আহত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি;

দুই: দেখা গেছে বজ্রপাতের কারণে মহিলাদের তুলনায় কর্মক্ষম পুরুষের মধ্যে মৃত কিংবা আহতের সংখ্যাই বেশি, যা সামাজিকভাবে একটা দুশ্চিন্তার কারণ। এই সব পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করার দয়িত্ব সরকারের এবং এর জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্ধ থাকা প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, চাকরির ক্ষেত্রেও এই পরিবারের প্রার্থীদেরও অগ্রধিকার দিতে হবে;

তৃতীয়ত: মাঠে ঘাটে কিংবা জলাধারে মংস্য শিকারের সময় বেশি মানুষ দর্ঘটনায় পতিত হয় বিষেত হাওরের এসব জায়গায মুঠোফোনের টাওয়ার লইটেনিং এরস্টোর লাগিয়ে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানো যায়, যা কোম্পানিগুলো তাদের দায়িত্বের অংশ হিসেবে কাজটি করতে পারে। কারণ গত কয়েক বছরে প্রায় চার হজার নারী পুরুষ বজ্রপাতের কারণে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছে। তাদের বেঁচে থাকার জন্য ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে হবে।

[লেখক : ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি]